দশম অধ্যায়
কার্নিশ থেকে ঝাঁপিয়ে নিচে নেমে এল গনশা। ভোর হয়ে আসছে। গ্রামের দিকে লোকের ঘুম তাড়াতাড়ি ভাঙে। ফলে আর দেরি করলে যে কেউ দেখে নিতে পারে। অবশ্য চুরি সে করছে না। যেটা করছে সেটা আদৌ যে কী তা গনশা নিজেও জানে না। তবে জানলার একেবারে উপর থেকে লোহার বাটা নামাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে। পায়ের কয়েক জায়গায় নূনছাল উড়ে গেছে। সমস্ত গা জুড়ে ধুলোর একটা পরত জমেছে। মাটিতে নেমে গা’টা ঝেড়ে নিল। ভাসানবাড়িরপাঁচিলের বাইরে লোকজনের যাতায়াতের শব্দ আসছে এখন। কেউ দেখে ফেলেনি তো? কাঁধ থেকে একটা ব্যাগ ঝুলছে গনশার। সেটা কাঁধ থেকে হাতে নিয়ে ভিতর থেকে একটা বাক্স বের করে আনে সে। ভারী সুন্দর দেখতে বাক্সটা। পিতলের মতো রঙ, আর তেমনই ভারী। উপরে একটা সিন্দুকের মতো ডালা আছে, সেই ডালার উপরে আর বাক্সের চারদিকে নানা রঙের কয়েকটা পাথর বসানো আছে। নিশ্চয়ই অনেক দাম হবে পাথরগুলোর? একবার লোভও লাগে গনশার, কিন্তু সে চোর নয়।
গনশার মা, বাবা কেউ বেঁচে নেই। আপন কাকার কাছে মানুষ হয়েছে সে, কাকা মানুষটা খারাপ নয়, কিন্তু বেজায় গরীব। গনশাকে ইচ্ছা থাকলেও পড়াশোনা শেখাতে পারেনি সে।
বছর পাঁচেক আগে কাকা গনশাকে নিয়ে কলকাতায় গেছিল টুকটাক কিছু কাজের খোঁজে, কাজ তেমন কিছু পায়নি। দিনে রিকশা চালাত, রাতে একটা মাংসের দোকানে হেল্পারের কাজ করত। কয়েক মাস সেখানে থেকে তেমন জুত করতে পারেনি বলে আবার গ্রামে ফিরে আসে। কিন্তু তার মধ্যেই একটা আজব নেশা চড়ে বসেছে গনশার ঘাড়ে শহরের নেশা। এখানে এত রকম কলকারখানা, এতরকম ব্যবসা, এত মানুষ একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রাস্তাঘাটে,
এখানে খুঁজলে নিশ্চয়ই কোথাও গুপ্তধন পাওয়া যায়। ওইতো রাস্তার ধার জুড়ে ঝা চকচকে ঠান্ডা দোকানের কাউন্টারে বসে যারা হাত পেতে টাকা নিচ্ছে, তারা পেয়েছে। গনশা বুঝেছে মুরগি কেটে, রিকশা চালিয়ে শহরে বেঁচে থাকা যায় বটে, কিন্তু শহরের আসল মজা নেই তাতে। তার জন্যে অন্য খেলা খেলতে হয়। খেলাটা বোঝার আগেই কলকাতা ছাড়তে হয়েছে। বাড়ির পেছন থেকে সামনের দিকে আসতেই থমকে যায় গনশা। বাগানের লাগোয়া কাঠের বেঞ্চে কেউ বসে আছে। মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছে না গনশা, তবে গুনগুন করে একটা গান গাইছে লোকটা। বুকটা দুরুদুরু করে উঠল তার। দেওয়াল ঘেঁষে একবার উঁকি দিয়ে নিশ্চিত হল, নিতাইকাকা। তবে যেই হোক না কেন, ঝোলার ভিতরে কী আছে সেটা জানানো যাবে না।
দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে চোখে না পড়ে উপায় নেই। কোনওরকমে ব্যাগটা আড়াল করে পার হতে যাচ্ছিল গনশা, কিন্তু এড়াতে পারল না।
—“হেই বান্দর পোলা, ইদিকে আয়…” গনশা ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় নিতাইয়ের সামনে। নিতাই ছলনা করে তার দিকে জ্বলন্ত বিড়ি এগিয়ে দিয়ে বলে, “টানবা?”
গনশা দুদিকে মাথা নাড়ে। বাতাসে খানিক ধোঁয়া ছাড়ে নিতাই, “তাইলে? হালায় পড়ালিখা তো করস না, বিড়ি টানবা, লোকের পোঁদে লাগবা..” খানিক থেমে বলে, “তোর গার্জেনটাও একখান খাটাস, পোলার বেরেন ব্রাইট কেবল ঘষামাজা হয় নাই। ফাঁকা পইড়া আসে, আর ফাঁকা মাথা হইল…”
—“শয়তানের আস্তানা।” অপরাধীর মতো মুখ করে গনশা বলে।
—“কাম সারসে! জ্ঞান তো দেহি কম নাই, কই হাতখান দে তো..” প্রায় জোর করেই গনশার হাতটা টেনে নেয় নিতাই, তারপর বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রেখাগুলোর দিকে। কয়েকবার মুখটাকেও জরিপ করে নেয়। মনে হয় বিড়বিড় করে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করছে। মুখ তুলেই বলে, “শুন, তোর কাকারে গিয়া কইবি নিতাইকাকা বলসে তোর
কপালে যশ আছে, কিন্তু তাইগ্লিগা পড়ালিখা করা লাগবে।”
গনশা উত্তর দেয় না, দু’দিকে মৃদু মাথা দোলায়। সেটা নিতাই লক্ষ্য করেনি তাই বলে, “কী অইল?”
—“হাত দেখে ভাগ্য বলা যায় না।” নিতাই অপলক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে গনশার দিকে, তারপর তার পিঠে একটা বড়সড় চাপড় মেরে বলে, “বড় হও বাপ, অনেক বড় হও… উতে কী আসে?” কাঁধের ঝোলায় চোখ পড়েছে নিতাইয়ের। গনশা একটু সামলে নিয়ে বলে, “মা… মাটি।”
—“মাটি! কিল্লিগা?” গনশা কাঁধ ঝাঁকায়, তারপর সন্দেহজনক ভাবেই উপরে দৌড় দেয়। মিথ্যে বলে বেশিক্ষণ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না সে।
হৈমন্তীর ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের দরজা বন্ধ। দরজার নিচ দিয়ে অন্ধকার উঁকি দিচ্ছে। গনশা বাইরে থেকেই দেখেছে দিদিমণি জানলা খুলে শোয়নি আজ। দরজার উপর হাত চালায় সে, “দিদি, ও দিদি… আমি গনশা…”
প্রায় মিনিট দশেক পর গনশা যখন ফিরে যাওয়ার উপক্রম করেছে ঠিক সেই সময়ে কাষ্ঠল শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়। হৈমন্তীর চেহারাটার দিকে চেয়ে গনশা অবাক হয়ে যায়। শরীরের বেশিভাগটাই একটা চাদরে জড়ানো। চুল খড়ের গাদার মতো জট পাকিয়ে গেছে। ছেড়া পুতুলের কথা মনে পড়ে মুখের দিকে তাকালে।
—“কী রে? আজ এত সকাল সকাল?” ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করে হৈমন্তী। হাত দিয়ে মুখের সামনে থেকে চুল সরায়।
গনশা কথা না বলে ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বাক্সটা বের করে এনে তার সামনে তুলে ধরে। সেটা দেখেই হৈমন্তীর মুখে কয়েকটা সতর্ক রেখা খেলে যায়, দু’পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গনশার হাত ধরে একটা
হ্যাঁচকা টানে তাকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় সে। তারপর দরজাটা আঁটসাঁট করে বন্ধ করে দেয়। ভিতরে এসেই অবাক হয়ে যায় গনশা। তার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে, “নিবারণকাকা!”
নিবারণ একটা শুকনো হাসি হেসে মাটির উপরেই বসে পড়ে। হৈমন্তী একটা হাত গনশার মাথায় রেখে বলে, “উনি যে এখানে এসে আছেন সেটা কাউকে বলিস না কিন্তু, অশ্বিনীকে তো একেবারেই নয়। কেমন?”
গনশার মুখ থেকে বিস্ময়টা যায় না, সে আর কথা না বাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ বলে মাথা নেড়ে দেয়। এতক্ষণে বাক্সটা হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছে হৈমন্তী। ডালার ঠিক সামনে একটা ছোট চাবি ঢোকানোর গর্ত। ডালাটা শক্ত হয়ে এঁটে আছে। টানাটানি করেও খুলল না সেটা। কানের কাছে ধরে হৈমন্তী বলল, “কাগজপত্র ছাড়াও সলিড কিছু আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু খুলতে গেলে তো চাবি লাগবে।”
—“চাবি!” নিবারণ নিচু স্বরে বলে, “একটা চাবির গোছা আমাকে দিয়েছিলেন বড়কত্তা। তাতে একটা এমন চাবি ছিল যেটা দিয়ে কিছুই খুলত না । তবে গোছর মধ্যে ছিল চাবিটা।”
—“চাবির গোছটা কোথায় এখন?” নিবারণ কোনও কথা বলে না। কেবল ইশারা করে একটা। হৈমন্তী বুঝে যায় উত্তরটা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কী একটা মনে পড়তে নিবারণ বলে, “না, মনে পড়েছে। চাবিটা এখন আর গোছে নেই। আগের বছর আমিই খুলে নিয়ে রাখতে দিয়েছিলাম নিতাইকে।”
—“নিতাইকাকাকে! কেন?”
—“ও বলছিল চাবিটা নাকি লোহার নয়, অন্য কোন ধাতুর তৈরি। কোন ধাতু সেটা ও একটু পরীক্ষা করে দেখবে। কোনও কাজে লাগত না চাবিটা, আমি আর আপত্তি করিনি।
—“নিতাইকাকা নিচে বসে আছে, আমাকে আসতে দেখেছে।” কেউ কিছু বলার আগেই গনশা বলল।
“গিয়ে বল চাবিটা নিয়ে উপরে চলে আসতে। আর দাদার সঙ্গে দেখা হলে..”
—“কিছু বলব না…”
হৈমন্তী হাত বাড়িয়ে তার গাল টিপে দেয়। গনশা দৌড়ে নিচে নেমে যায়, বাক্সটা তার মনের ভিতরেও কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছে।
দরজা বন্ধ করে আবার বাক্সের উপরে ঝুঁকে পড়ে হৈমন্তী। গলা ঠেলে বেরিয়ে আসা কাশির একটা দমক কাঁপিয়ে দেয় তাকে। কবজিটা মুখের সামনে ধরতে কিছুটা রক্ত এসে পড়ে।
সেটা মুছে নিয়ে ডালার উপরটা ভালো করে লক্ষ্য করে বলে, “কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।”
—“কী?”
—“উপরের পাথরটার নিচে কোন ধাতু নেই, ডালার গর্তের মধ্যে চেপে বসানো আছে পাথরটা। নিচের হলদে কাগজে লেখা কিছু একটা শব্দকে রিফ্লেক্ট করছে।” আরও কিছুটা অন্ধকারের মধ্যে বাক্সটাকে টেনে আনে হৈমন্তী।
তারপর একটা টর্চ জ্বেলে তার আলোটা ফেলে পাথরের একেবারে উপরে। ভুরু দুটো কুঁচকে যায় তার, মুখ তুলে বলে, “একটাই ওয়ার্ড পড়া যাচ্ছে- চিড়িয়াখানা।”
—“চিড়িয়াখানা!”
—“হ্যাঁ, সঙ্গে আরও কিছু লেখা আছে হয়তো, কিন্তু পাথরের গায়ে ওটুকুই পড়া যাচ্ছে। এখানে কাছেপিঠে কোথাও চিড়িয়াখানা আছে নাকি?”
—“এখানে আবার কোথায় চিড়িয়াখানা থাকবে ?” নিবারণ হাত উলটে বলে।
—“তাহলে এ-বাড়ির কোনও জায়গা যেখানে পশুপাখি থাকত।”
সজোরে মাথা দোলায় নিবারণ, “আমার তো পঞ্চাশ বছর কেটে গেল এই বাড়িতে, কই চিড়িয়াখানা বলে কিছুর কথা তো শুনিনি।”
ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে হৈমন্তীর। ভোরের বাতাসে শিরশিরানি ভাব খেলা করছে। দূরে কোনও কুঁড়ে ঘরের সামনের চাতালে মোরগ ডেকে উঠছে। গোয়াল থেকে গরুর পাল বেরিয়ে এসে মাটির উপরে ঠকঠক শব্দ তুলে হেঁটে যাচ্ছে মাঠের দিকে।
পাশবালিশে পিঠ রেখে শরীর এলিয়ে দেয় হৈমন্তী, “আপনি পঞ্চাশ বছর এখানে আছেন, তার আগের কথা আপনার জানা নেই কিছু? মানে এ বাডি তৈরি হওয়ার সময়কার কথা?”
—“না! বাড়িটার দায়িত্ব যখন পাই তখন আমার বয়স পনেরো। ওসব নিয়ে সে বয়সে বড়কর্তাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।”
বিছানা হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নেয় হৈমন্তী, লাইটার জ্বালাতে জ্বালাতে বলে, “আমি কিছু জানি। তবে তার পুরোটা সত্যি নাও হতে পারে। মুরারিমোহন নামে এক নামকরা সায়েন্টিস্ট তৈরি করেন এই বাড়িটা। আমার ধারণা তার কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। সম্ভবত স্পেস, টাইম নিয়ে চূড়ান্ত গোপনীয় কোনও রিসার্চ করছিলেন তিনি। তার কাছে ছিল ততোধিক গোপনীয় একটি রেলিক। লন্ডন মিউজিয়ামে ওই বছরই ইজিপ্ট থেকে একটি শিপমেন্ট আসে। আর্কিওলজিকাল সাইট থেকে যখন কোনও মিউজিয়ামে শিপমেন্ট আসে তখন তাতে কী কী জিনিস আছে তার একটা লিস্টও পাঠাননা হয়। সময়টা দেড়শ বছর আগে, ফলে ডিজিটাল কিছুই ছিল না। সমস্তটাই হাতে লেখা।
ঘটনাচক্রে শিপমেন্ট খোলার ঠিক পরপরই সেই লিস্টটা খোয়া যায়। এবং দিনতিনেক পরে লিস্ট আবার মামুলি খোঁজাখুঁজির পর ফিরে আসে। এবার ভেবে দেখলে সহজেই বুঝতে পারবেন এই তিনদিন লিস্টের গা ঢাকা দেওয়ার একটাই কারণ। শিপমেন্টের বিশেষ একটি আইটেম কেউ সরিয়ে নিয়েছে। তার বদলে সেই আইটেমের অনুরূপ একটি নকল তৈরি করে যথাস্থানে বসিয়ে দিয়েছে। খুঁজে পাওয়া লিস্টের সমস্ত জিনিস শিপমেন্টের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় কারও মনে কোনও সন্দেহ জাগেনি। এমনকী যে আর্কিওলজিস্টরা
শিপমেন্ট পাঠিয়েছিল তাদের মনেও নয়!”
সমস্ত ব্যপারটা মাথার মধ্যে ছকে নিতে একটু সময় লাগে নিবারণের,
খানিক ভেবে সে বলে, “কিন্তু এর জন্যে লিস্টটা চুরি করার কী দরকার ছিল ? জিনিসটা দেখে নিয়ে তার নকল বানিয়ে সেটা বদলে নিলেই তো সহজ হত।”
—“উহু, হত না। আর্কিওলজিস্টরা জিনিসটা ভালো করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে মিউজিয়ামে পাঠিয়েছেন। ফলে চোরকে যে নকলটা তৈরি করতে হবে সেটার ভয়ানক রকম পারফেক্ট হওয়া দরকার।”
—“কিন্তু জিনিসটা কী?” টেবিলের উপর থেকে নিজের ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে সেখানে একটা বিশেষ ছবি ওপেন করে হৈমন্তী, নিবারণের মাথা আরও খানিকটা ঘেটে যায় ।
—“এই জিনিসটার নাম অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজম। ১৯০১ সালে গ্রীসে সমুদ্রের তলা থেকে উদ্ধার করা হয়। ভারী অদ্ভুত একটা বস্তু। পৃথিবীর প্রথম তৈরি হওয়া অ্যানালগ কম্পিউটার।”
—“কম্পিউটার!” অবাক হয়ে যায় নিবারণ।
—“হ্যাঁ। যীশু খ্রিস্টের জন্মের দু’শো বছর আগে তৈরি হওয়া কম্পিউটার।”
—“কী কাজ হত এতে?” ছবিটার দিকে ঘুরে তাকায় হৈমন্তী, “সেটা বলা মুশকিল। তবে বিজ্ঞানীরা এর গঠন দেখে অবাক হয়ে যায়। বত্রিশটা ছোট-ছোট যন্ত্রের কারসাজি আছে এর মধ্যে। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, ধূমকেতুর আবির্ভাব, নক্ষত্রদের অবস্থান থেকে শুরু করে আরও হাজার রকমের মহাজাগতিক ঘটনা ঠিক কবে ঘটবে সেটা প্রেডিক্ট করা যায় এই যন্ত্র দিয়ে। সোজা কথায় বলতে গেলে একটা মহাজাগতিক ঘড়ি!
আর সেখানেই সমস্যা, আমরা যাকে ঘড়ি বলি তা আবিষ্কার হয় এটা তৈরি হওয়ার হাজার বছর পরে।”
নিবারণ আর কিছু জিজ্ঞেস করে না, হৈমন্তী একটু থেমে নিজে থেকেই বলে, “যন্ত্রটা যে বত্রিশটা যন্ত্রাংশ নিয়ে তৈরি সেগুলো ছাড়াও আরও অন্তত কুড়িটা যন্ত্রাংশ ছিল এর মধ্যে, যেগুলো সময়ের ধাক্কায় হারিয়ে গেছে। কিছু লোকের ধারণা এই সমস্ত যন্ত্রাংশ একসঙ্গে করলে এন্টিকাইথেরা মেকানিজমের কাজ শুধু মহাজাগতিক ঘটনাকে প্রেডিক্ট করা নয়…
এবার দেখুন এটা আবিষ্কার হয় ১৯০১ সালে। মুরারিমোহন এই বাড়ি তৈরি করেন তার পঞ্চাশ বছর আগে। অর্থাৎ এইটার কথা তখনকার মানুষ জানত না।
ধরুন ওই আঠেরোশো পঞ্চাশ নাগাদ ইজিপ্ট থেকে ঠিক এইরকম একটা যন্ত্র কোনও পিরামিডের ভিতর থেকে পাওয়া গেল। বিজ্ঞানীরা তখন মহাজাগতিক ঘড়ি বলে কিছু হতে পারে সেটা জানেন না। তারা ততটা গুরুত্ব দিলেন না। তখন সবে ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু হয়েছে। ছবি তোলা তখন ভয়ানক ব্যয়বহুল। ফলে ছবি না তুলেই প্রাথমিক কিছু দেখাশোনা করে তারা পাঠিয়ে দিল লন্ডন মিউজিয়ামে। এদিকে লন্ডন মিউজিয়ামের কোনও ক্ষমতাবান কর্তা সেটা সরিয়ে তার মতো আর একটা যন্ত্র বসিয়ে রাখলেন সেখানে।
ভদ্রলোক এতই ক্ষমতাবান ছিলেন যে যারা বুঝতে পেরেছিল জিনিসটা ফেক তাদেরকেও মন্ত্রগুপ্তি শিখিয়ে দেওয়া হল।”
—“কিন্তু জিনিসটা চুরি করলেন কেন?”
—“কারণ…” সিগারেটে একটা বড় করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল হৈমন্তী, “কারণ অ্যান্টিকাইথেরা মেকানিজমের মতো এ যন্ত্রটা খোঁড়া ছিল না। এর সব ক’টা যন্ত্রাংশই সচল ছিল। সমুদ্রের তলায় হাজার বছর কাটিয়ে যন্ত্র ক্ষয়ে যেতে পারে, কিন্তু পিরামিডের তলায় গোপন আস্তানায় সেই সম্ভাবনা কম।
সে যন্ত্র তখনও তার ইঙ্গিত কাজটি করতে পারে। এবং আমার ধারণা এই যন্ত্রটিকে নিয়েই শহর থেকে দূরে এসে এই ভাসানবাড়িতে গবেষণা করছিলেন মুরারী মোহন। তবে তারপর কী হয় তা আমি জানি না।”
হাতের বাক্সটার দিকে চেয়ে বলে, “এর মধ্যে হয়তো কিছু উত্তর পাওয়া যেতে পারে।”
বেশ কিছুক্ষণ কোনও কথা বলে না কেউ। মিহি সাদাটে ধোঁয়া শুধু নানা আকৃতির নকশা কাটতে থাকে বদ্ধ ঘরের বাতাসে। মিনিট পাঁচেক পর নিবারণ মুখ তুলে বলে, “কিন্তু আপনি এসব জানলেন কী করে?”
হৈমন্তী হাসে, “জানিনি, জানানো হয়েছে। আমি ভাসানবাড়িতে কোনও সোসাইটির কাজে আসিনি। অস্মিতার সঙ্গে গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব পাতাই শুধু এ বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র পাওয়ার জন্যে। আমার সত্যিকারের উদ্দেশ্য অন্য। মিথ যদি সত্যি হয়, আই মিন… জিনিসটা সত্যি যদি এ বাড়িতে থাকে তাহলে সেটা একটা সংস্থার হাতে তুলে দিতে হবে আমাকে। যাদের হাতে তুলে দেব তারা বড় সুবিধের লোক নয়।”
একটা লালচে ভাব ছড়িয়ে পড়ে নিবারণের মুখ জুড়ে, গলকণ্ঠটা বার কয়েক দপ করে থেমে যায়, “আমাকে এসব বললেন যে…”
হৈমন্তীর হাতের কাছ থেকে চাদর সরে গেছে, ডেভিল ট্যাটুর খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে, “আপনাকে বলা সেফ। কারণটা মনে হয় আপনিও জানেন।” .
বাইরে দরজার উপরে আবার খটখট শব্দ শোনা যায়। এবার নিবারণই উঠে দরজা খুলে দেয়। গনশা মুখ নামিয়ে বলে, “নিতাইকাকা বলল কাজ আছে, এখন আসবে না।”
—“আর চাবি?” হৈমন্তী পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে।
—“চাবি আনতে কাকার বাড়ি গেছিলাম। কাকিমা বলল ক’দিন আগে এসে দাদা নিয়ে গেছে চাবিটা, বলেছে কী একটা খুলতে নাকি কাজে লাগবে।”
—“শিট!” হৈমন্তী নিজের থাই-এর উপরে একটা চাপড় মারে, “চাবি অশ্বিনীর কাছে, ওর চোখ এড়িয়ে থেকে ওটা চুরি করে আনা অলমোস্ট ইম্পসিবল।” হতাশ দেখায় তাকে।
—“না…” বাইরের দরজাটা বন্ধ করে ভিতরে ঢুকে আসে গনশা। ওর মুঠো করা ডানহাতটা খুলে এগিয়ে দেয় হৈমন্তীর দিকে, “তুমি বলেছিলে ওই গেমটায় জেলের চাবি খুঁজে দেবে আমাকে…”
গনশার হাতের মুঠোর মধ্যে শুয়ে রয়েছে একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা, অজ্ঞাত ধাতুর খাঁজকাটা চাবি। এতটুকু জং ধরেনি তাতে। হৈমন্তী সেটা হাতে তুলে মুখের সামনে ধরে। প্রশান্তির হাসি খেলে যায় তার চোখে। গনশা মিনমিন করে বলে, “এবার দাও…”