ভাসানবাড়ি – ৮

অষ্টম অধ্যায়

সারারাত ঘুম হয়নি হৈমন্তীর। ঘরের ভিতরে একটা অদৃশ্য চেলো যেন একই লয়ে বেজে চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। প্রথম প্রথম মনটাকে ভাবিয়ে তুলেছিল সেটা, নানারকম সম্ভাবনার কথা অঙ্কের মতো কষে নিয়ে আবার মুছে ফেলছিল বারবার। উত্তর মিলছিল না কিছুতেই। এখন সেই সুরটা ঘ্যানঘ্যানে লাগতে শুরু করেছ। ছবিটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে হৈমন্তী। বারবার আলো জ্বেলে খুঁটিয়ে দেখেছে ছবিটা। অবিকল যেন অশ্বিনী দাঁড়িয়ে আছে ছবির একদিকের ধারে। কোনও পার্থক্য নেই। পিঠের উপরে একইভাবে ফেলা আছে শালটা। নিয়ম মেনে মাথার চুলগুলোও আঁচড়ান। তবে কি অবিকল অশ্বিনীর মতো দেখতে কেউ কখনও এ-বাড়িতে থাকত?

তাছাড়া আর কিই বা হতে পারে? ছবিতে যে মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে আজ তার বয়স অন্তত দেড়শো হবার কথা। অর্থাৎ তার পক্ষে বেঁচে থাকা কোনওভাবেই সম্ভব নয়।

হৈমন্তী একবার ভাবল গোটা ব্যাপারটা অশ্বিনীকে জানানো দরকার, কিন্তু ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে সেটা ঠিক হবে না।

ছবিটা নিবারণবাবুর বিছানার নিচে পড়েছিল। অর্থাৎ উধাও হবার আগে সেই ছবিটাই দেখছিলেন তিনি। ছবির ছেলেটার ব্যাপারেই নিশ্চয়ই কিছু জানতেন। সে জন্যেই অস্মিতাকে চিঠি লিখে সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। কোনও কি বিপদের আশঙ্কা করেছিলেন? অশ্বিনী? কিন্তু তার মধ্যে বিপদজনক কিছু তো লক্ষ করেনি হৈমন্তী…

আজ করেছে। আজ একটু আগে। তার শান্ত চোখ দুটোতে একটা হিংস্র নেকড়ের ক্রোধ লুকিয়েছিল।

বিছানা থেকে উঠে পড়ে হৈমন্তী। সিগারেট ধরায়। মাথার ভিতরটা ভনভন করছে। খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাইরে ঘন অন্ধকারে ঢাকা গ্রাম আর মিহি কুয়াশা মাখা গাছপালার সার থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। হৈমন্তীর চোখ নেমে এল মাটির দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সাদাটে কিছু একটা জিনিসের উপরে চোখ আটকে গেল। মানুষের দেহ! মাঝারি মাপের বাবলা গাছের নিচে পড়ে আছেন একটা মানুষ। কে হতে পারে? নিবারণ ? সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছে সে। হৈমন্তী ঠিক করে নিল যেভাবেই হোক বাইরে বেরিয়ে লোকটার কাছে পৌছাতে হবে। কিন্তু কী করে? সন্ধে পার হলেই বাইরের দরজায় তালা দিয়ে দেয় অশ্বিনী।

বেশি ভাবনা চিন্তার অবকাশ না নিয়ে হৈমন্তী নিচে নেমে আসে। যেভাবেই হোক চাবি খুলে বাইরে আসতে হবে। চাবিটা ঝোলানো থাকে অশ্বিনীর ঘরের দেওয়ালের হুকে। পা টিপে টিপে সেখানে পৌঁছে হৈমন্তী দেখে রোজকার। মতোই চেয়ারে বসে আয়নার দিকে চেয়ে ধ্যানমগ্ন হয়েছে অশ্বিনী। ইচ্ছা করেই পায়ে শব্দ করে সে। অশ্বিনীর ধ্যান ভঙ্গ হয় না।

দ্রুত পায়ে এগিয়ে দেওয়াল থেকে চাবিটা টেনে নেয় সে। আয়নার উপরে তার ছায়া সরে যায়, অশ্বিনীর স্থির শরীরে কোনও হেরফের আসে না। সে একটানা তাকিয়ে আছে নিজের দিকে। বাইরের দরজাটা খুলে প্রায় ছুটে বাগানটা পেরিয়ে বাড়ির পিছন দিকটায় এসে দাঁড়ায় হৈমন্তী। এদিকটা কাঁটাঝোপে ভর্তি। সেটা পেরিয়ে বাবলা গাছের কাছে পৌছাতে শরীরের কয়েক জায়গায় ছড়ে যায় তার। উত্তেজনা আর চেরা দাগগুলো অস্থির করে তোলে তাকে।

নিবারণের শরীরটা এখনও আগের মতোই পড়ে আছে। মাঝে মাঝে হাত দুটো কেঁপে উঠছে একটু। সে বেঁচে আছে। গোটা শরীর কাদামাখা, ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগ। টর্চ জ্বালিয়ে কাছে এগিয়ে এল হৈমন্তী।।

লোকটার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে তার গায়ে ঠেলা দিল, “শুনছেন, প্লিজ চোখ খুলুন..” অসহায় লাগল হৈমন্তীর, “দাদা, শুনছেন?”

লোকটার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল একবার। চোখ দুটো আধখোলা হল, একটা হাত উঠে এল হৈমন্তীর দিকে, ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে মানুষটার, কোমরে ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল সে।

—“আপনি নিবারণবাবু?”

অস্পষ্ট গলায় কিছু বলল লোকটা। বোঝা গেল না। হৈমন্তী তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, “আমার নাম হৈমন্তী ঘোষ। ভাসানবাড়িতে এসে রয়েছি আমি…”

—“ভাসান… বাড়ি…” অসুস্থতার মধ্যেও লোকটার মুখে একটা লালচে চেতনার রেশ লাগল, “আমি নিবারণ… ও বাড়ির…”

—“জানি। আজ রাতে আপনার বাড়ি গেছিলাম। আপনি ছিলেন না। কী হয়েছে আপনার?” এতক্ষণে সোজা হয়ে উঠে বসেছে নিবারণ, বৃদ্ধ মুখের মৃত বলিরেখাতে লালচে রঙ খরস্রোতা হয়েছে। প্রায় হুমড়ি খেয়ে হৈমন্তীর দুটো কাঁধ খামচে ধরেন তিনি, “পালিয়ে যাও, ও বাড়ি থেকে পালিয়ে যাও, যেখানে পারো লুকিয়ে পড়।”

—“কেন? কী আছে ওখানে?” হৈমন্তী উতলা হয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না নিবারণ। মাথাটা চারপাশে ঘুরিয়ে কিছু দেখে নেয়, কিছুর একটা আশঙ্কা জাগছে, মৃত্যুভয় খেলা করছে তার মনের ভিতরে।

—“বলুন কী আছে ওখানে?”

—“মৃত্যু, বিসর্জন, একবার ওই বাড়ির উপর মায়া পড়ে গেলে আর ফিরতে পারবে না কোনওদিন, ওই বাড়ি শুষে নেবে তোমাকে..” থেমে থেমে কথাগুলো শেষ করল নিবারণ।

—“অশ্বিনীরও কি তাই হয়েছে?”

এবার সতর্ক চোখ তুলে তাকায় নিবারণ, “কে? অশ্বিনী?”

—“আপনার ছেলে।” অবাক গলায় বলে হৈমন্তী।

—“আমার কোনও ছেলে নেই… আমার ছেলে সাত বছর বয়সে টাইফয়েডে মারা গেছে…”

একটা ঠান্ডা স্রোত হৈমন্তীর হৃদপিণ্ড ভেদ করে চলে যায়। শরীর কিছুটা পিছিয়ে আসে তার। মাথার ভিতরে ধুলোবালির ঝড় শুরু হয়েছে, নিজেকে স্থির রাখতে পারছে না কিছুতেই।

—“ও কে তাহলে?” প্রায় চিৎকার করে প্রশ্ন করে হৈমন্তী। নিবারণ দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে, কান্নার দমক এসে বৃদ্ধের বুক কাঁপিয়ে দেয়।

—“আমি জানি না, কিন্তু আমাকে ও বাঁচতে দেবে না, মেরে ফেলবে। আমি কোনওরকমে পালিয়ে..”

—“কেউ মারতে পারবে না আপনাকে।” একটা হাত ধরে নিবারণকে দাঁড় করিয়ে দেয় হৈমন্তী। কসরত করে উঠে দাঁড়ায় নিবারণ। হৈমন্তী একটা হাত কাঁধে তুলে নিয়ে বলে, “আপনি আমার সঙ্গে আসুন।”

—“কোথায়?” —“ভাসানবাড়িতে।”

—“না, ওখানে না।” ছিটকে সরে যেতে চায় নিবারণ। হৈমন্তী শক্ত হাতে ধরে রাখে, “বললাম তো ভয়ের কিছু নেই, আমি থাকতে কেউ ক্ষতি করবে না

আপনার। আসুন আমার সঙ্গে।” – হৈমন্তীর গলার ভিতরের জোর কিছুটা সঞ্চারিত হয় নিবারণের মধ্যে, দুজনে এগিয়ে গিয়ে বাড়িটার সামনে চলে আসে।

নিবারণ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী করছে ও এখন?”

—“নিজের ঘরে, আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে।”

ঢোক গেলে নিবারণ, “যতক্ষণ ওভাবে থাকে ততক্ষণ কোনওদিকে হুশ থাকে না।”

—“কিন্তু করে কী ওইভাবে?”

নিবারণ দুদিকে মাথা নেড়ে দেয়।

হৈমন্তী ঠোট কামড়ে বলে, “বেশ, এখন কিছু বলতে হবে না আপনাকে। আপাতত আমার ঘরে চলুন। একটু সুস্থ হয়ে নিয়ে সব খুলে বলবেন আমাকে।”

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অশ্বিনীর ঘরে আর একবার উঁকি দিয়ে দেখে হৈমন্তী। এখনও একইভাবে বসে আয়নার দিকে চেয়ে আছে ছেলেটা। কোনওদিকে হেলদোল নেই।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিবারণের শরীরটা একটু চাঙ্গা হয়ে ওঠে। হৈমন্তী তার ঠোঁটের পাশের কাটাটার উপরে এন্টীসেপ্টীক লাগিয়ে দেয়। দরজায় লাগানো হুড়কোটা কয়েকবার মন দিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয় নিবারণ। তারপর ফিরে এসে বিছানার পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে পড়ে।

হৈমন্তী তার সামনে পা মুড়ে বসে জিজ্ঞেস করে, “এবার বলুন তো, এই অশ্বিনী বলে ছেলেটা। যদি আপনার ছেলে না হয়, তাহলে কে?”

ঘাড় নাড়ে নিবারণ, “আমি জানি না ম্যাডাম, বড়কার সঙ্গে যখন এই বাড়িতে থাকতাম তখন থেকেই বুঝেছিলাম এই বাড়িটা একটু অদ্ভুত। এখানে কোথাও একটা কিছু ভারী গোলমাল হয়ে আছে। বেশিদিন থাকলে কেমন একটা মোহ জন্মায়। শ্যাওলার মতো, জানলার গ্রিলে ধরা জং এর মতে, এ বাড়ি ছেড়ে আর যেতে ইচ্ছা করে না, সংসারের আর কোনওকিছুর দিকে খেয়াল থাকে না।”

হৈমন্তী বুঝল নিবারণ নিজের মতো কথা বলে চলেছে। প্রশ্নের উত্তর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে আবার ফিরিয়ে আনে,“অশ্বিনীকে কবে থেকে চেনেন। আপনি?”

—“প্রায় চল্লিশ বছর হতে চলল। এই ক’বছরে ওকে একটুও বড় হতে দেখিনি, জানি না কেন যতবারই এ বাড়িতে ও এসেছে ওর বয়স সেই একই রয়ে গেছে। ও সত্যিকারের মানুষ নয় দিদিমণি, ওর মধ্যে অন্য কিছু আছে।”

হৈমন্তীর কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে। নিবারণকে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে হয় না। সে নিজে থেকেই বলে চলেছে। অতীতের কোনও প্রাচীন গহ্বরে হারিয়ে গেছে তার চোখ, “বড়কত্তা বলেছিলেন এ বাড়িতে এমন অনেক কিছু ঘটে যা বাইরের মানুষকে জানাতে নেই। বাড়ির ভিতরের ছবি রাস্তার লোকেদের আড়াল করতে যেমন পর্দা লাগানো হয়, তেমন ভাসান বাড়িতে অনেক কিছু আড়াল করতে হবে । আমি অবশ্য কথাটার মানে তখনো বুঝিনি।

দুটো বছর ভালো লাগতো এখানে থাকতে, লোকজনের হইহল্লা নেই, চিৎকার নেই নিজের মত থাকা আর বাড়ির দেখাশোনা করা। আমার যখন কুড়ি বয়সের বয়স তখন একদিন ওকে দেখতে পাই আমি। সেদিনও এমন ঝড় জলের রাত ছিল। ঘনঘন বাজ পড়ছিল।

মনে হচ্ছিল এই বুঝি বাড়িটা ভেঙে পড়ে যাবে।হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগছিল দরজায়।মনে হচ্ছিল বাইরে থেকে কেউ যেন এসে দরজায় টোকা দিচ্ছে। আমি তখন রান্না করছিলাম, ওতটা কান দিইনি , এমন সময় মনে হল সত্যিই টোকা পড়ছে। তাড়াহুড়ো করে উঠে দরজা খুলে দেখি একটা বছর সাতাশ এর ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করতে জানালোবাইরে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ঝড় জলে আটকে গেছিলো, রাতটুকু এ বাড়িতে কাটিয়ে সকালে চলে যাবে। ছেলেটার সাথে কথা বলে আমার ভালোই লেগেছিলো,তাছাড়া এ বাড়িতে চুরি চামারি হওয়ার মত কিছুই তো ছিল না। আমি ওকে এক রাতের জন্য একতলার ঘরে মাটিতে বিছানা পেতে থাকতে দিয়েছিলাম।

মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে। ছেলেটা এখনো আছে নাকি দরজা খুলে চলে গেছে দেখতে ঘরে গিয়ে দেখি সে ঘুমায় নি।

ঘরের ঠিক মাঝখানে বড় আয়নাটার দিকে মুখ করে বাবু হয়ে বসে

আছে। সকালে উঠে দেখি সে গায়েব ।ঘর ফাঁকা। সেই প্রথম দেখেছিলাম ওকে। তখনও জানতাম না ও আবার ফিরে আসবে.”

বাইরে বৃষ্টির ধারা আরও বেড়ে উঠেছে। নিবারণের সঙ্গে দ্রুতগামী সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঝরে পড়ছে যেন তারা। তারাও এ ঘটনার সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

—“এই ঘটনার আগে কোনোদিন দেখেননি ওকে?”

নিবারণ দুদিকে ঘাড় নাড়ে ” না, দেখে থাকলেও মুখ মনে ছিল না।”আমি গ্রামের মানুষের সাথে খুব একটা মিশিনি কোনোদিন। নিজের মতো করে এখানে পড়ে থাকতাম।

—” এরপর কবে দেখেছিলেন ওকে?”

—” এর আটবছর পরে। ততদিনে ওর মুখটা ভুলে গেছি ,আবছা মনে ছিল হয়েতো।

একদিন বাজার করে ফিরে দেখি বাগানের বাইরে দাড়িয়ে একমনে ফুল গুনছে। আমি কি চাই জিজ্ঞেস করতে বলল এবাড়িতে সে কদিন থাকতে চায়। তাকাপইসাও দিতে রাজি আছে।

বাবুদের চিঠি না পেলে এবাড়িতে আমি কাউকেও থাকতে দিই না।প্রথমে সে কথাই বলেছিলাম,তারপর ও আমাকে অবাক করে দিয়ে এবাড়ির সব কথা শোনাতে লাগলো আমাকে। বড়কত্তার কথা ,তার বাপের কথা,এমনকি আমার ছোটবেলার নারিনোক্ষত্র ও বলে দিলো।

এসব কথা কারোর জানার কথা নয়।পুরনো কথা বলে কিকরে জানি আমার মনটা নরম করে দিল ও। টাকাপইসা ছাড়া আমি ওকে থাকতে দিলাম। তবে গতরে খেটে দিত।ভারী অদ্ভুত ছেলে , ঘুমায়না, গায়ে জোরের অভাব নেই,এতটুকু ফাঁকি দেয়না কোনো কাজে, খাবার দাবারের লোভ নেই… তবে…

পরের কথাগুলো বলতে গিয়ে থেমে যায় নিবারণ, ঘরের দরজার দিকে তাকায় নিবারণ, কান পেতেকনও আওয়াজ আসছে কিনা শোনার চেষ্টা করে,

মুখের উপর এবার হাত চালিয়ে নিয়ে বলে,“একটা বুনো স্বভাব আছে ওর , আমার বা এই বাড়ির কোনও ক্ষতি করতে এলে ওর ভিতর সেই বুনো জন্তুটা জেগে উঠত। মনে আছে একবার গ্রামের কিছু ডেপো ছেলে আমার ঘরের জানলা দিয়ে একটা সাপ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। অশ্বিনী কীকরে জানি খুঁজে পেয়ে সেটাকে ধরে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল, তবে সেই ছেলেগুলোকে দুদিন পরে জঙ্গলের একটা গাছের সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়। মাঝরাতে ঘুমের ঘোরে কেউ তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে বেঁধে এসেছিল গাছের সঙ্গে। অন্ধকারে ছেলেগুলো কিছু দেখতে পায়নি তবে আমি জানি কাজটা অশ্বিনীর।

দুদিন ধরে অস্থির দেখাচ্ছিল ওকে। ওই ঘটনার পরে ওর চোখ থেকে আগুন নিভে যায়।”

হৈমন্তী গালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু ও যে আপনার ছেলে সে গ্রামে রটাল কে? ও নিজেই?”

—“না, আমি। বাবুরা মাঝে-মধ্যে কলকাতা থেকে আসেন। তাদেরকে কী উত্তর দেব? বাইরের লোককে বাড়িতে এনে রেখেছি?”

—“ওর যে এই চল্লিশ বছরে বয়স বাড়েনি সেটা আপনি ছাড়া আর কে জানে এখানে?”

—“নিতাই জানে। এ বাড়িতে অদ্ভুত কিছু যে ঘটে সেটা আমি ছাড়া ওই কেবল জানে কিছুটা।”

জানলার কাছটায় গিয়ে দাঁড়াল হৈমন্তী। মাথার ভিতরে দমকা একটা বাতাস আটকে আছে। কোথাও কিছু তাল কেটে যাচ্ছে গল্পটা। চল্লিশ বছর বয়স বাড়েনি অশ্বিনীর? এমনটাও সম্ভব?

টেবিলের উপর রাখা ছবিটা চোখে পড়ল তার। ছবিটা যদি সত্যি হয়। তাহলে চল্লিশ কেন? অন্তত শখানেক বছর ধরে একইরকম আছে অশ্বিনী।

সেদিন আকাশের তারাগুলো দেখে চকচক করছিল তার চোখ, অশ্বিনীর সঙ্গে কি কোন মিল আছে তারাগুলোর? সেও কি নিশ্চল সময়ের বুকে শুয়ে থাকা কোনও কালপুরুষ?

—“কিন্তু আপনি এখন ওকে ভয় পাচ্ছেন কেন?” হৈমন্তী প্রশ্ন করে।

নিবারণ ভিরু দৃষ্টিতে ঘুরে তাকায়, “ও আমাকে মেরে ফেলতে চায়। আমাকে হাতের সামনে পেলেই..”

—“কিন্তু কেন?” বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় নিবারণ, “আমাকে নাকি এ বাড়ির আর প্রয়োজন নেই। সেই জন্যেই আমাকে সরিয়ে দিতে চায়।”

টেবিলের উপরে একটা ঘুষি মারে হৈমন্তী, “মানে কী এসব কথার? বাড়ির কাউকে প্রয়োজন থাকে কী করে? তাছাড়া প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেই একটা

মানুষকে মেরে ফেলতে হবে?”

কথাগুলো বলে কী একটা ভেবে থমকে যায় হৈমন্তী, গলার স্বর নিচে নেমে আসে, “চল্লিশ বছর আগে ওকে প্রথম দেখেছিলেন, তাই না? তার আটবছর পরে আবার ফিরে আসে। মানে আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে। মানে নাইনটিন এইটটি এইট?”

—“হ্যাঁ, তাই হবে।”

—“ডেটটা মনে আছে?”

নিবারণকে ভাবুক দেখমনে করার চেষ্টা করে, “তা মনে নেই, তবে বাগানের যে ফুলটা ও দেখছিল সেটা সোড্রন্স। ওই ফুল বিদেশ থেকে এনে লাগিয়েছিলেন বড়কর্তা। শুধু নভেম্বর মাসে ফুটত।”

—“আর ডেট?”

নিবারণের সামনে নিরেট দেওয়াল, “একেবারে মনে নেই। তবে… সেদিন রাতে রান্নাটা অশ্বিনীই করে দিয়েছিল। যতদূর মনে পড়ছে আমার হাঁটুর গাঁটে ব্যথা হচ্ছিল সেদিন… মানে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা…” হৈমন্তী হাসে, “অমাবস্যা পূর্ণিমার সঙ্গে ব্যথার কোনও সম্পর্ক নেই। মিথটা আছে বলে আমাদের মনে হয় যে ব্যথা হচ্ছে এক ধরনের মনোরোগ এটা। নান দা লেস, পূর্ণিমা বা অমাবস্যা ছিল সেদিন..” ।

একটু থেমে পরের কথাগুলো বলে হৈমন্তী, “যদি অমাবস্যা হয় তাহলে অসুবিধা নেই, কিন্তু পূর্ণিমা হলে…”

—“পূর্ণিমা হলে কী?”

—“তাহলে ডেটটা হবে তেইশে নভেম্বর ১৯৮৮…”

—“সে কি! মনে আছে আপনার? এতদিন আগের…”

—“আছে মনে… কারণ তেইশে নভেম্বর ১৯৮৮ আমার জন্মদিন. সেদিন সকালেই অশ্বিনী ফিরে এসেছিল এ বাড়িতে..”

নিবারণ ছিটকে সরে যায় দূরে। তার একটা কারণ আছে অবশ্য।

দরজায় টোকা পড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাইরে থেকে একটা গলা ভেসে এসেছে, “আমি অশ্বিনী, দরজাটা খুলবেন একটু?”

চোখের ইশারায় নিবারণকে লুকিয়ে পড়তে বলে হৈমন্তী। তারপর মুখ থেকে দুশ্চিন্তার রেখাগুলো মুছে ফেলে দরজা খুলে দেয়।

অশ্বিনী উদ্বিগ্ন মুখে। তাকিয়ে আছে হৈমন্তীর দিকে, ধীরে ধীরে সে প্রশ্ন করে, “বাইরের দরজাটা দেখি খোলা? আপনি বাইরে গেছিলেন?” দুদিকে ঘাড় নাড়ে হৈমন্তী, “উহু.. নাতো…”

—“এমনি এমনি খুলে গেল? নাকি আমি নিজেই..” বিড়বিড় করে অশ্বিনী, তারপর আবার স্বাভাবিক গলায় বলে, “জানেন, আপনার ঘর থেকে কথা বলার আওয়াজ আসছিল মনে হল…”

হৈমন্তী ‘ফোনে কথা বলছিলাম’ বলতে যাচ্ছিল, ঘটনাটা মনে পড়তে সামলে নিয়ে বলল, “তাহলে ঘুমের ঘোরে কথা বলছিলাম হয়ত।”

—“আপনি ঘুমের ঘোরে কথা বলেন?” উপরে নিচে মাথা দোলায় হৈমন্তী। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দেয়।

—“কই আগে তো দেখিনি?”

—“তুমি রোজ ঘুমাতে দেখো আমায়?”

লাজুক হাসি হাসে অশ্বিনী। তারপর মুখটা নিচে নামিয়ে এনে বলে, “শুনুন না, মাঝরাতে দরজাটা যখন খুলেই গেছে তখন সেটা দিয়ে একটু বাইরে ঘুরে আসা যায়, কী বলুন?”

—“বাইরে! এত রাতে? কেন?” অশ্বিনীর ডানদিকের ভুরুটা কিছুটা উপরে উঠে যায়, রহস্যময় গলায় সে বলে, “ভূত দেখবেন?”

—“ভূত! এখন… আচ্ছা আমি জামাটা ছেড়ে নিয়ে…” হৈমন্তীর ডানহাতটা ধরে একটা টান দেয় অশ্বিনী, “কিচ্ছু ছাড়তে হবে না, ভূত, ভগবান আর সময় কারো জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *