ভাসমান চিড়িয়াখানা (ছোট গল্প)
১৯২৮ সাল।
এস এস ফোর্সডেল নামক জাহাজটি ছুটে চলেছে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দিকে।
জাহাজের খোলা ডেকের উপর প্রকাশ্য স্থানে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই, কিন্তু একটু নজর করলেই দেখা যায় বিভিন্ন গোপনীয় স্থানে গা-ঢাকা দিয়ে নাবিকরা চারদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। তাদের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে আতঙ্কের আভাস।
আতঙ্কের কারণ খুব স্পষ্ট। জাহাজের সর্বত্র পদচালনা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক ভাল্লুক-দম্পতি এবং একজোড়া ভীষণ-দর্শনবাঘ! শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখেও নাবিকরা আশ্বস্ত হতে পারছে না, তারা দূর থেকেই উঁকিঝুঁকি মারছে কাছে এসে শ্বাপদের অহিংসায় বিশ্বাস স্থাপন করতে তারা রাজি নয়!
বাঘ-ভালুক ছাড়া আরও যে-সব জন্তু জাহাজের উপর এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একদল বাঁদর, কয়েকটি ব্যাজার নামক ভোঁদড় জাতীয় প্রাণী এবং একটি তুষার-চিতা।
সমুদ্রের উপর ভাসমান জাহাজের উপর হঠাৎ এতগুলো বন্যপশুর আবির্ভাবের কারণ জানতে হলে আমাদের পাঠ করতে হবে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার কাহিনি…
উক্ত প্রত্যক্ষদর্শীর লিখিত বিবরণ থেকে জানা যায় যে, এস এস ফোর্সডেল নামক জাহাজটি লন্ডনের চিড়িয়াখানা থেকে অনেকগুলো বন্য পশু নিয়ে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাত্রা করে। বন্দি পশুদের মধ্যে ছিল একজোড়া বিশাল ভালুক, একটি অজগর সাপ, একটি প্যান্থার, তুষার-চিতা, কয়েকটি ব্যাজার, একদল বাঁদর, বিভিন্ন ধরনের পাখি এবং এক জোড়া ভীষণ দর্শন বাঘ।
পিঞ্জর-আবদ্ধ পশুদের পর্যবেক্ষণ করে জাহাজের ক্যাপ্টেনের ধারণা হল জন্তুগুলোকে ধরে রাখার পক্ষে খাঁচাগুলো যথেষ্ট মজবুত নয়। ক্যাপ্টেনের প্রধান সহকারীও তাঁর সঙ্গে একমত হল কিন্তু অভিজ্ঞ নাবিকরা ক্যাপ্টেনের সন্দেহ অমূলক বলে তাকে আশ্বস্ত করল। নাবিকরা ক্যাপ্টেনকে জানাল যে এই ধরনের খাঁচায় বড়ো বড়ো জানোয়ার তারা ইতিপূর্বে বহু বার চালান দিয়েছে, খাঁচা ভেঙে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে তারা কখনো দেখেনি, অতএব ক্যাপ্টেন সাহেবের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
পরবর্তীকালে অবশ্য প্রমাণ হয়েছিল যে ক্যাপ্টেনের সন্দেহ নিতান্ত অমূলক ছিল না।
গোলমাল শুরু হল প্রথমে ব্যাজারদের নিয়ে। ভোঁদড়ের মতো আকৃতিবিশিষ্ট এই ক্ষুদ্রাকায় মাংসাশী প্রাণীগুলো এক রাতে হঠাৎ খাঁচার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ল এবং কোয়েল পাখির খাঁচার উপর আক্রমণ চালিয়ে খাঁচা ভেঙে অসহায় পাখিগুলোকে উদরস্থ করে ফেলল।
ব্যাজারগুলো পাখির খাঁচা ভেঙেছিল বটে, কিন্তু নিজেদের খাঁচা তারা ভাঙতে পারে নি। লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে শরীর গলিয়ে তারা মুক্তিলাভ করেছিল। এই ঘটনা থেকেই বোঝ যায় যারা খাঁচাগুলি তৈরি করিয়েছিল, তারা সমস্ত ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করেনি।
সকাল বেলা নাবিকরা যখন দেখল ব্যাজারের শূন্য পিঞ্জর অটুট অবস্থায় বিরাজ করছে এবং কোয়েল পাখির ভাঙা খাঁচার ভিতর রাশি রাশি পালক ছাড়া একটি পাখিরও অস্তিত্ব নেই, তখনই তারা সমস্ত ব্যাপারটা অনুমান করে নিল খুব সহজেই।
হত্যাকারীদের খোঁজ পড়ল তৎক্ষণাৎ কিন্তু ব্যাপারটা যত সহজ বলে প্রথমে মনে হয়েছিল, পরে দেখা গেল সেটা তত সহজ নয়। ব্যাজার নামক জটিকে অত্যন্ত হিংস্র না বলতে পারলেও তাকে নিতান্ত নিরীহ বলা চলে না। এই ছোটোখাটো মাংসাশী জানোয়ারটিকে শ্বপদ-গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্য করলে খুব ভুল হয় না এবং নখদন্তে সজ্জিত এই জীবটি তার অস্ত্র সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন। অতএব ব্যাজার খুঁজতে গিয়ে নাবিকরা যে খুব অস্বস্তি বোধ করছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এরইমধ্যে জনৈক নাবিক একটা ব্যাজারকে কোণঠাসা করে ফেলল কিন্তু শয়তান জানোয়ারটা নাবিকটির মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ফাঁসকরে উঠতেই লোকটি চমকে উঠে পথ ছেড়ে দিল এবং পরক্ষণেই তিরবেগে ব্যাজারটা স্থানত্যাগ করে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
নাবিকটি আর ব্যাজারের পিছনে ছুটতে রাজি হল না, সে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিল যে ব্যাজার-শিকার নাবিকের কর্তব্য নয়।
যখন এই ঘটনা ঘটে জাহাজ তখন ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। পরবর্তী ঘটনার সূত্রপাত হল ভারত মহাসাগরের বুকে।
ফোর্সডেল জাহাজ যখন ভারত সাগরের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে, তখন দেখা গেল ভালুক দুটি হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
ভারত সাগরের উষ্ণ আবহাওয়া জানোয়ার দুটি পছন্দ করল না, খেপে গিয়ে তার বারবার আঘাত হানতে লাগল খাঁচার উপর। জাহাজের অফিসাররা জাহাজ পরিচালনার কার্যে খুবই নিপুণ ছিলেন, কিন্তু ভাল্লুকের শক্তি ও খাঁচার দৃঢ়তা সম্বন্ধে তাদের জ্ঞান ছিল নিতান্তই সীমাবদ্ধ। অতএব বারংবার আঘাতের ফলে দুর্বল খাঁচাটা যে আরও-দুর্বল হয়ে এক সময়ে ভেঙে যেতে পারে এমন ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা তাদের মনেই হয় নি…
অবশেষে এক রাত্রে ভালুকদের মিলিত আক্রমণের মুখে খাঁচা গেল ভেঙে এবং বন্দিরা মুক্তিলাভ করে পরম-আনন্দে জাহাজের বিভিন্ন স্থানে টহল দিতে শুরু করল।
জনৈক নাবিক ওই সময়ে ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, আচম্বিতে তার সম্মুখে আবির্ভূত হল দুটি চলমান ছায়া!
রাত্রির অন্ধকার যাদের ছায়ার রূপ দিয়েছে তাদের দেখে নাবিকটি ভুল করল না– ওই ছায়ার সঙ্গে দু-দুটি ভাল্লুককে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অত্যন্ত নিরেট দুটি কায়ার অস্তিত্ব অনুমান করে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে।
ক্যাপ্টেনের এক সহকারী উপরের ডেকে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছিলেন, হঠাৎ নীচের ডেক থেকে ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে উপরে এসে হাজির হল পূর্বোক্ত নাবিক। সহকারীটি নাবিকের মুখে ভাল্লুক-ঘটিত সমাচার শ্রবণ করলেন; তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ল জাহাজের দিক-নির্ণয় যন্ত্র বা কম্পাসটা এই মুহূর্তে পরিদর্শন না করলে কর্তব্যের হানি হবে এবং ভালুকদের খবরে কিছুমাত্র কৌতূহল প্রকাশ না করে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে তিনি কম্পাসের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করতে বলে গেলেন।
ইতিমধ্যে নাবিকটিকে অনুসরণ করে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে একটি ভালুক। খুব সম্ভব লোকটির সঙ্গে সে আলাপ করতেই চেয়েছিল, কারণ ভালুকের আচরণে নির্দোষ কৌতূহল ছাড়া কোনো বিরূপ-ভাব প্রকাশ পায় নি। নাবিকটি কিন্তু চতুস্পদ সহযাত্রীর সদিচ্ছায় বিশ্বাস করতে পারল না, তার চোখে-মুখে ফুটল দারুণ আতঙ্কের আভাস।
ভালুকটা বোধহয় নাবিকের ভাবভঙ্গিতে তার মনোভাব অনুমান করতে পেরেছিল; সে বুঝে নিল এই ভীরু অসামাজিক মানুষটা তার বন্ধুত্বের যোগ্য নয়। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাবিকের সান্নিধ্য ত্যাগ করে ভাল্লুক সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেল সঙ্গীর কাছে।
ইতিমধ্যে বেজে উঠেছে জাহাজের বিপদ-জ্ঞাপক ঘণ্টা এবং নাবিকরা সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে অকুস্থলে। ভালুক দুটিকে দেখে নাবিকরা বিশেষ ভয় পায়নি, বরং তাদের মধ্যে একটা মজা দেখার মনোভাবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই এমন গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে আনন্দের পরিবর্তে নাবিকদের মধ্যে সঞ্চারিত হল অস্বস্তি ও আতঙ্ক।
একটি ভালুক হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে বাঘের খাঁচার উপর আক্রমণ চালাল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই খাঁচা ভেঙে গেল এবং ডোরাকাটা জানোয়ার দুটি জাহাজের সর্বত্র পায়চারি করতে লাগল। মনে হল সমুদ্রের মুক্ত বায়ু তারা দস্তুর মতো উপভোগ করছে। কিন্তু এক জোড়া ভালুক এবং দু-দুটি বাঘের সাহচর্য নাবিকদের কাছে মোটেই উপভোগ্য হয় নি শাপদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের নীতিতে তারা আদৌ বিশ্বাসী নয়।
ক্যাপ্টেনের আদেশে অফিসাররা বন্দুক-রিভলভার নিয়ে নাবিকদের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হলেন।
বাঘদের মুক্তি দিয়ে ভালুকরা ক্ষান্ত হল না, চটপট আরও কয়েকটা খাঁচার উপর আক্রমণ চালিয়ে তারা অনেকগুলো জানোয়ারকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিয়ে জাহাজটাকে করে তুলল বন্য পশুদের বিচরণ ভূমি!…
একটা বাঘ হঠাৎ তার আশে-পাশে অবস্থিত দ্বিপদ জীবদের বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠল। ডেকের উপর দণ্ডায়মান এক অফিসার সচমকে দেখলেন তার দিকে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে এক বিপুলবপু ব্যাঘ্র!
জাহাজের অফিসার বাঘের সান্নিধ্য পছন্দ করলেন না, চটপট খাপ থেকে রিভলভার টেনে নিয়ে গুলি চালিয়ে দিলেন।
গুলি বাঘের দেহ স্পর্শ করল না বটে কিন্তু ভদ্রলোকের নিশানা একেবারে ব্যর্থ হয়েছে এ কথা বলা যায় না, কারণ ডেকের অপর প্রান্তে অবস্থিত বিড়ালটা গুলি খেয়ে মারা পড়ল তৎক্ষণাৎ!
রিভলভারের গর্জন এবং চকিত অগ্নিশিখার অভ্যর্থনা বাঘের ভালো লাগল না, গম্ভীর ভাবে স্থান ত্যাগ করে সে অন্যদিকে চলে গেল, ভদ্রলোকও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।
ক্যাপ্টেন এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা এইবার জন্তুগুলোকে বন্দি করার উদযোগ করলেন। মি. দেওয়ার নামক জনৈক ইঞ্জিনিয়ার বাঘ-ভালুকদের দড়ির ফাস বা ল্যাসো দিয়ে ধরতে চাইলেন। কিন্তু জাহজের সারেং বাঘ দুটিকে ধরার জন্য যে উপায় অবলম্বন করল সেটা হচ্ছে আরও নিরাপদ আরও সুন্দর। তার পরামর্শ অনুযায়ী জাহাজের ছুতোরকে দিয়ে একটা মজবুত খাঁচা তৈরি করানো হল, তারপর খাঁচার ভিতর রেখে দেওয়া হল ভেড়ার মাংস। কিছুক্ষণের মধ্যে মাংসের লোভে দুটি বাঘই খাঁচার ভিতর প্রবেশ করল এবং নাবিকরা যে সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সেটা অবশ্য বলাই বাহুল্য।
বাঘ দুটিকে যখন বন্দি করা হচ্ছিল তখন দুটি ভালুকই আগ্রহের সঙ্গে নাবিকদের কার্যকলাপ লক্ষ করছিল। জাহাজের ছুতোর এইবার খুব পুরু কাঠের সাহায্যে একটা উঁচু ও মজবুত পাঁচিল তৈরি করে ফেলল এবং সেই কাষ্ঠ প্রাচীরের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে নাবিকরা সবাই মিলে প্রাচীরটাকে ঠেলতে ঠেলতে অধিকাংশ জন্তুকেই কোণঠাসা করে ফেলল। সেখান থেকে জানোয়ারগুলিকে তাড়িয়ে খাঁচায় বন্ধ করতে বিশেষ অসুবিধা হয় নি। কিন্তু একটা ভালুক কাষ্ঠ প্রকারের উপর দিয়ে প্রকাণ্ড লাফ মেরে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালিয়ে গেল।
পলাতক ভালুকটাকে বন্দি করার জন্য দড়ির ফাস হাতে এগিয়ে এলেন মি. দেওয়ার। কিন্তু গলায় ফাস পড়তেই ভালুকটা ছুটতে শুরু করল এবং দড়ি হাতে মি. দেওয়ার হলেন ডেকের উপর লম্বমান!
ভালুকের প্রবল আকর্ষণে ডেকের উপর শায়িত অবস্থায় গড়াতে লাগলেন মি. দেওয়ার। ডেকের উপর গড়াগড়ি দিতে মি. দেওয়ারের ভালো লাগেনি বলাই বাহুল্য, এমন অবস্থায় পড়লে যে কোনো ভদ্রলোক যা করে তিনিও তাই করলেন অর্থাৎ দড়িটা হাত থেকে ছেড়ে দিলেন। বন্ধনমুক্ত হয়েই ভাল্লুক চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল এবং একটু দূরেই জাহাজের রাঁধুনিকে দেখে তার দিকেই তেড়ে গেল। রাঁধুনি-বেচারা মজা দেখতে এসেছিল, ভালুকটা যে মি. দেওয়ারের দড়ির ফাঁস থেকে মুক্তিলাভ করতে পারে একথা তার মনেই হয়নি। রাঁধুনির হাতে ছিল এক হাঁড়ি তরল ও উত্তপ্ত সিদ্ধ চর্বি। ভালুককে তেড়ে আসতে দেখেই সে আর্তনাদ করে চর্বির হাঁড়ি ফেলে চম্পট দিল। ভালুক রাঁধুনিকে নিয়ে মাথা ঘামাল না, জাহাজের ডেকের উপর যেখানে হাঁড়ির থেকে গরম চর্বি গড়িয়ে পড়ছিল তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল সেই দিকে। জন্তুটার বোধ হয় খুব খিদে পেয়েছিল, সে এক হাঁড়ি চর্বি উদরস্থ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ইতিমধ্যে মি. দেওয়ার নিজেকে সামলে নিয়েছেন এবং দড়ির ফঁসটা নিয়ে আবার অগ্রসর হয়েছেন ভালুকের দিকে। এইবার তিনি যথেষ্ট সাবধান হয়েছিলেন, তাই ভাল্লুকটা প্রাণপণ চেষ্টা করেও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। জন্তুটা অত্যন্ত ভীষণভাবে মি, দেওয়ারকে আক্রমণ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সমবেত নাবিকদের সাহায্যে মি. দেওয়ার তাকে খাঁচার ভিতর বন্দি করে ফেললেন।
বাঘ-ভালুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুগুলো আবার বন্দি হল বটে কিন্তু বানরের দল তখনও ধরা পড়েনি। অনেক কষ্টে বাঁদরগুলিকেও নাবিকরা বন্দি করল বটে কিন্তু একটা হতচ্ছাড়া বাঁদর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে জাহাজের উপর মুক্ত অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কোনো রকমেই তাকে ধরতে না পেরে ক্যাপ্টেন সাহেব ঘোষণা করলেন অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে পৌঁছোনোর আগেই বাঁদরটাকে জীবিত অথবা মৃত যে কোনো অবস্থাতেই তোক ধরতে হবে। আদেশটা খুব নিষ্ঠুর মনে হলেও ক্যাপ্টেনকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ কোনো বন্য প্রাণীকে মুক্ত অবস্থায় জাহাজের উপর বিচরণ করতে দেখলে অস্ট্রেলিয়ার আইন জাহাজের কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা করবে না এবং সে রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে সবচেয়ে বেশি দায়ী হবেন স্বয়ং ক্যাপ্টেন।
অতএব দেখা যাচ্ছে ক্যাপ্টেন বাঁদরটার সম্বন্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে জন্তুটা অবশ্য ধরা পড়েছিল, তাকে গুলি করে মারার দরকার হয়নি। বাঁদরটাকে ধরতে গিয়ে যে সব ঘটনার সৃষ্টি হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ একটি ঘটনার বিবরণী দিয়ে এই কাহিনিটি আমি শেষ করব…
সবে ভোর হয়েছে। অন্ধকার তখনও পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করেনি, আকাশের পূর্ব প্রান্তে জেগে উঠেছে রক্তিম আলোকের আভাস…
সূর্য উঠতে তখনও বেশ দেরি আছে।
এমন সময়ে ডেকের উপর এসে দাঁড়ালেন মি. দেওয়ার এবং একজন অফিসার। তারা দুজনে নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কথাবার্তা বলছিলেন, অকস্মাৎ জাহাজের অপর প্রান্ত থেকে এল এক নিদারুণ আর্তনাদ!
কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে একটু এগিয়ে যেতেই তাদের চোখে পড়ল দ্রুতবেগে ধাবমান একটা সাদা টুপি এবং সাদা অ্যাপ্রন! প্রথমটা চমকে গেলেও খানিক পরেই তারা বুঝলেন একটি মানুষ তাদের দিকে ছুটে আসছে। লোকটির দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্ধকারের গর্ভে আদৃশ্য, দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কেবল সাদা টুপি আর সাদা অ্যাপ্রন। ধাবমান মানুষটি নিকটবর্তী হতেই মি. দেওয়ার ও তার সঙ্গী তাকে চিনতে পারলেন।
জাহাজের বাবুর্চি!
সামনে মানুষ দেখে বাবুর্চি একটু আশ্বস্ত হল, মুখে কেবল তার একটি শব্দ ভূত! ভূত!
মি. দেওয়ার ও তার সঙ্গীটিকে বাবুর্চি যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে এই যে প্রতিদিনের মতো সেই দিনও সে প্রাতরাশ তৈরি করার জন্য রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল।
হঠাৎ অন্ধকারের ভিতর থেকে যে জীবটি আত্মপ্রকাশ করল সেটা যে একটা আস্ত ভূত সে বিষয়ে বাবুর্চির বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভূতটা ঠিক ভূতের মতোই ব্যবহার করেছিল অর্থাৎ তেড়ে এসেছিল বাবুর্চির দিকে এবং বলাই বাহুল্য যে বাবুর্চিও তিরবেগে পা চালিয়ে দিতে একটুও দেরি করেনি। ভূত আর মানুষের দৌড় প্রতিযোগিতায় বাবুর্চিই জয়ী হয়েছে, তাই এ যাত্রা তার প্রাণটা বেঁচে গেছে কোনো রকমে।
মি. দেওয়ারের সঙ্গী অফিসার রাঁধুনির বিবরণী শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। মি. দেওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ভূতটাকে যে দিকে দেখা গেছে সেই দিকে পদচালনা করলেন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল পূর্বোক্ত রাঁধুনি।
একটু পরেই অস্পষ্ট অন্ধকারের মধ্যে তাদের দৃষ্টিগোচর হল একটা ছায়ামূর্তি এবং এক জোড়া জ্বলন্ত চক্ষু। ছায়ামুর্তিটা এক লাফ মেরে ডেকের উপর গিয়ে পড়ল, তারপর তরতর করে একটা মাস্তুল বেয়ে একেবারে ডগার উপর আশ্রয় গ্রহণ করল। মি. দেওয়ার বুঝলেন জীবটি মোটেই অশরীরী নয়, সে হচ্ছে অত্যন্ত নিরেট দেহের অধিকারী একটি বাঁদর! এই জন্তুটাই নাবিকদের ফাঁকি দিয়ে নিজের স্বাধীনতা এত দিন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। মি. দেওয়ার এই পলাতক আসামীকে গ্রেপ্তার করার জন্য উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ডেকের উপর ছড়ানো কয়েকটা কাঠের টুকরো তুলে নিয়ে মি. দেওয়ার মাস্তুল বেয়ে খানিকটা উপরে উঠে গেলেন, তারপর সেই টুকরোগুলো ছুঁড়তে লাগলেন বাঁদরটার উদ্দেশ্যে। প্রথম টুকরোটা লাগল না, দ্বিতীয় বারের চেষ্টাও হল ব্যর্থ, কিন্তু তৃতীয় বারে নিক্ষিপ্ত কাষ্ঠখণ্ডটা অব্যর্থ লক্ষ্যে গিয়ে পড়ল বানরটার দেহের উপর! আঘাতটা বেশ জোরেই লেগেছিল, কারণ জন্তুটা মাস্তুলের উপর থেকে স্থানচ্যুত হয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে।
মি. দেওয়ার ভেবেছিলেন অত উঁচু থেকে পড়ে নিশ্চয়ই বাঁদরটার সর্বাঙ্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, কিন্তু জন্তুটা পড়তে পড়তে মাস্তুলের গায়ে জড়ানো একটা দড়ির সঙ্গে লেজটাকে জড়িয়ে দিয়ে আত্মরক্ষা করল!
মি. দেওয়ার সবিস্ময়ে দেখলেন তিনি মাস্তুলের যে অংশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার একটু দুরেই ইংরেজি ক্রস চিহ্নের মতো মাস্তুলের অপর অংশে আশ্রয় নিয়েছে বাঁদরটা।
জন্তুটা এবার প্রতিআক্রমণ করল। বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এসে মাস্তুলের গায়ে আটকানো এক টুকরো কাঠ খুলে নিয়ে সজোরে নিক্ষেপ করল মি. দেওয়ারের দিকে।
বাঁদুরে হাতের নিশানা ভুল হয় নি—
ঠাস করে মি. দেওয়ার সাহেবের মাথার উপর এসে পড়ল কাঠের টুকরোটা।
মি. দেওয়ার আঘাতটা সামলে নিয়ে কিছু করার আগেই বাঁদরটা সাঁৎ করে এগিয়ে এসে শত্রুর গণ্ডদেশে করল এক চপেটাঘাত।
দারুণ ক্রোধে মি. দেওয়ার সাহেবের চৈতন্য যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল, তিনি বানরটার গালের উপর বসিয়ে দিলেন প্রচণ্ড চড়!
তারপর কিছুক্ষণ ধরে চলল নর ও বানরের মধ্যে চপেটাঘাতের আদান-প্রদান।
নীচে ততক্ষণে নাবিকরা প্রায় সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু এই বিচিত্র দৃশ্যটি তারা বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারল না। মি. দেওয়ারের সঙ্গী অফিসারটি বানরের অগোচরে মাস্তুল বেয়ে উঠে তাকে চট করে জড়িয়ে ধরলেন তারপর দুজন মিলে জন্তুটাকে নামিয়ে আনলেন ডেকের উপর। তারপর আর কি? খুব সহজেই বানরটাকে একটা খাঁচার মধ্যে ভরে দেওয়া হল। জাহাজের নাবিকরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল..
কয়েক ঘণ্টা পরের কথা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ফ্রি-ম্যান্টল বন্দরে প্রবেশ করল ফোর্ডস ডেল নামক জাহাজটি।
আশা করি আপনাকে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় পড়তে হয় নি?ক্যাপ্টেনকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করলেন শুল্ক ভবনের জনৈক কর্মচারী।
নাঃ, তেমন আর কি! কয়েকটা জানোয়ার অবশ্য খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে পড়েছিল, তবে সেগুলোকে আমরা আবার আটকে ফেলেছিলাম।
খুব শান্ত ও স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন।