ভাসানবাড়ি – ২

দ্বিতীয় অধ্যায়

—“রোল নম্বর টোয়েন্টি সিক্স?” নামের পাশে ‘এ’ লিখে পরের রোলটা কল করতে যাচ্ছিল স্নিগ্ধা-থেমে গেল। মুখ তুলে ক্লাসের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “ফার্স্ট পিরিয়ডে প্রেসেন্ট আর টিফিনের পরে অ্যাবসেন্ট? স্কুলে পড়তে পড়তে ক্লাস বাঙ্ক করতে শিখেছে? হৈম”।

মুখটা খোঁজার চেষ্টা করল স্নিগ্ধা। ক্লাসে হৈম নেই। মেয়েটার চেহারা ছোটখাটো বলে মুখের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অনেক সময়। কিন্তু আজ তার সামনের বেঞ্চে বসার কথা। মেয়েটার ব্যাগটা অবধি রাখা আছে বেঞ্চের উপরে। গেল কোথায়?

—“ও মাঠ থেকে ফেরেনি ম্যাম…” ফাকা বেঞ্চটার ঠিক পাশে বসা ছাত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে কথাটা।

—“ফেরেনি মানে? কোথায় গেছে…?”

—“ওর শরীর খারাপ লাগছিল খেলতে খেলতে, শুয়ে পড়েছিল মাঠেই.” ।

স্নিগ্ধা ধমক দিয়ে ওঠে, “অসুস্থ মেয়েটাকে মাঠেই ফেলে চলে এলে?” বাকি রোলকলটা না করেই ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসে স্নিগ্ধা। স্কুলের বাইরের দরজার কাছে দারোয়ান বসে খৈনি ডলছিল, দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে স্নিগ্ধা বলল,“গোপালদা একটু আমার সঙ্গে আসবেন? মাঠে যেতে হবে।”

খৈনিটা লুকাতে দেরি হয়েছে গোপালের, থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মাঠে! কেন দিদি?”

—“একটা মেয়ে খেলতে গিয়ে ফেরেনি…” স্কুলের সামনের পিচের রাস্তাটা পার করে মাঠে এসে পড়ে দু’জনে। একটু আগের উড়ন্ত ধুলো এখন ঝিমিয়ে গেছে। তার উপরে দুপুরের রোদ চিকচিক করছে। এতগুলো ছটফটে পায়ের দৌরাত্ম্যে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল মাঠটা।

—“ম্যাডাম, ওই যে…” মাঠের একদিকের প্রান্তে ছোট স্লিপ আছে, সেদিকে এগিয়ে যায় স্নিগ্ধা। বুকটা সিটিয়ে গেছে তার। স্লিপের ঠিক গা ঘেঁষে পড়ে আছে হৈম। দুটো হাত দুদিকে ছড়ানো। চোখ দুটো বন্ধ। খেলতে খেলতে কি পড়ে গেছে তাহলে? চোট লেগেছে মাথায় ?

—“হৈম, শুনছিস?” সজোরে তার শরীরে ঠেলা দেয় স্নিগ্ধা। কপালে হাত রাখে, ভুরু কুঁচকে যায় তার, “সাংঘাতিক জ্বর!” বিড়বিড় করে, “এত জ্বর নিয়ে মেয়েটা রোদের মধ্যে পড়ে আছে,”হাঁটু আর ঘাড়ের কাছটা ধরে তাকে কোলে তুলতে যায় স্নিগ্ধা, পারে না, সতেরো বছরের মেয়েটাকে পাঁজাকোলা করা সোজা নয়।

—“তুমি নিয়ে এসো ওকে… জলদি..” প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে স্কুলে ফিরে আসে স্নিগ্ধা। ছোটখাটো হুলুস্থুল পড়ে যায় গোটা স্কুল জুড়ে। একঝাঁক মেয়ে ক্লাসরুম ফেলে উঠে এসেছে দরজার কাছে। দু-একজন ক্লাসটিচার তাদের তাড়িয়ে নিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করছেন।

ভিড়টাকে পাশ কাটিয়ে ক্লাসরুমের দিকে ফিরছিল স্নিগ্ধা। চোখে পড়ে ক্লাসরুমের ভিতরে বসে আছে পৌলমী। মাসকয়েক আগে অবধি হরিহর আত্মা ছিল দু’জন। হৈমন্তী মাঠে পড়ে আছে জানা সত্ত্বেও দেখতে যায়নি পৌলমী? ঝগড়া হয়েছে নাকি? স্নিগ্ধা মেয়েটার কাছে এগিয়ে আসে,

“ওর জ্বর হয়েছে তোকে বলেনি?”

—“না, ওর সঙ্গে আমার কথা নেই।”

—“কেন?”

—“ও বলতে চায় না। সব সময় দূরে দূরে থাকে, কিছু বলতে গেলেই ভীষণ রাগ করে, তাই আমিও আর কথা বলি না।” স্নিগ্ধার খেয়াল হয় সত্যি মাসখানেক হল কারো সঙ্গে তেমন একটা মেশে না হৈম। চুপচাপ স্কুলে আসে, কোনওরকমে ক্লাসগুলো করে বাড়ি চলে যায়। বাড়িতে কি কোনও সমস্যা হয়েছে মেয়েটার?

আবার পৌলমীর দিকে তাকায় স্নিগ্ধা, “ওর বাবা-মাকে চিনিস তুই?” পৌলমী দু’পাশে মাথা মাথা নাড়ে, “না ম্যাম।”

—“বাবা-মার ব্যাপারে কিছু বলেনি তোকে?” কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ভাবে স্নিগ্ধা। তারপর বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়ে বলে, “আজকের মতো ক্লাস আর হবে বলে তো মনে হয় না। ক্লাসরুমেই থাক, হট্টগোলের মধ্যে যেতে হবে না তোকে।” স্কুলের তরফ থেকে হেডমিস শেফালি দত্ত ফোন করে হৈমন্তীর বাবা-মাকে ডেকে পাঠালেন। আধঘণ্টার মধ্যে নিজেদের গাড়ি করেই স্কুলে এসে হাজির হলেন দুজনে।

এতক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে হৈমন্তীর। সে শেফালি দত্তের ঘরেই একটা অনেক আরাময়ক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছে। মাঝে-মধ্যে ঘুরেফিরে তাকাচ্ছে ঘরের চারদিকে। কখনও চোখ রগড়াচ্ছে কিংবা আঙুল দিয়ে ডলছে নাকের ডগা। এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি সে। বাবা-মায়ের দিকে ফিরে

তাকিয়েছিল একবার। তারপর চোখ নামিয়ে নিয়েছে। -“এভাবে জ্বর গায়ে স্কুলে পাঠিয়েছেন মেয়েকে! কিছু একটা হয়ে যেতে পারতো ।রাগত গলাতেই কথাগুলো বললেন শেফালি দত্ত।

মিসেস ঘোষ মিনমিন করে বললেন , “এ-মাসে অনেকগুলো কামাই হয়েছে। দুদিন হল জ্বরটা একটু কম, তাই ভাবলাম..”

“ডাক্তার দেখিয়েছেন ? “

—“আজ্ঞে হ্যাঁ। ওষুধও খাচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না কিছুতেই। একটু করে কমছে আবার সন্ধ্যার দিকে জ্বরটা বাড়ছে।

“এই ভাইরাল ফিভার খুব হচ্ছে আজকাল, বেয়াড়া অসুখ”।

“এতদিন ধরে ভাইরাল ফিভার?” স্নিগ্ধা পাশ থেকে বলে ওঠে, কাল ভাবছিলাম কমাস হল কারও সঙ্গে মিশছে না ও।”

মিস্টার ঘোষ এবার মুখ খুললেন, “শুধু জ্বর নয় ম্যাম, ওর চামড়াতেও কিছু একটা হয়েছে”

—“তো ডার্মাটোলজিস্ট দেখান।” দত্ত মুখ নামিয়ে বললেন।

—“ঠিক কী হয়েছে বলুন তো?” স্নিগ্ধা ঘুরে বসে।

—“রাতে ঘুম হয় না ভালো করে। সারাক্ষণ বলে গলাব্যথা, মাথায় ব্যথা, রোজই প্রায় বার দুয়েক করে বমি হয়ে যাচ্ছে আর…”, চামড়ার কথাটা বলতে গিয়েও একটু থেমে যান মিসেস ঘোষ।

চেয়ার থেকে উঠে পড়ে এগিয়ে আসেন মেয়ের দিকে, “চামড়ার উপর লালচে স্পট পড়ছে, প্রথমে লাল তিলের মতো দেখাচ্ছে, পরে কালশিটের মতো কালো হয়ে যাচ্ছে, এই যে…” মেয়ের পিঠের দিক থেকে জামাটা কিছুটা উপরে তুলে ধরেন মহিলা। ফর্সা মসৃণ চামড়ার কিছুটা অংশ দেখা যায়। সিট থেকে উঠে হৈমন্তীর চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়ায় স্নিগ্ধা। একবার মৃদু বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে হৈমন্তী। মিসেস ঘোষ কান দেন না। স্নিগ্ধা দেখে মেয়েটার কোমরের উপরে লালচে কয়েকটা স্পটকে ঘিরে খাতার মার্জিনের মতো লাইন ফুটে উঠেছে। তার ঠিক মাঝখানগুলো সরু সুতোর মতো কালচে হয়ে গেছে।

“কী করে হল এগুলো?” হৈমন্তী উত্তর দেয় না। শুধু দু পাশে মাথা নাড়ে।

—“কেউ মারধর করেছে? বা কোনও পোকার কামড়?”

—“না।”

—“ব্যথা আছে?”

—“উহু।”

—“শুধু এখানে না, সারা শরীর জুড়ে আছে দাগগুলো।”

—“রাতে ঘুম হয় না, তাই না?” স্নিগ্ধা লক্ষ্য করেছে মেয়েটার চোখের তলায় কালি পড়েছে,

কী মনে হতে সে বলে, “আপনারা একটা কাজ করুন। ডাক্তারটা মনে হয় চেঞ্জ করা দরকার। আমার এক বান্ধবী আছে। ডাক্তার সম্পূর্ণা ভট্টাচার্য। আমেরিকায় থাকে। সদ্য কলকাতায় এসে চেম্বার খুলেছে। আমি অ্যাপোয়েন্টমেন্ট করে দিচ্ছি, ওকে একবার দেখিয়ে নিন। দরকার হলে আমি যাব সঙ্গে।”

—“আপনি কি কিছু সন্দেহ করছেন?”

স্নিগ্ধা মুখ নামিয়ে হাসে, “আমি সামান্য স্কুলে ফিজিক্স পড়াই, আমার সন্দেহে কী যায় আসে বলুন? তবে এভাবে কালশিটে দাগ ফেলে রাখা ভাল না।”

ঘরে উপস্থিত চারজন মানুষ আরো কিছু আলোচনা করতে থাকে। হৈমন্তী চোখ বুজে নেয়, চোখ দুটো ভারী হয়ে আসছে। একটা বমি-বমি ভাব পাক দিয়ে উঠছে পেটের ভিতর। থেকে-থেকে মনে হচ্ছে কেউ যেন দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। আড়াল থেকে কান পেতে শুনছে ওদের কথা। ওর কোনও ক্লাসমেট কি?

মনে পড়ল ও যখন জ্বরের ঘোরে মাঠে শুয়ে পড়েছিল, তখনও কেউ যেন ওকে ঠেলা দিয়ে ডাকছিল। চাপাস্বরে ফিরে যেতে বলছিল স্কুলে। কষ্ট করে একবার চোখও খুলেছিল হৈমন্তী। কাউকে দেখতে পায়নি। এরপর আবার কদিন স্কুলে এল না হৈমন্তী। স্নিগ্ধার সেই আমেরিকা ফেরত বান্ধবী ডাক্তার ভট্টাচার্য হৈমন্তীকে একবার দেখেই কিছু টেস্ট করতে দিয়েছিলেন। আজ তার রিপোর্ট আসার কথা। ঝামেলায় পড়ে কিছুদিন সেদিকে আর মাথা দিতে পারেনি স্নিগ্ধা। আজ তাড়াতাড়ি স্কুল শেষ হয়ে যেতে সে সরাসরি বাড়ি গেল না। একটা ক্যাব বুক করে ডালহৌসির মোড়ে এসে নামল। এখানেই চেম্বার খুলেছে সম্পূর্ণা। আসার সময় একটা ফোন করে নিয়েছিল, ফোনে কিছু খুলে বলেনি সে। চেম্বারের ভিতরে ঢুকতেই ঘোষ দম্পতিকে দেখতে পেল স্নিগ্ধা। চোখে-মুখে উদ্বেগ।

—“ও কি ভিতরে আছে?”

—“আধঘণ্টা হয়ে গেল, কিছুই তো জানাচ্ছেনা।”মিস্টার ঘোষের গলায় স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ।

—“আপনারা চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি।”

সম্পূর্ণার চেম্বারের দরজায় টোকা দেয় স্নিগ্ধা, “আমি স্নিগ্ধা রে, বলছি ভিতরে আসব একবার?”

“চলে আয়।” দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে আসে স্নিগ্ধা। ঘরের একপ্রান্তে বড় একটা টেবিলের দু পাশে দুটো মানুষ বসে আছে। প্রায় বছরছয়েক পরে দেখা হল দুই বান্ধবীর, কিন্তু একটুকরো হাসিও ফুটল না সম্পূর্ণার মুখে। একদৃষ্টে হৈমন্তীর মুখের দিকে চেয়ে আছে সে। ক্লাস টুয়েলভে পড়া মেয়েটার মুখ থমথম করছে। একদলা অস্বস্তি গলা টিপে ধরে আছে তার। স্নিগ্ধা খেয়াল করল হৈমন্তীর দুটো হাতের আঙুলগুলো শক্ত করে জড়িয়ে আছে একে অপরকে। যেন প্রাণপণ চেষ্টা করে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে নিজেকে। স্নিগ্ধাকে হৈমন্তীর পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল সম্পূর্ণা। বাক্য ব্যয় না করে সেখানে বসে পড়ল স্নিগ্ধা।

—“ওর মা-বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?” পাথরের মতো কণ্ঠস্বর সম্পূণার।

—“হ্যাঁ। কিছু একটা জানিয়ে দে। দুশ্চিন্তায় আছেন।”

—“কী জানাবো সেটাই ভাবছি…” কথাগুলো বলে আবার হৈমন্তীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সে,

“ডু ইউ হ্যাঁভ আ বয়ফ্রেন্ড?” হৈমন্তী দুপাশে মাথা নাড়ে, সজোরে।

—“কিংবা এমন কেউ যার সঙ্গে তুমি খুব ঘনিষ্ঠ…” স্নিগ্ধা বুঝতে পারে হৈমন্তীর শরীর জুড়ে অস্বস্তির কারণ। সে একটু গলা খাকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হঠাৎ এসব প্রশ্ন কেন করছিস বলতো? কী হয়েছে ওর?”

আর.এন.এ টেস্টের রিপোর্টটা তার দিকে এগিয়ে দেয় সম্পূর্ণা। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কিছু মানে কিছু বুঝতে পারে না স্নিগ্ধা।

—“তোমার বাড়িতে কে কে আছে? আই মিন মা বাবা ছাড়া…”

—“আর তো কেউ নেই।”

—“কোনও আত্মীয়স্বজন? যারা ঘনঘন বা রেয়ারলি বাড়িতে আসে?” আর কোনও উত্তর দেয় না হৈমন্তী। তার গালের দু’পাশ লাল হয়ে উঠেছে। এইঘরে নিঃশ্বাস নিতেও যেন ভয় পাচ্ছে সে।

—“ঠিক আছে, তুমি এখন বাইরে যাও। মা-বাবাকে গিয়ে বলো চিন্তার কিছু নেই। আমি এক্ষুনি বেরিয়ে কথা বলছি ওনাদের সঙ্গে। কেমন?” প্রায় ঝড়ের মতো উঠে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় হৈমন্তী। স্নিগ্ধার দিকে ফেরে সম্পূর্ণা,

“শী ইজ এইচ.আই.ভি পজিটিভ।”

–“মানে! এসব কী বলছিস তুই।” থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে স্নিগ্ধার শরীর।

—“ওর ঘাড়ের দাগগুলো দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। ভাইরাসটা একটিভ হয়নি এখনও, সম্ভবত কয়েক উইক আগে ইনফেক্টেড। আর.এন.এ টেস্ট একটু এক্সপেন্সিভ, কিন্তু একেবারে প্রাইমারি স্টেজে ধরা পড়ে।”

—“এইটুকু বয়সের একটা মেয়ে…”

—“বয়সটা ফ্যাক্টর নয়, ভাইরাসটা নানারকম ভাবে ঢুকতে পারে, বডিলি ইডস বা সেক্সয়াল ইন্টারকোর্স…”

—“ইন্টারকোর্স! আমাদের গার্লস স্কুল!”

—“বাড়ি বা প্রাইভেট টিউশন তো গার্লস না…” রিপোর্টের উপর চোখ বুলাতে বুলাতে বলে সম্পূর্ণ, “তাছাড়া রিসেন্টলি কোনও ইঞ্জেকশান নিয়ে থাকলে আর সিরিঞ্জ ইনফেক্টেড থাকলে সেখান থেকেও হতে পারে।”

স্নিগ্ধার মাথা ঝিমঝিম করছিল, গোটা চেম্বারটা বন্ধ করে ঘুরতে শুরু করছে দেন। সামনে রাখা রিপোর্টের কাগজটায় লেখাগুলো গুলিয়ে গিয়ে হায়ারোগ্লিফিক এর মতো দেখাচ্ছে।

—“আমি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না! এসব হল কী করে?”

একটু ইতস্তত করে সম্পূর্ণা, “আমি সাজেস্ট করছি না কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকেছি এসব ক্ষেত্রে ডোমেস্টিক রেপ ইনভলভড থাকে। ইন এনি কেস

বাবামাকে ব্যাপারটা জানানো দরকার।”

—সারাটাজীবন পড়ে আছে সামনে, এত স্টুডিয়াস একটা মেয়ে… তুই কী এক্সপেক্ট করছিস? তাও মোটামুটি কত বছর?”

—“ক্যান নট সে। ভাইরাস যতদিন না অ্যাকটিভ হচ্ছে কিছু বলা যায় না। এমনও হতে পারে বছর দশেক শরীরে বাসা বেঁধে সে বসে থাকল, কেউ বুঝতেও পারল না। আবার আজ বাড়ি ফিরেই একটিভ হয়ে যেতে পারে।” হৈমন্তীর মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল স্নিগ্ধার। ভারী নরম, লাজুক স্বভাব মেয়েটার। একটু মুখচোরা গোছের, কিন্তু চোখ দুটো ভারী উজ্জ্বল।

–“আমার মনে হয় কথাটা ওকেও এখনই জানানো দরকার। আই মিন অলরেডি ওর যদি কোনও বয়ফ্রেন্ড থাকে… আর একটা মানুষের জীবন নিয়ে রিস্ক নেওয়াটা উচিত হবে না।”

—“হুম…” -“আমি ওর বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলছি। তুই ওর সঙ্গে একটু কথা বল।” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়ে স্নিগ্ধা। পা দুটোয় জোর পাচ্ছে না অনেকক্ষণ থেকে। হেয়ারলাইন বরাবর একটা কনকনে হাওয়া যেন বরফের কুচি ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। দুটো হাত দিয়ে মুখ মুছে নেয়। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে অজান্তে।

বাইরে বসে ছিল তিনজন। এগিয়ে এসে হৈমন্তীর কাঁধে একটা হাত রাখে স্নিগ্ধা। নিচু, চাপা গলায় বলে, “তোর সঙ্গে একটা কথা আছে, আয় আমার সঙ্গে।” রিসেপশনের ঠিক সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া সরু প্যাসেজটা একেবারে শেষপ্রান্তে এসে একটু বেঁকে গেছে। ছোট একটা খাঁজ তৈরি হয়েছে সেখানে। প্যাসেজের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখা যায় না জায়গাটা। সেখানে হৈমন্তীকে এনে দাঁড় করায় স্নিগ্ধা। খানিকটা ঝুঁকে তার কাঁধে দুটো হাত রাখে। মেয়েটা যেন একটু থতমত খেয়ে গেছে। চোখ দুটো স্বাভাবিকের তুলায় একটু বড় দেখাচ্ছে।

—“আমি একটা প্রশ্ন করব, মনে করে উত্তর দিবি, ঠিক আছে?”

—“আচ্ছা ম্যাম।”

—“সরণের সূত্র কী?”

এই প্রশ্নটার জন্যে প্রস্তুত ছিল না হৈমন্তী। তার থতমত ভাবটা বেড়ে ওঠে, একই ভেবেচিন্তে বলে, “কোনো বস্তু বা বিন্দু একটি অবস্থান থেকে আরেকটি অবস্থানে স্থানান্তরিত হলে, প্রথম অবস্থান থেকে দ্বিতীয় অবস্থান অবধি ভেক্টকে সরণ বলে।”

—“বা” খুশি হয় স্নিগ্ধা। নিজের হাত থেকে হাতঘড়িটা খুলে ফেলে সে, সেটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই দেখ, ঘড়ির কাঁটাটা বাৱোটা থেকে শুরু হয়ে আবার বারোটায় ফিরে আসছে। মানে ঘড়ির কাটার সরণ কত হল?”

—“শূন্য।” চটপট উত্তর দেয় হৈমন্তী।

ঘড়িটা হৈমন্তীর হাতে বাঁধতে থাকে স্নিগ্ধা। বলে, “এই কাঁটাটা হল সময়, এটাকে বন্দি করে তোর হাতে আটকে দিলাম আমি।”

—“ম্যাম আমি ক্লাস টুয়েলভে পড়ি…”

—“চুপ কর, যা বলছি শোন। সময় সবসময় পালিয়ে যেতে চায়, সে বারোর পর তেরো, চোদ্দ এমন করে খেয়ে যেতে থাকে। কিন্তু তুই তা হতে দিবি না, এমন করে বন্দি করে রাখবি তাকে, সময়ের যেন কোনও সরণ না হয়। মনে থাকবে তো?”

হৈমন্তী কী বলবে বুঝতে পারছিল না। মাথা নেড়ে দেয়।

—“এই ঘড়িটা কখনও খুলবি না হাত থেকে, ঠিক আছে?”

হৈমন্তীর মাথায় একটা হাত রাখে স্নিগ্ধা, “অনেক বড় হ রে মা, এখন যা, দেখ মা-বাবা কী বলছে.”

ঘমটা ভেঙে যায় হৈমন্তীর। সত্যি কি ঘুমাচ্ছিল? নাকি জেগে জেগেই ভাবছিল আগের কথা? এ বাড়িতে এসে থেকে ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। স্নিগ্ধাম্যামের খবর নেওয়া হয়নি অনেকদিন। নম্বরটাও হারিয়ে গেছে সেই কবে। কলকাতায় ফিরে আগে খোজ করতে হবে। এতক্ষণে বাঁ হাতের উপরে মাথা দিয়েই শুয়েছিল সে। সামনে তাকাতে কবজিতে বাঁধা ঘড়িটা চোখে পড়ে। সেকেন্ড, মিনিট আর ঘণ্টা, তিনটে কাঁটাই এখন বারোটার দাগ পার হয়ে যাচ্ছে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *