ভাষা: কা’শুর পৈঠ
কাশ্মীরি ভাষা। ভাষাটির অভ্যন্তরে অন্যরকম শক্তির ছোঁয়া পেয়েছি। পেয়েছি যজবা। মনে হয়েছে এ ভাষার শব্দভাণ্ডার সীমিত, কিন্তু আবেগ অসীম। ছোটখাটো বাক্য, কিন্তু তীব্র প্রভাব সৃষ্টিকারী। তুলনামূলকভাবে বাংলাভাষার চেয়ে অনেক কম শব্দ আছে এর অভিধানে। এতে সংস্কৃত, ফার্সি, আরবি, উর্দু, ইংরেজি, হিব্রুসহ অনেক ভাষার শব্দ আছে। কিন্তু, এই ভাষার নিজস্ব শব্দসংখ্যা খুবই কম। অন্যভাষায় কাশ্মীরি ভাষার শব্দ রপ্তানি হয়েছে এমনও খুব একটা পাওয়া যায় না।
স্পষ্টতই, কাশ্মীরি ভাষা একটা রিসিভার ল্যাঙ্গুয়েজ। গ্রাহক ভাষা। বিতরণকারী নয়। ভাষা হলো একটা সমাজের প্রবেশ দুয়ারের মতো। ভাষা বুঝতে পারলে ওই সমাজকে বুঝতে পারা যায়। কাশ্মীর পৌছার পর থেকেই এই টিপিক্যাল ভাষাটি খানিকটা উপলব্ধির চেষ্টা করেছিলাম। প্রথম দেড় বছরে সামান্যই বুঝতে পেরেছি। এরপর যখন ভাষাটির মর্ম বুঝতে শুরু করলাম, দেখলাম অপূর্ব ক্ষমতাধর একটি ভাষা। এই বুঝ হতে না হতেই ফেরার সময় এসে গিয়েছিল। ওই সময়ের মধ্যে কাশ্মীরি ভাষা সম্পর্কে যা বুঝতে পেরেছি তা এ অধ্যায়ে তুলে ধরেছি। মূলত, কাশ্মীরি ভাষাকে বাংলার পাশে রেখেই বুঝতে চেষ্টা করেছি। বাংলার সঙ্গে এর মিল-অমিল আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই ভাষাটিকে শেখার বা বোঝার চেষ্টা করেছি।
শুরুতেই কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। কাশ্মীরি সমাজে হাজাম’ নামে একটা বংশ আছে। নামের শেষে এই শব্দটি পাওয়া যায়। এক বন্ধু জানিয়েছিল এই হাজাম মানে হলো, নাপিত’। যারা বংশগতভাবে ছুরি-কাঁচি দিয়ে মানুষের মাথা কামায়। মজার ব্যাপার হলো, খুলনার শিরোমণি গ্রামে হাজাম’পাড়া বলে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এক গোষ্ঠী লোক আছে। ওই হাজামরা বংশগতভাবে কাঁচি বা ছুরি দিয়ে ছেলেদের খৎনা করে। এটা তাদের পেশা। এই দুই হাজাম শব্দের মধ্যে কোনো মিল আছে কিনা তার পক্ষে আরও কোনো যুক্তি আমার কাছে নেই। তবে, নিঃসন্দেহে এটা দারুণ সংযোগ। অবশ্য আরবি ভাষায় হাজামাত বলে একটি শব্দ আছে। একই শব্দ আছে পোশতুন (পাঠান) ভাষায়ও। কাশ্মীরি ভাষায় এগারকে বলে কাহ’। বাংলায় সুপারি গণনায় একটা শব্দ প্রচলিত
আছে- ‘গাহ’। সুপারির চাষ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা জানবেন ১১টা সুপারিকে এক ‘গাহ’ বলে। কাহ’ এবং ‘গাহ’ একই সূত্র থেকে জন্ম নিয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বরিশালের ভাষায় ‘পইড’ বলে একটা শব্দ পরিচিত। এর মানে হলো, কোনো কিছু সোজা হওয়া বা খাপে খাপে মিলে যাওয়া। কয়েকটি জিনিস একই সরল রেখায় এলে টিপিক্যাল বরিশাইল্যা ভাষায় বলে, ‘পইডে পইডে মিল্যা গ্যাছে’। জানিনা এই শব্দটির মূল কোথায়। তবে, তাজ্জব হয়েছি কাশ্মীরি ভাষার শব্দভাণ্ডারে ‘পইঠ’ শব্দের ব্যবহার দেখে। সে ভাষায় এর অর্থ হলো কোনো কিছু ঠিকঠাক’ বা ‘নির্দিষ্ট থাকা। ভাল আছি বোঝাতে কাশ্মীরিতে বলে ঠিক পইঠ। আবার কখনও বলে ‘আসল পইঠ’।
সুনির্দিষ্ট কোনো কিছু বোঝাতেও ব্যবহার করা হয় এই পইঠ’। কাইথ পইঠ ছু? এর মানে হলো, কোনো যায়গা থেকে (এসেছেন)? আবার কোনো কিছুর ওপর নির্ভর করা বা ভরসা করা বোঝাতেও ব্যবহৃত হয় পইঠ’। যেমন, ‘খোদায়েছ পইঠ হাওয়ালাহ’। মানে, খোদার ওপর হাওলা করলাম। বিদায় বেলায় বয়োবৃদ্ধ-গ্রামীণ কাশ্মীরিরা এখনও এই বাক্য বলেন। যে কোনো গাড়ির পেছনে উর্দু অক্ষরে এই লাইন লেখা থাকতে দেখা যায়। যেমন, বাংলাদেশে গাড়ির গায়ে লেখা হয় আল্লাহর নামে চলিলাম’। অবশ্য, শহরাঞ্চলের অনেকে বলেন খোদা হাফেজ, গুডবাই ইত্যাদি। নির্ভুলভাবে দাবি করা যায় কাশ্মীরি ভাষায় ‘পইঠ’ শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। এর মানে অনেক, তবে আসল অর্থ হলো ওপরে (ইংরেজি on)। মূলত এর দ্বারা কোনো অবস্থান বোঝানো হয়।
যেমন, আমি চৌরাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আছি বলতে হবে, ‘চৌওয়াথ’স পৈঠ’। একইভাবে, পাশেকাছে/ধারে বোঝাতে বলা হয় ‘নীশ’। যেমন, মার্কেট’স নীশ’ মানে হলো, বাজারের পাশে। মধ্যে বোঝাতে বলা হয় ‘মা’। যেমন, ‘ছে কাইথ ছু’ (তুমি কোথায়)? উত্তরে বলা হবে, ক্লাস’স মা’ (ক্লাসের মধ্যে)। যাই হোক, দুর্বোধ্য এই ভাষাটির শব্দাবলীর মধ্যে বাংলার এমন কিছু মিল খুঁজে পাওয়ার পরই আমি অদ্ভুত একটা নেশায় আক্রান্ত হই। তা হলো, বাংলার সঙ্গে এই ভাষার মিল অমিল আবিষ্কারের চেষ্টা। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, ভাষা বেঁচে থাকে মানুষের কথায়, গানে, সুরে ও সঙ্গীতে।
দেবতার বাণী ভাষা বটে। কিন্তু, তাকে মানুষের কাছে আনতে না পারলে পৃথিবীতে ওই ভাষার মৃত্যুই স্বাভাবিক। আর ভাষা এক দেশ থেকে আরেক দেশে যখন স্থানান্তরিত হয় তখন উচ্চারণ বদলায়। হয়তো উচ্চারণ বদলাতে বদলাতে এক সময় ভাষাই বদলে যায়। যেমন, ঢাকার বাংলা হলাম’কে কলকাতায় গিয়ে শুনতে হবে হলুম’। ইংরেজি পার্ক আরবিতে শোনা যাবে বার্ক। পাকিস্তানকে আরবরা বলে বাকিস্তান। বাংলা শব্দ পরী আরবের মানুষের মুখে উচ্চারিত হবে বরি’। বাংলা ও কাশ্মীরি নিয়ে এই অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের কিছু বইপত্রও পড়া শুরু করি। খুঁজতে শুরু করি বাংলার সঙ্গে কাশ্মীরের অতীত সংযোগের সূত্রগুলো জানতে পেলাম ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাশ্মীর। ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তার এক বন্ধুকে কাশ্মীর সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“আমি কাশ্মীরে ছিলাম। এক সন্ধ্যায় আমি ঝিলাম নদীর তীরে বসে। চারদিকে নীরবতা। আমি অনুভব করলাম যেন পদ্মার পাশেই বসে আছি। অবশ্য, যখন পদ্মার পাশে থেকেছি তখন আমি এক তরুণ আর এখন বৃদ্ধ। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান যেন উবে গেছে। একঝাক বলাকা আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে ঝিলামের ওপারে চলে গেল।… মনে হলো, আমি অদৃশ্য এক আহ্বান শুনতে পেলাম। আমাকে আরও দূরের পথে যেতে হবে’।
রবীন্দ্রনাথ তার ‘বলাকার বেশ কিছু কবিতা কাশ্মীরে বসেই লিখেছিলেন। ঝিলাম (কাশ্মীরি উচ্চারণ জেহলাম) নদীর রূপ বাংলা কবিতায় তুলে ধরেছেন যে, সে রবীন্দ্রনাথ। তার সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলামের স্রোতখানি বাঁকা’- এই কবিতায় ঝিলামকে যেভাবে পড়েছি, ঝিলামের পাশে গিয়ে প্রতিবারই তার প্রতিধ্বনি আর প্রতিচ্ছবি খুঁজেছি এবং পেয়েছি।” কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছিলেন, আকাশে উড়ন্ত বলাকাদের কাছ থেকে পাওয়া বার্তা। তিনি অনুভব করেছিলেন, বকেদের বিরতিহীন পাখাগুলো এক অসমাপ্ত যাত্রার কথা বলছে। হেথা নয়, হেথা নয়, অন্যকোনো খানে’।
বলাকার মূল বার্তাই হলো, গতিময়তা। যেমনটা মোবারক হোসেন খান লিখেছেন, বলাকা হচ্ছে গতির প্রতীক। ঝিলামের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের এই বর্ণনার পর ফিরে আসা যাক রবীন্দ্রনাথের পদ্মায়। তিনি তার কবিতায় লিখেছেন, আমার প্রিয়তম পদ্মা, সহস্রবার মিলেছি তোমার সাথে..’। তিনি তার যৌবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত করেছিলেন পদ্মার পাড়ে। সেখানে বসে তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু, পদ্মা ও ঝিলামের মধ্যে তিনি একটি বিষয়ে মিল খুঁজে পেয়েছেন। তা হলো, জীবনের গতিময়তা’। যদিও ভৌগোলিকভাবে বৈপরীত্য আছে দুইয়ের মধ্যে।
যাই হোক, এই অধ্যায়ের মূল মনোযোগ হচ্ছে ভাষার মধ্যে মিল খোঁজা। রবীন্দ্রনাথ বলাকা কবিতায় লিখেছেন বকের কথা। বাংলায় বককে বলা হয় বগি, বগা ইত্যাদি। কাশ্মীরি ভাষায় এই পাখিকে বলা হয় বিগলি’ অথবা ‘ব্র্যাগ’। বক বা বলাকার সঙ্গে কাশ্মীরি শব্দটি মেলেনি। কিন্তু, বগির সঙ্গে বগলি অন্তমিল সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু, ভাষার মিল খুঁজতে গিয়ে প্রকৃতি ও তার মর্মবাণীর মধ্যে এক মিল আবিষ্কৃত হয়েছে। ভাষা দুটির মধ্যে সখ্য খুঁজতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকেই আবিষ্কার করা গেল। এ কথাতো কারও অজানা নয় যে, নদীরা পর্বতের ঝরনা থেকে সৃষ্টি হয়ে সাগরের দিকে বয়ে চলে। তারা সভ্যতা আর শহরগুলোর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। একের সঙ্গে অন্যটিকে যুক্ত করে। আর যখন মানুষ নিজেই নদীর মতো
বহমান হয় তখন সে বহন করে সংস্কৃতি ও জ্ঞান। পরিভ্রমণের সময় মানুষ অচেনা লোকেদের সঙ্গে পরিচিত হয় আর যুক্ত হয় ভিন্ন ভিন্ন ভাষার সঙ্গে। এটা একটা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। ভাষা সংস্কৃতিগুলোকে যুক্ত করে। আবার সংস্কৃতি ভাষাসমূহকে যুক্ত করে। যেমনটা গবেষকরা বলেন, ‘ভাষাকে সংস্কৃতির বাচিক প্রকাশ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। এটা সাংস্কৃতিক বন্ধন এবং সংস্কৃতিকে ধারণ ও প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়।) মনে রাখা দরকার, দুটো ভাষার মধ্যে মিলগুলোর মাধ্যমে তাদের মধ্যকার অমিলগুলোকে অস্বীকার করা যাবে না। দুটো স্থান একে অপরের থেকে যত দূরের হবে তাদের ভাষা পরস্পরের থেকে ততটাই ভিন্ন হবে।
তথাপি, বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভাষা আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়াকে পরিচালিত করে। আবার আমাদের চিন্তার প্রক্রিয়াও ভাষাকে পরিচালিত করে। বেঞ্জামিন লি ওরফ তার তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে বলেছেন, ভাষা আমাদের চিন্তার পন্থাকে কাঠামোবদ্ধ করে। আমরা যে বিষয়ে চিন্তা করি তা নির্ধারণ করে দেয় ভাষা। তিনি মনে করেন, ভাষার ওপর নির্ভর করে আমরা কথা বলি। আমরা জগৎটাকে দেখি একেকজন একেকভাবে। তিনি উদাহরণ দিয়েছিলেন যে, একজন ইংরেজের কাছে এবং একজন এস্কিমোর কাছে তুষারের ধারণা ভিন্ন। এস্কিমোর অনেক শব্দ আছে তুষারকে বর্ণনা করার জন্য। কিন্তু, ইংরেজিতে একটিই আছে। তা হলো স্নো (Snow)। একজন এস্কিমোর সুনির্দিষ্ট শব্দ আছে ভেজা তুষার, বর্তমানে পতনশীল তুষার ইত্যাদি বোঝাতে। সে কারণে, একজন এস্কিমো শ্লো সম্পর্কে যা ব্যাখ্যা করতে পারেন তা ইংরেজের চেয়ে ভিন্ন। কাশ্মীরি ভাষায়ও দেখা গেছে এরকম বিশেষত্ব।
প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বৈপরিত্যের কারণে ভাষারা আলাদা হয়। কাশ্মীরি ভাষায় তুষারকে ব্যাখ্যা করার জন্য অসংখ্য শব্দ পেয়েছি, যা বাংলায় নেই। কাশ্মীরি ভাষায় তুষারকে বলা হয় ‘শীন। আবার শিশির বিন্দুকে বলা হয়, শুশুর। প্রচণ্ড শীতে শিশির বিন্দুরা কোনো গাছের ডালে বা ঘরের চালে ঝুলন্ত অবস্থায় জমাট বেঁধে বরফে রূপান্তরিত হয়। কাঁটার মতো ঝুলে থাকা ওই শিশিরের স্ফটিককে বলা হয় ‘তুল কাতুর’। এরকম নানা সময়ের শিশির ও তুষারের নানা রকমের নাম সেখানে আছে। অন্যদিকে নদীকে বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলায় যত শব্দ পাওয়া যায় তা কাশ্মীরিতে নেই।
একেক এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার মাধ্যমে ভাষায় নতুন শব্দ যুক্ত হতে পারে। যেমন, বাংলায় গত তিন দশকে বেড়ে ওঠা পোশাক শিল্প বস্ত্রবালিকা’ বা ‘সেলাইদিদিমনি’-এমন শব্দের জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীরিতে সুদীর্ঘ সংঘাত আর যুদ্ধের মধ্যদিয়ে জন্ম নিয়েছে একটা শব্দ: সয়েথ’। এর মূল আভিধানিক অর্থ হলো লণ্ঠনের সলতে। কিন্তু, শ্রীনগরবাসীর মুখে সয়েথ’ মানে হলো একজন যোদ্ধা, যে স্থানীয়ভাবেই তার অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়েছে, প্রশিক্ষণের জন্য যে অন্য দেশে যায়নি। এতেই স্পষ্ট হয় যে, বাংলা আর কাশ্মীরি এক নয়। কিন্তু, এসব
অমিলের মধ্যেও মিল আছে। একেই বলে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’। কাশ্মীর আর বাংলাদেশের দূরত্ব হচ্ছে আড়াই হাজার কিলোমিটার। গবেষণার তথ্যমতে, কাশ্মীরি ভাষাভাষি মোট জনসংখ্যা হলো ৯২ লাখ, যা জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের ৪২ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলায় কথা বলে অন্তত ২১ কোটি লোক যা পৃথিবীর সপ্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্য হিসেবে বলা হয় প্রায় ১৯ কোটি লোক বাংলাভাষি। সুতরাং, দুই ভাষার মধ্যে বৈপরিত্য স্বাভাবিক। এবার দুটো ভাষার জিনিওলজি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাক। কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. মুসাবিরের মতে, বিভিন্ন জায়গার লোকেরা একই ভাষা আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে।
শতাব্দী অন্তরে এই আলাদা আলাদা উচ্চারণ আলাদা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে। ফলে, এটা বলা যায়, ভাষাগুলো পূর্ববর্তী ভাষার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে (২০১৫: সাক্ষাৎকার)। অধিকন্তু তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের ভাষাগুলোকে বিভিন্ন পরিবারে ভাগ করেছেন। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সংরক্ষিত নথি The Archives of Languages of the World অনুসারে বাংলা এবং কাশ্মীরি উভয় ভাষাই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের বিভিন্ন শাখা থেকে সৃষ্ট। ওই আর্কাইভ ইন্দোইউরোপীয় পরিবারের আওতায় হাজার হাজার ভাষাকে লিপিবদ্ধ করেছে। Edgar H. Sturtevant ১৯৪৭ সালে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের মধ্যে সংস্কৃত, গ্রীক ও ল্যাটিনকে প্রাচীনতম ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছেন। ইরানিয়ান, ইন্ডিক, দারদিক-এসব ভাষা পরিবারও এই বৃহৎ ইন্দো-ইউরোপীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বাংলা এবং কাশ্মীরি ভাষার মূল নিহিত এই তিনটি প্রাচীন ভাষায়।
কিন্তু, বিশেজ্ঞদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য নেই। গ্রিয়ারসন নামে একজন বিশেষজ্ঞ কাশ্মীরি ভাষাকে দারদিস্তানের (পশ্চিম হিমালয়) দারদ ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তার মতে, এই দারদ ভাষা-পরিবার হলো ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষা পরিবারের শাখা। তিনি আরও মনে করেন, দারদ ভাষাগুলো খানিকটা মূল মা-ভাষা থেকে বিকৃত। অন্যদিকে পরিষ্কারভাবে বলা যায় বাংলার সৃষ্টি হয়েছে সংস্কৃত ভাষার কোনো একটি শাখা থেকে। সুতরাং বলা যায়, ভাষাগুলোর মধ্যে একে অপরের মধ্যে সম্পৃক্ত হওয়ার মতো বৈশিষ্ট্য (Overlapping features) রয়েছে, যা মূলত পরিবারগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। উ, মুসাবিরের মন্তব্য এখানেও উল্লেখযোগ্য। ভাষাগুলো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য স্বভাবতই অন্য ভাষা থেকে কিছু গ্রহণ করার এবং নিজে পরিবর্তিত হওয়ার বিষয়ে উদার।
অধ্যাপক ফিদা এম হাসনাঈনের একটি তথ্য এখানে জরুরি। তিনি কাশ্মীরি ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বর্তমানের কাশ্মীরি ভাষায় ৩০ ভাগ ফারসি, ২৫ ভাগ আরবি এবং ৪৫ ভাগ সংস্কৃত শব্দ আছে। এছাড়া হিব্রুসহ আরও কিছু ভাষার শব্দ রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাভাষায় সিংহভাগ শব্দ সংস্কৃত থেকে এসেছে। তারপর ফারসি, আরবি, ইংরেজি, পর্তুগীজ ভাষার শব্দ নানাভাবে গৃহীত বাংলায়।
কাশ্মীরিদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় জানা গেছে, দুটো ভাষার বিভিন্ন প্রবাদের মর্মার্থে মিল আছে। যদিও তাদের উচ্চারণ ও শব্দাবলী আলাদা। যেমন, দক্ষিণ কাশ্মীরে ‘ওয়াতাল হোম’ নামে একটা গ্রাম আছে। কোনো এক কারণে ওই গ্রামের লোকদের বোকা বা আহাম্মক মনে করা হয়। শ্রীনগরে যে কোনো মানুষকে ‘ওয়াতাল হামুক’ বলে গালি দিলে সে ক্ষুব্ধ হয়। কারণ, এর মানে হলো নির্বোধ। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লোকদের একইভাবে ‘মফিজ’ বলে গালি দেওয়া হয় ঢাকায়।
ধারণা করা যায়, দুই ভাষায় এই দুটি গালি গড়ে উঠেছে একই প্রক্রিয়ায়। বাংলা প্রবাদ দশে মিলে করি কাজহারি জিতি নাহি লাজ’ সকলেরই জানা। চতুর্দশ শতকের কাশ্মীরি জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক কবির একটা বিখ্যাত কবিতা আছে। তাতে বলা হয়েছে, সারি সামতাও, আকসাই রাজি লামতাও/আদমা রায়হা কাহন গাও’। এর অর্থ হলো, সবাই একসঙ্গে হয়ে দড়িটা শক্ত করে ধরো। অন্যথায় ১১ জন মিলেও গরু হারানো ঠেকাতে পারবে না। এই কবিতা থেকেই একটা প্রবাদ জনপ্রিয় হয়েছে। তা হলো, কাহন রমিজ গাও’ বা ‘যেখানে ঐক্য না থাকবে সেখানে ১১ জন মিলেও গরু রাখা যায় না। যে কোনো কাশ্মীরি এই কবিতা ও প্রবাদ বলে দিতে পারবেন। অনৈক্যের সমালোচনার জন্য এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।১৪)
এবার দুই ভাষার কিছু শব্দের মধ্যে তুলনা করা যাক, যার উচ্চারণে এবং অর্থ প্রায় একই রকম। কাশ্মীরিতে ‘আখ’ মানে বাংলায় এক’। দুই বোঝানো হয় জ্যো’ দ্বারা। তিন হলো ‘ত্রে। চারকে কাশ্মীরিতে বলে চুয়ার’। বাংলা প্রত্যেক বোঝাতে কাশ্মীরিতে ব্যবহৃত হয় প্রাতৃহাক’। দুই ভাষায় বেশ কিছু শব্দ আছে যা উচ্চারণ ও অর্থে একেবারে অভিন্ন। যেমন, কাশ্মীরি ভাষায় “ঠিক’ বা ‘আসল’ পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় সঠিক’ বা সুস্থ থাকা বোঝাতে। ঠিক পৈঠ? আসল পৈঠ? এই প্রশ্নগুলোর মানে হলে, কেমন আছেন? ভাল আছেন তো? নামবাচক বা বিশেষ্য, ক্রিয়াবাচক, বিশেষণ- সব ধরনের শব্দেই মিল আছে।
কাশ্মীরি শুশুর (শিশির), বাত (ভাত), গার (ঘর), গুর/গুড়া (ঘোড়া), কাম্বল (কাওলা/জন্ডিস), ছায় (ছায়া) এসব নামবাচক শব্দে বাংলার সঙ্গে মিল আছে। ক্রিয়াবাচক চমু (চুমুক দেওয়া/পান করা অর্থে), রানুন (রান্না), খেয়ন (খাওয়া), পারান (পড়া), চকরা (চক্কর দেওয়া/ ঘুরে বেড়ানো অর্থে), কা’থ (কথা), সেরান (স্নান), করান (করা) শব্দগুলোও ভিন্ন নয়। খাবারের স্বাদ বোঝতে কাশ্মীরি ভাষার টুট মানে বাংলা তেঁতো, মুদুর মানে মিঠা, চুক মানে টকচুকা, গারাম মানে ঝাল। বিশেষণ হিসেবেও মিল আবিষ্কার করা গেছে কিছু শব্দে। কাইথ মানে কথা। ক’শুর পইঠ কাইথ করান’- এই বাক্যের অর্থ হলো, কাশ্মীরিতে কথা বলুন। যেমন, বাংলায় তাপদাহ কাশ্মীরিতে বলা হয় তাফ দ্রাহ, বড়কে বলা হয় বুড’, খারাপকে বলা হয় ‘বদ’।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এক ভাষার বিশেষ্য বা নামবাচক পদ অন্য ভাষার বিশেষণ হয়ে গিয়েছে। যেমন, বাংলায় তৃষা বা তৃষ্ণা একটা অবস্থা। বিশেষণ। অথচ কাশ্মীরিতে ‘ত্রেষ’ মানে হলো পানি। পানি খাব/পানি পান করব’ বোঝাতে বলতে হবে ‘ত্রেষ চমু’। বাংলায় কোনো বস্তু নিচে শব্দ করে পড়লে ওই শব্দ বোঝাতে বলা হয় ঠাস’। সাধারণত, শুধু ঠাস’ শব্দটি বাংলায় কোথাও ব্যবহৃত হয় না। কোনো বস্তু বাংলায় বললে ঠাস-ঠুস করে পড়ে। কিন্তু কাশ্মীরিতে কোনো বস্তু শুধুই ‘ঠাস’- মানে পড়ে গেল। একই রকম হলো কাঁপন। বাংলায় কাঁপনের তীব্রতা বোঝাতে বলা হয় ‘থর। থর করে কাঁপে’। কাশ্মীরিতে ‘থার থার’ মানে হলো কোনো জিনিস কাঁপছে।
টেবিলটা থর থর করে কাঁপছে, এই বাক্যটি কাশ্মীরিতে বোঝাতে বলা হবে ‘টেবিল/ থারথার। তবে, এই দুটি শব্দ বলার সময় যে অঙ্গভঙ্গি দেওয়া হবে তা বাংলা ভাষায় বর্ণনা করে বোঝানো/দেখানো সম্ভব নয়। আরও কিছু শব্দজোড় আছে যা বাংলার সঙ্গে মেলে না। যেমন, ‘ওয়াইওয়াই’ মানে হলো শরীরের কোনো অঙ্গে ঝিঝি লাগা। আরেকটি শব্দজোড় ‘ওয়ারওয়ার’-এর মানে ধীরে-ধীরে। দক্ষিণাঞ্চলে ধীরে ধীরে বোঝাতে ভার-ভার বলা হয়। আঞ্চলিক বাংলায় ভার-ভার আর কাশ্মীরি ওয়ারওয়ার একই মূল থেকে ব্যুৎপত্তি পেয়েছে বলে ধারণা করা যায়। কারণ, আরবি ‘ওয়াও’ অক্ষরটি বাংলায় অনেকটা ‘ওয়া’ আর ‘ভ’এর মাঝামাঝি। বাংলায় বদল’ একটা ক্রিয়াপদ। এর মানে হলো পরিবর্তন করা।
বদল মূলত উর্দু শব্দ। ফায়েজ আহমেদ ফায়েজের কবিতায় আছে বদল চুকা হ্যায়’, মানে বিপ্লব হয়ে গেছে। কাশ্মীরিতে বদল মানে আলাদা। যেমন, অন্য একটা জিনিস’কে কাশ্মীরিতে বলবে, ‘বদল চিজ। অন্য একটা জানোয়ারকে বলা হবে বদল জানোয়ার। ব্যাপারটা অনেকটা ফার্সি খুব’ আর বাংলা ভালো’-এর মতো। ফার্সি ভাষায় ‘খুব’ মানে ভাল। কিন্তু, বাংলায় খুব’ বলা হয় ভালর মাত্রা কতটুকু তা বোঝাতে। খুব ভাল। শেষ করার আগে খাপছাড়াভাবে ভাষাটি সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জানিয়ে দেওয়া যাক। কাশ্মীরি ভাষায় কুকুরকে বলে হুন’। লতি মানে অপেক্ষা। যেমন, এক সেকেন্ড অপেক্ষা করুন বোঝাতে বলতে হবে লতি কইরু, আখ সেকেন্ড’ বা ‘আখ সেকেন্ড কাইরু লতি’। চলো মানে হলো ‘পাকো’। অঞ্চল বিশেষে বলে ‘পাইকু’। আর নীরো/নেরো’ মানে আসসা। কাশ্মীরি ভাষায় নারীকে বলে ‘জেনান’। মূল শব্দটি আরবি ‘জেনানা’। আবার কুমারি নারীকে বলে ‘কুর’। কাশ্মীরি কুমারি’ বোঝাতে বলতে হবে ‘ক’শুর কূর’। শহরের মেয়ে বোঝাতে বলা হবে শাহর’স কুর’।
নোট/সূত্র
১. শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে বাংলা ও কাশ্মীরি ভাষার সম্পর্ক নিয়ে একটি fac (Discovering Bridge through Language: A Study of Bengali and Kashmiri) উপস্থাপন করেছিলেন লেখক। নিবন্ধটি তৈরিতে লেখকের সহযোগী ছিলেন তার কাশ্মীরি সহপাঠী ফায়েজ রাহী ও রিয়াজ খালিক। ইংরেজিতে লেখা ওই নিবন্ধের তথ্যগুলোও এ অধ্যায়ে যুক্ত করা হয়েছে। তার সঙ্গে কিছু নতুন উদাহরণ ও তথ্য যোগ করা হয়েছে।
২. Mota, Autar (2013); Website: Chinar Shade (http://autarmota.blogspot.in/2013/03/gurudev-rabindranath-tagore-and-river.html?m=l) এখানে রবীন্দ্রনাথের ওই চিঠির বরাত দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি থেকে চিঠিটি বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে। আরও দেখুন, Sen, Kshitimohan; Balaka-Kabya-Parikrama, p.55 আরও দেখুন, Razdan, Vinayak (2012) Website: Search Kashmir (http://www.searchkashmir.org/2012/10/tagoresbalaka.html?m=1)
৩. কাশ্মীর: ঝিলাম নদের মূলে’- শিরোনামে লেখকের একটি লেখা এনটিভি অনলাইন (ntvbd.com)-এ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে।
৪. মোবারক হোসেন খান, দৈনিক যুগান্তর, ২ আগস্ট, ২০১৩; অথবা, স্বাগত গুপ্ত (২০১৩); পদ্মার তীর: রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য, কালি ও কলম (kaliokalam.com/2013/04/17)
৫. Emma (2010); The Relationship between Language and Culture; http://www.lexiophiles.com/uncategorized/ (accessed on: July, 28, 2015).
৬. Babla, Do Language Shape the Way we Think: http://www.lexiophiles.com/english/language-culture and-thoughts
৭. X-MITA study (11/08/2015); Srinagar: Kashmir Life
৮. Flamiejamie, 2008; Top ten most spoken languages in the world; web: listverse.com.
৯. Thompson, Irene 2015; aboutworldlanguages.com/bengali (accessed: 15/07/2015).
১০. Voegelin, C.F and F.M 1965; Languages of the World: Indo-European Fascicle One; Anthropological Linguistics, Vol.: 7, No.: 8; Archive of Language of The World, Anthropology Department; Indiana University; USA. Pp: 2, 182.
১১. Musavir 01/08/2011, Language and Times, Srinagar: Kashmir Life.
১২. Hassnain, Fida 2007; Kashmiri with Jewish Roots; The Journal of Kashmir Studies; Vol: II, 2007; Pp: 34-35.
১৩. Majeed, Gulshan; A Discourse on a few Expressions of Abuse and Curse in the Kashmiri Language; The Journal of Kashmir Studies; Vol: II, 2007; Pp: 34-35.
১৪. Saleem, Shahzada; Reaction to some Sociological Variables: Some Proverbs of Kashmiri Language; The Journal of Kashmir Studies; Vol: II, 2007; Pp: 135-140.
১৫. কাশ্মীরি ভাষা সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে দেখুন মধুর সন্তুর’: মনকাড়া সুর অধ্যায়।