পঞ্চদশ অধ্যায়
—“বিলেতে একটা ভারী অদ্ভুত গিফট দেওয়ার চল আছে, জানো, অ্যান্ট ফার্ম। আমরা যেমন অ্যাকোরিয়ামে মাছ পুষি সেইরকমই খানিকটা। তবে মাছের বদলে পিঁপড়ে। একটা বাক্সের মধ্যে অজস্র পিঁপড়ে জন্মায়, খায়, বড় হয়, মারা যায়, এমন করে চলতে থাকে। সেই জীবিত পিপড়ে ভর্তি বাক্সটা । গিফট করে একে অপরকে। কিছু দার্শনিকের মতে অ্যান্ট ফার্মের মধ্যে নাকি লুকিয়ে আছে মহাজগত সৃষ্টির তত্ত্ব। মানে আমাদের এই মহাজগত কেউ সৃষ্টি করেছিল স্রেফ আমাদের অবসার্ভ করার জন্য।”
কলকাতা প্রেস ক্লাবে টেড টকসের হয়ে বক্তৃতা রাখছিলেন গবেষক আনন্দ চৌধুরী। বক্তৃতার বিষয় ভারী গম্ভীর। তবে ট্যাগলাইনটা জলের মতো সহজ —Where is Everybody
একটু আগেই সহজ ট্যাগলাইনটার জটিল অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ডক্টর চৌধুরী, “কেবলমাত্র আমাদের এই গ্যালাক্সিতেই, একেবারে আমাদের সূর্যের মতো কয়েক বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বয়স আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক বিলিয়ন বছর বেশি। সেই সমস্ত সূর্যের আশেপাশে পৃথিবীর মতো আরও কয়েক বিলিয়ন পৃথিবী আছে। বুঝতেই পারছ খাতা কলম নিয়ে বসলে দেখা যাবে এই সমস্ত পৃথিবীতুল্য গ্রহে মানুষের চেয়ে অধিকতর জটিল প্রাণ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নিরানব্বই শতাংশ। এতদুর হিসেব নিয়ে কোনও গোলমাল নেই। শুধু একটা প্রশ্নে এসে আটকে যাই আমরা।” স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ট্যাগলাইনের দিকে নির্দেশ করেন আনন্দ, ‘Where is Everybody?’ থাকার সম্ভাবনা যদি একশো শতাংশ হয়, তাহলে তারা নেই কেন? মানুষের চোখে এবং যন্ত্রে তাদের টিকিটিও ধরা যায় না কেন?’
এতক্ষণে জায়ান্ট স্ক্রিনের দৃশ্য পালটে গেছে। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠেছে অ্যান্ট ফার্ম, “আমরা পিঁপড়ে পুষি, কারণ পিঁপড়ে, মাছ এদের থেকে বিবর্তনে আমরা এগিয়ে গেছি। ঠিক তেমনই মানুষের থেকে বিবর্তনে কয়েক বিলিয়ন বছর এগিয়ে থাকা, মানুষের থেকে বহুগুণ বেশি বুদ্ধিধর, বহুগুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন কোনও প্রাণী ইচ্ছা করেই নিরীক্ষণ করে চলেছে আমাদের। এমন কী এও ধরে নেওয়া যায় পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির মূল কারিগর তারাই। বিজ্ঞানের ভাষায় এ তত্ত্বের নাম ফার্মি প্যারাডক্স। কিন্তু এই ফার্মি প্যারাডক্স নিয়েও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। সে প্রশ্নটা আসে একটি পুরানো প্রবাদ থেকে। সব বাপেরই একটি বাপ আছে। মানে, যদি কোনও এলিয়েন রেস মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তাহলে সেই রেসকেও নিশ্চয়ই কেউ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। তাদেরকে আবার অন্য কেউ। সোজা কথায় আমরা যদি পেছতে থাকি তাহলে দেখতে পাব সমস্ত ব্যাপারটা একটা ধাপে ধাপে ভাগ করা ত্রিভুজের মতো। এই ত্রিভুজের একেবারে নিচের ধাপে পিপড়ে, তার ঠিক উপরের ধাপে মানুষ, মানুষের উপরের ধাপে কে আছে তা আমরা জানি না। ত্রিভুজের একেবারে চূড়াতে কে আছে সে সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই আমাদের। শুধু এটুকু জানি, তার বিবর্তন সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ সেই এই জগতের আদিমতম বাসিন্দা।” একটু থেমে টেবিলের উপর রাখা জলের বোতল থেকে একটু জল খেয়ে নেন আনন্দ চৌধুরী। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বলেন, “বেশ, এতদূর তো হল। কিন্তু এরপর প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ তো পিঁপড়েদের খেতে দেয়, পিঁপড়েদের থেকে লুকিয়েও থাকে না। তাহলে আমরা আমাদের বড়বাবুদের দেখতে পাই না কেন? এই উত্তরটা দেবার জন্যেও একটা তত্ত্ব আছে। আগে তত্ত্বটা বলি, তারপর নাম বলছি।
—পিঁপড়েদের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম অনুন্নত, তারা খাবারটা বোঝে, কিন্তু কে খেতে দিচ্ছে বোঝে না। একদিন খেতে দিয়েছেন বলে তারা আপনার পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায় না। একদিন পিপড়ের চাকে জল ঢেলে দিলে পরের দিন রাস্তায় কিছু ভেয়ো পিপড়ে আপনার মোজার ভিতরে ঢুকে পড়ে না। কিন্তু মানুষ উন্নত মস্তিষ্কের জীব। সে ভাবতে পারে, ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার রাগ, দুঃখ, অভিমান, প্রেম ইত্যাদি আছে, আমাদের থেকে উন্নত কোনও প্রাণী যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাহলে সে যোগাযোগ যতই সৌজন্যমূলক হোক না কেন, তার একটা প্রভাব পড়বে আমাদের সভ্যতার উপরে। যোগাযোগ না হলে ঠিক যা হত সেটা আর ঘটবে না। সব থেকে বড় কথা মানব সভ্যতা আর শুধু মানব সভ্যতা থাকবে না। পরীক্ষার হলে ইনভিজিলেটর যেমন উত্তর জানা সত্ত্বেও বলে দেন না, ঠিক সেভাবে আমাদের সভ্যতাকে কেবলমাত্র আমাদের নিয়মে এগোতে দিতেই বাইরের জগতের প্রাণীরা, অবসার্ভাররা, আমাদের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখে নিজেদের। চিড়িয়াখানার প্রাণীদের মতো সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে আমাদের উপর কেবল নজর রাখে তারা। এই তত্ত্বের নামটাও তাই চিড়িয়াখানার সঙ্গে মিলিয়েই, জু হাইপোথিসিস। ( জু হাইপোথিসিস নিয়ে মাতামাতি নতুন শুরু হলেও ধারণাটা কিন্তু বেশ পুরনো। বহু প্রাচীন দার্শনিক এর কথা বলে গেছেন। আমাদের মধ্যে যারা স্কেপ্টিকাল তারা ছোটবেলায় বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, ঈশ্বর আছেন, তিনি সর্বশক্তিমান, তাও পৃথিবীতে এত খারাপ ঘটনা রোজ ঘটে চলেছে কেন? তিনি কি নেমে এসে কিছু ঠেকাতে পারেন না?”
টেবিল ছেড়ে একটু এগিয়ে এসে আনন্দ চৌধুরী বলেন, “এই উত্তরটা জু হাইপোথিসিস দিয়ে দেওয়াই যায়। কিন্তু মানুষ তখন আর ঈশ্বরের সন্তান নয়, ঈশ্বরের তৈরি চিড়িয়াখানার একটি স্পেসিমেন হয়ে যায়।” ডক্টর চৌধুরী বোঝেন এরপর আলোচনা করতে গেলে মহাবিশ্বের অন্ধকারের থেকেও গভীর মানবমনের অন্ধকার অংশে আঘাত করবেন। প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে একটা মৃদু রসিকতা করে বক্তৃতা শেষ করেন তিনি। তারপর রিমোটের বোতাম টিপে আলো নিভিয়ে দেন।
হৈমন্তীর এই বিজ্ঞান আর ফিলোসফির কচকচানি নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না। সে দেখা করতে এসেছে অস্মিতার সঙ্গে। যেভাবেই হোক মেয়েটার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে হবে। পোডিয়াম থেকে নিচে নেমে আসতে ডক্টর চৌধুরীকে ঘিরে ধরে কিছু উৎসাহী টিনেজার। তাদের এক-এক জনের এক-এক রকম প্রশ্ন। সেসব সামলাতেই বিশেষ একজনের দিকে আঙুল তুলে দেখান চৌধুরী। সে খুশি হয়ে নিজের প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “স্যার আপনার সব কথাই বুঝেছি। কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউ কেউ যেমন ভুল করে মাঝে-মধ্যে সিংহের খাঁচায় ঢুকে পড়ে, তেমনই এলিয়েনদের কেউ কী ভুল করে আমাদের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করে ফেলতে পারে না?”
ডক্টর হাসেন, “ইউ.এফ.ও, লম্বা মাথার বেঁটে প্রাণী কিংবা ফ্লাইং সসার, এসব কী কম দেখা গেছে রে ভাই? এরিয়া ৫১ যাও না, দেখবে তেঁনারা রীতিমতো তল্পিতল্পা নিয়ে বসেছেন।”
—“ওসব তো আমেরিকায় স্যার। আমাদের দেশে দেখা যায়নি তেমন…”
—“কারণ আমাদের দেশে সাইন্স-ফিকশন নিয়ে মাতামাতি নেই, তাই এলিয়েনও নেই। যারা ভূতে বিশ্বাস করে, তারাই ভূত দেখে।” এগিয়ে এসে ছেলেটির কাঁধে হাত রাখেন চৌধুরী, “আমাদের সোলার সিস্টেমের বাইরে যদি কোথাও প্রাণ থেকেও থাকে তাহলে সে আমাদের থেকে কয়েক বিলিয়ন বছরের বেশি প্রাচীন। ফলে ক্ষমতার তফাতটা বাঘ-মানুষের নয়। অস্ট্রালোপিথেকাস, মানে একেবারে বাঁদর থেকে আজকের মহাকাশচারী মানুষ হতে সময়ে লেগেছে কুড়ি লক্ষ বছর। এই হিসেবে আমাদের থেকে এক বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হওয়া প্রাণীর সভ্যতার সঙ্গে আমাদের গ্যাপটা ওর পাঁচশো গুণ। মানে আমাদের থেকে তাদের পাঁচশোগুণ বেশি উন্নত হওয়ার কথা। তাহলে ভেবে দেখো, তারা যদি গা ঢাকা দিতে চায়, আমরা মাটিতে দাঁড়িয়ে, খালি চোখে তাদের চাকতি-টাকতি দেখে ফেলব?”
কথাটা শেষ হতেই আবার প্রশ্ন আসে, “কিন্তু যদি হয় স্যার? যদি সত্যি
কেউ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাহলে?”
কয়েক সেকেন্ডের জন্য একটু গম্ভীর হন ডক্টর চৌধুরী, তারপর আস্তে আস্তে বলেন, “জু হাইপোথিসিস যদি সত্যি হয় তাহলে তা রুল অফ নেচার। নিজের নিয়ম বিঘ্নিত হলে নেচার সেই বিঘ্ন মেরামত করে নেয় নিজেই। এক্ষেত্রে কীভাবে করবে তা বলার ক্ষমতা নেই আমার।” পোডিয়াম থেকে খানিক দূরে অস্মিতাকে দেখতে পায় হৈমন্তী। সেদিকে এগিয়ে যায় সে। একটা কাগজে মন দিয়ে কিছু লিখছিল অস্মিতা। হৈমন্তী ঝুঁকে পড়ে একটু চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে, “প্লিজ কিছু মাইন্ড করবেন না, আমার আপনাকে ভীষণ চেনা চেনা লাগছে।”
মুখ তুলে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে অস্মিতা, তারপর একটু সহজ হয়ে বলে, “আপনি কী নাটক-টাটক দেখেন?”
কপালে হাত দেয় হৈমন্তী, “শিট, একদম ভুলে গেছি, দেখলেন তো। এই তো আগের মাসেই অ্যাকাডেমিতে দেখলাম। কিং লেয়ার। আপনি মনে হয় গোনরিলটা করেছিলেন?”
অস্মিতা মিষ্টি করে হাসে, “আজ্ঞে হ্যাঁ, আসলে নেগেটিভ ক্যারেক্টার। বরাবরই ভালো লাগে আমার। তাছাড়া ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে ওরকম একটা এগ্রেসিভ ক্যারেক্টার… লোভ সামলাতে পারিনি…”
—“বাবা! শেক্সপিয়ারের নাটকও করেন আবার মহাকাশ নিয়েও আগ্রহ আছে! বিরাট রেঞ্জ তো আপনার!” হৈমন্তী হেসে বলে।
—“এই শেক্সপিয়ার ভদ্রলোকও কিন্তু মহাকাশ নিয়ে রীতিমত লেখালিখি করেছিলেন। সে-সময়ে স্পেস সাইন্স এতটা এগোয়নি বলে ভুল লিখেছিলেন তা ঠিক, কিন্তু আগ্রহ কম ছিল না।”
হৈমন্তী আর কিছু বলে না, অস্মিতা নিজে থেকেই বলে ওঠে, “তবে কী জানেন, আমি এখানে এসেছিলাম অন্য একটা উদ্দেশ্যে। ডক্টর চৌধুরী বিগ ব্যাং নিয়ে বিস্তর অনেক লেখালিখি করেন। কিন্তু এখানে এসে দেখি আজ সাবজেক্ট আলাদা।”
—“আর একদিন আসবেন না হয়।” আগের মাসে অ্যাকাডেমিতে অস্মিতার নাটক ছিল সেটা তার ফেসবুক প্রোফাইল দেখেই জেনেছে হৈমন্তী। আলাপ জমানোর জন্য কাজে লেগে গেল ইনফরমেশান’টা।
দু’জনে হেঁটে কনফারেন্স হলের বাইরে বেরিয়ে আসে। অস্মিতা মেয়েটা ভারী সরল। নানারকম বিষয়ে বিস্তর জ্ঞান আছে তার। হলের বাইরে একটা কফি-শপ দেখে তার ভিতরে এসে টেবিল নিয়ে বসে পড়ল দু’জনে। এর মধ্যে শেক্সপিয়ারের নাটকে স্পেস নিয়ে বেশ কিছু হেঁদো কথা বলে গেছে অস্মিতা। মেয়েটা মনে হয় বকবক করতে ভালোবাসে। হৈমন্তীর সুবিধাই হল। দু কাপ কফি টেবিলে এসে পড়তে, তাতে একটা বড়সড় চুমুক দিয়ে অস্মিতা বলে, “স্কুলে আমাদের শেখানো হয়েছিল পদার্থের সব থেকে ছোট কণা হল পরমাণু, ডাহা মিথ্যে কথা!”
—“নয়?” ওই দেখুন, গলথফ্যায়মি। আমার মা, আমার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারেন। , এমনকি সামনের দোকান বাজারে গেলেও তঁাকে বেঁধে নিয়ে যান। এর জন্য কি মাকে আর আলাদা করে মানুষ বলা যাবে না?”
—“নিশ্চয়ই যাবে।” হৈমন্তী হাসে।
—“পরমাণুকে ভেঙে ফেললে আসে ইলেকট্রন, প্রোটন আউর নিউট্রন। এই তিনটে কণাও তৈরি হয় কোয়ার্ক’ নামে এক ধরনের কণা দিয়ে। কোয়ার্ক একা একা থাকতে পারে না বলে এর কথা ভাবিই না আমরা। কিন্তু কোয়ার্ক ভারী মজার জিনিস, জানেন?”
—“মজার!” হৈমন্তীর ভুরু দুটো কুঁচকে যায়, “মজার কেন?”
—“আপনি, আমি বা সুনিতা উইলিয়ামস চারপাশে যা কিছু দেখে এসেছি এতদিন, তার সব কিছুই তৈরি হয়েছে কোয়ার্ক দিয়ে। বিগ ব্যাং যখন ঘটে তখন দুটো জিনিস তৈরি হয়। এক, সময় আর দুই, কোয়ার্ক। কিছু কোয়ার্ক মিলেমিশে তৈরি হয় প্রথম হাইড্রোজেন। সেই হাইড্রোজেন থেকে আবার একগাদা অন্য মৌল। সেখান থেকে এই এত্ত কিছু!”
—“সত্যি, ভীষণ মজার!” হৈমন্তী বাঁকা হাসি হেসে বলে, “কিন্তু আমি শুনেছিলাম তিনটে জিনিস তৈরি হয়েছিল। টাইম, স্পেস আর এনার্জি…”
—“আরে সেই হিটলারের তাড়া খাওয়া ইহুদি বুড়োকে ভুলে গেলেন। তিনিই তো বলে গেছিলেন স্পেস, এনার্জি আর ম্যাটার বলে আলদা করে কিছু নেই। এনার্জি আর ম্যাটার নিয়ত একে অপরে বদলে যাচ্ছে আর স্পেস বলতে…”
বাকি কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় অস্মিতা, সে বুঝতে পারে উলটোদিকের মানুষটার আগ্রহে ভাটা পড়েছে, প্রসঙ্গ পালটে সে বলে, “আপনি বোর হচ্ছেন, তাই না?”
হৈমন্তী লজ্জিত হয়, সেটা সামলে নিয়ে বলে, “উঁহু, অবাক হচ্ছি। স্পেস নিয়ে তোমার এত আগ্রহ দেখে।” অস্মিতার মুখের সামনে থেকে চুল সরিয়ে বলে, “আমাদের শরীরটাও কোনও মৃত তারা ভেঙে বেরিয়ে আসা কোয়ার্ক থেকেই তো তৈরি হয়েছে। আমারাও মহাবিশ্বেরই অংশ। আমাদের মহাবিশ্বের রহস্য জানতে চাওয়া মানে আসলে আয়নায় নিজের দিকেই তাকিয়ে থাকা…”
উদাস মুখে কথাগুলো বলেই জিভ কাটে অস্মিতা, আবার বোর করছে সে, “এঃ আপনার নামটাই তো জানা হয়নি। আমি অস্মিতা গোস্বামী। প্রফেশনাল বেকার।”
হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে দেয়, “হৈমন্তী ঘোষ। একটা সার্ভে গ্রুপে কাজ করি। পুরনো হেরিটেজ বিল্ডিং দেখাশোনার কাজ মেইনলি!”
অস্মিতা হাঁ হয়ে যায়, “মানে?”
—“মানে এই ধরুন ভারতবর্ষে এত ছড়ানো-ছিটানো পুরনো বাড়ি আছে… সেগুলোর হিস্টোরিক্যাল ভ্যালু আইডেন্টিফাই করি আমরা।”
ঠক করে কফির কাপ নামিয়ে রাখে অস্মিতা, “আর আপনার সঙ্গেই আলাপ হল আমার! হাউ এক্সট্রাওর্ডিনারি!”
হৈমন্তী মুখে কৌতূহল ফুটিয়ে তোলে, “কেন বলুন তো?”
—“আমার একটা এন্সেস্ট্রাল হোম আছে। একটা বাড়ি, বুঝলেন। সামথিং
ভাসান বা পাষাণ কিছু একটা। আমি ছেলেবেলায় কয়েকবার গেছি, বড় হতে দীর্ঘদিন যাইনি। আপাতত ওখানে কেউ থাকে না।”
—“সে কী! পুরনো?”
—“পুরনো বলতে অলমোস্ট দেড়শো বছর!” হাতের ব্যাগ থেকে একটা নোটবই বের করে টেবিলের উপরে বা হৈমন্তী, “আপনার কন্ট্যাক্ট নম্বরটা দিন প্লিজ!”
অস্মিতা থেমে যায়, “দিতে পারি, ইন ওয়ান কন্ডিশান।”
—“কী?”
—“এইসব আপনি আজ্ঞে চলবে না। আমি বছর দুয়েকের ছোট হব, তুই চলবে?”
মৃদু হাসে হৈমন্তী, “আচ্ছা বেশ। চলবে।” অস্মিতার নম্বর আর ঠিকানা লিখে নেয় হৈমন্তী।
এ-সময়ে কফি-শপের ম্যানেজার এসে দাঁড়ায় ওদের টেবিলের ঠিক পাশে। কিছু একটা বলতে চাইছেন ভদ্রলোক, কিন্তু ইতস্তত করছেন। অস্মিতা তার দিকে মুখ তুলে বলে, “কিছু বলবেন?”
গদগদ মুখে ম্যানেজার বলেন, “একটা রিকোয়েস্ট আছে আসলে, যদি কিছু মনে না করেন…”
—“বলুন না..”
—“আমাদের একটি কাস্টমার আছে। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। উনি রোজ মোটামুটি এইরকম সময়ে আমাদের দোকানের এই পার্টিকুলার চেয়ারে এসে বসেন।”
—“তাই নাকি! রোজ?”
—“আজ্ঞে হাঁ। রোজ। একদিনও মিস করেননি।”
—“ইন্টারেস্টিং!” অস্মিতা অবাক হয়ে বলে। ম্যানেজার আর একটু গদগদ গলায় বলে, “অন্য কেউ হলে আমরা এন্টারটেইন করতাম না কিন্তু উনি বলেই”
—“বেশ তো,” এবার হৈমন্তী বলে, “আমরা অন্য টেবিলে শিফট করে যাচ্ছি না হয়। নট আ বিগ ডিল।”
—“আরে নানা।” বাধা দেন ম্যানেজার, “আপনাদের উঠতে হবে না, আমি আর একটা চেয়ার এনে দিচ্ছি। উনি আপনাদের সঙ্গেই বসবেন। ভদ্রলোক খুব একটা কথাবার্তা বলেন না। আপনাদের যদি অসুবিধা না হয়…”
—“ওঃ শিওর। আপনি এখানেই বসতে বলুন ওনাকে..” ম্যানেজার চলে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে এক বছর পঁচাত্তরের বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন টেবিলের কাছে। ওদের দু’জনের দিকে একটা কৃতজ্ঞতার হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বসে পড়লেন বাড়তি চেয়ারে।
হৈমন্তী তাকিয়ে দেখল লোকটার সমস্ত মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, মাথায় চুলের কোনও চিহ্ন নেই। একটা নীল রঙের শার্ট আর ছিটের প্যান্ট পরেছেন বৃদ্ধ। হাতে একটা খয়েরি লাঠি। সেটা পায়ের উপরে হেলান দিয়ে রেখে দুটো কনুই টেবিলের উপর রাখলেন। তারপর স্থির হয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে।
অস্মিতা তার দিকে চেয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি রোজই আসেন এখানে?”
ভদ্রলোক মুখ না ফিরিয়েই উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ…”
—“কোনও কারণ আছে নিশ্চয়ই?” যেচে আগ্রহ দেখায় সে।
ভেবেছিল লোকটা চুপ করে থাকবে, তার বদলে অস্মিতার মুখের দিকে খয়েরি চোখ তুলে তাকালেন বৃদ্ধ, “অপেক্ষা করি একজনের। তার এখানে আসার কথা আছে।”
—“কার?” হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে কাঁপা-কাঁপা হাতে সেটা টেবিলের উপর রাখেন বৃদ্ধ। তারপর ভিতর থেকে একটা পুরনো হলদে হয়ে যাওয়া ছবি বের করে বলেন, “আমার স্ত্রী… চারবছর আগে মারা গেছে। মৃত্যুর সময় আমাকে বলে গেছিল..” ভদ্রলোকের মুখ থেকে কথা হারিয়ে যায়।
—“কী বলে গেছিল?”
—“রোজ এই সময়ে এই কফি-শপের ঠিক এই টেবিলে এসে বসতে।”
অস্মিতার মনটা উদাস হয়ে গেছিল। হৈমন্তী মুখ নিচে নামিয়ে ঠিকানাটা দেখে নিচ্ছিল। ভাসানবাড়ি? ভারী অদ্ভুত নাম।
আচমকাই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে যায়। বৃদ্ধের দুটো হাত টেবিল থেকে উঠে এসে আঁকড়ে ধরে হৈমন্তীর হাত দুটো। হৈমন্তী আঁতকে উঠে ফিরে তাকায় মানুষটার চোখের দিকে। এক আকাশ অবাক বিস্ময়ে যেন মানুষটা তাকিয়ে আছে হৈমন্তীর মুখে। মুখের প্রতিটা ক্ষুদ্রতম কণাকে পরম আগ্রহে লক্ষ্য করে চলেছেন। উষ্ণ হাতের স্পর্শ কিছুক্ষণের বিশ্রাম খুঁজছে ওর ঘামে ভিজে যাওয়া হাতের ভিতর।
যেন কয়েক লক্ষ বছর ধরে সেইটুকুনি বিশ্রামের আশায় ছিল হাত দুটো।
—“এ কী! কী করছেন আপনি?” মৃদু চিৎকার করে অস্মিতা। ম্যানেজার ছুটে আসেন সেই ডাক শুনে।
দুটো মানুষ সম্মোহিতের মতো চেয়ে আছে একে অপরের দিকে। মনে হয় তাদের ঘিরে বায়ু চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সময় জমাট মেঘের মতো ওদের আঁকড়ে ধরে থমকে গেছে। কণা, তরঙ্গ আর শক্তিতে ভাগ করা যায় না শরীরদুটোকে। সব কিছু গুলিয়ে গিয়ে জেগে আছে দুটো প্রাণ।
কয়েক সেকেন্ড পরে কয়েকটা অল্পবয়সী ছেলে এসে ছাড়িয়ে নেন বৃদ্ধের হাত দুটো। সঙ্গে-সঙ্গে তার মুখ থেকে সম্মোহিত ভাবটা কেটে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকান বৃদ্ধ আর হৈমন্তীর মুখের দিকে।
—“কী করছিলেন আপনি!” ম্যানেজার মৃদু তিরস্কার করেন।
—“আমি…”বৃদ্ধ উত্তর দিতে পারেন না, “আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?”
—“ঘুমাননি দাদু, তবে শুতে চাইছিলেন মনে হয়।” একটা ফচকে ছেলে পেছন থেকে রসিকতা ছুঁড়ে দেয়।
হৈমন্তী কিন্তু হাসতে পারে না। কী একটা যেন হয়ে গেছিল ওর মধ্যে, এই কফি-শপের ভিতরে বসে মনে হচ্ছিল একটা মস্তবড় অচেনা আকাশের
বুকে শুয়ে আছে ও। বৃদ্ধের চোখ দুটো যেন তার দিকে চেয়ে আছে অনা কোনও আকাশ থেকে। যেন এই অন্তহীন ইউনিভার্স মাতৃগর্ভের মতো ধারন করেছে ওকে। এ কেমন অদ্ভুত অনুভূতি!
—“তুই ঠিক আছিস তো?” অস্মিতা জিজ্ঞেস করে।
—“আমি…” উত্তর দিতে পারে না হৈমন্তী।