ভাসান
উপুড়ঝুপুড় তিনদিন বৃষ্টির পর যেইমাত্র ধরন হল, বিতুনদের বাড়ির ভিত জলের তলায়। আশপাশে যতগুলো বাড়ি আছে, তাদের মধ্যে একমাত্র বিতুনদের বাড়িটাই পাকা, বাকি সবই টালি বা টিন দিয়ে ছাওয়া মাটির বাড়ি। তাদের ভিতও এমন কিছু উঁচু নয়, তাই বিতুনের ভাবনা হচ্ছিল সেই বাড়িগুলোর জন্য কেন না এই বাড়িগুলোর কোনও কোনওটায় তার স্কুলের সহপাঠীরা থাকে।
গত রাতেই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে, সেই সঙ্গে ভীষণ ঝড়। সোঁ সোঁ করে আওয়াজ ভেসে আসছিল বন্ধ জানালা ভেদ করে। দাদা বলছিল, শুনছিস বিতুন, ঝড়ের মধ্যে ঘূর্ণি মেশানো আছে, নইলে এরকম ফাটা-বাঁশির মতো আওয়াজ হয় না!
ঘূর্ণি শব্দটা বিতুন কিছুটা আন্দাজ করতে পারে, কিন্তু চোখে দেখেনি কখনও।
দাদা বলছিল, ঘূর্ণির মধ্যে একটা খড় বা কুটো পড়লেও তা ঘুরতে শুরু করে লাট্টুর মতো। নদীর জলে এরকম ঘূর্ণির মধ্যে মানুষ পড়লে মানুষও সাঁতার কাটতে ভুলে যায়।
গাঁ-দেশে থাকে বিতুনরা। তাদের গাঁয়ের পাশ দিয়ে গেছে ফুলেশ্বরী নদী। নদী এখানে তেমন চওড়া তা নয়, কিন্তু বৃষ্টির কাল শুরু হতেই ক্রমশ জল বাড়তে থাকে, ছাপিয়ে যায় নদীর বুক, তখন অনেকখানি চওড়া দেখায় ফুলেশ্বরীকে। সেই ফুলেশ্বরীর জলে কখনও ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, দাদা দেখেছে, বিতুন দেখেনি।
ঝড়ের মধ্যে সেরকমই নাকি ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলে সোঁ সোঁ শব্দটা ক্রমে পরিণত হচ্ছিল ফাটা বাঁশি থেকে বেরোনো বিকট শব্দের মতো।
সেই ঝড়ের দৌরাত্মেরর ভিতর মাঝেমধ্যে এমন বাজ ডাকছিল, বিতুনের মনে হচ্ছিল তাদের বাড়ির ছাদেই পড়ছে বাজগুলো। বাড়ির দেওয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিল বাজ পড়ার শব্দে। একটু পরেই তাদের বাড়ির পাশেই ঝুপ করে একটা বড়ো ধরনের আওয়াজ হল, আর বাবা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল, যাহ।
বিতুন বুঝতে পারছিল না কীসের শব্দ। যেন বড়ো কিছু একটা পড়ল তাদের বাড়ির পাশে। দাদা জিজ্ঞাসা করল, কীসের শব্দ, মা?
মায়ের মুখ অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছিল না ওরা কেউ, কিন্তু মায়ের কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না, শুধু অন্ধকারের চাদর ভেদ করে তাঁর বুক থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটি দীর্ঘশ্বাস।
বিতুনের বয়স এই সাত পেরিয়ে আটে, এই বয়সকালের মধ্যে এরকম সাংঘাতিক বৃষ্টি সে দেখেনি। সারা রাত সে, তার দাদা নিতু, মা, বাবা— চারজনেই জেগে কাটিয়েছে। মা বারবার হাত জোড় করে ঠাকুরকে ডাকছিল, আর বলছিল, পবনদেব বোসো।
পবন মানে ঝড় তা বিতুন জানে, কিন্তু পবনদেবকে কেন মা বসতে বলছিল তা বুঝতে পারে না, দাদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কেন এরকম কথা বলল, মা?’ দাদার গলা ফ্যাঁসফ্যাঁস করছিল ভয়ে, আশঙ্কায়। দাদাও ঘাড় নাড়ছিল, সেও জানে না কথাটার মানে। বলছিল ঝড় থামলে কোনও একদিন জিজ্ঞাসা করে নেবে মাকে।
বিতুনেরও ভয় করছিল খুব, মনে হচ্ছিল এই বৃষ্টি, এই ঝড় বুঝি আর থামবে না কোনওদিন। কাল বিকেলেই তাদের উঠোন ভরে গিয়েছিল জলে, তখন তার খুব ইচ্ছে করছিল উঠোনে নেমে একটু জল ঘাঁটে, কিন্তু মা তাকে নিষেধ করেছিল, এখন একদম জলে নামবি নে।
বাবা সন্ধের দিকে বলছিল, যা বৃষ্টি হচ্ছে, বন্যা না হয়!
তখন ছিল উঠোনে জল। সারা রাত ভীষণ বৃষ্টির পর মধ্যরাতে বাড়ির ভিতও জলের তলায়। তখন বারান্দায় জল ঢুকি-ঢুকি করছে, বাবা মাকে বলল, মেঝেয় যা আছে, সব তাকের উপর খাটের উপর তুলে রাখো। মনে হচ্ছে ঘরে জল ঢুকবে।
বিতুনের তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই ঘরের মধ্যে জল ঢুকবে কি না! ঘরে জল ঢুকলে তারা বাস করবে কী করে! জলের মধ্যে থাকা যাবে নাকি!
কিন্তু মা-বাবা দুজনেই তখন প্রথমে রান্নাঘরে, পরে শোওয়ার ঘরের যা কিছু জিনিসপত্র ছড়ানো-ছিটোনো ছিল, সব টেনে টেনে তাকের উপর, খাটের উপর জড়ো করছে।
তাদের ব্যস্ততার মধ্যে দাদা এক ফাঁকে বারান্দায় গেল জল দেখতে। বিতুন চুপ করে বসে আছে তক্তাপোশের উপর, মেঝেয় পা দিতেও সাহস হচ্ছে না, কেন না তখন বারান্দায় একটু-একটু করে জল উঠছে। দাদা ভিজে পায়ে ঘরে ঢুকে বলল, জানিস, বিতুন, বিজুদের ঘরটা মাটিতে ধসে গেছে!
বিজুদের ঘরটা! বিতুন চমকে উঠল, ধসে গেছে মানে?
মাটিতে পড়ে গেছে। মুখ থুবড়ে রয়েছে সামনের দিকে।
কী করে?
রাতের ঝড়ে। সেই যে একটা শব্দ হল না ঝুপ করে!
বিতুন বুঝে ফেলল ব্যাপারটা। বিজুদা দাদার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। ওরা তিন ভাইবোন। বিজুর বোন লতু পড়ে বিতুনের সঙ্গে। ওদের আরও একটা ছোট্ট বোন হয়েছে কিছুদিন হল। দাদার কথা শুনে চমকে উঠল তৎক্ষণাৎ, জিজ্ঞাসা করল, আর বিজুদারা?
দাদা মাথা নাড়ে, জানে না বিজুদারা কোথায়!
বিজুদাদের বাড়িটা একটা ছোট্ট চালাঘর, খুব গরিব ওরা। ওর বাবা শুধু চাষবাস করে বলে বিতুনদের সঙ্গে ওদের একটা দূরত্ব রয়েই গেছে বরাবর। বিতুনের বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার, তাই ওর বাবা সযত্নে একটা দূরত্বের সৃষ্টি করেছেন বিজুদের থেকে তা বিতুনের বুঝতে অসুবিধে হয় না। তবু লতু তার সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে বলে লতুর সঙ্গে তার একটু ভাব আছে, কিন্তু সেটা স্কুলের গণ্ডির মধ্যে।
তাদের সঙ্গে দূরত্ব আছে বলেই বিজুদার বাবা এত ঝড়জলের মধ্যেও তাদের বাড়িতে আশ্রয় চাওয়ার কথা ভাবতে পারেনি। সবাই মিলে নিশ্চয় নদীবাঁধের উপর গিয়ে ভিজেছে সারা রাত!
বাবা-মা যতক্ষণে ঘরের মেঝের জিনিসপত্র নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে ফেলেছে, বারান্দার জল একটু একটু করে ঢুকেছে ঘরের ভিতর। ততক্ষণে বাইরে একটু-একটু ভোর। বৃষ্টির ধরন হয়েছে, কিন্তু তখনও পর্যন্ত হাওয়ার দাপানির রেশ রয়ে গেছে, তার ঝাপট আছড়ে পড়ছে বড়ো কাঁঠালগাছটায়। খোলা দরজা দিয়ে যেটুকু পৃথিবী চোখে পড়ছে বিতুনের, তাতে দুটো নারকেল গাছ একবার ঝুঁকে পড়ছে সামনের দিকে, একবার পিছনে।
মা ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, কী হবে যদি জল আরও বাড়ে। আমাদের ছাদে যাওয়ার সিঁড়িও নেই যে, ছাদের উপরে গিয়ে উঠব।
বাবারও চোখে পড়ছিল হাওয়ার দুলুনিতে উঠোনে জমা জলে ছোটো ছোটো ঢেউ উঠছে, সেই ঢেউয়ে ঢেউয়ে জল ঢুকছে ঘরের ভিতর। বিতুনেরও মনে হল জল যদি আরও বাড়ে, যদি তাদের এই তক্তাপোষটা ডুবে যায় জলের তলায় তারা তখন কোথায় গিয়ে উঠবে, না কি ডুবে যাবে জলের মধ্যে!
বিতুন সাঁতার জানে না, তার দাদা জানে। তার দাদা অনেকবার বলেছে, ‘চল বিতুন, ফুলেশ্বরী নদীতে আমাদের সঙ্গে সাঁতার শিখবি।’, কিন্তু বিতুনের আবার জলে খুব ভয়। সাঁতার শিখতে গিয়ে যদি ডুবে যায়!
সেই জল এখন একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে তাদের ঘরের মধ্যে। বিতুন যেমন নদীকে ভয় করত, তেমনি তাকে ডুবিয়ে দিতে নদীই এসে ঢুকে পড়েছে তাদের ঘরে। বিতুন ভয়ার্ত চোখে তাকায় একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের দিকে। মা সাঁতার জানে, এ-কথা মা অনেকবার বলেছে তাদের সঙ্গে গল্প করতে-করতে। বাবা তো জানেই, শুধু বিতুনই জানে না সাঁতার। এখন যদি তাদের ঘর ভরে যায় নদীর জলে, তাহলে সে কী করবে! সে কি ডুবে যাবে জলের মধ্যে!
বিতুন শুনছিল বাবার কথা, নদীবাঁধ ভেঙে গেলে গ্রাম তো ভাসবেই জলে। এখন কী উপায়!
মা বলল, জল কি আরও বাড়তে পারে?
পারেই তো। আমাদের এই ময়নামতী গ্রামটা কড়াইয়ের মতো। সারা এলাকার জমা জল এসে ভরে দেয় আমাদের গ্রামটা।
তাহলে কী হবে!
মায়ের শঙ্কিত প্রশ্নের উত্তরে বাবা কোনও জবাব দেয় না। বাবা গালে হাত দিয়ে বসে আছে তক্তাপোশের কোণে। তার পা-দুটো মেঝেয় জলের মধ্যে ডোবানো। বিতুন দেখছিল জল ক্রমশ বাড়ছে, বাবার পায়ের গোছ পেরিয়ে আরও খানিকটা উপরে উঠেছে জল। বিতুন বুঝতে পারে তার বুকের মধ্যে ঢিবঢিব করছে আতঙ্কে।
বিতুন ফ্যাঁসফেঁসে গলায় জিজ্ঞাসা করল, দাদা, বিজুদারা সব কোথায় গেল?
দাদার কণ্ঠেও ভয়, কী জানি, তুই তো শুনলি, বাবা একটু আগে মাকে বলছিল গ্রামের সব লোক নদীবাঁধে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে মাঝরাত থেকে।
বিতুন শুনতে পাচ্ছিল অনেক দূর থেকে হইহল্লার শব্দ আসছে, নিশ্চয় নদীবাঁধের দিক থেকে। বাবা মাঝেমধ্যে বলত, ‘নদীর ধারে বাস, ভাবনা বারোমাস।’ এর আগেও কয়েকবার নদীবাঁধ ভেঙে জল ঢুকেছে গাঁয়ের মধ্যে, কিন্তু তাতে চাষের জমির ক্ষতি হয়েছে, নদীর জলে ডুবে থেকেছে ধান-বোনা জমি। সেই জল কয়েকদিন পরে নামলে সবাই দেখেছে কচি সবুজ ধানে পচন ধরেছে।
বিতুনদেরও তিন বিঘে জমি আছে নদীর কাছে, কিন্তু সেই জমিও এখন একবুক জলের নীচে।
বিতুন ভাবার চেষ্টা করছিল বিজুদারাও কি নদীবাঁধে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখন! বিজুদার ছোট্ট বোনটা কোথায় এখন! সারা রাত বৃষ্টিতে কি অন্যদের সঙ্গে সেও ভিজেছে অসহায়ের মতো! বিজুদারা কেন তাদের বাড়িতে এল না! তাদের বাড়ির মধ্যে থেকে যেতে পারত ওরাও!
কিন্তু এসেই বা কী করত! তাদের বাড়িও তো ডুবে যাচ্ছে জলের নীচে!
বাবার হাঁটুতেও যখন জল এসে স্পর্শ করল বিতুন আবছা গলায় বলল, বাবা, কী হবে এখন?
বাবা বিতুনের দিকে তাকায়, বলল, দাঁড়া, যদি জল আরও একটু বাড়ে, সবাই ছাদে গিয়ে উঠব।
কী করে ছাদে যাবে বিতুনের ভাবনায় কুলোয় না। সে ভাবনা বাবার। বাবা একে-একে বিতুনকে আর দাদাকে কাঁধে নিয়ে জানলার কার্নিশে উঠবে, তারপর তুলে দেবে ছাদে। তারপর মা আর বাবা।
কিন্তু যদি ছাদে উঠতেই হয়, তাহলে আর দেরি করা কেন?
বাবা তখন মাকে বলছে, তুমি হাঁড়ি-কড়াগুলো কোথায় রেখেছ। কিছু চালডাল তুলে নিতে হত ছাদে।
মা তক্তাপোশের অন্য কোণে বসে আছে একমুখ ভয় মেখে। ঘরের মধ্যে এত জল ঢুকবে কে কবে ভেবেছে! গাঁয়ের মধ্যে যে কটা পাকাবাড়ি আছে, তাদের মধ্যে বিতুনদের একটা। তার বাবা স্কুলের মাস্টারি করে বলেই ছোটোখাটো হলেও তাদের একটা পাকাবাড়ি। সেই কারণেই তারা এখনও ঘরের মধ্যে বাস করতে পারছে, বিজুরা পারেনি। বিজুরা চলে গেছে নদীবাঁধের উপর।
বিজুর ছোটোবোনটার কথা ভেবে বিতুনের খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওর ফরসা রং বলে নাম রেখেছে বিবি। ওর মাও ফরসা কিনা! ওদের মোটে দু-বিঘে জমি, তাতে ভর-বচ্ছর খাওয়ার ধান হয় না। ওর বাবাকে ময়নামতীর বাজারে আরও কী কী কাজ করতে হয়!
বাবার হাঁটু পর্যন্ত জল এসে কী কারণে অনেকক্ষণ আর জলের বাড় হয়নি, অনেকক্ষণ পরে হাঁটু থেকে একটু নীচে জল। বাবা বলল, মনে হয় নদীর জলে ভাটা ধরেছে, তাই জল একটু একটু করে নামছে।
জল নামছে শুনে দাদা বিতুনকে বলল, বিতুন, আমরা বোধহয় বেঁচে গেলাম!
‘বেঁচে গেলাম’ শুনে বিতুনের বুকের ভিতর একটা অদ্ভুত অনুভূতি!
একটু পরেই বাবা বাইরে গেল, বাবার জল ঠেলে এগোনোর সময় পায়ের ছপছপ শব্দ শুনতে পাচ্ছিল বিতুন। বাবা কেন বাইরে গেল তা বুঝতে বিতুন ঝুঁকে পড়ে দেখছিল বারান্দার দিকে। দেখল একটা নৌকো ছপর ছপর দাঁড় টেনে যাচ্ছে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। তার পাটাতনের উপর কয়েকজন লোক। যারা দাঁড় বাইছিল, তাদের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে বলল, যাবেন নাকি, মাস্টারমশাই?
বাবা কী যেন ভাবলেন দু-এক মুহূর্ত, তারপর বললেন, জল নামছে মনে হচ্ছে। এখন যাব না।
তারপর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন অনেক কিছু। কিছুক্ষণ কথোপকথনের পর নৌকোটা চলে গেল গাঁয়ের ভিতর। বাবা বারান্দা থেকে দেখছিল সামনের বাড়িঘরগুলোকে। ফিরে এসে মাকে বলল, সমস্ত ঘর ডুবে আছে জলের তলায়! বেশিরভাগ মানুষ বাঁধের দিকে গেছে। বিষেণরা সব আমগাছের ডালে উঠে বসে ছিল। ওদের নামিয়ে নিয়ে এসেছে নৌকোয়। গাঁয়ের ভিতর থেকে বাকি সবাইকে নিয়ে গিয়ে এখন স্কুলবাড়িতে রাখবে। লঙ্গরখানা খোলা হবে দুপুর থেকে।
লঙ্গরখানা শব্দটা বিতুন কখনও শোনেনি। বাবা বলল, বড়ো বড়ো হাঁড়ি-কড়াইতে খিচুড়ি রান্না হবে। তাই সবাইকে দেবে দু-হাতা করে। আমার পক্ষে কি ফ্যামিলি নিয়ে লঙ্গরখানায় যাওয়া সম্ভব!
বাবা প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলে বিতুনদের পরিবারে একটা চাপা গর্ব আছে। সেই পরিবারের পক্ষে লঙ্গরখানায় অন্য সবার সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খাওয়ার অসুবিধের কথাটা অনুভব করল বিতুন।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তার মনে হয়েছিল জল আরও বাড়লে হয়তো তাদেরও চলে যেতে হতে পারে বাঁধের দিকে। নইলে মৃত্যু অবধারিত।
তখনও ছাদে ওঠার কথা ভাবতে পারেনি ওরা।
অথচ জল নামতে শুরু করায় যে-মুহূর্তে বুঝেছে তারা বিপদমুক্ত, তাদের সেই চাপা অহঙ্কার ফিরে এসেছে ভিতরে।
কিন্তু ঘরের ভিতর জল তো চট করে নেমে যাওয়ার নয়! বেলা ক্রমে বাড়তে থাকে। বাঁধের উপর কোলাহলের মাত্রাও বাড়তে থাকে তা ঘরে বসেই শুনতে পারছে ওরা। বিতুনের একটু-একটু খিদে পাচ্ছে এখন। অনেকখানি বেলা হয়ে গেছে, অন্যদিন এর অনেক আগেই তারা রুটি-গুড় খায়, এতক্ষণ জলের দৌরাত্মের খিদের কথা ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন খিদের কথা বলাই যাবে না।
কিন্তু মা ঠিক বুঝে গেছে বিতুন আর দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে। বলল, জল আর একটু নামুক। তাকে মুড়ির বয়াম তুলে রেখেছি, বাটি-বাটি করে দেব একটু পরে। শুধু মুড়ি খেতে হবে কিন্তু, গুড়ের বয়াম কোথায় রেখেছি কে জানে!
ঘরের মেঝে জলে ভর্তি, এ সময় শুধু মুড়ি পেলেই বর্তে যায় বিতুন।
হঠাৎ বারান্দা থেকে ঘুরে এসে শঙ্কিত কণ্ঠস্বরে বাবা বলল, দুলালদের ঘরটা ভেসে চলে গেল কোথায়!
মা আশ্চর্য হয়ে বলল, ঘরটাই ভেসে চলে গেল!
হ্যাঁ, এই সেদিন বলছিল দুলাল, এবার ধান-কাটা হয়ে গেলে চালে কিছু খড় না গুঁজলেই নয়। দেওয়ালটাও পলকা হয়ে গেছে।
বিতুনের যেন বিশ্বাস হয় না বাবার কথা। দুলাল মানে বিজুর বাবা। দু-বিঘে জমিই সম্বল ওদের। তাদের চালাঘরটা কমজোরি ছিল ঠিকই, কিন্তু সেই ঘরটা মধ্যরাতে ধসে পড়েছে ও সকালবেলায় সেই চালাঘরের সব কিছু ভেসে চলে গেল জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তা বিতুনের কাছে অবিশ্বাস্য।
তার তৎক্ষণাৎ মনে হল বিজুরা যখন বাঁধের উপর থেকে ফিরে আসবে, তাদের চালাঘরটা জায়গায় না দেখতে পেলে তাদের মনের অবস্থা কী হবে! ভাবনাটা ভেবে কেমন অস্থির বোধ করল বিতুন।
মা তখন তাদের মুড়ি দিতে ঘরের মেঝেয় ছপছপ করে ঘুরছে, কোথা থেকে বাটি খুঁজে নিয়ে এল, তাকের উপর বয়াম খুলে তাতে মুড়ি ঢালল দুজনের জন্য। বিতুন আর নিতু, দু-ভাইয়ের হাতে দুটো বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলল, নে খেয়ে নে। খুব খিদে পেয়েছে তোদের।
বিতুন বাটিটা হাতে নিয়ে বলল, তোমরা খাবে না?
আমরা পরে খাব। আমি তো সকালে কিছু খাইনে। তোর বাবাকে পরে দিচ্ছি।
বিতুন সবে মুখে তুলেছে এক গ্রাস মুড়ি, হঠাৎ বারান্দা থেকে একটু দূরে কী একটা ভাসতে দেখে খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল তার। ইচ্ছে করছিল বারান্দায় গিয়ে দৃশ্যটা দেখে ভালো করে। কিন্তু মায়ের বারণ শুনে তক্তাপোশ থেকে নামল না আর। জিজ্ঞাসা করল, ওটা কী ভাসছে মা?
মায়ের চোখে পড়েনি দৃশ্যটা। হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে কেমন চমকে উঠল মায়ের চোখ দুটো তা নজর এড়াল না বিতুনের। বিতুন দেখল বাবাও দৃশ্যটা দেখে কেমন নিথর হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। মা কিছুক্ষণ পরে বলল, ও কিছু না।
কিছু না? বিতুন সন্তুষ্ট হতে পারল না, বলল, ওই যে চুল দেখা যাচ্ছে!
মা অবলীলায় বলল, বুঝেছি। সেই যে দুগ্গাঠাকুরের ভাসান হয়েছিল না? নিশ্চয় সেই কাঠামোটা ভাসতে ভাসতে এসেছে এদিকে।
ভাসান হয়েছিল সেই আশ্বিন মাসে। এখন শ্রাবণ মাস।
নিশ্চয় অসুরের মূর্তিটা। দেখছিস নে কেমন ঝাঁকড়া চুল।
দূর থেকে হঠাৎ দেখলে তাই মনে হয়। পাড়ার দুর্গামণ্ডপের অসুরের মূর্তিটার কথাই মনে উপচে উঠল তার। এরকমই ঝাঁকড়া চুল ছিল বটে। অনেকক্ষণ সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে কেমন গা ছমছম করল বিতুনের। তার মুখে মুড়িগুলো থমকে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। এক-এক দলা মুড়ি খাওয়ার মধ্যে সেই অসুরের দেহটি জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে চলে গেল দৃষ্টির আড়ালে।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ তার দাদা নিতু সামনের রাস্তার জলে আবিষ্কার করল ভাসমান আর একটি মূর্তি। নিতু চমকে উঠে বলল, মা, ওই দ্যাখো, আর একটা—
বিতুনও দেখল সবুজ শাড়ি পরা আর একটি দেহ, ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, মা, ওটা কী?
ও কিছু নয়। নিশ্চয় মা দুর্গার কাঠামো এটা।
বিতুন থমকে গিয়ে বলল, কিন্তু আমাদের দুর্গাপুজোয় মা দুর্গা কি সবুজ শাড়ি পরেছিলেন? আমার মনে পড়ে, লাল।
মা তাকে ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে বলল, হয়তো অন্য পাড়ার ঠাকুর এটা। জলে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে এত দূর।
বিতুনদের চোখের সামনে দিয়ে সেই মূর্তিটাও ক্রমে চোখের আড়ালে।
বিতুনের তখনও প্রত্যয় হয়নি, দাদাকে জিজ্ঞাসা করল, দাদা, আমাদের মা দুর্গা লাল শাড়ি পরেছিল না? তোর মনে নেই?
নিতুর গলার স্বরও ফ্যাঁসফ্যাস করছে, কী জানি, হয়তো মনে নেই।
তার একটু পরেই একসঙ্গে দুটো মূর্তি, একজনের মাথায় ছোটো চুল, অন্যটির মাথায় বড়ো বড়ো চুল। বিতুনের বুকের ভিতর বড়ো বড়ো শ্বাস পড়ছে, মা, দ্যাখো, দ্যাখো, আরও দুটি মূর্তি।
তার মা সেদিকে চোখ রেখেই ফিরিয়ে নিল চোখ, বিতুন লক্ষ করল তার মায়ের স্বরও কেমন মিনমিন করছে, বলল, ঘরের মধ্যে চুপ করে বসে থাক। সব দেখার দরকার কী? হয়তো একটা কার্তিক, অন্যটা লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতী।
বিতুনের ঠিক পছন্দ হল না মায়ের উত্তর। বাবা কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার কোণে। দূর থেকে নদীবাঁধের উপর থেকে ভেসে আসছে কোলাহল। বেলা বাড়ছে ক্রমশ। সেই মূর্তিদুটোও ক্রমে চোখের আড়ালে। ততক্ষণে জল আরও একটু কমে। ভাটার টানে নেমে যাচ্ছে জল. আরও একটা নৌকো ছপর ছপর করে এল গাঁয়ের অন্যপাশ থেকে, একজন চেঁচিয়ে বলল, মাস্টারমশাই, আপনারা সবাই ঠিক আছেন তো?
বাবা ঘাড় নেড়ে জানলেন, হ্যাঁ।
মাস্টারমশাই, কত যে বাড়ি পড়ে গেল কাল রাতে তা আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। কত মানুষের সব্বোনাশ হয়ে গেল ঝড়বাদলায়!
নৌকোটা ক্রমে চোখের আড়ালে। বিতুনের বাবা তার ধুতির খুঁট হাঁটুর উপর তুলে দেখতে গেল বাড়ির পিছনদিকটা। একটা মস্ত পেঁপেগাছ ছিল, সেটা পড়ে যাওয়ার শব্দ এসেছিল রাতের বেলায়।
মা তখন হাঁটুজল ঠেলে রান্নাঘরে গিয়ে এটা-সেটা খুঁজছে। হয়তো ভাবছে দুপুরে কী রান্না করা যায় কিংবা আদৌ রান্না করা সম্ভব কি না এই জলের মধ্যে! সে সময় বিতুনের চোখে পড়ল তাদের বারান্দার কোণে কী একটা ভাসছে ছোট্ট মতো। বিতুনের বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল, দাদাকে জিজ্ঞাসা করতে দাদার মুখটাও ছোট্ট হয়ে গেল যেন, বলল, হয়তো ওটা গণেশের ইঁদুর হবে।
বিতুন বুঝল দাদাও সত্যি কথাটা বলছে না। ইঁদুর এরকম হবে কেন! ইঁদুরের মাথায় কি এরকম কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল থাকে!
বিতুন হঠাৎ ঝপ করে জলের মধ্যে নামে, ছপছপ শব্দ করে বারান্দার দিকে যায়, পিছন থেকে দাদার কণ্ঠস্বর শোনে, বিতুন, যাস নে বাইরে।
কিন্তু বিতুনের শরীরের ভিতরটা কেমন যেন করছিল, সে বারান্দায় গিয়ে জলে গেল সেইখানে সেখানে সেই কোঁকড়া চুলের ছোট্ট মাথাটা ভাসছিল। কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, দাদা, এ তো বিবি রে!