চতুর্থ অধ্যায়
মাটিতে সজোরে মাথাটা ঠুকে যেতে ঘুম ভাঙল হৈমন্তীর। চোখ মেলতে বুঝতে পারল বিছানা থেকে মেঝের উপরে এসে পড়েছে। উঃ” শব্দ করে এক হাতে কপাল চেপে ধরল সে। মনে হল মাথায় একসঙ্গে দুটো যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। একটা আগে থেকেই ছিল, আর একটা এইমাত্র মাটিতে মাথা ঠুকে জন্মেছে। চোখ খুলে হৈমন্তী দেখল মেঝের উপরে সাদা রঙের কয়েকটা কাগজ পড়ে আছে, যেন ঘরময় সেগুলো ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। হাতের উপরে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। শরীরটা চলছে না। মাথাটা ভারী হয়ে আসছে। গলার কাছে একটা কষাতে স্বাদ টোক গিলতে বাধা দিচ্ছে বারবার। সেই সঙ্গে ঠোঁটের পাশে চটচটে আঠালো ভাব। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আঠালো ভাবটা আধশুকানো রক্তের ,গাল আর চিবুকের কয়েক জায়গায় কালো রক্ত শুকিয়ে গেছে। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা টাটকা জল নেমে এসেছিল বাসি রক্তের গায়ে, বেসিনের সামনে গিয়ে দ্রুত সেগুলো মুছে ফেলল হৈমন্তী। জামাকাপড় খানিকটা ঠিকঠাক করে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল। গলায় জোর এনে ডাক দিল, “অশ্বিনী… এই অশ্বিনী…”
নিচের দিকের ঘর থেকে কোনও শব্দ এল না। রেলিং ধরে নিচে নামতে লাগল সে। রাত সাড়ে ন’টার কাছাকাছি বেজেছে। সকাল থেকে এখন অবধি ঠিক কী ঘটেছে মনে নেই হৈমন্তীর। বাজারে ঢোকার মুখে সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। তারপর অশ্বিনীই হয়তো বাড়িতে এনে শুইয়ে দিয়েছে ওকে।
একতলায় নেমে আরও বারদুয়েক ডাকাডাকি করে সাড়া পাওয়া গেল না। আবার কালকের ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল হৈমন্ত্রী। এখনও আলো আসছে
সেখান থেকে দেয়ালে হাত রেখে এগিয়ে যায় সে।
কালকে থেকে আজকে কোনও তফাৎ নেই। মোটামুটি ফাঁকা একটা ঘরে একদিকে বড় আয়নার মুখোমুখি বসে আছে ছেলেটা। অধির আগ্রহে চেয়ে আছে, আয়নাটার দিকে মন দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। মাথা, পা, হাতের আঙুল একবিন্দুও নড়ছেও না। কিছুক্ষণের জন্যে যেন তার শরীর থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে দিয়েছে কেউ।
—“অশ্বিনী, তুমি এখানে” বেশ জোর গলাতেই কথাটা বলেছে হৈমন্তী। ছেলেটা কিন্তু এখনও ফিরে তাকায়নি ওর দিকে।
ধীরে ধীরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় হৈমন্তী। আয়নায় অস্বাভাবিক কিছু নেই। একটা হাতল দেওয়া চেয়ারে বসে আছে অশ্বিনী। চোখ দুটো ঠান্ডা পাথরের মতো স্থির, তার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে হৈমন্তী।
—“এই অশ্বিনী”,কাঁধে একটা ঠেলা দেয় হৈমন্তী। আর সঙ্গে সঙ্গে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে। থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, “ওঃ! আপনি, শরীর কেমন লাগছে এখন?”
—“বেটার ,মুখটা একবার মুছে নিয়ে বলে হৈমন্তী।
অশ্বিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, “আপনি বসুন বরঞ্চ, আমার একটু কাজ আছে এখন…”
—“না দাঁড়াও..” অশ্বিনীর হাতের উপর চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়।
হৈমন্তী, বলে, “আমার মুখে রক্ত লেগেছিল, কিন্তু বিছানায় তেমন রক্ত ছিল না, সারাদুপুর কোথায় ছিলাম আমি?”
—“বিছানাতেই ছিলেন,”আঙুল দিয়ে ঘরের একটা কোণ দেখিয়ে দেয় অশ্বিনী। একটা ছোট ঝুড়ি ভর্তি হয়ে আছে দলা পাকানো কাগজে। সব কাগজগুলোতেই রক্তের দাগ।
—“আজ বিকেল অবধি ভীষণ জ্বর ছিল আপনার, ঘুমের ঘোরে মুখ দিয়ে খুব রক্ত উঠছিল, আমার কাছে অত কাপড় নেই তাই…”
চেয়ারে বসে পড়ে হৈমন্তী। দুটো হাত দিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। মুখ তুলতে আয়নার নিজের মুখটা দেখতে পায়, চোখ সরিয়ে নেয়।
হাতঘড়ি টার দিকে চেয়ে থাকে কয়েক সেকেন্ড।
তারপর মুখের উপর এসে পড়া চুলগুলো যত্ন করে সরিয়ে নিয়ে বলে, “তুমি এমন অনার দিকে তাকিয়ে থাকো কেন বলতো?”
স্বভাব বলতে পারেন, এই যেমন আপনি সবসময় হাতে এই ঘড়িটা পরেন
হৈমন্তী হাসে, আয়না ছাড়া অন্য দিকেও নজর দাও তার মানে। এটা স্কুলে আমাকে আমার এক ম্যাম দিয়েছিলেন।”
“কেনো?”
—“পরীক্ষায় থার্ড হয়েছিলাম একবার। আচ্ছা তোমার পড়াশোনা কতদূর ?”
একটু ইতস্তত করে অশ্বিনী, “আমার আর পড়াশোনা…” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “ওই স্কুলটুকু পাশ করেছি। তবে আমি বই অনেক পড়েছি জানেন, ফিকশন, নন-ফিকশন, বিজ্ঞানের বই, ছাদে যাবেন?”
হৈমন্তীর মনে হল ‘বিজ্ঞানের বই এর সঙ্গে ছাদে যাওয়ার প্রসঙ্গটার কোথাও একটা যোগাযোগ আছে। সে মাথা নাড়ল, “চলো…” হৈমন্তী লক্ষ করেছে অশ্বিনী এ বাড়িতে এতটা সময়ে থাকলেও তার থাকার চিহ্ন নেই কোথাও। বিছানা নেই, ধরে নেওয়া যায় সে মাটিতে শোয় কিন্তু মাটিতে পাতার চাদর-তোষক, বালিশ, জামাকাপড়ের আলনা, গামছা, টুথব্রাশ, দড়িকাটার জিনিসপত্র এসব কোথায়? ছেলেটার গাল দেখে বোঝা যায় প্রায় রোজই দাড়ি কাটে সে। অন্য কোনও ঘরে আছে কি তাহলে? হাতে একটা ছোট চটের থলে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ছাদে চলে আসে অশিনী, তার পেছন পেছন হৈমন্তী। ভাসানবাড়ির ছাদে সে এই প্রথম এল। মনটা জুড়িয়ে গেল তার। ছাদের চারদিকে দু’ফুট উচু পাচিল দেওয়া, সেগুলো পার করে গ্রামের বুক জুড়ে ঝোপঝাড়, জঙ্গল আর খুদে খুদে বাড়িঘর
চোখে পড়ে। উপরে অনন্ত তারাভরা আকাশ। তার বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা আকাশছোঁয়া গাছ। যেন গ্রামের মানুষজন এককালে আকাশে চড়ার জন্যই জানিয়েছিল সেগুলো, খানিকটা তৈরি করার পর কোনও কারণে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
শন শন করে হওয়া দিচ্ছে একটা। হৈমন্তীর শরীর যেন সেই বাতাস থেকেই ফুরিয়ে যাওয়া রক্ত শুষে নিচ্ছে। মাথার পিছনে বাঁধা চুলগুলো খুলে ফেলল সে। খোলা হওয়ায় নিঃশব্দ ছন্দে উড়তে লাগল তারা। ছাদের একপ্রান্তে একটা সিমেন্টের বেঞ্চ করা আছে। জনাতিনেক লোক তাতে বসতে পারে। ওরা দুজন দুপাশে বসল। অশ্বিনী চটের থলে থেকে কয়েকটা লালচে ফল বের করে মাঝখানে রাখল।
—“ওটা?” হৈমতী জ্যোৎস্নায় চিনতে পারল না ফলটা।
—“বেদানা। আপনার শরীর থেকে যা রক্ত বেরিয়েছে সেটা ফিরিয়ে আনতে এর থেকে ভালো কিছু হয় না।”
কয়েক সেকেন্ডের জন্যে ছেলেটার মুখের দিকে তাকায় হৈমন্তী, নিচু চাপা গলায় বলে, “তুমি আমার এত যত্ন নিচ্ছ কেন বলতো?”
বেদানার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে অশ্বিনী বলে, “আমার গোটা জীবনটা তো যত্ন নিতে নিতেই কেটেছে, কখনও বাড়ির কখনও মানুষের।”
—“কেয়ারটেকার?” হৈমন্তী হাসে, “এমন করে গোটা জীবন বললে যেন চার কুড়ি পেরিয়ে গেছে.”
—“আমার বয়স দেখে যা মনে হয় তার থেকে অনেক বেশি… হাত পাতুন”।
হৈমন্তীর হাতে কয়েকটা দানা তুলে দেয় অশ্বিনী। সেগুলো চিবোতে চিবোতে হৈমন্তী বলে, “আচ্ছা এই বাড়িটা ত বেশ পুরনো, কোনও লুকানো ঘর, প্যাসেজ, সুড়ঙ্গ এই টাইপের কিছু আছে?”
—“বছর ষাটেক আগেও তো লোক থাকত এখানে, তাদের সব জিনিসপত্র গেলো কোথায়?”
—”বিক্রি হয়ে গেছে নিলামে।”
—“আর যেসব জিনিস নিলাম করা যায় না? মানে ধরো বইপত্র, কাগজ, বা সেকালের যেসব ছবি-টবি ছিল? সেগুলো গেল কোথায়?”
—“আমি জানি না। হয়তো জঞ্জালের সঙ্গে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে কী করবেন আপনি?”
—“আমার কাজে লাগত।” অশ্বিনী আর কিছু বলল না। কিছু বিশেষ প্রসঙ্গে কথা বললে সে হঠাৎ করেই চুপ করে যায়। হৈমন্তীর কিন্তু মন বলছে কাগজপত্র এ বাড়িই চোথাও রাখা আছে। হয়তো সবার চোখের আড়ালে। হয়তো এমন কোনও জায়গায় যেখানে বাড়ির বাসিন্দাদেরও চোখ পড়ে না। তন্নন্তন্ন করে খুঁজলে পাওয়া যাবে কিন্তু সুযোগ কোথায়? ছেলেটাকে এসে থেকে একবারও ঘুমাতে দেখেনি হৈমন্তী। যতবার নিচে নেমেছে ততবার ওই একই দৃশ্য দেখেছে। এক মনে আয়নার দিকে চেয়ে বসে আছে অশ্বিনী। বাজার বা আশেপাশের কোথাও পাঠানো যায় তাকে, কিন্তু সেটুকু সময় তো গোটা বাড়ি খুঁজে ফেলা যায় না। অন্তত একটা দিন তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হবে। ঘুমের ওষুধ আছে হৈমন্তীর…
নিস্তব্ধতা ঘন হয়ে উঠছিল, হৈমন্তী প্রসঙ্গ পালটে নেয়, “তুমি যে বলছিলে রাতে এ বাড়ির ছাদ থেকে কিছু অচেনা তারা দেখা যায়…”
—“এখন না, আর একটু রাতের দিকে..” বেদানাটা প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে এসেছে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে হৈমন্তী, মেঘ নেই, ফাঁকা তেপান্তরের মাঠের উপরে যেন অনেকগুল উজ্জল হ্যাঁরিকেন জ্বালিয়ে রেখে গেছে কেউ।
—“আচ্ছা এই যে তারাগুলো, লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, আমাদের হাসি-কান্না-অভিমানের সাক্ষী হয়ে আছে যুগের পর যুগ, আমাদের ব্যাপারে কী ভাবে বলতো ওরা?”
—“একা লাগে ভীষণ…”
—“মানে?” উত্তরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না হৈমন্তী।
অশ্বিনীর গলার স্বর যেন দূর থেকে ভেসে আসছে, “আপনার কখনও মনে হয়নি এত বছর ধরে মানুষের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ওরা বিরক্ত হয়ে গেছে? মনে হয়নি আর জ্বলতে চায় না ওরা? ওরা নিভতে চায়? ওরা আর আপনার গল্প শুনতে চায় না? মনে হয়নি এবার বিদায় চায় ওরা ?”
হৈমন্তী কিছু উত্তর দিতে পারে না। ছেলেটাকে এমন এক নিঃশ্বাসে দমকা হাওয়ার মতো শব্দে আগে কথা বলতে শোনেনি সে। মুহূর্ত আরও ঘন হয়ে ওঠে, আবার থমথমে কণ্ঠস্বর শোনা যায়, “আপনি আমার কথার উলটো মানে বুঝেছিলেন, আমি বলিনি ভাসানবাড়ির আকাশ থেকে নতুন কোন তারা দেখা যায়…”
—“তাহলে?”
—“এ বাড়ির আকাশ থেকে বেশ কিছু তারা দেখা যায় না। যেসব তারা মরে গেছে তাদের দেখা যায় না এ বাড়ির ছাদ থেকে… একটু রাত হলে দেখতে পাবেন…”
—“যাঃ এ আবার হয় নাকি?” আকাশের দিকে তাকায় হৈমন্তী, “অন্য জায়গা থেকে দেখা যায়, এবাড়ির ছাদ থেকে দেখা যায় না? ইয়ার্কি?”
—“একটু রাত হোক, দেখতে পাবেন।” বেদানার শেষ দানাটা হাতে তুলে দিতে দিতে বলে অশ্বিনী।।
হৈমন্তী মনে মনে ভাবে ব্যপারটা যদি সত্যি হয় তাহলে তার কোনও স্বাভাবিক ব্যাখ্যা নেই। যে তারাগুলো মরে গেছে তাদেরও আমরা দেখতে পাই কারণ তাদের শেষ সময়ের আলোটুকুনির পৃথিবীতে আসতে কিছুটা সময় লাগে। তাহলে কী গোটা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র এই ভাসানবাড়িতে সময়ের গতিবেগ বেশি? কিন্তু তা কী করে হয়? শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগ বদলানো অসম্ভব। ছাদের দরজার দিক থেকে খুশখুশে পায়ের আওয়াজ আসতে চমকে ফিরে তাকায় হৈমন্তী, এতক্ষণ ভাবনায় ডুবে গেছিল সে।
দরজার কাছে একটা বেঁটেখাটো মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। চাঁদের আলোয় ছায়াটা চিনতে পারল হৈমন্তী। নিতাইবাবু। একহাতে একটা চোঙের মতো যন্ত্র, সম্ভবত দূরবীন, অন্য হাতে লাল শালুতে বাঁধানোে খাতা।
—“কাল রাইতে একখান খুন হইয়া গেসে ইদিকে.” নিতাই এর কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগে হৈমন্তীর,
অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রশ্নটা, “কী?”
—“কী নয়, কেডা। সেইডাই তো বুঝা যায় নাই এহনও। রক্তারক্তি হইয়া গেসে, বুজস? ভোজালি দিয়া মাথা আর ধড় পৃথক কোইরা দিসে..”
—“বাবা! এদিকেও শুরু হল এসব! তো লোকটার মানিব্যাগ-ট্যাগের মধ্যে কোনও পরিচয়পত্র পায়নি পুলিশ?” অশ্বিনী জিজ্ঞেস করে।
—“আইডেন্টিফিকেশোন? হালায় বডিটাই তো গায়েব হইসে… মুন্ডখান কেবল রাস্তার উপরে রাইখখা গেসে।” খাতাটা বেঞ্চের মাঝখানে রেখে চোঙটা আকাশের দিকে তুলে ধরে নিতাই, বলে, “তবে চেহারা দেইখা তো এ গ্রামের ব্যাডা বলে তো মনে হইতেসে না।” বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে ছাদের পাঁচিলের একদিকে এগিয়ে যায় হৈমন্তী, রাতের অন্ধকার মেখে শুয়ে আছে গ্রামটা। শনশনে হাওয়ার তেজ এতক্ষণে কিছুটা বেড়েছে। একটু আগে বেল আর ছাতিম ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল দূর থেকে। এখন মাংসের গন্ধ মিশেছে তাতে?
—“ব্যাপারটা গোলমেলে লাগছে,”অশ্বিনী বলে, “খুন করে মুণ্ড গায়েব করার একটা যুক্তি আছে, তাতে আইডেন্টিফিকেশান হতে একটু সময় লাগে, কিন্তু বডি গায়েব করে কী লাভ? এতক্ষণে হয়তো পুলিশ লোকটার পরিচয় পেয়েই গেছে…”
—“ভায়োল্যান্স, বুজস? ভায়োল্যান্স। মুণ্ডখান দেখায়ে আইডেন্টিফাই করা লাগবে। হুদাই কি বডী গায়েব করসে?” এতক্ষণ চুপ করে ছিল হৈমন্তী, সে থমথমে গলায় বলে, “ভাবা যায় এই
শান্ত নিরিবিলি গ্রামে একটা লোক রাতবিরেতে ছুরি হাতে লুকিয়ে আছে খুন করবে বলে ?”
—ছুরি হাতে লোক কিন্তু পৃথিবীর সব জায়গাতেই দেখা যায়, আপনি চাইলে আমি এখুনি দেখিয়ে দিতে পারি…”
—“কোথায়?” অবিশ্বাসের সুরে বলে হৈমন্তী। অশ্বিনী নিতাই-এর দিকে ফিরে হাত বাড়িয়ে দেয়, “আপনার যন্ত্রটা একটু ধার দিন তো নিতাইদা, বিড়ি ধরান বরঞ্চ একটা..”।
কথা না বাড়িয়ে দূরবীনটা দিয়ে দেয় নিতাই। অশ্বিনী সেটা হৈমন্তীর হাতে দিয়ে বলে, “নিন চোখ লাগান এতে, দেখাচ্ছি…”
—“মানে? কী দেখাবে তুমি?”
—“আহা, লাগান না…” দূরবীনটা চোখে লাগিয়ে গ্রামের দিকে তাকায় হৈমন্তী। অশ্বিনী একটা হাত দিয়ে তার আর একটা চোখ ঢেকে দিয়ে বলে, “উহ, নিচে নয়, উপরে। আকাশের দিকে তাকান।”
—“আকাশের দিকে ছুরি হাতে লোক!” বিড়বিড় করে হৈমন্তী। কথাগুলো তার ঠোটেই আটকে যায়। সত্যি ছুরি কোমরে আর তির-ধনুক হাতে একটা লোককে দেখা যাচ্ছে। আকাশের বুকে শুয়ে আছে সে। শুয়ে আছে কয়েক কোটি বছর ধরে – কালপুরুষ। মুগ্ধ হয়ে সেই আদিম অস্ত্রসজ্জিত পুরুষের দিকে চেয়ে থাকে হৈমন্তী।
—“তারাগুলো চেনেন?”
—“কোমরে গোঁজা তলোয়ারটা দেখতে পাচ্ছেন? ওর ঠিক মাঝের তারাটার নাম জানেন?” – “উহ..
—“অরিয়ন নেবুলা… ওটা আসলে তারাই নয়। হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর ধুলোর মিশ্রণে তৈরি একটা গোলা… অথচ না থাকলে কালপুরুষের তালোয়ার টা তৈরি হত না…”
হৈমন্তীর উড়ন্ত চুলের কয়েকটা এসে পড়ে অশ্বিনীর গলার কাছে। সেগুলো সযত্নে সরিয়ে রাখে ছেলেটা। নিজেও আকাশের দিকে চেয়ে আছে সে।
হৈমন্তী তাকায় কালপুরুষের চোখের দিকে। মুখের একটা ক্ষীণ আভাস ছাড়া আর কিছু নেই তার। এত বছর ধরে ওইভাবে হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কি সত্যি ক্লান্ত হয়ে যায়নি মানুষটা? আর কি শিকার করতে চায় না সে? নাকি এত বছর ধরে সেও জেগে আছে কারও অপেক্ষায় ? আর তাকে দেখতে পেলেই তার শরীরে একটু একটু করে রক্ত-মাংস ফিরে আসবে। অসংখ্য রঙের সমুদ্রের মাঝে আকাশের বুক জুড়ে দুজনে খেলে বেড়াবে তখন…। হৈমন্তী নিঃশব্দে প্রশ্ন করে, হয়তো কিছু উত্তরও দেয় কালপুরুষ। কিন্তু তাদের মধ্যেকার কয়েক আলোকবর্ষ বায়ুহীন দূরত্বে হারিয়ে যায় সে উত্তর। দূরবীনটা নিতাইয়ের হাতে আবার ফিরিয়ে দেয় সে। – “লোকটা এ গ্রামের নয় বুঝলেন কেমন করে?” জিজ্ঞেস করে হৈমন্তী।
—“গ্রামের লোকের কি আর গলার কাসে…” পরের শব্দটা হাতড়ায় নিতাই, “কালো কালি দিয়া চামড়ার কী জ্যান আঁকে আইজকাল..”
—“ট্যাটু..” – “হা, ওই একখান ট্যাটু আসে…” – “আর? আর কিছু পাওয়া যায়নি মুখে?”
একটু সময় নিয়ে নিতাই বলে, “নাকের ঠিক উপরে একখান কাটা দাগ আছে, মেলা বদখৎ দেখতে নাকি…” -“কোনটা? লোকটা নাকি ট্যাটুটা?” অশ্বিনী জিজ্ঞেস করে। – “দুইটাই… ওই ট্যাটুর একখান নামও সুনসিলাম, কী জ্যান…”
—“ডেভিল ট্যাটু..” অজান্তেই হৈমন্তীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে কথাটা।
—“সেকী! আপনি চেনেন নাকি লোকটাকে?” অশ্বিনী তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে।
—”না “
‘তাহলে নাম জানলেন কী করে?”
—“এমনি… গেস করলাম…” দুটো হাত দিয়ে সজোরে ছাদের পাঁচিলটা চেপে ধরেছে হৈমন্তী। এত জোরে যে বুড়ো আঙুলের নখ বেশ কিছুটা চামড়া ছাড়িয়ে উঠে এসেছে। একটা চাপা যন্ত্রণা যেন রক্তের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে।
—“আমি ওরকম কাউকে চিনি না…”