ভাসানবাড়ি – ৯

নবম অধ্যায়

খানিকটা কান্নার পরে নিজেকে জোর করে থামিয়ে নেয় মানুষ। নিজেকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারপর তার মনের বাঁধ ভেঙে যায়, আবার তার চোখ থেকে আরও বেশি ঝাঁপিয়ে জল নেমে আসে। মাঝের এই সময়টুকু তার মনের ভিতরে দ্বন্দ্ব চলে। তার ভিজে নোনতা গাল ফুপিয়ে ওঠে কয়েকবার। এবং ঠিক সেই সময়টায় একটা মানুষকে সব থেকে বেশি প্রয়োজন হয় তার। তারপরে কান্নার দমকের কাছে হার স্বীকার করে নিলে আর সহস্র ডাকাডাকিতেও লাভ হয় না কিছু। আজকের আবহাওয়াতেও সেই মাঝের সময়টুকু চলছে। একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, আরও একপশলা নামা শুধু সময়ের অপেক্ষা। মাঝের এই মিনিট তিরিশেক কেবল আকাশে মেঘ ডাকবে, ভিজে মাটির গন্ধে ভরে থাকবে চারিদিক, আর জল-কাদায় ডুবে থাকা বুনো ঝোপের আড়াল থেকে অলৌকিক পোকামাকড়ের ডাক কানে আসবে।

সেই জলকাদার উপর দিয়ে প্রায় দৌড়ে এগোচ্ছে অশ্বিনী। হৈমন্তী তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। মাঝে থেমে থেমে সে ভাবছে ব্যপারটা সত্যি ঘটছে তো? এর আগে ভারী গভীর আর রাশভারী একটা মানুষ বলে মনে হচ্ছিল তাকে। অথচ এখন তার চোখে, মুখে কৈশোরের চাপা উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে।

—“কী হল? আসুন…” পেছনে ফিরে তাড়া দিল অশ্বিনী।

হৈমন্তী ছোট্ট লাফ দিয়ে একটা জমা জল পেরিয়ে এসে বলল, “আরে পায়ে জুততা নেই তো, কিসে না কিসে পা পড়ে যায়…” এতটা দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছে হৈমন্তী, বড় করে শ্বাস নিতে নিতে বলে, “তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। ভালো কথা, তোমার বয়স কত বলতো? সাতাশ আঠাশ?”

সামনে হাঁটতে থাকে অশ্বিনী, “ওই… কাছাকাছি।”

—“, মেয়েরা বয়স বলতে চায়না শুনেছিলাম, এখন দেখছি ছেলেরাও , মুখের চারদিকে ছড়িয়ে পড়া উসকো-খুসকো চুলগুলো গুছিয়ে বেঁধে নেয়। হৈমন্তী। শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে একটা। সুতির নরম গেঞ্জির ফাঁকে ঢুকে পড়ে সারা শরীরে খেলা করে যাচ্ছে। মুখের চামড়া শুকিয়ে যাচ্ছে বারবার।

চতুর্দিক অন্ধকারে ঢেকে আছে। ঝোপঝাড়ের উপর জোনাকির ঝাঁক জ্বলছে মাঝে-মাঝে। তার ফাঁক দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা এগিয়ে গেছে। অশ্বিনী রাস্তাটা চেনে। তার শালের একটা প্রান্ত চেপে ধরে এগিয়ে চলেছে হৈমন্তী। কিছুদূর হেঁটে এসে থমকে দাঁড়ায় অশ্বিনী। তার শরীরের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে হৈমন্তী দেখে একটা বড় ডোবার সামনে এসে পড়েছে দু’জনে। ডোবার চারদিক ঝোপ আর জলাভূমি। সেই জলাভূমি চতুর্দিকে প্রসারিত হয়ে দিগন্ত ছুঁয়ে ফেলেছে। ঝিলটাকে কেন্দ্র করে একটা হাঁটু সমান উদ্ভিদদের ব্রিগেড মিটিং চলছে যেন।

—“এখানে নিয়ে এলে যে… সাপখোপ থাকতে পারে তো…” হৈমন্তী

বলে।

—“থাকতে পারে কেন? আছে তো। সেই সঙ্গে ভূতও আছে।”

—“ধুর! ওসবে বিশ্বাস করি না। বিষাক্ত সাপে কামড়ালে কী হবে বলতো?”

—“উহু, কামড়াবে না, সেইজন্যেই তো সিংহাসনের ব্যবস্থা।”

—“সিংহাসন! সেটা আবার কোথায়?”

—“ওই যে..” আঙুল তুলে ঝিলের ঠিক মাঝখানটা দেখায় অশ্বিনী। সেদিকে চেয়ে হৈমন্তী দেখতে পায় জলের উপরে একটা আধমিটার ব্যাসের উঁচু ঢিবি জেগে আছে। সম্ভবত কাদামাটি জড় হয়ে শক্ত ঢিবিটা দ্বীপের মতো তৈরি হয়েছে। ঢিবির গা’টা এবড়ো-খেবড়ো হলেও উপরিতলটা মসৃণ। সেটাকেই কি সিংহাসন বলছে অশ্বিনী?

—“ওর উপরে গিয়ে বসব আমরা?” অবিশ্বাসের গলায় বলে হৈমন্তী।

—“আজ্ঞে হ্যাঁ, এত বছর আমি একাই বসে এসেছি। দু’জন বসার জায়গাও হয়ে যাবে, চলে আসুন।”

হৈমন্তীর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করেছে, মাথাটা ঘুরছে অল্প অল্প, একটু পরেই হয়তো আবার জ্ঞান হারাবে সে। এ অবস্থায় বাইরে থাকা বিপদজনক, তাও ভয় করল না হৈমন্তীর। সে মনে জোর এনে বলল, “কিন্তু যাব কী করে? মাঝে তো জল..”। অশ্বিনী কথাটার উত্তর দিল না। একটু দূরে পড়ে থাকা একটা ছোট গাছের গুড়ি কুড়িয়ে নিয়েছে সে। অন্তত দেড়মিটার লম্বা হবে গুড়িটা, সেটা সশব্দে জলের উপরে ছুঁড়ে ফেলল সে। প্রথমে ডুবে গিয়ে তারপর জলের উপরে ভেসে উঠল গুড়িটা। সেটা দেখিয়ে হাসি মুখে অশ্বিনী বলল, “অন্নপূর্ণা উত্তরিলা গাঙ্গিনীর তীরে। পার করো বলিয়া ডাকিলা পাটুনীরে। নিন, উঠে পড়ুন।”

—“নাঃ আগে তুমি।” হৈমন্তীর এবার ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে, সেই সঙ্গে খানিকটা মজাও। অশ্বিনী ঝিলের পাড়ে গিয়ে ছোট লাফ দিয়ে গুড়ির উপরে উঠে পড়ে, তারপর শক্ত লাঠি কুড়িয়ে নেয়।

—“কী যে করো না, পড়ে গেলে কী হবে বলতো?”

—“আপনি নিতাইকাকাকে হাত দেখিয়েছিলেন নাকি?” সাবধানে এগোতে থাকে হৈমন্তী, “কেন?”

—“ভাবলাম হয়তো বলেছেন জলে ফাঁড়া আছে। এখানে জল চারফুটও হবে না, গরম জল করে দেব, স্নান করে নেবেন বাড়ি ফিরে।”

—কথাটা বলে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় অশ্বিনী। সেটা ধরে কোনওরকমে টাল সামলে গুড়ির উপরে উঠে এসে বসে পড়ে হৈমন্তী। ওঁড়িটা একটু দুলে উঠে মোটামুটি শান্ত হয়ে যায়। মৃদু জলস্রোতের ধাক্কায় দুটো শরীর একই ছন্দে দুলতে থাকে। হৈমন্তীর দিকে পিছন ঘুরে বসে হাতের লাঠিটা বৈঠার মতো চালিয়ে ঢিবির দিকে এগিয়ে যায় অশ্বিনী।

—“এখন বুঝতে পারছি কেন এই জায়গাটা ছেড়ে যাওনি তুমি। এখানে তোমার একটা নিজের জগত আছে, চেনা পরিসর আছে, যেমন ধরো গাছের গুড়িটা, ওই ঢিবিটা… ওগুলোর উপর মায়া পড়ে গেছে, তাই না?”

—“হতে পারে…” অশ্বিনীর মুখ দেখা যায় না, “আপনার কোনও কিছুর উপর মায়া পড়েনি?”

হৈমন্তী দুদিকে মাথা নাড়ে, “উঁহু, মায়া খুব বিপদ্দজনক জিনিস, বিশেষ করে আমার জন্য।”

—“আপনার জন্য?”

—“আমার একটা সিক্রেট আছে, যেটা তুমি জানো না।” হৈমন্তীর মনে হয় অশ্বিনী নিঃশব্দে হাসছে।

মুখটা দেখা যাচ্ছে না বলে নিশ্চিত হতে পারে না, নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, তোমার কোনও সিক্রেট নেই? যেটা আমি জানি না…”

—“কীরকম সিক্রেট?”

—“এই যেমন ধরো, তোমার জন্ম, বাবা-মা, কিংবা ছোটবেলার কোনও স্মৃতি, যার কথা কাউকে বললানি তুমি? এমন কী কোনও বন্ধুকেও না।”

—“আমার কোনও বন্ধু ছিল না কোনওদিন।” খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে অশ্বিনী। জলের উপরে তার লাঠির আওয়াজ ভেসে আসে ছলাত-ছলাত্ করে। হাওয়ার জোর বেড়ে উঠেছে এতক্ষণে, দাঁড় বাইতে বাইতে সে বলতে থাকে, “আজ দশ বছর আগে, এই ডোবাটার ঠিক পাশে একটা সাংঘাতিক বড় বটগাছ ছিল, জানেন? দিগন্তছোঁয়া এই মাঠের মাঝে একটা মাত্র ডোবা, তার পাশে একটা মাত্র বটগাছ। লম্বালম্বা ঝুরি ছিল গাছটার। আর এই বড় দৈত্যর মতো চেহারা। রাত হলে আমি এখানে এসে ওর সব থেকে উঁচু ডালে উঠে শুয়ে থাকতাম, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম সারারাত। তখন আমার একটা ইচ্ছা করত, খুব ইচ্ছা করত, কিন্তু সেই ইচ্ছাটার কথা কেউ জানে না।”

—“কী ইচ্ছা করত তোমার?” হৈমন্তীর গলা শুকিয়ে এসেছে।

—“আমার মরে যেতে ইচ্ছা করত তখন।”

—“ওয়াট রাবিশ! তোমার মতো মানুষের এসব কথা মাথায় আনাও

পাপ।”

—“পাপ বলেই তো সিক্রেট, তাই না? অনেকের তো এমন সিক্রেটও থাকে যেগুলো পাপ নয়…” কথাগুলো বলতে-বলতে উঠে দাঁড়ায় অশ্বিনী। গাছের গুড়িটা এসে ঠেকেছে টিবির একপ্রান্তে। লাফ দিয়ে সেটার উপরে এসে পড়ে আবার একটা হাত বাড়িয়ে দেয় সে, “আসুন।” দজনে ডিবিটার উপর এসে বসে পড়ে। টিবিটা বসার জন্য খুব একটা ছোট নয়, কিন্তু কিছুটা সমতলের পরেই ঢাল শুরু হয়েছে। সেখানে বসলে গড়িয়ে পড়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। হৈমন্তী অশ্বিনীর গা ঘেঁষে বসে। তারপর দূরের দিকে চেয়ে থাকে।

দু’চোখ ভরে যাওয়া মাঠ জুড়ে গোটা চারেক হাওয়ার স্রোত খেলা কছে। ভীষণ ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে তারা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে সব কটা ঝোপের মাথা নড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। ঝিঝি ডেকে চলেছে একটানা। তবে মশার উৎপাত নেই এখানে। এমন কি পোকামাকড় অবধি গায়ে এসে বসছে না। আকাশের একপাশে গোল চাঁদ উঠেছে। গোটা আকাশ দেখা যাচ্ছে বলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কিছুটা বড় দেখাচ্ছে তাকে।

—“গাছটার সঙ্গে তোমার ভারী মিল ছিল, বুঝলে।”,

থমথমে গলায় হৈমন্তী বলে, “যেখানে বীজ থেকে অঙ্কুর উঠেছিল সেখানেই রয়ে গেল চিরকাল। পৃথিবীর আর কোনও দৃশ্য দেখল না, অন্য কোনও পাতার স্পর্শ পেল না, মৃত্যু অবধি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।”

অশ্বিনী হাসে, “কিন্তু ওর পায়ের তলায় একটা এক বা মাটি ছিল যে, এতগুলো মানুষকে অক্সিজেন দিয়ে এল যে… এর মধ্যে সুখ নেই নাকি? সবার সুখের কারণ একরকম হয় না হৈমন্তীদেবী…”

মাথাটা ভারী হয়ে আসে হৈমন্তীর। কখন অজান্তেই সেটা অশ্বিনীর কাঁধের

উপরে হেলে পড়ে, তবে স্পর্শ করে না।

বাঁ হাতের একটা আঙুল তুলে পূর্বদিকের একটা কোণ দেখায় অশ্বিনী, ওইখানে তাকিয়ে থাকুন একটানা, একটু পরেই কিছু দেখতে পাবেন।”

—“আমি এইচ.আই.ভি পজিটিভ।”

অশ্বিনী উত্তর দেয় না। হৈমন্তী মুখ তুলে একবার তার মুখের দিকে তাকায়, তারপর ধরা গলায় বলে, “কিছু বললে না যে… এইচআইভি হল এক ধরনের ”

–“মারণরোগ… আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধকারি টি-সেলগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে এইচ.আই.ভি ভাইরাস। শুধু ধ্বংস করে দিচ্ছে তাই নয়, যে পদ্ধতিতে শরীরে টি-সেল তৈরি হয় সেই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়েই নিজের বংশবিস্তার করছে সে। আপনার টি-সেল কাউন্ট এখন একশো আশির কাছাকাছি, মানে অ্যাকটিভ এইচ.আই.ভি। মানে খুব দ্রুত আপনার শরীর পারমানেন্টলি ইমিউনিটি হারাচ্ছে, মানে আপনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।” দিগন্তরেখার থেকে চোখ না সরিয়েই গড়গড় করে কথাগুলো বলে যায় অশ্বিনী।

হৈমন্তীর মাথাটা এবার স্পর্শ করে অশ্বিনীর কাঁধ, প্রশ্ন করতে আর ইচ্ছা করে না তার। বাঁ হাতে ছেলেটার কবজির উপরটা আঁকড়ে ধরে সে। মসৃণ চামড়ার স্পর্শে আরাম লাগে। সাধারণ ছেলেদের চামড়া এমন মখমলের মতো হয় না, একটু আগেই নিবারণ বলেছে অশ্বিনী স্বাভাবিক মানুষ নয়, নাই বা হল, এই মুহূর্তে এই অলৌকিক পরিবেশে যে কোনও মানুষের থেকে তাকে বেশি প্রয়োজন হৈমন্তীর। কোনও অজ্ঞাত কারণে তার স্থির চোখ থেকে জলের ফোঁটা গড়িয়ে নামে, বিড়বিড় করে বলতে থাকে, “আমি এসব কথা কাউকে বলতে পারি না জানো, ট্রিটমেন্ট করালে হয়তো আরও কটা বছর বেশি…”

—“শশশশ..” ঠোঁটের উপরে আঙুল রেখে ইশারায় হৈমন্তীকে চুপ করতে বলে অশ্বিনী, চাপা ফিসফিসে গলায় বলে, “ওই দেখুন, ওরা এসেছে.”

জলটা মুছে নিয়ে মুখ তোলে হৈমন্তী। ওদের থেকে অন্তত কয়েকশো মিটার কারে বিস্তীর্ণ মাঠের ঝোপের উপরে কয়েকটা সাদাটে আলোর বিন্দু ফুটে উঠছে। মাটি থেকে কয়েক মিটার উপরে লাফিয়ে উঠছে আলোগুলো, তারপর আবার ফুরিয়ে গিয়ে নেমে আসছে মাটির বুকে। ঠিক যেন একদল অদৃশ্য জাদুকর মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে এসে আলোর গোলা নিয়ে জাগলিং করছে।

হৈমন্তী হতবাক হয়ে গেছিল, কয়েক সেকেন্ড এক মনে সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থাকতেই বিস্ময় আর উচ্ছাস এক সঙ্গে ফুটে উঠল তার মুখে, “আলেয়া! উইলো দ্য উইম্প!”

—“ব্যস, দিলেন সব মাটি করে।”অশ্বিনী ব্যাজার মুখে বলল, “ভাবলাম আপনাকে একটু ভূতের ভয় দেখাব…”

খুশিতে ঢিবির উপরে উঠে দাঁড়িয়েছে হৈমন্তী, অবাধ খুশির ঢেউ এসে ভরিয়ে দিচ্ছে তার মুখটা।

—“কতদিনের ইচ্ছা ছিল আলেয়া দেখব… শুধু বইতে পড়ে এসেছি, উফফফ… তোমাকে যে কী বলে..”।

—“শুধু ওইটুকুই ইচ্ছা ছিল না আরও কিছু…” শিশুর মতো লাফাতে শুরু করেছে হৈমন্তী, “মা ছোটবেলায় বলতো যে মাঝিরা নৌকাডুবি হয়ে মরে যায় তাদের আত্মাই আলোর মতো দেখা যায় নদীর ধারে, আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করত সামনে থেকে।”

—“তাহলে চলুন, সামনে থেকে দেখবেন।” একটু থমকে যায় হৈমন্তী, “কী করে যাব? জায়গাটা তো জলকাদা, তাছাড়া ঠান্ডা লেগে..”

—“আপনি তত বেশিদিন বাঁচবেন না, শরীরের এত ভয় কীসের?” হৈমন্তী এবার হো-হো করে হেসে ওঠে, “এক্সাক্টলি, যে জিনিস বিক্রি হয়ে গেছে তা নিয়ে আবার দরদাম কীসের? চলো, আজ আলেয়া ধরতে যাব।” অশ্বিনীও উঠে দাঁড়ায়, “আলেয়ার পিছনে ছোটা মানে জানেন তো? এমন

কিছুকে ধাওয়া করা যা সত্যি নয়, এক কথায় মায়া…” আপনি তো মায়া এড়িয়ে চলেন?”

উত্তর দিতে আর দাড়ায় না হৈমন্তী।তার শরীরটা পড়ে যাচ্ছিল ঢাল বেয়ে, অশ্বিনী প্রায় বিদ্যুৎ বেগে দুহাতে ধরে নেয় তাকে। দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়।মাতালের মত খিলখিল করে হেসেওঠে হৈমন্তী।ধরা গলায় ভুল লিরিকে গান গাইতে থাকে। অশ্বিনীর কান বন্ধ করার সুযোগ নেই।দুহাতে ঠিক কেনো একটা তুলোর বস্তা তুলে নিয়েছে সে।

সেইভাবেই জলের উপরে নেমে আসে সে।

—“অশ্বিনী স্বাভাবিক মানুষ নয়— অন্তত কয়েকশো বছর ধরে বেঁচে আছে ও ,নিবারণ কে খুন করতে চায় ও, সুমিতকেও হয়তো ওই খুন করেছে….

কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে হৈমন্তীর কানের কাছে। ছেলেটার মাংসালো হাতের কনুই এর কাছে ওর মাথাটা। ওর মুখের দিকে তাকালে অন্তহীন আকাশের আধখানা দেখা যায়।

বাকিটা ঢাকা পড়েছে অশ্বিনী র নাক, ঠোঁট আর গালে।হৈমন্তীর ঘর লাগে, যেন মৃত্যুহীন দূত এসে ওর অবিনশ্বর আত্মাকে সদ্যোজাত শিশুর মত বয়ে নিয়ে চলেছে মহাকালের দিকে।

ঘোরের মধ্যেই ওর ঠোঁটের কোন থেকে এক অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে, ” কে তুমি?” তারপর চোখ বুজে আসে।

বিলটা পেরিয়ে এসে হৈমন্তী কে নামিয়ে রাখলো অশ্বিনী।মৃদু গলায় প্রশ্ন করল, ” হাঁটতে পারবেন?”

—” পারবো”

হাঁটতে পারলোনা হৈমন্তী।তার মাথার ভেতরে সব গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে। শরীরের ভিতরে সব শক্তি যেনো শুষে নিয়েছে কেউ।চোখ দুটো কিছুতেই খোলা থাকতে চাইছে না।কিছুদূর গিয়ে মাটির উপরে গড়িয়ে পড়লো।মাটিতে বসেই অশ্বিনী র একটা হাত ধরে ফেললো।

সামনের ঘাসের জমিটা দেখিয়ে বললো ,” বস এখানে”

কথা না বাড়িয়ে বসে পরলো অশ্বিনী,তার চোখে মুখে কোনো অভিব্যাক্তি

নেই, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হৈমন্তীর ক্লান্ত মুখের দিকে।

—“আমাকে দিয়ে হবে না, এ জীবনে আর হবে না…”

অশ্বিনী উত্তর দিল না, “পৃথিবীতে আর জন্মাবেন না আপনি। এ জীবনে হলে আর হবে না কোনওদিন।” বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে আবার। অশ্বিনীর মুখের উপর এসে পড়ল কয়েক ফোটা। চাদের আলোয় তরল স্বচ্ছ পারদের মত চকমক করে উঠল তারা। হৈমন্তী একটা হাত দিয়ে মুছিয়ে দিল জলটা, তারপর অবসন্ন গলায় বলল, “আমার শরীর চলতে চায় না আর। গলা অবধি লাল দগদগে দাগে ভরে গেছে। চোখের তলা লাল হয়ে আসছে ইদানীং, ঘুমাতে ঘুমাতে কতবার রক্তবমি করি তুমি জাননা না…।”

—“আমি জানি।”

—“কিছু জানো না, জানলে এভাবে কাছে আসতে না। আমার রক্ত বিষাক্ত, শরীরের সমস্ত তরল বিষাক্ত।”

হাত বাড়িয়ে হৈমন্তীর চোখের তলা থেকে নোনতা জলের কয়েকটা ফোটা মুছে দেয় অশ্বিনী, “এই তরলটা বিষাক্ত নয়। যাক গে, চলুন।”

—“কোথায়?”

—“আলেয়া দেখতে যাবেন না?”

তীব্র মাথা নাড়ায় হৈমন্তী, “বললাম তো, আমি পারব না। আমার শরীরে হাঁটার শক্তি নেই।”

কাঁধ ধরে হৈমন্তীকে দাঁড় করিয়ে দেয় অশ্বিনী। তারপর অবলীলায় তার প্রায় স্পন্দনহীন দেহটাকে পিঠে চাপিয়ে নেয়। দুটো হাত বুকের কাছে ঝুলতে থাকে। দু পা দিয়ে কোমর আঁকড়ে ধরে।

জোরে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে এতক্ষণে। তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে থাকে অশ্বিনী। হৈমন্তী দুবলা হলেও একটা মানুষের ওজন কাঁধে নিয়েও অশ্বিনীর পা এতটুকু কাঁপছে না। যেন চাইলে এমন আরও দশটা মানুষকে নিয়ে নির্দ্বিধায় হেঁটে যেতে পারে সে। বৃষ্টিতে ওদের দুজনের সমস্ত শরীর

ভিজে ওঠে। হৈমন্তীর আধখোলা অসুস্থ চোখে চারপাশের দৃশ্য ভ্যান গগের ছবির মতো বিমূর্ত হয়ে ওঠে যেন।

মুশলধারে বৃষ্টি নেমেছে এখন। আর ‘আলেয়া ফুটবে না। জলার উপরে একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে অশ্বিনী। একটু আগে এখানেই জ্বলছিল আলেয়া। এখন পোড়া পাতার ছাই ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে কিছুটা মিলিয়ে আসা আগুনের গন্ধ।

ফাঁকা জায়গাটার উপরে শুয়ে পড়ে হৈমন্তী। অশ্বিনীও হয়তো হাঁপিয়ে গেছে এতদূর এসে। সেও পাশে শুয়ে পড়ে। দুজনে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ঘন মেঘে ঢেকে যাওয়া মৃত তারাগুলোর শবদেহের দিকে। কেউ কোনও কথা বলে না। শুধু হৈমন্তীর অসুস্থ, তাল কেটে যাওয়া নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। একটানা।

—“আমার একটা ইচ্ছা আছে, জানো?”

—“কী?” আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞেস করে অশ্বিনী।

—“ইউজিন শুমেকারের নাম শুনেছ?”

—“না, কে ছিলেন?”

—“মহাকাশবিজ্ঞানী। ভারী জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। প্রায় সবকটা এপেলো অভিযানের নেপথ্য কারিগর…” হাঁফ ধরা গলায় বলতে থাকে হৈমন্তী, “চাঁদে পা রাখার ভারী শখ ছিল ভদ্রলোকের। যাওয়া একরকম নিশ্চিতও ছিল, কিন্তু এডিসন ডিজিজ নামে একটা রোগ হয় শুমেকারের, ফলে তার মহাকাশে যাওয়া আর হয়ে ওঠে না..”

—“তারপর?” এবার অশ্বিনীর মুখের দিকে তাকায় হৈমন্তী, “তারপর একদিন গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ভদ্রলোক। ঘটনাচক্রে তার পরদিনই নাসার লুনার প্রস্পেক্টার স্পেসক্রাফটের চাঁদে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল। সেই স্পেসক্রাফটের সঙ্গে শুমেকারের খানিকটা শরীর পোড় ছাই চাঁদে পাঠায় নাসা। চাঁদের বুকেই সমাহিত হন তিনি। তিনিই একমাত্র মানুষ যার দেহকণা মিশে আছে চাঁদের

মাটিতে… আমিও তাই চাই।”

শেষ কথাটা শুনে একটু অবাক হয় অশ্বিনী, “আপনি চান আপনাকেও চাঁদের মাটিতে কবর দেওয়া হোক?”।

—“উহু.” আকাশের বুক জুড়ে ফুটে থাকা রুপোলি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে হৈমন্তী, “চাঁদে নয়, গোটা আকাশ জুড়ে… ধুলো হয়ে থাকতে চাই আমি..”

হৈমন্তীর বাকি কথাগুলো মিলিয়ে আসে, মনে হয় একটা কবিতা বলার চেষ্টা করছে সে, অশ্বিনীর কানে আসে শব্দগুলো –

And, when he shall die Take him

and cut him out in little stars

And he will make the face of heaven so fine

That all the world will be in love with night

And pay no worship to the garish sun.

রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে ক্রমশ। হৈমন্তীর ঘুম পায়। শীতের রাতে, খোলা আকাশের নিচে, ভেজা মাটিতে পিঠ রেখে, অশ্বিনীর শরীরের স্পর্শে ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সে।

একবার অজান্তেই চোখ খুলে যায় তার, মনে হয় রক্তে ভিজে গেছে মুখের পাশের ঘাসগুলো। পাশে তাকিয়ে দেখে অশ্বিনী কোথাও নেই। মাঠ জুড়ে কেবল একটা দুরন্ত হাওয়া খেলা করছে।

—“অশ্বিনী, কোথায় তুমি?” অসহায় কষ্ঠে চাপা চিৎকার করে ওঠে সে।

—“আমি আছি, আপনি ঘুমান।” গম্ভীর আওয়াজটা ঠিক কোথা থেকে আসছে হৈমন্তী বুঝতে পারে না। তবে গলাটা চেনা লাগে তার। নিশ্চিন্তে আবার ঘুমিয়ে পড়ে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *