ভাষার দর্শন
কথায় বলে বোবার শত্রু নেই, এর কারণ বোধ হয় বোবার সমাজ নেই। মানুষের সমাজে শক্রতা ও একটা সামাজিক সম্বন্ধ। কিন্তু ভাষা ছাড়া কোনো সামাজিক সম্বন্ধই গড়ে উঠতে পারে না। যাত্রাগানে দুই পক্ষ যুদ্ধ করার আগে রৌদ্ররস ও বীররস সৃষ্টি করার জন্য ক্ৰোধোদ্দীপ্ত বীরদর্পিত ভাষণের দ্বারা বেশ কিছুক্ষণ ধরে আসর গরম করে নেয়। তারপর আরম্ভ করে। ঘোরতর যুদ্ধ। তখন সরল হৃদয় শিশুদর্শকের মনে আবিভূতি হয় ভয়ানক রস। কিন্তু উন্ন্যাসিক আধুনিক সেয়ানা দর্শক উপভোগ করেন হাস্যরস। সাহিত্যরসিকের আসরে যাত্রাগান কতখানি রসোত্তীৰ্ণ সে আলোচনা বন্ধ থাক। কিন্তু মনে করা যাক রঙ্গমঞ্চে যুযুৎসু দুইপক্ষের কুশীলবগণ কোনো কথা না বলে কেবল স্থাণুর মতন দাঁড়িয়ে রইল, আর কতক্ষণ পরে হঠাৎ মল্লযুদ্ধ আরম্ভ করে দিল। তখন মল্লযুদ্ধটা মঞ্চের কুশীলবদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। কারণ তাদের রুদ্ধবাক যুদ্ধলীলা দর্শকদের মুখর করে তুলবে, মল্লক্ষেত্রে টেনে আনবে। এখানে কিন্তু বোরারও শত্রু আছে। আসরের দর্শকবৃন্দ ও মঞ্চের কুশীলববৃন্দের একত্ৰ উপস্থিতির পিছনে একটা সুগভীর সামাজিক প্রত্যাশ রয়েছে। একদল আনন্দ দান ক’রে আনন্দ পাবে, আর এক দল আনন্দের দান গ্ৰহণ করবে। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে যদি প্ৰত্যাশিত সম্পর্কের ছেদ ঘটে। তবে স্বভাবতই তার স্থান গ্ৰহণ করবে একটা বিরূপ সম্পর্ক। যাদের কাছে থেকে আশা করা গিয়েছিল অনর্গল ভাষা, তারা যদি অহেতুক এই আশাভঙ্গ ক’রে বোবার মতন ব্যবহার করে, তাহলে এই নকল মৌনের মধ্যে যে উলেক্ষা ও অবজ্ঞা প্রচ্ছন্ন থাকে তাই সৃষ্টি করে তিক্ততা ও শত্ৰুতা। আপাতদৃষ্টিতে ভাষার অভাবটাই এখানে বিরূপতার কারণ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যারা কথা বলছে না। তারা কথা বলতে জানেনা এটা সত্য বলে মনে করতে পারলে দর্শকরা মারমুখো হয়ে উঠত না। কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কথা বলতে পারছে না, অথচ লোক ডাকা হয়েছে কথা শোনাবার জন্য। বিক্ষোভের আসল কারণ তাই। ভাষার অভাবের পিছনে ভাষা বলার এই অপ্ৰযুক্ত ক্ষমতাটাই তিক্ততার কারণ। সংসারে পরমাত্মীয়ও অনেক সময় खङिग्नভরে কথা বন্ধ করে দেয়। এখানেও অভিমান প্ৰকাশের কারণ ভাষার অভাব নয়। কিন্তু অবরুদ্ধ ভাষার পিছনে ভাষা প্রয়োগের ভাবমূলক ক্ষমতাটাই অভিমান প্রকাশের কারণ। অপর পক্ষের পাল্টা অভিমানের পালাটাও এই জন্যেই। বোবা স্বামীর উপর স্ত্রীও অভিমান করে না। কিন্তু বোবাকেও সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে টেনে আনার জন্য ইশারা-ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গিমার ভাষা শিক্ষা দেয়া দরকার হয়।
শত্রুর সঙ্গে শত্রুতা করতে গেলে তার সঙ্গে ভাবের ক্ষেত্রে একটা মিলের প্রয়োজন। শত্রুর কথা ও আচরণের এমন একটা সাধারণ ভাষা আছে যার ভাবাৰ্থ উভয় পক্ষই সমানরূপে উপলব্ধি করতে পারে। উপলব্ধির এই সমানভূমিতে দাড়াতে না পারলে শক্রকেও শত্রু বলে চেনা যায় না। এই সমানভূমি হল মূলতঃ ভাষার ভূমি। মানুষের সম্পর্ক অনুকূলই হোক আর প্রতিকুলই হোক, সবই সামাজিক সম্পর্ক। এইরূপ সকল সামাজিক সম্পর্কের সামগ্রিক বিন্যাসকেই বলা যেতে পারে মানুষের সমাজ। ভাষা ছাড়া এ সমাজ গড়ে উঠত না, বাঁচতে পারত না, চলতে পারত না। এ কথাটা এত সহজ যে বলাটাই বোধ হয়। অপরাধ। কিন্তু ভাষা কি ক’বে সমাজ গড়ে, কি ক’রে মানুষকে সামাজিক করে এ আলোচনাটা বোধহয় অপরাধ নয়। কারণ এ নিয়ে প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পৰ্যন্ত দার্শনিকদের মধ্যে বিচার-বিতর্ক চলে এসেছে। আমাদের দেশের প্রাচীন আলিঙ্কারিক আচাৰ্য্য দণ্ডী বললেন-ভাষা না থাকলে লোকযাত্ৰা অসম্ভব হত, জগৎসংসার অন্ধকারের অন্ধতায় ডুবে থাকত। ভাষা এক অত্যাশ্চৰ্য ঐন্দ্ৰজালিক আদর্শ। সাধারণ আদর্শ শুধু সম্মুখে উপস্থিত বস্তুকেই প্ৰতিবিন্বিত করতে পারে। কিন্তু এই বাঙাময় আদর্শ যা কিছু অনুপস্থিত তাকেও প্ৰতিবিম্বিত করে।
অনুপস্থিতকে উপস্থিত করতে পারা, অতীত ও ভবিষ্যতকেও বর্তমানের বুকে দাঁড় করাতে পারার এই বিস্ময়কর ক্ষমতার জন্যই ভাষা অতীত থেকে ভবিষ্যৎ পৰ্যন্ত প্রসারিত সমগ্র সমাজকে একটি সাধারণভূমিতে ধারণ করতে পারে। যে আমার সামনে উপস্থিত তাকে আমি একটি নাম দিয়ে সনাক্ত করতে পারি। এই সনাক্তনীকরণ নামের একটি গৌণ ব্যাপার মাত্র। কিন্তু আর একটি বৃহৎ ব্যাপারের উপায় হিসাবে কাজ করে বলেই এই গৌণ ব্যাপারটির অসামান্য গুরুত্ব রয়েছে। উপস্থিতকে নাম ধরে ডাকার জন্যই নামকরণ করা হয়নি। যে অনুপস্থিত তার নাম ধরে যখন অন্যের অভিজ্ঞতা ও বোধের ভিতরে তাকে উপস্থিত করতে পারি তখনই নামকরণের চরম সার্থকতা। শিশু আঙল দিয়ে দুধের বাটি দেখিয়ে দেয়। এই অঙ্গুলিনির্দেশ সে মায়ের কাছ থেকে দেখে শিখেছে। প্ৰথম অবস্থায় এটা একটা অনুকরণ মাত্র। পরে এই অঙ্গুলিসংকেত আর নিছক অনুকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। কারণ অনুকরণটাই সংকেত নয়। অঙ্গলি-সংকেতের দ্বারা শিশু যখন মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তার দুধের পিপাসা মাকে জানায় তখন যান্ত্রিক অনুকরণ সার্থক সংকেতে পরিণত হয়। এই অঙ্গুলি-সংকেতের স্তর অতিক্রম করে শিশু যখন ভাষার সংকেত শিখতে পারে, তখন তার চেতনা ও একটা নূতন স্তরে উন্নীত হয়। নিজের বুদ্ধির ভিতরে দুধকে দুধের বাটি থেকে আলাদা করা বুদ্ধি-বিকাশের প্রথম পৰ্য্যায়েই সম্ভব নয়। আধার থেকে আধেয়কে আলাদা করে বোঝার এই ক্ষমতা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আয়ত্ত করতে হয়। দুধকে “দুধ’ বলে চিনতে পারা তখনই অর্থপূর্ণ, যখন দুধের অনুপস্থিতিতেও শব্দটি উচ্চারণ করে শিশু মাকে তার জৈবিক প্ৰয়োজন ও মানসিক অভিপ্ৰায় জানাতে পারে। যে পৰ্য্যন্ত ভাষাজ্ঞান বস্তুর উপস্থিতিতে শব্দটি উচ্চারণ করতে পারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, সে পৰ্য্যন্ত শব্দটি একটি সনাক্তীকরণের চিহ্নমাত্ৰ, কোন বস্তুর উপস্থিতির দ্বারা উদ্দীপিত একটু উচ্চস্তরের জৈবিক প্রক্রিয়া মাত্র। কিন্তু শিশু যেদিন তার ক্ষুধা তৃষ্ণ শান্ত করার জন্য সামনে দুধ না দেখেও মাকে দেখে “দুধ’ বলে কান্না জুড়ে দিতে পারে, সেদিন তার শব্দজ্ঞান চিহ্ন থেকে সংকেতে উন্নীত হয়েছে, তার চেতনায় তখন এক বৈপ্লবিক পরিবতন এসেছে। শিশু সেদিন নিজের চেতনাকে মায়ের চেতনায় সঞ্চারিত করার উপায় খুঁজে পেয়েছে। অন্যের ভিতরে নিজের আশানুরূপ প্ৰতিক্রিয়া সৃষ্টির জন্য শব্দের দ্বারা নিজের অভিপ্রেত অর্থকে অন্যের চেতনায় উপস্থিত করার এই বিস্ময়কর ক্ষমতাই শব্দ-জগতকে মানুষের চেতনার এক সাধারণ ভূমিতে পরিণত করে। স্বর্তন্ত্র ব্যক্তিসত্তার একই সমান চেতনায় এই মিলন সম্ভব করে মানুষের ভাষা। সমাজ মানেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিজ্ঞতার, চেতনার সঙ্গে চেতনার এই সমকেন্দ্রিক মিলন। মানুষের চেতনার এই সাধারণীকরণকেই বলা যেতে পারে মানুষের সমাজীকরণ।
আমাদের গৌড়ীয় বৈষ্ণবদর্শনে নামের মহিমা কীর্তনের জন্য নাম ও নামীর অভেদতত্ত্ব উপস্থিত করা হয়েছে। এই তত্ত্বের আধ্যাত্মিক রহস্য আমাদের অজ্ঞাত। আমরা এ আলৌকিক রহস্তে দীক্ষিত নই। তবু এই তত্ত্বের একটা লৌকিক দার্শনিক দিক্ রয়েছে যা আমাদের বিচারবুদ্ধির একান্ত অগোচর নয়। যার নাম দেবদত্ত, তার কোন নাম না থাকলেও অনামা হয়ে সে বেঁচে থাকতে পারত। কিন্তু মানুষটি কাছে না থাকলেও তার সম্পর্কে অন্যকে কিছু বুঝাতে হলে তার একটা শব্দাত্মক নাম, অগত্যা একটা বৰ্ণনাত্মক নামের প্রয়োজন আছে। নামের অর্থ যদি নিছক ব্যক্তিটিই হত। তবে অন্যের কাছে দেবদত্তকে বুঝাবার জন্য সব সময়ই দেবদত্তকে ধরে এনে হাজির করার প্রয়োজন পড়ত। নামের অর্থ আর নামী ব্যক্তিটি এক হলে ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে শুধু নামের দ্বারাই অর্থের বোধ জন্মানো যেত না। অর্থটি বক্তা ও শ্রোতার কাছে সাধারণ, কিন্তু ব্যক্তিটি অসাধারণ। বক্তা ও শ্রোতার চেতনায় সমানভাবে বিধৃত এই অর্থটিকে কিন্তু নাম থেকে আলাদা করা যায় না। নামের সঙ্গে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধে বিজড়িত না হয়ে কোন অর্থই জ্ঞানের ভিতরে ধরা পড়ে না। অর্থের সঙ্গে নামের এই একাত্মতাকেই নাম-চিহ্নিত ব্যক্তির সঙ্গে একাত্মতা বলে একটা ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এই ভ্ৰান্তির মূল কারণ হল শব্দনির্দিষ্ট ব্যক্তি ও শব্দার্থকে এক বলে মনে করা। বক্তা ও শ্রোতা, লেখক ও পাঠকের সমান চেতনাবিধৃত একটি সাধারণ অর্থের সঙ্গে শব্দের এই একাত্মতাকেও প্ৰকারান্তরে নাম ও নামীর অভেদ বলা যেতে পারে। শব্দ যে সাধারণ অর্থটিকে শ্রোতার কাছে উপস্থিত করে, সেই প্ৰকাশযোগ্য অর্থসামান্যকেই সাক্ষাৎ সম্বন্ধে নামী বলা উচিত। কারণ নাম সাক্ষাৎভাবে তাকেই প্ৰকাশ করে। এই অর্থেই নাম ও নামী অভিন্ন, কারণ নাম ও অর্থ একাত্মক। যে ভক্তি-দর্শনের মতে ঈশ্বর এক অলৌকিক বিরাট ব্যক্তিবিশেষ তার পক্ষে ‘ঈশ্বর’ এই নামের সঙ্গে নামী ঈশ্বরের অভেদ কল্পনা করা এলৗকিক বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু ঈশ্বর বলতে যদি এক নৈর্ব্যক্তিক সর্বাত্মক চেতনাকে বুঝি, তাহলে আমরা আস্তিকই হই আর নাস্তিকই হই, আমাদের বুদ্ধির সীমানার মধ্যে এক সাধারণ অর্থবোধের ভিত্তিতে নাম ও নামীকে একাত্মা বলে কল্পনা করতে পারি। এই অর্থবোধের সমভূমিতে আমার চেতনাকে “ঐশ্বরিক’ চেতনা থেকে আলাদা করতে পারিনা। এই দিক থেকে বিচার করলে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য” মূলক ভক্তিদর্শনের তুলনায় ভর্তুহরির বৈদান্তিক শব্দাদ্বৈতবাদ মানুষের বিচারবুদ্ধির অনেক বেশী কাছাকাছি। অবশ্য আমাদের এই কথাগুলিকেই শব্দাদ্বৈতবাদের সার ও শেষ সিদ্ধান্ত বলে কেউ যেন ভুল না করেন। যে দর্শনের ভিতরে অনেক কিছুই বিচারবুদ্ধির অগোচর, তাকেও যতখানি বুদ্ধির সীমানায় টেনে আনা সম্ভব ততখানিই চেষ্টা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখা উচিত, যাকে বাক্য ও মনের অতীত বলে মনে করা হয় তাকে বাক্যময় মননের মধ্যে টেনে আনার চেষ্টা করলে অনেকখানি বিকৃতিও অবশ্যম্ভাবী । কিন্তু এই বিকৃতি মেনে না নিলে কোন ব্যাখ্যাই সম্ভব নয়।
আমরা অনেক সময় ‘সমাজমানস’ কথাটি ব্যবহার করি। ভাষা ছাড়া সমাজমানস গড়ে উঠতে পারে না একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অনেক ব্যক্তিবাদী আধুনিক দার্শনিক এই জাতীয় কথাগুলিকে অর্থশূন্য বিমূৰ্ত্ত কল্পনা মাত্র বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। সমাজের কোন দুই ব্যক্তিই যখন এক নয়, তখন সকলের মনকে একত্র করে একটি পিণ্ডাকার ‘সমাজমানস’ কি করে তৈরী করা সম্ভব ? কতকগুলি সোনার টুকরো গলিয়ে মিলিয়ে নিয়ে একতাল সোনা তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু কতকগুলি মন গলিয়ে মিলিয়ে একতাল মন কি তৈরী করা যায় ? তাহলে ‘সমাজমানস’, ‘বিশ্বমানস” এগুলি ফ্যাক কথা, কারণ এদের কোনো অভিধাশক্তি নেই। অভিধাশক্তি শুধু সেই জাতীয় শব্দেরই সম্ভব যে গুলি সাক্ষাৎ উপস্থিত তত্ত্বটিকে মাত্র নির্দেশ করতে পারে। যেমন এক পোচ লাল রং দেখে বললাম, ‘(এই) লাল’। এই মুহূর্তে পেটে ব্যথা অনুভব করে বললাম, ‘(এই) পেট ব্যথা’। এমনি সোজাসুজি ইন্দ্ৰিয়া হৃত প্ৰাথমিক অৰ্থকে নির্দেশ করাই শবেদব অভিধাশক্তি । এখানে তীর যেন একেবারে সোজা গিয়ে লক্ষ্যভেদ করছে। কিন্তু এজাতীয় শব্দ নিয়েও গোল বেধে যায়। তাই প্ৰত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেক ক্ষণের এক একটি অখণ্ডিত অভিজ্ঞতার বুকে যদি এক, দুই, তিনি ক’রে নম্বর এটে দেয়া যেত, তাহলে বোধহয় শব্দের অভিধাশক্তির নির্ভেজাল নিদর্শন মিলত। তবে মুস্কিল হত এই যে কারুর কথাই কেউ বুঝত না। ধরুন আপনার ‘রক্তিম’ অভিজ্ঞতার নাম ১ নম্বর এবং আমার ‘রক্তিম’ অভিজ্ঞতার নাম ২ নম্বর। আপনার অভিজ্ঞতা আপনার, আমার অভিজ্ঞতা আমার, এই দুই-এর মধ্যে মুখ দেখাদেখির কোন প্রশ্নই ওঠেন। আপনি ২ নম্বরের মানে জানেন না । আমিও ১ নম্বরের মানে জানিনা । অথচ “এক দুই’ এই সংখ্যাগুলির অর্থগ্রহণ পরস্পর আপেক্ষিক। তাই নম্বরের কথা বাদ দিন। মনে করুন পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের অসংখ্য কোটি বিন্দু বিন্দু অভিজ্ঞতার জন্য অসংখ্য কোটি সংকেত তৈরী করলাম। তাহলেও আপনার সঙ্গে আমার কথা বলা বন্ধ করতে হবে । কারণ আপনার আমার সংকেতগুলি পরস্পরের কাছে দুর্বোধ্য। তখন একান্তই কথা বলতে হলে নিজের কাছে নিজের কথা বলতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ শুধু আপন মনে বিড় বিড় ক’রে চলবে। নিরঙ্কুশ ব্যক্তিবাদী দার্শনিক তাহলে পৃথিবীকে একটা পাগলা গারদে পরিণত করবে, যেখানে ডাক্তার ও চৌকিদার সবাই পাগল । অথবা মনে করুন, বিধাতা এমন একটি নাটক লিখেছেন যার প্ৰত্যেকটি চরিত্রের প্রত্যেকটি কথাই স্বগতোক্তি এবং যার একটি উক্তির সঙ্গে আর একটি উক্তির কোনো সম্পর্ক নেই।
নিরঙ্কুশ ব্যক্তিত্ববাদী দর্শন হিসাবে বৌদ্ধ দর্শনের জুড়ি মেলা ভার। নিরাকাজক্ষ, নির্লিপ্ত, আত্ম-সম্পূর্ণ নিরন্তর স্রোতোবাহী ক্ষণিক ব্যক্তিসমষ্টি এই জগৎ । বৌদ্ধ দর্শনের পরিভাষায় শুদ্ধ ক্ষণিক ব্যক্তিকে বলা হয় স্বলক্ষণ । স্বলক্ষণ মানে যা নিজেই নিজের লক্ষণ। অর্থাৎ স্বলক্ষণ মানে অলক্ষণ, কোন শব্দের দ্বারা যার লক্ষণ নির্ণয় করা যায় না । সুতরাং বৌদ্ধ দর্শনের মতে যা সত্য তা শব্দের দ্বারা “অনভিলপ্য’-অনির্দেশ্য ও অপ্ৰকাশ্য, কারণ শুদ্ধ ক্ষণিক ব্যক্তিবিশেষই একমাত্র সত্য। একথা মানতেই হবে যে আধুনিক ব্যক্তিত্ববাদী দর্শনের তুলনায় বৌদ্ধ দর্শনের নৈয়ায়িক দৃষ্টি অনেক বেশী পরিচ্ছন্ন। আধুনিক যখাস্থিতিবাদ বা Positivism এবং অস্তিত্ববাদ বা Existentialism পরস্পরের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ সত্ত্বেও ব্যক্তিপ্ৰাধান্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব অৰ্পণ করে। যথাস্থিতিবাদের মতে ব্যক্তির মধ্যে আমি তুমি বা উত্তম পুরুষ ও মধ্যম পুরুষের স্থান নেই। ব্যক্তি বলতে “আমি”, “তুমি’ এমন কি আঁমরা যাকে ‘সে’ বলে নির্দেশ করি তারও-কোনো স্থান নেই। বিশুদ্ধ ব্যক্তি বলতে বুঝি “ইহা” বা “তাহা’-It বা ‘This ও That। “আমিত্বহীন’, ‘তুমিত্বহীন” এই শুদ্ধ ‘ইহা-ময়’ ব্যক্তিসমষ্টিই জগৎ। আমার আমিত্ব বা তোমার তুমিত্ব মুছে ফেললে এবং গাছ, পাহাড়, নদী, সাগর, মানুষ, পশু সব কিছু থেকে বৃক্ষত্ব মনুষ্যত্ব প্রভৃতি সাধারণ ধর্মগুলিকে বিমূর্ত কল্পনা বা abstraction বলে ছাটাই করে দিলে যা বাকী থাকে, তাই হ’ল শুদ্ধব্যক্তি,-নিছক ‘ইহামাত্র”। এই হ’ল মূর্ত ব্যক্তি বা Concrete Particular। এখানে বৌদ্ধ দর্শনের সঙ্গে যথাস্থিতিবাদের চমৎকার মিল রয়েছে। কিন্তু এই মতবাদ থেকে বৌদ্ধ দার্শনিকরা যে স্বাভাবিক ন্যায়ানুগ সিদ্ধান্ত টেনেছেন যথাস্থিতিবাদীরা তা পারেন নি। বৌদ্ধ দার্শনিক ঠিকই বুঝেছিলেন যে বিশুদ্ধ ব্যক্তি সম্পূর্ণ ভাষাতীত। এদিকে পজিটিভিষ্ট দার্শনিক বলছেন– নিছক ব্যক্তিসত্তা মানুষের সাধারণ ব্যবহারিক ভাষার অতীত সন্দেহ নেই, কিন্তু সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে না। এমন কোন ও নূতন ধরণের নৈয়ায়িক বা গাণিতিক সংকেত সৃষ্টি করা সম্ভব, যা দ্বারা বিশুদ্ধ ব্যক্তিকেও নির্দেশ করা যেতে পারে। এ ধরণের সংকেত সৃষ্টির বিপদ আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি। তা হলে প্রত্যেক মানুষের প্রত্যেকটি ক্ষণিক অভিজ্ঞতার জন্য এক একটি আলাদা সংকেত সৃষ্টি করতে হবে, যা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আর যদি বা সম্ভব বলে ধরে নেয়া যায়, তাহ’লেও মানুষে মানুষে, এমন কি এই বিশুদ্ধ দর্শনে দীক্ষিত পণ্ডিতদেৱ মধ্যেও পরস্পর বাক্যালাপ বন্ধ করতে হবে। যে যার নিজ নিজ সংকেতের মধ্যে ডুবে থাকবে। একের অভিজ্ঞতাকে অন্যের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে দেয়া যাবে না।
বৌদ্ধ দার্শনিকরা এ সম্বন্ধে খুবই সচেতন। কোন সংকেতই শুদ্ধ ব্যক্তিকে বুঝাতে পারে না। কারণ শব্দ মাত্রই একটি সাধারণ ধারণাকে সংকেতিত করে যার সঙ্গে প্ৰকৃত ব্যক্তিসত্তার কোনো বাস্তব সম্বন্ধ নেই। এই সাধারণ বিমূৰ্ত্ত ধারণার পারিভাষিক নাম ‘সামান্য যা বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে সমান, অথচ যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এমনকি যে ‘স্বলক্ষণ’ শব্দটি শুদ্ধ ব্যক্তিকে নির্দেশ করে বলে মনে হতে পারে, তাও প্রকৃতপক্ষে শুদ্ধ ব্যক্তিবাচী নয়। কিন্তু সামাল্লিঘাচী। এ শব্দটিও কোনো বিশেষ একটি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে না। কিন্তু যে-কোনো ব্যক্তিবিশেষ সম্বন্ধে নির্বিশেষে প্ৰযুক্ত হয়ে থাকে। “যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ’ বললেই ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে যেতে হয়। ব্যক্তিবিশেষ এবং “যে কোনো ব্যক্তিবিশেষ’ এক কথা নয়। আধুনিক দার্শনিক পরিভাষায় দ্বিতীয় কথাটি একটি variable, constant নয়। বৌদ্ধ দার্শনিক বলবেন, প্ৰতীক বা সংকেত মাত্ৰই variable, constant value সংকেতের দ্বারা নির্দেশ্য ও অপ্রকাশ্য– ইহা “অনভিলপ্য’। ইংরেজী ‘a’ বা ‘any’ শব্দটি variable, কিন্তু “Socrates” হ’ল constant, পাশ্চাত্ত্য ন্যায়শাস্ত্রের এই ভেদরেখা বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রে অগ্ৰাহ। আমি আর আপনি এক নই, সুতরাং আমার ও আপনার বোধ ও অভিজ্ঞতাও এক নয়, কাজেই আমার বোধবিধৃত সক্রেটিস থেকে আপনার সক্রেটিস আলাদা। শুধু তাই নয়, আপনার বা আমার দুই ক্ষণের দুইটি অভিজ্ঞতাও এক নয়। এদিকে যাকে এক সক্রেটিস ব্যক্তি বলে মনে করা হয় তিনিও এক ব্যক্তি নন, পূর্বাপরীক্ষণবাহী বহু সদৃশ ক্ষণিক ব্যক্তির সন্তান বা প্ৰবাহকে কল্পনায় ঐক্যবদ্ধ ক’রে সক্রেটিসকে মিথ্যাই এক বলে। চালাবার চেষ্টা করা হয়। ক্ষণে ক্ষণে নিত্য নূতন এই সক্রেটিস বক্তা ও শ্ৰোতার অভিজ্ঞতা অনুসারে জনে জনে “vary’ করছে। তাই ‘Socrates’ও variable মাত্র। তেমনি It, This, That প্ৰভৃতি যে কোনো demonstrative pronouns variable। বৌদ্ধ ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে পাশ্চাত্ত্য ন্যায়শাস্ত্রের ‘Logical Proper Name’ মোটেই proper name নয়, সবই general name। বৌদ্ধদের ‘স্বলক্ষণ’ শব্দটিও কোনো বিশেষ বিশুদ্ধ ব্যক্তিসত্তার নাম বা লক্ষণ নয়। শুদ্ধ ক্ষণিক অদ্বৈত সত্তাকে কোনো নামের দ্বারা নির্দেশ করা যায় না, এই নেতিবাচক ধারণাকে ধারণ করার জন্যই স্বলক্ষণ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতরাং বৌদ্ধ মতে ‘সমাজমানস’ ‘বিশ্ব-মানস’, প্রভৃতি শব্দগুলি নিরর্থক নয়, সম্পূর্ণ সার্থক, কিন্তু বস্তুহীন। এইরূপ বস্তুহীন সাধারণ ধারণাই হ’ল শব্দের অর্থ। এর পারিভাষিক নাম হ’ল বিকল্প। বস্তুহীন ধারণার আকারে বিকল্পিত হয় বলেই শব্দার্থকে বিকল্প বলা হয়। শব্দার্থ সম্বন্ধে বৌদ্ধদের প্রসিদ্ধ নীতিবাক্যটি খুবই তাৎপৰ্যপূর্ণ-‘শব্দের উৎস বিকল্প, বিকল্পের উৎস শব্দ, শব্দ ও বিকল্প পরস্পরকে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এরা কেউই শুদ্ধসত্তাকে স্পর্শ করতে পারে না।” পজিটিভিষ্টদের ভ্ৰান্তি এইখানে যে তারা abstract শব্দকে নিরর্থক বলেছেন এবং শুদ্ধ ব্যক্তিসত্তাকেও সার্থক সাংকেতিক শব্দের দ্বারা নির্দেশযোগ্য বলে মেনে নিয়েছেন। বৌদ্ধরা দেখিয়েছেন যে যত সূক্ষ্মতম সংকেতই তৈরী করি না কেন শব্দ মাত্রেরই অর্থ হ’ল abstraction ; সুতরাং abstract শব্দ নিরর্থক নয়। কারণ abstractionই হ’ল শব্দের সার্থকতা। কিন্তু যা সার্থক তা বস্তুহীন । বস্তু কখনো শব্দার্থ হতে পারে না ।
অস্তিত্ববাদী বা Existentialist দার্শনিকরা পজিটিভিষ্টদের বিপরীত দিক থেকে সুরু ক’রে ব্যক্তিত্ববাদের ওপর জোর দিয়েছেন। এরা উভয়েই ব্যক্তিত্ববাদী, কিন্তু বিপরীত অর্থে। বলা যেতে পারে পজিটিভিষ্টরা ব্যক্তিবাদী, কিন্তু “ব্যক্তিত্ব”বাদী নয়, অপরপক্ষে অস্তিত্ববাদীরা ব্যক্তিত্ববাদী কিন্তু ব্যক্তিবাদী নয়। পজিটিভিষ্ট দর্শন জগতের বস্তুসত্তা থেকে person ও personality-কে নির্বাসন দিয়েছে, যা জমা রইল তা concrete individual নয়, কিন্তু concrete particular—ব্যাকরণের ক্লীবলিঙ্গ প্রথম পুরুষ একবচন। কিন্তু অস্তিত্ববাদী দর্শনে ব্যক্তি মানে concrete individual, person বা personality। তাদের দার্শনিক ব্যাকরণে উত্তম পুরুষ এক বচনের প্রাধান্য। অস্তিত্ববাদের অহং-পুরুষ কস্তুরী মৃগ সম আপন গন্ধে পাগল হয়ে সংসার-অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। আপনা থেকে আপনি বিচ্ছেদে আত্মহারা এই আত্মপুরুষ জগত থেকেও বিচ্ছিন্ন। এই দ্বিগুণ বিচ্ছেদ-জালায় জর্জরিত আত্ম-পুরুষের আত্ম-জিজ্ঞাসার তাই কোনো বিরাম নেই। নিত্য পরিবর্তনশীল জগৎ নিত্য নূতন সমস্যা ও সামঞ্জস্যের দাবী নিয়ে অখণ্ড আত্মাকে দ্বিখণ্ডিত করছে। এই আত্মপুরুষ যেখানে নিঃসঙ্গ একাকী সেখানে তার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা তুৱীয় ভাবে ভোগ করার উপায় নেই, কারণ সমাজ সংসারের কলরব নিরন্তর এসে সেখানে আঘাত করছে। এই আঘাতকে স্বীকার করা যায় না, অস্বীকারও করা যায় না। সুতরাং আত্মাও যেন দ্বিধায় পড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে । বাইরের সমাজ সংসার আত্মারই নেতিবাচক দিক, শুদ্ধ ব্যক্তিত্ব তার ইতিবাচক দিক। আত্মা নিজে যা এবং যা নয় এই Being ও Nothing নিয়ে হল সত্তা বা Existence. Nothing মানে বস্তুহীন অভাব মাত্র নয়, একে ভারতীয় নৈয়ায়িকদের “অন্যোন্থাভাব” বলা যেতে পারে। গরু মানুষ থেকে আলাদা । মানুষের অভাব রয়েছে। গরুতে । গরু অভাবের আধার, কিন্তু নিজে অবস্তু নয় । বিশুদ্ধ Being বা আত্মপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন আত্নেতর বহির্জগতকে এই বিচ্ছেদের আধার হিসাবে Nothing বলা হয়েছে। তেমনি বহির্বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন মানবাত্মাকে ঐ একই বিচ্ছেদের আধার হিসাবে Nothing বলা যেতে পারে। এ অর্থে Being ও Nothing একই সত্তার দ্বৈতচরিত্র মাত্ৰ; Nothing সংজ্ঞাটি এখানে অভিধার্থে ব্যবহার করা হয় নি, হয়েছে লাক্ষণিক অর্থে। আধেয়ের দ্বারা আধারকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এই লক্ষণ নিষ্প্রয়োজন নয়। আত্মেতার থেকে আত্মার বিচ্ছেদের উপর গুরুত্ব অৰ্পণ করতে হলে একটি নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা উচিত। এই বিচ্ছেদের গুরুত্ব প্ৰকাশ করার প্রয়োজনেই লক্ষণার আশ্রয় গ্ৰহণ করা হয়েছে। অদ্বেগ্নতর জগৎ বস্তুহীন নয় বলেই Nothing-এর অভিধার্থ এখানে বাধিত হচ্ছে। মুখ্যাৰ্থ বাধিত হলেই লক্ষণার প্রয়োগ অনিবার্যে। সুতরাং এই লক্ষণার সঙ্গে সঙ্গে Nothing শব্দটি দ্বারা অস্তিত্ববাদী দর্শনে “ আত্ম-বিচ্ছেদের’ গুরুত্ব ধ্বনিত হচ্ছে। আত্মেতার জগৎ বোঝাতে Nothing শব্দটির লক্ষণা, আত্ম-বিচ্ছেদের গুরুত্ব প্ৰকাশ করতে ব্যঞ্জনা, একই শব্দের এই দুইটি শক্তি এখানে অনস্বীকাৰ্য্য।
ভারতীয় দর্শনের পরিভাষার সাহায্যে এই ভাবে সর্বাধুনিক অস্তিত্ববাদকে বুঝবার প্রচেষ্টা অনেকের কাছে আপত্তিকর হতে পারে। অস্তিত্ববাদের “ আত্ম দর্শন’ অপরোক্ষানুভূতি বা intuition-এর উপর নির্ভরশীল হলেও একে বুঝতে হলে ব্যাখ্যা করতে হলে বিচার বুদ্ধির আলোকপাত ছাড়া উপায় নেই। ভারতীয় দর্শনের পরিভাষাগুলি এত পরিচ্ছন্ন যে এখানে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা খুবই কম, কারণ কোন অর্থে কোন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা বুঝতে কষ্ট হয় না। অস্তিত্ববাদী দর্শনের অন্যান্য দর্শন থেকে একটা প্ৰধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল এই যে এই দর্শন নৈয়ায়িক বিচার বুদ্ধি ও তর্ক বিতর্কের ধার ধারেনা। ফলে একই শব্দ কোথায় অভিধার্থে, কোথায় লাক্ষণিক অর্থে, কোথায় বা ব্যঞ্জনগত অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, তা বোঝা দুষ্কর। যেখানে ন্যায়শাস্ত্রের বিচার নেই এমন দর্শন সাহিত্যে পরিণত হতে বাধ্য। আর দর্শন সাহিত্যে পরিণত হলে, সাহিত্যের সাহিত্য melodrama-র হাত থেকে নিস্কৃতি পেলেও, তর্কবিহীন দর্শনের সাহিত্য melodramatic হতে বাধ্য। তাই সার্ত্রর Being and Nothingness চিরাচরিত দৰ্শন-রসিকদের নিকট এক খণ্ড বিপুলকায় metaphysical melodirama বলে মনে হবে। নৈয়ায়িকসুলভ-বিশ্লেষণবিহীন অপরূপ বাচনভঙ্গিমায় একই কথার বিভিন্ন আকারে এমন একঘেয়ে পুনরুক্তি মননধর্মী দর্শনপাঠকের দার্শনিক রুচিকে পীড়িত করে। জ্ঞান ও জ্ঞেয় বস্তু এক নয়। অথচ এ দুই-এর মধ্যে একটা দুরপনেয় সম্বন্ধ রয়েছে এই সহজ কথাটি বুঝানো হল এই ভাবে :
জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য বিচ্ছেদ রয়েছে। অথচ চেতনা যা সে নয়। সব সময় তারই কাছে উপস্থিত হয়। যা সে নিতান্তই নয়। তাকে এড়িয়ে চেতনার অস্তিত্বই অসম্ভব। এর অর্থ হ’ল য। সে নয়। তাই দিয়েই চৈতন্যের পরিচয়। এই নাস্তিত্ব নিয়েই চেতনার আবির্ভাব। অনন্ত বিচ্ছেদ নিয়ে যার আবির্ভাব অনন্ত বিচ্ছেদই তার পরিচয়। এই বিরহযাতনার কোনোদিন বিরাম নেই। তাই আমার অস্তিত্বের ভিতরে সব সময়ই একটা নাস্তিত্বের আৰ্ত্তিনাদ আছে। অতএব জ্ঞান থেকে জ্ঞেয়ের বিচ্ছেদ আমারই অন্তবিচ্ছেদের নামান্তর, কারণ নাস্তিত্ব আমার অন্তরঙ্গ সত্তারই একটা অঙ্গ। এই বিচ্ছেদ ঘুচোনোই আমার সমস্যা; আমি যা আছি তা আমি হতে চাই না, যা নাই তাই আমি হতে চাই! আমি এখন হোটেলের পরিচারক, কিন্তু এই পরিচারকই আমি নই। ধরুন আমি চাই সাংবাদিক হতে বা মন্ত্রী হতে। এর অর্থ, এই ‘পরিচারক আমি’র নিকট থেকে আমাকে আমি বিচ্ছিন্ন ক’রে নিয়ে, যা আমি নই সেই ভাবী মন্ত্রী বা সাংবাদিক রূপে আমাকে আমি পুনর্গঠিত করতে চাই। এই ভাবে ভবিষ্যতের সঙ্গে বর্তমান আমিত্বের ব্যবধান ঘুচিয়ে নিত্য নূতন ক’রে আমাকে আমি পুনর্গঠিত করি। আমি এখনো যা হয়ে উঠিনি কি ক’রে তা হয়ে উঠতে পারি। আমার সকল আশা আকাঙ্ক্ষা এই পুনবিন্যাসের নিরন্তর প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু এই পুনর্বিন্যাস কোনো দিন পূর্ণ হবে না। আমার বিচ্ছেদ চিরন্তন। আমার নাস্তিত্বস্বরূপ দুরতিক্রম্য।
সহজকে সুগম্ভীর করা, obviousকে profound করার এই নিদর্শন মেনে নিয়েও দার্শনিক বিচারে একটা কথা হেঁয়ালি বলেই মনে হয়। আমি গরু নাই সত্য, কিন্তু গরুর নাস্তিত্বটা আমি হলাম কি ক’রে? “আমি গরু নই, এই সরল বাক্যটির এ জাতীয় দুর্বিষহ গম্ভীর অর্থ করলে সার্বজনীন ভাষাবোধের দুরন্ত ব্যভিচার করা হয়। আমি রাজা নেই, রাজা হতে চাই, ভাল কথা। যদি রাজা হতে পারি, সাংখ্য দর্শন বলবে, বর্তমান আমির মধ্যে রাজা হবার সুপ্ত শক্তি ভবিষ্যতে জাগ্রত ও অভিব্যক্ত হবে। এ কথা বুঝতে পারি। কিন্তু যখন আমি রাজা নাই, তখন ভবিষ্যৎ রাজার বর্তমান নাস্তিত্বটাই আমার আমিত্ব, এটা দার্শনিক বিচারের কথা নয়, দর্শনের আকারে বুদ্ধির ওপর হেঁয়ালিপনার দৌরাত্ম্য। মাটি থেকে ঘট তৈরী হবার আগে পর্যন্ত ঘটের যে অভাব রয়েছে নৈয়ায়িক তার নাম দিয়েছেন ‘প্রাগভাব’, অর্থাৎ বস্তু উৎপন্ন হবার পূর্ব পৰ্যন্ত বস্তুর অভাব। ঘটের প্রাগভাব মাটিতে আছে বটে, কিন্তু ঘটের প্রাগভাবটাই মাটি নয়, বা ঘটের প্রাগভাব দিয়ে মাটিটা তৈরী হয়নি। উপনিষদ ‘নেতি নেতি’ বলে আত্মতত্ত্ব বুঝাতে চেয়েছে। কিন্তু নাস্তিত্বটাকেই আত্মস্বরূপ বলেনি। প্রথম দিকে ভারতীয় দর্শনের পরিভাষার মধ্য দিয়ে অস্তিত্ববাদকে আমরা যেভাবে বুঝতে চেয়েছি সে ভাবে হয়ত কিছুটা বুঝতে পারি। কিন্তু অস্তিত্ববাদীর নিজের ভঙ্গীতে যা বলার চেষ্টা করা হল ওটা বোধ হয় অপচেষ্টারই সামিল। সাত্রর Being and Nothingness-as ইংরেজী অনুবাদের ভাষা তার দর্শনের প্ৰতিচ্ছবি বলে মনে হয় (ফরাসী জানিনা বলে বলছি)। অর্থাৎ এই ভাষা ভাষার কাজ করেন, লেখক ও পাঠককে সমান বোধ, সমান চেতনার অংশীদার করে না, বরং অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জন শক্তির সমস্ত নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে লেখক ও পাঠকের মধ্যে দুর্লঙ্ঘ্য দুবিষহ ব্যবধান গড়ে তোলে। দর্শন থেকে দার্শনিকের এই বিচ্ছেদ মর্মান্তিক। যে দর্শন জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের সম্পর্ককে একটা দুঃসহ দুর্লঙ্ঘ্য বিচ্ছেদ ব’লে ভূমিকা সুরু করেছে এবং একটা নিঃসহায় নাস্তিত্বকে ব্যক্তিপুরুষের স্বরূপ ব’লে ধরে নিয়েছে, সে দর্শনকে অস্তিবাদী বলা বিপরীত লক্ষণার নামান্তর মাত্র, কারণ মুখ্যার্থের বিচারে এর নাম হওয়ার উচিত ছিল নাস্তিত্ববাদী দর্শন।
সার্ত্র যে ভাবে মানবচেতনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা থেকে চেতনাকে স্বপ্ৰকাশ বা পরপ্ৰকাশ কোনটাই বলা যায় না। সাত্ৰ বলেন জ্ঞেয় থেকে বিচ্ছিন্ন ব’লেই জ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিচ্ছেদকে যখন জ্ঞানের স্বরূপ বলে ধরা হয়েছে তখন যার থেকে বিচ্ছেদ তাকে বাদ দিয়ে বিচ্ছেদ সম্ভব নয়, তাই জ্ঞেয় বিষয়কে বাদ দিয়ে জ্ঞানের স্বরূপ লাভও সম্ভব নয়। এই অর্থেই জ্ঞান জ্ঞেয় বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এখন জ্ঞানের আবির্ভাব স্বরূপলাভ বা প্ৰকাশ একই কথা। তাই নিরন্তর পরনির্ভরশীলতার জন্য জ্ঞান স্বপ্ৰকাশ হতে পারে না। এ জাতীয় “বিচ্ছেদ-যাতনা’- মুখর ভাষা ব্যবহারের বিপদ হল এই যে কেউ অনুরূপ যুক্তি প্রয়োগ করে বলতে পারেন-গরু গণ্ডার থেকে বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছেদ গরুর আত্মস্বরূপ। সুতরাং গো-স্বরূপ গণ্ডারের ওপর নির্ভরশীল। অস্তিত্ববাদী এর উত্তরে বলবেন-আমি যে বিচ্ছেদের কথা বলেছি তা শুধু চেতনার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, চেতনা-বহির্ভূত বস্তু সম্পর্কে প্রয়োজ্য নয়। কিন্তু এ যুক্তির কথা নয়, অনুশাসনের কথা।
জ্ঞান পর-প্ৰকাশ ও নয়। জ্ঞেয় জগৎ থেকে জ্ঞানের অনুমান করা যায় না। কিন্তু জ্ঞান থেকেই জ্ঞেয় জগতের অনুমান করা সম্ভব। এর অর্থ জ্ঞানের দ্বারাই বিষয় প্ৰকাশিত হয়, প্ৰকাশিত হয় বলেই তার অস্তিত্বকে স্বীকার করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাত্ৰ পাঠকদের সতর্ক ক’রে দিলেন-এর মানে এই নয় যে জ্ঞান জ্ঞেয় অপেক্ষা স্বাধীন বা প্ৰাচীন। কিন্তু জ্ঞান বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে চলে যায়, (transcends the world), জ্ঞান নিজেই একটি প্রকাশযোগ্য বিষয় নয় (not itself a phenomenon) জ্ঞান পরবর্তী কোনো জ্ঞান অর্থাৎ অনুব্যবসায় বা introspection দ্বারাও প্ৰকাশ্য নয়। ভারতীয় নৈয়ায়িক বলেন-জ্ঞান পরবর্তী অনুব্যবসায় দ্বারা প্ৰকাশিত হয়। আমার বর্তমান কালীন ঘাট-জ্ঞান পরীক্ষণে “আমি ঘট জানি’ এইরূপ দ্বিতীয় জ্ঞানেীয় বিষয় রূপে প্ৰকাশিত হয়। এর উত্তরে স্বপ্ৰকাশবাদী বলেন—তাহলে অনবস্থা দোষ বা infinite regress অপরিহার্য। এই দ্বিতীয় জ্ঞান আত্মপ্রকাশের জন্য তৃতীয় জ্ঞানের উপর নির্ভর করবে, তৃতীয় জ্ঞান চতুর্থ জ্ঞানের অপেক্ষা রাখবে। সুতরাং কোনো জ্ঞানই কোনো দিন প্রকাশিত হবেনা। সাত্র পর-প্রকাশবাদীদের বিরুদ্ধে এই একই যুক্তি প্ৰদৰ্শন করেছেন।
জ্ঞান স্বপ্রকাশ ও নয়, পর-প্রকাশ ও নয়, কিন্তু প্রতিক্ষণে নিজকে নূতন করে পুনর্বিন্যস্ত করছে।-এর দ্বারা জ্ঞানতত্ত্ব যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেল। এই নাস্তিরূপী অস্তিবাদের রহস্য আরও ঘনীভূত হয় যখন ভাষার সঙ্গে চেতনার মিল লোপ পায়। অস্তিত্ববাদীর মতে আমি যখন গরু দেখছি তখন দর্শন-জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই ‘আমি গরু নই’ এই নাস্তিত্বও আমার ‘আত্মস্থ’ হয়ে গেল। এর অর্থ দাঁড়ায় আমার গরু দেখা আর ‘আমি গরু নাই’ একই কথা। কারণ চেতনামাত্ৰই নাস্তিরূপে জগতে আবিভূতি হয়। তা হলে ‘আমি গরু দেখছি’ এবং “আমি গরু নাই’-এই দুটি বাক্য সমার্থক। যদি বলা হ’ত দ্বিতীয় বাক্যার্থটি প্রথম বাক্যার্থ দ্বারা ব্যঞ্জন শক্তির মাধ্যমে ধ্বনিত হচ্ছে তা হ’লে হয়ত বিশেষ আপত্তিকর কিছু ছিল না। কিন্তু তাহলে অস্তিত্ববাদ মূলেই নিমূল হয়ে যেত। অস্তিত্ববাদের গোড়ায় কথাই হ’ল-নাস্তিরূপ ছাড়া চেতনার প্রকাশ বা আবির্ভাবই সম্ভব নয়। সুতরাং “আমি গরু দেখছি’। আর ‘আমি গরু নাই’ এ দুটো একই জ্ঞান। অতএব বলতেই হবে ‘আমি গরু দেখছি’ এবং “আমি গরু নাই’ এই বাক্য দুটি মুখ্যার্থের দিক থেকেও সমার্থক। যদি অস্তিত্ববাদী বলেন-“এই আমার তর্কাতীত অনুভূতি’, এর উত্তরে পাঠক শুধু বলতে পারেন—“আমার অনুভূতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার আপনার মধ্যে কোনো সাধারণবোধ্য ভাষার মাধ্যম নেই। আপনি যদি বলেন যে আপনি মুরগী খাচ্ছেন, আমি কখনো মনে করতে পারব না যে আপনি আমাকে বুঝাতে চাইছেন যে আপনি নিজে একটা মুরগী নন। আর যদি প্রত্যেকের নিজস্ব অনুভূতি ভাষাতীত হয় তাহলে হতচ্ছাড়া মানব সমাজ একদিন ও টিকত না। সমাজ সংসার সবই মিছে হত। সকল ভাষার কলরব একদিনে মুছে যেত।
সাত্রর সাহিত্য ধারা বুঝতে পারেন তারা যদি তার গুরু গম্ভীর দার্শনিক গ্রন্থ বুঝতে না পারেন, তবে সমস্ত দোষটা পাঠকের বোধ-দৈন্যের উপর চাপিয়ে দেয়াটা সঙ্গত হবে না। সাহিত্যের মত দর্শনশাস্ত্র ও অনুভূতি মাত্ৰই নয়, কিন্তু ভাষার সাধারণ মাধ্যমে অনুভূতির সার্থক প্ৰকাশ। সাত্রের দর্শনে এই প্ৰকাশ কেন ব্যাহত হচ্ছে অন্যদিক থেকে তা আলোচনা করা যাক। আমার কাছে আমি ব্যাকরণের উত্তম পুরুষ, কিন্তু আপনি মধ্যম পুরুষ। আবার আপনার কাছে আপনি উত্তম পুরুষ, কিন্তু আমি মধ্যম পুরুষ। এক ব্যক্তিপুরুষ যখন অন্য কোন ব্যক্তি-পুরুষের চেতনার বিষয়ৰূপে প্ৰতিভাত হয়, তখনই উত্তমপুরুষ মধ্যমপুরুষের চরিত্র অর্জন করে। অর্থাৎ একই জ্ঞাতৃপুরুষ একাধারে বিষয় (object) ও বিষয়ী (subject)। কিন্তু অস্তিত্ববাদের মূল সূত্র অনুসারে আমার বহির্জগতে আপনি রয়েছেন এবং আপনার বহির্জগতে আমি রয়েছি, এবং চেতনা ও চেতনার বহির্ভূত বিষয় জগতের মধ্যে রয়েছে এক দুস্তর ব্যবধান। সুতরাং আপনার ও আমার মধ্যেও দুনিবার বিচ্ছেদ স্বীকার ক’রে নিতে হবে। তা’হলে মানুষে মানুষে যোগাযোগটা কি ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? Solipsism বা স্ব-বিজ্ঞানবাদের হাত থেকে নিস্কৃতির উপায় কি? মানবদরদী অস্তিত্ববাদী দার্শনিক মানবিক সম্পর্ক অস্বীকার করতে পারেন না, তাই Solipsism স্বীকার করতে পারেন। না। তঁাকে ঘোষণা ক’রে বলতে হয়- আমি নিজেই যে অন্যের চেতনার বিষয় এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, অথচ আবার বলতে হয়- আমি যখন অন্য এক চেতন ব্যক্তিকে জানি, বুঝি, ভালবাসি বা ঘৃণা করি, তখন আমি তার শুদ্ধ বিষয়ী স্বরূপটিকে (subjectivity) জানি না, তার বিষয়-স্বরূপটিকেই (objectivity) জানি। কিন্তু চেতনের সঙ্গে চেতনের সম্পর্ক চেতন ও অচেতনের সম্পর্ক থেকে স্বতন্ত্র। এটা ঠিক বস্তুজগতের সম্পর্ক নয়। ব্যক্তিচেতনা অচেতন বস্তুর উপর নির্ভরশীল হয়ে ও বিষয়বস্তুকে অতিক্রম করে, কারণ এই নির্ভরশীলতা এক মৌলিক বিচ্ছেদের আকারে আকারিত হয়। এই অর্থে আমার ব্যক্তিত্ব transcendental বা অতিক্রান্তিশীল। এখন আমি নিজেই যদি অন্য এক চেতনার বিষয় হয়ে পড়ি, তা হ’লে সেই অপর বিষয়ী চৈতন্য আমার অতিক্রান্তিশীল সত্তাকেও অতিক্রম করে যাবে, কারণ বিষয়কে অতিক্রম করাই বিষয়ীর স্বভাব। সুতরাং চেতনের সঙ্গে চেতনের সম্পর্ক (inter-subjective relation) হল অতিক্রান্তিকে অতিক্রম করার সম্পর্ক, double transcendence বা double negation.
এখানে ঘনগম্ভীর আড়ম্বর ক’রে যা বলা হ’ল তা কিন্তু সামান্যই। চেতন মানুষের সম্পর্কটা যে unique বা স্বতন্ত্র অন্য বস্তুজাগতিক সম্পর্কের মত নয়, সে কথাটাই ঘটা ক’রে বলা হ’ল। চেতন মানুষই অচেতন বস্তুকে জানে, অচেতন চেতনকে জানে না। কিন্তু দুজন মানুষ একে অন্যকে জানে। পৰ্য্যায়ক্রমে প্ৰত্যেকেই জ্ঞাতা, প্ৰত্যেকেই জ্ঞেয়। এই সহজ সত্যটিকে ‘Transcendence is transcended’ এ জাতীয় প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের জমকালো ভাষার চাপরাস চাপিয়ে আচ্ছাদিত করা হ’ল কেন? সম্পর্ককে প্রথুম থেকেই মিলন-প্ৰধান সম্বন্ধ না ব’লে, বিচ্ছেদ-প্ৰধান সম্বন্ধ ব’লে কল্পনা করাটাই এই আড়ম্বরের কারণ। বিচ্ছেদের অন্ত নেই বলেই
মিলন প্ৰচেষ্টার শেষ নেই। কিন্তু যারা জ্ঞাতা সেই মানুষই যখন পরস্পর জ্ঞতৃ-জ্ঞেয় সম্বন্ধে সম্বন্ধ হয়, তখন সম্বন্ধটা বিচ্চেদভিত্তিক ব’লে ধারণা করা খুবই কষ্ট কল্পনা। স্পষ্টতই মানবিক সম্বন্ধগুলি বিভিন্ন ব্যক্তির চেতনার সাদৃশ্য বা মিলনকে ভিত্তি ক’রেই অনুভূত হয়। কিন্তু অস্তিত্ববাদী ‘স্বসিদ্ধান্তহানির’ ভয়ে একথা বলতে পারেন না । সুতরাং বিভিন্নতাকে বিচ্ছিন্নতার পৰ্য্যায়ভুক্ত ক’রে নিয়ে মানবিক সম্বন্ধের মধ্যেও বিচ্ছেদমূলক নাস্তিত্বপ্রাধান্য আমদানী করতে হয়েছে । এর ফলেই অস্তিত্ববাদী দর্শনের পাতায় পাতায় separation, alienation, discontinuity, transcendence, double transcendence প্রভৃতি negative terminology একঘেয়ে মিছিল চলছে।
যাই হোক, অস্তিত্ববাদী দর্শন solipsism-এর হাত থেকে ব্যক্তি-মানুষকে কি ক’রে রক্ষা করতে পারে এ প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মানুষে মানুষে দুস্তর ব্যবধানটাও একটা সম্বন্ধ, এ কথা ব’লে solipsism দূর করা যায় না। অথবা “আমি অন্যকে জানি এবং অন্যে আমাকে জানে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ’-একথা একটা বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয়ের ঘোষণা হতে পারে, কিন্তু বিঘোষিত বিশ্বাসটাই যুক্তি নয়। অথবা “বস্তুতে বস্তুতে যে সম্বন্ধ এবং চেতনের সহিত অচেতন বস্তুর যে জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় সম্বন্ধ তা থেকে মানুষে মানুষে জ্ঞাতৃ-জ্ঞেয় সম্পর্কটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র’ -এই স্বাতন্ত্র্যের ঘোষণাটাও অকাট্য প্রমাণ নয়, বিশেষ ক’রে যেখানে মূল দার্শনিক প্রত্যয়টা বিচ্ছেন্দমুখীন। সাত্রের গভীর সংবেদনশীল মানবদরদী হৃদয় এবং দার্শনিক মননশীল মানস-এ দুইয়ের ভিতরে একটা বৈপরীত্য রয়েছে। বিশ্লেষণী যুক্তির কাছে মানুষ ও বস্তুজগৎ এবং মানুষ ও মানুষের মধ্যে “বিশ্লেষ’টাই বড় হ’য়ে দেখা দেয়। শোষণভিত্তিক পুজিবাদী সমাজব্যবস্থার ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই ‘বিশ্লেষ’ মর্মান্তিক ভাবে হৃদয়কে আঘাত করে । হৃদয়ের দাবী,-মিলতে হবে। নিজের মধ্যে অপরের নাস্তিত্বরূপটাকেই মানুষের শেষ কথা বলে হৃদয় মেনে নিতে পারে না । মেলবার ও মেলাবার প্রচেষ্টা হৃদয়ের স্বাভাবিক প্ৰবৃত্তি । মনন ও সংবেদনের এই বৈপরীত্যের মধ্যে সমন্বয় সৃষ্টি করতে গিয়ে মানবদরদী অস্তিত্ববাদী দর্শন একটা চমকপ্ৰদ সিদ্ধান্তে পৌছেছে-‘অন্তহীন বিচ্ছেদের মধ্যে বিরামহীন মিলন প্ৰচেষ্টা-এই মানুষের ভাগ্য। বিচ্ছেদের শেষ নেই, তাই মিলনের পূর্ণতা Cat-Man is condemned to be free’–“Liberty is lack of being in relation to given being and not the emergence of a positive being’.
মানুষের স্বাধীনতার এই অদ্ভুত ধরণের negative definition বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উপস্থিত বর্তমানকে মানুষ চায়না, এই না চাওয়ার ক্ষমতাটাই মানুষের স্বাধীনতা । এখানেই তার দায়িত্ববোধ ও কাৰ্যকলাপের উৎস। অনীপ্তিসত বর্তমানকে অতিক্রম করে ঈপিসত ভবিষ্যতের মধ্যে মানবসত্তার যে পুনর্বিন্যাস সেই অস্তিবাচক দিকটা বাস্তব নয়, সম্ভাবনা মাত্র । কিন্তু অনী পিসত বর্তমান থেকে মানবাত্মার যে বিচ্ছেদ-বাসনা সেই নাস্তিবাচক চরিত্রটাই হ’ল স্বাধীনতার বাস্তব সত্তা ( facticity ) ।
মানুষের স্বাধীনতার দার্শনিক লক্ষণ নির্ণয়ে negative চরিত্রটাকে যদি প্রধান ব’লে ধরে নিতে হয়, তবে মানুষের ব্যক্তিসত্তার গভীরতা খুঁজতে হয় একটা নিঃসঙ্গ একাকিত্বের মধ্যে । অনীপ্সিতকে না চাইতে পারাটাই স্বাধীনতা, সেই emergence of a positive being, ঈপ্সিতের অস্তিধর্মী আবির্ভাব স্বাধীনতার অন্তরঙ্গ সত্তা নয়, এর ন্যায়সংগত অর্থ দাড়ায়-একটা নিঃসীম শূন্যতার নিরাবরণ হাহাকারই হ’ল আত্মিক স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। যদি বলা যায়, যা নাই তাইতো আমি চাই, সুতরাং এই শূন্যতা-বোধটাই ○| মুক্তির মূলমন্ত্র, তাহলে একটা মারাত্মক দার্শনিক ভ্রান্তিকে প্রশ্ৰয় দেয়া হয়। কি আমি চাই তার positive ধারণা না থাকলে কি আমার নাই তার বোধ হতে পারে না। তাই নৈয়ায়িক বলেছেন-যা positive সেই ‘প্ৰতিযোগী’র বোধ ছাড়া megation-এর বোধ থাকতে পারে না। সুতরাং শুদ্ধ negation কোন সত্তার স্বরূপ লক্ষণ হতে পারে না। নিস্কৃতিই মুক্তি নয়, positive-এর প্রাপ্তিই মুক্তি। নিস্কৃতি মাত্রকে মুক্তি বললে যার হাত থেকে নিস্কৃতি সেই অপাদান কার্যকটির মধ্যেই সমস্ত positive content সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, নূতনের সঙ্গে যোগটাও দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে না। সুতরাং কর্তৃকারকরূপী মানুষটির উভয় প্ৰান্তেই বিচ্ছেদ জমে ওঠে। এর অবশ্যম্ভাবী। ফল এক নিরালম্ব নিরাধার নিঃসঙ্গ ‘স্বাধীন’ ব্যক্তিসত্তা-যার অপর নাম solipsism অস্তিত্ববাদী দার্শনিক solipsism মানেন না । অথচ তাঁর সমস্ত সংজ্ঞা ও পরিভাষা-শাস্ত্রে নাস্তিত্ববাচক শব্দসম্পদের প্রাধাণ্য, নাস্তিধর্মী চরিত্রের উপর অর্পিত অকাতর গুরুত্ব এই solipsism বা ‘স্ব-সংবেদনবাদের’ দিকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে ঠেলে নিয়ে যায়। এজন্যই অস্তিত্ববাদী দর্শনের আশাবাদের ভিতরেও মাঝে মাঝে অবসন্ন নিঃসঙ্গতার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।
বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধদৰ্শন ‘স্ব-সংবেদন’কেই একমাত্ৰ প্ৰামাণিক সত্তা বলে স্বীকার করেছে। তাহলে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগটা কি করে সম্ভব হচ্ছে। বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ তার যুক্তির প্রতি একনিষ্ঠ নিষ্ঠ রেখে উত্তর করলেন-এই যোগাযোগটা পারমার্থিক সত্য নয়, ব্যবহারিক সত্য মাত্র, বৌদ্ধ পরিভাষায় ‘সাংবৃত সত্য”। তাহ’লে অহিংসা, প্ৰেম, মৈত্রী, করুণা, সৌভ্রাত্র, কার জন্য? সংঘের শরণ নিয়েই বা লাভ কি? এ জাতীয় প্রশ্নের জন্য বৌদ্ধ দার্শনিক প্রস্তুত ছিলেন। উত্তর করলেন, ব্যবহারিক সত্যু পারমার্থিক সত্যের সোপান হিসাবে কাজ করে। সবাই মিলে সবাইকে ভালবাসব এইজন্য, যাতে সবাই মিলে উপলব্ধি করতে পারি যে পারমার্থিক সত্যের ভূমিতে আত্মার সঙ্গে আত্মার মিল নেই, এক-ক্ষণের আত্মার সঙ্গে পরীক্ষণের আত্মারও কোনো মিল নেই, এক স্থির আত্মা বলে কিছু নেই, আছে স্তম্বু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নিরন্তর প্রবাহ বাহিত এক একটি নিঃসঙ্গ নিলিপ্ত ক্ষণিক বিজ্ঞান। এ নৈরাত্ম্য-ভাবনাই নির্বাণের সাধনা। হিংসা-দ্বেষ-বৈরিতা এই অদ্বৈত নৈরাত্ম্য-সাধনায় বিম্বসূষ্টি করে। মানুষকে আত্মিক বন্ধন থেকে মুক্ত করতে হবে। তাই নিরাসক্তভাবে প্ৰেম মৈত্রী করুণা ও সংঘের উপাসনা প্রয়োজন। সাধনাটা ব্যবহারিক সত্য, নৈরাত্ম্য পারমার্থিক সত্য। উপনিষদ ও বলেছে-‘অবিদ্যায়। মৃত্যুং তীত্ব বিদ্যয়ামৃতমশ্লাতে’, ভর্তৃহরি বলেছেন-‘অসত্যে বস্তুনি স্থিত্বা তত: সত্যং সমীহতে”।
বলা বাহুল্য, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক এ জাতীয় চরম মতবাদ চূড়ান্তভাবে অগ্ৰাহ করেন। কিন্তু কেন করেন। তার কোন ন্যায়শাস্ত্রসম্মত দার্শনিক যুক্তি দেখাতে পারেন না। ফলে এই দার্শনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সদর দরজা দিয়ে না হলেও খিড়কি দুয়ার দিয়ে solipsism অনুপ্ৰবেশ করে। এখানে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন এবং শব্দাদ্বৈতবাদী ভর্তৃহরি-দর্শনের একটা বলিষ্ঠ বক্তব্য আছে। আমরা পারমার্থিক চিন্তাটা স্থগিত রাখলাম। ব্যবহারিক সত্যকেই যদি সত্য ব’লে মেনে চলি তা হ’লে solipsism-এর হাত থেকে যা আমাদের শত হস্ত দূর রাখে সে হ’ল মানুষের ভাষা। মানুষের ভাষাই হল solipsism-এর সবচেয়ে বলিষ্ঠ প্রমাণ ও প্রতিবাদ। ভাষা ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে অক্ষুন্ন রেখেও ব্যক্তিসত্তাকে অতিক্রম করে, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তিকে মিলিত করে। সুতরাং ভাষার ক্ষমতাই মানুষের transcendenceএর ক্ষমতা। যেখানেই ভাষার ব্যবহার সেখানেই ব্যক্তির নির্ব্যক্তীকরণ বা de-personalisation অবশ্যম্ভাবী। না হ’লে পরস্পর বিভিন্ন দুইটি বি-ষম মানুষ সমাৰ্থবোধের অংশীদার হ’তে পারত না। মানুষ বিভিন্ন হলেও বিচ্ছিন্ন নয়, তার প্রধান প্ৰমাণ-মানুষ বাত্ময়। মনের সঙ্গে মনের মিলনের প্রথম নিদর্শন বক্তা ও শ্রোতার মিলন। আপনি গাছ বললে আমি গাছ বুঝি, আমি – পাৰ্থ ব বললে আপনি পাথর বোঝেন। আমাদের কথাগুলো গাছ পাথর কাঁধে নিয়ে ব’য়ে বেড়ায় না, আপনার আমার মগজের মধ্যেও গাছ পাথর গজায় না। তাঁবুতো আমরা পরস্পরকে বুঝি। তা হ’লে গাছ পাথর সম্পর্কে এমন একটি সাধারণ ধারণা বা concept আছে যেখানে আমি আপনি তফাৎ নই। অর্থবোধক শব্দ এই concept-এর বাহন। বাহন বললেও ঠিক বলা হল না। বাহন থেকে আরোহীকে আলাদা করা যায়। কিন্তু শব্দ থেকে concept আলাদা করা যায় না। একেই বলে শব্দার্থের তদাত্ম্য সম্বন্ধ। শব্দ যখন অসাধারণ ব্যক্তিকে সাধারণ করে তখন সে নিজকেই নিজে সাধারণ করে। আমি যখন ভাষার অর্থ বুঝি তখন ভাষাকেও আর বায়ু-তরঙ্গের অভিঘাতসমষ্টি হিসাবে গ্রহণ করিনা, গ্ৰহণ করি সাধারণ অর্থবোধের অন্তরঙ্গ অঙ্গ হিসাবে। সুতরাং ভাষার সাধারণীকৃতি ত্ৰিমুখী। প্রথমত:—ভাষা আমাদের চেতনাগ্রাহ্য বস্তু ব্যক্তিকে একটি সাধারণ ধারণা concept, universal বা ‘সামান্তে’র আকারে রূপায়িত করে। এই সমানীকৃত সামান্যই চেতনাকে রূপ দান করে, অর্থজ্ঞানকে আকার দান করে। দ্বিতীয়ত:–এই সামান্য বা universal-এর সমান ভূমিতে বক্তা ও শ্রোতার ব্যক্তিচেতনা পরস্পর মিলিত হয়। এই অর্থে বক্তা ও শ্রোতার ব্যক্তিসত্তারও সাধারণীকরণ সম্পাদিত হয়। তৃতীয়ত:–শব্দও তার বায়ুতরঙ্গরূপ বস্তুব্যক্তিত্ব অতিক্রম ক’রে সাধারণ অর্থের মধ্যে সাধারণ্য প্ৰাপ্ত হয়। এই তিন ধরণের সাধারণীকরণ তিনটি পৃথক ব্যাপার নয়। একই সাধারণীকরণের তিনটি দিঙনিৰ্দেশ মাত্র। প্ৰকৃত পক্ষে শব্দ, অর্থ ও জ্ঞান একই সাধারণীকরণের ভিতরে একাত্মতা লাভ করে।
এই একাত্মতা প্রতিষ্ঠা দার্শনিক ভর্তৃহরিকে সৰ্বকালের এক অলোকসামান্য চিন্তানায়ক রূপে প্ৰতিষ্ঠিত করেছে। এ বিষয়ে বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদের সঙ্গে ভর্তৃিহরির শব্দাদ্বৈতবাদের অনেকাংশে গুরুতর প্রভেদ রয়েছে। কিন্তু বৌদ্ধ দার্শনিক যখন বললেন, বিশুদ্ধ ব্যক্তি বা ‘স্ব-লক্ষণ” শব্দাতীত, তখন প্ৰকারান্তরে একথাই মেনে নেয়া হল যে মানুষের ব্যবহারিক জগতে solipsism বা ‘স্ব-সংবেদনবাদ’ অগ্রাহ। মানুষের চেতনায় শব্দ কখনে। অর্থকে বিশুদ্ধ ব্যক্তিরূপে উপস্থিত করতে পারেনা, উপস্থিত করে বিভিন্ন মানুষ কর্তৃক সমানভাবে গ্রাহ ‘সামান্য’ রূপে। অসামান্যকে সামান্যে পরিণত করার শক্তিই শব্দশক্তি। কিন্তু অর্থের সামান্যীকরণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষেরও ‘সমানীভবন” মেনে নিতে হয়। বৌদ্ধ দার্শনিক এই “সামান্তের’ বাস্তব সত্তা স্বীকার কনেন না, কিন্তু “সংবৃতি সত্তা’ স্বীকার করেন। ‘সংবৃতি-সত্তা।” শেষ পৰ্য্যন্ত ব্যবহারিক সত্তারই নামান্তর হয়ে দাড়ায়। “সামান্য’ বিকল্প বা abstraction হলেও, এরই মাধ্যমে মানুষে মানুযে ব্যবহারিক যোগাযোগ সাধিত হয়। যে মুক্তর্তে শব্দার্থ বস্তু-ব্যক্তিকে অতিক্রম করে সেই একই মুহূর্তে মানুষ-ব্যক্তি ও তার ‘দ্বীপধর্মিতা’ বা insularity অতিক্রম করে। ব্যক্তি মানসের ঊর্ধ্বে সমাজ-মানসের অস্তিত্বও এই জন্যই স্বীকার করতে হয়।
এখন প্রশ্ন উঠবে abstraction কি বাস্তব? যার বস্তুসত্তা নেই, বিস্তু শব্দানুপাতী একটা সাধারণ” ধারণা মাত্ৰ আছে তারই নাম দেয়া হয়েছে “বিকল্প”। বৌদ্ধ দার্শনিক প্ৰতিভার প্রকৃষ্ট প্ৰকাশ ধৰ্মকীতি। তিনি শত শত পঠা ধরে শাণিত যুক্তি ও বিস্ময়কর বিশ্লেষণী শক্তির দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, সামান্য বা universal বিকল্প মাত্র, বাস্তব নয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ বাস্তব নয়। কিন্তু মানুষের ভাষার এমনি মহিমা যে বস্তুজগতে যা নেই তাকে ও সামান্যাকারে মানবিক ধারণার মধ্যে বর্তমানরূপে উপস্থিত করে। মানুষের ভাষা নাস্তিকে অস্তিরূপে মানবচেতনায় প্রতিফলিত করে। এ জন্যই সামান্যকে বাস্তব বলা যায় না, অথচ ব্যবহারিক জগতে এর উপযোগিতাও অস্বীকার করা যায় না। এই বলেই সুনিপুণ দার্শনিক সতর্ক হয়ে গেলেন-এ জাতীয় বিকল্প ধারণা যে মানুষের চেতনায় উপস্থিত হয়, সেই উপস্থিতিকে তো অবলুপ্ত করা যায় না। বিকল্পের সত্তা নেই, তার মানে কি এই যে ধারণার উপস্থিতিটাই মিথ্যা? একথা বললে তা স্ব-সংবেদনরূপী স্ব-লক্ষণটিও মিথ্যা হয়ে যাবে। তখন বলতেই হল-বিকল্প স্বরূপগত ভাবে মিথ্যা নয়, কিন্তু তার বস্তু-নির্দেশ-সম্বন্ধ বা referential relationটি মিথ্যা। বিকল্প স্বাতিরিক্ত কোনো বস্তুকে নির্দেশ করে না। অর্থাৎ শব্দার্থের বাচ্য-বাচক সম্বন্ধটা শব্দ ও বিকল্পরূপী সামান্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিকল্পতিরিক্ত কোনো বস্তু শব্দার্থ নয়।
কিন্তু একথা ব’লে বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ দর্শন এক বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য। বিকল্প বা সামান্য স্বরূপগতভাবে মিথ্যা নয়, একথা স্বীকার করলেই আমাদের বর্তমান আলোচনার দার্শনিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। বিকল্প স্বরূপগত ভাবে সত্য-এর দ্বারা বৌদ্ধ দার্শনিক বোঝাতে চেয়েছেন, আপনার চেতনা ধৃত সাধারণ ধারণাটি আপনারই আয়ত্ত, আমার নয়। এবং আমার চেতনা ধৃত সাধারণ ধারণাটি আমারই আয়ত্ত, আপনার নয়। কিন্তু এতে পারমাথিক প্ৰবক্তার কথা হল, “সাংব্যবহারিকের” কথা নয়। বিজ্ঞানবাদীর পারমাথিক তত্ত্ব আমরা আলোচনা করছি না, ব্যবহারিক তত্ত্বই আলোচনা করছি। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বৌদ্ধমতি গ্রহণ করলে এ কথা ও মানতে হয় যে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে অর্থবোধের কোনরূপ সমতা নেই। দুজনে একই শব্দ বা বাক্যের দ্বারা একই অর্থ বোঝেন না। মানুষের ভাষা থাকা না থাকা একই কথা। ভাষাটা পেটের ভিতরে appendix-এর মত একটা বৰ্জনীয় বাহুল্যমাত্র। কিন্তু আপনি যদি আমাকে বলেন ‘বইখানা দিন’, আমি বই খানাই দিই, আপনি যা চেয়েছেন তাই পেয়ে খুন্সী হন। তেমনি আমি টাকা চাইলে যদি আপনার কাছ থেকে টাকা পাই, আমিও খুন্সী হই। দুজনের সাধারণ ধারণার মধ্যে যদি ঐক্য না থাকে, তাহলে ভাষা ব্যবহারের পর বস্তু সম্পর্কিত ব্যবহারে ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে ঐক্য কি করে সম্ভব হল। বৌদ্ধ বললেন, আপনার আমার ধারণা এক নয়, কিন্তু অনুরূপ। কিন্তু কি করে বুঝব অনুরূপ? আমরা দুটি ব্যক্তি নিঃসঙ্গ নিলিপ্ত-স্বতন্ত্র পরস্পরবিচ্ছিন্ন দুটি “সাধারণ ধারণা” নিয়ে নিজ নিজ গুহার মধ্যে আত্মারাম হয়ে বসে আছি। তবু একথা বুঝতে পারছি যে আমাদের দুজনের ধারণা এক না হলেও অনুরূপ বটে। এই আনুরূপ্যের বোধটা কোথা থেকে আমদানী হল? দুটি ধারণাকে অনুরূপ বলে বুঝতে হলে এমন একটি অতিক্ৰান্তিশীল ধারণ-রূপ দরকার, যার ভিতরে আনুরূপ্যাটা প্ৰত্যক্ষ প্ৰতিভাত হয়। আবার সেখানেও যদি আনুরূপ্যের প্রশ্ন ওঠে, অববস্থায় দোষ বা Infinite regress অপরিহাৰ্য্য। সুতরাং যখনই বলি স্বরূপগত-ভাবে বিকল্প সত্য, তখনই স্বীকার করতে হয় বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে বিধৃত সাধারণ ধারণাটি দুটা বিকল্প নয়, কিন্তু এক ও অখণ্ড। এর অর্থ, abbtraction মিথ্যা নয়, ঘোরতর সত্য। চেতনা বহির্ভূত ধারণা অসম্ভব। তাই ধারণার ঐক্য মানে চেতনার ঐক্য। এই ঐক্যকে অস্বীকার করা আর মানুষের ব্যক্তি-সত্তাকে দ্বীপান্তরে নির্বাসন দেয়া একই কথা। এই জন্যই মানুষের ভাষার ভিত্তিতে যে সমাজমানস গঠিত হয়, তা মিথ্যা abstraction নয়। সে abstraction-এর এমন এক বাস্তব সত্তা রয়েছে, যাকে শুধু বিমূর্ত metaphysical non-sense বলে উড়িয়ে দিলে মানুষের বনিয়াদকেই উড়িয়ে দিতে হয়। একে Idealism-ই বলুন আর Materialism-ই বলুন, নিজের সমস্ত ব্যবহারিক কাৰ্য্যকলাপকে অস্বীকার না করে একে অস্বীকার করার উপায় নেই।
বেশ কিছুদিন থেকে আমরা এমন একটা অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে এসেছি যে ‘concrete’ বললেই যেন একটু প্রশংসার স্পর্শ পাই আর ‘abstract’ অনেক সময়ই অনিচ্ছাকৃত ব্যভিচার ঘটিয়ে থাকি। concrete মানেই বস্তু-গৌরবে মহীয়ান এক উজ্জ্বল সত্য নয়। আর abstract মানেই বস্তুহীন অগৌরবের ধূম্রমায়া নয়। বরং দার্শনিক বিচারে এ কথাই সত্য যে concrete-কে যে পৰ্য্যন্ত abstract-এ পরিণত করিতে না পারি। সে পৰ্য্যন্ত কোন কিছুই জানা সম্ভব নয়; ভাষার মাধ্যমে concrete যদি abstract হয়ে না। উঠাত, মানুষে মানুষে মুখ দেখাদেখি হত না। এমন কি মার্কস যখন আহ্বান জানালেন ‘দুনিয়ার শ্রমিক এক হও’, তখনো এই আহ্বানের দার্শনিক ভিত্তি ছিল abstract labour-এর ধারণা। মানুষের শ্রমকে শুধু concrete হিসাবে দেখলে শ্রমিক ঐক্যের কোনো সাধারণ ভিত্তি থাকে না। abstract মানে মিথ্যা হলে শ্রমিক ঐক্যও মায়া।
মানুষ যেদিন কথা বলতে শিখেছে সেদিন থেকেই মানবিক চেতনার ঐক্যের ভিত্তি রচিত হয়েছে। সমাজের ভিতরে বিরোধ, সংঘাত, শ্রেণী-দ্বন্দ্ব, সব কিছু নিয়েও এই ঐক্য আরও পরিব্যাপ্ত হয়েছে। ভাষার সমৃদ্ধি ও গভীরতা এবং এই ঐক্যের পরিব্যাপ্তি দোসররূপে এগিয়ে চলেছে। সভ্যতার অগ্রগতিতে ভাষার এই সাধারণীকৃতির অসাধারণ গুরুত্ব অনস্বীকাৰ্য্য। সাহিত্যে আমরা যে সাধারণীকৃতির কথা আলোচনা ক’রে থাকি তা এই সাধারণ মানুষের সাধারণ ভাষার মৌলিক সাধারণীকৃতিরই এক উন্নততর, গভীরতর রূপ। ভিত্তি ছাড়া ইমারত হয় না। বহু আধুনিক কাব্যসাহিত্য যে রসোত্তীর্ণ হয় না, তার কারণ মানবিক ভাষা-ভিত্তিই সেখানে স্খলিত ও বিপৰ্য্যস্ত। শূন্যোদ্যান হয়ত বেবিলনে ছিল, কাব্যে সাহিত্যে কোনদিন ছিল না।