ভাসানবাড়ি – ১৬

ষোড়শ অধ্যায়

—“চিড়িয়াখানা!” ধড়ফড় করে উঠে বসল হৈমন্তী, “জু হাইপোথিসিস! সব মনে পড়েছে আমার…” বিছানার উপরে বসে হাঁপাতে থাকে হৈমন্তী। তার বুকটা দ্রুত ওঠানামা করছে।

নিবারণ মেঝেতে শুয়েছিল, তারও ঘুম ভেঙে গেছে। অবাক হয়ে বিছানার উপরে তাকিয়ে সে বলে, “চিড়িয়াখানা! কী বলছেন আপনি?”

—“অশ্বিনীকে জু হাইপোথিসিস মেনে চলতে হয়। তাই সে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। এমন কিছু করতে পারে না যাতে যা হবার ছিল তা হবে না…”

টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে দেয় নিবারণ, এই কদিনে হৈমন্তীর শরীর আরও খারাপ হয়েছে। মুখের বেশ কয়েকটা জায়গার চামড়ায় লালচে ভাব এসেছে, এখানে আসার পর থেকে অন্তত দশ কেজি ওজন কমে গেছে তার। নাকের ডগাটা লেগে থাকা রক্তের মতো লাল হয়ে রয়েছে।

—“যোগাযোগ করে না কী বলছেন! আমরা তো…”।

নিজের বুকে একটা হাত রেখে নিঃশ্বাসের গতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করে হৈমন্তী। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেছে তার। কয়েকটা সেকেন্ড সেইভাবে দম নিয়ে বলে, “আমি একটু নিচে যাচ্ছি। দরজাটা লাগিয়ে দিন।”

—“এই শরীরে আপনি সিঁড়ি দিয়ে…”।

—“কিচ্ছু হবে না। একটু ধরুন আমাকে।” নিবারণ আর বাক্যব্যয় না করে হৈমন্তীর একটা হাত কাঁধে নিয়ে তাকে এগিয়ে দেয় দরজা অবধি। তারপর ভিতর থেকে আটকে দেয় দরজাটা, হৈমন্তী কোনওরকমে দেওয়াল ধরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে। কয়েকবার পায়ের উপরে জোর হারায়। সবসময় একটা জ্বর-জ্বর ভাব, শরীর দুর্বল। মাথার ভিতর গুনগুন মৌমাছি ডেকে চলেছে একটানা। আজ কিন্তু নিচে নামার আগেই সিঁড়িতে অশ্বিনীকে দেখতে পায় সে। হাতে কয়েকটা ওষুধ নিয়ে উপরে আসছিল। হৈমন্তীকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

—“এ কী আপনি নিচে নামছেন কেন? ডাকতে পারতেন তো আমাকে…” সিঁড়ি থেকে হাত তুলে অশ্বিনীর দুটো কাঁধে জোর দিয়ে দাঁড়ায় হৈমন্তী, “মাঝে-মাঝে আমি তোমার কাছে গেলাম না হয়…”

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখ তোলে অশ্বিনী, একটা ট্যাবলেটের পাতা তুলে ধরে, “এইটা আপনার মাথার যন্ত্রণা হলে, আর বেশি একটু বাড়লে.”

—“আমার একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে।”

—“বেশ। উপরে চলুন, বলছি।”

—“না, উপরে নয়।”

—“তাহলে?”

—“ওই ঝিলটার কাছে নিয়ে যাবে আবার?”

—“ওখানে!” অশ্বিনী অবাক হয়ে যায়, “এই শরীরে ওখানে যাবেন আপনি!”

—“আর কোনও শরীরেই যেতে পারব না। যতদিন শরীর আছে নিয়ে চল না হয়।”

মাথা নামিয়ে নেয় অশ্বিনী। হৈমন্তীর কবজিটা হাতে ধরে বলে, “বেশ আসুন আমার সঙ্গে।”

আজ জোরালো হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। শুকনো বাষ্পে বৃষ্টির কণামাত্র লেখে নেই। হৈমন্তীর একটা হাত অশ্বিনীর কাঁধের উপর দিয়ে ফেলা রয়েছে। কোনও রকমে হেঁটে শরীরটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সে, মাঝে মধ্যে থামছে। জোর নিশ্বাস নিচ্ছে, ঘোলাটে চোখে দেখে নিচ্ছে চারপাশ। মাটির উপরেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে তার। তাও প্রবল জেদে বারবার টেনে তুলছে নিজেকে। এখনও সে হাঁটতে পারে, যতদিন পারছে, এই ক্ষমতাটাকে লুটে পুটে নিতে চায়। ঝিল অবধি কিন্তু পৌছাতে পারে না হৈমন্তী। তার আগেই মাটির উপরে বসে পড়ে সে। এখানে একটা ধান-জমির সীমানায় পানের বরজ করা আছে। সেই বরজের বেড়াতেই পিঠ দিয়ে সে শরীর এলিয়ে দেয়। পাশে জায়গাটাতে একটা চাপড় মেরে অশ্বিনীকে বসতে ইঙ্গিত করে।

—“আজ এখানেই বসুন একটু। কাল শরীর সুস্থ হলে ওখানে যাবেন।” পাশাপাশি বসে থাকে দু’জনে। স্থবির মূর্তির মতো। হৈমন্তীর কাশির দমক ওঠে, ঠোটের কোল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ে। অশ্বিনী মুছে দেয়।

হৈমন্তী আবার কাশতে কাশতে বলে, “আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব, তার সোজাসুজি উত্তর দেবে। কোনও কথার মারপ্যাচ নয়, কোনও গোপনীয়তা নয়, রাজি?”

—“যদি রাজি না হই কী করবেন?”

—“তাহলে আমি আর ভাসানবাড়িতে ফিরব না। সারারাত এখানে শুয়ে থাকব। সকাল হলে যেভাবেই হোক কলকাতা ফিরে যাব।”

—“কেন? কী আছে কলকাতায়?”

—“তা জানি না। কিন্তু তুমি নেই।” মিহি হাসে অশ্বিনী, ঠোঁট উলটে বলে, আমি সব জায়গায় আছি হৈমন্তী দেবী। শুধু আপনি আমাকে দেখতে চান কি না সেটা আপনার ব্যাপার।”

তার গলায় একটা হাত রাখে হৈমন্তী, “উহু, প্রসঙ্গ পাল্টাবে না। আমার প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিতে হবে তোমাকে।”

—“বেশ, দেবো, শুরু করুন।”

বুকে হাত রেখে আবার কাশি থামায় হৈমন্তী, “তুমি হাসতে-হাসতে মানুষ খুন করো, কিন্তু নিরামিশ খাও কেন?”

গম্ভীর মুখে উত্তর দেন অশ্বিনী, “আমার বেঁচে থাকতে খাবারের দরকার পড়ে না। আপনার আর গনশার সামনে কয়েকবার খেয়েছি যাতে আপনাদের অস্বস্তি না হয়। কেবলমাত্র খাওয়ার অভিনয় করছি। অযথা একটা প্রাণীর মৃত্যু আমি পছন্দ করি না।”

—“তুমি কী এলিয়েন?”

হাসিটা আবার ফিরে আসে অশ্বিনীর মুখে, দু’পাশে মাথা নাড়ায়, “না।”

—“মানে তুমি পৃথিবীতেই জন্মেছ?” আবার মাথা নড়ে, “না।”

—“আবার কথার মারপ্যাচ। আমি কিন্তু বারণ করেছিলাম।”

—“আপনার প্রশ্নটা ভুল, আমি কোথাও জন্মাইনি। আমার জন্ম নেই।”

—“আচ্ছা বেশ, তুমি কি বাইরে থেকে পৃথিবীতে এসেছ?”

মুখ দিয়ে একটা শব্দ করে অশ্বিনী, “কী মুশকিল, আপনার স্মৃতিশক্তি ভারী দুর্বল, বললাম যে আমি সব জায়গায় আছি। আমাকে কোথাও যেতে হয় না।” হৈমন্তীকে অসহায় দেখায়। তার মুখের উপর কতগুলো বিজাতীয় রেখা খেলা করতে থাকে।

—“কী প্রশ্ন করবেন বুঝতে পারছেন না, তাই তো?” অশ্বিনী ব্যঙ্গ করে, “আমি একটু সাহায্য করি?”

—“করো…” আচমকা হৈমন্তীর দিকে ঘুরে বসে অশ্বিনী, দু’গালে দুটো হাত রেখে সোজাসুজি তাকায় চোখের দিকে, “আপনি কে? আপনি কোথা থেকে এসেছেন? আপনার জন্ম কোথায়?”

—“আমার জন্ম…” হৈমন্তী নিজের জন্মদিন মনে করার চেষ্টা করে। অশ্বিনী বাধা দেয়, “উঁহু, ওটা না। এই মহাজগতে সৃষ্টি একবারই হয়েছিল আজ থেকে কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগে। তারপর থেকে আর কিছু সঠিক হয়নি। শুধু রুপ পালটেছে…”

—“কী বলছ তুমি আমি তো কিছুই…” – “আর আপনার সমস্ত রূপে আপনাকে খুঁজে বেরিয়েছি আমি।”

অশ্বিনীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হৈমন্তীর মনে হয় তার। চারপাশের পরিবেশ বদলে গেছে। গ্রামের মেঠো পথ আর ধানক্ষেত হারিয়ে গিয়ে ওদের পায়ের কাছে গোটা জমিটা প্লাবিত হয়ে গেছে জলে, অনন্ত জলরাশির মাঝে পা ডুবিয়ে বসে আছে ওরা দু’জনে। আর সেই জলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু হয়ে ফুটে উঠছে কিছু আলোকোজ্জ্বল কণা। যেন তারাদের ছায়া। পড়েছে জলে। ক্রমশ কেঁপে উঠছে তারাগুলো। একটু আগে অশ্বিনীর বলা কথাগুলো বেজে উঠছে হৈমন্তীর কানে

—এই মহাজগতে সৃষ্টি একবারই হয়েছিল। আজ থেকে কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগে। তারপর থেকে আর কিছু সৃষ্টি হয়নি। শুধু রূপ পালটেছে…” শক্তি বদলে গেছে পদার্থে। পদার্থ থেকে আবার ফিরে গেছে শক্তিতে। সৃষ্টির শুরুতে সেই প্রথম কণা কোয়ার্ক। জলের উপরে ভেসে ওঠা বিন্দুগুলো ঠিক তেমনই কোনও কণা। হৈমন্তী অবাক হয়ে দেখল জল থেকে বাতাসে উঠে আসছে কণাগুলো। ক্রমশ একটা জায়গায় জমা হচ্ছে তারা। বিশেষ একটা রূপ ধারণ করছে। সে রূপ মানুষের নয়, পশুর নয়, গ্রহের নয়, নক্ষত্রপুঞ্জের নয়। সম্পূর্ণ অচেনা, তবু যেন কিছুর আকৃতি তৈরি করছে কণাগুলো। উজ্জ্বল রুপালি আলোয় জ্বলছে।।

প্রাণ তৈরি হচ্ছে। জীবিত কিছু তৈরি হচ্ছে ধীরে ধীরে… জলাভূমির উপর দিয়ে অস্থির হয়ে উড়ে বেড়াতে লাগল সেই কণাগুলো। একবার ছুঁয়ে গেল হৈমন্তীর শরীরটাকে। চিনতে পারলে কি? হঠাৎ কিসে যেন ধাক্কা খেয়ে ভেঙে ছড়িয়ে আলাদা হয়ে গেল কণাগুলো।

হাওয়ায় বয়ে গিয়ে জলের উপরে ইতস্তত ছড়িয়ে পড়ল, আরও কয়েকটা কণা বয়ে যেতে লাগল জলের উপর দিয়ে। আবার ঝড় উঠল। রুপালি কণাগুলো কাছাকাছি এল কয়েকবার কিন্তু আগের মতো আকৃতি তৈরি করতে পারল না। ঝড় বাড়তে শুরু করেছে। কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ছে আরও দূরে।

—“অশ্বিনী…” হৈমন্তী অসহায়ভাবে ডেকে উঠল, “অশ্বিনী…”

—“আমি আছি আপনার সামনে।” শব্দটা কোথা থেকে ভেসে এল বুঝতে পারল না হৈমন্তী। সে বাতাস হাতড়াতে লাগল।

—“শরীরের মৃত্যু হলে শরীরের সমস্ত উপাদান ফিরে যায় প্রকৃতিতে। কালের নিয়মে ফিরে যাওয়া সেই উপাদানগুলো অস্থির হয়ে ছুটে বেড়াতে থাকে প্রকৃতির বুকে। কোনও কোনও কণা নতুন প্রাণ সৃষ্টি করে, সেই প্রাণেরও আবার মৃত্যু ঘটে, আবার তারা প্রকৃতিতে ফিরে আসে। যে কণাগুলো দিয়ে আপনার শরীর তৈরি সেগুলো আপনার মৃত্যুর পর প্রকৃতিতে মিশে যাবে। অঙ্কের হিসেবে সেই সমস্ত কণার আবার একসঙ্গে এসে প্রাণ সৃষ্টি করতে কয়েক লক্ষ কোটি বছর সময় লেগে যাবে।”

হৈমন্তীর মাথায় ঢোকে না ব্যাপারটা। সে ফ্যালফ্যাল করে দেখে মাঠের উপরে জমা হওয়া রুপালি কণাগুলো আবার একটা আকৃতি তৈরি করেছে। আবার চিনতে পারছে সে। হ্যাঁ, এবার একটা মানুষের ছায়া।

—“আজ থেকে কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগে, মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে আপনার শরীরের সমস্ত উপাদান একত্রে এসে প্রাণ সৃষ্টি করেছিল..”

—“এসব কী বলছ তুমি অশ্বিনী!”

—“এ মহাবিশ্বের প্রথম সৃষ্টি হওয়া প্রাণ…”

—“তুমি কোথায়?”

—“এখানে থেকে কয়েক মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে… সমস্ত গ্যালাক্সি সৃষ্টির আগে, সদ্য চলতে শেখা মহাবিশ্বের বুকে চোখ মেলেছিলেন আপনি।”

—“কিন্তু কে সৃষ্টি করেছিল আমাকে?”

—“আমি…”

হৈমন্তীর মনে হয় তার পায়ের তলায় জলের স্রোত বেড়ে উঠছে, ক্রমশ তাকে ডুবিয়ে নিয়ে যাবে সেই জল। এ কী অদ্ভুত মাদকতা গ্রাস করছে তাকে। বুক ছুঁয়ে ফেলছে জল। গলা বেয়ে উঠে আসছে, এক্ষুনি দম আটকে যাবে, মৃত্যু আসন্ন।

দুহাতে জল সরাতে গিয়ে থেমে গেল হৈমন্তী। অশ্বিনীর দুটো হাত এসে চেপে ধরেছে তাকে। চোখ মেলে তাকিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে হাহাকারের মতো চিৎকার করে উঠল হৈমন্তী।

—“এটা… এটা কী দেখছিলাম আমি?”

—“যা জানতে চাইছিলেন…”।

—“আমি… কয়েক লক্ষ কোটি বছর আগে…”

—“হ্যাঁ..” হৈমন্তীর কাঁধে একটা হাত রাখে অশ্বিনী।।

—“কিন্তু এই বাড়িতে কী করে এলে তুমি? কে আনল তোমাকে? এমন কী আছে ওই বাড়িতে?”

হৈমন্তীর মুখের উপরে এবার ঝুঁকে পড়ে অশ্বিনী, “সেটা জানতেই তো এখানে আসা আপনার, তাই না?”

—“আর কিছু জানতে চাই না আমি। শুধু তোমার কথা জানতে চাই। কেন এভাবে জড়িয়ে রাখো আমাকে?”

আকাশের বুকে এখনও জেগে আছে কালপুরুষ। তার দিকে আঙুল তুলে দেখায় অশ্বিনী, তারপর বলে, “আমার আঙুলের সোজা তাকান। ওই যেখানে কালপুরুষের ধনুকটা শেষ হয়েছে তার ঠিক পাশ দিয়ে কয়েক বিলিয়ন আলোকবর্ষ গেলে একটা ভারী সুন্দর জায়গায় এসে পড়বেন আপনি, জানেন? মানুষ কোনদিন যেতে পারবে না ওখানে, জানতেও পারবে না জায়গাটার কথা। কালো আকাশের বুকে ধূমকেতুর লেজের মতো এক ধরনের উজ্জ্বল আলোর কণা দেখতে পাওয়া যায় ওখানে, মাঝে মাঝে তারাখসা উল্কা এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় আলোর চাদরটাকে। তারাগুলো এত ঘন হয়ে আছে। যে মনে হয় চোখের সামনে বিন্দুবিন্দু সোনা দিয়ে বানানো একটা পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে।

ওখানে একদিন আপনি আর আমি শুয়েছিলাম…”

—“তারপর?”

—“গোটা মহাবিশ্বের কোথাও কেউ ছিল না তখন। ওইটুকুনি জায়গা ছাড়া আর কোথাও কোনও আলো ছিল না।”

—“ডার্ক এজ!” হৈমন্তী বিড়বিড় করে বলে, “তারপর? কী হল তারপর?”

—“তারপর…” অশ্বিনীর কণ্ঠ হারিয়ে যায়, তারপর সময় এল। সে আমাকে ছুঁতে পারে না। সময় সৃষ্টি হওয়ার আগে থেকেই তো আমি ছিলাম। কিন্তু আপনাকে তো আমি সৃষ্টি করেছি। তাই আপনাকে রূপ বদল করতে হবে, করতেই হবে… একদিন… একদিন আপনি হারিয়ে গেলেন… সোনালি ধুলোর মতো মিশে গেলেন মহাশূন্যে। আমি আপনাকে ধরে রাখতে পারলাম না।”

—“তারপর?” – “তারপর আবার সময় এল। সময় ভারী মজার জানেন। সে জীব, জড় সব কিছুকে রূপ বদল করতে বাধ্য করে, কিন্তু একদিন তার নতুন রূপের ভাঁড়ারও শেষ হয়ে যায়। তখন আবার প্রথম থেকে শুরু করে সে, এই যেমন আপনি ফিরে এলেন…”

অশ্বিনীর মুখের দিকে তাকায় হৈমন্তী। তারপর আচমকায় রুগ্ন হাতে জড়িয়ে ধরে তাকে, “কেমন ছিলাম আমি? এত বছর আগে কেমন দেখতে ছিল আমাকে?”

অশ্বিনী হাসে, “আসলে তখন খুব অন্ধকার ছিল তো, দেখতে পাইনি আপনাকে। এত বছরে এই প্রথম দেখছি আমি। তবে স্পর্শ করেছিলাম, জানেন… আজকের সঙ্গে তার কোনও পার্থক্য নেই…”

—“আমার এই শরীরটাও তো শেষ হয়ে যাচ্ছে অশ্বিনী, সময় এসে আবার ডেকে নিয়ে চলে যাবে আমাকে।” হৈমন্তী ফুপিয়ে ওঠে।

—“আপনি চিন্তা করছেন কেন? রূপ বদলাতে-বদলাতে আজ থেকে আরও কয়েক লক্ষ কোটি বছর পরে, কয়েক বিলিয়ন ইউনিভার্সের গড়ার পর আপনাকেই ফিরিয়ে দেবে সে…”

—“ততদিন কী করবে তুমি?”

—“আমি অপেক্ষা করব!” হৈমন্তীর মনে পড়ে যায় সে যখন প্রথম ভাসানবাড়িতে আসে, অশ্বিনী দেখা হওয়ার পর বলে, “আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম কখন থেকে..” সে অপেক্ষাটা ঠিক কত বড় তা ধারণা করতে পারেনি সে।”

—“তুমি তো এত কিছু পারো, আমার শরীরটাকে ঠিক করে দিতে পারো না? যাতে আরও কয়েকটা বছর দেখতে পাই তোমাকে।”

—“আপনার শরীরে তো ভুল নেই কিছু। কেবল রূপ বদলাচ্ছে..”

—“আচ্ছা বেশ, তাহলে অন্য একটা কাজ বলি, যেটা তুমি পারবে?”

—“বলুন।” ।

—“আমি যখন হাঁটতে পারব না তখন রোজ কোলে করে ওই ডোবাটার কাছে নিয়ে আসবে আমাকে?”

—“উঁহু, কোলে করে নয়… অন্য একটা উপায় আছে…” কথাটা বলে আর হৈমন্তীকে কিছু বলার সুযোেগ না দিয়ে তার একটা হাত শক্ত করে ধরে বুকে টেনে নেয় তাকে। পরমুহূর্তে দুজনের শরীর মাটি থেকে বেশ কিছুটা উপরে উঠে আসে। হাওয়ার গতি আগের থেকে আরও কিছুটা বেড়ে যায়। হৈমন্তী দেখে প্রায় দোতলা বাড়ির সমান উচ্চতায় উঠে শূন্যে। ভেসে আছে ওদের শরীর দুটো। গোটা গ্রাম চোখে পড়ছে এখান থেকে।

—“এই পাগল! নামাও আমাকে…” ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে হৈমন্তী।

—“কেন? ভয় লাগে আপনার?”

—“খুব… এর আগে কোনওদিন এত উপরে উঠিনি।”

—“উঠেছেন, এর থেকে অনেক বেশি উঁচুতে, অনেকবার।” দু’হাতে অশ্বিনীর গলা জড়িয়ে ধরে হৈমন্তী। সত্যি আজ পৃথিবীর মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে এসেছে ও। এইডসের থেকে, সুমিতের থেকে,

মা-বাবা-বোনের থেকে… ওর গোটা মুখ জুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। গলা ছেড়ে একটা চিৎকার করে উঠল। তারপর মুখ নেমে এল নিচের দিকে। ওর ঠোঁটের ঠিক সামনে অশ্বিনীর কপাল। সেখান ঠোঁট ছোঁয়াল হৈমন্তী।

একটু দূরে ভাসানবাড়ি দেখা যাচ্ছে, চারপাশ ঘিরে মিহি জঙ্গল, অশ্বিনীর সেই ঝিল, ঝিলের মাঝে উঁচু হয়ে থাকা মাটির স্তুপ, আকাশের বুকে আধভাঙা চাঁদটা তাকিয়ে রইল শূন্যে ভাসমান দুটো মানুষের দিকে। একদলা রক্ত কাশির দমকে বেরিয়ে এসে ছেয়ে গেল অশ্বিনীর কপালে, মুখটা ভরে গেল তার। হৈমন্তীর মনে হল আবার ফিরে এসেছে শ্বাসকষ্টটা, সে অসহায়ের মতো হাঁপাতে লাগল।

মাটিতে নেমে আসতে হাঁপানি কিছুটা কমে এল হৈমন্তীর। জামার হাতা দিয়ে অশ্বিনীর মুখ থেকে লাল রঙটা মুছে দিল সে।

—“আচ্ছা ওই বুড়ো লোকটা যে আমার হাত চেপে ধরেছিল, সেটা তুমিই ছিলে, তাই না?”

—“হ্যাঁ…”।

—“আর ওনার স্ত্রী মৃত্যুর আগে যে কথাগুলো বলেছিল সেগুলো তোমারই কথা, তাই না?”

—“হা..” অশ্বিনী লাজুক হাসে।

—“খামোকা অপেক্ষা করাতে মানুষটাকে।”

—“উঁহু, অপেক্ষা জিনিসটা এই পৃথিবীতে হাঁটার মতো। যতক্ষণ আপনি হাঁটবেন মনে হবে পৃথিবীটা একদম সমতল, ফ্ল্যাট। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে একদিন যখন আবার যেখান থেকে শুরু করেছিলেন সেখানে ফিরে আসবেন সেদিন বুঝবেন পৃথিবীটা আসলে গোল। যার জন্য অপেক্ষা করছেন সে যতদিন না আগের রূপে ফিরে আসছে ততদিন মনেই হবে না সে কোনওদিন ফিরবে বলে…”

কিছুক্ষণের জন্যে উদাস হয়ে যায় হৈমন্তী, তারপর মুখ ফিরিয়ে বলে,“তুমি আয়নায় কী দেখো বলোতো?”

—“আপনাকে, আপনার জীবনের সমস্ত মুহূর্ত। বারবার দেখি, দেখ ভালো লাগে আমার।”

—“এত আমাকে দেখার শখ যখন তখন এবার থেকে নিচে তোমার ঘরে থাকব আমি…”

হঠাৎ অশ্বিনীর খুব কাছে চলে আসে হৈমন্তী। একটু সরে বসে অশ্বিনী।

হৈমন্তী হেসে বলে, “কী হল? সরে গেলে যে…”

—“নাঃ মানে…” আগে কারও এত কাছে আসিনি আমি।”

ফিসফিস করে বলে হৈমন্তী, “এসেছ । এই জীবনে, এর থেকে অনেক বেশি কাছে…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *