প্রথম অধ্যায়
—“দাদা, পাষাণবাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?”
গুমটি দোকানের ভেতর থেকে আধুনিক বাংলা গানের সুর ভেসে আসছিল। আধুনিক বলতে অতিআধুনিক, শুনতে না চাওয়া হৈমন্তীর কানের পর্দায় শিরিষ কাগজ ঘষে দিয়ে গেল সেই সুর। ভেতর থেকে প্রায় ডিমের আকৃতির মতো মাথা এবং সিদ্ধ ডিমের কুসুম রঙের চামড়ার একটা লোক বেরিয়ে এল, “কোন বাড়ি বললেন?”
হৈমন্তীর দুটো হাতে সুটকেস, চশমাটা খানিক আগেই নাক বরাবর অনেকটা নেমে এসেছে। এখন সে খেয়াল করল ট্রেনের ঠেলাঠেলিতে শার্টের উপরের দিকের একটা বোতাম খুলে গেছে। কুসুমের দুটো খুদে চোখ এখন সেখানে পছন্দমতো কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে।
—“পাষাণ বাড়ি। ওই নামে একটা বাড়ি আছে এখানে…”
—“তাই নাকি! কই, আমি তো শুনিনি।”
হৈমন্তী আর কিছু না বলে এগোতে যাচ্ছিল। এইসময় গুমটি দোকানের ভেতর থেকে আর একটা গলা ভেসে আসে,
—“পাষাণ না ভাসান? ভালো করে জেনে আসুন। ভাসানবাড়ি বলে একটা বাড়ি আছে, তবে সেখানে লোকজন আসে বলে তো শুনিনি… আপনি হঠাৎ…”
—“হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাসানই হবে, আসলে আমার চশমাটা…”
বিকেল হয়ে এসেছে। দুপুরের আলোর মুখে বার্ধক্য কাঁচা হলুদের রং টেনেছে। কনে দেখা আলো ভারী হিসেবি। কখন আসে আর কখন শেষ হয়ে যায় বোঝাই যায় না। হৈমন্তীর বাইফোকাল লেন্সের বেশিরভাগটাই চোখের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। ফলে চিরকুটে লেখা ঠিকানাটা ভালো করে দেখতে পায়নি সে। দুটো স্যুটকেস মাটির উপর নামিয়ে রেখে জামার বোতামটা আটকে, চশমাটা সিংহাসনে ফিরিয়ে আনে সে।
—“ভাসানবাড়ি কী করে যাব বলুন তো? ম্যাপে তো দেখছি না।” ফোনটা তুলে দেখায় হৈমন্তী।
—“কেন যাবেন?” আটকানো বোতামটার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে ডিমের কুসুম দরজা থেকে সরে যায়। দরজা ফাঁক হয়ে পুরোটা খুলে যায়। একটা মাঝবয়সী লোক উৎসুক মুখ বাড়িয়ে দেন সেখান থেকে, “হঠাৎ ওখানে যাবেন যে, খবরের কাগজ থেকে নাকি?”
—“আজ্ঞে না আমি একটু লেখালেখি করি…”
—“অঃ! ভাসানবাড়ি নিয়ে গল্প লিখতে এসেছেন? আগেও কতজন এল, তবে গল্প-টল্প তেমন লিখতে পেরেছে বলে তো মনে হয় না।” লোকটার গলায় আক্ষেপ না ব্যঙ্গ তা ঠিক বোঝা গেল না।
—“আমি গল্প লিখতে আসিনি, একটা নন ফিকশন..” বাকি কথাটা শেষ করে না সে, “বাকিরা লিখতে পারেনি কেন?”
—“লেখার মত আর কী আছে?” চকচক করে জিভে বিরক্তিকর একটা শব্দ করে লোকটা, “আছে তো একটা আকুরে কেয়ারটেকার, ও বাড়ির ইতিহাসের সে না জানে আগা না জানে মুড়ো। কেবল একাকুম্ভ হয়ে গোঁ ধরে বসেআছে। বাড়ি বেচতে দেবেনা, তার উপরে লোকটা সুবিধের নয় শুনেছি…”
‘কক্!’ করে একটা আওয়াজ করে কথার মাঝেই থেমে গেল। লোকটা। হৈমন্তী বুঝল পেছন থেকে তাকে খোঁচা মেরেছে কেউ। প্রসঙ্গ বদলে নিয়ে বলল, “তা আপনি একাই থাকবেন ওখানে?”
—“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
—“কতদিন?”
—“এই ধরুন সপ্তাদুয়েক।”
—“তা বিয়ে করেছেন?”
একটু গলা খাঁকারি দেয় হৈমন্তী। লোকটা অনর্থক কৌতূহল দেখাতে শুরু করেছে।
—“না, কেন বলুন তো? আপনি করেননি?”
লোকটা প্রশ্নটা গায়ে মাখে না, চোখের কৌতূহল মেটেনি যখন মনের কৌতহলটাই এগিয়ে ধরে সে, “মেয়েছেলে…একা একা থাকবেন এখানে!”
একজন কেয়ারটেকার ও একটি সুন্দরী মেয়ে এক নির্জন বাড়িতে থাকবে ভেবেই হয়তো লোকটার কল্পনার ডানায় ঝড় ওঠে।
হৈমন্তী বলে, “একটা ছেলে দেখে দিন, বিয়ে করে নেব না হয়। আপাতত ডিরেকশন’টা দিন প্লিজ।”
কিছু যেন বিড়বিড় করে লোকটা। বোধহয় নারীজাতির অধঃপতনে মর্মাহত হল। হাত তুলে সামনে ফাঁকা রাস্তা দেখিয়ে দেয়, “সিধে গেলে একটা ভাঙা কালিমন্দির পড়বে, সেখান থেকে ডান দিকে একটু হেঁটে যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন একনাথের ঝিল কোথায়? ঝিলটা পেরোতে অবশ্য বোট লাগবে। ঝিলের ওপারেই ভাসানবাড়ি।”
আর কোনও কথা না বলে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে হৈমন্তী, কনুইয়ের কাছ থেকে শার্টের হাতাটা গুটিয়ে উপরে তুলে নেয়। তার মিস্টিক ডেভিল ট্যাটুটা বেরিয়ে পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে আরেকবার থতমত খায় লোকটা। হৈমন্তী এবার ফোনটা বের করে অস্মিতার নম্বরটা ডায়াল করে।
—“হ্যাঁরে পৌঁছে গেছিস?”
—“যাইনি, তবে যাব। দুটো লোকের থেকে ডিরেকশনটা নিলাম।”
—“কোন লোক?”
—“মিস্টার পার্ভার্ট আর মিস্টার মিসোজিনিস্ট।”
—“ওয়েলকাম টু বিরাজপুর। ওখানে ওই দুটো ক্যাটাগরির লোকই আছে।
—“তুই সব বলে রেখেছিস তো?”
—“বলার কী আছে আবার? চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি। নিবারণ কাকা একটু অর্থোডক্স টাইপের। মোবাইল ফোন-টোন ইউজ করতে চায় না।”
—“নিবারণ কেয়ারটেকার? লোকটা শুনছিলাম নাকি কোট-আনকোট ‘সুবিধের নয়।”
—“অসুবিধের কী আছে? একটু উইয়ার্ড বটে। বাড়িটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। ছোটবেলায় আমি যতবারই ও বাড়িতে গেছি নিবারণকাকাই আদর-আপ্যায়ন করেছে।”
—“আদর! কী রকম আদর?”
—“আঃ! সবকিছুই নোংরা অ্যাঙ্গেলে দেখিস কেন বলতো? স্নেহ করতেন বলতে চেয়েছি।”
—“অ্যাঙ্গেলের আর দোষ কী বল? তুই বললি দু’রকম ক্যাটাগরির লোক থাকে এখানে.”
ওপাশ থেকে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল অস্মিতা। ঘরঘর করে শব্দ হয়। কান থেকে ফোন সরিয়ে হৈমন্তী দেখে ফোন কেটে গেছে।
হৈমন্তী ঘোষের বয়স তিরিশের আশেপাশে। পাতলা, ছিপছিপে চেহারা। দেখতে একেবারেই প্রথাগত বাঙালি মেয়েদের মতো নয়। বছর পাঁচেক আগে এবার বিয়ে করেছিল কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে সে বিয়ে টেকেনি। কলেজ জীবনে ফিজিক্সের ছাত্রী ছিল, পরে জার্নালিজমে আগ্রহ জন্মায়। বিয়ে ভেঙে যেতে একটা গভর্মেন্ট স্পন্সরড হেরিটেজ রিসার্চ সোসাইটিতে যোগ দেয়। পরের পাঁচবছরে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সিঁড়ি ভেঙে বেশ খানিকটা উপরে পৌঁছেছে।
মাসখানেক আগে এক সোর্সের মাধ্যমে সোসাইটির অফিসে একটা চিঠি এসে পৌঁছায়। তাতে লেখা ছিল বিরাজপুর নামের একটা গ্রামে একটি ভগ্নপ্রায় হেরিটেজ বিল্ডিং আছে। প্রাইভেট ওনারশিপ। অন্তত দুশো বছরের পুরনো সেই বাড়ি, অথচ যত্নের অভাবে ভেঙে পড়ছে। বাড়ির উত্তরপুরুষদের বেশিরভাগই দেশছাড়া।
ধোঁজখবর নিয়ে হৈমন্তী জানতে পারে যে এন্সেস্টারদের মধ্যে একটি মাত্র পরিবার কলকাতায় থাকে এবং সে পরিবারের একমাত্র মেয়ে অস্মিতা গোস্বামী থাকে কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলে।
অস্মিতা গোস্বামীর সঙ্গে গায়ে পড়ে যোগাযোগ করে নাথপরিবার সম্পর্কে কিছটা জানতে পারে হৈমন্তী। মেয়ে নাকি কচিবয়সে বার তিনেক গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল, তবে আপাতত সেখানে স্থানীয় এক কেয়ারটেকার ছাড়া আর কেউই থাকে না। অফিসে বসের কাছ থেকে কন্সেন্ট লেটার আদায় করে হৈমন্তী নিজেই ঠিক করে সেখানে গিয়ে নাথ পরিবারের ইতিহাস উদ্ধার করে আনবে। সেই নিয়ে একটু প্রবন্ধ লেখার ইচ্ছে আছে। সেই সূত্রেই আজ দুপুরের দিকে এই গ্রামে এসে পৌঁছেছে সে। ঝিলের কাছে এসে দাঁড়াতে মনটা হালকা হয়ে যায় হৈমন্তীর। এমন স্বচ্ছ জলের ঝিল কলকাতার বুকে দেখা যায় না। টলটলে জলের উপরে ঝুঁকে
পড়া গাছের কচি সবুজ পাতা ভেসে রয়েছে। তার তলা দিয়ে কুচোমাছ ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। এখন বিকেলের আলো প্রায় কুরিয়ে আসতে চলেছে, ডুবন্ত সূর্যের গৈরিক রঙ ঝিলের জলে যেন শরবৎ গুলে গেছে।
পুকুরের ধারে একটা ভেলা বাঁধা আছে। তার উপরে পা রেখে বাকি দেহ মাটির উপর দিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটা গ্রাম্য লোক। পরণে কেবল একটা গামছা। পাশে একটা ছিপও যেন লোকটাকে নকল করেই ঘুমানোর ভান করছে। হৈমন্তী এগিয়ে গেল।
—“দাদা, দাদা শুনছেন?” ধীরে ধীরে চোখ খুলল লোকটা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক হল। সম্ভবত এমন শহুরে জামাকাপড় পরে বড় একটা কেউ এদিকে আসে না।
মুখের উপর হাত চালিয়ে লোকটা বলল, “পাঁচটাকা, রাজি তো উঠে পড়েন…”
—“দশটাকা দেব। আমাকে ভাসানবাড়ি দেখিয়ে দিতে হবে।”
—“ভাসানবাড়ি” বিড়বিড় করে লোকটা। সম্ভবত কিছু একটা প্রশ্ন করতে চাইছিল, কিন্তু থেমে যায়।
বৈঠা জলের ভেতর ডুবিয়ে দেয়, “আসেন।”
ভেলায় চড়ার অভ্যাস নেই হৈমন্তীর। কোনওরকমে জিনসটা গুটিয়ে উঠে বসে। শক্ত হাতে পাড় বেয়ে জলের উপর বেশ কিছুদূর এগিয়ে যায় লোকটা। মিনিট দশেকের মধ্যেই ঝিলের উলটোদিকের পাড়ে এসে ধাক্কা খায় ভেলাটা। সেটা বেঁধে রেখে পাড়ে উঠে আসে লোকটা। পিছন পিছন হৈমন্তীও। মনে হয় লোকটা অনেকক্ষণ থেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে চাইছে তাকে, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না। সে নিজেও আর কথা বাড়ায় না। সারাদিনের জার্নিতে শরীর ক্লান্ত হয়ে আছে। বাড়িতে পৌঁছেই একটা বড়সড় ঘুম দরকার। খানিকটা হেঁটে আসতেই ভাসানবাড়ি চোখে পড়ে হৈমন্তীর। বাড়িটা তেমন বড় নয়। দোতলা। তবে দু’পাশে বেশ খানিকটা ছড়ান। একেবারে মাথায় ছাদের উপরে একটা ত্রিশূল, আর তার গায়ে লাল রঙের পতাকা ঝুলছে। তার নিচে খানিকটা অংশ ইট সিমেন্টের চাদর ফাটিয়ে উঁকি দিচ্ছে বাতাসে।
বাড়ির চারপাশ জুড়ে পোটিকোর মতো বারান্দা করা আছে। বারান্দার বেলিং-এর কয়েকটা গারদ উধাও।একতলার সামনে একটা ছোট বাগিচা, তাতে টব করে কিছু ফুল গাছ চাষ করা হয়েছিল। এখন তারা মরে গেছে। বোঝ যায় বয়সের কারণেই আগের মতো দেখাশোনা করতে পারে না নিবারণ।
টাকাটা হাতে নিয়ে চলে গেল লোকটা। হৈমন্তী স্যুটকেসগুলো মাটিতে রেখে কিছুক্ষশ তাকিয়ে থাকে ফাঁকা খয়েরি রঙ লাগা ঝুল বারান্দাটার দিকে। বাড়িটা পুরানত তাতে সন্দেহ নেই।
বড়বাড়িতে মানুষ কম থাকলে কেমন একটা বিষন্নতার ছাপ পড়ে বাড়িময়। ভাসানবাড়িও যেন সেই বিষন্নতার অন্ধকারে ঢেকে আছে। হৈমন্তী মনে মনে ভাবে এই বাড়ির দোতলায় একটা পুরনো তাঁতের শাড়ি, একটা ছিটাভের ফুল প্যান্ট যদি শুকাতে তাহলে এই ভাঙ্গা বাড়িটাকেও এত থমথমে দেখাতো না। পা চালিয়ে আরও কাছে এগিয়ে এল সে। বাগানের সামনে একটা ছোট কবজা করা আছে। তাতে আপাতত তালা ঝুলছে না। ভিতরে ঢুকে সে বাগানের মাঝখানায় এসে দাঁড়াল। গলা তুলে দোতালা বাবান্দাটার দিকে চেয়ে কয়েকবার ডাকাডাকি করল, “কেউ শুনছেন? নিবাবণ বাবু?”
বারতিনেক ডাকাডাকি করার পর হৈমন্তীর মনে হল ছাদের দিকে কার যেন ছায়া পড়েছে। একটু পিছিয়ে এসে মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করল সে, আর সঙ্গে সঙ্গে গা’টা শিউরে উঠল তার। পিছিয়ে আসার সময় পিছনে কী আছে দেখেনি, অবশ্যও একটু আগেই কিছু ছিল না। তাই দেখার দরকারও পড়েনি। এখন শক্ত কিছুর ছোঁয়া লাগল তার পিঠে। বুক? একটা মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে তার ঠিক পিছনে।
ঘুরে তাকিয়ে আগন্তুককে দেখতে পেল হৈমন্তী। তারপর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক।
—“বাবা নেই, আমি শুনছি। বলুন কী বলবেন?”
—“আ… আমি হৈমন্তী ঘোষ… আজ আসার কথা..”
ছেলেটার মুখে একটা হাসি ফুটে ওঠে, “আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। আসুন আমার সঙ্গে…”
গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে নিয়ে ঘরের ভিতরের দিকে পা বাড়াল সে। হৈমন্তী খানিক থতমত খেয়ে তাকে অনুসরণ করে। বয়সে ছেলেটা তার থেকে বছর দুয়েকের ছোটই হবে। তবে লম্বায় ফুটখানেক বেশি। মাংসল চেহারার। একটা কালচে সবুজ কাশ্মীরি শাল আর পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আছে সে। কাটা কাটা মুখ। দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিত হতে থাকা তানপুরার তারের মতো গভীর অথচ সুরেলা গলা।
—“আপনার নামটা তো ঠিক…”
—“অশ্বিনী। নিবারণবাবু আমার বাবা হন?” হৈমন্তীর দিকে না তাকিয়েই বলল ছেলেটা।
—“উনি কি গেছেন কোথাও?”
—“বাবা একটু অসুস্থ, বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না কদিন।”
—“এ বাবা! কী হয়েছে ওনার?”
—“পক্ষাঘাত, সম্ভবত বাঁচবেন না বেশিদিন।” হৈমন্তী থমকায়। ছেলেটার গলার স্বরে ভাবলেশের কোনও চিহ্ন নেই।বাপের সঙ্গে কি সম্পর্ক ভালো নয় ছেলেটার?
এতক্ষণে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছে দুজনে। অশ্বিনী এর মধ্যে একবারও ফিরে তাকায়নি ওর দিকে। বারদুয়েক কাঁধ থেকে সরে আসা শালটা ঠিক করেছে শুধু।
—“তিনতলার একটা ঘর বাবা আপনার জন্য পরিষ্কার করে রেখেছে। এতদিন ও ঘরে যিনি থাকতেন তিনি কিছুতেই ঘর ছেড়ে বেরোতে চাইছিলেন না। অগত্যা বাসিন্দাটিকে কাল সকালেই বাগানে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হল।” হৈমন্তীর বুক কেঁপে ওঠে, “কী বলছেন এসব! কে থাকত ওখানে?” – “একটা সাপ। চন্দ্ৰবোড়া, বাবা পুড়িয়ে ফেলেছে।” হৈমন্তী আর কিছু উত্তর দিতে পারল না। তেতলার সিঁড়ি পেরিয়ে প্যাসেজের উপরে এসে দাঁড়িয়েছে দু’জনে। অশ্বিনী ডানদিকটা দেখিয়ে বলল, “ওপাশের বারান্দার রেলিং নেই। ন্যাড়া হয়ে আছে। যাবেন না, আপনার ঘরটা বাঁদিকে… আসুন।”
—“এই বাড়িটার নাম এমন অদ্ভুত কেন বলুন তো?”
—“কেমন?”
—“এই যে ভাসানবাড়ি।”
—“হুম।” ছেলেটা যেন আগে থেকেই জানত প্রশ্নটা করবে হৈমন্তী,
—“জানেন নিশ্চয়, আজ থেকে দুশো বছর আগে এ বাড়ি তৈরি হয়। তার আগে একটা পুকুর ছিল এখানে। গোটা গ্রামের লোক ঠাকুর বিসর্জন দিত সেখানে৷ সেটাকে বলা হত ভাসানপুকুর, সেখান থেকে ভাসানবাড়ি। আসুন…”
ঘরের দরজা খুলে ভিতরের দিকে হাত দেখিয়ে ইশারা করল অশ্বিনী। হৈমন্তী ঢুকে এল ভিতরে।
—“কিছু যদি মনে না করেন…” একটু ইতস্তত করল হৈমন্তী, “আপনার ফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারি? আমারটা আসলে নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না।”
—“আমার কাছে নেই। ফোন আমি ব্যবহার করি না।”
হৈমন্তী এসে থেকে লক্ষ্য করছে অশ্বিনীর বয়সের তুলনায় তার আচার আচরণ বেশ গম্ভীর গোছের। পাট করে আঁচড়ানো মাথার চুল। একটা চুলেরও যেন সিঁথির এপাশ থেকে ওপাশে হেলে পড়ার অনুমতি নেই। ওজন করে কথা বলে। মুখের উপরে যে অভিব্যক্তি খেলে সেগুলোও যেন আগে থেকে যেন নিখুঁতভাবে মাপা হয়ে আছে।
—“আপনি আপাতত বিশ্রাম করুন, আমি একটু পরে এসে…”
—“তুমি হয়তো আমার থেকে অল্প ছোট হবে, আপনি বলার দরকার নেই, কেমন?” সহজ গলায় কথাগুলো বলল হৈমন্তী। অশ্বিনী ঘাড় নেড়ে নিচে নেমে গেল। হৈমন্তী ঘরের একদিকে জানলার কাছে সরে এসে নেটওয়ার্ক আনার চেষ্টা করল। লাভ হল না কিছু।
—‘পৌঁছে গেছি, নিবারণবাবু ইজ সিক, ওনার ছেলে আছে এখানে, এভ্রিথিং ইজ রাইট টিল নাও’- মেসেজটা টাইপ করে অস্মিতার নম্বরে ওয়াটস্যাপ করে রাখল। নেটওয়ার্ক এলে যাতে নিজে থেকেই ডেলিভারড হয়ে যায়।
আর একটা মেসেজ টাইপ করল, “জিনিসটা যদি কোথাও থেকে থাকে তো সেটা এ বাড়িতেই, কিছু জানতে পারলেই জানাব আপনাকে..’।
জানলার ধারে ফোনটা রেখে ঘরের দিকে তাকাল হৈমন্তী। দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে পাল্লা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। একদিকের দেওয়ালে একটা বড় আয়না ঝোলানো। সম্ভবত কদিন আগেই এনে রাখা হয়েছে সেটা। তবে অযত্নে আয়নার উপর জমা সরু ধুলোর পরত সরানো হয়নি। সেটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চুলের ক্লিপটা খুলে ফেলল। হৈমন্তী, তারপর শার্টটা। হাতের আলগা স্পর্শে সরিয়ে ফেলল ধুলোর আস্তরণ। আয়না জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার ফর্সা নরম চামড়ার উপরে গোটা তিরিশেক কালশিটের দাগ। বুক, পেট, কোমর চিরে চলে গেছে তারা। মুন্ড, ধড় আর পা ছাড়াও আরও অনেক ভাগে ভাগ করেছে হৈমন্তীর শরীরটাকে। দাগগুলোর উপরে আঙুল বোলাল সে। একটানা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নিজের মুখের দিকে।
ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে একটা চাদর টেনে শুয়ে পড়ল বিছানায়। শিরদাঁড়া, কোমর আর হাঁটু দুটো অবশ হয়ে পড়ছে। দু’চোখ জুড়ে ক্লান্তির ঘুম নামল তার।
ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ ভেঙে গেল ঘুমটা। মিহি একটা যান্ত্রিক শব্দ কোথাও থেকে এল মনে হল। বিছানার উপরে উঠে বসে আগে হাতঘড়ির দিকে তাকাল হৈমন্তী। ওই একটা জিনিস সে কিছুতেই শরীর থেকে আলাদা হতে দেয় না, কেবলমাত্র স্নানের সময়টুকু ছাড়া। রাত সাড়ে দশটা বাজে। হৈমন্তীর মনে হল তার খিদে পেয়ে গেছে।
যান্ত্রিক শব্দটা মোবাইলের। একটা মেসেজ এসেছে তাতে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে কয়েক মিনিটের জন্যে নেটওয়ার্ক এসেই চলে গেছে। তার মধ্যেই অস্মিতার রিপ্লাই ঢুকেছে—“হুম, নিবারণকাকার একটা ছেলে ছিল বটে, নামটা মনে পড়ছে না। কিছু অসুবিধা হলে জানাস কিন্তু।
ফোনটা আবার জানলাতেই রেখে আলো জ্বেলে সুটকেশ থেকে জিনিসপত্র বের করে ঘরের ভিতরে সাজিয়ে নেয় সে। আলনাটা গোছানো জামাকাপড়ে ভরে ওঠে। তার মধ্যে থেকে কলারওয়ালা একটা গেঞ্জি টেনে নেয়। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে নিচে নেমে আসে।
হৈমন্তীর ঘর ছাড়া বাকি দোতলাটা অন্ধকারে ঢেকে ছিল। বোঝা যায় কেউ নেই সেখানে। একতলায় নামতেই ছোটো একটা দালান। তার চারপাশ জুড়ে মোট আটটা ঘর। সিঁড়িটা যেখানে এসে শেষ হচ্ছে তার ঠিক উলটোদিকে একটা ঘরের ভিতর আলো জ্বলছে। সেদিকে এগিয়ে গেল হৈমন্তী। ঘরটা। ফাঁকা, তবে সেটা পেরিয়ে ভিতরে আর একটা ছোট ঘর আছে। সেখান থেকে আর একটা হালকা আলো ভেসে আসছে। সেদিকে এগিয়ে যায় হৈমন্তী। এবং দরজার সামনেটায় গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।
ঘরের একেবারে মাঝখানে একটা চেয়ার পেতে বসে আছে অশ্বিনী। তার ঠিক উলটোদিকে একটা বড় আয়না। সেটার দিকে তাকিয়ে আছে একমনে। হাতের আঙুল নড়ছে না কোনও, শরীরে কোনও স্পন্দন নেই যেন, পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে কিছু দেখছে আয়নায়। পিছন থেকে তার মুখ দেখতে পায় না হৈমন্তী। প্রায় মিনিট পাঁচেক ঠায় অপেক্ষা করে সে। ভারী অদ্ভুত ব্যাপার তো!
–“গুড ইভনিং…” গলায় উচ্ছ্বাস এনে কথাটা বলে ভিতরে ঢুকে আসে হৈমন্তী। চমকে উঠে দাঁড়ায় অশ্বিনী। হৈমন্তীর দিকে ফিরতেই তার মুখে কয়েকটা লজ্জার রেখা খেলে যায়,
—“ওঃ, আপনি…”
—“হ্যাঁ আমি, কেন? একতলায় আসা বারণ নাকি?”
—“না না…” ছেলেটা হেসে ওঠে, “কোথাও যাওয়া বারণ না।”
—“তাহলে রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিন প্লিজ, খিদেয় আর পারা যাচ্ছে না।”
ছেলেটা আরও লজ্জিত হয়ে ওঠে, “এঃ, খুব রাত হয়ে গেছে, তাই না? আসলে এখানে একা থাকি তো, সময়ের হিসেব থাকে না। আমি রান্না করেই রেখেছি, একটু দাঁড়ান।”
কথাটা বলে একগাল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অশ্বিনী। হৈমন্তী লক্ষ করে ছেলেটার হাসিটা ভারী সুন্দর। দুটো গজদাঁত আছে তার। হাসলে দাঁতের ঠিক উপরে একটা পাতলা চামড়া দেখা যায়। তাতে আরও শিশুসুলভ হয়ে ওঠে হাসিটা।
আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় হৈমন্তী। এতক্ষণ একমনে কী দেখছিল ছেলেটা? ঘরের যে জায়গায় চেয়ারটা রাখা আছে সেখান থেকে আয়নায় তাকালে, নিজেকে ছাড়া অন্য কিছু তো দেখতে পাওয়ার কথা নয়। মিনিট দশেক ধরে নিজের দিকেই তাকিয়েছিল? কিন্তু কেন?
হৈমন্তীর মনে হয় ছেলেটার মধ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে। নাকি এই বাড়িটাই এমন গোলমেলে? হতেই পারে, শ’দুয়েক বছর ধরে এত বড় একটা বাড়ি নিঃসঙ্গতায় খাঁ-খাঁ করছে। একসময় হয়তো বাড়িভর্তি মানুষের হাঁকডাক শোনা যেত, এখন একটি মাত্র আক্কুরে কেয়ারটেকার ছাড়া আর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
পাষাণবাড়ি ?