পঞ্চম অধ্যায়
লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে খুশি হল হৈমন্তী। গেটের ঠিক বাইরেই একটা হলদে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। আজকাল অনলাইন ক্যাবের যুগে সাবেক ট্যাক্সির দিন গেছে। তাও হৈমন্তীর অ্যাম্বাসাডারে উঠতেই ভালো লাগে। এদের সবার রঙ এক, যেন একটা বিরাট বড় গাড়ি প্রতিজ্ঞা করেছিল সব মানুষকে বুকে নিয়ে হাঁটবে সে, কিন্তু একসঙ্গে সবাইকে নিতে পারেনি বলে নিজেকে টুকরো টুকরো করে কেটে ছড়িয়ে দিয়েছে কলকাতার রাস্তায়। গুগল ম্যাপ যখন আসেনি তখন এদেরকেই রাস্তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করত পথচলতি মানুষ। বেশিরভাগ সময় দাঁড়িয়েই থাকত ট্যাক্সিগুলো, কখনও ড্রাইভার ঘুমিয়ে পড়ত সিটের উপর শুয়ে। ঘুম ভেঙে ঠিকানা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ত। ঢলঢলে, গতিহীন, ঘরোয়া জীবনের ইঙ্গিত ছিল সেখানে।
তাই হৈমন্তী হলদে ট্যাক্সি দেখলে আর উবার ডাকে না। আজও সেদিকেই এগিয়ে এল। ড্রাইভার ভদ্রলোক পাঞ্জাবী। তার খয়েরি দাড়ির উপরে বিকেলের নরম রোদ এসে পড়েছে।
—“গোলপার্ক যাবে?” হৈমন্তী জানলার কাছে মুখ এনে জিজ্ঞেস করে।
টাক্সিওয়ালা ঝিমোচ্ছিল, মুখ তোলে, “কাহে নাহি জায়েঙ্গে? আইয়ে।” সামনের সিটে উঠে বসে হৈমন্তী। ছোট থেকেই যে কোনও গাড়ির পিছনের সিট তার পছন্দ নয়। তাছাড়া মনে হল পিছনের সিটে কেউ একজন বসে আছে। সে খেয়াল করল না ভালো করে। পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে নিউজ স্ক্রোল করতে লাগল। একটা খবরে চোখ আটকে গেল।
কলকাতার বুকে এক বিচিত্র কাণ্ড ঘটে চলেছে কয়েকমাস ধরে। এমন আহামরি কিছু নয়, তাও ভারী আগ্রহ জাগল হৈমন্তীর। খবরের সারমর্ম হলপথচলতি মানুষের মধ্যে কারও কারও চোখে আচমকাই জাল পড়ে যাচ্ছে। হুঁশ থাকছে না, তারপর ঘণ্টাতিনেক পরে আবার রাস্তারই একপাশে জ্ঞান ফিরছে তাদের। যেন পথ চলতে চলতে আচমকা ঘুমিয়ে পড়েছিল। পকেট থেকে দামি ফোন, মানিব্যাগ কিছুই উধাও হয়নি। শরীরের কোথাও কোন জ্বালা-যন্ত্রণা নেই। শুধু জীবন থেকে ঘণ্টাতিনেক সময় কাটা পড়ছে। জিনিসটা গুজবের মতো রটেছে, ক্ষয়ক্ষতি কিছু হচ্ছে না বলে পুলিশ এখনও পাত্তা দেয়নি।
আরও দু তিনটে খবরে চোখ বুলিয়ে একটা গান চালায় হৈমন্তী। জন ডেনভারের ভিজে হাওয়ার মতো গলা ভেসে আসে, —I guess he’d rather be in Colorado He’d rather spend his time out where the sky
looks like a pearl after a rain… শহর কলকাতার বুকে ঘিঞ্জি আর ঘর্মসিক্ত মানুষের ভিড় মুছে গিয়ে বৃষ্টির ভিজে ছাপ লাগা পাহাড়ী জঙ্গল ভেসে ওঠে। বাসের হর্ণের বদলে বাজতে থাকে ডি মেজর। হৈমন্তীর মন ঠান্ডা হয়ে আসে। Once again I see him walkin Once again I hear him talking to the stars he makes And asking them for bus fare… কিছুটা তন্দ্রা এসে গিয়েছিল, চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে সে চমকে ওঠে, “এ কী! গোলপার্ক যাব বললাম যে, কোথায় যাচ্ছেন?”
সর্দার উত্তর দেন না, উত্তর আসে পিছন থেকে, “গাড়িটা উনি চালাচ্ছেন বটে কিন্তু নির্দেশ দিচ্ছি আমি…”
গলাটা চিনতে পারে হৈমন্তী, রিয়ার ভিউ মিররে তাকায়। পিছনে যে লোকটা বসে আছে তার নাকের উপরে একটা কাটা দাগ। মোটই সুবিধের নয় মুখটা। তবে মুখটা চেনা, প্রাথমিক বিস্ময়ের ভাবটা কাটিয়ে নিয়ে হৈমন্তী বলে, “তুমি আমাকে ফলো করছ নাকি?”
—“মাথা খারাপ?” সুমিতের গলায় ব্যঙ্গর ছাপ, “তোমাকে যে অনুসরণ করবে সে নরকের দরজা অবধি পৌঁছে যাবে।”
—“তো? এই ট্যাক্সিটা কী আপাতত সেদিকেই যাচ্ছে?”
—“হ্যাঁ, তবে চিন্তা নেই। আবার ফিরেও আসবে।” হৈমন্তী বুঝতে পারে একটা ধান্দা আছে সুমিতের। সে মুখ নিচু করে ফোনে কিছু ডায়াল করতে যাচ্ছিল। সর্দারের বাঁ হাতটা পাথরের মতো নেবে আসে। ছিনিয়ে নেয় ফোনটা।
—“আহা গুরুজী! ওকে অমন জবরদস্তী করার দরকার নেই। ওর খুঁটি আমার কাছে বাধা আছে… ফোনটা রাখতে দিন..”
ফোনটা হৈমন্তীর কোলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ড্রাইভার। সেটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে সে।
—“তুমি আমার সঙ্গে ঠিক করনি কিন্তু…”
—“কী ঠিক করিনি?” শান্ত গলায় প্রশ্ন করে হৈমন্তী।
—“আমাদের ব্যাপারটা শুরু হওয়ার সময় তোমার এইডস আছে সেটা আমাকে ভদ্রলোকের মতো জানানো উচিত ছিল।”
—“আমার এইডস নেই এখনও। এইচ.আই.ভি আছে।”
—“ওয়াটএভার, জানানো উচিত ছিল না?” একটুক্ষণ চুপ করে থাকে হৈমন্তী, তারপর কেটে কেটে উত্তর দেয়, “না জানানোয় কোনও ক্ষতি হয়নি তোমার…”
—“উই কিসড…”
—তাতে এইচ,আই,ভি ট্রান্সমিট হয় না, অশিক্ষিতের মাতা..”
—“শাট আপ। চুমু থেকে ব্যাপারটা আরও বেশিদূর গড়ালে কী হত তুমি বুঝতে পারছ?”
—“সেটা হতে পারে ভেবেই এগোতে দিইনি সম্পর্কটা.” কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে, “তারপর থেকে আর কোনও সম্পর্কই এগোতে দিই না, বন্ধু-বান্ধব, কলিগ, নাথিং …”।
কয়েক সেকেন্ড কোনও উত্তর আসে না। গাড়ির চাকার শব্দ ছুটে চলে পিচের রাস্তার উপর দিয়ে।
—“তুমি যা করেছ সেটা লিগাল অফেন্স, এতবড় একটা রোগ লুকিয়ে
—“আমার হাঁপানি আছে, গাইনোকালজিকাল সমস্যা আছে, পিরিয়ড হয় না ঠিকঠাক, সেসব বলেছি তোমাকে?”
—“হেল উইথ ইয়র পিরিয়ড..”সুমিতের গলায় একটা কর্কশ ভাব এসে মেশে, “শোন, তোমার এক্সপ্ল্যনেশান আমার দরকার নেই। তোমাকে কেবল আমায় একটা কাজ করতে দিতে হবে। যদি না দাও তাহলে তোমার এই রোগের কথা কাল তোমার ময়লা নিতে আসা লোকটাও জেনে যাবে…”
—“কী কাজ? টাকাপয়সা চাইলে নেই আমার কাছে। তাছাড়া যেটা আছে সেটা দেওয়ার মতো নয়।” মিহি একটা হাসি ফুটে ওঠে হৈমন্তীর ঠোঁটে।
—“ঠিক সেটাই চাই আমাদের। রক্ত।”
—“রক্ত!” হৈমন্তী চমকে ওঠে, “আমার রক্ত? কী হবে? এন্ড ওয়াট ডু ইউ মিন বাই ‘আমাদের’?”
—“সেটা তোমাকে না জানালেও চলবে আমার। জাস্ট তোমার কিছুটা রক্ত নেব আমরা, বেশি না। দু সিরিঞ্জ।”
—“কী হবে সেটা দিয়ে?” সর্দারের মুখের দিক থেকে একবার চোখ ফিরিয়ে নেয় সুমিত, “দেয়ার ইজ আ কোম্পানি, ওরা তোমাদের মতো মানুষের রক্ত চাইছে।”
—“আমাদের বলতে এইচ.আই.ভি ইনফেক্টেড রক্ত?”
—“কী হবে সেটা দিয়ে ?” সুমিতের গলা নরম হয়ে আসে, আরোপিত কর্কশ গলা কমে আসে অজান্তেই, “ওরা রাস্তা থেকে লোক তুলে এনে তাদের শরীরে ওই ইঞ্জেক্ট করে ছেড়ে দিচ্ছে। লোকগুলো বুঝতে পারছে না ওরা শরীরে এইচ.আই.ভি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে…”
ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে একটু সময় লাগে হৈমন্তীর, “কী লাভ হচ্ছে এতে ওদের?”
—“আমি জানি না…” হৈমন্তী আর কিছু বলার আগেই একটা ছোট গলির সামনে এসে আচমকা ব্রেক কষে ট্যাক্সিটা। ওর মাথাটা সিটের পিছনে ঠুকে যায়।
—“উতর আইয়ে… আরামসে…” দরজা খুলে দাঁড়ায় ড্রাইভার। তারপর এগিয়ে গিয়ে গলির ভিতরে ঢুকে পড়ে।
এতক্ষণে সন্ধ্যে কিছুটা গাঢ় হয়েছে। গলির ভিতরটা আধো অন্ধকারে ঢেকে আছে। তার ভিতর থেকে রেডিওর শব্দ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে সুর করে নামতা পড়ছে একটা বছর দশেকের ছেলে।
—“এসো আমার সঙ্গে..”হৈমন্তীর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় সুমিত। হাতটা কিন্তু ধরে না হৈমন্তী। একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সামনে পা বাড়াতে বাড়াতে বলে, “ট্যাটুটা তোলনি এখনও ?”
নিজের গলার ডেভিল ট্যাটুটার দিকে চেয়ে সুমিত হাসে, “তোলা এক হ্যাঁপা। তাছাড়া এখন নিজেকে ডেভিল এপ্রেন্টিস হিসেবে বেশ মানিয়ে যায়। তুমি তোলনি কেন?”
—“যার রক্তে বিষ আছে তার চামড়ায় কী থাকল তাতে কী যায় আসে?” অন্ধকার গলির ভিতরে খানিকটা এগিয়ে একটা শাটারের তলা দিয়ে ঢুকে আসে তিনজনে। একটা ঢিমে হলদে আলো জ্বলছে ভিতরে। পাম্প চলার আওয়াজ আসছে একটানা। সেই বাচ্চা ছেলের নামতাটা মিলিয়ে এসেছে এতক্ষণে।
ওষুধের গন্ধ আসছে কোথা থেকে।কিছুটা এগিয়ে একটা ছোটো সিড়ি আর করিডোর পার করে ডানপাশে ঝুলন্ত পর্দা সরিয়ে ফেলল সুমিত। ডান হাতের আংটি দিয়ে বিশেষ কায়দায় টোকা দিল।হৈমন্তী বুঝলো টোকাটাই পাসওয়ার্ড।
—”ও হেল্লো , হেল্লো , আপনিই সেই হৈমন্তী ঘোষ?” দরজা খুলে যে ছেলেটা দাড়িয়েছে তাকে দেখে সদ্য কলেজ পাস করা কর্পোরেট সিড়ির প্রথম ধাপে দাড়িয়ে থাকা ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। চোখে নেতাজির মতো গোল ফেমের চশমা, সিঁথি করে আঁচড়ানো চুল, ভরাট মায়াময় মুখ।
—” সুদ্ধাসত্ব.. “আলাপ করিয়ে দেয় সুমিত, “এখানকার ব্যাপারগুলো ওই দেখাশোনা করে”।
একটা বড় হলঘর চোখে পড়ছে তার ভিতরে বেশ কয়েকটা বেড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাধা আছে। মর্গে লাশ কাটার টেবিলগুলোর মতো দেখতে অনেকটা । সেই ওষুধের গন্ধটা বেড়ে উঠেছে আগের থেকে।
—“বসুন না, প্লিজ…” ঘরের একধারে একটা অগোছালো করে রাখা চেয়ার দেখিয়ে দেয় শুদ্ধসত্ব, “আমাদের হসপিটালিটির অভাব বুঝতেই পারছেন, আসলে আমাদের কাজটা সবে শুরু, তাই একটু…”
—“আমাকে এভাবে এখানে ধরে আনার মানে কী?” চেয়ারে বসে প্রশ্ন করে হৈমন্তী। তার কপালের মাঝখানটা জ্বালা করতে শুরু করেছে। শুদ্ধস্বত্ত অবাক হয়, “সেকী! সুমিত, তুমি জানাওনি ওনাকে?”
—“জানিয়েছে, কিন্তু আপনাদের উদ্দেশ্যটা কী? এভাবে মানুষের শরীরে বিষ প্রবেশ করিয়ে লাভ কী আপনাদের?”
প্রশ্নটা শুনে খুশি হয় শুদ্ধসত্ব। প্রায় শিশুর মতো দৌড়ে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে এনে রাখে হৈমন্তীর সামনে, তারপর সেটার উপরে বসে পড়ে বলে, “আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আপনার কখনও মনে হয়নি, এই যে রোগটা, এইডস.. এটা খুব কম হচ্ছে। মানে একশো জনের মধ্যে প্রায় —“ওয়াট দ্য হেল ইউ আর টকিং আবাউট ?” রাগত গলায় প্রশ্ন করে হৈমন্তী। চেয়ারের দুটো হাতল খামচে ধরে।
“আবাউট ইউ মিস ঘোষ.. আপনি একবারও ভাবেননি যে দুর্ভাগ্যটা একা আপনার কেন হবে?”
—“না,,”জোর গলায় বলে হৈমন্তী, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনাদের আপনারা যা শুরু করেছেন তাতে কত মানুষের সর্বনাশ হচ্ছে আইডিয়া আছে ? টেরোরিস্ট আপনারা.. আপনারা… আই উইল কল দ্য পুলিশ..”
হো হো করে হেসে ওঠে ছেলেটা, তারপর পকেট থেকে একটা ফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে। কল বাটান’টা দেখিয়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দেয় সেটা, “নিশ্চয়ই জানাবেন পুলিশকে, তার আগে এই হসপিটালে ফোন করে বলুন তো যে আপনি এইচআইভি পজেটিভ… ইউ নিড ট্রিটমেন্ট।” ফোন টা নিতে গিয়েও থেমে যায় হৈমন্তী।
—“কী হল? করবেন না কল?” শুদ্ধসত্ব আর একটু এগিয়ে আসে, তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় ফোনটা, গনগনে গলায় বলতে থাকে,
—“আপনাকে যে এতদুর নিয়ে এলাম আমরা, চোখ বাধিনি, ফোন কেড়ে নিইয়নি, এমন কী আপনাকে এখান থেকে অক্ষত শরীরেই ফেরত দিয়ে আসব। এত কনফিডেন্স আমাদের আসে কোথা থেকে? আমরা কী করে নিশ্চিত হই যে আপনি পুলিশকে জানাবেন না ? বলতে পারেন?” হৈমন্তী উত্তর দেয় না। মাথা নামিয়ে নেয়। ছেলেটা বলে চলে, “নিজের বোগটার কথা বলতে পারেন না কাউকে, কারণ আপনার এইচ,আই,ভি আছে জানামাত্র আপনার চরিত্র থেকে পাবলিক টয়লেটের গন্ধ পাবে লোকে, কাগজের অফিসে আপনার চাকরিটা চলে যাবে। আপনি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারবেন না, দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনতে পারবেন না। রোগটা ধরা পরার পর একটা টেস্ট করেছিল আপনার বাড়ির লোক, আপনি ভার্জিন কিনা, মনে আছে?”
—“আছে…”
—“কীভাবে করা হয়েছিল সেটা ?”
হৈমন্তীর ঠোটটা কেঁপে ওঠে দু’বার। মুখে কথা ফোটে না।
—“ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলেন ছোট থেকে, সুন্দরী, ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন, গান গাইতে পারেন, ঝকঝকে স্মার্ট একটা মেয়ে। আপনাকে নিয়ে নিশ্চয়ই গর্ব ছিল আপনার মা-বাবার। সেই বাবার চোখে প্রকাশ্য ঘৃণা কেমন লেগেছিল আপনার? যে মায়ের শরীরের অংশ আপনি… আপনি জানেন আপনার জীবন বেশিদিন বাকি নেই, এই বাকি দিনগুলোও ভয়ে-ভয়ে কাটাতে হবে আপনাকে… তার চেয়ে না হয় খানিকটা শিক্ষা দিলেন এই সমাজটাকে…”
—“এসব বলে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন?”
—“যাদের আপনি বাঁচাতে চাইছেন তারা বাঁচানোর যোগ্যই না। এই সোসাইটি সেদিনই এই রোগটাকে মেনে নেবে সেদিন মড়কের মতো ছড়িয়ে পড়বে রোগটা।”
হাঁটুর উপর পা তুলে বসে হৈমন্তী, “তা না হয় হল। কিন্তু আপনাদের এতে লাভটা কোথায়? আপনাকে দেখে তো এইডস পেসেন্ট মনে হচ্ছে না, সেটা হলে আমাকে দরকার হত না।”
—“এত কথার কী মানে হয় আমি বুঝতে পারছি না।” সুমিত বলে “জাস্ট রক্তটা দিয়ে দাও, ব্যাস… ল্যাঠা চুকে গেল…”
—“তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? টেরোরিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছ তুমি?” আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে হৈমন্তীর একটা হাত চেপে ধরে তাকে একধারে টেনে আনে সুমিত, তারপর চাপা গলায় বলে, “আমি হাত মেলাতে বাধ্য হয়েছি। তোমার জীবনের ঠিক নেই, আজ আছে কাল নেই, তুমি মানিয়ে নিয়েছ সেটা, কিন্তু আমাকে বাঁচতে হবে। তোমার থেকে রক্তটা আদায় করতে
পারলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।”
—“আই ডোন্ট কেয়ার… আমি এতগুলো মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারব না। আর তুমি বেঁচে থেকেও এমন মহান কিছু তো করে ফেলছ না…”
—“রক্তটা তোমাকে দিতেই হবে হৈমন্তী। এখান থেকে তুমি সুঁচ না ফুটিয়ে বেরোতে পারবে না।
—”প্লিজ, হাত জোড় করছি, অন্তত আমার প্রতি যে অন্যায়টা করেছ তার প্রতিদান হিসেবে…”
—“মানুষের মৃত্যু নিয়ে বার্গেন করব না আমি…”। হিংস্র একটা ধাক্কা দেয় সুমিত, “শালা নিজেও মরবে আমাকেও মারবে, এরা কত সাংঘাতিক লোক ধারণা আছে তোমার?”
হলঘরের উলটোদিকের দরজা খুলে দু’জন ষণ্ডা লোক বেরিয়ে আসে, দু’জনের গায়েই জামা নেই। হাত আর বুকের পেশিগুলো নিভন্ত টিউবলাইটের আলোতেও ঝকমক করে উঠছে। শুদ্ধসত্ব এতক্ষণে তার কোমরে বাঁধা ব্যাগ থেকে একটা ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ বের করে ফেলেছে। দু’জন লোককে পাশে নিয়ে এগিয়ে আসে হৈমন্তীর দিকে।
—“ভেবে নিন রক্তদান করছেন। ফর আ গ্রেট কজ…” বিড়বিড় করে শুদ্ধসত্ব। রক্তাভ হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো।
পিছন ফিরে হৈমন্তী দেখে একটা গ্রিলহীন খোলা জানলা আছে সেখানে। কিন্তু সেটা অবধি পৌঁছানর আগেই লোকগুলো ধরে ফেলবে ওকে। কোণঠাসা বিড়ালের মতো সে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। শুদ্ধসত্ব আরও কিছুদূর এগিয়ে আসে, “নাউ ডোন্ট ফাইট লিটিল বার্ডি।”
—“সিরিঞ্জটা আমাকে দিন…” হাত বাড়িয়ে দেয় হৈমন্তী, “আমার শরীর থেকে অন্য কাউকে রক্ত নিতে দেব না আমি।”
একটু ভাবে ছেলেটা, তারপর হাসিমুখে সিরিঞ্জ এগিয়ে দেয় হৈমন্তীর দিকে, “বেশ। তাই হোক..”
সিরিঞ্জটা হাতে ধরে আচমকাই নিজের ঘাড়ের কাছে বসিয়ে দেয় হৈমন্তী, তারপর গাঁথা অবস্থাতেই সেটা চালিয়ে দেয় নিজের বুক বরাবর, লম্বালম্বি হয়ে চিরে যায় অনেকটা। গলগল করে লাল রক্তের ধারা বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। সিরিঞ্জটা ছুরির মতো তুলে ধরে হৈমন্তী।
—“ফাকিং বিচ..” খিস্তি করে ওঠে সুমিত। দু’জন লোক ওকে ধরতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। হৈমন্তীর হাতের সিরিঞ্জের সূঁচ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। সে রক্ত চামড়া ভেদ করে শরীরে প্রবেশ করলেই সাক্ষাৎ মৃত্যু সঞ্চারিত হবে শিরায় শিরায়। লোক দুটো ভয়ে পিছিয়ে যায়। জানলাটার কাছে গিয়ে সেটার উপর উঠে বসে হৈমন্তী। তারপর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে ঝাঁপ মারে বাইরে।
মাটিতে এসে পড়ে হাঁটু আর মাথা দুটো একসঙ্গে ঠুকে যায়। তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠে সে। উঠে দাঁড়াতে একটু সময় নেয়। উপর থেকে সুমিতের চিৎকার ভেসে আসে, “আজ তুমি পালিয়ে গেলে হৈমন্তী। বাট আই উইল ফাইন্ড ইউ। আমার হাত থেকে তুমি পালাতে পারবে না…” সিরিঞ্জটা রাস্তার উপরে ছুঁড়ে ফেলে খোঁড়া পায়ে এগোতে থাকে হৈমন্তী, মাটির উপর পাটা টেনে নিয়ে চলে কোনও মতে, দুর্বিষহ যন্ত্রণা উল্লসিত ধর্ষকের মতো মাটিতে টেনে ফেলতে চায় ওকে।
—“আর যেদিন তোমাকে খুঁজে পাব… আই উইল টিয়ার ইউ… তোমার মাথা আর ধড় টেনে আলাদা করে ফেলব আমি… ইউ ফিলথি হোর…”