ত্রয়োদশ অধ্যায়
—“আমি তো হ্যাঁর আগামাথা কিছুই বুজতাসি না।” পার্চমেন্টগুলো হাত থেকে নামিয়ে রেখে নিতাই বলে। তারপর চোখ তুলে তাকায় হৈমন্তীর দিকে।
—হৈমন্তির ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট, এই একটা দিনে আরও কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। গায়ে একরোখা জর, মুখে খাবার উঠছে না, অথচ কিছুতেই ডাক্তার দেখাবে না।
নিতাই জিজ্ঞেস করে, “আপনি বুজসেন কি?” গত দুদিন ধরে নিতাই আর হৈমন্তী চেষ্টা করেছে মুরারিমোহনের রেখে যাওয়া হলদেটে কাগজগুলোর মর্ম উদ্ধার করার। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। সাধারণের বোঝার জন্য সেগুলো রেখে যাননি মুরারিমোহন! গোটা পঞ্চাশেক হলদেটে কাগজ। তার উপরে পদার্থবিদ্যার জটিল গাণিতিক ফর্মুলা আর হিসেব নিকেশ লেখা রয়েছে। সঙ্গে আঁকাবাঁকা ও অসমান্তরাল লাইনে বাংলা ইংরাজি মিশিয়ে কিছু লেখা। বেশ কয়েক জায়গাতেই। ‘চিড়িয়াখানা’ শব্দটার উল্লেখ আছে। তবে সেটা ঠিক কোন্ প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয়।
নিতাইয়ের প্রশ্নে হৈমন্তী দুপাশে মাথা নাড়ায়, “আমার পেটে এত বুদ্ধি নেই। তবে কয়েকটা জিনিস চেনা লাগছে। এই যেমন…”।
কাগজের তাড়া থেকে একটা বিশেষ কাগজ টেনে বের করে হৈমন্তী, সেটার একটা জায়গায় আঙুল রেখে বলে, “এই ফর্মুলাটা, এটা টাইম ডায়ালেশানের ফর্মুলা। আমাদের স্কুলে ম্যাম শিখিয়েছিল। এর মানে হল সময় বিশেষ বিশেষ কারণে মন্থর হয়ে যেতে পারে…”
—“মানে?” নিতাই হাঁ হয়ে যায়।
—“মানে ধরুন এই ভাসানবাড়ি, গোটা পৃথিবীতে সময় যে নিয়মে এগিয়ে চলেছে ভাসানবাড়িতে সে নিয়মে চলবেই তার কোনও মানে নেই..”।
কিছু একটা কথা মনে পড়ে নিতাইয়ের, একটু ভেবে নিয়ে সে বলে, “আমি সেলেবেলায় একখান আলো দেখসিলাম আকাশে। বুড়োকত্তা বলসিলেন ওইটা হইল হ্যাঁলির ধূমকেতু। সেইটার নাকি তহন আসার কতা ছিল না ?
—“আপনার ছেলেবেলা!” হৈমন্তী অসুস্থ শরীরেও উঠে বসার চেষ্টা করে, “মানে ধরুন সত্তরের আশেপাশে। তখন হ্যাঁলির ধূমকেতু!”
—“হ,…” নিতাইয়ের চোখ দেখে মনে হয় এখনও দৃষ্টিপটে অন্ধকার আকাশের বুক চিরে ধূমকেতু ছুটে চলেছে।
—“কিন্তু সেটা তো এইট্টী সিক্সে এসেছিল। আপনি সেটা পনেরো বছর আগে দেখেছিলেন মানে..” হৈমন্তী পরের কথাগুলো বলার আগে একটু থামে, যেন কোনও নিষিদ্ধ বেড়া টপকানোর আগে একটু ইতস্তত করছে, “কোনও জিনিস ঘটার আগে দেখা মানে সময় এখানে মন্থর নয়, টাইম ডায়ালেশান ঋণাত্মক, সময় এখানে দ্রুতগামী! ইম্পসিবল!”
—“ক্যান?” নিতাই আপত্তি জানায়, “আপনি তো কেবল কইলেন যে দুইজনের লইগ্যা টাইম সেইম গতিতে চলবে তার কুননা মানে নাই, তাইলে যার কাসে টাইম স্লো চলবে তার তো মনে হইবে অন্যজনের টাইম ফাস্টার…” হৈমন্তীর মাথায় গুলিয়ে যায় ব্যাপারটা, কী উত্তর দেবে সে বুঝতে পারে না।
থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স তার সাবজেক্ট ছিল না কোনওদিন। তার মাথায় অন্য একটা ভাবনা খেলা করছে এখন। বিড়বিড় করে বলে, “এ বাড়িতে যে জিনিসটা মুরারিমোহন এনেছিলেন সেটাই সম্ভবত সময়ের গতিকে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিতে পারে। সে জন্যেই ভাসানবাড়ির ছাদ থেকে অন্য সময়ের আকাশ দেখা যায়। কিন্তু জিনিসটা আছে কোথায়?”
হৈমন্তী এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, “এ বাড়িতে এসে থেকে প্রায় রোজই কিছু না কিছু স্বপ্ন দেখি, জানেন? আমার ছোটবেলা, বড়বেলার নানা ঘটনা। তবে কাল রাতে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম… যার সঙ্গে আমার ছেলেবেলার কোনও সম্পর্ক নেই।”
—“কী দেখলেন?” এবার নিবারণ জিজ্ঞেস করেছে। সে একটু দূরে একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল।
—“মনে হল যেন একটা থিয়েটারে বসে আছি। সামনে বিরাট বড় একটা পর্দা ঝোলানো। পর্দার ওপারে মঞ্চসজ্জার কাজ চলছে। নামানো পর্দার উপরে মাঝে-মধ্যে ওপাশের ঘুরে ফিরে যাওয়া আলো চোখে পড়ছে, লোকজনের হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে সেটা থেমে যেতে পর্দা উঠে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি পর্দার পেছনে কোনও স্টেজ নেই আর। শুধু একটা একটা করে বিন্দু বিন্দু আলোর মতো তারা ফুটে উঠছে, মঞ্চের উপরে কেউ কোথাও নেই। শুধু অন্তহীন মহাবিশ্ব জেগে আছে।”
—“সে কী! এর মানে কী?” নিবারণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
—“জানি না, মনে হল অন্ধকার জগতের ভিতর থেকে যেন কেউ ডাকছে আমাকে, শব্দ শুনতে পাচ্ছি না, তাও মন বলল কেউ ওর ভিতরে অপেক্ষা করে বসে আছে আমার জন্য।”
—“পুরাই মিনিংলেস…” নিতাই বলে। হৈমন্তী কপালে হাত বুলিয়ে একবার নিজের জ্বরটা দেখে। নিবারণ একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে তার কপালে জলপট্টি দেয়। একটু আগেই অশ্বিনী এসে ব্রেকফাস্ট আর ওষুধ খাইয়ে গেছে তাকে। একটু পরে জ্বর ছাড়ার কথা।
—“স্বপ্নটা ভেঙে যেতে আমারও মনে হয়েছিল মিনিংলেস… তবে এই জ্বরের ঘোরে পড়ে আছি তো সারাদিন… একটা কথা মাথায় আসছে।”
—“কীরকম কথা?”
—“স্বপ্নটার একটা মানে আছে। আমাকে হয়তো ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইছে স্বপ্নটা…”
—“কী বোঝাতে চাইছে?” বাইরে সকালের আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘ করে আছে। বৃষ্টি নামবে হয়তো একটু পরে। সেই কালচে ছোপ লাগা আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হৈমন্তী বলে, “এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়ার বেশ কিছুটা সময় পরে একটা অন্ধকার যুগ এসেছিল, যাকে বলা হয় ডার্ক এজ। মহাবিশ্বের সেটা জন্মলগ্ন। ফলে এখনকার মতো এত বড় আর বিস্তৃত ছিল না সেটা। ধরে নিন মহাবিশ্বটা ছিল একটা বাটির মতো, কিন্তু আমরা ছোটোবেলায় পড়েছিলাম মহাবিশ্বের সমস্ত ভর তার জন্মলগ থেকে একই আছে, বাড়েওনি কমেওনি। ফলে এই বিপুল পরিমাণ ভর জমা হয়েছিল ওই ছোট্ট জায়গাটার মধ্যে। এবার ভাবুন, এক হাঁড়ি ভাতকে যদি জোর করে একটা বাটির মধ্যে ধরাতে চান তাহলে কী হবে? বাটির ভিতরে ভয়ানক চাপ তৈরি হবে। সেই চাপ থেকে প্রচণ্ড উত্তাপ তৈরি হবে। এবং সেই উত্তাপে ভাতের পরমাণু ভেঙে ইলেকট্রন পোটনে পরিণত হয়ে ইতস্তত ছুটে বেড়াবে হাঁড়ির ভিতরে। এই মুক্ত নেগেটিভ চার্জড ইলেকট্রন মহাবিশ্বের যাবতীয় আলোকে আটকে দিত। ফলে মহাজগত অন্ধকারে ডুবে থাকল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্ব বেড়েও উঠল, সঙ্গে ঠান্ডাও হল কিছুটা। এই সময় থেকেই শুরু হল আমাদের ডার্ক এজ। চারশো মিলিয়ন বছর চলার পরে যেদিন মহাবিশ্বের প্রথম তারা ফুটল সেদিন এসে শেষ হল ডার্ক এজ। কিন্তু মাঝের এই চারশো মিলিয়ন বছর ঠিক কী ঘটেছে? বিজ্ঞানীদের কাছে উত্তর নেই। যেন মহাকালের ওইটুকু অংশে কেউ পর্দা ঝুলিয়ে দিয়েছে। এমন মনে হতে পারে যে কিছুই ঘটেনি এর মধ্যে। পরমাণু
নিজের নিয়মে দানা বেঁধে প্রথম নক্ষত্র তৈরি করেছে। কিন্তু তা হবার নয়। নক্ষত্র কেবল অণু-পরমাণু জমে তৈরি হতে পারে না। তাকে একটা নির্দিষ্ট আকারে গঠিত হতে হবে। নির্দিষ্ট জটিল গাণিতিক নিয়ম মেনে তাকে আবর্তিত হতে হবে। মহাকর্ষ মেনে কক্ষপথ নির্ণয় করতে হয়, এসব এমনি এমনি হবে কী করে? এই ডার্ক এজের পর্দা যখন মঞ্চে নেমে এসেছিল তখন মহাবিশ্ব ছিল একটা কেওস। কোনও অর্থ ছিল না তার, চারশো মিলিয়ন বছর পরে পর্দা উঠতে আমরা দেখলাম এই সম্ভাবনাময় মহাবিশ্ব, যেখানে এত জটিল প্রাণ অবধি সৃষ্টি হতে পারে। শুধু মঞ্চসজ্জার কারিগরদের আমরা দেখতে পেলাম না। তাদের হাঁকডাক শুনলাম, ইতস্তত আলো দেখতে পেলাম। যেন একটা মানুষের স্মৃতি থেকে তার ছোটবেলার একটা বিশেষ অংশ মুছে দিতে চেয়েছে কেউ, এরকম কখন হয় বলুন? যখন সেই ছোটবেলায় এমন কেউ থাকে যার কথা মনে রাখলে তার বেড়ে ওঠায় কোনও ক্ষতি হতে পারে…” ।
একটু দূরে মেঝের উপরে বসেছিল গনশা। সকাল থেকে গেম খেলে চলেছে সে। একটু আগে ক্ষান্ত দিয়েছে। আপাতত তার চোখ গিয়ে পড়েছে মুরারিমোহনের গবেষণার কাগজগুলোর উপরে। একটা বিশেষ জায়গা চোখে পড়তে তার ভুরু কুঁচকে যায়। কাগজটা হৈমন্তীর দিকে তুলে ধরে সে বলে, “এই চিহ্নটা… একটা জায়গায় দেখেছি।”
হৈমন্তী দেখে কাগজের একটা কোণের দিকে ছোট্ট একটা গোলের উপর প্রায় বিন্দুর মতো আর একটা উপবৃত্ত আঁকা রয়েছে। ভারী সহজ চিহ্ন। সদ্য পেনসিল ধরতে শেখা বাচ্চাছেলেও অবলীলায় আঁকতে পারবে সেটা।
—“কোথায় দেখেছিস?”
—“এই বাড়িতেই দেখেছি। একদিন দাদা ছিল না, তখন…”
—“মনে পড়লে আমাকে দেখাতে পারবি?” গনশা কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় টোকা পড়ে। ওপাশ থেকে অশ্বিনীর গলার আওয়াজ শোনা যায়, “শুনছেন? শরীর কেমন আছে?”
আওয়াজটা শুনেই বিছানা থেকে নেমে পাশের ছোট ঘরে লুকিয়ে পড়ে নিবারণ। এই ক’দিন অশ্বিনী উপরে এলে ওখানেই থাকে সে। গনশা উঠে দরজা খুলে দেয়।
অশ্বিনী নিতাইকে বসে থাকতে দেখে একটু থমকে যায় ,কাগজগুলো এতক্ষণে বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলছে হৈমন্তী। সেই বালিশের ঠিক পাশেই এসে বসে অশ্বিনী, হৈমন্তীর কপালে একটা হাত রাখে, মিহি স্বরে বলে, “জ্বরটা কমছে। খাবেন কিছু?”
—“উহু,” অশ্বিনীর হাতের উপরে একটা হাত রেখে নিতাইয়ের দিকে চায় হৈমন্তী, “শুনছি এ বাড়ি নাকি বিক্রি হয়ে যাবে। তো কেয়ারটেকারটিকে আমি কলকাতায় নিয়ে গেলে আপত্তি করবেন না তো?”
—“আপত্তি করনের কী আসে আর, এই পোলা একখান হ্যাঁডেক..”
—“আর আপনার আকাশ দেখার কী হবে? বাড়ি ভেঙে হোটেল হলে তারা আপনাকে আর দূরবীন নিয়ে ছাদে অ্যালাউ করবে বলে তো মনে হয় না।
নিবারণের মুখটা করুণ হয় ওঠে। বোঝা যায় এ ব্যাপারটা আগে ভেবে দেখেনি। বিছানার চাদরের উপরে আঙুল দিয়ে দাগ কাটতে থাকে।
—“আমার কী মনে হয় জানেন?” হৈমন্তী আবার জানলার দিকে তাকায়, “আমরা কেউ এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না। আমাদের শখ, আহ্লাদ, ভালোবাসা সব নিয়ে এখান থেকেই বিলীন হয়ে যাব..”
—“কে বলেছে আপনাকে?” অশ্বিনী জিজ্ঞেস করে।
—“তুমি বলেছিলে না দেড়শ বছর আগে এখানে একটা পুকুর ছিল, সেখানে সবাই ভাসান দিত বলে নাম ছিল ভাসানপুকুর?”
—“হ্যাঁ বলেছিলাম। তো?”
—“মানুষ ঠাকুরকে পুজো করার পর কেন ভাসান দেয় জানো?” গনশা মাটিতে বসে থাকতে থাকতেই জবাব দেয়, “দুর্গাঠাকুর তখন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আবার বাপের বাড়ি ফিরে যায়।”
—“ধুর পাগল! ওসব তো শুধু বলার জন্য। আসল কারণ হল মানুষ অত বড় ঠাকুর সারাবছর রাখবে কোথায়? কোথাও রাস্তা আটকে পুজো হয়, কোথাও খেলার মাঠ জুড়ে, তাছাড়া রেখে দিলে ঠাকুরের রঙ উঠে যাবে, চল নষ্ট হবে, খড় বেরিয়ে পড়বে, তাই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অনেকদিন ধরে ভাসান হতে হতে সেই পুকুরটার মনে হয় অভ্যাস হয়ে গেছিল ব্যাপারটা। এই সমাজে যাদের ঠাঁই হয় না, যারা ঠিক সমাজের মাপে তৈরি নয়, যাদের সবাই ভয় পায়, ঘৃণা করে, তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যেত পুকুরটা, নামের সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের আত্মাটাও হয়তো এই ভাসানবাড়ির মধ্যে ঢুকে গেছে…”
বড়সড় একটা বাজ পড়ে বাইরে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়, মাটির গন্ধ এসে লাগে নাকে। ভারী চমৎকার একটা সকাল আজ।
বৃষ্টির শব্দ শুনেই দ্রুত খাট থেকে নেমে পড়ে নিতাই, “বৃষ্টি আইসা গেল, বাড়ি জাইতে হইব।” গনশার পিঠে একটা চাপড় দিয়ে বলে, “সাতা তো নাই তোর কাসে, আমার লগে বাইরাইরা আয়…”
গনশা আর বাক্যব্যয় না করে বেরিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে বাইরে। হৈমন্তী আটকে থাকা কান্নার দমকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে অশ্বিনীর বুকের উপরে, “আমার ভয় লাগছে খুব অশ্বিনী..”
—“কীসের ভয়?”
—“ওরা আবার আসবে, ওদের লোক কম নেই। বাড়িটাও কিনে নিয়েছে। ওরা, তোমাকে বাঁচতে দেবে না ওরা..”
—“আমাকে বাঁচতে দেবে না!” চাপা হাসি খেলে যায় অশ্বিনীর মুখে।
—“হাসছ কেন তুমি?”
—“না এমনি। আপনিও হাসুন, হাসলে ভালো লাগে আপনাকে দেখতে।”
—“প্লিজ অশ্বিনী, আমার চিন্তা হচ্ছে তোমাকে নিয়ে, তুমি একা আটকাতে পারবে ওদের সবাইকে? গায়ে ছুরি চললে রক্ত পড়বে না তোমার? গুলি লাগলে…”
—“কিচ্ছু হবে না। আপনি চিন্তা করবেন না।” হৈমন্তীর মাথায় একটা হাত বোলাতে থাকে অশ্বিনী। তার চোখ দুটো আকাশ থেকে নেমে আসে বিছানার চাদরে।
একটা ঠান্ডা হাওয়া শিহরণ খেলিয়ে দেয় হৈমন্তীর শরীরময়। অশ্বিনীর দুটো গালে দুটো হাত রাখে সে। চোখে চোখ রেখে বলে, “অশ্বিনী আমি জানি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চেয়ে এই মহাবিশ্বকে অনেক বেশি করে চেন তুমি, আমি শুধু জানতে চাই আমার মৃত্যুর পর কী হবে? তোমাকে আর দেখতে পাব না আমি? আমার আত্মা…”
—“আত্মার কথা বলে গনশাকে ভয় দেখানো যায় হৈম। কিন্তু আত্মা বলে কিছু হয় না। আমাদের শরীর হল আপনার হাতের এই ঘড়িটার মতো, যন্ত্রের কারসাজিতে চলছে। আপনি ভাবতেই পারেন ওর ভিতরে এমন একটা কিছু আছে যেটা ও থেমে গেলে মুক্ত হয়ে যাবে কিন্তু…”
—“তাহলে আমার মৃত্যুর পর…”।
—“আপনার শরীর মিশে যাবে মাটিতে। শরীরের সমস্ত কণা ধুলো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে প্রকৃতিতে…”
হৈমন্তীর মাথাটা আবার নেমে আসে অশ্বিনীর বুকে। পেটের কাছে পাঞ্জাবির কিছুটা অংশ টেনে ধরে সে, “তাহলে সব কিছুর অর্থ কী? কেন যত্ন নিচ্ছ আমার? যেদিন আমার জন্ম হয়েছিল সেদিন কেন এসে উঠেছিলে এই বাড়িতে?” হৈমন্তীর পিঠে হাত রাখে অশ্বিনী, “আপনি একটু শান্ত হোন।”
জানলা বেয়ে আসা বৃষ্টির ছাটে হৈমন্তীর মুখ ভিজে গেছিল। সেটা একটা হাত দিয়ে মুছে দেয় সে। তারপর একটানা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার চোখে। হৈমন্তীও চোখ ফেরাতে পারে না। ওর মনে হয় অশ্বিনীর কালো ভরাট চোখের মণির মাঝে অচেনা আশ্রয়ের ছায়া পড়ে আছে।
হৈমন্তীর পেটের কাছে জামাটা বেশ খানিকটা উঠে আছে। কোমর আর পিঠের একটা বড় অংশ বেরিয়ে পড়েছে সেখান থেকে। তুলতুলে চামড়ার
উপরে লালচে ছোপের দাগ ফুটে রয়েছে কয়েকটা। কান্নার দমকের সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠছে তারা।
—“আমি মরতে চাই না অশ্বিনী, আমি বিসর্জনের জলে ভেসে যেতে চাই না, আমি বাঁচতে চাই, এখানে, এইভাবে, তোমার কাছে.
—“থাকবে হৈম, আমার কাছে থাকবে। কয়েক কোটি বছর আগেও ছিলে যেমন, আবার আমি ফিরে আসব, তোমার জন্য…”
কথাগুলোর মানে বুঝতে পারে না হৈমন্তী। পুনর্জন্ম বলে কিছু নেই, আত্মা বলেও কিছু নেই তাহলে কী করে ফিরে আসবে অশ্বিনী।
ফিসফিসে শব্দগুলো কানে আসে তার, “সকালে ঘুমিয়ে বিকেলে উঠে কী আর খুঁজে পান না আমাকে? বুঝতেই পারেন না এতটা সময় কোথা দিয়ে চলে গেছে। চেতনা না থাকলে সময়ের হুঁশও থাকে না হৈম। আমি আবার ফিরে আসব তোমার কাছে…”
—“কিন্তু কী করে?” হৈমন্তীর চোখের জলে অশ্বিনীর বুক ভিজে যায়।
মাথাটা আলগা করে বালিশের উপরে রেখে উঠে দাঁড়ায় অশ্বিনী, “এখন ঘুমান, আমি বিকেলে আবার আসব।”
—“সত্যি আসবে তো? ভুলে যাবে না?” অশ্বিনী হেসে মাথা নাড়ে, “ভুলব না। কিন্তু আপনি যে একটা জিনিস ভুলে গেছেন।”
—“কী?”
—“আপনি যেদিন জন্মেছিলেন সেদিন আমি এ বাড়িতে এসেছিলাম, এই কথাটা যে আপনি জানেন সেটা আমাকে বলা উচিত হয়নি আপনার। কারণ ও কথাটা বাবা ছাড়া কেউ জানে না… নিতাইকাকাও না…” হৈমন্তী উঠে বসার চেষ্টা করে। অশ্বিনী বালিশটা ঠিক করে তার মাথাটা নরম হাতে শুইয়ে দেয় তার উপরে। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে, “বিকেলে আসব আবার। এখন ঘুমান…”