সপ্তম অধ্যায়
—“নিতে ও নিতে” বটতলার কাছে এসে ডাক দেয় নিবারণ। নিতাইচরণ সাড়া দেয় না। দিঘির পাড় ঘেঁষে সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে যেন, অথচ এখন বিকেলও হয়নি। আজ কৌশিকি অমাবস্যা, তায় সূর্যগ্রহণ লেগেছে। নিতাইয়ের বাড়ির লোক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ফলে বাড়িতে বসে সূর্যগ্রহণ দেখায় বাধা আছে। লুকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিবারণের বাড়ির সামনে গাছতলার অন্ধকারে গা ডুবিয়ে সূর্য দেখছে সে।
অবাক হয়ে আকাশের বুকে চোখ রেখেছিল সে – ওই একটা অন্ধকার ছায়া এসে ঢেকে ফেলল সূর্যটা। এমন কিছু কি আছে তাহলে, যে সমস্ত সূর্যটাকেও ঢেকে ফেলতে পারে?
এমন সময়ে নিবারণের ডাক কানে আসে তার, “আরে এই নিতে, তোরে বড়বাড়ির কবরেজ ডাকে, চ…”
বড়বাড়ির করবেজ মানে শশাঙ্কমোহন। লোকটাকে ভালোই লাগে নিতাইয়ের। কিন্তু এখন সূর্যগ্রহণ ছেড়ে একটুও যেতে ইচ্ছা করে না তার। মুখ না ঘুরিয়ে বলে, “বইলা দে এখন নিতে যাবা না, গরহন লাগতাসে…”
প্রশ্নের উত্তর মজুত ছিল নিবারণের, “কবরেজ বলেছে দূরবীন দিয়ে দেখাবে, আরও ভালো দেখতে পাবি।”
রাজি হতে আর দেরি হয় না নিতাইয়ের। চট করে নিবারণের ভাঙ্গা সাইকেলে উঠে পরে সে। ঘটঘট শব্দ করে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে গড়াতে থাকে সাইকেল। মিনিট দশেক পর ভাসানবাড়ির দালানে পৌছে থামে, আকাশ তখনও আরও খানিকটা অন্ধকার হয়েছে।
বৃদ্ধ শশাঙ্কমোহনের পাখির শখ। গোটা ভাসানবাড়িতে রঙবেরঙের পাখিদের আনাগোনা। তাদের যত্ন নেন তিনি। খেতে দেন, জলের বাটি রেখে আসেন ছাদে। বিয়ে-থা করেননি। পাখিদের নিয়ে সংসার।
তবে এদের মধ্যে কেউই খাঁচায় থাকে না। রোদ মেখে এসে বসে জানলায়, ছাদের কার্নিশে, কিচিরমিচির শব্দে বৃদ্ধের খবর নেয়, তারপর উড়ে যায় ইচ্ছা মতো। দুজনকে সিড়ি দিয়ে উঠতে দেখেই শশাঙ্কমোহনের মুখ হাসিতে ভরে ওঠে, “এসো, এসো কত্তা, ওই জানলায় দাঁড়িয়ে এই দূরবীনটা বাগিয়ে তো তো দেখি, ব্যাটাচ্ছেলে সূর্যটাকে ধরতে পারে কিনা।”
টেবিলে রাখা দুরবীনটা দেখিয়ে দেন শশাঙ্কমোহন। নিতাই সেটা নিয়ে এগিয়ে যায় জানলার দিকে। নিবারণ মেঝেতেই বসে পড়ে। তার আকাশ নিয়ে অত আগ্রহ নেই। সে এ বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকে। কত্তাবাবুর যত্ন নেয়। শশাঙ্কমোহনের বয়স হয়েছে। তাছাড়া ইদানীং চোখেও কিছু কম দেখেন। তাকে ধরে ধরে সিঁড়ি দিয়ে নামায়, জল এনে দেয়, বাজার করে দেয়। নিবারণকে বড় ভালোবাসেন শশাঙ্কমোহন। তিনি ধমক দেন, “কতবার তোকে বলেছি মেঝেতে বসৰি না। এ বাড়িতে এত খাট বিছানা, চেয়ার টেবিল, আর তুই শুধু মেঝেটাই দেখতে পাস ?”
—“আমার এখানে বসেই শান্তি কত্তাবাবু।” একগাল হেসে মেঝের উপর ঝুকে বসে নিবারণ। জানলায় নিতায়ের দিকে চোখ ফেরান তিনি, “এই ব্যাটা সারাক্ষণ মাটিতে রয়েছেন আর উনি তাকিয়ে থাকেন আকাশে… হা রে,”
শশাঙ্কমোহন গলা তুলে বলেন, “তোর বাড়িতে কিছু বলে না?” অন্যমনস্ক হয়েই উত্তর দেয় নিতাই, “বলে তো…”
—“জানেন কত্তা, ও একবার আকাশ দেখতে দেখতে ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছিল,” খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে নিবারণ। এইবার চোখ ফিরিয়ে খেকিয়ে ওঠে নিতাই, “সমুন্দির ব্যাটা, যেইটা বুঝে না, সেইটা লইয়া বেশি কথা কয়ো না, সেদিন রাইতে আমি যা দেখসিলাম সেইটা দেখলে তোমার মাথায় আউলা লাগি যাব।”
—“কী দেখেছিলি?” শশাঙ্কমোহন প্রশ্ন করেন।
মুখ ফিরিয়ে দুরবিনে চোখ রাখে নিতাই,” একখান আগুনের গোলা”।
—” হ্যাঁলিস কোমেট ?” উৎসাহিত হয়ে ওঠেন শশাঙ্কমোহন, “কিন্ত” পরের কথাগুলো মনে মনে বলেন তিনি, সে তো উনিশশো দশে এসেছিল আবার পঁচাত্তর বছর পরে, মানে উনিশশো ছিয়াশি নাগাদ আসবে। এখন সবে সত্তর।
থমথমে মুখে বসে থাকেন শশাঙ্কমোহন। বাড়ির কোথাও থেকে তার প্রিয় ময়নাটা ডাকতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটাও কানে যায় না শশাঙ্কর। তবে কি অন্য কোন ধূমকেতু দেখেছে নিতাই ? কিন্তু খালি চোখে পৃথিবী থেকে এমন স্পষ্ট করে আর কোন কমেট তো দেখা যায় না।
নিতাইয়ের কাছে এগিয়ে যান তিনি, মাথায় একটা হাত রেখে বলেন, – “শোন, তোকে একটা বুদ্ধি দিই আমি, তাতে তোর বাড়ির লোক খুশি হবে, তুইও দু পয়সা ইনকাম করতে পারবি…”
—“বাড়ি গিয়ে তুই বল যে কাল রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিস, তুই গ্রহ নক্ষত্র হিসেব করে মানুষের ভাগ্য বলে দিতে পারিস।”
চাপা হাসি হাসে নিতাই, “কী যে কয়েন কত্তা.. আমি কি ওসব পারি?”
—“উঁহু, তোকে পারতে কে বলেছে? ওসব বুজরুকি, আমি জানি। কিন্তু ভেবে দেখ, তুই সারাদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কেউ বাধা দেবে , পয়সা কড়ি কামাবি, মান-সম্মান পাবি…”।
নিতাই মাথা নাড়ে, “না, বাপ বলসেন মিথ্যা কওয়া আর চুরি করা পাপ…” মেঝের উপর হাঁটু রেখে বসে পড়েন শশাঙ্কমোহন, “বল দেখি এই দুনিয়াতে সবচেয়ে বড়ো চোর কে?”
“কে?”
—“তুই যার দিকে তাকিয়ে আছিস সে…”
~ “সূর্য ?” অবাক বিস্ময়ে বলে নিতাই।
শশাঙ্কমোহন তার পিঠে একটা চাপড় মারেন, “শনির যেমন একটা বলয় আছে না? আমাদের এই সৌরজগতেরও একটা বলয় আছে। একটা বিরাট বড় রিং, বুঝলি? ঠিক যেন নিজের ছানাপোনা আর বাড়িকে ঘিকে একটা পাচিল দিয়ে রেখেছে সুজ্যিামামা। এই পাঁচিলকে বলে উরস ক্লাউড …, চোখ বড়বড় করেন শশাঙ্কমোহন, “এখন গোপন কথা হল আমাদের এই গুরুগম্ভীর ঋষিসুলভ সূর্য এই গোটা রিংটা অন্য গ্রহের থেকে চুরি করে এনেছিলেন অন্য নক্ষত্র থেকে ধূমকেতু চুরি করে এনে রেখেছিলেন নিজের পাশে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিংটা বড় হতে হতে এখন অনেকটা দূরে চলে গেছে। তবে গোল করে ঘিরে রেখেছে এখনও…”
সমস্ত ব্যাপারটা বোঝে না নিতাই। শশাঙ্কমোহন এবার নিবারণের দিকে সরে আসে, “ওর তো না হয় আকাশ দেখে পেট চলে যাবে, তোর কী হবে?”
কী উত্তর দেবে বুঝে পায় না নিবারণ, ফিক করে হেসে দেয়। শশাঙ্কমোহন তার পাশেই মেঝেতে বসে পড়ে, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, “আমার তো বয়স হয়েছে, আজ আছি কাল নেই। আমি হুট করে চলে গেলে তুই এই বাড়ির দেখাশুনা করবি, বুঝলি?” নিবারণের হাসিটা নিভে আসে।
—“কী রে, পারবি না? আমার দেখাশোনা তো বেশ করিস, বাড়িটার যত্ন নিতে পারবি না?”
উপরে নিচে মাথা দোলায় নিবারণ, “হা, পারব কত্তা ” ।
শশাঙ্কমোহন খুশি হন, “পারবি যখন তোকে একটা কথা বলি তাহলে। নিবারণ উত্তর দেয় না, শশাঙ্কমোহন বলে যান, “নিতাই সেদিন সেটা দেখেছিল সেটাকে হ্যাঁলির ধূমকেতু বলে। প্রতি পচাত্তর বছর পরে পৃথিবীর কাছে আসে। তখন কিছুক্ষণের জন্য মাত্র তাকে দেখতে পায় পৃথিবীর মানুষ। আজ থেকে নয় কিন্তু। লক্ষলক্ষ বছর ধরে আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছর ধরে চীনারা দেখেছে, ব্যাবিলনিয়ানরা দেখেছে, ইনকারা
দেখেছে, রোমানরা দেখেছে, লিখেও রেখেছে আকাশে অদ্ভুত আলোর কথা। কিন্তু একটাই ধূমকেতু যে বারবার ফিরে আসছে সেটা তারা বুঝতে পারেনি। শেষে অ্যাডমন্ড হ্যাঁলি নামে এক বিজ্ঞানী এইসব লেখার মধ্যে থেকে ধরতে পারলেন ব্যাপারটা। ভাবলেন, উহু এত মিল তো আলাদা আলাদা ধূমকেতুতে থাকতে পারে না। ইনি তাহলে একই ব্যক্তি, শুধু এতটা সময়ের ব্যবধানে দেখা যায় যে একটা সভ্যতার মানুষের পক্ষে তাকে চিনতে পারা সম্ভব নয়, তার নাম থেকেই ধুমকেতুর নাম দেওয়া হয়… এখন…”
কিছুক্ষণ থেমে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে পরের কথাগুলো বললেন শশাঙ্কমোহন, “আমাদের এই ভাসানবাড়িতেও এমন অনেক অচেনা ধূমকেতু আসে। বারবার, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে, তাদের আমরা দেখি, অনুভব করি, কি তারা যে একই মানুষ সেটা আমরা বুঝতে পারি না, তুই যদি অনেকদিন এ বাড়িতে থাকিস তাহলে একদিন চিনতে পারবি তাদের… কেমন?
গোটা ব্যপারটা অনেকক্ষণ আগেই গুলিয়ে গেছে ছেলেটার কাছে। কিন্তু মনটা খুশি হয়ে ওঠে। এই বাড়িটার প্রতি এতদিনে একটা মায়া জমেছে তার। ঠিক ভাসানের সময়ে দুর্গাঠাকুরের জলে পড়া মুখটার দিকে চেয়ে যেমন মায়া লাগে। এ বাড়ির যত্ন নেবে সে, যতদিন বেঁচে আছে এখানেই থেকে যাবে। নিবারণ ঠিক করে নেয়। মুখ তুলে জানলায় এসে বসা একটা চডুয়ের ডানায় আলতো করে হাত বোলাচ্ছেন শশাঙ্কমোহন। লোকটা বুড়ো, কিন্তু ভারী সরল। মাস দুয়েক পরে জ্বরে ভুগে শশাঙ্কমোহন মারা যেতে গ্রামেরই শ্বশানে দাহ করা হয় তাকে। জ্ঞাতিগুষ্টির তেমন কেউ ছিল না বলে গ্রামের লোকই সমস্ত দায়িত্ব নেয়। তবে তার শ্রাদ্ধশান্তি ক্রিয়া মিটে যেতেই শুরু হয় বাড়িতে লোকজনের আনাগোনা। কোর্টে বাড়ির মালিকানা নিয়ে শুরু হয় মামলা।
লতায়-পাতায় বংশধরদের মধ্যে আইন-আদালতের বিবাদ মিটতে-মিটতে পাঁচ বছর কেটে যায়। এই পাঁচ বছরে নিবারণ নিজ দায়িত্বে যত্ন নিয়েছে বাড়িটার। সামনে বাগানে নতুন ফুল লাগিয়েছে। রাজমিস্ত্রি ডেকে এনে কয়েক জায়গায় ভাঙ্গা ইঁট মেরামত করেছে। ঘরদোর পরিষ্কার করেছে।বাড়িটাকে নিজের বাড়ির থেকে বেশি ভালোবাসে সে।
মামলা মিটতে একটা চিঠি পায় নিবারণ। তাতে বলা হলো বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টা দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাকে। বাড়ির অধুনা মালিক কলকাতা ছেড়ে এখানে আসবেন না। ভাসানবাড়ি বিক্রি করার তেমন ইচ্ছা নেই তাদের। ফলে আপাতত নিবারণকেই যোগ্য লোক হিসেবে কেয়ার্টেকার রাখছে তারা। মাঝে-মাঝে কলকাতা থেকে ছুটি কাটাতে মালিক আসবেন। তখন বাড়িটা ঝকঝকে অবস্থায় পেলেই চলবে।
সেই থেকে নিবারণ এ বাড়ি ছেড়ে নড়েনি আর। তার নিজের একটা ছোট এক-কামরার ঘর আছে এ গ্রামে। কিন্তু সেখানে নিতান্ত দরকার না পড়লে যায় না।
তিরিশ বছর বয়সে নিবারণ বিয়ে করে। একটা সন্তানও হয়। তবে ছেলে বউয়ের দিকে তেমন নজর ছিল না তার। বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলোতে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াত। চাইলে ছেলে-বউকে এখানে এনে রাখতে পারত, কিন্তু এ বাড়িতে অন্য কেউ এসে থাকলে সেটা পছন্দ করে না নিবারণ। ভিখারিএলে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেয়। দু-তিন বছরে একবার পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান বাড়ির মালিক। সে কদিন কোনওরকমে সহ্য করে নেয় নিবারণ।ওরা থাকলে বাড়ির স্বাভাবিক শাস্তি নষ্ট হয়। দেওয়ালগুলো বিরক্ত হয়। ভাসানবাড়ি নীরবতা চায়, অবকাশ চায়, গঙ্গার ঘোলাটে জলের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে যেমন ডুব দিতে ইচ্ছা করে তার অতলে, তেমন ভাসানবাড়ি বিলীন করতে ভালোবাসে মানুষকে। দুদিন কাটিয়ে ফিরে যাওয়া পছন্দ করেনা সে।
বাড়িটা কি জীবন্ত ? মাঝে মাঝে ভাবে নিবারণ। কিছু একটা চায় যেন বাড়িটা। বুড়ো কবরেজের বলে যাওয়া কথাগুলো মনে পড়ে যায়, “এ বাড়িতে এমন অনেক কিছু লেখা হয়ে আছে যা এখনও চিনে নেওয়া হয়নী!”
একই মানুষ ঘুরে ফিরে আসে বারবার, শুধু একই মানুষ বলে চেনা যায় না তাকে।
চিনতে কি পারবে নিবারণ? সে জানে না। শশাঙ্কমোহন মারা যেতে তেমন কেউ আসেনি এ বাড়িতে। নিবারণকে হয়তো পছন্দ নয় তাদের। তবে ভাসানবাড়িকে বুক দিয়ে আগলে রাখে সে। যেমন রাতের আকাশের তারা না চিনেও তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে নিতাইচরণ। দু’জনের চোখেই ফটে ওঠে অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা।
* * * * *
পুরনো বটতলা ফেলে জঙ্গলের প্রান্ত বরাবর এগিয়ে আসে দু’জনে। গনশার একটা হাত ধরে রেখেছে হৈমন্তী। এই রাস্তাটায় মাটি এবড়ো-খেবড়ো। হোঁচট খেয়েছে কয়েকবার। এখন সন্ধে নেমে গেছে। আলো কমে এসেছে সেই সঙ্গে। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে। যদিও রাস্তার খানাখন্দে জল জমে আছে এখনও। নিবারণের বাস্তুভিটের দিকে এগিয়ে যায় দুজনে। গনশাকে চিন্তিত দেখায়,
হৈমন্তী তার মাথায় একটা ঠেলা দিয়ে বলে, “কীরে, কী ভাবছিস তুই?”
চমক ভাঙে গনশার, মুখ না তুলেই বলে, “দাদা অবেলায় ঘুমায় না, কিন্তু আজ ঘুমাচ্ছে।”
—“তাহলে কখন ঘুমায়?”
—“তা জানি না, কিন্তু এমন সময়ে তো ঘুমায় না।”
হৈমন্তী গম্ভীর মুখে বলে, “আজ রান্না-টান্না করে ক্লান্ত হয়েছে মনে হয়। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
—“রান্না তো রোজ করে… আজ…”
—“উফফ! তোকে এত জ্যাঠামি করতে হবে না।…” ধমক খেয়ে চুপ করে যায় গনশা, তার কপাল থেকে চিন্তার রেখাগুলো কিন্তু যায় না।
হাত দিয়ে তার চুল নেড়ে দেয় হৈমন্তী, নরম গলায় বলে, “আজ দুপুরে আমার ল্যাপটপে যে গেমটা খেলছিলি ওটার নাম মনে আছে?”
—“প্রো… প্র…” মনে করার চেষ্টা করে গনশা।
—“প্রোজেক্ট আইজিআই, আমার আর একটা কাজ করে দিলে আজ রাতে যতক্ষণ খুশি খেলিস, কেমন?”
—“কাজ?” গনশা বুঝতে পারে তাকে ঘুষ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তার নীতিমালার দাঁড়িপাল্লায় ‘প্রোজেক্ট আইজিআই’ সব বাটখারাকে হারিয়ে দিয়েছে, “কী কাজ?”
—“তুই দোতলার জানলায় উঠতে পারবি? বাইরে থেকে?”
—“জানলায়! কেন?” হোঁচট খেতে খেতে সামলে নেয় গনশা।
—“একটা জিনিস পেড়ে দিতে হবে।”
—“কিছু আটকে গেছে?”
—“ধরে নে তাই।” একটুক্ষণ বিচার করে গনশা, কাতর গলায় বলে, “দোতলার জানলায় উঠেছি জানলে দাদা মেরে ফেলবে আমাকে।”
—“মহা আহাম্মক তো…” আবার ধমকায় হৈমন্তী, “তোর দাদাকে জানাচ্ছে কে? আচ্ছা শোন, গেমের তিন নম্বর ধাপে ওই জেলখানার চাবিটা কোথায় আছে তাও বলে দেব…”
অব্যর্থ নিশানা। গনশা বিমোহিত হয়ে পড়ে। জেলখানার চাবির খোঁজ পাওয়া গেলে পাপের ভয় কীসের?
মিনিট দশেক পরে নিবারণের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় দু’জনে। বাড়ি বলতে তেমন আহামরি কিছু না। এক কামরার চালাঘর। জঙ্গলের ঠিক বাইরের প্রান্তে বলে আশেপাশে কিছু কলাগাছের সার গজিয়েছে। গাছের পাতায় ঢেকে আছে ঘরটা। ভিতর অবধি না ঢুকলে বোঝাই যায় না ভিতরে একটা ঘর আছে বলে।
—“পাড়া প্রতিবেশি বলে কেউ নেই দেখছি” হৈমন্তী দেখতে দেখতে বলে।
—” নিবারণ কাকা কারোর সঙ্গে মিশতো না মানুষজন পছন্দ করতনা”
নিবারণ ভাসান বাড়ির যত্ন নিত,কিন্তু তার নিজের বাড়িতে তেমন শ্রী নেই।
কোনরকমে দাঁড় করানো আছে কাঠামোটা।
—“মোবাইল ব্যবহার না করার কারণটা বুঝতে পারছি এবার ” জলজমা পথে কিছুটা এগিয়ে আসে হৈমন্তী। পায়ে কাদার ছিটে লাগে তার।
নিবারণের বউ বেঁচে নেই।অসুস্থ শরীরে এমন অস্বাস্থ্যকর ঘরে লোকটা একা পড়ে থাকে? হট করে কিছু হয়ে গেলে চিৎকার করলে একটা মানুষও শুনতে পাবে না।
কী মনে হতে গনশ বলে, “আমার কাকা বলে নিবারণ কাকা নাকি পাগল
হয়ে গেছিল।”
—“কী রকম পাগল?” সাবধানে এগোতে এগোতে বলে হৈমন্তী।
—“ভাসানবাড়ি কাকাকে শুষে নিয়েছে”।
বিড়বিড় করে হৈমন্তী,“বাড়ি আবার মানুষকে শুষে নেবে কী করে ? তবে
লোকটার মাথায় কিছু ছিট আছে তা তো বুঝতেই পারছি “।
গনশা পিছনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। হৈমন্তী কাঠের দরজায় হালকা একা ঠেলা দেয়। মিহি শব্দ করে খুলে যায় দরজাটা। পুরনো লেপকথা আর ভিজে কাঠের গন্ধ একসঙ্গে নাকে আসে হৈমন্তীর
চাঁদের আলো চালের ফাঁক দিয়ে এসে ঢুকছে ভিতরে।পায়ের তলায় সিমেন্টের মেঝে, তার উপরে কিছুটা ছেড়া আলো ধুমিয়ে আছে।
ঘরটা ফাঁকা।
একদিকের বিছানার উপরে চাদর পাতা আছে। তার উপরে মানুষের শরীর নেই, এমন কী কারো শোবার চিহ্নও নেই। হৈমন্তীর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এ ঘরে বেশ কয়েকদিন কোনও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। সেটা অবশ্য ভুল হতে পারে…।
এই বৃষ্টির মধ্যে গেলেন কোথায় নিবারণবাবু? নাকি কদিন আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথাও চলে গেছেন তিনি? বিছানাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল হৈমন্তী। চোখে পড়ল, খাটের পায়ার কাছে দলা পাকানো কিছু একটা পড়ে। সেটা হাতে নিতে গিয়েও আটকে যায় সে- পিঠে একটা শক্ত হাত এসে পড়েছে। সে চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। অশিনী দাঁড়িয়ে আছে ঘরের ঠিক মাঝামাঝি।কাঁধের শালটা কয়েক জায়গায় ভিজে গেছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হৈমন্তীর দিকে।
আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করে হৈমন্তী, “আসলে নিবারণবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করার ইচ্ছা ছিল “
—“দেখা হয়েছে?” যেন বরফের ফাটল থেকে বেরিয়ে আসছে কথাগুলো
—“না মানে- গলা আটকে যায়, “উনি তো নেই
—“অপেক্ষা করবেন?”
হৈমন্তী বোঝে তার পা দুটো কেঁপে উঠছে, “না না, কিন্তু এত বৃষ্টিধ্যে অসুস্থ মানুষটা কোথায় গেল, চিন্ত হচ্ছে না আপনার?”
এক পা এগিয়ে আসে অশ্বিনী, “এক্টা খুন হয়ে গেছে। আরও হতে পারে। এই গ্রামটা নিরাপদ নয় আর আপনাকে আমি বলেছিলাম একা একা কোথাও যাবেন না।
—“আসলে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন দেখে আর ডাকিনি…”
জ্বল জ্বলে চোখে একবার হৈমন্তীর দিকে তাকায় অশ্বিনী। তারপর দরজার দিকে ফিরে এগিয়ে যায়। হৈমন্তীর হতভম্ব ভাবটা কাটেনি এখনও। যে ডোজের ঘুমের ওষুধ শরবতে মিশিয়েছিল সে, তাতে অন্তত আটঘন্টার আগে জাগার কথা নয় অশ্বিনীর। অথচ এখন একঘন্টাও কাটেনি। এ কী করে সম্ভব?
—“শুনুন না,কখনও অশ্বিনীকে তুমি ছেড়ে আপনি বলতে শুরু করেছে নিজেও খেয়াল করেনি হৈমন্তী।
গলাটা স্বাভাবিক করে বলে, “ভাবছি কালকে ট্রেনটা ধরবো না।আর কটাদিন থেকে যাই এখানে।
মুখ ফিরিয়ে দাড়ায় অশ্বিনী।আর পরিচিত শিশুসুলভ হাসিটা গোটা মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।চকচকে মসৃণ মুখের উপর জোৎস্না খেলে যায় একঝলক।
আর কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।
দুরু দুরু বুকে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে হৈমন্তী।তারপর সতর্কভাবে হাতের কাগজটা মেলেধরে। খাটের পাশে থেকে কাগজটা আগেই হাতে তুলে নিয়েছিল।
কাগজ নয়, একটা পুরনো হলুদ হয়ে যাওয়া ফটোগ্রাফ।নিচে ব্লক লেটারেএর ছবি তোলার সাল উল্লেখ করা আছে। আঠারোশো একানব্বই।
ছবিটা সাদাকালো…। এক টুকরো জ্যোৎস্নায় সেটা মেলে ধরতে রূপালী আলোয় ভরে ওঠে ছবিটা।
একশো ত্রিশ বছর আগে ভাসানবাড়ির সামনের বাগানে তোলা হয়েছিল ছবিটা।
সে সময় বাড়িতে যারা থাকত তাদের সবাই উপস্থিত আছে ছবিতে। সম্ভবত এদের মধ্যে কোন একজন মুরারী মোহন। ছবি থেকেও সামনের সারিতে কেউ পেছনে, সেকালে এমন পারিবারিক গ্রুপ ফটো তোলার রীতি ছিল।
ছবির একেবারে বাঁদিক থেকে তিন নম্বরে, পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা, বছর আঠাশ এর সালগারে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখে চোখ আটকে গেল তার।
ছবিটা হাত থেকে খসে পড়ে…
Piya sarkar er ” brischik,brishchikchakra” boi gulo din pls.