ভাসানবাড়ি – ১৪

চতুর্দশ অধ্যায়

রাত সাড়ে ন’টা বাজতেই দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছিল সুজয়। নামানো তেরপলের বাইরে রাস্তার উপর একটা গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ শুনে মাথা বের করল। দোকানের বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়েছে মানে দু পয়সা আমদানির সম্ভাবনা আছে। গাড়িটা দেখে তার মনটা আরও খুশি হয়ে গেল। বড় টাটা সুমা জাতীয় গাড়ি। অন্তত জনাদশেক লোক তো আছেই ভিতরে।

কাঁধের গামছাটা দিয়ে দোকানের বেঞ্চগুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিল সে। মুখে একটা আদিখ্যেতার হাসি ঝুলিয়ে নিল।

দাঁড়িয়ে থাকা সুমো থেকে দুটো লোক নেমে এল। সুজয় বুঝল এরা ছাড়াও আরও লোক আছে গাড়িতে। চায়ের দোকানের বাইরে বাল্বের হলদে আলো জ্বলছিল। সেই আলোতেই সুজয় দেখল লোকদুটোর গায়ে ব্র্যান্ডেড ফুলহাতা শার্ট, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ঝাঁ চকচকে চামড়া, যেন এক্ষুনি দোকান থেকে কিনে লাগান।

—“হেল্লো..” দু’জনের মধ্যে একজনের শার্টের রঙ নেভি ব্লু। সে সুজয়ের এ দিকে চেয়ে বলল কথাটা। চায়ের দোকানে এসে কাউকে ‘হেল্লো’ বলতে

শোনেনি এর আগে সুজয়।

প্রথমে একটু অপ্রস্তুতে পড়ল। তারপর বোকা হাসি হেসে বলল, “আঁ? ইয়ে… বসুন না…”

—“গাড়িতে ছ’জন আছে, আর আমরা দু’জন, মানে আট কাপ চা হবে।”

—“এক্ষুনি দিচ্ছি স্যার। গাড়িতে কি দিয়ে আসব?” লোকটা মাথা নাড়ে, অন্য লোকটাকে দেখিয়ে বলে, “একটা প্লেটে করে অরিন্দমের হাতে দেবেন, ও ভিতরে নিয়ে যাবে।”

আর কথা না বাড়িয়ে চায়ের জল ঢাপিয়ে দেয় সুজয়। লোকটা রোবটের মতো সোজা হয়ে বসে থাকে বেঞ্চের উপরে। এমন যান্ত্রিক হাবভাব যেন

লোকটার শরীরের ভিতরে রক্ত-মাংস নয়, কলকজা আছে। সুজয় একবার গাড়িটার দিকে তাকায়। জানলার কাচ নামানো। অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না।

—“কোথায় যাবেন আপনারা?” গদগদ স্বরে জিজ্ঞেস করে সে।

লোকটা মুখ ফেরায়, “কোথাও না। আসলে একজনকে খুঁজছি আমরা।”

—“খুঁজছেন! কাকে?”

—“এ গ্রামে রিসেন্টলি খুন জাতীয় কিছু ঘটেছে?” সুজয় একটু ঘাবড়ে যায় আগে, তারপর মনে করে উত্তর দেয়, “আজ্ঞে হ্যাঁ, এই তো গেল সপ্তাহে। বাজারের ঠিক সামনে একটা লোকের কাটা গলা পাওয়া গেছিল…

—“খুনি এই গ্রামেই কোথাও লুকিয়ে আছে। তাকে আইডেন্টিফাইও করেছি আমরা। তবে ঠিক কোথায় আছে জানি না।” দুধ উথলে উঠেছে। সুজয় এতক্ষণ খেয়াল করেনি। সেটা কমিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনারা পুলিশের লোক?”

—“বলতে পারো।” সুজয়ের মুখে হাসি ফোটে, “যাক, নিশ্চিন্ত হলাম স্যার। আমাদের গ্রামে আগে কোনওদিন খুন-টুন হয়নি। যেদিন শুনলাম বাজারের মুখটায় কেউ খুন হয়েছে তার পর থেকে ভারী ভয় লাগছিল। দোকানই তো খুলিনি টানা চারদিন। কিন্তু…” পরের প্রশ্নটা করার আগে একটু থামে সুজয়, “লোকটা খুন হল কেন স্যার? গা ঢাকা দিয়েছিল এখানে?”

—“নাঃ, সেও একজনকে খুঁজতেই এসেছিল।” পকেট থেকে একটা হাতের তালুর সাইজের ছবি বের করে সুজয়ের সামনে ধরে লোকটা, “এই মহিলাকে খুঁজতে এসেছিল। এই মহিলাই খুনি।” সুজয়ের চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। ছবির মেয়েটাকে সে চেনে, আগের সপ্তায় ইনিই সুজয়ের দোকানে ভাসানবাড়ির খোঁজ করছিলেন, কথাটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সুজয়। খুনের মামলার মাঝে জড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। বাড়িতে ছেলে বউ আছে তার।

—“কিন্তু খুন করল কেন স্যার? দেখে তো মনে হয় না…”

—“শি হ্যাঁজ কোয়াইট আ লাইফ!” মনে মনেই বিড়বিড় করে লোকটা, “যোল বছর বয়সে এইডস ধরা পড়ে মহিলার। তবে রোগটা লুকিয়ে ছিলেন এতদিন। যিনি খুন হয়েছেন তিনি হলেন এর প্রাক্তন প্রেমিক। তার কাছে জানাজানি হতে ব্যপারটা ডেঞ্জারাস টার্ন নেয়। শোনা যায় রোগের ডিপ্রেশান থেকে কিছু টেররিস্ট অরগানাইজেশনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন। শেষে কলকাতা থেকে পালিয়ে এখানে চলে আসেন এবং তার পিছু ধাওয়া করে তার বয়ফ্রেন্ডও এখানে এসে পৌছাতে তাকে গলা কেটে খুন করেন।”

—“এ তো ডেঞ্জারাস মহিলা স্যার!” কাঁপা-কাঁপা হাতে চায়ের কাপ তুলে দেয় সুজয়। গামছা নিয়ে ঘাম মোছে।

—“ভাসানবাড়িটা কোথায় জানো?”

সুজয় হাসে সেটা লক্ষ্য করে লোকটা বলে, “হাসছ কেন বলতো?”

সুজয় মাথা নেড়ে বলে, “এতদিন বাড়িটা ফাঁকা পড়ে আছে। আমরা ভুলেই গেছিলাম অমন একটা বাড়ি এ গ্রামে আছে বলে। এদিকে এই এক সপ্তায় রাজ্যের লোক এসে খোঁজ করছে বাড়িটার।”

—“এর আগে কে খোঁজ করেছিল ?”

অন্য লোকটার হাতে চায়ের প্লেট তুলে দিয়ে সুজয় বলে, “এই তো। তিনদিন আগেই আর একটা লোক এসেছিল। আপনাদের মতোই দেখতে, সেও ভাসানবাড়ির খোঁজ করছিল। আমি তো নিজে গিয়ে দেখিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। কাজ মিটে গেলে ফেরার সময় একশো টাকা বকসিস দেবে বলে গেছিল। কিন্তু… আর এলই না দোকানে…”

—“হুম..” লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা একশো টাকার নোট তার হাতে ধরিয়ে দেয়। তারপর বলে, “ধরে নাও তার হয়ে আমিই দিলাম এটা। আমাদেরকে দেখিয়ে দাও বাড়িটা।” লাজুক হেসে টাকাটা নিয়ে নেয় সুজয়, তারপর বলে, “বাড়ি দেখিয়ে দেব, কিন্তু গাড়ি নিয়ে তো যেতে পারবেন না সেখানে। জল পেরিয়ে যেতে হয়।”

লোকটা এবার চিন্তায় পড়ে, “জল পেরিয়ে এতগুলো লোক…”

—“জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা আছে। একটু ঘুরপথ, কিন্তু গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই…”

—“তুমি দেখিয়ে দিতে পারবে? দোকান তো বন্ধই করে দিচ্ছ।” একটু ইতস্তত করল সুজয়। এত রাতে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব। তার উপরে আবার একটা খুনিকে ধাওয়া করে। তাকে দোনোমননা করতে দেখে লোকটা আর একটা নোট চাপিয়ে দিল তার হাতে। এটা আগের থেকে পাঁচগুণ বেশি ভারী।

সুজয়ের হলদে আলোয় ভরা মুখ রঙিন হয়ে উঠল, “এক মিনিট দাঁড়ান স্যার, দোকানটা বন্ধ করে নিই…”

* * * *

—“কলকাতায় থাকলে আকাশ বলে যে একটা জিনিস আছে খেয়ালই হয় না, জানো?”

—“তাহলে ছিলেন কেন এতদিন?”

ভাসানবাড়ির ছাদে শুয়েছিল অশ্বিনী আর হৈমন্তী। ছাদের ঠিক মাঝে একটা শতরঞ্চি পাতা আছে। নরম আদুরে হাওয়া বইছে তার উপরে। দু’জনের চোখই আকাশের বুকে স্থির। কয়েক সহস্র আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা তারাদের আলো মেখে দুটো শরীর একই রঙের প্যালেট এ মিশে গেছে যেন। হৈমন্তীর একটা হাত পড়ে আছে অশ্বিনীর বুকের উপরে। সে আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।

—“আচ্ছা তুমি তো জানতে আমি কবে জন্মেছি, একবারও কলকাতা এসে দেখা করতে পারলে না?” অশ্বিনী হাসে, “কে বলেছে আমি যাইনি?”

—“গিয়েছিলে?” অশ্বিনীর দিকে পাশ ফিরে শশায় হৈমন্তী, “স্কুলের মাঠে জ্বরের ঘোরে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম তখন তুমি জাগানোর চেষ্টা করেছিলে আমাকে? যেদিন আত্মহত্যা করতে গেছিলাম সেদিন তুমি ডেকেছিলে আমাকে?”

—“ব্যাস! ওইটুকু? হৈম তোমার জীবনে এমন কোনও মুহূর্ত নেই যেখানে আমি ছিলাম না।”

—“তাহলে আমি তোমাকে চিনতে পারি না কেন বলতো?” তারা ভরা আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখায় অশ্বিনী, “দেখুন তারাগুলোও রোজ একটু একটু করে সরে যায় নিজের কক্ষপথে। রোজ একটা নতুন আকাশ দেখি আমরা, কিন্তু অচেনা লাগে না। আমারও তাই অচেনা লাগে না আপনাকে। আবার ভাবুন আজ থেকে কয়েক কোটি বছর পরে আকাশের তারাগুলো এতই পালটে যাবে যে আজকের সঙ্গে আর মিল পাবেন না। তখন আর চিনতে পারবেন না আকাশটাকে।”

—“মানে তোমার আর আমার মধ্যে ব্যবধান শুধু সময়ের?”

হৈমন্তীর মাথায় একটা হাত রাখে অশ্বিনী, “না হৈম, আমার কাছে সময়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। তোমার কাছে আছে।”

—“তুমি কী বল আমি বুঝি না, কিন্তু শুনতে ভালো লাগে। যেমন কিছু না বুঝেও ঝলমলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে।”

দু’জনের হাত খেলা করতে থাকে শতরঞ্চির উপরে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার কাশি এসেছে হৈমন্তীর। কাশি চাপতে গিয়ে মুখে রক্তের স্বাদ গিলে নিয়েছে। কাশলে এই মুহূর্তটা নষ্ট হয়ে যাবে। অশ্বিনী ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে।

—“নিবারণকাকা কোথায় আছে জিজ্ঞেস করবে না?”

—“না…”

—“একটা প্রশ্ন করব কিছু মনে করবে না?”

—“না, করুন।”

—“তোমাকে উনি ভয় পান কেন? তুমি ওর ক্ষতি করতে চাও?”

অশ্বিনীর মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়, সে কোনও উত্তর দেয় না। হৈমন্তী বোঝে প্রসঙ্গটা পছন্দ হয়নি তার। দুটো হাত দিয়ে অশ্বিনীর হাত জড়িয়ে ধরে সে বলে, “আচ্ছা আমার একটা ইচ্ছাপূরণ করবে?”

—“কী?”

—“আমি ইলেকট্রিক চুল্লিতে পুড়তে চাই না। আমি মরে গেলে…”

—“এসব কথা এখন থাক।”

—“উহু। শুনে নাও। আমি একেবারে ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে পুড়তে চাই। সেই মাঠের উপর বটগাছটা যেখানে ছিল সেখানে চিতা সাজাবে আমার, তারপর নিজে হাতে মুখাগ্নি করবে… করবে তো?”

—“আচ্ছা।” একটু উদাস হয়ে যায় হৈমন্তী, “আমার একটা বোন আছে, জানো। ভারী ভালোবাসত আমাকে। কিন্তু এখন কোথায় আছে জানি না।”

—“কেন?”

—“আমিই বলেছি যোগাযোগ না রাখতে। বিয়ে হয়ে গেছে শুনেছিলাম। সুখেই আছে মনে হয়।”

—“আপনি সুখে নেই?”

হৈমন্তীর চোখ দুটো ভিজে যায়, বাস্পমাখা স্বরে সে বলে, “পাগল ছেলে, সুখে আছি বলেই তো কষ্ট হচ্ছে…”

—“আপনি কী বলেন বুঝি না, কিন্তু শুনতে ভালো লাগে।” অশ্বিনীর বুকের কাছে মাথা রেখে শোয় হৈমন্তী।

* * * *

মেঠো পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভিতরে গাড়িটা এসে পড়তেই অস্বস্তি শুরু হয় সুজয়ের। তার অনেকগুলো কারণ হতে পারে। এত দামি গাড়িতে সে আগে চাপেনি, গাড়ির ভিতরে যে মানুষগুলো বসে আছে তাদের কারও মুখই দেখা যাচ্ছে না, কেউ কোনও কথা বলছে না, এইসব কারণের সঙ্গে আর একটা অনভূতি এসে মিশছে বারবার।

থেকে থেকে তার মনে হচ্ছে গাড়ির পাশে পাশে আরও একটা কিছু ছুটে চলেছে। কিন্তু যে চলেছে তাকে দেখা যাচ্ছে না।

মাঝে মাঝে কালো জানলার ওপার থেকে ভিতরে চোখ রেখে সুজয়কে দেখার চেষ্টা করছে। এমন অদ্ভুত ভয় আগে কখনও লাগেনি সুজয়ের।

নেভি ব্লু শার্ট পরা লোকটা বোধহয় আঁচ করতে পেরেছে ব্যাপারটা। মখ ঘুরিয়ে বলে, “কী ব্যপার? উশখুশ করছ কেন?”

—“কেমন একটা যেন লাগছে স্যার।”

—“কেমন লাগছে? রাস্তা চিনতে পারছ না?” সজোরে ঘাড় নাড়ে সুজয়। পকেটের ভিতরে দুটো নোট যেন ঘা দিয়ে হুঁশ ফেরায় তার, শুকনো হাসি হেসে বলে, “আসলে গ্রামের লোক বলে এ জঙ্গলটা ভালো নয়।”

—“কেন? ভূত আছে?” লোকটা বাঁকা হাসি হাসে।

—“না স্যার। ভূত নেই তবে… কিছু একটা আছে। আমার বাবার মুখে একটা গল্প শুনেছি.. তিনি তখন ছেলেমানুষ..”

—“গারবেজ।”অন্ধকার মুখগুলোর মধ্যে একটা বলে ওঠে কথাটা। নীল শার্ট হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয়, “আহা বলতে দাও ওকে।” তারপর সুজয়ের দিকে চেয়ে বলে, “বলো কী বলছিলে?”

সুজয়ের চোখ জানলার বাইরে গাছগাছালির ফাঁকে জমে ওঠা অন্ধকারে স্থির হয়ে গেছে, “অনেককাল আগে এখানে একটা বড় বাজ পড়েছিল। তারপর থেকেই জঙ্গলের একটা জায়গায় আর গাছ গজায় না। সমস্ত জায়গাটা কেমন খয়েরি হয়ে গেছে। গ্রামের লোক কেউ যেতে চায় না ওখানে… যারা যায় তারা কেমন যেন হয়ে যায়…”

—“বাবা! মনে হচ্ছে ভূতের গল্প!” পিছনদিক থেকে কেউ কৌতুক মেশানো গলায় বলে।

—“না স্যার, ভূত নয়। অদৃশ্য কিছু। সে মানুষের কোনও ক্ষতি করে না। কেবল রয়েছে ওখানে। চোখে দেখা যায় না, হাত দিয়ে ধরা যায় না, শুধু আছে এটুকু বোঝা যায়।”

—“স্টিল সাউন্ডস ঘোস্ট টু মি…” এবার অন্য একটা গলা। সুজয় চুপ করে যায়। নেভি ব্ল শার্ট মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে, “সে তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার গল্পটা কী?”

—“আমার বাবা একবার স্পর্শ করেছিলেন তাকে।”

—“এই যে বললে অদৃশ্য… তাহলে স্পর্শ করলেন কী করে?” সুজয়ের গলা দূরে ভেসে যায়, যেন জঙ্গলের গভীর থেকেই কথা বলছে সে, “বাবা ভারী সাহসি মানুষ ছিলেন। ওই পাগলাটে গোছের। মাঝরাতে জঙ্গলের ভিতরে ঘোরাঘুরি করতেন। আমরা ভোরে উঠে দেখতাম বাবার সারা গায়ে ঝোপঝাড়ের শুকনো পাতা। কোথাও বুননা কাঁটাগাছে চিরে গেছে।

একদিন সকালে বাবা বাড়ি ফিরতে দেখি তার ডানহাতের আঙুলের মাথাগুলো নেই। যেন ধারালো ব্লেড দিয়ে মাখনের মতো কেটে নিয়েছে কেউ। এদিকে রক্ত পড়ছে না, কোনও যন্ত্রণা নেই। যেন আঙুলগুলো আগে ছিলই না ওখানে…

তারপর থেকে আর জঙ্গলে যেতেন না বাবা, কারও সঙ্গে তেমন কথাও বলতেন না। ঠিক কী করে তার আঙুলগুলো খোয়া গেল সে কথাও বলেননি কোনওদিন…”

এবার আর কোনও টিপ্পনি ভেসে এল না। তার বদলে পিছন থেকে একটা প্রশ্ন ভেসে এল, “আপনার বাবা বেঁচে আছেন?”

—“না স্যার… দশবছর হল মারা গেছেন।”

নেভি ব্লু শার্ট এবার পিছনে ঘোরে। অন্ধকার মুখগুলোর দিকে চেয়ে বলে, “এ জঙ্গলে ভূত নেই, কিন্তু কী আছে সেটা মনে হয় খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি।”

—“কী?”

—“ওই যে স্যার, দেখা যাচ্ছে বাড়ির মাথাটা, ওটাই ভাসানবাড়ি।”

* * * *

দূর থেকে একটা গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসে। গ্রামের দিকে পথঘাট শুনশান থাকে। তাছাড়া এখানে অন্য গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই। ফলে। নরম মাটির উপরে চাকা ঘষ্টানোর যান্ত্রিক শব্দ দূর থেকেও শোনা যায়। হৈমন্তী আধো ঘুমে জড়িয়ে ছিল। সামান্য শব্দেই তার তন্দ্রা ভেঙে যায়। ওর কাঁধের ঠিক পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে অশ্বিনী। এই প্রথমবার ছেলেটাকে ঘুমাতে দেখল হৈমন্তী। ইচ্ছে করেই ডাকল না। কিন্তু এত রাতে গাড়ি করে কে এল? চাপা কৌতূহল ঘিরে ধরল হৈমন্তীকে। গাড়িটা বড়সড়। ভাসানবাড়ির সামনে’টায় এসেই হেডলাইট নিভিয়ে ফেলেছে গাড়িটা। মানে ভিতরে যারা আছে তারা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চায় না। উৎকণ্ঠা বুকে নিয়ে হৈমন্তী অপেক্ষা করতে থাকে। গাড়ির দরজা খুলে যায় ধীরে ধীরে। ভিতর থেকে কয়েকটা ছায়া নেমে আসে। তাদের হাতে বড়সড় কিছু ধরা আছে। অন্ধকারেও অবয়বটা ফুটে ওঠে—শটগান। বিড়ালের মতো সন্তর্পণে তারা এগিয়ে আসতে থাকে ভাসানবাড়ির দিকে।

অশ্বিনীর ঘুমন্ত মুখের দিকে ফিরে তাকাল একবার হৈমন্তী। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে তার। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। লোকগুলো তার খোঁজেই। এসেছে সন্দেহ নেই।

দ্রুত শতরঞ্চির উপরে ফিরে এসে অশ্বিনীর গায়ে ঠেলা দিল হৈমন্তী, “প্লিজ একটু ওঠো, কারা যেন এসেছে… অশ্বিনী..” ” ছেলেটা নড়ল না। যেন ঘণ্টাখানেক আগেই মারা গেছে সে। শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। সেটা রাতের কনকনে হাওয়ায় না সত্যি তার দেহে প্রাণ নেই বোঝা যায় না।

লোকগুলোর পায়ের আওয়াজও এবার কানে এল হৈমন্তীর। সে চাপা চিৎকার করে উঠল, “অশ্বিনী.. এরকম করো না। তুমি বলেছিলে আমার কিছু হতে দেবে না… ওরা আমাকে ছাড়বে না… প্লিজ…” প্রাণের শেষ স্পন্দনটুকুও মুছে গেছে ছেলেটার শরীর থেকে। মুখ ফ্যাকাসে লাগছে। কাঁপা-কাঁপা হাত নাকের সামনে রাখে হৈমন্তী। নিশ্বাস বন্ধ। সে ডুকরে কেঁদে ওঠে।

—“দাঁড়ান স্যার। আগে আমি যাই।” এগিয়ে যাওয়া লোকগুলোর দিকে চেয়ে সুজয় বলল।

—“কেন?”

—“বাড়িতে একটা কেয়ারটেকার আছে। আমার সঙ্গে মুখ-চেনা। আমি গিয়ে বললে দরজা খুলে দেবে।” নেভি-শার্ট অরিন্দম বলে লোকটার কাছে গিয়ে কী যেন আলোচনা করে নেয়। তারপর ফিরে এসে বলে, “বেশ তুমি আগে যাও। আমরা জোর করে দরজা খোলাতে চাই না। গোলাগুলি, চিৎকার চেঁচামিচি যত কম হয় ততই ভালো।”

একটু আগের আদিখ্যেতার হাসিটা আবার হেসে সুজয় বলে, “একটা কথা বলি স্যার? কিছু মনে করবেন না। একজন মহিলা, যে আবার মারণরোগে ভুগছে, তাকে ধরতে আপনারা এত লোকজন আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছেন! মহিলার কিন্তু এলেম আছে!”

—“শি ক্যান বি আ বিচ আন্ডার সারকামস্টেন্সেস!” কথা না বাড়িয়ে এগিয়ে যায় সুজয়। জল-কাদা পেরিয়ে ভাসানবাড়ির বাগানের দরজার বাইরে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এগোয় না। প্রায় মিনিট তিনেক স্পন্দন খেলে না শরীরে।

দু’জন বন্দুকধারী সাবধানে ফলো করছিল তাকে। তারা কাছে এগিয়ে গিয়ে পিঠে খোঁচা দেয়, এই শালা, দাঁড়িয়ে গেলি কেন?”

সুজয় ঘুরে দাঁড়ায়। বন্দুকধারীরা সভয়ে পিছিয়ে আসে। সুজয়ের দুটো চোখের মণি উধাও হয়েছে। তার বদলে চোখ ঢেকে গেছে রক্তের মতো লাল রঙ্গে। মুখমণ্ডল তরল গলিত লাভার মতো ভেঙে-চুরে যাচ্ছে। যেন সুজয়ের শরীরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে অন্য কেউ,অন্য কিছু…

কিছু না বুঝেই পরপর দুটো গুলি চালায় দু’জন। সুজয়ের গলিত শরীরের মাঝে হারিয়ে যায় সেগুলো। শরীরটা লম্বায় বাড়তে শুরু করেছে। আর মানুষের মতো আকৃতি নেই তার। লাভার মতো তরল আগুনের রেখা ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। যেন একটুকরো সূর্য কেটে এনে কেউ রেখে দিয়েছে ভাসানবাড়ির সামনে। হিংস্র নয়, অথচ ভয়াবহ, ধোঁয়ার মতো গ্রাস করছে। চারিদিক, অথচ ধোঁয়া নয়, নিপ্রাণ নয়।

গাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মধ্যে হইচই পড়ে যায়। একযোগে চিৎকার করতে গিয়েও পারে না তারা। মনে হয় সাঁড়াশি দিয়ে জিভ টেনে ধরেছে কেউ। পা আটকে দিয়েছে। স্থবিরের মতো সেই বেড়ে ওঠা কঠিন মেঘের কুন্ডলির দিকে চেয়ে থাকে তারা। সেটা বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় বাড়িটার সমান আকৃতি ধারণ করেছে।

সেই আকাশছোঁয়া মেঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষের উপরে। তারপর সরে আসে গাড়িটার দিকে। পাথরে পরিণত হওয়া মানুষগুলোর চোখে প্রতিফলিত হয় সেই আগুন। নেভি ব্লুর টি-শার্ট পরা মানুষটার দিকে এগিয়ে আসে মহাজাগতিক সেই আগুন। তিনি চোখ বন্ধ করে নেন। চোখ খুলতেই দেখেন সুজয় দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক সামনে। তার মুখ-চোখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। রোবটের মতো খটখটে শব্দে কয়েকটা কথা বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, “আমি চাই না আপনারা আর এখানে আসুন।”

লোকগুলোর মুখে আর কোনও কথা ফোটে না। সুজয় হাত বাড়িয়ে লোকটার পকেট থেকে হৈমন্তীর ছবিটা বের করে নিয়ে বলে, “উনি যতদিন বেঁচে আছেন এ বাড়িতে আসবেন না আপনারা। উনি মারা গেলে বাড়ি ভেঙে যা ইচ্ছা করতে পারেন। তার আগে না। বুঝতে পেরেছেন?” ব্লু শার্ট মাথা নাড়াতে ভুলে গেছিলে। সুজয় তার কাঁধে হাত রেখে বলে,

—“বুঝেছেন তো?”

—“এবার চলে যান।” মিনিট তিনেক পর একটা ছোট ধাক্কা লেগে যেন জ্ঞান ফেরে সুজয়ের। সে অবাক হয়ে দেখে জঙ্গলের রাস্তা ধরে গাড়িটার আলো মিলিয়ে আসছে। এতক্ষণ কী হয়েছে কিছুই মনে নেই তার। পকেট চেপে ধরে নোট দুটো অনুভব করে সে।

—“অশ্বিনী.. অশ্বিনী…” পাগলের মতো কাঁধ ধরে ঝাকাতে থাকে হৈমন্তী। হঠাৎই ধড়ফড় করে উঠে বসে অশ্বিনী। উদ্বিগ্ন মুখে বলে, “কী হয়েছে হৈম?” হৈমন্তী ডুকরে ওঠে, “আমি ভাবলাম তুমি…” অশ্বিনী হাসে। একটা হাত দিয়ে হৈমন্তীর মাথাটা কোলে টেনে নেয়।

—“বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। অনেকগুলো লোক এনেছে ওরা।”

—“তাই নাকি! কই দেখি তো…”দু’জনে মিলে গিয়ে দাঁড়ায় ছাদের ধারে। বাইরে অন্ধকার রাত আগের মতোই পড়ে রয়েছে। নিশ্চপ। গাড়ি উধাও হয়েছে। কোনও মানুষেরও চিহ্ন নেই। হৈমন্তী হাঁ করে চেয়ে থাকে সেদিকে।

—“মিছিমিছি ভয় পান আপনি…।” অশ্বিনী নিচু গলায় বলে। দুহাতে তার কনুই চেপে ধরে হৈমন্তী। তারপর চোখ বোজে।

—“ড্রাইভ দ্যা কার… যত জোরে পারো চালাও গাড়িটা।” গাড়ির বাকি লোকগুলো হতভম্ব হয়ে গেছিল, তাদের মধ্যে একজন উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করে, “ওয়াট দ্য ফাক ওয়াজ দ্যাট!”

—“আর যাই হোক, এই পৃথিবীর কিছু নয়।”, অরিন্দমের হাত পা কেঁপে চলেছে এখনও, “এণ্ড ইট হ্যাঁজ ফাকিং শেপশিফটিং এবিলিটি।”

—“আর ওই জঙ্গলে?”

—“এই… প্রাণীটার সঙ্গে স্পেস থেকে আরও কিছু এসেছিল এখানে।”

—“কী?” অরিন্দমের গলকণ্ঠটা ওঠানামা করে একবার, ঢোক গিলে সে বলে,

—“ডার্ক ম্যাটার। ম্যাটার যখন ডার্ক ম্যাটারের কন্ট্যাক্টে আসে তখন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেই জন্যেই লোকটার আঙুলগুলো… কিন্তু…” একটু থেমে রাস্তার উপরে সতর্ক দৃষ্টি রেখে আবার বলে সে, “ডার্ক ম্যাটার পৃথিবীতে পাওয়া অসম্ভব। একমাত্র স্পেসের কোনও কোনও জায়গায় থাকতে পারে বলে ধারণা করতে পারি আমরা। এ জঙ্গলে সেটা আছে মানে কোনওভাবে সেটা এসেছিল..”

—“কীভাবে?”

—“হয়তো বিশেষ কোনও কারণে কেউ নিয়ে এসেছিল…”

—“কী কারণে?”

—“আই হ্যাঁভ নো ফাকিং আইডিয়া…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *