দ্বাদশ অধ্যায়
“১৯০৫ সালের এক সন্ধ্যা, বুঝলে? সারাদিনের কাজকাম শেষ করে এক পেটেন্ট ক্লার্ক বাড়ি ফিরছিলেন। দেশটা সুইটজারল্যান্ড। তো ভদ্রলোক ঠিক করলেন ট্রামে চেপে বাড়ি ফিরবেন। সেই মত ট্রামে উঠে বসে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকলেন বাইরে। তো আমাদের এই পেটেন্ট ক্লার্কটি ভারী ভাবুক মানুষ ছিলেন। তবে বাঙালি তো নয়, তাই পদ্য, পার্টি-পলিটিক্স কিংবা আধ্যাত্মিক চিন্তা করতেন না। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই তিনি এই ইউনিভার্সের রহস্য নিয়ে মেতে উঠতেন। যাই হোক, সেদিন কিন্তু তার মনে কোনও ভাবনা এল না, কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছে সব কিছু। মস্তিস্ক আর আগের মতো কাজ করছে না।
মাথাটা একটু ঠাণ্ডা করতেই ভদ্রলোক ট্রামের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন।
বাইরে তাকিয়ে দেখলেন জাইতলগ একটা ক্লকটাওয়ার এর পাশ দিয়ে যাচ্ছে ট্রমটা । টওয়ারের ঠিক চুড়ার কাছে একটা মস্ত ঘড়ি। সেই ঘড়ি থেকে ক্রমশ দূরে চলে আসছে ট্রামটা।
ট্রামে বসে থাকা মানুহাগুলো ঘুণাক্ষরেও বোঝেনি ওইদিন, ওই টাম, ওই ঘড়ি আর ওই ছাপোষা ক্লার্ক মানবসভ্যতার বিজ্ঞানচর্চা কে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে দেবে।
যাই হোক , ট্রামে বসে ঘড়ির দিকে চেয়ে ভদ্রলোক ভাবলেন তিনি যে ট্রামে বসে আছেন সেটাকে যদি আলোর গতিবেগে চালানো যায় তাহলে ট্রামে বসে থাকা মানুষদের চোখে ওই ঘড়ির কাটা স্থির হয়ে থাকবে। কারণটা খুব সহজ, কাটা যে নাড়ছে সেটা আলোই আমাদের চোখ অবধি নিয়ে আসে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যদি আমরা দৌড়াই তাহলে ঘড়ির কাটার বদলটা সে আর দেখাতে পাবে না আমাদের। কিন্তু ধরো যে লোকটা ওই টাওয়ারের ঠিক নিচে মাটিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখে ঘড়ি নিজের নিয়মেই ঘুরছে।
এবার ভাবো, ঘড়িটা কিন্তু চলছে, সেটা মিথ্যে নয়। অর্থাৎ কেবল ট্রামে বসে থাকা মানুষের চোখে সময় থমকে গেছে তা কী করে হতে পারে? তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা তার আগে বলে গেছেন সময়ের চেয়ে বেশি একা কেউ নেই। সে একই বেগে, একই ছন্দে, কারো তোয়াক্কা না করে বয়ে চলেছে সামনের দিকে। ক্লার্ক সাহেব পড়লেন আতান্তরে, শ্যাম রাখি না কুল রাখি ?
তবে কী সত্যি তোয়াক্কা করে সে ব্যাপারটা আরও ভালো করে বুঝতে গিয়ে আরও বেশি ধন্দে পড়লেন তিনি।
আরো একটা বিরাট ফাকা মাঠের একেবারে মধ্যেখানে তুমি দাঁড়িয়ে আছে। মাঠের দুদিক থেকে তোমার দিকে লক্ষ্য করে দুটো তীর ছোঁড়া হল। নিয়ম হল দুটো তীর যদি একসঙ্গে গায়ে লাগে তাহলেই তুমি মরবে। একটা লাগলে
কোনো ক্ষতি হবে না।যেহেতু তির দুটো একই গতিবেগে একই দূরত্ব থেকে ছোঁড়া হচ্ছে ,তাই দুটো তীরের একই সঙ্গে তোমার গায়ে লাগার কথা…
এবার ধরো এই গোটা ঘটনাটা দেখতে দেখতে আমি মাঠের উপর দিয়ে আলোর গতিবেগে পার হয়ে যাচ্ছি। ভাবলেই বুঝতে পারবে আমার চোখে কিন্তু দুটো তীর একসঙ্গে তোমার গায়ে বিঁধবে না। ফলে তোমার মৃত্যু হবে না। অথচ বাস্তবে কিন্তু তোমার মৃত্যু হয়েছে।
মানে একটা মানুষ একই সঙ্গে কারোর চোখে জীবিত কারোর চোখে মৃত এবং দুটোর কোনোটাই মিথ্যা নয়।
প্রকৃতি এ জিনিস হতে দেয় না। হতে না দেওয়ার জন্যে নিজের কোনও একটা অখণ্ডনীয় নিয়ম ভাঙতে হয় তাকে। কোনও একটা শিকলকে আলগা করতে হয়। এক্ষেত্রে যে শিকল আলগা হয় তার নাম সময়। প্রকৃতির এই গ্লিচকে মেরামত করতে সময় নিজেকে মস্থর করে নেয়।
আমাদের সেই পেটেন্ট ক্লার্ক সময়ে এই মন্থর হয়ে যাওয়াকে একটা নাম দেন টাইম ডায়ালেশান। অঙ্ক কষে তার একটা যমুলাও আবিষ্কার করেন তিনি।
image page no : 123 (mathematics)
সোজা কথা হল তুমি যত দ্রুতগামী হবে, সময় তোমার জন্য তত বেশি মন্থর হবে। যদি পৃথিবীর বাইরে বেরিয়ে মহাবিশ্বের বুকে তুমি আলোর কাছাকাছি গতিবেগে চলতে থাকে তবে তোমার হাতে বাঁধা ঘড়িতে সময় মিলিয়ে চারবছর পর ফিরে এসে দেখবে পৃথিবীতে আট বছর কেটে গেছে। এবার ধরো যদি কোন ব্লাকহোলের মধ্যে ফ্রি কল করো.” – “আমার মা খুব বকবে, ম্যাম…
—“আঁ! ব্ল্যাক হোলের মধ্যে তোমার মা আবার কোথা থেকে আসবে?”
—“হোল-টোল নয় ম্যাম, সাড়ে নটা বেজে গেছে। এত লেট করে বাড়ি ফিরলে মা আলোর গতিবেগে জুতা ছুঁড়ে মারবে…”
নাকের ডগা থেকে চশমাটা চোখের সামনে টেনে আনলেন পূজারিণী পালিত, “ওঃ! সময়টারই খেয়াল থাকে না আজকাল। বেশ, তুমি বেরিয়ে পরো, বাকিদের তাড়া নেই তো?”
তাড়া থাকলেও বলতে পারে না বাকিরা। জনাচারেকের ছোট দলের অন্তত দুটো মুখ এতক্ষণে ঝিমিয়ে পড়েছে। তাও কোনওরকমে মেকি আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করছে তারা।
মেয়েটি চলে যেতে ছোট দশফুট বাই দশফুট ঘরের মধ্যে মোট পাঁচটি মানুষ পড়ে রইল। সন্ধ্যেয় স্কুল থেকে ফিরে প্রাইভেট টিউশন পড়াতে বসেছিলেন পূজারিণী পালিত। কিন্তু বইয়ের পড়ায় একদম মন বসছে না আজ। গল্পের ছলে কিছু শেখানোর চেষ্টা করছিলেন। এই মেয়েগুলো অন্যদের থেকে একটু ব্রাইট। নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের দুরহ। কিছু শেখানো যায় কিনা। এখন তিনি অবশিষ্ট চার মুখ সরেজমিন করলেন। নাঃ, মহাবিশ্বের অনন্ত রহস্যের মতো সত্য উদ্ধার করতে পারলেন না।
—“পেটেন্ট ক্লার্কটির নাম অ্যালবার্ট আইন্সটাইন, এবং তার যে থিওরির মাত্র চূড়াটুকুর ধারণা তোমরা পেলে তার পোশাকি নাম —থিওরি অফ রিলেটিভিটি। কারও কোনও প্রশ্ন আছে?”
চারটে মুখেই কোনও প্রশ্ন ফুটল না। পূজারিণী একটু হতাশ হলেন, এমন একটা কিছু এদের হাতে তুলে দিতে হবে যাতে এরা প্রশ্ন করে, প্রশ্ন না করলে শিখবে না। বিজ্ঞানের প্রথম ধাপ হল অবিশ্বাস আর সন্দেহ।
—“যাই হোক, টাইম ডায়ালেশান থেকে খুব সহজে একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়। মহাবিশ্বে আলোর থেকে বেশি গতিশীল আর কিছু হতে পারে না। কারণ সেক্ষেত্রে সময় মন্থর হওয়ার গন্ডি টপকে ঋণাত্মক হয়ে যাবে। তাহলে কী হবে বুঝতেই পারছ।”
_ “টাইম ট্রাভেল!” একেবারে বাঁদিকের একটা মেয়ে বলল।
—“এক্সাক্টলি, ফলে প্রোফেসর আইনস্টাইন টাইম ডায়ালেশানকেও নিয়মে বেঁধে দিলেন। শূন্যর থেকে কম সে হতে পারে না!”
—“কিন্তু আপনি এক্ষুনি বললেন প্রকৃতি তার অসংগতি মেরামত করতে নিজের নিয়মকে আলগা করে ফেলতে পারে…”
—“পারে। কিন্তু এ নিয়ম আলগা হওয়ার মতো নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাতে দ্বিতীয়বার ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। টাইম ট্রাভেল কেবলমাত্র সাইন্স ফিকশনেই সম্ভব। কিন্তু…”
পরের কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যান পূজারিণী পালিত। ঘড়ির দিকে নজর পড়ে তার। সত্যি অনেক রাত হয়ে গেছে। এতগুলো মেয়ে এই অন্ধকারে বাড়ি ফিরবে। হাতের সামনে খোলা খাতাটা বন্ধ করে তিনি হাসলেন, “আজ আর ভেবে কাজ নেই আমাদের। আপাতত সাবধানে বাড়ি ফেরো সবাই। কাল স্কুলে দেখা হবে।”
চারজনেই উঠে পড়ে। পূজারিণী চশমাটা খুলতে খুলতে হৈমন্তীর দিকে চেয়ে বলেন, “তুমি একটু বসে যাও হৈম। এই কদিন তো ক্লাসে আসনি, নোটশগুলো লিখে নিয়ে যেও। হরেন বাড়ি দিয়ে আসবে তোমাকে।” হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। বাকিরা চলে যেতে পূজারিণী হাত ধরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। এ ঘরে এলেই ন্যাপথালিন আর পুরানো বইয়ের গন্ধ নাকে আসে।
—“তুমি গল্পের বই পড়ো?” পূজারিণী জিজ্ঞেস করে।
—“হ্যাঁ।”
—“এ ঘরে অনেক গল্পের বই পাবে। বাংলা, ইংরাজি সব। যেটা খুশি নিয়ে যেতে পারো, কেমন?”
হৈমন্তীর মুখে ঝিলিক খেলে যায়। লোভটা যাতে ম্যামের চোখের না পড়ে তাই মুখ নামিয়ে নেয় সে।
—“স্নিগ্ধার সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। তোমার রোগটার ব্যাপারেও আমি জানি।” হৈমন্তীর কাঁধে হাত রাখেন পূজারিণী।
—“আইনস্টাইনের তত্ত্ব ঠিক হলে টাইম ট্রাভেল অসম্ভব, এটা সত্যি কিন্তু আইন্সটাইনের ছেলেবেলার স্কুলমাস্টারদের চোখে আইন্সটাইনের বিজ্ঞান হওয়াটা তার থেকেও বড় অসম্ভব ছিল। বুঝলে?”
হৈমন্তী মাথা নেড়ে দিল, মুখে কিছু বলল না। পূজারিণী আর একটু এগিয়ে এসে বললেন, “তাছাড়া আরও একটা কথা তোমার জানা দরকার, আমাদের এই মহাবিশ্বে এমন একটা জায়গা আছে যার কথা মানুষের পক্ষে কোনওদিন জানা সম্ভব নয়। সেখানে কী আছে আর কী নেই তা কেউ জানে না। আলোর থেকে বেশি গতিশীল কিছু যদি সেখানে থাকে তাহলে আমি তো মোটে আশ্চর্য হব না।”
—“সেটা কোথায় ম্যাম?”
বইয়ের তাকের দিকে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেলেন পূজারিণী পালিত তারপর একটা কোণা থেকে প্রায় আধমানুষ সমান একটা রোল করা ছবি মেলে মেলে ধরলেন হৈমন্তীর সামনে।
—“এই গ্লাসটা ভালো করে দেখো। এই হচ্ছে আমাদের নন ইউনিভার্সের টাইমলাইন। ওই বাঁদিকের প্রান্তে যেখানে আলো জ্বলছে সেটা
বিগ ব্যাং। তার আগে স্পেস, টাইম কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। এই বিগ বাং-এর কিছু পর থেকে প্রথম তারা জন্মানোর সময় অবধি চারশো মিলিয়ন বছর সময়কে বলা হয় ডার্ক এজ – মহাবিশ্বের অন্ধকার যুগ। অন্ধকার যুগ নাম হওয়ার দুটো কারণ আছে।
এক, এ-সময় গোটা মহাবিশ্বের কোথাও কোনো আলো ছিল না। আর দুই..”
থেমে একবার মেয়েটার চোখের দিকে তাকান পূজারিণী পালিত, “এই সময়ে মহাবিশ্ব জুড়ে ঠিক কী ছিল তা আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, কারণ মহাবিশ্বের সীমানা রোজ বর্ধিত হচ্ছে, দ্রুত গতিতে। ফলে ডার্ক এজ আমাদের থেকে এতটাই দূরে চলে যাচ্ছে যে সে আলো আর কোনোদিনই আমাদের চোখে এসে পৌছাবে না। তাই এই চারশো মিলিয়ন বছরে ঠিক কী ছিল তা আমরা জানি না, যদি এমন কিছু থাকে যা আলোর থেকে বেশি দ্রুতগামী তাহলে টাইম ট্রাভেল ছাড়াও আরও অনেক নিয়ম ভাঙতে বাধ্য।”
কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে হৈমন্তী। ছবিতে অন্ধকার দিয়ে চিহ্নিত করা ডার্ক এজের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর আমতা আমতা করে বলে, “ওখানে কী ছিল ম্যাম?”
—“ওই যে বললাম, কেউ জানে না কী ছিল ওখানে, হয়তো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, কিংবা হয়তো সেই অসীম অন্ধকারের বুকে কোথাও প্রাণের স্পন্দন ছিল। যাই থাক না কেন, আমরা আর জানতে পারব না।”
হরেনের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে হৈমন্তীর চোখ ঘুরে বেড়াতে থাকে অন্ধকার আকাশের কোণায় কোণায়। স্পেস-টাইমের বেড়া পেরিয়ে উড়ে যেতে চায় সে। তেরো বিলিয়ন বছরের প্রতিটা মুহূর্তকে সে মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রতিটা মুহূর্তকে হাতের তালুতে তুলে এনে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে তার।
* * * *
—“আঃ, দেখে চলো দিদিমণি। হোঁচট খাবে যে…” হরেন বিরক্ত হয়ে
ওঠে।
বাড়ি পৌঁছে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই একটা কষিয়ে চড় পড়ে হৈমন্তীর গালে। এত জোরে মাথাটা ঘুরে যায় যে ঘাড়ের কাছ থেকে খচ করে শব্দ আসে একটা। গাল গরম হয়ে ওঠে হৈমন্তীর।
—“কার বিছানায় পড়ে ছিলি হারামজাদি?” বীণাপাণিদেবী রগরগে গলায় চিৎকার করে ওঠেন।।
—“ম্যাম আজকে একটু বেশি…”।
আবার একটা চড় খেয়ে হৈমন্তীর মাথা ঘুরে যায়, “চুপ কর মাগি। তোর কোনও কথা আমি বিশ্বাস করি না।” চুলের মুটি ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেন। বীণাপাণি, “চরিত্রহীন লম্পট একটা। ছিঃ ছিঃ ছিঃ..”
রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বিড়বিড় করেন তিনি, “আত্মীয়-স্বজনরা। একবার জানতে পারলে আর আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না আমাদের। মেয়ের সবে যোলো এরই মধ্যে শরীর নোংরা করে এসেছে… সোনাগাছির বেশ্যাদেরও এই রোগ হয় না…” হৈমন্তী নিজের ঘরে ঢুকে আসে। গায়ে লেপ্টে যাওয়া স্কুলড্রেসটা খুলে এসে দাঁড়ায় আয়নার সামনে। নাঃ এখনও কোনও দাগ দেখা যায়নি শরীরে, আজও দেখা যায়নি…
স্নিগ্ধা ম্যামের দেওয়া হাত ঘড়িটা টিকটিক করে এগিয়ে চলেছে। পাশের ঘর থেকে হৈমন্তীর বোন সীমন্তিনীর পড়ার আওয়াজ আসছে। সেটা ছাপিয়ে বীণাপাণির গড়গড়ানি কানে আসে, “লোক জানাজানি হলে ছোট মেয়েটার বিয়ে হবে না। এর থেকে ভালো ক্যান্সার বাঁধিয়ে আসতিস, নাহয় সব্বশান্ত হতাম, সমাজে মুখ তো দেখাতে পারতাম… ছিঃ এমন মাগি পেটে ধরেছি…”
সীমন্তিনীর পড়ার শব্দ থেমে যায়। কয়েক সেকেন্ড পরে সে হৈমন্তীর ঘরের দরজা খুলে ঢুকে আসে। বিছানার উপর বসে পা থেকে মোজা খুলছিল হৈমন্তী। তার ঠিক পাশটায় বসে পড়ে।
= “এসব তো কম ছিল কিছুদিন, আজ আবার শুরু করল কেন?” মোজা খুলে ছুঁড়ে ফেলে হৈমন্তী।
—“বাবা আজ সুইসাইড করতে গেছিল। আমার ঘরে পাখার ব্লেডে গামছা বেঁধে ঝুলছিল, টুলটা লাথি মেরে ফেলার আগেই আমি..” সীমন্তিনী থমথমে গলায় বলে।।
—“মানে। কেন? সেসব তো…”।
—“কাল একটা পার্টি ছিল অফিসে, প্রচুর মদ খেয়েছিল। মদের নেশায় তিন বন্ধুকে তোর ব্যাপারে ভুল করে বলে ফেলছে। তারা এখন থ্রেট করছে সবাইকে জানিয়ে দেবে।” নিজের ঠোট কামরায় হৈমন্তী, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, “কতদিন আর লুকিয়ে রাখবে?”
—“তুই বুঝতে পারছিস না দিদি। রোগটা কীভাবে হয়েছে কেউ জানতে চাইবে না, কীভাবে সংক্রামিত হয় জানতে চাইবে না। আমাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখবে, আমাদের এড়িয়ে চলবে…” ব্যাগের ভিতর থেকে সিগারেট টেনে বের করে হৈমন্তী, কিন্তু ধরায় না, বলে, “তুই আমায় ঘৃণা করিস, সোমু?”
এগিয়ে এসে হৈমন্তীর হাতের উপরে মাথা রাখে সীমন্তিনী, “আমার খুব ভয় করে রে দিদি…”
—“কীসের ভয়?”
—“আমি জানি বাবার মতো একদিন তুইও আর সহ্য করতে পারবি না এতকিছু। আমি তো চিরকাল তোদের কাউকে ধরে বেঁধে রাখতে পারব না, কখনও একা হবি। আমি বাড়ি ফিরে শুনব তোদের মধ্যে একজন চলে গেছিস।”
বোনকে কোলের কাছে টেনে নেয় হৈমন্তী, “তোর দিদি অত নরম নয় রে, আমি নিজে থেকে কোথাও যাব না। যাই হয়ে যাক…”
বাইরে থেকে বীণাপাণির চিৎকার শোনা যায়, “তুই আবার ওই লম্পট মাগিটার কাছে গেছিস! নিজেকে শেষ করেছে, তোকেও নষ্ট করে ছাড়বে, বেরিয়ে আয়।”
সীমন্তিনীকে সোজা করে বসিয়ে দেয় হৈমন্তী। তারপর সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলে, “আমি একটু ছাদে যাই। খোলা হাওয়া দরকার। তুই নিজের ঘরে যা এখন।”
কথা না বাড়িয়ে চলে যায় সীমন্তিনী। হৈমন্তী সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে ছাদে চলে আসে।
ভারী মিষ্টি একটা এলোমেলো হাওয়া দিচ্ছে ছাদে। হৈমন্তীদের বাড়ির চতুর্দিক বেশ নির্জন। অন্ধকারের বুক চিরে ছুটে যাওয়া রাস্তার মধ্যে মধ্যে। হলদে সোডিয়ামের আলো জ্বলছে।
দূরে কোথাও থেকে ঢাক বাজার আওয়াজ আসছে কি? পুজো চলে এল মনে হয়। সারা কলকাতা শহর ঢেকে যাচ্ছে আলো, জমকালো কোল্ড ড্রিঙ্কের ব্যানার আর বাঁশের খুঁটি দিয়ে আলাদা করা ফুটপাথে। গড়িয়া, বউবাজার, বড়বাজার আর হাতিবাগানে লোকেদের কেনাকাটা চলছে জোরকদমে। পুজোর আগে আগে এই সময়টায় অকারণেই মন খারাপ হয়ে যায় হৈমন্তীর। মনে হয় কী যেন একটা কাজ ওর করার আছে অথচ দেরি হয়ে যাচ্ছে খুব, করা হয়ে উঠছে না।
সিগারেট ধরিয়ে ছাদের একদিকের পাঁচিলের কাছাকাছি সরে আসে হৈমন্তী। ওদের বাড়িটা তিনতলা। নিচে দুটো তলায় ভাড়াটে থাকে।
নেড়া ছাদের একেবারে ধার ঘেঁষে দাঁড়ায় ও। ঢাক বাজছে, হ্যাঁ, সত্যি ঢাক বাজছে, যে কোনও বড় কাজের আগে ঢাক বাজে, যে কোনও শুভ কাজের আগে, জমকালো কোনও কাজ, যুদ্ধ, অসুরনিধন, মৃত্যু…
হৈমন্তী চাইলেই ঢাকের আওয়াজটা থামিয়ে দিতে পারে, মন খারাপ থামিয়ে দিতে পারে এক নিমেষে। চারতলা থেকে নিচে পড়লে…
ছাদের বাইরে একটা পা বাড়িয়ে দেয় সে। গোটা শরীরটা দুলে ওঠে ওর। আর একটু বাড়িয়ে দিতে হবে পাটা.. তাহলেই সমস্ত শরীর ওর
বাধ্য হয়ে উঠবে।
—“হৈম…” পেছন থেকে কি ডেকে উঠল কেউ? না কি হাওয়ার শব্দ? হৈমন্তী পেছনে ফেরে- কেউ নেই।
ফাঁকা ছাদে আগের মতোই মৃদু শরতের হাওয়া বইছে।
ছাদের ধারেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে হৈমন্তী। দু’চোখ জলে ঢেকে যায়। তার। আকাশের দিকে তাকাতে মনে হয় তেরো বিলিয়ন বছর পরে আবার একটা অন্ধকার যুগ নেমে আসছে সেখানে। তবে স্থির, নিশ্চল নয়, কেউ জেগে আছে তার মাঝে… চেয়ে আছে হৈমন্তীর দিকে…