ভাসানবাড়ি – ২০

বিংশ অধ্যায়

সন্ধ্যার সময়। ভাসানবাড়ির সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় নিতাইচরণ। বাড়িটা আগের থেকে কিছুটা বেশি ভেঙে গেছে। যেন বয়সের ভারে ক্লান্ত এক বৃদ্ধের হাড় বের করা পাঁজর।

প্রায় তিন মাস হল নিতাইচরণের আর এ বাড়িতে আসা হয়নি। নিজের বাড়িতে মেলা কাজ থাকে তার। নিবারণের খবরও নেওয়া হয়নি।

মত বদলে একবার বাড়ির ভিতরে ঢুকে তার সঙ্গে দেখা করে আসবে বলে ঠিক করে নিতাইচরণ। সত্যি বলতে ছেলেবেলায় নিবারণের সঙ্গে এক নাড়ীর টান ছিল তার। কবে জীবনের নিয়মে সে টান আলগা হয়ে গেছে বোঝাই যায়নি। আজ পুরনো বন্ধুত্বের কথা ভেবে নিতাইয়ের মনটা উদাস হয়ে গেল।

বাগান পেরিয়ে দরজার কাছে আসতেই একটা গন্ধ পেল নিতাই। চেনা একটা গন্ধ, কেরোসিন। বাগানের কোথাও কি তবে কেরোসিনের বোতল উল্টেছে?

চারিদিকে তাকিয়ে দরজা দিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে আসে নিতাই। একতলা থেকে কোনও সাড়াশব্দ আসছে না। আসেও না অবশ্য। তাও একবার অশ্বিনীর ঘরে উঁকি দেয় কেউ নেই।

একতলার গোটাটা দেখে নিয়ে উপরে উঠে আসে। উঠতে উঠতে তার কপালের রেখায় কতগুলো ভাঁজ পড়ে। কেরোসিনের গন্ধটা এখানেও পাওয়া যাচ্ছে। বরঞ্চ আর একটু বেশি জোরালো। দু জায়গাতেই কি বোতল। উল্টেছে?

হৈমন্তীর ঘরে এসে টোকা দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় সে খেয়াল করে ঘরের দরজা খোলা। বিছানার ঠিক উপরে দরজার দিকে মুখ করেই বসে আছে নিবারণ। যেন তার জন্যেই অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে একটু অবাক হয় নিতাই। এমন দরজা খুলে তো বসে থাকে না সে।

নিতাইকে দেখেই নিবারণের মুখে হাসি খেলে যায়, “মনে হচ্ছিল ব্যাটা, তুই আসবি…”

—“সমুন্দির পো, আর এইটা মনে হয় নাই যে গোটা বাসায় কেরোসিন ছড়ায়ে আছে?”

—“কেরোসিন! সে কী রে!”

—“হ, গন্ধ নাকে আসতেসে।” একটু রাগ দেখিয়েই কথাগুলো বলে নিতাই, “একখান দিশ্লাই জ্বালায়ে দিলেই আগুন জ্বলব বাড়িময়…”

—“দাঁড়া দেখছি।”নিবারণ দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে একবার ঘুরে আসে চারদিকটা। তারপর আবার হৈমন্তীর ঘরে ফিরে এসে নিতায়ের দিকে না তাকিয়েই বলে, “মনে হয় ছাদের ধারে কেরোসিন রেখেছিল কেউ। সেটাই খসে বাগানে গিয়ে পড়েছে?”

—“তাইলে গন্ধ বাড়ির ভিতরে আসে ক্যামনে?”

—“দেখছি, তুই আয় আমার সঙ্গে।” দু’জনে মিলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। নিতাই ছাদের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “বাকি দুইজন কুথায়?”

—“বের হয়েছে। দিদির..” বাকি কথাটা বলতে গিয়ে একটু থামে নিবারণ, “মনে হয় আর বাঁচবে না।”

একটা বড় নিঃশ্বাস নেয় নিতাই, “তা আমরাই বা আর কয়দিন? চুলগুলা তো সব পাইক্কা গেল…”

—“হ্যাঁ, সে তো আর আজকের কথা নয়… পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেল, সেই বটগাছটার কথা মনে আছে তোর? যেটার ডালে টায়ার বেঁধে দোল খেতাম আমরা?”

—“আর বছর বন্যায় সেখানাও তো ভাইস্যা গেল। সুট থিকা দেকসি, কত ঝড়-জল, বন্যা পাড় কইরা দিসে… বয়স হইলে আর কিছু কওন যায়রে ভায়া…”

সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ছাদে উঠে আসে দুজনে। দুজনের নাকেই আসে গন্ধটা। এখানে জোরালো হাওয়া দিচ্ছে বলে গন্ধের তীব্রতা একটু বেশি। দু’জনে মিলে একবার ভালো করে দেখে ছাদটা। তেমন কিছুই পাওয়া যায় না কোথাও। ক্লান্ত হয়ে দুই বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায় ছাদের ধারে। একজনের গোটা জীবন লেগে আছে তারাদের গায়ে, অন্যজনের সময় বয়ে গেছে পায়ের নিচের বৃদ্ধ বাড়িটার ইট পাথরে। আপাতত দু’জনের দৃষ্টিই দিগন্তরেখার দিকে স্থির। যে ত্রিলকেশ্বর এই দুনিয়ার গোপন কলকব্জা নেড়ে তাকে পরিচালনা করে থাকেন তিনিই যেন দু’ভাগে ভাগ হয়ে দেখতে এসেছেন তার কর্মক্ষেত্র।

দুজনের কারো মুখে কথা ফোটে না। এই গ্রাম, এই বাড়ি, এই জনমানবহীন পথ, ওই রহস্যঘেরা জঙ্গলের সার-সবই যেন ওদের ছেলেবেলার কোনও ফুরিয়ে যাওয়া বিকেলের উপর টেনে দেওয়া একটা পর্দা। সেটাকে ছিড়তে পারলেই সব আবার পঞ্চাশ বছর আগে ফিরে যাবে।

—“জাইগ গা…” বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে বলে নিতাই, “স, নিচে গিয়া..”

—“আমাকে ক্ষমা করো নিতাইকাকা…” নিবারণ থমথমে গলায় বলে।

—“নিতাইকাকা! তোর কি মাথাখানা পুরাই গেসে?”

—“আমার কাছে আর কোনও উপায় নেই।”

—“তুই কী বলতেসিস..”

একটা হাত দিয়ে নিতাইকে ঠেলে দেয় নিবারণ। অস্ফুট আর্তনাদে ছিটকে পড়ে বৃদ্ধ। তারপর নিজেও লাফ মারে নিবারণ…

* * * *

—“এই… তুমি ঘুমিয়ে পড়লে?” অশ্বিনীর গায়ে ঠেলা দেবার চেষ্টা করে হৈমন্তী। তার গলা দিয়ে এখন প্রায় শব্দ বের হয় না। দীর্ঘ, প্রলম্বিত নিঃশ্বাসের শব্দ মিটারখানেক দূর থেকেও শোনা যায়।

চটক ভাঙে অশ্বিনীর ,ঘুরে তাকায় হৈমন্তীর দিকে, “ঘুমাইনি হৈম, বলো কী বলবে…”

—“তুমি এভাবে ঘুমিয়ে পড়লে আমার ভীষণ ভয় লাগে।”

—“কীসের ভয়?” হৈমন্তী উত্তর দেয় না। ঢিবির ঢালের উপর অশ্বিনীর হাতে মাথা রেখে চুপ করে শুয়ে থাকে। রাত কটা বাজে খেয়াল নেই। চাঁদ দূরের কথা, আজ তারাগুলোও ঢেকে গেছে মেঘের আড়ালে। সেদিনের মতো আজ আর আলেয়া দেখা যাচ্ছে না। শুধু কয়েকটা জোনাকি জ্বলছে সেখানে।

—“গনশাটার জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব…” বিড়বিড় করে হৈমন্তী। বড় হয়ে কী যে করবে… “আচ্ছা তোমার কথা যদি বলে ফেলে কাউকে?”

—“বলবে না। ও আমার কথা জানে না সেভাবে। আর জানলেও সবটুকু বোঝেনি।”

—“আর নিবারণকাকা, নিতাইকাকা…” হৈমন্তীর চুলে হাত বুলিয়ে দেয় অশ্বিনী, “চিন্তা করো না। ওরাও বলবে অন্য কাউকে…”

অশ্বিনীর আঙুলের ফাঁকে নিজের সব কটা আঙুলকে গচ্ছিত রাখে হৈমন্তী, বলে, “মানে আমরা এখান থেকে চলে গেলে আর কেউ জানবে না আমাদের কথা ? তোমার কথা?”

অশ্বিনী ঘাড় নাড়ে, “না। কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। শুধু আপনি আর আমি জানব।”

—“আমি চলে গেলে তুমি আর থাকবে না এখানে, তাই না?” অশ্বিনীর চোখের দিকে চায় হৈমন্তী।।

—“না, আমার আর কী আছে এখানে?”

—“কোথায় থাকবে?”

এবার সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে অশ্বিনী। একটা আঙুল আকাশের দিকে তুলে কালপুরুষের তীরের পাশটা দেখিয়ে বলে, “এতকাল যেখানে ছিলাম, অপেক্ষা করব আপনার জন্য…”

কেশে ওঠে হৈমন্তী। রক্তে ঠোট ভিজে যায় তার। উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে, “বাড়ি নিয়ে যাবে?”

—“চলুন।” দু’হাতে তাকে কোলে তুলে নেয় অশ্বিনী। তারপর হাঁটতে থাকে জলাজমিটার উপর দিয়ে। ভেজা ঘাসে ওর পা ভিজে যায়। হৈমন্তীর চোখ দুটো বুজে যায়। আধো ঘুমে শুধু এটুকু বুঝতে পারে অশ্বিনীর বুকের কাছে ওর মুখটা আছে। হৃৎপিণ্ডের শব্দ কানে আসছে। অশ্বিনীর বেঁচে থাকতে এ শব্দের দরকার পড়ে না। তাও কী ভীষণ শান্তি দেয় ওকে শব্দটা।

—“আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে…” হাত দিয়ে রক্ত মুছতে মুছতে বলে হৈমন্তী। কথাগুলো রাতের হাওয়ায় ভেসে যায় কিছুদূর।

—“তাই! কী করে বুঝলেন?”

—“তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা করছে খুব, আর পাঁচটা মানুষের মতো। ঝগড়াঝাটি করব, মান-অভিমান হবে, মারপিট হবে…

—“কী যে বলেন, আমি ঝগড়া করতে পারি না।”

—“বেশ তো, আমি শিখিয়ে দিতাম। তারপর করতাম দু’জন মিলে।”

—“শিখিয়ে দিন। চেষ্টা করি।”

হৈমন্তী কী ভেবে একটু ঘাবড়ে যায়, বলে, “এই ভালো ঝগড়া করার টেকনিকটা মেয়েদের সিক্রেট, জাননা? জোরে জোরে বললে ফাঁস হয়ে যাবে কানটা এদিকে আনো।”

হৈমন্তীর শরীরটা আর একটু উপরে তুলে মাথা হেলিয়ে কানটা নিচে করে অশ্বিনী। হৈমন্তী কানের কাছে আনে ঠোঁট দুটো। আলতো করে ছুইয়ে দেয় গালে। ফিসফিসিয়ে বলে, “এভাবে ঝগড়া করব সারাজীবন।” অশ্বিনীর মুখ থমথমে হয়ে গেছিল। গালের লালচে রঙ কমে আসে কয়েক সেকেন্ড পরে।

আগের মতোই হাঁটতে-হাঁটতে বলে, “এটা ঝগড়া হলে আপনার মান-অভিমান আর মারপিট কেমন হবে কে জানে…”

—“আনরোম্যান্টিক শালা।” একটা হাত দিয়ে অশ্বিনীর বুকে একটা ধাক্কা দেয় হৈমন্তী।

—“এটা অভিমান?”

রেগে যায় হৈমন্তী, “অস্মিতা ঠিকই বলেছিল এ গ্রামে দু’ধরনের মানুষ আছে, পার্ভাট আর চুতিয়া।”

—“ওর মধ্যে আমি কোনটা?”

—“তুমি খুব ভালো…” চোখ বুকে অশ্বিনীর হাতে মাথা রাখে হৈমন্তী, “আর আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।”

ভাসানবাড়ির সামনে এসে একবার দরজার কাছে তাকায় অশ্বিনী। দুটো মানুষের দেহ পড়ে আছে। খানিকটা রক্তও ছড়িয়ে আছে তাদের চারপাশে। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে হৈমন্তীকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে আসে সে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে থাকে।।

হৈমন্তীর ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় বুকের কাছ থেকে একটা শব্দ শুনতে পায়, “উঁহু, ঘরে না… ছাদে যাব।”

—“এই তো বাইরে থেকে এলেন, এক্ষুনি আবার ছাদে?”

দাঁতের ফাঁকে হাসে হৈমন্তী, “নিজের পায়ে হাঁটতে না হলে ওরকম ইচ্ছা হয় মানুষের ,চলো চলো।” আবার সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে আসে অশ্বিনী। মেঝেতে একটা মাদুর পাতা ছিল আগে থেকে। তার উপরে শুইয়ে দেয় হৈমন্তীকে। পাশে বসে পড়ে একটা হাত আঁকড়ে ধরে দু’হাতে। একটু আগে মেঘে ঢেকে ছিল আকাশ, এখন ধীরে ধীরে তারা ফুটতে শুরু করেছে তাতে। এই তিনমাসে কত তারার নাম জেনেছে হৈমন্তী, একমনে চুপ করে বসে শুনেছে অশ্বিনীর কথা। ওদের ফেলে আসা জীবনের কথা। কয়েক লক্ষকোটি বছরের জমানো কথা যেন এই তিনমাসের জন্য জমিয়ে রেখেছিল অশ্বিনী। হৈমন্তী চুপ করে শুনে গেছে কেবল। গল্প শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে যায় হৈমন্তী। সব গল্প শোনা হয়না।

মাঝরাতে ঠান্ডায় ঘুম ভেঙে গেলে তাকিয়ে দেখে অশ্বিনী ওর হাতটা ধরে বসে আছে পাশে। আপন মনে কী যেন ভেবে চলেছে ছেলেটা।

আজ অন্যদিনের থেকে একটু বেশি চুপচাপ অশ্বিনী। হাওয়ার দমকে পাঞ্জাবির বুকের বোতামটা খুলে গেছে। শালটা খসে পড়েছে গা থেকে। খেয়াল করছে না ছেলেটা। দূরের দিকে তাকিয়ে যেন কিছু দেখতে দেখতে হারিয়ে গেছে চোখ।

—“আমার না… গনশাকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব… অনেকদিন তো আসেনি এখানে, ডেকে আনবে একবার?” হৈমন্তী জড়ান কণ্ঠে বলে।

অশ্বিনী হাসে, “ও ব্যাটা এখন পড়ছে। সময় হবে না।”

—“উঁহু প্লিজ, একবার। দেখতে ইচ্ছা করছে।”

—“বললাম যে, সময় নেই ওর।” অশ্বিনী ঘোলাটে স্বরে বলে।

অশ্বিনীর দু’হাতে ধরা হাতটা নিজের ঠোঁটের কাছে তুলে আনে হৈমন্তী, তারপর বলে, “ওর না, আমার সময় নেই। তাই না?” অশ্বিনী কিছু উত্তর দেয় না। স্থির হয়ে বসে থাকে।

—“আমার একটা কাজ করে দেবে?”

—“বলুন।”

—“তোমাকে যে পাঞ্জাবিটা দিয়েছিলাম ওটা পরে আসবে?”

—“এক্ষুনি আসছি।”

—“আর আসার সময় আমার ল্যাপটপটা নিয়ে এসো।”

অশ্বিনী দ্রুত নিচে গিয়ে বদলে নেয় পাঞ্জাবিটা। ল্যাপটপটা হাতে নিয়ে এনে রাখে তার সামনে। হৈমন্তীর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। তাও ভালো করে তাকায় অশ্বিনীর দিকে। মুখে একটা ক্লান্ত হাসি খেলে যায়।

ল্যাপটপে একটা ফাইল খুলে সেটা অশ্বিনীর সামনে তুলে ধরে হৈমন্তী। বিড়বিড় করে বলে, “এইটা পড়ে শোনাবে একটু?” অশ্বিনী দেখে একটা কবিতা লেখা আছে সেখানে।

ল্যাপটপটা নামিয়ে রাখে সে, —“আমি জানি এটা। দেখতে হবে না।”

“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি,

শত রূপে শত বার…

জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।”

পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে কাঁপাকাঁপা হাতে সেটা ধরায় হৈমন্তী। তারপর কনুইতে ভর দিয়ে শরীর কিছুটা উপরে তুলে মাথা রাখে অশ্বিনীর বুকে। দূরে, কালপুরুষের তীর ঘেঁসে কিছুটা দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। অশ্বিনীর দুটো হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে তাকে।

যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, –

প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,

অতি পুরাতন বিরহমিলনকথা,

অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে

দেখা দেয় অবশেষে কালের তিমিরজনী ভেদিয়া

তোমারি মুরতি এসে,

চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।

“আঃ..” সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দেয় হৈমন্তী। সেটা খসে পড়ে তার হাত থেকে। কবিতার শেষ ক’টা লাইন তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে,

আমরা দু’জনে করিয়াছি খেলা

কোটি প্রেমিকের মাঝে

বিরহবিধুর নয়নসলিলে,

মিলনমধুর লাজে

পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।

আজি সেই চিরদিবসের প্রেম

অবসান লভিয়াছে

রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।

—“আবার দেখা হবে, বলো?”

খুব মৃদু একটা দুলুনি উঠে আসছে হৈমন্তীর পা বেয়ে। অশ্বিনীর গলা শুনতে পায় সে, “হবে তো। মহাবিশ্বের অন্য কোনও প্রান্তে…”

—“আমি যদি চিনতে না পারি তোমাকে?”

—“এবারও তো চিনতে পারেননি আমাকে।”

মৃদু হাসে হৈমন্তী, “পরের বার আর একটু সুস্থ হব, বুঝলে। আর একটু বেশিদিন থাকতে পারব তোমার সঙ্গে।”ঘনঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরিয়ে আসে কথাগুলো, “আর তুমি একটু বুদ্ধিমান হয়ো বাপু…”

—“বুদ্ধিমান! আমি বোকা নাকি?”

—“নও? আমি মরার আগে একটা চুমু পর্যন্ত খেতে পারলে না।”

—“আমি! মানে… কোনও মেয়েকে আগে…”

—“শাট আপ…” ধমক দিয়ে চুপ করে হৈমন্তী। বড় নিঃশ্বাস নেয় একবার। কাশির দমক চুপ করিয়ে দেয় তাকে।

—“আচ্ছা হৈম…” অশ্বিনীর মুখে একটা হাসি খেলে যায়। হৈমন্তীর মাথায় হালকা ঝাকা দেয় সে, “শুনছো?”

হৈমন্তীর বাঁ হাতটা গড়িয়ে পড়েছে অশ্বিনীর বুক বেয়ে, চোখ দুটো নিপুণ হাতে বন্ধ করে গেছে কেউ। মাথাটা ঢলে পড়েছে অশ্বিনীর হাতের উপরে।

—“চলে গেছো হৈম?”

আর উত্তর আসে না কোনও। অশ্বিনী সেভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকে। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে হৈমন্তীর প্রাণহীন মুখের উপরে। তার চোখে এক ফোটাও জলের রেখা দেখা যায় না। মাদুরে হৈমন্তীর ঠিক পাশটায় শুয়ে পড়ে সে। একটা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঠান্ডা শরীরটাকে। তারপর চোখ বুজে ফেলে। ঘুমিয়ে পড়ে ছেলেটা। হু হু করে হাওয়া বইতে থাকে ওদের ঘিরে। অচেনা ছন্দে মাথা দোলাতে থাকে দূরের গাছগুলো। যেন খেলনা নিয়ে খেলতে-খেলতে ক্লান্ত দুই শিশুকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে তারা। অখণ্ড নীরবতার মাঝে মৃতদেহের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ভাসানবাড়ি। তার পায়ের তলায় ঘুমিয়ে পড়া পুকুরে আবার ঢেউ খেলছে। শেষবারের মতো… কয়েক ঘণ্টা পর ঘুম ভাঙে অশ্বিনীর। মাদুরের উপরে উঠে বসে সে। তারপর দুহাতে তুলে নেয় হৈমন্তীর দেহটা। সেটাকে বয়ে এনে রাখে একতলার ঘরে আয়নাটার সামনে। বাইরের বাগান থেকে দুটো দেহ তুলে এনে হৈমন্তীর ঘরে শুইয়ে দেয়।

দুই বৃদ্ধের মুখের দিকে চেয়ে বলে, “আমরা চললাম। আপনাদের কথা মনে থাকবে সবসময়।” ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে আসে অশ্বিনী। রান্নাঘর থেকে সিঁড়ির কাছে। দুটো সিলিন্ডার টেনে আনে। পকেট থেকে বের করে আনে হৈমন্তীর লাইটারটা। সেটা জ্বেলে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে লকলকে শিখাটার দিকে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোণে।

মুহূর্তে জ্বলে ওঠে ভাসানবাড়ি। দাউদাউ করে সশব্দ আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে তার কোণায় কোণায়। এই বাড়ি, যেখানে তার দীর্ঘ দুশো বছর ধরে। যাওয়া আসা। যে উদ্দেশ্যে বারবার ফিরে আসত, আজ তা ফুরিয়ে গেছে। আজ তার শেষ প্রতিমা বুকে নিয়ে বাড়িটাও মিশে যাবে বিসর্জনে।।

আয়নার সামনে থেকে হৈমন্তীর দেহটা তুলতে গিয়ে একবার থমকে দাঁড়ায় অশ্বিনী। জ্বলন্ত আয়নায় তার নিজের ছায়া পড়েছে। আগুন এসে বারবার ঢেকে ফেলছে অশ্বিনীর দেহটা। এ আয়নার দিকে দীর্ঘদিন চেয়ে থেকেছে। তাও নিজেকে এই প্রথম দেখল, হৈমন্তীর দেওয়া লাল পাঞ্জাবিটায়…।

হৈমন্তীর দেহটা কোলে নিয়ে ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল অশ্বিনী। এতক্ষণে ছাদ অবধি পৌঁছেছে আগুন। দুশো বছরের পুরনো কড়িকাঠগুলো ভেঙে পড়ছে একটা-একটা করে। আজ সত্যি যেন এক আলোকিত ভাসানযাত্রায় মেতেছে বৃদ্ধবাড়িটা। এতগুলো মানুষের স্মৃতি ডুবে যাচ্ছে লকলকে শিখায়।

সেদিকে ফিরেই দাঁড়িয়ে ছিল অশ্বিনী। কোলে রাখা হৈমন্তীর মুখের দিকে চেয়ে বলে, “দেখো, পুড়ে গেল সব।”

ধীরে ধীরে সামনের পথ বেয়ে হাঁটতে থাকে অশ্বিনী। তার মুখের উপর আগুনের হলদে রঙ প্রতিফলিত হচ্ছে বারবার। কিছুক্ষণ হেঁটে আবার সেই ঢিবিটার কাছে পৌছে যায় অশ্বিনী। জলের ধারে পড়ে থাকা লাঠিটা তুলে নেয়। ছুঁড়ে ফেলে দেয় জলের উপরে। আর এই পুকুরে ফিরে আসবে না ও কোনওদিন।

উলটোদিকে মুখ করে অশ্বিনী হেঁটে আসে মাঠের একেবারে মাঝামাঝি। আবার জমাট বেঁধে জোনাকির সার জ্বলতে শুরু করেছে আঁধারে ঢাকা ঝোপঝাড়ের উপরে। মৃদু হাওয়ার দোলায় মাথা নাড়ছে গাছগুলো। কীসের যেন একটা সুর ভেসে আসছে থেকে থেকে। নরম ঘাসের উপরে হৈমন্তীকে শুইয়ে দেয় অশ্বিনী। তারপর দু’পাশের জমির উপর থেকে কিছু শুকনো কাঠ তুলে আনে। হৈমন্তীর দেহের পাশে সেগুলো জড় করতে থাকে।

সাজানো শেষ হতে হৈমন্তীর পাশে বসে একটু জিরিয়ে নেয় সে। কপালে আর একবার হাত রাখে। এখন আগের থেকে আরও ঠান্ডা হয়ে গেছে দেহ। নিজের দুটো হাত জড় করে মুখ ঢাকে অশ্বিনী। কয়েক সেকেন্ড সেইভাবে থেকে একটু একটু করে উঠে দাঁড়ায়। হৈমন্তীর দেহটা কোলে তুলে নিয়ে শুইয়ে দেয় সাজানো কাঠের উপরে।।

—“ভয় পেয়ো না, হৈম। আমি অপেক্ষা করব… আবার দেখা হবে… কেমন?”

একটু পিছিয়ে এসে একটা লাঠির মাথায় আগুন ধরায় অশ্বিনী। তারপর সেটা এগিয়ে ধরে শুকনো কাঠের সারের ভিতরে। মুহূর্তে জ্বলে ওঠে কাঠ। আগুন ছড়িয়ে পড়ে হৈমন্তীর জামাকাপড়ে। শান্ত হয়ে শুয়ে আছে সে। আগুনের শিখায় তার মুখটা বিসর্জনের পর জলে ডুবতে থাকা প্রতিমার মতো দেখায়।

সেই ছোটবেলার হৈমন্তী, মায়ের বকুনি খাওয়া হৈমন্তী, স্কুলফেরত কাচা আমড়া খাওয়া হৈমন্তী, নাচের ক্লাসে সেকেন্ড হওয়া হৈমন্তী, মাঝরাতে কেঁদে বালিশ ভেজানো হৈমন্তী, সবাই যেন এক সঙ্গে ভেসে যাচ্ছে অতল গঙ্গার গভীরে… সেদিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অশ্বিনী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *