ভাষা-ভাষা
এক বৃদ্ধ বাঙালি ভদ্রলোক নার্সিংহোমে বিছানায় শুয়ে পরলোকের দিন গুনছেন। তাঁর খুবই খারাপ অসুখ, পরমায়ু প্রায় হয়ে এসেছে।
এইসময় তাঁর কী খেয়াল হল তিনি একদিন তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘আমার জন্য একজন সংস্কৃত মাস্টারমশাই রেখে দে তো। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে সংস্কৃত শিখব। সকাল-বিকাল দুইবেলা দু’ঘণ্টা করে আমার এখানে এসে পড়িয়ে যাবেন। তা হলে তাড়াতাড়ি শিখে ফেলব।’
পিতৃদেবের অনুরোধ শুনে পুত্র অবাক। অনেক ইতস্তত করে সে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু এ বয়েসে, এ শারীরিক অবস্থায় নতুন করে সংস্কৃত শিখে কী করবে, কী কাজে লাগবে সংস্কৃত?
বাবা বললেন, ‘তোরা যতই গোপন করিস আমি ধরে ফেলেছি আমি আর বেশিদিন নেই। মারা গেলে স্বর্গে গিয়ে কথাবার্তা বলতে হবে তো, তখন দেবভাষা সংস্কৃত ছাড়া কোন ভাষায় কথা বলব?’
বৃদ্ধের পুত্রের সঙ্গে সেদিন একটি প্রগলভ পৌত্র তাকে দেখতে এসেছিল। সেই পৌত্রটি হঠাৎ বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু দাদু তুমি যে স্বর্গেই যাবে তার কোনও গ্যারান্টি আছে?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘না, নরকে গেলেও অসুবিধা হবে না, এতকাল দিল্লিতে, বেহারে ছিলুম। হিন্দি তো আমি বেশ ভাল কইতে পারি।’
এই ভাষাকাহিনীর সারমর্ম হল, হিন্দি নরকের ভাষা। জানি না গোঁড়া হিন্দি অনুরাগীরা চটে গেলেন কি না, তবে গল্প গল্পই এবং যাঁরা আমাকে জানেন তাঁরা ভালভাবেই জানেন কাউকে দুঃখিত করা বা আহত করার ইচ্ছে আমার মোটেই নেই।
ভাষা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে কিঞ্চিৎ ব্যাকরণের ভিতরে যদি যেতে হয় কিছুই করার নেই।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল আমাদের মাতৃভাষায় ‘ভাষা’ শব্দটির একাধিক মানে। যেমন, (১) বাঙাল ভাষায় একটা গ্রাম্য মাধুর্য আছে, আবার (২) বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধের ভাষা অতুলনীয় কিংবা (৩) হিন্দি ভাষা শেখা কঠিন নয়।
এই তিনটি উদাহরণের প্রথম ক্ষেত্রে ভাষা শব্দটি ইংরেজির Dialect (বাঙাল ভাষা), দ্বিতীয় ক্ষেত্রে Style (বুদ্ধদেব বসুর রচনাভঙ্গি) এবং অবশেষে Language, হিন্দি ভাষা, ইংরেজি ভাষা ইত্যাদি।
রাজশেখর বসু ভাষার সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘দেশবিশেষে বা জাতিবিশেষের মধ্যে প্রচলিত অথবা বিশেষ উদ্দেশ্য বা রূপে ব্যবহৃত শব্দগুলি এবং তাহার প্রয়োগ-প্রণালী।’
কী জানি, কিছু টের পাওয়ার আগে ব্যাপারটি বড় জটিল হয়ে গেল এবং আমারও স্মরণ রাখা উচিত ছিল, এই রচনাটির নাম ভাষা নয়—ভাষা-ভাষা এবং এটি একটি রম্যনিবন্ধ।
সে যা হোক, ভাষা শেখার মতো সোজা আর কিছু নেই। যে লেখাপড়া জানে না, অঙ্ক কষতে পারে না, নিজের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত বলতে পারে না, সে কিন্তু পরিষ্কার ভাষায় কথা বলতে পারে। সে ভাষা কেউ তাকে শেখায়নি, সে শিশুকালে পরিবেশ থেকে বিনা আয়াসে আয়ত্ত করেছে।
পাটনায় একটি বন্ধু কন্যাকে দেখেছিলাম, তার বয়েস সাত-আট, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। সে বাড়িতে ঠাকুমা-ঠাকুরদা, বাবা-মা’র সঙ্গে কথা বলে বাংলা ঝরঝর করে বলা শিখেছে, স্কুলে ইংরেজি এবং পাড়ার ও ভৃত্যদের সঙ্গে মেলামেশা করে হিন্দি শিখেছে। এই বয়েসে তিনটি কথ্যভাষাতেই সে চোস্ত।
এসব সুখবর, এবং এসব নিতান্তই শিশুদের জন্য।
বড় হয়ে সাবালক হয়ে ভাষা শেখা খুবই কঠিন। আর সবসময় সে-ভাষা শেখা কোনও সাজে লাগে না।
একবার আমার প্যারিস শহরে অল্প কিছুদিনের জন্যে যাওয়ার কথা। কার কাছে যেন শুনেছিলাম, ফরাসি সাহেবরা ইংরেজি শুনলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যান, কোনও জবাব দেন না। তাঁদের সঙ্গে ফরাসি ভাষায় কথা বলতে হবে, না বললে উত্তর নেই।
অনেক খুঁজে পেতে একটি বিগিনার্স ফ্রেঞ্চ (Beginner’s French) বই কিনে যাওয়ার আগে প্রায় প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা ধরে পড়াশুনো করে বইটা যতটা সম্ভব আত্মস্থ করলাম।
কিন্তু প্যারিসে পৌঁছে অভিজ্ঞতা হল অতিশয় মর্মান্তিক। ওখানকার লোকেরা মানে ওইসব নাক উঁচু ফরাসি সাহেবরা মোটেই বিগিনার্স ফ্রেঞ্চে কথা বলে না। তারা পুরোপুরি ফরাসি ভাষায় কথা বলে এবং তথাকথিত বিগিনার্স ফ্রেঞ্চ তারা জানে না।
অতঃপর সেই শিশুটির গল্প বলি। সে এতদিন তার মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় ছিল। অতি সম্প্রতি তারা কলকাতায় ফিরে এসেছে।
কলকাতায় এসে আপাতত কোনও ভাল স্কুল না পাওয়ায় এই শিশুটিকে, শিশুটির নাম রতন, পাড়ার কাছে একটা বাংলা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে।
বলা বাহুল্য, প্রবাসে সঠিক বাংলা বলতে শেখা শিশুটির পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ একরকম ভালই হল, বাংলা স্কুলে সহপাঠীদের আর দিদিমণিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে মাতৃভাষা তাড়াতাড়ি শিখে যাবে।
একদিন রতন বাড়ি থেকে টিফিন নিতে ভুলে গেছে। দুপুরে টিফিনের সময় দিদিমণি লক্ষ করলেন রতন বারান্দায় একা একা বসে আছে। টিফিন খাচ্ছে না। তখন দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘রতন তুমি টিফিন খাচ্ছ না কেন?’
রতন বলল, ‘আমার টিফিন না আছে।’
রতনের এইরকম ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে দিদিমণি বেশ পরিচিত। তিনি সংশোধন করে দিয়ে বললেন, ‘কথাটা হবে—আমার টিফিন নেই। যেমন তোমার টিফিন নেই। তোমাদের টিফিন নেই। আমাদের টিফিন নেই। রামের টিফিন নেই, শ্যামের টিফিন নেই।’
দীর্ঘ উদাহরণ দিয়ে দিদিমণি থামামাত্র রতন প্রশ্ন করল, ‘আজ সবার কেন টিফিন না আছে?’
পুনশ্চঃ
এক কুকুরের মালিক একদা বলেছিলেন যে, তাঁর কুকুর কুকুরের ভাষা ছাড়াও বাড়িতে একজন বিখ্যাত ট্রেনারের কাছে অন্য-এক ভাষাতে কথা বলা শিখছে। অন্য ভাষাটা কী জানতে চাইলে ট্রেনারসাহেব বললেন, ‘বেড়ালের ভাষা। কুকুরটা দৈনিক আধঘণ্টা করে মিউমিউ করা শিখছে।’