ভাসানবাড়ি – ১৭

সপ্তদশ অধ্যায়

—গল্পের বইটা বুকের উপরে ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছিল হৈমন্তী। সকালের রোদ অনেকক্ষণ থেকে অপেক্ষা করছে মুখটা ঘিরে। আজকাল ওর সহজে ঘুম ভাঙতে চায় না। কখনও চোখ খোলে, আবার নিজে থেকে বুজে আসে। শরীর শেষ হয়ে আসছে বলে কি ঘুম বেড়েছে? নাকি এই ক’দিন আগের থেকে মনটা ভালো আছে হৈমন্তীর?

মন খারাপের নানারকম কারণ হয় না। একটাই হয়—আমরা যে জিনিসটাকে চিরকালীন সত্যি ভেবে এসেছি সেটা হুট করে একদিন মিথ্যে প্রমাণিত হলে। বেঁচে থাকতে মানুষ নিজেকে অবিনশ্বর ভাবে। রোজ কালকের প্ল্যান গোছাতে গোছাতে শুতে যায়। তারপর একদিন হুট করে মৃত্যু এসে ধাক্কা দিয়ে তার অস্তিত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গেলে মেনে নিতে পারে না। যাদের বারবার এভাবে

বিশ্বাস ভেঙে যেতে থাকে তারা ভারী বেপরোয়া হয়ে খাঁটি কিছু খোঁজার চেষ্টা করে, এমন কিছু যা সাজানো নয়, কৃত্রিম নয়। যতক্ষণ সেটা না খুঁজে পাচ্ছে ততক্ষণ তার ভিতরে একটা হাহাকার চলতে থাকে।

ভাসানবাড়িতে এসে থেকে অবাস্তব সব ঘটনা ঘটে চলেছে হৈমন্তীর সঙ্গে, অথচ সেই অবাস্তবের কোথাও কোনও ভেজাল নেই, নকল নেই।

কলকাতায় থাকতে এমন একটা জিনিসই খুঁজে পেয়েছিল হৈমন্তী। জন ডেনভারের গান। এখন একটু দূরে খোলা ল্যাপটপ থেকে সেই গানই ভেসে আসছে। বই রেখে সেটা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে হৈমন্তী।

“All of her days have gone soft and cloudy

All of her dreams have gone dry

All of her nights have gone sad and shady

She’s getting ready to fly…”

এতক্ষণ তার মুখে আলো পড়তে ঘুম ভাঙেনি। এখন আচমকা মুখ থেকে রোদ সরে গিয়ে ছায়া পড়তে ঘুমটা ভেঙে গেল হৈমন্তীর। চোখ খুলেই সে দেখতে পেল সামনে গনশা এসে দাঁড়িয়েছে। বিকেলের দিকে ছাদে এসে ঘুরঘুর করে গনশা। কখনও ঘুড়ি ওড়ায়। আজ কিন্তু হাতে লাটাই দেখা গেল না।

তার দিকে চেয়ে হাতের বইটা বন্ধ করতে করতে হৈমন্তী বলল, “কী। জোনসবাবু? হাতে বন্দুক ছাড়াই এনিমি টেরিটরিতে!”

হৈমন্তীর কোলের উপরে রাখা বইটার দিকে ইশারা করে দেখায় গনশা, “কীসের বই ওটা?”

—“এটা?” হৈমন্তী বইটা তুলে ধরে, “গল্পেরও বলতে পারিস আবার পড়ারও বলতে পারিস। তুই কীভাবে পড়ছিস তার উপর নির্ভর করছে।”

বইটা ভালো করে দেখতে থাকে গনশা। প্রচ্ছদের ছবিটা চোখ টানছে তার। সেখানে আঙুল রেখে বলে, “এটা পিরামিড! আমি চিনি।”

—“ তবে যে সে পিরামিড নয়। দ্য গ্রেট পিরামিড অফ গিজা। বিজ্ঞানীরা বলে তৈরি হতে কুড়ি বছর সময় লেগেছিল!”

—“মাত্র!”

—“ইয়েস। গোটা পৃথিবীর মানুষ তখনও জন্তু-জানোয়ারের ছাল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই সময়ে মাত্র কুড়ি বছরে পাথরের ব্লক একটার উপর একটা চাপিয়ে এইটা তৈরি করেছিল ইজিপ্টের কারিগররা। মোট কটা ব্লক আছে আন্দাজ কর।” পিরামিডটা ভালো করে খেয়াল করে গনশা বলে, “দশ হাজার!”

—“না হে, তেইশ লক্ষ। যার প্রত্যেকটা ব্লকের ওজন ছিল একটা গাড়ির সমান। আটশো কিলোমিটার দূরে আসওয়ান নামের একটা জায়গা থেকে ওদের কেটে আনতে হত ব্লকগুলো। তারপর সমান করে কাটো, একটার মাপ একটু এদিক ওদিক হলেই হুরমুড়িয়ে ভেঙে পড়বে। ভাব, তখন তো ভেঙে পড়েইনি, তিন হাজার বছর পরেও আস্ত টিকে আছে। কী করে করল। বলতো?” গনশা হাঁ হয়ে থাকে। উত্তর দেয় না।

—“তার উপরে এরা নাকি আবার চাকার ব্যবহার জানত না। সম্বল বলতে কেবল ছেনি আর হাতুড়ি!”

—“কী করে করল গো?” এবার গনশা জিজ্ঞেস করে।

—“বলছি, তার আগে শোন। এই কাজটা যদি আজকের লোক আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে করতে যায় তাহলে কতদিন লাগবে…”

—“কতদিন লাগবে?”

—“আমাদের সব থেকে অ্যাডভান্সড যন্ত্রপাতি হাতে সব থেকে বুদ্ধিমান ইঞ্জিনিয়ারদের গিজার পিরামিডের অবিকল একটা স্ট্রাকচার তৈরি করতে সময় লাগবে দেড়শো বছর।”

গনশার হাঁ এবার আর একটু বড় হয়, “ওরা তাহলে এত কম সময়ে করল কী করে?”

হৈমন্তী হাসে, “তোর অশ্বিনীদাদাকে জিজ্ঞেস কর। একেবারে আই উইটনেসের সাক্ষ্য পেয়ে যাবি মনে হয়।”

—“নাঃ। তুমি বলো।”

গনশার পিঠে হাত রাখে হৈমন্তী, “কী করে বলব বল? আমার কাছে তো আন্দাজ করা ছাড়া উপায় নেই। তবে কী মনে হয় জানিস? আমাদের কাছে নানারকম যন্ত্র আছে বটে, কিন্তু পিরামিডের কারিগরদের কাছে এমন একটা যন্ত্র ছিল যেটা আমাদের নেই।”

—“কী যন্ত্র ?”

—“যে যন্ত্রটা এই বাড়িতে আছে। ওই যন্ত্রটা দিয়ে সময়কে মন্থর করে দেওয়া যায়। মানে ধর তোর এখান থেকে বাড়ি যেতে আধঘণ্টা লাগে। এখন আমি যন্ত্রটা ব্যবহার করে সময়কে কচ্ছপ করে দিলাম। আধঘণ্টা হয়ে গেল দুঘন্টা। তুইও তাহলে ওই আধঘণ্টায় চারবার বাড়ি যাওয়া আসা করতে পারবি। ইজিপ্সীওরা হয়তো এভাবেই এত কম সময়ে শেষ করেছিল কাজটা…”

—“হ, আর মুরারিমোহন?” এ প্রশ্নটা এসেছে পিছন থেকে। হৈমন্তী ঘুরে তাকিয়ে দেখে নিতাইচরণ এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। এতক্ষণ মনে হয় কান পেতে হৈমন্তীর কথা শুনছিল।

হৈমন্তী মুখ সামনে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “মুরারিমোহনের যন্ত্রটাও সে কাজটা করতে পারত।”

—“তাইলে গরমেন্টকে জানাইল না ক্যান? একখান ডিসকভারী হইত। কী কও ভাতিজা?” গনশার পাশের মেঝেতে এসে বসে পড়ে নিতাই।

—“জানাতে পারত। কিন্তু তার আগে মুরারিমোহন অন্য একটা পরীক্ষা করার চেষ্টা করেছিল মনে হয়।”

—“কী পরীক্ষা?”

ভাবুক গলায় পরের কথাগুলো বলে হৈমন্তী, “যন্ত্রটাকে দিয়ে উলটো কাজটা করানো যায় কিনা, মানে সময়কে স্লো-এর সঙ্গে সঙ্গে ফাস্টও করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এবং সম্ভবত সফলও হয়েছিলেন। সেই জন্যেই আপনি নির্ধারিত সময়ের কয়েক বছর আগে হ্যাঁলির ধূমকেত দেখতে পেয়েছিলেন।”

—”তা ক্যামনে হয় ? সময় যদি দ্রুত চলে তাহলে আমিও তো দ্রুত চলব।”

—“তার কোনও মানে নেই। এই গোটা মহাবিশ্ব জুড়ে সময় এক নয়। এ বাড়িতে যে যন্ত্রটা আছে সেটার একটা রেঞ্জ আছে। সেই রেঞ্জের মধ্যে যা কিছু থাকে তাদের সময়ের হেরফের ঘটাতে পারে যন্ত্রটা। সেজন্যই একমাত্র এ বাড়ি থেকেই অন্য আকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই গ্রাম থেকে নয়। রোদ থেকে একটু সরে বসেছে নিতাই। তার মুখের উপরে ছায়া নেমেছে এখন। সে মাথার পিছনে একবার হাত বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, “কিন্তু জিনিসটা আছে কই?”

—“সেটাই তো প্রশ্ন…” গালে হাত দিয়ে বসে থাকে হৈমন্তী। এই প্রশ্নটা অশ্বিনীকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। করলে সে উত্তর দেবে কিনা জানে না হৈমন্তী, কিন্তু তার মনে হতে পারে হৈমন্তী এখনও জিনিসটা উদ্ধার করার কথাই ভাবছে। এই ভয়ে এখনও জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি। একটা বিড়ি ধরায় নিতাই, “ছাড়ান দেন। ওঃ জিনিস আর পাওয়া যাইব না । আদৌ আসে কিনা… তাসাড়া আপনার সরিলটা ভালো নাই…”

হৈমন্তী মিহি হেসে গনশার দিকে তাকায়, “আমার দৌড়ঝাঁপ করার শক্তি নেই বটে, কিন্তু আমার জোনসবাবু আছে। আমার হয়ে ওই খুঁজে বের করবে। আচ্ছা, তুই একদিন বলছিলি জঙ্গলের ভিতর থেকে তুই কীসব শব্দ শুনেছিস, এ বাড়ির কোথাও শুনিসনি?” গনশা দুদিকে মাথা দোলায়।

হৈমন্তীর কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে, “যন্ত্রটা ইন-একটিভ হয়ে পড়ে আছে সন্দেহ নেই। মুরারিমোহন কোথায় রেখে যেতে পারেন সেটা?” ।

—“মাটির তলায়?”

—“না নিতাইকাকা। তিনি যন্ত্রটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন। খুব গোপন কোনও জায়গায় লুকিয়ে রাখলে বারবার সেটা টেনে বের করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নিজেরই অসুবিধা হবে। জিনিসটা অত গভীর কোথাও নেই। সম্ভবত আমাদের চোখের সামনেই আছে। কোথাও কেমোফ্লাজ করে…”

—“ডাইরিতে কিসু নাই?”

—“থাকলেও আমি তো বুঝতে পারিনি।” পাশ থেকে ল্যাপটপ তুলে নেয় হৈমন্তী। এন্টিকাইথেরা মেকানিজমের ছবিটা খুলে আবার চোখ বোলাতে থাকে। এ বাড়িতে আসার পর বাড়ির। নানা জায়গার বেশ কিছু ছবি তুলেছিল। সেগুলো পরপর দেখতে থাকে, কোথাও নোনা ধরা দেওয়াল, কোথাও ভাঙা কড়িকাঠ, কোথাও স্রেফ ঝুলে থাকা আসবাবপত্র। নাঃ, এর মধ্যে কোথাও থাকতে পারে না এত বড় একটা যন্ত্র।

ল্যাপটপ বন্ধ করে গনশার পিঠে হাত রাখে হৈমন্তী, “আমাকে একটু ধর তো বাবা। বাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে হবে।”

—“ঘুইরা দেখবেন! কন কী!” নিতাই চোখ গোলগোল করে বলে, “শরীরের কন্ডিশন দেকসেন?”

—“তা বললে হয় নিতাইদা? যন্ত্রটা একবার হাতে পেলে আমি কী করতে পারি জানেন?”

—“কী?” হৈমন্তী কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল, থমকে যায়, বলে, “কী করতে পারি বলুন তো? টাকাপয়সা পেয়ে ফুর্তি করব সে উপায়ও তো নেই। তাও কিছু একটা বড়সড় কাজ করে যেতে ইচ্ছা করছে, জানেন? আমি মারা যাওয়ার অনেক বছর পর অবধি যাতে লোকে হৈমন্তী ঘোষকে মনে রাখে।”

—“আমি মনে রাখব তোমাকে।” গনশা হৈমন্তীর একটা হাত কাঁধে নিতে নিতে বলে।

—“তুই ব্যাটাচ্ছেলে আবার কী মনে রাখবি?” হাত বাড়িয়ে গনশার গাল টিপে দেয় হৈমন্তী। তারপর ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলে, “শোন ব্যাটা, আমাকে মনে রাখাটা অত দরকারি নয়। সারাজীবনে এত এলিবেলিকে মনে রাখতে গেলে মাথার কলসি উলটে যাবে। তখন আর আসল জিনিসটা মনে থাকবে না…”

—“আসল জিনিস কী?”

—“ওঃ! জানিস না?” দেওয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে হৈমন্তী। কয়েক পা হেঁটেই ক্লান্ত হয়ে গেছে সে। বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলে, “এই গ্রামে থাকতে তোর ভালো লাগে না, তাই না?”

গনশা অধবদনে মাথা দোলায়। হৈমন্তী হাসে, “আমারও কলকাতায় ফিরে যেতে ইচ্ছা করে না আর। অথচ ভাগ্যের পরিহাস দেখ, তুই জন্মেছিস এখানে, আর আমি ওখানে। একটা ব্যবস্থা করা যাক, কী বল?”

—“কী?” গনশা অবাক চোখে চায়। ট্রাউজারের পকেট থেকে কিছু একটা হাতড়ে বের করে আনে হৈমন্তী। গনশা চেয়ে দেখে একটা চাবির রিং ধরা আছে তার হাতে। সেটা থেকে তিনটে লম্বা চাবি ঝুলছে, “আজ থেকে এটা তোর।” গনশা হাত দিয়ে স্পর্শ করে রিংটা, “কীসের চাবি?”

—“আমার কলকাতার ফ্ল্যাটের।”

—“তাহলে আমাকে চাবি দিচ্ছ কেন?”

—“আরে বাবা এতদিন আমার ছিল। আজ থেকে তোর। তবে শুধু চাবিটা দিয়ে হবে না। আরও কাজ আছে।” একটু ভেবে হৈমন্তী বলে, “এক কাজ করিস, কাল তোর কাকাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস।” গনশা এতটাই হতবাক হয়ে গেছে যে তার মুখে আর কথা ফোটে না। দু-একবার সংকোচ করে চাবির রিংটা হাতে নেয় সে। ঠান্ডা ধাতব স্পর্শে তার হাতটা কেঁপে ওঠে। যেন চাবিটা ওর হাতে আসতে আপত্তি করছে নিজেদের ভাষায়। শক্ত করে চাবিটা চেপে ধরে।

কসরত করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে হৈমন্তী, তার পা কেঁপে যাচ্ছে। বারবার। একটা হাত দিয়ে ধরে রেখেছে সিঁড়ির রেলিং। খোলা চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ছে, অন্য হাতটা গনশার কাঁধ থেকে সরিয়ে সেগুলো ঠিক করে নিচ্ছে বারবার।

একধাপ সিঁড়ি নেমে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে পড়ল হৈমন্তী। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “এই বাড়ি জিনিসটা, বুঝলি, ভারী অদ্ভুত।”

—“অদ্ভুত কেন?”

—“অদ্ভুত নয়? আমরা ভাবি বাড়ি বানাতে ইট, সিমেন্ট, রড এইসব লাগে, এদিকে বাড়ি কিন্তু আসলে তৈরি হয় মানুষ দিয়ে। মানুষের থাকা দিয়ে। তোর বাড়ির সব লোক যদি তোকে একা রেখে কোথাও বেড়াতে যায়। তখন মনে হয় না অন্য একটা বাড়িতে এসে আছি?”

—“হ্যাঁ, ভয় লাগে খুব।”

হাঁটু গেড়ে গনশার সামনে বসে পড়ে হৈমন্তী, দু গালে দুটো হাতে রেখে বলে, “একদিন আমি, তোর অশ্বিনীদাদা, নিবারণকাকা, নিতাইকাকা সবাই এই ভাসানবাড়িটাকে ফাঁকা করে দিয়ে চলে যাব। শহর থেকে অন্য লোক এসে ভেঙে ফেলবে বাড়িটাকে। তখন কষ্ট হবে তোর?”

গনশার ঠোট ফুলে ওঠে। চোখ ছলছল করে, তার মাথায় একটা আলতো চাপড় মারে হৈমন্তী, “আরে গাধা, কাঁদছিস কেন? বললাম না বাড়ি তৈরি হয় মানুষ দিয়ে। এই বাড়িটা ভেঙে ফেললে তুই বাবা-মাকে নিয়ে কলকাতায়। আমার বাড়িতে গিয়ে থাকবি। দেখবি ওখানে আমার অনেক চিহ্ন পড়ে আছে। কত্ত ছবি, আমার ছোট থেকে বড় হওয়ার। আমার স্কুল কলেজের বই, রাফখাতা, আঁকার খাতা, ফটো অ্যালবাম… সিগারেটের বাক্সগুলো সোজা ফেলে দিবি, ঠিক আছে?” গনশা উপরে-নিচে মাথা নাড়ে।

—“আর একটা কাজ করতে পারবি?”

—“কী?”

—“ফোটো অ্যালবামে দেখবি আমার আর বোনের একসঙ্গে ছবি আছে। ওই ছবিগুলো ওকে দিয়ে আসবি। আর বলবি, ওর দিদি ভালো আছে। সত্যি খুব ভালো আছে।” আবার সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় হৈমন্তী, “বুঝলি গনশা, ইজিপ্টের রাজাগজারা মরে গেলে পিরামিডগুলোর তলায় রাজার দেহের সঙ্গে তার সস ব্যবহারের জিনিসপত্র রেখে দেওয়া হত। ওরা বিশ্বাস করত মারা যাওয়ায় পরে যখন মানুষের দ্বিতীয় জীবন শুরু হয় তখন কাজে লাগে ওইগুলো।”

—“দ্বিতীয় জীবন!”

—“ইয়েস, আর আমি আমার দ্বিতীয় জীবনটা রেখে যাব তোর জন্য, দোতলার প্যাসেজে এসে পড়েছিল দুজনে। হৈমন্তী পায়ে জোর এনে ভালো করে ঘুরে দেখার চেষ্টা করল ছাদের দেওয়ালগুলো। জিনিসটা মুরারিমোহনের আমলে যেখানে থাকত এখন সম্ভবত সেখানে নেই। মারা যাওয়ার আগে মুরারিমোহন নিজেই হয়তো নিরাপদ কোনও জায়গায় সরিয়ে রেখেছিলেন সেটা। কিন্তু আগে যেখানে ছিল সে জায়গাটা খুব একটা গোপন হওয়ার কথা নয়। একতলা? দোতলা? নাকি ছাদ?

ছাদ নয়। সেক্ষেত্রে জিনিসটা রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। একতলায় নয়, কারণ রোজ রাতে দু ধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে। সেটা ছাদে নিয়ে যাওয়া মুরারিমোহনের একার পক্ষে কষ্টকর। মানে জিনিসটা দোতলাতেই থাকত একসময়। কোথায়? হঠাৎ কী মনে পড়তে গনশার দিকে চায় হৈমন্তী, “এক কাজ কর। আমার ঘরে টেবিলে একটা পুরনো ছবি আছে। ওটা নিয়ে আয়।”

গনশা ছুটে গিয়ে নিয়ে আসে ছবিটা। ক’দিন আগে নিবারণের ঘর থেকে এই ছবিটাই পেয়েছিল হৈমন্তী। এবার সেটাকে আলোর তলায় মেলে ধরে সে। আজ থেকে প্রায় একশো তিরিশ বছর আগের ভাসানবাড়ি দেখা যাচ্ছে তাতে। মুরারিমোন হয়তো তখনও বেঁচে আছেন। মানে, ছবির সময়ে যন্ত্রটা দোতলাতেই ছিল। অবশ্য ছবিটা বাড়ির সামনে থেকে তোলা। সেখান থেকে ভিতরের কিছুই প্রায় বোঝা সম্ভব নয়। তাও হৈমন্তী ভালো করে দেখতে থাকে ছবিটা। ” আচমকা ছবির একেবারে ডানদিকের কোণে চোখ আটকে যায় তার।

ছবিতে পুরো বাড়িটা আসেনি। ডানদিকের কিছুটা অংশ ছবির বাইরে রয়ে গেছে। ছবির সেইদিকের ধার বরাবর দেওয়ালের উপর কালো রঙের চৌকো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ভালো করে তাকালে বোঝা যায় একটা জানলা। খোলা জানলা। ছবিটা সাদাকালো বলে কালো বাক্স মনে হচ্ছে।

বাঁদিকের ঘরটার দিকে হাত দেখায় হৈমন্তী, “এই ঘরটা, কিন্তু ওইখানে তো কোনও জানলা নেই। মানে কেউ বুজিয়ে দিয়েছে জানলাটা…”

আরও ভালো করে সেই অন্ধকার জানলায় চোখ রাখে হৈমন্তী। জানলার পিছনের দেওয়ালে খুব ঝাপসা হলেও বোঝা যায়, একটা ছোট আংটা লাগানো আছে। অর্থাৎ দরজা বা আলমারি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরটায় ঢুকে আসে হৈমন্তী। আংটাটা নেই। কোন দরজা বা আলমারি জাতীয় প্রায় কিছুই নেই। কেবল একটা পাঁচফুট লম্বা ও একফুট গভীর খোপ করা আছে সেখানে। খোপটা খালি। এগিয়ে এসে সেইখানের দেওয়ালে হাত রাখে হৈমন্তী। বিড়বিড় করে বলে, “আজ থেকে দেড়শ বছর আগে এই খোপের সামনে একটা কাঠের দরজা লাগাননা ছিল। সেই দরজার ভিতরে রাখা থাকত প্রাচীন পৃথিবীর সমস্ত অজ্ঞাত রহস্যের চাবিকাঠি।”

মিনিটখানেক সেইখানে বসে থেকে উঠে পড়ে হৈমন্তী, “কিন্তু এখন কোথায় আছে?” গনশা এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের ভিতরে। তার মুখের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে

, “এ বাড়িতে এমন কোনও দরজা আছে যেটা খোলা হয়। না?”

—“না তো…”। হৈমন্তী বিমর্ষ হয়। ফাঁকা জায়গাটা দেখিয়ে বলে, “তাহলে এরকম কোনও খোপ আর কোথাও দেখেছিস?”

একবার ভেবে নেয় গনশা। তারপর সজোরে মাথা নাড়ায় দুদিকে। কিছু একটা মনে পড়ে হৈমন্তীর সে থেমে গিয়ে বলে, “কাগজে সেদিন চিহ্নটা তুই দেখে তই বলেছিলি ওটা এ বাড়িতে আগেও কোথাও দেখেছিস। কোথায় দেখেছিল মনে পড়ছে না?”

এবার আরও জোরদার চেষ্টা করে গনশা। কিন্তু এবারও হতাশ হয়, “না দিদি, মনে পড়ছে না। অনেকদিন আগে..”

হৈমন্তীর মন বলে চিহ্নটা গনশা যেখানে দেখেছিল সেখানেই সম্ভবত লুকানো আছে যন্ত্রটা। গনশার উচ্চতা সাড়ে চারফুট। অর্থাৎ জিনিসটা মাটির কাছাকাছিই আছে। উপরের দিকে নেই।

—“কোথায় দেখেছিলাম মনে নেই দিদি। কিন্তু কেন দেখেছিলাম মনে পড়ছে।” গনশা ভুরু কুচকে বলে।

—“কেন?”

—“সেদিন বাড়িতে কেউ ছিল না। নিবারণকাকা বাজারে গেছিল। কাকা

থাকলে আমাকে এ বাড়িতে আসতে মানা করেছিল। কিন্তু আমি সেদিন ছাদে এসেছিলাম। এমন সময় দেখি কাকা বাড়ি ঢুকছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে নেমে লুকিয়ে পড়েছিলাম… তখনই ওটা…”

—“কোথায় লুকিয়েছিলি?”

—“সেটা মনে পড়ছে না দিদি।” হৈমন্তীর মুখে আবার ছায়া নামে, “লুকিয়ে পড়েছিলি, তখন চোখে পড়েছিল। মানে জিনিসটা কোন কিছুর পিছনে আছে… কিন্তু..”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। শরীরটা ভারী ক্লান্ত লাগছে। আজকাল এইটুকু উত্তেজনাই আর সহ্য হয় না। ঘর থেকে গনশাকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিল সে। এমন সময় তার পা আটকে যায়। গনশার জামাটা চেপে ধরে মুঠো করে। ঠান্ডা, ভয় জাগানো গলায় বলে, “একটু আগে কী বললাম তোকে মনে আছে?”

—“বললে তোমার বোনকে…”

—“উহু. ওসব না। বাড়ির ব্যাপারে কী বলেছিলাম?” গনশা মনে করার চেষ্টা করে, “বলেছিলে বাড়ি তৈরি হয় মানুষ দিয়ে।”

—“ইয়েস। এবং সেইজন্য বাড়ির সমস্ত গোপন কথা জানতে পারা যায় বাড়ির মানুষের আচরণ লক্ষ করলে…”

—“মানে?” গনশা আর কিছু উত্তর দেয় না। হৈমন্তী ধীর পায়ে ফিরে আসে নিজের ঘরে। জিনিসটা কোথায় আছে তা নিয়ে আর সংশয় নেই মনে।

গনশাকে নিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসে হৈমন্তী। নিবারণের দিকে চেয়ে বলে, “মুরারিমোহনের যন্ত্রটা কোথায় আছে আমি আপনাকে বলে দিয়ে যাব। তবে সেটা কী করে উদ্ধার করবেন আপনি জানেন।”

—“মানে আপনি জানেন কোথায় আছে?”

হৈমন্তী বাঁকা হাসি হাসে।।

—“কোথায় আছে?” হৈমন্তী বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিতে দিতে বলে, “আপনার কখনও মনে হয়নি অশ্বিনী আয়নার সামনে বসে ধ্যান করে কেন? ওর যা ক্ষমতা তাতে অতীতে বিচরণ করতে সামান্য আয়নার দরকার হবে কেন ওর?

—“মানে… আমি কখনও সেভাবে…”

—“ধ্যান করার সময় অশ্বিনীর শরীরে সাড় থাকে না। সামনে কী হচ্ছে বুঝতে পারে না। তাহলে এইসময়ে ঘরের ভিতর ঢুকে কেউ কোন দরকারি জিনিস যদি চুরি করে নিয়ে চলে যায় তাহলে তাকে আটকাতে পারবে না ও। তাই ওভাবে আয়নাটার দিকে মুখ করে নিজেকে বসিয়ে রাখে। যাতে চোর ভাবে ও আয়নার দিকে চেয়ে আছে…”

—“কিন্তু কী আছে আয়নাতে?”

—“আয়নাতে নয়…” একটা সিগারেট ধরায় হৈমন্তী, “আয়নার পিছনে। একটা দরজা। এবং সেই দরজার ভিতরে..”

—“মুরারিমোহনের যন্ত্র…” নিবারণের মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *