ভাষা

ভাষা

হাট-বাজার, শাক-সবজি(১), দান-খয়রাত, দুখ-দরদ, ফাঁড়া-গর্দিশ, মান-ইজ্জৎ, লজ্জা-শরম, ভাই-বেরাদর, দেশ-মুল্লুক, ধন-দৌলত, রাজা-বাদশা, ঝড়-তুফান, হাসি-খুশি, মায়া-মহব্বৎ জন্তু-জানোয়ার, সীমা-সরহদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ-স্থলে লক্ষ করার প্রথম তত্ত্ব এই যে, প্রত্যেক সমাসের প্রথম শব্দটি খাঁটি দিশি ভারতীয় শব্দ; হাট, শাক, দান, দুখ, মান, লজ্জা, দেশ ইত্যাদি এবং দ্বিতীয় শব্দটি যবনিক (আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিব্রু গয়রহ), যেমন বাজার, সবজি, খয়রাৎ, দর্দ ইত্যাদি। এবং দুটি শব্দই প্রায় সমার্থসূচক।

তা হলে প্রশ্ন, এ ‘কুকর্মের’ কী প্রয়োজন?

আমরা যখন সাধারণের কোনও অজানা ভাষা থেকে উদ্ধৃতি দিই, তখন বাংলা অনুবাদটি দিই তার পরে। তাই আমরা যদি ইংরেজি প্রবন্ধে সংস্কৃত বা বাংলা উদ্ধৃতি দিই তবে ইংরেজি অনুবাদটি দিই পরে। অর্থাৎ যাকে বোঝাতে যাচ্ছি, তার ভাষা আসে পরে।

তা হলে মনে করুন, মুসলমানের আগমনের কিছুকাল পরে কোনও হিন্দু (বা নবদীক্ষিত মুসলমানও হতে পারে কারণ হিন্দু ধর্মবর্জন করে মুসলমান হয়ে গেলে রাতারাতি তার আরবি-ফার্সি রপ্ত হয়ে যায় না) গেল মুসলমান শাসনকর্তার কাছে বিচারের আশায়। বললে, ‘ধর্মাবতার’, হুজুর! দেশ–’ বলেই থমকে দাঁড়াল। ভাবলে হুজুর কি “দেশ” শব্দটা জানেন! হুজুর তো হাট-বাজারে ঘোরাঘুরি করে দেশি শব্দ শেখবার ফুসৎ পান না’–(অথচ আমাদের হিন্দুটি পেটের দায়ে, কাজের তাড়ায় বিদেশাগত মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে কিছু কিছু যাবনিক শব্দ শিখে গিয়েছে। তাই ‘দেশ’ বলে থমকে গিয়ে বললে ‘মুল্লুক’– ওটা হুজুরের যাবনিক শব্দ। অতএব শেষ পর্যন্ত তার নিবেদন দাঁড়াল, ‘দেশ-মুলুক ছারখার হয়ে গেল। রাজা-বাদশা (আবার রাজা বলে থমকে গিয়ে যাবনিক “বাদশা” বললে) আমাদের মতো কাঙাল-গরিবের (গরিব আরবি), দুখ-দরদ (দরদ, দর্দ ফার্সি) কে বুঝবে? আমাদের মান-ইজ্জৎ (ইজ্জৎ আরবি) ধনদৌলত (দৌলত যাবনিক) সব গেল। মেয়েছেলের লজ্জা-শরম (শর্ম যাবনিক)-ও আর বাঁচে না। রাস্তায় বেরোলেই দেখতে পাবেন, কারও মুখে হাসি-খুশি (খুশি ফার্সি) নেই। হুজুর অনুমতি দেন– ভাই-বেরাদর (বেরাদর ফার্সি) নিয়ে মগের মুল্লুকে চলে যাই।’

মনে করুন, কথার কথা কইছি, হুজুর সত্যকার হুজুর ছিলেন। হুঙ্কার দিয়ে প্রতিবিধান করলেন।

আমাদের বঙ্গসন্তানটি বাড়ি ফিরে গৃহিণীকে আনন্দে ডগমগ হয়ে বললে, ‘বুঝলে গিন্নি হুজুর যা আমায় খাতির–’(বলেই থমকে দাঁড়াল : হুজুরের দরবারে ‘খাতির’ কথাটি খুবই চালু, সেইটেই এতক্ষণ ধরে দরবারে সে শুনেছে, তাই দুম্ করে সেটা ব্যবহার করে দুশ্চিন্তায় পড়ল, গিন্নি তোে যাবনিক শব্দটা বুঝবে না, গিন্নি তো হাট-বাজারে গিয়ে যবনের সঙ্গে মেলামেশা করে এসব শব্দ শেখেনি– তাই সঙ্গে সঙ্গে বললে)—’যত্ন– হুজুর যা খাতির-যত্ন করলেন কী বলব। আবার দোকান (ফের মুশকিল– দোকান ফার্সি শব্দ, তাই বললে “হাট” হিট্ট হাট খুলবে, কোনও চিন্তা করো না গিন্নি! নারায়ণ, নারায়ণ।’

এ যুগে আবার ফিরে আসব। কিন্তু তার পরবর্তী যুগে দেখুন, ইংরেজ boss-কে বলছি, ‘স্যার! আমি উকিল (বলে থমকে দাঁড়ালুম, উকিল যদ্যপি আসলে আরবি শব্দ, এদানির ইটি খাঁটি বাংলা, স্যার কি বুঝবেন? তাই হন্তদন্ত হয়ে বললুম) ব্যারিস্টার (উকিল-ব্যারিস্টার) লাগিয়েছিলুম, ঘটি (ওই যযা! স্যার বুঝবেন কি?) গেলাস (glass= এবার স্যার বুঝবেন!) ঘটি-গেলাস বন্ধক দিয়েছি তেনাদের জন্য এরেক (ফের ইংরেজি ‘ব্রান্ডি’) ব্রান্ডি, বিড়ি-সিগারেট (দ্বিতীয়টা ইয়োরোপীয়) যা গেছে সে আর বলে কাজ নেই।’

এইসব বলে-কয়ে তো ছুটি নিয়ে দেশে গেলুম। প্রথমেই ঠাকুরমাকে পেন্নাম।

বললুম,’ ঠাকুমা’ পরে সব গুছিয়ে বলব, এই বেলা শুনে নাও সংক্ষেপে। বড় মাসীর গুণধর ছোটভাইটি নিয়েছেন ফ্ল্যাট (আবার সেই হাঙ্গামা– ঠাকুমা তো ‘ফ্ল্যাট’ বুঝবে না, অতএব বললুম) ফ্ল্যাট-বাড়ি। আমাদের কাউকে না শুনিয়ে করেছেন বিয়ে। কিন্তু ঠাকুমা, মেয়েটি কী সুন্দর। এক্কেবারে ডল (dool–সর্বনাশ, ঠাকুমা তো বুঝবে না, তা হলে ‘পুতুল’ বলি)– পুতুলের মতো। কিন্তু হলে কী হয়! গুরু আছেন, ধম্মো আছেন। ব্যস! এল তেড়ে টাইফয়েড-জ্বর (টাইফয়েড তো জ্বরই বটে– তবু ঠাকুমা যদি না বোঝেন, অতএব ‘জ্বর’টা বলতে হল); তুমি ভাবছ আমরা কিছুই করিনি। ডাক্তার (আবার সেই বিপদ, তাই বলতে হবে) বদ্যি (ডাক্তার-বদ্যি) নিয়ে এলুম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।’

তাই আবার নিবেদন করছি, যাকে বোঝাচ্ছি তার বোধ্য শব্দটি আসে পরে।

এটা কিছু নতুন তত্ত্ব, আমাদের দেশের আজগুবি ব্যাপার নয়। ইংলন্ডেও নরমান বিজয়ের পর ইংরেজ যখন বিদেশি হুজুরের কাছে গিয়ে ফরিয়াদ বা রিপোর্ট দিত, তখন বলত, ‘He is very meek and humble (meek to gafaris, fpe humble fast নরমানদের শব্দ), Sir, but it is odd and strange (odd ইংরেজি, strange নরমান), that although we thought it meet & proper (meet ইংরেজি, proper নরমান) that we should search every nook and comer (nook RTS, comer নরমান), our sorrow and grief (sorrow ইংরিজি, grief নরমান) know nobound that we did not find him.’

তফাৎ শুধু এইটুকু যে ইংরেজ তখন দেশি ও বিদেশি শব্দের মাঝখানে and বসিয়েছে– meek and humble, odd and strange; আমরা বাঙালিরা ‘and’ এবং বসাইনিঃ আমরা বলেছি, হাসি-খুশি, মান-ইজ্জৎ, দেশ-মুল্লুক।

পাঠক কিন্তু ভাববেন না, আমাদের সব সমাসই এরকম।

জল-পানি, বাজার-উটকো, মাল-মশলা, ঘটি-বাটি, টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রাসা, ইস্কুল-কলেজ অন্য ধরনের সমাস।
১২/৩/৬৬

———

১. কিন্তু শাক-ভাত, শাক-পাত, শাক-পাতেড়, শাকান্ন, শাক মাছ অন্য সমস্যার অঙ্গ। স্থানাভাব না হলে সেটিরও আলোচনা করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *