ভাসানবাড়ি – ৩

তৃতীয় অধ্যায়

জল দিয়ে সবে ধুয়েছে মুখটা। এখনও মোছা হয়নি। টপটপিয়ে জল পড়ছে মুখ থেকে। এমন সময় দরজায় খটরমটর আওয়াজ।

—“শুনছেন? চা এনেছি আপনার জন্য…”

—“দাঁড়ান, খুলছি.” মুখটা না মুছেই এগিয়ে এসে দরজাটা খুলে দেয় হৈমন্তী। চায়ের প্লেট হাতে অখিনী ঘরের ভিতরে এসে ঢোকে,

“চিনিটা একদম আন্দাজে দেওয়া, ভাবলাম একবার ডেকে জিজ্ঞেস করি কতটা চিনি খান, তারপর ভাবলাম এত তুচ্ছ কারণে ডাকলে যদি রেগে যান…” দাঁড়ানো অবস্থাতেই কাপে একটা চুমুক দেয় হৈমন্তী,

“আঃ, পারফেক্ট।”

অস্বিনীর মুখে হাসি ফোটে, প্লেটটা টেবিলের উপরে রেখে সে ঘর থেকে বেরনোর উপক্রম করে। হৈমন্তী থামিয়ে দেয় তাকে।

—“তাড়া আছে নাকি?”

—“তেমন না, আসলে একটু বাজার করতে যেতে হবে। চাল-ডাল বাড়ন্ত।”

—“আপনি নিজে বাজার করেন ?”

—“রোজ না, গনশা বলে একটা ছেলে আছে, ওই এনে দেয়। তবে আজ আপনি এসেছেন, শুধু চাল ডাল হলেই তো আর হল না।”

গম্ভীর মুখে পকেটে হাত চালিয়ে সিগারেট বের করে আনে হৈমন্তী, “আমার জন্য স্পেশাল আয়োজন ? তা কী কী রান্না করতে পারেন?

এতক্ষণে হৈমন্তীর মুখে আপনি সম্বোধন’টা বেমানান লাগতে শুরু করেছে। ছেলেটা তার থেকে তো ছোট, তুমি বলতে অসুবিধা নেই কোনও। কিন্তু আচমকা সেটা বলতে শুরু করলে কেয়ারটেকার বলে তাচ্ছিল্য করছে ভেবে হতে পারে ছেলেটা।

—“আপনি তো দু’সপ্তাহ আছেন, সারপ্রাইজ থাক না হয়।” দেশলাই দিয়ে অগ্নিসংযোগ করতেও কিন্তু জ্বলল না সিগারেটটা, হৈমন্তী বিরক্ত হয়। কাল জল লেগে কি ড্যাম্প খেয়ে গেছে?

—“এটা জ্বলবে, দেখুন… ছেলেটা কোথা থেকে যেন একটা সিগারেটের বাক্স বের করে এগিয়ে দেয় তার দিকে। হৈমন্তী একটু অবাক হয়, “আপনি সিগারেট খান নাকি?”

—“আজ্ঞে না।”

—“তাহলে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন যে।” ছেলেটা এইরকম ঠান্ডা গলায় বলে, “ভাবলাম যদি আপনি খান আর কি আমি এসে থেকে তো এবারও খাইনি তোমার সামনে, জানলে কী করে যে আমি সিগারেট খাই?” ছেলেটা মৃদু হাসে, “আমি তো এও জানি, আমাকে আপনি বলতে অস্বস্তি হচ্ছে আপনার। নেহাত আমি কেয়ারটেকার বলে সংকোচ বোধ করছেন।” সিগারেটটা জ্বালাতে গিয়েও থেমে যায় হৈমন্তী,

“তুমি তো ভারী ইন্টারেস্টিং ছেলে হে মাইন্ড রিডিং পারো না কি?”

—“ওই একটু আধটু…” অশ্বিনী সলজ্জ মুখে বলে।

“বাঃ, আর কী বুঝতে পারছ আমার সম্পর্কে?” সিগারেটে একটা টান দিয়ে ভুরু তুলে জিজ্ঞেস করে হৈমন্তী।

হৈমন্তীর কপালের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকায় ছেলেটা, গড়গড় করে বলে যেতে থাকে, “আপনি অবিবাহিত, বা খুব অল্প সময়ের জন্য বিয়ে করেছিলেন।ছোটবেলায় মা-বাবার সঙ্গে ঘুমাতেন না, একা ঘুমাতেন, গায়ে হাতে পায়ে কিছু দাগ আছে মনে হয়, কিছুটা অলস, চুল নিয়ে ভীষণ কনসাস… আর.”

—“হাউ ডু ইউ ডু দ্যাট?” প্রায় দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিল হৈমন্তী। ছেলেটা রহস্যময় হাসে,

“আহা বসুন, উত্তেজিত হবেন না।”

—“সে হব না, আগে বলল কী করে জানলে?” ছেলেটা একটা আঙুল দিয়ে হৈমন্তীর বিছানাটা দেখায়,

“দেখুন, বিছানার একেবারে মাঝখানটা কুঁচকেছে, ধারের দিকগুলো টানটান, মানে সারারাত আপনি বিছানার একেবারে মাঝখানে শুয়েছিলেন। সাধারণত যারা ছোট থেকে কারও সঙ্গে বিছানা শেয়ার করে আসে তারা এভাবে মাঝখানে শোয় না, কারও জন্য জায়গা ছেড়ে একটা ধার ঘেঁষে শোয়। বিশেষ করে বিবাহিত মানুষদের পক্ষে তো সম্ভবই না। একা শুলেও অবচেতনে তারা কারও জন্যে বিছানা ছেড়ে শোয়।”

—“আই এম ইমপ্রেসড, আর বাকিগুলো?”

—“সকাল হয়ে গেছে কিন্তু বিছানা তোলেননি, তাছাড়া আপনি কাল এখানে এসেছেন এখনও ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করেননি, মানে রিসার্চের কাজও শুরু করেননি; অর্থাৎ অলস। আপনার আলনার দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সমস্ত জামা কলারওয়ালা, মানে কাঁধে বা গলার কাছে কোনও দাগ আছে যেটা কাউকে দেখাতে চান না.”

—“আর চুলের ব্যাপারটা?” এবার হেসে ফেলে অশ্বিনী, “আপনি আজ পর্যন্ত এমন কোনও মেয়ে দেখেছেন যে নিজের চুলের ব্যাপারে কনসাস না?”

—“বাবা! মেয়েদের ব্যাপারে ভালো জ্ঞানগম্যি আছে দেখছি, তা গার্লফ্রেন্ড জোটেনি এখনও?”

প্রশ্নটা শুনে আচমকাই গম্ভীর হয়ে যায় ছেলেটা, মুখ নামিয়ে বলে, “আমি যাই এখন, বাজার করতে হবে, বেলা বাড়লে ভালো সবজি আর পাওয়া যাবে না।”

—“আমি গেলে আপত্তি আছে কিছু?” হৈমন্তী সিগারেটে আর একটা টান দিয়ে বলে,

“সবজিপাতি বয়ে দিতে পারি, আর জায়গাটাও খানিক দেখা হয়, তাছাড়া…”

—“সাতসকালে অলস বলে দাগিয়ে দিলে, কিছু তো একটা করা দরকার.” একটু কৌতুক করে বলে হৈমন্তী।

—“বেশ, আপনি তৈরি হয়ে নিন, আমি ডাক দিচ্ছি।” বলে নিচে নেমে যায় অশ্বিনী। হৈমন্তী সিগারেটটা শেষ করে বিছানার উপরে ফিরে আসে। ব্যাগের ভিতর থেকে ল্যাপটপটা বের করে আনে। অস্মিতা এর মধ্যে বেশ কটা মামুলি মেসেজ পাঠিয়েছে। সেগুলোর আর জবাব দিতে ইচ্ছে করে না। ল্যাপটপ খুলে প্রথমে মেইল চেক করে, একটা নতুন ই-মেইল এসেছে, সেটার রিপ্লাই দেয়, আজ থেকে কাজ শুরু করব, জিনিসটা যেখানেই থাক টোটালি আনগার্ডেড অবস্থায় আছে। আশা করি খুব একটা বেগ পেতে হবে না।

মেইল বন্ধ করে ডকিউমেন্ট ফোল্ডারে ফিরে আসে। এই ভাসানবাড়ি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে সেটা পয়েন্ট করে রাখা আছে সেখানে। তার উপরেই আর একবার চোখ বুলিয়ে নেয় হৈমন্তী।

মোটামুটি আঠেরোশো ষাটের আশেপাশে মুরারিমোহন মানে এক জ্যোতির্বিদ কলকাতা থেকে এসে এই বাড়ি বানান। সে সময়ে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং। এই মুরারিমোহন ছিলেন ক্যানিংয়ের অত্যন্ত কাছের একজন।

তার একটা কারণও ছিল, সে সময়ে ভারতের মহাকাশ গবেষকদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন মুরারিমোহন। সাইন্স জার্নালে তার নামও পাওয়া যায় বেশ কয়েকবার। কিন্তু ওই আঠেরোশো ষাটের পর থেকেই যেন লুকিয়ে পড়েন মুরারিমোহন। অর্থাৎ এ বাড়িতে এসে বসবার শুরু করার পর থেকেই নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নেন যেন। ভারতে আসার আগে আঠেরোশ সাতচল্লিশ নাগাদ ব্রিটেনের জাদুঘর পরিচালন সমিতির সদস্য ছিলেন ক্যানিং। গোটা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা কয়েক লক্ষ প্রাচীনপুঁথি আর আর্টিফ্যাক্টের আঁতুড়ঘর ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়াম। শোনা যায় সেখান থেকেই মহাকাশ বিজ্ঞান সংক্রান্ত কোন আর্টিক্যাক্ট ভারতে নিয়ে আসেন ক্যানিং। সেটা তিনি তুলে দেন মুরারিমোহনের হাতে। তবে এ-সবই প্রাচীন গুজব। সম্ভবত আরবান মিথ। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে হৈমন্তী। সত্যিই কি লর্ড ক্যানিঙের হাতে করে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কোনও গোপন সম্পদ এসে পৌঁছেছিল মুরারিমোহনের হাতে? যদি এসে থাকে তবে সেটা নিয়ে কী করেছিলেন মুরারিমোহন? এবং তার থেকেও বড় কথা, জিনিসটা কি এখনও এই বাড়িতেই আছে?

ভাসানবাড়ির চারপাশটা নির্জন,দুপাশে বুনো গাছের সার ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ে না। কারুকাজ করা যে পাঁচিলটা দিয়ে চৌহদ্দিরা ঘেরা সেটা কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। লোহার রড় বেরিয়ে পড়েছে সেখান থেকে। সেই ভাঙা জায়গার ফাঁকে ফাঁকে শুকনো শ্যাওলার আস্তরণ জমে আছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ভ্যান রিকশা দাঁড় করাল অশ্বিনী। হৈমন্তী এর আগে কোনওদিন ভ্যানে ওঠেনি। উপরে চড়ে বসতে বেশ অসুবিধা হল তার। তবে মানিয়ে নিল কোনওরকমে। মাটির রাস্তার উপরে চাকার ঘটঘট শব্দ করে চলতে লাগল গাড়ি। এ গ্রামে এসে থেকে হৈমন্তীর মনটা ভিজে আছে, এখানে কলকাতা শহরের ধোঁয়া আর কলকজা নেই, রাস্তার দু পাশ জুড়ে এবড়ো-খেবড়ো ঘাসে ঢাকা জমির উপরে লম্বা লম্বা ঘাস, পথের ধারে কলতলা, দীঘি আর তার মাকে একটা দুটো কুড়ে ঘর। কোথাও আবার পাকা বাড়ি।

—“আচ্ছা, একা একা এখানে থাকতে বোৱ লাগে না তোমার?” রাস্তার দিকে চোখ রেখেই জিজ্ঞেস করে হৈমন্তী।

—না, আপনার লাগছে?”

—“আমি তো কাজে এসেছি, কাজ নিয়ে থাকলে আর বোর লাগবে কেন ভালো কথা, নিবারণবাবু কোথায় আছেন বলতো?”

—“আমাদের বাড়ির আর একটু ভিতরের দিকে।”

—“ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করা দরকার, কয়েকটা ইনফরমেশান জানার আছে, নাহলে কাজ এগোবে না।”

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ছেলেটা উত্তর দেয়, আপনার যা জানার আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন, এ বাড়ির ব্যাপারে বাবার থেকে অনেক গল্প শুনেছি।”

—“বটে!” ডানহাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে ঠেলে দেয় হৈমন্তী,

“কতদিন হল দেখছ বাড়িটা ?”

—“জন্ম থেকেই।”

—“মানে বছর তিরিশেক?

এবার গলাটাকে একটু ভারী করে নেয় হৈমন্তী, “আর নিবারণবাবু?”

—“বাবাও জন্ম থেকেই এখানে আছেন। বাবার বয়স ধরে নিন ষাট…” হৈমন্ত মনে মনে হিসেব করে, উনিশশো ষাট। মুরারিমোহন সম্ভবত মারা বান আঠেরোশো নই নাগাদ। মাঝের এই সত্তর বছরের হিসেব জানে এমন কাউকে খুঁজতে হবে।

—”নিবারণবাবুর আগে এ বাড়ি কে দেখাশোনা করতেন?”

অশ্বিনী ঠোট উল্টায়, “বাবার আগে পাঁচবছর বাড়িটা ফাঁকা পড়েছিল, শুনেছি তখন থেইে কোর্টে কেস চলছে। তার আগে তো লোক থাকত এখানে। যিনি এ বাড়ি তৈরি করেছিলেন তার বংশধররা।”

—“বটে। কিছুক্ষণের জন্যে গভীর ভাবনায় ডুবে যায় হৈমন্তী। মাটি এখন আগের থেকে আরও একটু বেশি অমসৃণ হয়ে পড়েছে। ঘটঘট শব্দটা বেড়ে গেছে তুলনায়। জোর করে মুখে একটা কৌতুকের ভাব আনে হৈমন্তী, “আচ্ছা এইসব প্রাচীন পরিত্যক্ত বাড়িতে তো শুনেছি অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, নিরারণবাবু বা তুমি তেমন কিছু দেখোনি কোনওদিন?” আচমকাই একটা ঝাকা খায় ভ্যানটা, হৈমন্তীর শরীরটা অনেকটা সরে আসে অশিনীর দিকে, দুটো মুখ কাছে এসে পড়ে, একটা কফিজাতীয় গন্ধ এসে প্রবেশ করে হৈমন্তীর নাকে।

—“আপনি বিশ্বাস করেন, ভূতে?” অশ্বিনী জিজ্ঞেস করে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে হৈমন্তী, গোটা ভ্যানটা দুলে উঠেছিল এইমাত্র। চালক, হৈমন্তী এবং বসার পাটাতনগুলোও প্রায় কয়েক ইঞ্চি লাফিয়ে উঠেছিল নিজেদের জায়গা থেকে, অথচ অশ্বিনীর শরীরে কোনও হেলদোল নেই। ধাক্কাটা যেন এসে লাগেইনি তার শরীরে।

—“উহ.. যা দেখিনি তা বিশ্বাস করব কেন?”

—“আজ রাতে দেখলে বিশ্বাস করবেন?”

—“মানে.” হৈমন্তী জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলে।

—“আজ রাতে ঠিক দেড়টা নাগাদ ছাদে চলে আসবেন। আপনি বাঙাল ভাষা জানেন?”।

হৈমন্তী হাসে, “কেন? তোমার ভূত বাঙাল নাকি?”

—“না, তবে নিতাইদা বাঙাল, একেবারে ঢাকাইয়া…” কথা শেষ হবার আগেই থেমে যায় ভ্যানটা, একটা ধুতিপাঞ্জাবি পরা বেঁটেখাটো মাঝবয়সী লোক হাত দেখিয়ে দাঁড় করিয়েছে ভ্যানটা, লোকটার মুখে পান, রাস্তার একধারে পিক ফেলে এগিয়ে আসে সে ভ্যানের দিকে,

“অত হরবড় করনের কী আসে? ধীরে চালাইতে পারো না? কই যাবা?”

—“আমরা তো বাজার যাচ্ছি নিতাইদা, আপনিও চলুন না?”

—“তুমি বেশি কথা কইবা না পোলা, তমারে কি আমি জিগাইসি?” ধমক দেন নিতাই, চালকের দিকে তাকিয়ে বলেন,

“শুনো, পুলাপানগো বাজারে ড্রপ কইরা আমারে পোস্ট আপিসে লইয়া যাবে। বুঝস?”। চালক মাথা নেড়ে দেয়। ধুতি গুটিয়ে ভ্যানে উঠে পড়ে নিতাই। লোকটার কথার মধ্যে কেমন একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুক আছে, হৈমন্তীর মনটা হালকা হয়ে যায়।

ভান টা আবার একটা বিকট গর্জন করে চলতে শুরু করে। নিতাই হৈমন্তীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, মন দিয়ে পান চিবাতে চিবাতে বলে, “মাইয়া কেডা?”

—“কলকাতা থেকে এসেছেন আমাদের ভাসানবাড়ি নিয়ে রিসার্চ করতে”।

—“রিসার্চ! মানে সাইন্টিস্ট?” হৈী ছুি বলতে যাচ্ছিল, অশ্বিনী হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়, “হা, নাম করা বিজ্ঞানী। মহাকাশ গবেষণা করেন। আমাদের নিতাইদার আবার এ অঞ্চলে জ্যোতিষী বলে একটা খ্যাতি আছে।” ছলনার হাসি হাসে

—“তাই নাকি! আপনি হাত দেখতে পারেন?” হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে।

—“হাত না, মুখ। মানুষের মুখ দেখে গড়গড় করে সব বলে দেন…” হৈমন্তী উৎসাহিত হয়ে ওঠে, “তাই নাকি? আমার মুখ দেখে বলে দিতে রিকোয়েস্ট করে দেখুন, কখন কী মুডে থাকেন বলা তো যায় না, ও নিতাই, হবে নাকি একবার?” নিতাই পকেট থেকে বের করে একটা বিড়ি ধরিয়েছে এতক্ষণে। প্রাণের আরামে একটা টান দেয় তাতে, তারপর অশ্বিনীর দিকে চেয়ে বলে, “তোমার মুখখান জানি না ক্যান একদম বুজি না, এদ্দিন দেখসি, ঘুরঘুর করতিসো চোখের সামনে অথচ বেবাক ফাঁকা। জ্যান সৃষ্টিকর্তা কিছুই লেখে নাই। ব্ল্যাঙ্ক

চাপা গলায় হৈমন্তী বলে, “আমারও কিন্তু তাই মনে হয় বুঝলে, তোমাকে উপর থেকে যা মনে হয় আদৌ তুমি তা নয়, ভিতরে অন্য কিছু আছে।”

—“এত তাড়াতাড়ি বুঝে গেলেন?” হৈমন্তী চোখ টেপে,

“একটু সময় দাও, আরও বুঝে যাব, এই বাড়িটাকেও আর তোমাকেও…”

একটু উদাস দেখায় অশ্বিনীকে, নিতাই মুখ ফিরিয়ে বলে, “শুনো মাইয়া, রিসার্চ বলল আর যাই বলল, ও বাড়ির আসল কানেকশন হইল এস্ট্রোলজির লগে, ভাসানবাড়ির ছাতে গিয়ে দাঁড়াইলে এমন কিছু তারার দেখা পাবা যা তুমি অন্য কুথাও হতে পাবা না।”

—“বলেন কী! শুধু ছাদ থেকেই দেখা যায়?”

—“আর সেই জন্যেই নিতাইদা মাঝে-মাঝে খাতাপত্র নিয়ে ছাদে গিয়ে কীসব গণনা করেন। ও বাড়ির ছাদ থেকে নাকি অন্যরকম আকাশ দেখা যায়।”

হৈমন্তীর ভুরু দুটো কুঁচকে যায়। সে আর কিছু বলে না। আবার ভ্যানের শব্দ প্রকট হয়ে ওঠে। মিনিটখানেক পরেই বাজারের সামনে এসে দাঁড়ায় ভ্যানটা। অশ্বিনী নিচে নেমে ঝোলা ব্যাগগুলো নিজের হাতে নিয়ে নেয়। ভাড়া মেটাতে-মেটাতে বলে, “আপনি কী খেতে ভালোবাসেন? মাছ না মাংস?”

—“মাইন্ড রিডিং করে বের করবে পারবে না এটা?” ইটের উপরে পা রেখে বলে হৈমন্তী।

ঠোট দুটো ফাঁক হয় ছেলেটার, হাসিটা অর্থপূর্ণ, বলে, “চলে আসুন। মশলাপাতি কিনতে হবে আগে।”

—“কী কিনবেন ঠিক করতে পারলেন না?” অশ্বিনী সামনে হাঁটতে-হাঁটতে বলে, “কোনটাই লাগবে না। বাড়িতে মাটন আছে, কালই গনশা কিনে দিয়ে গেছে।”

—”আপনি কী করে জানলেন আমি মটন ভালোবাসি?”

এবার কিন্তু সত্যি একটা সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে হৈমন্তীর মনের ভিতরে। ছেলেটা তার সমস্ত কথা এত সহজে জেনে যাচ্ছে কী করে? থট রিডিং বলে আদৌ কিছু হয় বলে সে বিশ্বাস করে না।

—“দিদি ব্যাগ নেবেন? ভালো ব্যাগ আছে…”

—“রবারের চটি, হরেক মাল পঞ্চাশ টাকা…” একটা গলা কাটা মুগীর শেষ চিৎকার শোনা গেল, একটা মাছের মাথাকে মাঝখান থেকে ফাঁক করে দিল একটা ধারালো আঁশবটি..

এগোতে গিয়েও পা বাড়াতে পারল না হৈমন্তী। তার মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে, চারদিক থেকে ভেসে আসা ডাকগুলো পাক খেতে লাগল ওকে ঘিরে। এমন হচ্ছে কেন? চারদিকের পৃথিবীটা এমন বন্ধ করে ঘুরতে শুরু করেছে কেন?

পায়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তার ক্লান্ত শরীরটা নেমে আসছে মাটির কাছাকাছি। অনুভব করল কাঁধ থেকে কলারটা সরে গেছে, কাঁধে শুকনো ছোপগুলো বেরিয়ে পড়েছে রোদের আলোয়। চারপাশ থেকে অনেকগুলো চোখ চেয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে আছে কাঁধ বুক আর কোমরের দাগগুলোর দিকে।

হঠাৎ চারপাশ থেকে একটা উষ্ণ অনুভূতি ঘিরে ফেলল ওকে। একটা সালের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে হৈমন্তী। সেই সঙ্গে একটা মানুষের শক্ত শরীর – একটা বুক। বুটা চেনে হৈমন্তী, এর স্পর্শে আগেও চমকে উঠেছে সে। এবার আর চলো না বরং আঁকড়ে ধরল এবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *