উনবিংশ অধ্যায়
সকালে ঘুম ভাঙতে চোখ খোলে হৈমন্তী। সঙ্গে সঙ্গে অশ্বিনীর চোখে চোখ পড়ে যায়। ছেলেটা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। চোখ দুটো খোলা। বোঝা যায় সারারাত একবারও বন্ধ হয়নি তারা।
—“গুড মর্নিং ।”
—“মর্নিং। আপনার গায়ে জ্বর আছে। ওষুধ খেয়ে নিন। পাশের টেবিলে। এনে রাখা ওষুধটা দেখায় অশ্বিনী। তারপর আবার চোখ রাখে তার মখে।
ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে মুখে ফেলতে ফেলতে হৈমন্তী বলে, “কখন থাকে। বলতো? জ্বর আর তুমি, এই নিয়েই এখন আমার সংসার।”
—“আগে কী নিয়ে ছিল?” হৈমন্তী হাসে, “সংসার আমার কোনওদিনই কিছু ছিল না। রোজকার বেঁচে থাকাটা চুরি করাকে, সংসার বলে না। রোগটা ধরা পড়া থেকেই…”
—“জিলিপি খাবেন? বাজারের সামনে ভাজা হচ্ছিল। এখনও গরম আছে…”
অশ্বিনীর বাড়িয়ে ধরা জিলিপির ঠোঙ্গা খুলে একটা জিলিপিতে কামড় বসায় হৈমন্তী। ধীরেসুস্থে সেটা চেবাতে চেবাতে বলে, “বাঃ, এমন রসভরা মোটা মোটা জিলিপি বহুদিন খাইনি… ছোটবেলায় আমাদের পাড়ার একটা লোক বানাত, জানো? তখন আমার বয়স পাঁচ কী ছয় হবে, আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমার হাতে একটা করে দিত, রোজ। এদিকে পয়সা নিত
না।”
—“তারপর?”
‘ হৈমন্তী আর একটা জিলিপি তুলে নিয়ে বলল, “তারপর একদিন দেখলাম লোকটা দোকান-টোকান ফেলে রাস্তায় ভিক্ষা করছে। যদ্দুর মনে পড়ে আগুন
লেগে পুড়ে গেছিল দোকানটা। গরিব মানুষ… তো আমার স্কুলে যাবার ভাড়া ছিল তিন টাকা, আসার তিন টাকা। বাবা আমাকে দিত দশটাকা। বাকি চার টাকা কিছু কিনে টিনে খাওয়ার জন্য। আমি ওকে ওই চার টাকা দিতাম রোজ…
একদিন লোকটা আমার হাত চেপে ধরল খপ করে…” শব্দ করে হাসে অশ্বিনী, “আমি একাই করিনি তার মানে।”
—“আরে শোনো না, ব্যাটা আমার হাত ধরে বলে, এই খুকি তুই আমাকে রোজ টাকা দিস কেন? আমি বললাম তুমি যে রোজ জিলিপি দিতে। সে বলল। তোর আবার জিলিপি খেতে ইচ্ছা করে? আমি খুব জোরে মাথা নেড়েছিলাম বুঝলে… তারপর…”
—“তারপর কী হল?” ঠোঙা রেখে অশ্বিনীর দিকে এগিয়ে আসে হৈমন্তী, “কী হল সেটা তুমি বললা। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে আর দেখতে পেলাম না ওকে। তারপর থেকে আর দেখতেও পাইনি কোনওদিন…”
অশ্বিনী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল।
হৈমন্তী থামিয়ে দিয়ে বলে, “দাঁড়াও আর একটা লোকের কথাও জানতে ইচ্ছা করছে। হাওড়া ব্রিজের একদম গা ঘেঁসে, বুঝলে, একটা মাতাল থাকত। গাঁজা-টাজা খেত বোধহয়। তবে পঞ্চাশ টাকা দিলে সে ভায়োলিন বাজিয়ে শোনাত।
আমি একবার শুনেছিলাম, ‘এক পেয়ার কা নাগমা…’ বলেছিল কোনওদিন মদের টাকা না পেলে বেচে দেবে ভায়োলিন’টা… ওর কথাও জানতে চাই।”
—“ওরা দু’জনেই খুব খুশি আছে।” অশ্বিনী চোখ বন্ধ করে বলে,
“এখনও যদি অন্ধকার শুনশান রাতে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ান, দেখবেন জ্যোৎস্নার আলোয় বসে লোকটা বেহালা বাজাচ্ছে।”
—“তুমি যেতে পারো সেখানে?” অশ্বিনী উপরে নিচে মাথা নাড়ায়।
—“আমাকে নিয়ে যেতে পারো? একবার? প্লিজ…”
চেয়ারে ছেড়ে উঠে পড়ে অশ্বিনী। তারপর নিজের দুটো হাত চেপে ধরে হৈমন্তীর চোখের উপরে। চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। পরমুহূর্তে কেটে যায় অন্ধকারটা। হৈমন্তী দেখে চারপাশের পরিবেশ বদলে গেছে। অন্ধকার একটা রাত নেমে এসেছে চারিদিকে। দমকা হাওয়া বইছে ওদের ঘিরে গত জলের গন্ধ সেই বাতাসে। সঙ্গে একটা নরম সুর খেলা করে চলেছে।
অবাক হয়ে হাওড়া ব্রিজের আকাশছোঁয়া চূড়া দুটোর দিকে তাকায় হৈমন্তী। এত গভীর রাতে এই ব্রিজটাকে আগে কখনও দেখেনি সে। ট্রেনের আওয়াজ নেই, স্টেশানের সামনে মোটরবাহক আর ট্যাক্সিওয়ালাদের হাঁক-ডাক নেই। গোটা শহরটা যেন সারাদিনের হৈচৈ-তে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা ঘাটের সিঁড়ির ধাপের উপরে বসে আছে ওরা, সামনে জলের ছলছল শব্দ।
হৈমন্তী অশ্বিনীর কোলে ঠেস দিয়ে বসে। জলের উপরে তারাদের ছায়া এসে পড়েছে। সবকটা তারার উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে সুরটা।
একটু একটু করে ধাপের উপরে উঠে দাঁড়ায় হৈমন্তী। এগিয়ে যায় জলের দিকে। তার গোড়ালি অবধি ডুবে যায় জলে। কাশির দমকে কেঁপে ওঠে একবার। নিচু হয়ে আঁজলা করে জল তুলে নেয় হাতে। তারপর সেটা ছুঁড়ে দেয় অশ্বিনীর দিকে।
—“এ কী ভিজে যাব তো…”
—“তো? জলাতঙ্ক আছে তোমার? কুকুরে কামড়েছিল?”
—“কুকুর আমার ধারে-কাছে আসে না, ভয় পায়।” হৈমন্তী মাথা নাড়ে, “শুনেছি কুকুর ছদ্মবেশী মানুষকেও চিনে নিতে পারে, আচ্ছা, তোমার আসল রূপটা দেখাও তো…”
—“সেটা কী আবার?”
—“মানে এই মানুষের শরীরটা তো তোমার খোলস, আসলটা কেমন সেটা দেখতে ইচ্ছা করছে…”
—“আমার কোনও আসল রূপ নেই। সবই খোলস..”
—“বাবা! তুমি মানুষ না পেঁয়াজ?”
—“কোনওটাই না, কাটলে যে চোখের জলটা বেরোই সেটা বলতে পারেন। আচ্ছা এবার উঠে আসুন।”
একটা হাত বাড়িয়ে দেয় অশ্বিনী। সেটা ধরে হৈমন্তী ঘাটের উপরে উঠে আসে। রাস্তায় ওঠার মুখেই গঙ্গার বাঁধানো পাড় জুড়ে লম্বা ফাঁকা রাস্তা। সেটা দেখিয়ে হৈমন্তী বলে, “এখানে একটু হাঁটব, তারপর ফিরি?”
—“চলুন।” পাশাপাশি হাঁটতে থাকে দু’জনে। গঙ্গার জোলো হাওয়া বইতে থাকে ওদের ঘিরে। অশ্বিনীর গায়ে ঠেস দিয়ে হাঁটতে থাকে হৈমন্তী, “আমার রোগটা হওয়ার পর থেকে একটা কাজ খুব সহজে পারতাম, জাননা?”
—“কী কাজ?”
—“এই সব কিছুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। এই গঙ্গার পাড়, কলকাতা, মানুষজন… সবকিছু…”
—“তারপর ?”
—“তারপর হুট করে তুমি চলে এলে একদিন। আচ্ছা আমার একটা শেষ ইচ্ছাপূরণ করবে?”
—“কী? বলুন…”
* * * *
সকালের দিকে একটু পার্কে হাঁটতে বেরোন মিসেস ঘোষ। ষাটের কাছাকাছি বয়স হতেই ডাক্তার নিদান দিয়েছেন মর্নিংওয়াকের। নাহলে পায়ের জোর কমবে দিন দিন। এমনিতে সকালে পার্কটা ফাঁকাই থাকে, গরমের দিন একটু পরেই রোদ উঠে যাবে। তাড়াহুড়ো করেন মিসেস ঘোষ। পার্কের গেট খুলে হাঁটা রাস্তার দিকে এগোতেই খেয়াল করেন আজ ঘড়ি পরতে ভুলে গেছেন। আটটা অবধি হাঁটেন তিনি। তার বেশি দেরি হলেই চিত্তির। স্কুলে যাওয়ার দেরি হয়ে যাবে। নিজের প্রতি বিরক্ত হয়ে সামনের পথে পা বাড়ান।
—“ম্যাম…” পিছন থেকে ভেসে এসেছে ডাকটা। মিসেস ঘোষ ঘরে তাকান। এই ঘুরে তাকানোটা কিছুটা প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো হয়ে গেছে তার। তাকাতেই ঠিক পেছনে দুটো মানুষকে দেখতে পেলেন তিনি। দুজনেরই বয়স তিরিশের কাছাকাছি। একজন পুরুষ, অপরজন মহিলা। দুজনের কাউকেই তিনি চেনেন না। অবশ্য পুরনো ছাত্রছাত্রী হলে…
হাঁটা থামিয়ে তিনি এগিয়ে আসেন। মেয়েটির মুখের দিকে একবার তাকান। সম্ভবত অসুস্থ মেয়েটি। মুখ চোখের অবস্থা ভালো নয়।
—“চিনতে পারছেন না আমাকে, তাই না?” মেয়েটা হাসার চেষ্টা করে।
—“তুমি…” চশমার বাইফোকাল দিয়ে ভালো করে তাকান তিনি, “তুমি… হৈম… হৈমন্তী…” মিসেস ঘোষ অবাক হয়ে বারবার খতিয়ে দেখতে থাকেন মেয়েটির মুখ।।
—“এ কী চেহারা হয়েছে রে তোর। গোলগাল ছিলি, এখন…”।
হৈমন্তীর ওজন বেশ কিছুটা কমেছে আগের থেকে। রোগা যাকে বলে তা সে কোনওদিনই ছিল না। কিন্তু গোলগাল ছিল কি? ম্যামের স্মৃতিশক্তি বয়সের সঙ্গে কিছুটা ক্ষয়েছে বোঝা যায়।
—“কী একটা রোগ হয়েছিল যেন…”
—“এইডস হয়েছিল ম্যাম।” এতক্ষণে স্নিগ্ধা ঘোষের মুখের উপর রঙ খেলে যায়। দু’হাতে হৈমন্তীর কাঁধের উপরে একটা ঝাঁকা দেন তিনি, “এই তুই… তুই এতদিন একবারও যোগাযোগ করলি না ম্যামের সঙ্গে, আঁ? আমার ছেলেকে কতবার বলেছি তোর নাম দিয়ে ফেসবুকে খুঁজতে, সে বলে তুই নাকি ফেসবুকে নেই…”
—“ওই… থাকি, থাকি না…” হৈমন্তী মন খুলে হাসে। ।
—“সে যাই কর বাবা, আমাকে ফোন নম্বরটা দে এক্ষুনি।”
—“ফোন নেই ম্যাম। হারিয়ে গেছে।”
—“সে কী রে!” হৈমন্তীর চিবুকে হাত দেন মিসেস ঘোষ, “তাহলে ঠিকানাটা অন্তত..”
একবার পিছন ফিরে অশ্বিনীর দিকে চায় হৈমন্তী। আবার মুখ ঘুরিয়ে বলে, “ঠিকানা বললেও তো আর দেখা হবে না ম্যাম… আমি আসলে… আপনার একটা জিনিস ফেরত দিতে এসেছি। আমার কাছে ছিল এতদিন…” নিজের হাত থেকে হলদে ব্যান্ডের ঘড়িটা খুলে নেয় হৈমন্তী। তারপর মিসেস ঘোষের হাতটা তুলে নিয়ে তাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলে, “একদিন আপনি আমার হাতে এটা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমি কোনওদিন খুলিনি হাত থেকে।” ঘড়িটা চিনতে পারেন মিসেস ঘোষ। তার মুখে কোনও শব্দ ফোটে না।
—“আপনার কথাগুলো সেদিন বুঝতে পারিনি। আজ বুঝি। সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়, কিন্তু পালিয়ে যায় না। ঘড়ির কাঁটা রোজ বারোটার কাছে। ফিরে আসে। বারবার… আমাদের হাতে বন্দি হয়ে থাকে… আজ সেটা আমাকে মনে করাতে আর এই ঘড়িটা লাগবে না।” অশ্বিনীর দিকে চোখ পড়ে ঘোষের। হৈমন্তীর সিঁথির দিকে একবার চট করে চোখ বুলিয়ে নেন তিনি।
—“আমাকে মনে রাখবেন তো ম্যাম?” সময়ের স্রোত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিক্ষিকার উপরে। হু হু করে পিছিয়ে যেতে থাকে দীর্ঘ বছরগুলো। সেই ছোট্ট বছর পনেরোর মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়। গোলগাল সরল একটা মুখ, দুটো উজ্জ্বল কাজলমাখা চোখ, সরস্বতী পুজোয় আলপনা দেওয়া মেয়েটা, হোমওয়ার্ক না করে এনে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা, রাফখাতার পিছনে কাকতাড়ুয়া আঁকা মেয়েটা আজ কী ভীষণ ধৃষ্টতায় বলে বসেছে, “আমাকে মনে রাখবেন তো ম্যাম?” . এ অপরাধের শাস্তি ঠিক করতে পারলেন না তিনি। হৈমন্তীর দু’গালে দুটো হাত রাখলেন তিনি, “সুখে থাক মা। যেখানেই থাক, সুখে থাক…”
হাঁটতে শুরু করলেন মিসেস ঘোষ। ওরা দু’জনে উলটো দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগল। হৈমন্তীর চোখ বেয়ে জল নামছিল। সেটা মুছে নিয়ে পাশে তাকিয়ে সে বলল, “চলো, বাড়ি ফিরব এবার।”
—“আপনার বোনের সঙ্গে দেখা করবেন না?”
“না।”
—“কেন?”
—“আমার আর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানো উচিত হবে না।”
—“কেন বলুন তো?” একটু হেসে হৈমন্তী বলে, “মানুষের মধ্যেও একধরনের জু হাইপোথিসিস কাজ করে, বুঝলে? আমাদের যতই ইচ্ছা হোক, সবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। চলো তো, আমাদের জিলিপি ঠান্ডা হচ্ছে…”
* * * *
—“তোমাকে অনেকবার বলেছি? এমন করলে শাস্তি পেতে হবে…” শশীর মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দেয় রমেন। বাইরে থেকে টেনে দেয়। ছিটকিনি’টা, “আপাতত বন্দি থাকো। যা দেখবে জানলা দিয়ে দেখো।”
বন্ধ দরজার ওপার থেকে গটগট করে নেমে যাওয়ার শব্দ পায় শশী। একবার দরজার উপর চাপড় মারে সে। তারপর গোমড়া মুখ করে জানলার দিকে সরে আসে।
আজ সকাল থেকে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা গাছ কাটা হবে। কেন কাটা হবে তা অবশ্য বাড়ির হর্তাকর্তা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। শশীর বয়স কম। তার ভারী ইচ্ছা সেও জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে গাছ কাটা দেখবে। এই মর্মে বাবার কাছে আগ্রহ দেখাতে গিয়েই কাল হয়েছে। ঘরের ভিতরে আটকা পড়তে হয়েছে। সে ভারী দুরন্ত ছেলে। এক জায়গায়। বেশিক্ষণ বসতে পারে না।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে দূরে জঙ্গলের ভিতরটা চোখে পড়ে তার। এখন অবশ্য গাছপালার সার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু একটু পরেই গাছের মাথা কেঁপে উঠবে। মানে তাদের গোড়া কাটা হচ্ছে। এটুকু যা দেখতে পাবে শশী।
গাছগুলোর কাছে পৌছে মুরারিমোহনের দিকে একবার ফিরে তাকায় অশ্বিনী, “আপনি মানলেন না আমার কথা।”
চারপাশটা দেখতে দেখতে মুরারি বলেন, “তুমি আমাকে মাফ করো ভাই, ও কথা আমি রাখতে পারব না। সারাজীবন বিজ্ঞানসাধনা করে এসেছি, যা কিছুতে মানুষের উপকার হয় তাই করব আমি।”
—“সেক্ষেত্রে আমার সাহায্য নেওয়া উচিত হয়নি আপনার।”
—“থামো হে ছোকরা। আমি যা দেখেছি তা দেখলে তোমার পিলে চমকে যাবে। ভাসানবাড়ির ছাদ থেকে আমি দুশো বছর অবধি ভবিষ্যৎকালের আকাশ দেখেছি। তখনই বুঝেছি আমার গবেষণার কাগজ প্রকাশে আসার সময়ে এসে গেছে। এখন শুধু দেখতে চাই বাড়ির বাইরেও যন্ত্রটা কতদুর কাজ করে। বাড়ির বাইরে শেষ একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই… আজকের মধ্যে এ জায়গাটা সাফ হয়ে গেলে যন্ত্রটা এখানে এনে আজ রাতেই..”
—“বেশ…” অশ্বিনী দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা গাছের কাছে এগিয়ে যায়। তারপর সেটার উপরে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, “এই গাছটা আর এর পাশের চারটে গাছ কাটতে হবে, তাহলে যন্ত্রটার জায়গা হয়ে যাবে। তাছাড়া জায়গাটা থেকে এখনও সাধারণ আকাশই দেখা যায়। ফলে আপনার গবেষণার ফলও একেবারে নির্ভুল আসবে…”
—“খেটুরাম…” জোর গলায় ডাক দেন মুরারি। একটু পিছিয়ে হাঁটছিল খেটু আর তার দুই সাগরেদ। তারা এগিয়ে এসে হাত জোড় করতে মুরারি বলেন, “এই দাদাবাবু তোদের গাছ দেখিয়ে দেবে। আজ বিকেলের মধ্যে আমার জায়গাটা সাফ চাই একদম।”
—“জী হুজুর। আভি কাম শুরু করে দেব.” বাড়ির আর জনাপাঁচেক লোক এসে জড় হয়েছে জায়গাটায়। গাছের গুঁড়িটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে তারা। শক্ত গুঁড়ি। তবে খেটু আর তার সাগরেদদের হাতের অস্ত্রও তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো। করাতের মনে দেখতে অনেকটা, কিন্তু তার থেকে ঢের বেশি ধারালো আর লম্বা। করাতে গায়ের হিংস্র কাঁটাগুলোকে দেখলে মনে হয় গাছকে কাটার আগে খানিকটা অত্যাচার করার অভিপ্রায় আছে তাদের। দড়ি আর সেই করাত হাতে গাছের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা।
আচমকা বাধা দিয়ে ওঠে। উপরে তাকিয়ে কিছু একটা চোখে পড়েন হাত তুলে বলে, “একটু দাঁড়ান। গাছের উপরে কিছু একটা আছে,
—“ক্যা হ্যাঁয়?” অবাক হয়ে জিগেস করে খেটু।
আরও ভালো করে দেখে নিয়ে মুখ নামায় অশ্বিনী, “একটা পাখিস তাতে পাখির বাচ্চাও আছে। প্রাণীহত্যা উচিত হবে না।”
রমেন সামনে এগিয়ে আসে, “আরে গাছ কাটলে তার সঙ্গে কিছু তো যাবেই… তেমন হলে ঢিল ছুঁড়ে উড়িয়ে দাও পাখিকে।”
—“বাচ্চা পাখি। উড়তে পারে না।”
—“তাহলে কী করবে এখন?” মুরারি জিজ্ঞেস করেন।
—“ওদের নামিয়ে আনতে হবে।” খ্যাক খ্যাক করে খৈনি খাওয়া গলায় হেসে ওঠে ঘেঁটু, “বাবুজি বাহক গায়ে ক্যা…”।
—“আরে এ কি আমগাছ নাকি যে উপরে উঠে নামিয়ে আনবে?” রমেন ঝাজিয়ে ওঠে, “কাণ্ডটা দেখেছ? একেবারে সিধে উঠে গেছে। এ গাছে ওঠার ঝামেলা অনেক…”
—“হাম পেড় কাটনে আয়ে হে, চড়েঙ্গে নেহি।” ঘেঁটু সাফ জানিয়ে দেয়।
মুরারি একটু এগিয়ে বলেন, “বেশ তো। অশ্বিনীর যখন মনে হচ্ছে বাসাটা নামিয়ে আনা উচিত তখন ও নিজেই নামিয়ে আনুক না হয়। তারপর আমরা গাছে হাত দেব।”
রমেন আবার আপত্তি জানাচ্ছিল। অশ্বিনী তার আগেই এগিয়ে গেছে গাছের কাণ্ডের দিকে। মাটির উপর দাঁড়িয়ে একবার কাণ্ডটা ভালো করে দেখে নেয় সে। তারপর দড়ি-টড়ির তোয়াক্কা না করে কাণ্ড জড়িয়ে ধরে উপরে উঠতে থাকে। জিভ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে খেঁটু, “গিরনে পে বাচনেকা উম্মিদ নাহি। আজ কুছ গালাথ হোনেওয়ালা হ্যাঁয়।”
মিনিট পনেরোর কসরতে অন্তত তিনতলা সমান গাছটার মাথার উপরে উঠে আসে অশ্বিনী। ডালপালার ফাঁকে পাখির বাসাটা তার চোখের সামনে চলে আসে। মা পাখিটা এখন নেই। তবে সদ্যজাত তিনটে বাচ্চা গোলগোল চোখে তাকায় অশ্বিনীর দিকে। এর আগে বাসার কাছে মানুষ দেখেনি তারা। অবাক হয়ে ঠোঁট বাড়িয়ে কয়েকবার চকচক করে আওয়াজ করে।
জানলা থেকে গাছের মাথায় মানুষ উঠতে দেখে চমকে যায় শশী। যে ছেলেটা গাছের মাথায় উঠেছে তাকে সে চেনে। ওদের বাড়িতেই থাকে। দাদুর কাজে কীসব সাহায্য করে। একবার নাকি দাদু তাড়িয়ে দেবেন ভেবেছিলেন। তারপর কিছু কারণে ফিরিয়ে এনেছেন। ছেলেটার গায়ের শালটা এখন তার কোমরে বাঁধা। হাত বাড়িয়ে গাছের ডালপালার মধ্যে থেকে কী একটা যেন বের করে আনছে। শশী জানে ওদের বাড়ির প্রায় সব লোক ওই গাছতলায় গিয়ে ভিড় করেছে। ওকে একা শুধু বন্ধ করে রেখেছে বাড়িতে। স্থির চোখে তাকিয়ে দেখছিল শশী। গাছে ওঠা ছেলেটা একটা হাত আকাশের দিকে তুলে ধরে। যেন আকাশের দিক থেকে কাউকে ডাকছে সে। তাজ্জব হয়ে যায় শশী। কাকে ডাকছে ছেলেটা?
পরমুহূর্তে তার চোখে ধাঁধাঁ লেগে যায়। পরিষ্কার রৌদ্রজ্জ্বল আকাশের বুক থেকে সাদা রঙের কিছু একটা নেমে আসে গাছটার ঠিক মাথার উপরে। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে ওদের বাড়িটা। যেন আর একটু হলেই মাটি থেকে উপড়ে পড়বে সেটা।
বাজ পড়ল? কিন্তু এমন মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ থেকে কি বাজ পড়ে?
শশীর মাথায় এসব ভাবনা খেলার অবকাশ পেল না। পাতাল বিদীর্ণ করা একটা শব্দ ওর সমস্ত চেতনাকে কয়েক মিনিটের জন্য নিস্ক্রিয় করে দিল। জানলার সামনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল ও। মিনিট খানেক পরে চোখ খুলতে উঠে দাঁড়াল শশী। কানের ভিতরে এখনও একটানা স্থির রেডিও তরঙ্গের শব্দ হয়ে চলেছে। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখল। জঙ্গলের ওই বিশেষ জায়গাটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। জলছবির সবজ ক্যানভাসের ওইটুকু অংশে ভুল করে কালো রঙ পড়ে গেছে যেন।। আর নড়ছে না গাছগুলো। গাছের মাথায় যে ছেলেটা উঠেছিল তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না। শশী বুঝতে পারে ওদের কাউকে আর কোনওদিন দেখতে পাবে না।।
দরজায় খটখট করে শব্দ হতে সেদিকে ঘুরে তাকায় শশী। বাইরে থেকে। ছিটকিনি খুলছে কেউ। দরজাটা খুলে একটা ছেলে ঢুকে এল ঘরের ভিতর। তার কোমরের শালটা এখন আবার আগের মতো কাঁধে ফেলা রয়েছে। শরীরের কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।
হাসিমুখে শশীর দিকে এগিয়ে এল সে। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম শশাঙ্কমোহন, মুরারিবাবুর নাতি। তাই তো?” বিস্ময়ে শশীর মুখে কোনও কথা ফোটে না। সে চুপ করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার মুখের দিকে।
অশ্বিনী এগিয়ে এসে দুটো হাঁটু মাটিতে রেখে বসে পড়ে তার সামনে। তারপর আগের মতোই মিহি সুরে বলে, “তোমার জন্য একটা জিনিস আছে আমার কাছে।”
ধীরে ধীরে নিজের হাতের মুঠো খুলে ধরে অশ্বিনী। শশী তাকিয়ে দেখে সেই মুঠোর ভিতরে ধরা আছে তিনটে অক্ষত, জীবন্ত পাখির বাচ্চা। হাতের উপড়ে মাঝে মাঝে অপরিণত ঠোটে ঠোকর মারছে তারা।
—“ভয় নেই, হাত পাতো..” শশী হাত পাততে তার উপর বাচ্চাগুলোকে রেখে দেয় অশ্বিনী। তারপর শশীর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে বলে, “এদের যত্ন নিয়ো… আমি আবার আসব পরে…”
উঠে পড়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে যায় অশ্বিনী। শশাঙ্কমোহন অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তারপর তার চোখ নেমে আসে পাখির বাচ্চাগুলোর দিকে।