অষ্টাদশ অধ্যায়
—“বাবু, আপনি একটি ছেলে আনতে বলেছিলেন, সে এসছে।” – “পাঠিয়ে দে।” বসার ঘরে রাখা আরামকেদারায় পিঠ এলিয়ে বসলেন মুরারিমোহন। সবে ভোর হয়েছে। আকাশে নীল রঙ ধরতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। মুরারি এই ভোরের দিকটায় জানলার সামনে রাখা কেদারায় এসে বসেন। সকালে পাখির ডাক শুনলে সারাদিন মনটা ভারী উৎসাহ পায়।।
দরজার কাছে পায়ের আওয়াজ হতে ফিরে তাকান মুরারি। রঘুবীর পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকে আসে। তারপর ঝুলন্ত পর্দার দিকে চেয়ে বলে, “কই থোকা, ভিতরে এসো। বাবু এ-ঘরেই আছেন।” পর্দার আড়াল থেকে যে ছেলেটি ঘরে ঢুকে আসে তাকে আগে কখনও দেখেননি মুরারি। ভারী বলিষ্ঠ, ঋজু চেহারা। অথচ মুখে কেউকেটা ভাব নেই। বরঞ্চ শরীরের তুলনায় মুখটা শিশুসুলভ। চোখ দুটোয় একটা দ্যুতি খেলা করে যাচ্ছে। এখন জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। তার উপরে ভোর, তাও ছেলেটার গায়ে পাঞ্জাবির উপরে কেবল একটা পাতলা শাল ফেলা। মুরারি তাকে উপর থেকে নিচ অবধি একবার দেখে নেন, তারপর মুখ ফিরিয়ে আবার জানলার দিকে চেয়ে বলেন, “নাম কী তোমার?”
—“অশ্বিনী…”
—“পুরো নাম।”
—“ওইটুকুই। আর কিছু নেই।”
চোখ তুলে তাকান মুরারি, “থাকা হয় কোথায়?”
একটু কি হাসে ছেলেটা? বলে, “আপাতত থাকার জায়গা নেই।”
—“তাহলে চেনা পরিচিত কেউ?”
ছেলেটা মাথা নিচু করে, “একজন আছে। তার খোঁজেই এসেছি এখানে।”
—“কার কথা বলছ তুমি? কে থাকে এখানে?”
—“থাকে না। থাকবে। দেরি আছে।” ছেলেটার কথাবার্তা স্বাভাবিক নয়। খানিকটা কি ছিট আছে? তবে?
মুরারি আবার জানলার বাইরে তাকিয়ে বলেন, “দেখো তোমার চেহারা দেখে আর কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে আমার কাজের জন্য তুমি উপযুক্ত, কিন্তু একটা অজ্ঞাত কুলশীল মানুষকে ঘরে থাকতে দেব… আচ্ছা, তুমি ঠিকানা রেখে যাও। আমি কিছু ভেবে উঠলে খবর দেব।”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে অশ্বিনী। তারপরের যা বলে সেটা শুনে মুরারি চেয়ারটা তার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বসেন।
—“বাইশ নম্বর হুইল, উত্তর পূর্ব কোণে সতেরো ডিগ্রী পোলার এক্সিস…”
—“মানে?” মুরারি প্রায় আঁতকে ওঠেন।
—“আপনি যে নক্ষত্রের গতিপথ দেখতে চাইছেন সেটা ওই যন্ত্র দিয়ে কীভাবে দেখতে পারবেন সেটাই বললাম।” হাতের ইশারায় রঘুবীরকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন মুরারি। চেয়ারের ঠিক পাশে রাখা টুলটা দেখিয়ে অশ্বিনীকে বসতে বলেন। এক গ্লাস জল খান ঢকঢক করে, “যন্ত্রটার কথা তুমি জানলে কী করে?”
—“অজ্ঞাতকুলশীলকে চাকরি পেতে গেলে এটুকু তো জানতেই হয়…”
—“গ্রামে কেউ ও যন্ত্রের নামও শোনেনি। ভূ-ভারতে হাতেগোনা কয়েকজন জানে যন্ত্রটার কথা। সত্যি করে বলতো তোমার মতলবটা কী?”
—“আমি মিথ্যে বলি না। এ-বাড়িতে একজনের আসার কথা আছে। তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্যে নেই আমার।”
মুরারিমোহন ব্যাপারটাকে আর এগোতে দেন না। চশমাটা চোখের উপর টেনে এনে বলেন, “আমার যন্ত্রের ব্যাপারে আর কী জানো তুমি?”
—“এটা জানি যে আপনি যন্ত্রের প্রক্রিয়া বিপরীত করতে চাইছেন।” এতক্ষণে অভিজ্ঞ মুরারিমোহন বুঝতে পারেন এ কোনও সাধারণ ছেলে নয়। ভালো করে জিজ্ঞাসা করতে পারলে এর কাছ থেকে যন্ত্রের ব্যাপারে আরো কিছু তথ্য জানা যেতে পারে।
—“তোমার কি মনে হয় সেটা সম্ভব?”
ছেলেটা সরাসরি উত্তর দেয় না। উলটে একটা প্রশ্ন করে, “লাভ কী?”
—“লাভ কী! কী বলছো তুমি! দেখো, যন্ত্রটা ব্যবহার করে আকাশে সমস্ত। নক্ষত্রের অতীত অবস্থা দেখতে পাই আমরা। আজ থেকে কয়েকশো বছর। আগে সেখানে কী ছিল, আবহাওয়া কেমন ছিল, প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কিনা। সব কিছু দেখা যায়। এখন ভাবো যদি নক্ষত্রের ভবিষ্যৎও এমন করে দেখা। যায় তাহলে পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে এই যন্ত্র স্থাপন করলে ভবিষ্যতের পৃথিবীও দেখতে পাব আমরা। আর সেটা হলে কী হবে বুঝতে পারছ?”
—“আজ থেকে দুশো কি তিনশো বছর পরের মানুষদের দেখে আমরা তাদের প্রযুক্তি শিখে নিতে পারব।”
—“শুধু প্রযুক্তি? তাদের গতিময় বিজ্ঞান, তথ্য, শিল্প, ওষুধ…”
—“ওষুধ!”
—“হ্যাঁ, ওষুধ… পৃথিবীতে এমন অনেক রোগ আছে যার ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। হয়তো আজ থেকে পাঁচশো বছর পরে হবে। আমরা ভবিষ্যৎ মানবসভ্যতাকে দেখে সেই অসুধের ব্যবহার এখনই শিখে নিতে পারি।”
—“মানে মানুষের আর মৃত্যু হবে না।”
—“হবে না নয়। কিন্তু কমে আসবে। কখন ভূমিকম্প হবে, কখন সাইক্লোন আসবে, সব আগে থেকে জানতে পারব আমরা।”
—“আপনার মনে হয় না ভবিষ্যতের মানুষকে জায়গা দিতে বর্তমানের মানুষের চলে যাওয়াটা অবশ্যম্ভাবী? প্রতি বছর পুজোর শেষে প্রতিমাকে ভাসান দেন না আপনি?”
কপালে একটা হাত রাখেন মুরারিমোহন, “তোমার বয়স বেশি নয়। হয়তো এমন কাউকে এখনও দেখোনি যে রোগে ভুগে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে…”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অশ্বিনী। শালটা গা থেকে খুলে আবার গায়ে চাপিয়ে নেয়। তারপর বলে, “আমি আপনাকে কাজটায় সাহায্য করতে পারি। কিন্তু একটা শর্তে।”
—“কী শর্ত?”
—“যন্ত্রের প্রক্রিয়া বিপরীত করার উপায় আপনি আমার সাহায্যে আবিষ্কার করলেও অন্য কাউকে জানাতে পারবেন না।”
—“মানে! কেন?” মুরারিমোহন অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।
—“তাহলে যার এখানে আসার কথা তার আর আসার প্রয়োজন পড়বে না।” একটু সময় নিলেন মুরারিমোহন, কেদারায় আবার পিঠ এলিয়ে দিয়ে বললেন, “শুধু আমি জেনে লাভ কী হবে? মানুষের তো কোনও উপকার হবে না তাতে।”
অশ্বিনী গম্ভীর, ভারী গলায় বলে, “মানুষের উপকার মানুষকেই করতে হবে। আমার পক্ষে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়।”
—“জু হাইপথিসিস…” অবাক গলায় বিড়বিড় করেন মুরারিমোহন। তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলেন, “যাই হোক, এসব নিয়ে পরে কথা হবে না হয়। এখন থেকে তুমি এ-বাড়িতেই থাকবে। ভালো কথা, তোমার খাওয়া-দাওয়ার কোনও বাধা-নিষেধ আছে কি কিছু?”
—“আমি আমিশ খাই না।”
—“বেশ, আর কিছু?”
—“আমার একার জন্য একটা ঘর চাই। আমি ভিতরে থাকলে ভিতর থেকে তালা দিয়ে থাকব।”
হাঁক দিয়ে রঘুবীরকে ডাকলেন মুরারি। সে এসে দাঁড়াতে অশ্বিনীকে দেখিয়ে বললেন, “একে আমার পাশের ঘরটা দেখিয়ে দে। আজ থেকে ইনি এখানেই থাকবেন।”
মাথা নেড়ে প্যাসেজে বেরিয়ে রঘুবীর অশ্বিনীকে দেখিয়ে দেয় ঘরটা। তারপর তালা চাবি হাতে দিয়ে বলে, “আপনি এখানে কদ্দিন থাকবেন?”
—”কেন বলো তো?”
ইতস্তত করে রঘুবীর, “বাবুর সঙ্গে যেনারাই কাজ করতে আসে তার বেশিদিন টেকে নে।”
রঘুবীরের কাঁধে একটা হাত রাখে অশ্বিনী, “আমি অনেকদিন থাকব, বুঝলে? এই বাড়িটা ভারী ভালো লাগছে আমার।”
—“বেলা তো পেরিয়ে গেছে। আপনি খাবেন কিছু?”
অশ্বিনী মাথা নাড়ে, “না। ক্লান্ত লাগছে বেশ। একটু বিশ্রাম নেব।” আর কথা না বাড়িয়ে দরজাটা টেনে দেয় রঘুবীর। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যায়। অশ্বিনী দরজায় ছিটকিনি দিয়ে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সিলিঙের দিকে। গোটা দুপুর কেউ ডাকাডাকি করে না অশ্বিনীকে। আজ প্রথম দিন বলে দুপুরে তাকে দিয়ে কোনও কাজ করাননি মুরারিমোহন। বিকেলের দিকে তার দরজায় টোকা পড়ে। সে ভিতর থেকে সাড়া দিতে দরজার ওপার থেকে রঘুবীর বলে, “বাবু আপনাকে নিচে ডাকছেন। ছবি তোলা হবে।”
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে অশ্বিনী। জিজ্ঞেস করে, “কীসের ছবি?”
—“বাবুর শখ হয়েছে। বাড়ির সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে ছবি তোলা হবে। বাইরের চাতালে মেশিন বসিয়েছেন।”
—“আচ্ছা বেশ। তুমি যাও, আমি আসছি।” রঘুবীর নিচে চলে যেতে প্যাসেজটা পেরিয়ে ডানদিকে চলে আসে অশ্বিনী। যে ঘরে যন্ত্রটা রাখা আছে সেখানে ঢুকে আসে। চারপাশটা একবার ভালো। করে দেখে নেয়। তারপর ঘরের বন্ধ জানলাটার দিকে এগিয়ে আসে। ছোট একটা ধাক্কায় খুলে দেয় জানলাটা। বাইরে তাকিয়ে দেখা যায় বাড়ির চাতালে সত্যি দুটো নোক একটা ক্যামেরা বসিয়েছে। তার সামনে ভিড় জড় হওয়া শুরু হয়েছে।
পিছনে তাকিয়ে অশ্বিনী যন্ত্রের খোপের দরজাটা খেয়াল করে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বাইরের ক্যামেরাটার দিকে।
—“এ কী! তুমি এখানে কেন?” ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে একটা লোক। সম্ভবত এ বাড়িতেই থাকে। কিছু একটা নিতে এসেছিল বাড়ির ভিতরে। অশ্বিনীকে এ ঘরে জানলার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ করেছে হয়তো।
—“হ্যাঁ, এই যাচ্ছি নিচে।” মুখ দিয়ে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করে লোকটা, বলে, “এ কী! এই শীতের বিকেলে জানলা খুলে দিয়েছ কেন? ঘরটা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।”
—“একটু খোলা থাক। সন্ধ্যা নামার আগে বন্ধ করে দেব।” কথাটা বলে নিচে নেমে চাতালে চলে আসে অশ্বিনী। ছবি তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে এতক্ষণে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। আকাশে হালকা মেঘ জমছে। আলো হয়তো কমে আসবে একটু পরে। তাই তাড়াতাড়ি তুলে নেওয়া হবে ছবিটা।
অশ্বিনী ক্যামেরার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। যে লোকদুটো ছবি তোলার দায়িত্বে আছে তাদের দিকে একবার হাসি মুখে চেয়ে নরম গলায় বলে, “আমার খুব চোখ রাখার ইচ্ছা ওতে…”
অশ্বিনীর হাসিটা সময়ে সময়ে কাজে দেয়। লোক দুটো যন্ত্রের একটা বিশেষ জায়গা দেখিয়ে বলে, “সামনে পেয়েছ যখন দেখে নাও। ওই ফুটো দিয়ে দেখতে পাবে, চোখ রাখো।”
অশ্বিনী চাদরটা মাথার উপর নিয়ে চোখ রাখে সেই আইহোলে। জানলা – দিয়ে আংটাটা দেখা যাচ্ছে। মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে, “খুব সুন্দর।”
জমাট ভিড়ের একটা কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তারপর একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ক্যামেরার দিকে। ছবি তুলতে মিনিট দশেক সময় লাগে। কাজ শেষ হতে ক্যামেরাম্যান এগিয়ে আসে মুরারিমোহনের দিকে। তারপর একগাল হেসে বলে, “ব্যাস, আপনারা এতগুলো মানুষ এবার অমর হয়ে গেলেন। আপনাদের দেহ মিলিয়ে যাবে কিন্তু এ ছবি… কয়েকশো বছর পরেও থেকে যাবে। কি ভাই, তাই তো?”
শেষ কথাটা অশ্বিনীর দিকে চেয়ে বলেছে লোকটা। সে মৃদু হেসে মাথা নাড়ে।
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মুরারিমোহনের ঘরে ডাক পড়ল অশ্বিনীর। ঘরে পৌছাতেই লক্ষ্য করল মুরারিমোহনের সমস্ত মুখ লাল হয়ে আছে। পড়ার টেবিলের উপরে কিছু কাগজপত্র ছড়ানো। দেওয়ালে আটকানো দেরাজের সমস্ত পাল্লা হাট করে খোলা।
অশ্বিনীকে দেখে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি, “তুমি সত্যি করে বলো তো কী উদ্দেশ্যে এসেছ এখানে?”
—“বলেছি আগে। আবার একবার বলছি না হয়।”
—“ওসব আমি শুনতে চাই না। আমার বাক্স কোথায় রেখেছ বলো?”
—“বাক্স!”
—“হ্যাঁ। যাতে আমার গবেষণার কাগজপত্র থাকত।” আর কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মুরারিমোহন। তার আগেই বিকেলে দেখা সেই। লোকটা ঘরে ঢুকে আসে। ঘরের ওলট-পালট অবস্থা দেখে একটু থমকে গিয়ে। জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে মামাবাবু?”
—“হয়নি কিছু, তবে হবে… টের পেতে শুরু করেছি এর মধ্যে…”।
—“কিছু চুরি গেছে?” লোকটা অশ্বিনীর দিকে একবার চেয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করে। তারপর মুরারিমোহনের দিকে এগিয়ে আসে।
—“একটা বাক্স। তুমি তো দেখেছো। নবগঞ্জের বাহাদুরসাহেব উপহার দিয়েছিলেন। তার উপরে রত্নটত্ন বসানো ছিল। সেইটা দেখেই ব্যাটা চুরি করেছে বাক্সটা।”
—“শুধু ওইটাই? নাকি আর কিছু.” টেবিলের উপরে একটা চাপড় মারেন মুরারিমোহন, “আরে সেইটাই ভেবে তো তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি। বাক্সের ভিতরে আমার গবেষণার কাগজ ছিল। সেগুলো দেরাজের মধ্যে রেখে গেছে চোর। তার বদলে দেরাজ থেকে কিছু সাদা কাগজ নিয়ে গেছে।”
—“সাদা কাগজ! সে আবার চুরি যায় নাকি?”
—“তাহলে বোঝো অবস্থা।”
অশ্বিনীর দিকে চোখ ফেরান মুরারিমোহন, “মাংস ভক্ষণ করো না, এদিকে চুরি করতে হাত কাঁপে না।”
অন্য লোকটা এবার রক্তচক্ষু হয়ে ওঠে, “আজ বিকেলে যখন সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত ছিল তখন একা ঘুরতে-ঘুরতে চুরি করেছিস তাই না?” অশ্বিনীর দিকে এগিয়ে এসে তার গালে দুটো সপাটে চড় মারে লোকটা। পা থেকে চটি-জুতো খুলতে যাচ্ছিল, মুরারিমোহন, “থাক রমেন। তুমি এসো এখন।” বলে থামিয়ে দেন। লোকটা আর একবার অশ্বিনীর দিকে হিংস্র দৃষ্টি হেনে গটগট করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
মুরারিমোহন নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করেন। তারপর চেয়ারে বসে পড়ে বলেন, “অচেনা অজানা একটা মানুষকে ঘরে থাকতে দিয়ে বড় একটা ভুল করে ফেলেছি রে ভাই। বাক্সটার জন্যে দুঃখ নেই। ওটা আমার ফেরতও চাই না। শুধু কলকাতা থেকে এত দূরে এসেও শেষে ঠক জোচ্চরের উপর বিশ্বাস করে ঠকতে হবে ভাবতে পারিনি। নাঃ তুমি কাল সকাল হলে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেও।” মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল অশ্বিনী। সে ধীরে ধীরে মুখ খোলে, “ঠিক আছে চলে যাব। কিন্তু আপনি দয়া করে চাকরি দিয়েছেন যখন তখন এ-বাড়িতে শেষ একটা কাজ করে যেতে চাই।”
—“কী কাজ?”
—“আমি যে ঘরটায় আছি তার জানলার উপর ভাঙা জায়গাটা খানিকটা চুন সুরকি পেলে আমি মেরামত করে দিতে পারি।”
—“জানলার উপরে ভাঙা জায়গা!” মুরারি একটু থমকান, “ওই জায়গাটা ভেঙে গেছে নাকি? আজ বিকেলেই তো দেখলাম..”
“ভাঙেনি। ভাঙবে। আজ রাতে এ বাড়ির কাছে একটা বাজ পড়বে, তাতেই ভেঙে পড়বে জায়গাটা।” মুরারিমোহন আর কিছু বলেন না। হাতের ইশারায় তাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।
অশ্বিনী ঘরে ফিরে এসের দরজার ছিটকিনি তুলে দেয়। তারপর বিছানার তলা থেকে বের করে আনে রত্নখচিত বাক্স এবং সাদা কাগজগুলো। ঘরের বাতিটা জ্বালিয়ে সাদা কাগজের উপরে কিছু লিখতে শুরু করে সে। কয়েক জায়গায় কিছু চিহ্ন আঁকে। কোথাও নিজের ইচ্ছামতো আঁক কাটে। দু এক জায়গায় চিড়িয়াখানা কথাটা লিখে দেয়। বাইরে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শীতকালে এমন ঝড়ের তান্ডব সচরাচর দেখা। যায় না। মেঘ ডাকছে ক্রমাগত। দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ শোনা গেল। ক্রমশ কাছে আসছে সেটা।
অশ্বিনীর মুখমণ্ডলে কিন্তু কোনও বিকার নেই। দ্রুত হাত চলতে থাকে তার। কাগজের উপরে ঘসঘস আওয়াজে ভরে ওঠে ঘরটা। যেন মুখস্ত কিছু লিখে চলেছে।
ঘণ্টাতিনেকের মধ্যে লেখা শেষ হয়ে যায় তার। ভালো করে একবার দেখে নিয়ে সমস্ত লেখা কাগজগুলো বাক্সের ভিতরে ভরে ফেলে সেটার চাবি বন্ধ করে দেয়। বাক্সটা সরিয়ে রেখে আলো নিভিয়ে বিছানার উপরে শুয়ে পড়ে। ঝড় এখন প্রলয়ে পরিণত হয়েছে। ভীষণ বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে বাড়িটা। অন্ধকারে শুয়ে অঝোর বৃষ্টির শব্দ শুনতে থাকে অশ্বিনী। মনে হয় সেই বৃষ্টির শব্দে একটা গানের সুর মিশে আছে। এ গান লেখা হতে এখনও দু দশক বছর দেরি আছে। তোমার শেষ নাহি তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে…
অশ্বিনীর মনে হয় তার নিজের মতো এই শব্দগুলোেও সময়ের নিয়ম মানে , তারা অবিনশ্বর। তাদের কালের চাকায় ক্ষয় হয় না। কেবল সৃষ্টি আছে, ধ্বংস নেই।
“তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের
ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিগমন,
তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ…
অশ্বিনী চোখ বন্ধ করে নেয়।
* * * *
চোখ খুলে হৈমন্তী দেখে একটা অন্ধকার ছায়া বসে আছে তার বিছানার পাশের চেয়ারে। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। জানলাগুলো খুলে শুয়েছিল সে। এখন বন্ধ করা আছে।
—“ঘুম আসছে না?” হৈমন্তী ছায়াটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে।
—“আপনি জানেন আসে না।” ছায়া উত্তর দেয়।
—“তাহলে আয়নার সামনে বসে নেই যে… আমার অতীতের সব কিছু দেখা হয়ে গেছে?”
—“অনেকদিন আগে।”
—“হুম, মাঝরাতে প্যাঁচার মতো জেগে বসে থাকতে হবে না। আমার পাশে শুয়ে পড়ো।”
একটু ইতস্তত করে অশ্বিনী, “আমি আগে কোনওদিন..”
—“ধ্যাত…” বিরক্ত হয় হৈমন্তী, “আবার সেই ভাঙা রেডিও। আরে শোও, এডস রোগীর সঙ্গে শুলে এডস হয় না।”
—“মজা করছেন? হাসা উচিত ছিল আমার?”
—“উঁহু… ঘর অন্ধকার। হাসিটা না দেখে মিস করতে চাই না। শুয়ে পড়ো এখানে…”
কয়েক সেকেন্ড সময় নেয় অশ্বিনী। তারপর চেয়ার থেকে উঠে এসে শুয়ে পড়ে হৈমন্তীর পাশে। হৈমন্তী একটা হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “আজ একটা ব্যাপার জানতে পেরেছি, জানো?”
—“তাই নাকি?”
—“মহা মুশকিল তো! কী জেনেছি জানতে চাইবে না?”
—“নিশ্চই এমন কিছু যেটা আমাকে বলা বলা যাবে না।”
ঠোঁট উলটায় হৈমন্তী, “ধুর কোনও মজা নেই। তুমি তো সব কিছুই জেনে বসে আছে। কিন্তু আজ যে কীভাবে ব্যাপারটা জেনেছি তা তুমি ভাবতেও পারবে না।”
—“বটে!” অশ্বিনীর গলায় একটা হাসির ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তবে আমি একটা জিনিস খুব ভালো জানি।”
—“কী?”
—“আপনাকে কী করে এ-বাড়িতে আটকে রাখতে হয়…”।
মাথা তুলে অশ্বিনীর মাথায় একটা চাঁটি মারে হৈমন্তী, “বাজে কথা। আমি কখনও যেতেই চাইনি ভাসানবাড়ি ছেড়ে…”
—“তিনদিনের মাথাতেই যেতে চেয়েছিলেন। তারপর কেন জানি না। আটকে গেলেন…”
—“আরে জানলার উপরে ওই বাক্সটা…” কথাটা বলতে গিয়েও থেমে। যায় হৈমন্তী। আর একটু হলেই বলে ফেলেছিল কথাটা।
—“কোন্ বাক্স?”
—“না কিছু না..” আর একটু জোরে অশ্বিনীকে জড়িয়ে ধরে হৈমন্তী। হাত বাড়িয়ে একটা জানলা খুলে দেয়। বৃষ্টির মিহি ছাট এসে লাগতে থাকে ওদের গায়ে, বিছানায়।
—“আচ্ছা একটা কথা বলতো…” হৈমন্তী জড়াননা গলায় বলে।
—“কী?”
—“এই আমার গোটা জীবনটা চোখের সামনে না দেখে তুমি তো ছোট থেকে আমার সঙ্গে থাকতে পারতে। কোন বন্ধু হয়ে… পারতে না?”
—“না।”
—“কেন?”
অশ্বিনী সিলিঙের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে, “এই যে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলি, স্পর্শ করি এটা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ। সে নিয়ম। মানলে আপনাকে শুধু দেখতে পারি আমি। দেখা দিতে পারি না। এই
পৃথিবীতে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে প্রকৃতির নিয়ম খাটে না, কেবল এই বাড়িটা ছাড়া। এখানে এমন একটা যন্ত্র আছে যেটা সময়ের স্বাভাবিক নিয়ম পালটে দিতে পারে… ফলে মহাবিশ্বের কোনও নিয়ম মানতে হয় না এখানে। তাই এ বাড়িতে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি।”
—“কিন্তু আমরা যে বাজারে গেছি এক সঙ্গে, তোমার সেই ডোবাটার উপরে গিয়ে বসেছি…”
—“সে তো দেখা হওয়ার পর। এখন আর কোথাও যেতে বাধা নেই…” কিছুক্ষণ চিন্তায় ডুবে থাকে হৈমন্তী। একটা প্রশ্ন বারবার অমাবস্যার তারার মতো জেগে উঠছে তার মনে, “তুমি তো ভবিষ্যতেও যেতে পারো, তাহলে আমি মারা গেলে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা না করে আমার দ্বিতীয় জীবনে চলে যেতে পারবে?”
—“না হৈম। আমি ভবিষ্যৎ জানতে পারি, সেখানে যেতে পারি না।” বুক থেকে মুখ তোলে হৈমন্তী, “জানতে পারো। মানে আমি কবে মরব। তুমি এখন জানো?”
—“জানি।”
—“বলো কবে?”
তার মাথাটা আবার বুকে টেনে নেয় অশ্বিনী।।
—“বেশ, বুঝেছি বলবে না। তাহলে এটুকু অন্তত বলো যখন মরব তুমি কাছে থাকবে কিনা…”
—“এমন কোনও সময় আসবে না যখন আমি তোমার কাছে থাকব না।” কেউ আর কোনও কথা বলে না। বৃষ্টির ফোঁটারা এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে। সেই নিস্তব্ধতার সুযোগে শোনা যায়, সত্যি দূরের কোন রেডিও থেকে গান ভেসে আসে। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে লেখা কোনও গান। তার সুর বৃষ্টির ছাঁটের মতোই এসে ভিজিয়ে দিতে থাকে ওদের
“দেখা দেবে বলে তুমি হও যে অদর্শন,
তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ”