ভাসানবাড়ি – ৬

ষষ্ঠ অধ্যায়

মাথার উপরে তাকিয়ে আকাশটা দেখেই দৌড় মারে গনশা। কালো মেঘ। ঘনিয়ে আসছে এককোণে। একটু আগে ঘাড়ের কাছে আলপিনের মতো ঠান্ডা স্পর্শ পেয়েছে। এইবার জোরে বৃষ্টি নামবে।

গড়গড় করে মেঘ ডেকে উঠল একবার। গনশা হাতের ব্যাগটা বাগিয়ে ধরে কোনওরকমে দৌড় দিল। মাছটুকুনি ভাসানবাড়ি অবধি পৌছে দিতে পারলে গোটা পঞ্চাশটাকা বকশিশ পাওয়া যাবে। এমনিতে আজ বাজারে যাওয়ার কথা ছিল না। তার উপরে কাল বাজারের কাছে একটা লোক খুন হওয়ায়

বেশিরভাগ দোকান খোলেনি। তাও পঞ্চাশটাকার লোভ সামলাতে পারেন গনশা। পাথুরে রাস্তার উপর কালো বিদ্যুতের মতো দৌড়াতে লাগল সে।

ভাসানবাড়িতে যেতে ভালোই লাগে গনশার। সেখানে বকাবকি করার মতো কেউ নেই। যেখানে খুশি ঘোরাঘুরি করা যায়। শান্ত, নিরিবিলি।

খানিকটা দৌড়াতেই মেঘলা আলোয় জঙ্গলের দিকটা চোখে পড়ল গণশার। এই একচিলতে জঙ্গলটা ছোট থেকেই ওকে টানে। জঙ্গলের একটা বিশেষ জায়গার বেশ কিছুটা বাজ পড়ে কালো হয়ে গেছে। লোকে বলে কয়েক বছর আগে নাকি ভয়ানক একটা বাজ পড়েছিল ওখানে, তারপর থেকে কখনও গাছ গজায়নি জায়গাটায়।

গনশা এগোতেই যাচ্ছিল, এমন সময় ওর মনে হয় জঙ্গলের ভিতর থেকে কে যেন ডাকছে ওকে, নাকি হাওয়ার শব্দ?

বড়বড় ফোঁটায় এখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। গনশা সামনে হাঁটতে গিয়েও থেমে গেল, কেউ কী হেসে উঠল? জঙ্গলের ভিতরে অন্ধকার অংশটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল সে। মনে হল সত্যি কারা যেন দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। ওকে যেন কিছু বলতে চায় লোকগুলো। ভয়ে ভয়ে দৌড় দিল ভাসানবাড়ির দিকে। কাকভেজা হয়ে কোনওরকমে হাতের ব্যাগটা খাবলে ধরে যখন বাড়ির গেট পেরল তখন মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। ঝমঝম শব্দে ভরে উঠেছে চারিদিক। নরম মাটির উপর কয়েক চিলতে জলাধার তৈরি হয়েছে। তার উপরে বৃষ্টির ফোঁটা বৃত্তাকার নকশা কেটেই নিজের খেয়ালে মুছে দিচ্ছে। একতলার রান্নাঘরে এসে সে দেখতে পেল অশ্বিনীকে, হাতের ব্যাগটা সামনে তুলে ধরে বলল, “এনেছি দাদা, ভেজেনি…”

মটরশুটি ছাড়াচ্ছিল অশ্বিনী, মুখ তুলে চোখ গোলগোল করে বলল, —“আর তুই ভিজে টইটুম্বুর হয়েছিস…” নিজের কাঁধে পড়ে থাকা গামছাটা তার দিকে ছুঁড়ে দিল সে, “চান করে গা-হাত মুছে নে। আর দিদিমণিকে ডেকে দে তো…”

স্নানঘরের দিকে যাচ্ছিল গনশা, একটু থেমে কী যেন ভেবে বলল, —“আমি আর পুরানবাসা দিয়ে আসব না দাদা, ও জঙ্গলে কিছু আছে।”

—“জঙ্গলে! কী আছে?” চোখ না তুলেই জিজ্ঞেস করে অশ্বিনী।

—“জানি না, কে যেন হাসছিল আজ। স্পষ্ট শুনতে পেলাম… ওখানে কী হয়েছিল বলতো?”

অশ্বিনী একটু ভেবেচিন্তে বলে, “শুনেছি তো বাজ পড়েছিল একবার।”

—“তাতে লোক মরে গেছিল?”

—“যেতে পারে। কেউ হয়তো কাঠ কাটতে গিয়েছিল তখন। কেন রে?” গনশা কিছুক্ষণ থম্ মেরে থেকে বলল, “আজ মনে হল ওখানে দাঁড়িয়ে কারা যেন হাসছিল…”

—“এ আর এমন কী? ও জঙ্গলে তো কত লোকে কাঠ কাটতে যায়, তাদের কেউ হাসছিল হয়তো…” গনশার পছন্দ হয় না উত্তর, “না দাদা, অমন হাসি নয়, মনে হল যেন…”

—“আঃ” বিরক্ত হয় অশ্বিনী, “ঠান্ডা লাগবে এবার, যা স্নান করে নে…” গনশা আর প্রশ্ন না করে সরে পড়ে। অশ্বিনী নির্বিকার মুখ করে মটরের বাটি সরিয়ে গনশার আনা মাছের ব্যাগটা টেনে নেয়।

আজ অন্য রান্না হওয়ার কথা ছিল। সেই মতোই বাজার করা হয়েছে, কিন্তু সকাল থেকে গ্রাম কাঁপিয়ে বৃষ্টি এসে পড়ায় খিচুড়ির তোড়জোড় শুরু হয়েছে, সেই সঙ্গে ইলিশ মাছ।

গ্রামের কোথাও ভীষণ শব্দ করে একটা বাজ পড়ল। পায়ের নিচের মাটি হাফ ইঞ্চি কেঁপে উঠল তাতে। অশ্বিনীর মুখে কিন্তু কোনও পরিবর্তন এল না । অম্লান বদনে চালে-ডালে মেশাতে লাগল সে। এদিকে রান্নাঘরের জানলায় বাইরের পেয়ারা গাছের পাতা ভিড় করে এসেছে। বাইরের বৃষ্টির জল পাতা চুইয়ে এসে পড়ছে স্টোভের ঠিক সামনেটায়। ভিজে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে সেই সঙ্গে, নরম চালের গন্ধ, পুরনো বাড়ির ভাঙা ইটের গন্ধ… অশ্বিনীর কোনওদিকে খেয়াল নেই… যেন

এসব কিছুরই কোনও গুরুত্ব নেই তার কাছে।

—“দিদিমণি তো ঘরে নেই…” পেছন থেকে গনশার গলা পেয়ে মুখ ঘোরায় অশ্বিনী, “চানঘরে আছে তাহলে.”

—“দরজা খোলা… নেই তো…” উঠে দাঁড়ায় অশ্বিনী, “নেই মানে? কোথায় গেল? বাইরে এত বৃষ্টি, গ্রামের কিছু চেনে না..” বিড়বিড় করে নিজের মনেই কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে উপরে। হৈমন্তীর ঘরের সামনে এসে একবার ভিতরে উঁকি দেয়। কেউ নেই। বিছানার চাদর। এলোমেলো। যেন হঠাৎ করেই কোনও কারণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে সে। এমন কি ঘরের ঠিক সামনে চটিটা পর্যন্ত পড়ে আছে। জোলো হাওয়ায় বয়ে। আসা ছাটে ভিজে উঠছে বিছানাটা।

অশ্বিনী আর গনশা মিলে বন্ধ করে দেয় খোলা জানলাগুলো। সেগুলো বন্ধ হতেই ছাদের দিক থেকে একটা ধুপধাপ আওয়াজ ভেসে আসে।

অশ্বিনী ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে, “ছাদে গেছে মনে হয়। উপরে আয় তো একবার।”

তিনতলার শেষ সিঁড়িটা টপকাতেই হৈমন্তীকে দেখা যায়। তার গায়ে কাল রাতের পোশাক। ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। মাথার চুল বেয়ে কোমরে নেমে আসছে জলের স্রোত। অশ্বিনীদের দিকে পেছন করে ছাদের পাঁচিল ধরে দূরের দিকে চেয়ে আছে সে।

সিঁড়ির শেষ ধাপে বসে পড়ে ওরা দু’জনে। বেশ কিছুক্ষণ বৃষ্টির ঝমঝমে আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। ভিজে হাওয়ার ধাক্কা লাগছে গায়ে, অশ্বিনী শালটা ভালো করে গায়ে চাপিয়ে নেয়।

কিছুক্ষণ পরে নিজে থেকেই পিছন ঘোরে হৈমন্তী। ওদের দু’জনকে সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হয়ে হাসে, মুখের জলটা মুছে নেওয়ার চেষ্টা। করে। কিন্তু পরক্ষণেই অবাধ জলের ধারা এসে আবার ভিজিয়ে দেয়।

—“আজ শরীর ভালো আছে মনে হচ্ছে…” অশ্বিনী বলে।

—“তা আছে, এখানে যা রাজার হালে রেখেছ…” হৈমন্তী হাসে, বাড়িতে থাকলে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হত, এখানে এমনিতেই শরীর ভালো হয়ে যায়।”

অশ্বিনী মাথা দোলায়, “তা যায় বটে, কিন্তু এমন হুটহাট এদিক-ওদিক চলে যাবেন না। এ জায়গাটা ইদানীং ভালো নেই আর একটা খুন হয়ে গেছে। আজ গনশা আবার জঙ্গলে কাকে যেন হাসতে শুনেছে…”

—“ইদানীং বলতে আমি আসার পর থেকে, তাই তো?” হৈমন্তী এগিয়ে আসে ওদের দিকে, “তবে আর বেশিদিন নেই আমি।”

—“মানে?” অশ্বিনী মুখ তুলে প্রশ্ন করে। জলের শব্দে তার কথাটা অস্পষ্ট শোনায়, “আপনি তো দু’সপ্তাহ থাকবেন কথা ছিল..”।

ছাদের মেঝেতেই বসে পড়ে হৈমন্তী, “না, যে কাজে এসেছিলাম সেটা আদৌ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এ বাড়িটা পুরানো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতিহাসের কোনও চিহ্নই আর নেই এখানে।”

অশ্বিনীকে একটু চিন্তিত দেখায়। হৈমন্তী মেঝের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, “একবার তোমার বাবা, মানে নিবারণবাবুর সঙ্গে দেখা করলে হত। কিন্তু তা তো আর হচ্ছে না, অগত্যা…”

এই সময়ে গনশা মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, অশ্বিনী তাকে থামিয়ে দেয়, “বেশ, তো কবে ফিরছেন?”

—“কাল প্রবাবলি ।”

—“ট্রেনের টিকিট কেটেছেন?”

—“হ্যাঁ, অনলাইনে বুক করলাম।” অশ্বিনী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়েও আবার বন্ধ হয়ে এল। ব্যাপারটা চোখে পড়ে হৈমন্তীর। সে বলে, “কিছু বলতে যাচ্ছিলে মনে হল…”

*—“হ্যাঁ।” গম্ভীর গলায় বলে অশ্বিনী।

—“বল।”

—” আপনার জন্য খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ হচ্ছে আজ, ভেজা হয়ে গেলে

নিচে চলে আসবেন।”

কথাটা বলে আচমকাই উঠে দাঁড়ায় অশ্বিনী। আর কোনও কথা না বলে গট গট করে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। গনশাও তার দেখাদেখি উঠে যাচ্ছিল। হৈমন্তী থামিয়ে দেয় তাকে। হাত ধরে একটা টান দিয়ে বলে _ “এই তুই যাচ্ছিস কোথায়? আয় ভিজবি আয়…”

প্রবল ঘাড় নাড়ে গনশা, “না, আমার ঠান্ডা লাগবে।”

—“এঃ, গ্রামের ছেলে, মাঠ ঘাটে চষে বেড়ায়, আর বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা লাগবে! আয় বলছি…” একটানে হাত ছাড়িয়ে নেয় গনশা, “না, দাদা বকবে।” গনশার হাতে হৈমন্তীর নখের আঁচড় লাগে, সে সিঁড়ির উপরে এসে বসে মুখ বাড়িয়ে হাতটা দেখার চেষ্টা করে, “রক্ত বেরচ্ছে?”

—“না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় গনশা।

—“ঠিক তো?” হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে দেখায় গনশা। হৈমন্তী নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো বুকের উপরে এনে বলে, “আচ্ছা, তোর এই দাদা এখানে কতদিন হল আছে রে?”

—“আগের মঙ্গলবার এসেছে।”

—“সেকী!” থমকায় হৈমন্তী, “হাবভাব দেখে মনে হয় অনেকদিন ধরে আছে। তার আগে দেখিসনি কোনওদিন?”

—“দেখেছি, নিবুকাকার সঙ্গে আসত এখানে, মাঝে মাঝে।”

—“জন্ম থেকেই দেখছিস?”

—“না, আগে অন্য কোথাও থাকত। কিন্তু দাদা এখানে সবকিছু চেনে..”

—“তাই তো দেখছি। আচ্ছা এই নিবুকাকাকে তুই ছোট থেকে দেখছিস?”

—“নিবুকাকা?” গনশা হাসে, “হ্যাঁ, ছোটবেলায় তো পড়াত আমাকে।”

—“ওদের বাড়িটা কোথায় তুই জানিস?”

_ হ্যাঁ, কেন জানব না? ওই গোলামাঠের ভিতরে একটা গলি আছে, ওটা দিয়ে হেঁটে…”

—“আচ্ছা পরে বলিস না হয়, এখন চল নিচে যাই।” চুলট থেকে জলটা নিংড়ে নিয়ে আবার সেটা পিছনে ঠেলে দেয় হৈমন্তী, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, ভালো কথা, যাবার সময় বলে গেল আমার জন্যে খিচুড়ি ইলিশ মাছ হচ্ছে, ও নিজে খাবে না মনে হল..”

—“না। দাদা মাছ মাংস খায় না।”

—“সে কী! ব্রত করে নাকি? কিন্তু রান্না তো করছে।”

—“রান্না করে, খায় না। আমাকে একবার মাংস করে খাইয়েছিল। খুব ঝাল দেয়। কিন্তু খেতে খুব ভালো দিদি।”

—“বটে…” নিচে নেমে নিজের ঘরে ফিরে এল হৈমন্তী। টুপটুপ করে শরীর থেকে জল পড়ে চলেছে একটানা। পায়ে পায়ে জলের দাগ এগিয়ে চলেছে। হৈমন্তী এসে ঢুকল ঘরের ভিতরে। বাইরে আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছে। যেন এখুনি একটা বড়সড় বাজ পড়বে, তার প্রস্তুতি চলছে।

কাল রাতে ঘুমটা ভেঙে যেতেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে হৈমন্তী। এই দুদিনে এই জায়গাটার উপর, বাড়িটার উপর একটা অলুক্ষুণে মায়া পড়তে শুরু করেছে তার। এমন কি এই বাড়ির ছাদ থেকে যে আকাশটুকু দেখা যায় সেটাও, অত দূর থেকেও যেন আঁকড়ে ধরতে চাইছে। হৈমন্তী জানে- টান ভালো নয়। নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিল কোনও টানকে আর প্রশ্রয় দেবে । সামান্য শিকড় গজালেই উপড়ে ফেলবে চারাগাছ। ইলিশমাছ ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে একতলা থেকে। লাল, কড়া করে ভাজা মাছগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই গন্ধটাকে ঘায়েল করতেই একটা সিগারেট ধরাল সে। আমেজে টান দিতে লাগল। সাদা মিহি ধোঁয়ার রেখা বেরিয়ে এসে জানলা দিয়ে মেঘের সঙ্গে মিশে উড়ে যেতে লাগল

কোনও এক অজানার উদ্দেশে।

হৈমন্তীর ফোনটা বেজে উঠল রিনরিন শব্দে। অস্মিতা ফোন করেছে, লাফিয়ে জানলার কাছে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করল সে, নেটওয়ার্ক প্রায় নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে তাতে বৃষ্টির ফোঁটার মতোই ঝিরঝিরে খাপছাড়া কথা শোনা যাচ্ছে, -“শোন ভাই, নিবারণবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ছে তোর?”

—“না তো, উনি তো অসুস্থ।”

—“কান্ট হিয়ার ইউ, যাই হোক। সপ্তাহখানেক আগে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন ভদ্রলোক। পোস্ট অফিসের কৃতিত্বে আজ এসে পৌছাল। চিঠিটা খুব ছোট। তবে পড়ে মনে হল মানুষটা কোন একটা কারণে ভয়। পেয়েছেন। স্পেশালি তোকে যেতে বারণ করছে, গেলেও বলেছেন যেন হোটেল ভাড়া করে থাকিস। ভাসানবাড়িটা সেফ নয়।” আরও কিছু বলছিল অস্মিতা, সবটা কানে আসে না হৈমন্তীর, সে প্রশ্ন। করে, “সেফ নয় মানে? ভেঙে পড়বে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

—“তা জানি না, তবে নিবারণকাকা কোন কারণ না থাকলে বারণ করার মানুষ নয়।”

—“আচ্ছা আমি কাল ফিরে যাচ্ছি। আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেব না হয়। বাই দ্য ওয়ে, নিবারণকাকার ছেলেটি ভারী ইন্টারেস্টিং।”

এবার ওপাশের গলায় সন্দেহের আভাস ধরা পড়ে, “কেমন ইন্টারেস্টিং? ছকটক নেই তো?”

—“ধুর, তবে বেশ খাতির-যত্ন করছে আমার।”

—“গ্রেট, আসার সময় হাত ভরে বকশিস দিয়ে আসিস।” বকশিসের কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল হৈমন্তীর। অশ্বিনীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয় না টাকাপয়সা কিংবা অন্য কোনওরকম চাহিদা তার আছে বলে। ছেলেটা অদ্ভুত, সন্দেহ নেই। যদি ভিতরে লোভ কিংবা উদ্দেশ্য থেকেও থাকে সেটা এত সহজে বোঝা সম্ভব নয়।

—“আর শোন,” অস্মিতা এখনও কাটেনি ফোনটা।

—“হ্যাঁ বল।”

—“আজ পারলে একবার নিবারণকাকার সঙ্গে দেখা করে আয়। উনি ঠিক কী বলতে চাইছেন ভারী জানতে ইচ্ছা করছে।”

—“বেশ, বৃষ্টি থামলে যাব বিকেলের দিকে।” আরও দু-একটা কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় অস্মিতা। শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা জানলা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয় হৈমন্তী। চোখে পড়ে খানিক দূরে কাঁচা মাটির রাস্তার উপর দিয়ে একটা বছর বারোর ছেলে’বোনকে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজছে তারা দু’জনেই। দাদা সাইকেল চালাচ্ছে আর বোন অকারণেই টুংটুং করে বেল বাজাচ্ছে। একটা মুড়িওয়ালাকে পাশ কাটিয়ে গেল তারা। তার মাথায় মস্ত ধামা। তাদের থেকে কিছু উপরে একটা বাড়ির ছাদে করগেট শেডের তলায় কাসুন্দি শুকাতে দিয়েছে কেউ। সেই বয়ামের উপরে মাঝে মাঝে চড়াই পাখি এসে বসছে আর ঠোঁট দিয়ে টোকা দিয়ে বয়াম খোলার চেষ্টা করছে। জায়গাটা ঠিক অজগ্রাম নয়, তাও একটা গ্রাম্য প্রশান্তি আছে এখানে। কী খেয়াল হতে একটা কাগজের প্লেন বানালো হৈমন্তী। পেন দিয়ে তার উপরে নিজের নাম লিখল, “হৈম”। তারপর জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেটা সজোরে উড়িয়ে দিল আকাশের দিকে।

—“যাঃ, উড়ে যা…” বিড়বিড় করে বলল সে। প্লেনটা খানিক ওড়ার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু অজানা জগতের ভয় পেয়েই হয়তো আবার নেমে আসতে লাগল নরম মাটির দিকে। প্লেনটা খুশি হয়েছে কিনা বোঝা গেল না। হৈমন্তী তার ডানার দিকটা দেখতে পাচ্ছে, মুখের দিকটা নয়। বৃষ্টিতে ভিজে গেল কাগজটা।

—“নিচে যাবে দিদি? না এখানে খাবার দিয়ে যাব?” গনশা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। মনে হয় হৈমন্তীর প্লেন ওড়াননা দেখে মনে মনে একচোট হেসে নিয়েছে। হৈমন্তী খানিক লাজুক মুখে বলল, “না না, দিয়ে যাবি কেন? আমি যাচ্ছি নিচে।”

নিচে নেমে বড় ঘরটার কাছে পৌছে হৈমন্তী দেখে ঘরের একেবারে মাঝামাঝি তিনটে আসন পাতা রয়েছে। মাঝের কল্কিকাটা আসন’টা। তাহ জন্য। সেটার উপরে গিয়ে বসে পড়ে হৈমন্তী। কয়েক মিনিট পরে তার সামনে খাবারের থালা রেখে যায় অশ্বিনী। গন্ধে ম ম করে ওঠে ঘরটা, হৈমন্তীর জিভে জল এসে যায়। একটু বাঁকা সুরে সে বলে, “তোমার রান্নার এমন হাত আছে জানলে আরও কদিন থেকে যেতাম এখানে… নেহাত ট্রেনের টিকিটটা কাটা হয়ে গেছে…।”

একটু আগে বেশ গম্ভীর দেখাচ্ছিল অশ্বিনীকে। এখন তার মুখে আবার সেই উজ্জ্বল ভাব ফিরে এসেছে, খিচুরির হাঁড়িটা হৈমন্তীর সামনে রেখে সে। বলে, “তাহলে আজ বেশি করে খান না হয়। আবার কবে আসবেন তো। ঠিক নেই।” হৈমন্তী অশ্বিনীকেও খেতে বলতে যাচ্ছিল এমন সময় মনে পড়ল সে। নিরামিষাশী। হয়তো আমিশ খাবারের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে একসঙ্গে খায় না।

এক চামচ খিচুড়ি মুখে দিয়ে সে বলে, “ভালো কথা, তুমি নাকি মাছ। মাংস খাও না। কোনও ঠাকুরের ব্রত আছে নাকি?”

অশ্বিনী ঘাড় নাড়ে, “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। কিন্তু খাদ্যের জন্য পশুজন্তুর মৃত্যু আমার পছন্দ নয়।”

—“তাহলে রান্না করলে যে…” বাইরে থেকে গমগম করে একটা শব্দ আসে। যে বাজের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল সেটা এতক্ষণে যোড়শপচারে পড়তে চলেছে।

—“মাঝে মাঝে আমাদের হত্যা করতে হয়। ভালো না লাগলেও করতে হয়, বিশেষ কোনও উদ্দেশ্যে, জানেন না? সুখেদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালোভৌঃ জয়জয়ৌ

ততো যুদ্ধায় যুধ্যস্ব নৈবং পাপমবান্স্যসি।”

—“বাবা! ঈশ্বরে বিশ্বাস নেই এদিকে গীতা পড়েছ!” হাসির রেখা ফোটে অশ্বিনীর মুখে, “আমার সময়ের অভাব নেই, তাই সব পড়ে ফেলি।”

—“তা অর্জুনকে তো কৃষ্ণ ধর্মরক্ষার্থে নির্দেশ দিচ্ছেন, তুমি কী রক্ষা করছ

শুনি?”

অশ্বিনী মুখ তুলে তাকায়, আর সঙ্গে সঙ্গে হৈমন্তী ছিটকে পড়ে আসন থেকে বেশ কিছুটা দূরে। কানে তালা লেগে যায় তার। মাথাটা ঠুকে যায় মেঝের উপরে। বাড়ির একবারে পাশেই একটা বাজ পড়েছে। উপর তলা থেকে সশব্দে কিছু মাটিতে পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়। সম্ভবত ছাদ থেকে কয়েকটা ইট খসে পড়ে নিচে। গোটা গ্রামটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে বাজটা। শুধু একজনকে ছাড়া। সে এখনও আগের মতোই মেঝের উপরে বসে আছে। এই উন্মাদ বজ্রপাত তাকে এক বিন্দু টলাতে পারেনি।

—“শিট! আমার ল্যাপটপটা…” হৈমন্তীর মনে পড়ে টেবিলের উপরে ল্যাপটপটা রেখে নিচে এসেছিল সে। বাজ পড়ে বাড়ি কেঁপে ওঠায় সেটাই হয়তো নিচে এসেপড়েছে। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে সে। নিজের ঘরে ফিরে এসে নিশ্চিত হয়।

ল্যাপটপটা টেবিলের উপরেই আছে। শুধু জানলার বিমের উপরে ফোনটা নেই। জানলার কাছে এসে নিচে তাকায়। নাঃ কোথাও চিহ্ন নেই ফোনটার। নির্ঘাত সেটা নিচে গিয়ে পড়েছে। তাই যদি হয়ে থাকে তবে সেটা আর উদ্ধার করেও লাভ নেই। এতক্ষণে গুড়ো হয়ে গেছে হয়তো। হতাশ হয়ে মুখের সামনে থেকে চুল সরায় হৈমন্তী। উপরে তাকাতেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। জানলার বাইরের উপরের দিকের একটা ছোট অংশের ইট খসে পড়েছে। শতাব্দী প্রাচীন পাঁজরের সিমেন্ট আর বালি উঁকি দিচ্ছে সেখান থেকে। কিন্তু সেগুলো ছাড়াও আরও একটা জিনিস দেখা যাচ্ছে সেই ফাঁকে। একটা প্রায় ইটের সাইজেরই পেতলের বাক্স। তার উপরে কিছু রঙিন পাথর বসানো।

প্রায় দেড়শ বছর ধরে ভাসানবাড়ির দেওয়ালের গাঁথনিতে বন্দি হয়ে ছিল বাক্সটা……

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *