ভাসানবাড়ি – ১১

একাদশ অধ্যায়

পিছনে পায়ের শব্দ শুনে গাছে জল দেওয়ার বালতিটা নামিয়ে রেখে একবার পিছনে ফেরে অশ্বিনী। একগাল হাসে, সকালের রোদের রেখা মুখ ধুয়ে দেয় তার।

—“আমি হেল্প করতে পারি?” হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে।

—“আপনার শরীর ঠিক আছে?”

—“এবার এই আপনি বলাটুকু ছেড়ে দাও না হয়…”

—“অভ্যেস হয়ে গেছে…” অশ্বিনী কাঁচি দিয়ে গাছের শুকনো পাতা ছাঁটতে ছাঁটতে বলে, “অভ্যেসের কথায় মনে পড়ল! আপনি আজ পঞ্চাশ মিনিট কম ঘুমিয়েছেন।”

—“মানে?”

অশ্বিনী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “অন্য দিন আপনি বারোটা নাগাদ ঘুমিয়ে, সাড়ে আটটায় ওঠেন। সাড়ে আটঘণ্টা। কাল তিনটেয় ঘুমিয়েছিলেন, মানে সাড়ে এগারোটায় ওঠার কথা… লোকটাকেও তাই বারোটায় আসতে বলেছিলাম…”

—“লোক! কোন লোক?” হৈমন্তী চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়াতে জড়াতে জিজ্ঞেস করে।

—“একজন লোক দেখা করতে এসেছিলেন আপনার সঙ্গে। কোমরে একটা পিস্তল ছিল, তাছাড়া কথাবার্তায় মনে হল আপনার উপরে রেগে আছেন খানিকটা।”

একটু ইতস্তত করে হৈমন্তী বলে, “আমার অফিসের কেউ হবে। ফোনটা খোয়া গেছে বলে যোগাযোগ করতে পারেনি। তাই হয়তো খুঁজতে চলে এসেছে।”

—“অস্ত্র নিয়ে?” হৈমন্তী একটু অস্বস্তিতে পড়ে।

জোর করে হেসে বলে, “তোমার রহস্যটা কী বলতো?”

অশ্বিনী গাছের গোড়ায় জল ছিটাতে ছিটাতে হাসে, “কী রহস্য?”

—“মানে আমি আজ অবধি যত সুপারহিরো দেখেছি তাদের সবাই প্রায় একইরকম জামাকাপড় পরে থাকে সবসময়। তুমিও সারাক্ষণ এই শাল আর সাদা পাঞ্জাবী, মানে তুমি সাধারণ মানুষ নও, তাহলে বলতো তোমার সুপার পাওয়ারটা ঠিক কী?”

—“সুপার পাওয়ার…” অশ্বিনী মন দিয়ে ভাবে, তারপর হঠাৎ আগের মতোই নিঃস্পৃহ মুখে বলে“অভ্যাস। আমার অভ্যাস সহজে ছাড়তে পারি না।”

—“বেশ, আমি আসছি দাঁড়াও।” কথাটা বলেই ভিতরের সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায় হৈমন্তী।

অশ্বিনী একবার পিছন ফিরে দেখে। তারপর আবার নিজের কাজে মনে দেয়।

খানিক পরে ফিরে আসে হৈমন্তী। হাতে ছোট প্লাস্টিকের পাতে অশ্বিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “নাও, এটা পরে দেখো

—“কী এটা?”

—“পাঞ্জাবিই, তবে নতুন। অস্মিতা বলেছিল নিবারণবাবু টাকা নিতে চাইবেন না। তাই বুদ্ধি করে ওনার জন্য কিনেছিলাম কলকাতা থেকে, উনি তো নেই, তুমিই পরো না হয়।”

—“আমি… মানে…” অশ্বিনী কী বলবে ভেবে পায় না। এর আ এভাবে জামাকাপড় উপহার দেয়নি তাকে।

হৈমন্তী নিজেই প্যাকেট খুলে পাঞ্জাবিটা ওর হাতে তুলে দিয়ে বলে, “তবে এটা সাদা নয়, ক্রিমসন , তুমি তো আর রাজনীতিতে নাম লেখাওনি বাপু যে সাদা ছাড়া পরবে না… এখনও থতমত হয়ে তাকিয়ে আছে টুকটুকে লাল রঙের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো গোল-গোল হয়ে গেছে তার।

—“আর এইসব শাল-টাল আদ্যিকালের লোকেরা পরত,তাও এখন আবার বর্ষাকাল, এসব পরার দরকার নেই।”

—“আচ্ছা, আমি রেখে দিচ্ছি।”

—“আরে রেখে দিচ্ছি মানেটা কী?” হৈমন্তী ভুরু কুঁচকায়, “পরে দেখো ঠিক ফিট হয়েছে কিনা…”

অশ্বিনীর মুখের পেশিতে অজ্ঞাত কোনও অনুভূতি খেলে যায়। সে কাঁধের শালে ভেজা হাতটা মুছে ভিতরে চলে যায়। হৈমন্তী বাগানের বাকি ফুলগুলোর দিকে তাকায়। নানা রঙের ফুল, কোনটা টবে ফুটেছে তো কোনটা ছোট কঞ্চির মাচার উপরে শুয়ে আছে। সদ্য বৃষ্টির জলে ভেজা বলে সব ফুলগুলোকেই বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

একদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে সে। সকালে যে লোকটা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তাকে সম্ভবত চেনে হৈমন্তী। এই কদিনে ওদের কোনও খবরই জানাতে পারেনি সে। তাই হয়তো পথ খুঁজে চলে এসেছে। দুশ্চিন্তায় ওর মনটা ভার হয়ে ওঠে।

বাড়ির দিক থেকে পায়ের শব্দে পেছন ফেরে হৈমন্তী। বাগানে নামার সিঁড়ির ঠিক উপরে ওর চোখ আটকে যায়। মুগ্ধ হয়ে একটানা সেদিকে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পাঞ্জাবিটা খানিক ছোট হয়েছে অশ্বিনীর গায়ে। হাতার কাছটা গোটাতে পারেনি ঠিক মতো। কলারটা ভিতর দিকে ঢুকে রয়েছে। তাও চোখ ফেরাতে পারল না হৈমন্তী। স্কুলফেরত ঘনায়মান সূর্যাস্ত দেখা কিশোরীর মতো একটানা তাকিয়ে রইল সে।

—“কেমন একটা লাগছে…”অশ্বিনী সামনে এসে দাঁড়িয়ে হাতাটা টানাটানি করে ঠিক করতে লাগল।

—“কই দেখি, এসো এদিকে…” অশ্বিনীকে কাছে টেনে তার কলারটা বাইরে বের করে দিল হৈমন্তী। তারপর হাতাটা কনুই অবধি গুটিয়ে দিল। বুকের কাছে কুঁচকে যাওয়া ভাঁজগুলোর উপর হাত চালিয়ে কিছুটা পেছনে সরে এসে আগের মতোই স্থির নয়নে তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে। কানের পেছনটা অজান্তেই লাল হয়ে উঠল তার।

—“কী?” অশ্বিনী তার চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।

—“না, কিছু না।” লাজুক হেসে মাথা নামিয়ে নিল হৈমন্তী।

—“এবার পালটে আসি।”

—“উহু। একটু পরে। এখন বুঝতে পারছি কেন আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকো তুমি…”

—“আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি নিজেকে দেখি না।”

—“তাহলে?” অশ্বিনী প্রসঙ্গটা পালটে ফেলে, “মাঝে মাঝে আপনাকেও ভারী সুন্দর দেখায়…”

—“কখন বলতো?”

পরের কথাগুলো একটু ভেবে চিনতে বলে অশ্বিনী, “একটা কালো রঙ এর শাড়ি আছে না আপনার? ধারটা লাল রঙের।”

হৈমন্তীর পা থমকে যায়। পাশ ফিরে অশ্বিনীর দিকে ঘুরে দাঁড়ায় সে, ‘ওটার কথা তুমি জানলে কী করে?”

—“ধরে নিন আমার আর একটা সুপারপাওয়ার…”

হৈমন্তী আবার সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলে, “মা পুজোয় কিনে দিয়েছিল ওটা, এখন আর পরতে পারি না।”

—“কেন?”

—“আমার পেটের কাছে অনেকগুলো লালচে ব্রুজ আছে। শাড়ি পরলে ওগুলো দেখা যায়।”

—“সেই জন্যেই শাড়িটা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন, তাই না?”

এবার আর ফিরে তাকায় না হৈমন্তী। গলা নেমে আসে তার, অস্ফুট শব্দে বলে, “তোমার এই সুপার পাওয়ারটা ভালো লাগছে না আমার। আমার সম্পর্কে কেউ এত কিছু জানুক আমি চাই না।”

—“এর থেকে আরও বেশি কিছু জানি আমি..”

—“তাই নাকি? কই শুনি…”

—“আমি জানি আপনি প্রথম কবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। আপনার নিজের মা আপনার শরীরে আঙুল ঢুকিয়ে কীভাবে আপনার সতীত্ব পরীক্ষা করেছিলেন, বা ধরুন সামাজিক কলঙ্কের দায় এড়াতে আপনার বাড়ির লোক কবে আপনাকে একটু বেশি পরিমাণে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল..”

আচমকাই একটা বিদ্যুৎ খেলে যায় হৈমন্তীর দেহে। অশ্বিনীর বুকে, দুটো হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দেয় সে, গায়ে পা পড়া সাপের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। অশ্বিনীর আলগা শরীরটা দেওয়ালে চেপে ধরে, “হাও ডেয়ার ইউ, লজ্জা করে না একটা মানুষের দুর্বল জায়গার সুযোগ নিয়ে তাকে এক্সপ্লয়েট করতে?”

অশ্বিনী নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে না, “আমি আপনাকে এক্সপ্লয়েট করিনি। আপনার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম। আমি তো একবারও বলিনি কালো শাড়ি পরে ভালো লাগে আপনাকে। বলছিলাম এই সবকিছুর সঙ্গে লড়াই করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েও যখন হেরে যান না, যখন আরও কদিন বেঁচে থাকবেন বলে ঠিক করেন তখন ভারী সুন্দর দেখায় আপনাকে। ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু লড়ে যাওয়া মানুষের থেকে বেশি সুন্দর কিছু আছে? বলুন?”

হৈমন্তীর হাত দুটো কিন্তু আলগা হয় না, সে আরও জোরে ধাক্কা দিতে থাকে অশ্বিনীর কাঁধে, “কে তুমি? কীভাবে জানলে এত কিছু আমার ব্যপারে? বলো কে তুমি?” পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে হৈমন্তী।

—“আমি অশ্বিনী, নিবারণবাবু আমার…”

—“রাবিশ, অন্তত দেড়শো বছর ধরে বয়স পালটায়নি তোমার! কাল রাতে তুমি আমার পাশে ছিলে না তাও তোমার গলার স্বর শুনতে পেয়েছি। কেন তুমি ঘুমাও না কখনও? কেন তাকিয়ে থাকো আয়নার দিকে? কেন তোমার শরীরে কোনও বিপদের প্রভাব পড়ে না?”

—“কেন একজন মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ অন্য কয়েকটা মানুষকে বাঁচাতে নিজের শরীর কেটে রক্ত ঝরায় জিজ্ঞেস করলেন না তো..”

—“কারণ আমি মানুষ, আমার চেতনা আছে, প্রাণ আছে, মৃত্যু আছে, দুঃখ-কষ্ট আছে, আর তুমি কী ?”

চোখ তোলে অশ্বিনী, “আমারও চেতনা আছে, প্রাণ আছে। আমি রান্নার ফাঁকে অবসর পেলে আপনার কথা ভাবি, রাতে আপনার ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করি আপনি কাশছেন কিনা, আপনার জন্য অসময়ে জল গরম করতে ভালো লাগে, আপনি ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরলে আপনার চাদর পালটে দিয়ে আসতে ভালো লাগে…” আচমকাই অশ্বিনীর বুকের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হৈমন্তী। তার রোদলাগা খয়েরি চোখের পাতা আবার ভিজে যায়, শরীরটা কেঁপে উঠতে থাকে বারবার।

—“আর আমার এইডস কী করে হয়েছিল সেটাও জানো নিশ্চয়ই?”________________

—“না জানি না। দেখিনি।”

—“কেন? সবাই তো জানতে চায়…”

—“আমার কিছু যায় আসে না। আপনি আমার দেখা সব থেকে সুন্দর মানুষ। যতটা দেখেছি, যতটা দেখিনি, সবটা মিলে।”

—“কে তুমি? কেন এভাবে ভালোবাসছ আমাকে? যে জিনিসটা না চাইতেই পেয়েছি, পাব বলে কল্পনাও করিনি কোনওদিন সেটা কেন পেলাম জানতে ইচ্ছা করে না? তুমিই বলো…”

হৈমন্তীর মাথার উপরে একটা হাত রাখে অশ্বিনী, “বলব একদিন শুধু আপনাকেই বলব। কিন্তু আজ নয়… আজ…”

—“আজ কী?”

—“আজ একজন দেখা করতে আসছে আপনার সঙ্গে…” বুক থেকে মুখ তুলে বাগানের গেটের দিকে তাকায় হৈমন্তী, একটা বছর পয়তাল্লিশের লোক দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে আসছে। লোকটার মাথা জোড়া টাক। গায়ে একটা কালো রঙের শার্ট, চোখে সানগ্লাস। মুখ তুলে একবার হৈমন্তীকে দেখে একটা হাসি ফোটে তার মুখে। হাতটা উপরে তুলে এগিয়ে আসে ওদের দিকে।

—“তুমি ভিতরে যাও এখন।” হৈমন্তী বলে।

—“আপনারা দুজনে ভিতরে যান না হয়। বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। আমি বসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।” অশ্বিনী ভিতরে ঢুকে যায়। লোকটা হৈমন্তীর দিকে এগিয়ে আসে। হাত তুলে নমস্কার করে নরম সুরে বলে, “সকালে একবার এসেছিলাম। এই কেয়ারটেকার ছেলেটি বলল আপনি ঘুমাচ্ছেন। ভালো কথা, আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চই?”

হৈমন্তীর মুখ শক্ত হয়ে গেছে। উপরে নিচে মাথা নাড়ে সে, “হ্যাঁ। আমার ফোনটা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে… তাই..”

—“আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি?”

আবার মাথা নাড়ায় হৈমন্তী। লোকটা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, ভিতর থেকে অশ্বিনীর গলা শোনা যায়, “আপনারা ভিতরে এসে কথা বলুন না হয়… চেয়ার রেখে এসেছি…”

—“আসুন।” হাত দেখিয়ে লোকটাকে ভিতরের রাস্তা দেখায় হৈমন্তী। দু’জনে বাড়ির ভিতরে ঢুকে আসে। উঠোনটা পেরিয়ে একতলার একটা বন্ধ ঘর খুলে সেখানেই দুটো মুখোমুখি চেয়ার রেখেছে অশ্বিনী।

তার একটার উপরে বসতে বসতে হৈমন্তী বলে, “এতদূর পেরিয়ে এসেছেন মানে সিরিয়াস কিছু ব্যাপার..”

সানগ্লাস খুলে গলার কাছে ঝুলিয়ে রাখে লোকটা, তারপর পা জড় করে বসে বলে, “সিরিয়াস বৈ কী! কদিনে কিছু ইম্পরট্যান্ট ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। আপনার ফোনটা…”

—“দোতলার জানলা থেকে পড়ে ভেঙে গেছে।”

—“ওকে, বাট একটা ই-মেল অন্তত…”

—“ফোনটা দিয়েই আমার ল্যাপটপে নেট কানেকশন আসত।” কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে লোকটা, চারপাশটা দেখে নেয় একবার, “জিনিসটার কোনও সন্ধান পেয়েছেন?”

—“এক্সাক্টলি সন্ধান নয়, তবে একটা সূত্র পেয়েছি।”

—“কীরকম সূত্র?”

—“সেটা আপনাদের বলতে হবে এমন কোনও ডিল হয়নি আমাদের। এটুকু এসিওর করতে পারি জিনিসটা এ বাড়ি বা বাড়ির আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রাখা আছে।”

খশখশে শব্দ করে হাসে লোকটা, “ওয়েল, দেন আপনার মিশন ইজ অলমোস্ট ওভার।”

—“মানে! কী বলতে চাইছেন?” কপালের মাঝেখানে আঙুল দিয়ে টোকা দেয় লোকটা, তারপর চাপা গলায় বলে, “মানে জিনিসটা ঠিক কোথায় আছে সেটার সন্ধান দেওয়াটাই ছিল

আপনার কাজ… বাট দেন আপনার থেকে এতদিন কোনও কমিউনিকেশান পাওয়াটা আমাদের কিছু ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য করে…”

—“বেশ! তো কী ভাবলেন?”

—“উই হ্যাঁভ রিয়ালাইজড যে আপনার এই কাজটাতে আর সেরকম ইন্টারেস্ট নেই। বেটার হবে আপনি যতটুকু জানতে পেরেছেন সেটা আমাদের জানিয়ে কলকাতায় ফিরে যান। বাকি কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবো। আমরা।”

—“বটে!” হৈমন্তী গালে একটা হাত রাখে।

—“ইয়েস, দেখুন আপনার শরীরের কন্ডিশন ভালো নয়। ইনফরমেশানের ব্যাপারে আপনার হেল্প নিয়েছি আমরা। কিন্তু এর পরের কাজ মেইনলি ফিজিকাল। মাটি খোঁড়া, পুরানো দেওয়াল, ইট, চুন, সুরকি ভাঙাভাঙি এসব করার মতো ফিজিকাল এবিলিটি…”

—“আমার নেই, তাই তো?”

লোকটা ঠোঁট উলটায়, “সেটা তো আমার থেকে আপনি ভালো জানেন।”

হৈমন্তী কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “আমাকে এখান থেকে সরাবেন ভালো কথা কিন্তু এ বাড়ির কেয়ারটেকার ছেলেটি আমাকে যেতে দিতে চাইছে না। ও কিন্তু রেগে যাবে। আমার বদলে নতুন যিনি আসবেন তাকে যে ও ভালোভাবে নেবে সেটা ভেবে নিচ্ছেন কেন?”

প্রথমে একটু অবাক হয় লোকটা, তারপর খ্যাকখ্যাক করে হেসে ওঠে, “কেয়ারটেকার। উই হ্যাঁভ বট দ্য হাউজ। ওয়াট ইজ দ্য ইউজ অফ আ কেয়ারটেকার নাউ?”

—“কিনে নিয়েছেন বাড়িটা।”

হাসির বেগ আরও বেড়ে ওঠে, “দা ডিল ইজ ডান। বাড়ির সব ওয়ারিশ সই করেছে। ইনকুডিং অস্মিতা গোস্বামী। টাকার অঙ্কটাই যা আমাদের একটু বাড়াতে হয়েছে।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে হৈমন্তী। ঘরের দেওয়ালের দিকে মুখ করে কয়েক পা এগিয়ে যায়। কিছু একটা ভাবনা চলছে তার মাথায়, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলে, “আমি এ বাড়ি ছেড়ে যাব না।”

—“কী বললেন?”

—“আমার মায়া পড়ে গেছে। এ বাড়ির উপর, এ বাড়ির মানুষের উপর!”

—“এ বাড়ির মানুষ। আর ইউ কিডিং?”

—“আজ্ঞে হ্যাঁ, এ বাড়ির মানুষ, যারা এখানে আগে থাকত, এখন থাকে, তাদের কারও সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারব না।”

—“মানে আপনি আমাদের সঙ্গে কো-অপারেট করবেন না?”

—“না।”

—“ইউ আর ডেড, বিচ।” কোমরের বন্দুকে হাত চলে যায় লোকটার। কিন্তু থেমে যায় সে, অশ্বিনী ঘরে ঢুকছে। তার এক হাতে চায়ের কাপ। অন্য হাতে একটা রোল করা মাদুর। শেষ শব্দটা হয়তো কানে গেছে তার।

—“আপনাদের চা, এ ঘরে তো টেবিল নেই, হাতে তুলে নিতে হবে।” চায়ের কাপটা লোকটার দিকে এগিয়ে দেয় অশ্বিনী, অন্য কাপটা ধরিয়ে দেয় হৈমন্তীর হাতে। হৈমন্তী মাথা নিচু করে নিয়ে নেয় কাপটা।

—“ভালো কথা, এ ঘরে মাটি দিয়ে ড্যাম্প ওঠে। হাঁটা-চলা করছেন, পায়ে ঠান্ডা লাগবে হয়তো, এই চাটাইটা বিছিয়ে দি…” অশ্বিনী মিহি গলায় বলে। মুখে রাগের কোনও চিহ্ন নেই। একটু অবাক হয় হৈমন্তী। উত্তরের অপেক্ষা না করে অশ্বিনী ঘরের একবারে মাঝখানে লম্বা করে বিছিয়ে দেয় মাদুরটা। কোনওদিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

—“আপনি অকারণেই বন্দুকটা নিয়ে এসেছেন স্যার। আমি মরতে চলেছি কমাস পরেই। আমাকে বন্দুক দিয়ে ভয় দেখাতে পারবেন না।”

—“ওঃ! একদম ভুল হয়ে গেছি।” জিভ কাটে লোকটা, ‘‘বন্দুক নয়, তবে অন্য একটা অস্ত্র আছে আমার কাছে।” পকেট থেকে নিজের স্মার্ট ফোনটা বের করে লোকটা, তারপর ফোনের

গ্যালারি ঘেঁটে কয়েকটা ভিডিও ক্লিপ বের করে। সেটা সামনে এগিয়ে ধরে বলে, “দেখুন তো এই টিন-এজ মেয়েটিকে চিনতে পারেন কিনা… অনেকটা চেনা চেনা লাগছে…”

হৈমন্তী জানে কী আছে ভিডিও ক্লিপে, সে ছিনিয়ে নিতে যায় ফোনটা, কিন্তু তার আগেই ফোন’টা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। সে বিড়বিড় করে বলে, “আই থিংক দিস শুড গো ভাইরাল, আন্ডার দ্যা টাইটেল

—সফট রেপ অফ এন এইচআইভি পেসেইন্ট বাই থ্রি ওল্ডার মেন। এখানে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে.. মাই গড! আজকালকার ছেলেরা কীসব উইয়ার্ড পর্ন দেখে ভাই!”

—“জাস্ট গিভ মি দ্য ফাকিং ফোন!” হৈমন্তীর মাথাটা দুলে উঠতে শুরু করেছে।

লোকটা আবার তুলে ধরে ফোনটা, “ওঃ, একটা ট্যাগলাইন ও আছে, হোয়াইল হার প্যারেন্টস ওয়াচিং..” ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠে লোকটা,

“আমরা চাইলে ছিড়ে কুটিকুটি করে ফেলতে পারি আপনাকে…”

—“হৈম, চোখ বন্ধ করো.” লোকটার হাসির আওয়াজ ছাপিয়ে অন্য একটা গলা শোনা যায়। হৈমন্তী মুখ তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে অশ্বিনী এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়, তার হাতে বাগানের ঘাস কাটার লম্বা কাঁচিটা। কালো শার্ট পরা লোকটার ঘাড়ের কাছটা ধরে তাকে চাটাইয়ের উপরে টেনে আনে অশ্বিনী, ঠান্ডা নিরুদ্বিগ্ন গলাটা আবার শোনা যায়, “চোখ বন্ধ করো।” লোকটার কপালটা হাতের তালু দিয়ে মাটিতে চেপে ধরে পেটের উপরে একটা পা রেখে শরীরটা স্থির করায় অশ্বিনী। লোকটা হাঁ করে দম নেওয়ার চেষ্টা করছিল। সেই হাঁ এর ভিতরে দিয়ে আমূলে ঢুকে যায় কাঁচিটা। চাটাইয়ের উপরে ঘিলু আর রক্ত মেশানো একটা থকথকে তরল নেমে আসে। গোটা মুখের উপরে আরও কয়েকবার কাঁচি চালায় অশ্বিনী। লাল পাঞ্জাবিটা ছেড়ে তার পুরনো সাদা পাঞ্জাবি পরে এসেছিল অশ্বিনী। সেটাই এখন লাল হয়ে গেছে রক্তে।

উঠে দাঁড়িয়ে মানুষটার দেহসমেত চাটাইটা রোল করতে থাকে অশ্বিনী। হৈমন্তী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়েছে ঘরের এককোণে। তার মুখ থেকে কান্না উধাও। স্থির পাথরের চোখ তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।

রোলটা ঘরের একদিকের দেওয়াল বরাবর সরিয়ে রেখে হৈমন্তীর পাশে এসে বসে পড়ে অশ্বিনী। কাপা-কাঁপা হাতে তার পাঞ্জাবির একটা পাশ চেপে ধরে পায়ের উপরে মাথা রাখে হৈমন্তী। মুখে অস্পষ্ট কয়েকটা শব্দ ফুটে ওঠে, “এটা কী করলে তুমি? ওরা আবার আসবে…”

হৈমন্তীর চুলের ভিতরে অশ্বিনীর হাত খেলা করতে থাকে, কিছুক্ষণ পর কথা ফোটে তার মুখে, “একটা কথা তখন বলা হয়নি আপনাকে.”

—“কালো শাড়িটা পরেও সত্যি খুব ভালো দেখায় আপনাকে…”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *