ভাল বাসা
যুদ্ধের হিড়িকে বোম্বাই শহরে বাঙালী অনেক বাড়িয়াছে। আগে যত ছিল তাহার প্রায় চতুর্গুণ। তিন বছর আগেও বোম্বাইয়ের পথেঘাটে গুজরাতী-মারাঠী-পার্শী- গোয়ানিজ মিশ্রিত জনারণ্যে হঠাৎ একটি সিঁদুর-পরা বাঙালী মেয়ে বা ধুতি- পাঞ্জাবি-পরা পুরুষ দেখিলে মন পুলকিত হইয়া উঠিত, যাচিয়া কথা বলিবার ইচ্ছা হইত। এখন আর সেদিন নাই। এখন পদে পদে হাফ-প্যান্ট-পরা দ্রুতপদচারী বাঙালী যুবকের সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকি হইয়া যায়। যাঁহারা স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁহারা পূর্ববৎ শহরের উত্তরাঞ্চলে খানিকটা স্থানে বাঙালীপাড়া তৈয়ার করিয়া বাস করিতেছেন; নূতন আমদানী যাহারা, তাহারা শহরের চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কে কোথায় কিভাবে থাকে তাহার ঠিকানা করা কঠিন। তাহারা যুদ্ধের জোয়ারে ভাসিয়া আসিয়াছে, যখন যুদ্ধ শেষ হইবে তখন আবার ভাঁটার টানে বাংলা দেশের বিপুল গর্ভে ফিরিয়া যাইবে।
গত সাত বৎসর যাবৎ আমিও এ-প্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হইয়া পড়িয়াছি। তবে আমি বোম্বাই শহরের সীমানার বাহিরে থাকি; বেশি দূর নয়, মাত্র আঠারো মাইল। বাড়িটি ভাল এবং পাড়াটি নিরিবিলি; ইলেক্ট্রিক ট্রেনের কল্যাণে অল্প সময়ের মধ্যে শহরে পৌঁছানো যায়। কোনও হাঙ্গামা নাই। শহরে থাকার সুখ ও পাড়াগাঁয়ে থাকার শান্তি দুই-ই একসঙ্গে ভোগ করি। বন্ধুরা হিংসা করেন— কিন্তু সে যাক। এটা আমার কাহিনী নয়, ঘেঁচুর উপাখ্যান।
মাসকয়েক আগে একটা কাজে শহরে গিয়াছিলাম। গিরগাঁও অঞ্চলের জনাকীর্ণ ফুটপাথ দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ দেখি— ঘেঁচু! বিকালবেলার পড়ন্ত রৌদ্রে খাকি হাফ্-প্যান্ট ও হাফ্-শার্ট-পরা কৃষ্ণকায় ছোকরাকে দেখিয়া চিনিতে বিলম্ব হইল না— আমাদের ঘেঁচুই বটে। তাহার চেহারাখানা এমন কিছু অসামান্য নয় কিন্তু অমন শজারুর মতো খোঁচা খোঁচা চুল এবং তিনকোণা কান আর কাহারও হইতেও পারে না।
ঘেঁচুকে ছেলেবেলা হইতেই চিনি; আমাদের গাঁয়ের ছেলে— বিষ্ণু মাইতির ভাইপো। এখন বয়স বোধহয় উনিশ-কুড়ি দাঁড়াইয়াছে। যখন তাহাকে শেষ দেখি তখন সে গাঁয়ের মিড্ল স্কুলে পড়িত এবং ডাংগুলি খেলিত। চেহারা কিছুই বদলায় নাই, কেবল একটু ঢ্যাঙা হইয়াছে। এই ছেলেটা বাংলা দেশের অজ পাড়াগাঁয়ের একটি পঙ্কিল পানাপুকুরের অতি ক্ষুদ্র পুঁটিমাছের মতো ছিপের এক টানে একেবারে বোম্বাইয়ের শুক্না ডাঙায় আসিয়া পড়িয়াছে।
বলিলাম— ‘আরে ঘেঁচু! তুই!’
ঘেঁচু একটা ইরাণী হোটেল হইতে মুখ মুছিতে মুছিতে বাহির হইতেছিল, আমার ডাক শুনিয়া ক্ষণকাল বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো তাকাইয়া রহিল; তারপর লাফাইয়া আসিয়া এক খাম্চা পায়ের ধূলা লইল—
‘বটুকদা!’
তাহার আনন্দবিহ্বলতার বর্ণনা করা কঠিন। হারানো কুকুরছানা অচেনা পথের মাঝখানে হঠাৎ প্রভুকে দেখিতে পাইলে যেমন অসংবৃত আনন্দে অধীর ও চঞ্চল হইয়া উঠে, ঘেঁচুও তেমনি আমাকে পাইয়া একেবারে আত্মহারা হইয়া পড়িল— কি বলিবে কি করিবে কিছুই যেন ভাবিয়া পায় না। সে সামান্য একটু তোৎলা, কিন্তু এখন তাহার কথা পদে পদে আটকাইয়া যাইতে লাগিল— ‘হাঃ হাশ্চর্য! আপনি কী করে আমাকে দেখে ফেললেন? আম্মিও আপনার ঠ্ঠিকানা লিখে এনেছিলুম, ক্কিন্তু কাগজের চিল্তেটা কোথায় হাঃ হারিয়ে গেল। আর ক্কী করে খোঁজ নেব? কেউ একটা কথা বুঝতে পারে না, কিড়ির মিড়ির করে ক্কী বলে আম্মিও বুঝতে পারি না— এসে অবধি একটা বাঙালীর মুখ দেখিনি। ভাঃ ভাগ্যে দেখা হয়ে গেল— নইলে তো— ’
নিজের কাজ ভুলিয়া ফুটপাথে দাঁড়াইয়াই তাহার সহিত অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিলাম। ছেলেটা ভালমানুষ, তাহার উপর বলিতে গেলে এই প্রথম পাড়াগাঁয়ের বাহিরে পা বাড়াইয়াছে। নিজের অবস্থা বর্ণনা করিতে করিতে প্রায় কঁদিয়া ফেলিল। দিন সাতেক হইল সে বোম্বাই আসিয়াছে, আসিয়াই কোন এক যুদ্ধ-সম্পর্কিত কারখানায় যোগ দিয়াছে। একটা মাথা গুঁজিবার আস্তানা খুঁজিতে তাহার প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছিল, শেষে এক মারাঠী সহকর্মীর কৃপায় একটা চৌলে একটি খোলি পাইয়াছে। সেইখানেই থাকে এবং চৌলের নীচের তলায় একটা নিরামিষ হোটেলে খায়। এখানে আসিয়া অবধি মাছের মুখ দেখে নাই, কেবল ডাল রুটি আর তেলাকুচার তরকারি খাইয়া তাহার প্রাণ কণ্ঠাগত হইয়াছে।
বর্ণনা শেষ করিয়া ঘেঁচু সজলনেত্রে বলিল, ‘ব্বটুকদা, এদেশের রান্না আমি ম্মুখে দিতে পারি না; খাবারের দিকে যখন তাকাই প্রাণটা হু হুঃ করে ওঠে। আর কিছু নয়, দুটি ভাত আর ম্মাছের ঝোল যদি পেতুম— ’
বলিলাম, ‘সে না হয় ক্রমে সয়ে যাবে। কিন্তু তুই যে এখানে একটা মাথা গোঁজবার জায়গা পেয়েছিস্ এই ভাগ্যি। আজকাল তাই কেউ পায় না।’
ঘেঁচু বলিল— ‘ম্মাথা গোঁজবার জায়গা যদি স্বচক্ষে দেখেন বটুকদা, তা হলে আপনারও কান্না পাবে। আসবেন— দেখবেন? বেশি দূর নয়, ঐ মোড়টা ঘুরেই— ’
ঘেঁচুর সঙ্গে তাহার বাসা দেখিতে গেলাম। প্রকাণ্ড একখানা চারতলা বাড়ি, তাহার আপাদমস্তক পায়রার খোপের মতো ছোট্ট কুঠুরী বা খোলি। প্রত্যেক কুঠুরীতে একটি করিয়া মধ্যবিত্ত পরিবার থাকে; সেই একটি ঘরের মধ্যে শয়ন রান্না সবকিছুই সম্পাদিত হয়। ইহাই বোম্বাইয়ের চৌল। এক একটি বড় চৌলে শতাধিক ভদ্র দরিদ্র পরিবার কাচ্চাবাচ্চা লইয়া বৎসরের পর বৎসর বাস করে। ঐটুকু পরিসরের অধিক বাসস্থান পাওয়া যায় না। বোধ করি ইহারা প্রয়োজনও মনে করে না।
ঘেঁচুর খোলি চৌলের চারতলায়। তিনপ্রস্থ অন্ধকার সিঁড়ি ভাঙিয়া উপরে উঠিলাম। লম্বা সঙ্কীর্ণ বারান্দা এপ্রান্ত ওপ্রান্ত চলিয়া গিয়াছে, তাহারই দুই পাশে সারি সারি ঘরের দরজা। বারান্দায় অসংখ্য ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিতেছে, চিৎকার করিতেছে, কুস্তি লড়িতেছে। প্রত্যেকটি দ্বারের কাছে একটি দুটি স্ত্রীলোক মেঝেয় বসিয়া গম বা ডাল বাছিতেছে, নিজেদের মধ্যে হাসিতেছে, গল্প করিতেছে। অপরিচিত আগন্তুক কেহ আসিলে ক্ষণেক নিরুৎসুক চক্ষে চাহিয়া দেখিয়া আবার ডাল বাছায় মন দিতেছে।
বারান্দার একপ্রান্তে ঘেঁচুর ঘর। দেখিলাম, ঘরটি আদৌ ঘর ছিল না, ব্যাল্কনি ছিল। ঘরের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিমান গৃহস্বামী স্থানটি তক্তা দিয়া ঘিরিয়া সম্মুখে একটি দরজা বসাইয়া রীতিমত ঘর বানাইয়া ভাড়া দিতেছেন। ভিতরটি দেশলাইয়ের বাক্সের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। ঘেঁচুর একটি তোরঙ্গ ও গুটানো বিছানাতেই তাহার অর্ধেকটা ভরিয়া গিয়াছে।
ঘেঁচু বলিল— ‘দ্দেখছেন তো! দরজা বন্ধ করলে দ্দম বন্ধ হয়ে যায়, আর খুলে রাখলে মনে হয় হাঃ হাটের মধ্যিখানে বসে আছি। সাতদিন রয়েছি, একটা ল্লোকের সঙ্গে মুখ-চেনাচেনি হয়নি। কেউ ডেকে কথা কয় না, আর ক্কী বা কথা কইবে! বুঝতে পারলে তো! ইংরেজীও কেউ বোঝে না, সব সাট্টাবাজারের গোমস্তা। বলুন তো, এমন করে মানুষ বাঁচতে পারে? ক্কেন যে মরতে চাকরি করতে এসেছিলুম! এক এক সময় ল্লোভ হয়, ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু প্পালাবার কি জো আছে— লড়াইয়ের চাক্করি— ধ্ধরেই জেলে পুরে দেবে— ’
ছেলেটার কথা শুনিয়া বড় মায়া হইল, বলিলাম— ‘চল্ ঘেঁচু, তুই আমার বাড়িতে থাকবি। আমার একটা ফাল্তু ঘর আছে— হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারবি। আর কিছু না হোক, তোর বৌদির রান্না ডালভাত তো দু’বেলা পেটে পড়বে।’
আহ্লাদে ঘেঁচু নাচিয়া উঠিলেও, শেষ পর্যন্ত বিবেচনা করিয়া দেখা গেল ব্যবস্থাটা খুব কার্যকরী নয়। ঘেঁচুকে সকাল আটটার মধ্যে কারখানার হাজ্রি দিতে হয়। একঘণ্টা ট্রেনে আসিয়া তারপর আরও আধঘণ্টা পায়ে হাঁটিয়া ঠিক আটটার সময় প্রত্যহ কারখানায় হাজির হওয়া কোনওমতেই সম্ভবপর মনে হইল না।
ঘেঁচু দুঃখিতভাবে বলিল— ‘আমার ক্কপালে নেই তো কী হবে! কিন্তু বটুকদা, এখানে আর পারছি না। আপনি অন্য কোথাও একটা ভ্ভাল বাসা দেখে দিন— যেখানে স্সকাল বিকেল দুটো বাংলা কথা শুনতে পাই— আর যদি মাঝে মাঝে দুটি মাছের-ঝোল ভাত পাওয়া যায়— ’
আমি বলিলাম— ‘চেষ্টা করব। কিন্তু আজকাল ভাল বাসা পাওয়া তো সহজ কথা নয়। যদি বা একটা ভদ্রলোকের মতো ঘর পাওয়া যায়, তার ভাড়া হয়তো পনেরো টাকা কিন্তু পাগ্ড়ি দিতে হবে দেড় হাজার।’
ঘেঁচু চক্ষু কপালে তুলিয়া বলিল— ‘পাগ্ড়ি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাগ্ড়ি; যাকে বলে গোদের ওপর বিষফোঁড়া। সেলামী আর কী! গভর্মেন্ট্ আইন করে দিয়েছে বাড়িওয়ালারা ভাড়া বাড়াতে পারবে না, তাই রসিদ না দিয়ে মোটা টাকা গোড়াতেই আদায় করে নেয়। এ তো আর ভেতো বাঙালীর বুদ্ধি নয়— গুজরাতী বুদ্ধি।’
ঘেঁচু বলিল— ‘ও ব্বাবা, অত টাকা কোথায় পাব! মাইনে তো পাই কুল্লে— ’
বলিলাম, ‘না না, সে তোকে ভাবতে হবে না। বাসা যদি জোগাড় করতে পারি, বিনা পাগ্ড়িতেই পাবি। চেষ্টা করব দাদারে, মানে বাঙালীপাড়ায়। তোর ভাগ্যে থাকে তো এক-আধটা ঘর পেলেও পেতে পারি। কিন্তু তুই ভরসা রাখিস নে; মনে ভেবে রাখ এইখানেই তোকে থাকতে হবে। আর একটা কথা বলি, যখন এদেশে এসেছিস তখন এদেশের ভাষাও শিখতে আরম্ভ কর। নইলে এভাবে কদ্দিন চালাবি?’
কাতরভাবে ঘেঁচু বলিল— ‘সে তো ঠ্ঠিক কথা বটুকদা, কিন্তু ও ক্কিচির মিচির ভাষা কি শিখতে পারব? ভাষা শুনলে মনে হয় চ্চাল কড়াই দাঁতে ফেলে চিবচ্ছে— ’
বলিলাম— ‘নতুন নতুন অমনি মনে হয়— ক্রমে সয়ে যাবে। কথায় বলে যস্মিন্ দেশে যদাচারঃ।’
নিরপরাধ আসামী যেভাবে ফাঁসির আজ্ঞা গ্রহণ করে তেমনি ভাবে ঘেঁচু বলিল— ‘ব্বেশ, আপনি যখন বলছেন— ’
সেদিন ঘেঁচুকে তাহার কোটরে রাখিয়া ফিরিয়া আসিলাম। স্থির করিলাম অবকাশ পাইলেই দাদারে গিয়া তাহার জন্য ভাল বাসার খোঁজ করিব। সেখানে অনেক ভদ্রলোক আছেন, তাঁহাদের কাহারও পরিবারে একটি আলাদা ঘর ও দুটি মাছের-ঝোল ভাত জোগাড় করা বোধ করি একেবারে অসম্ভব হইবে না।
তারপর পাঁচটা কাজে পড়িয়া ঘেঁচুর কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছি। মনে পড়িল প্রায় দু’হপ্তা পরে। বেচারা নির্বান্ধব পুরীতে তেলাকুচার তরকারি খাইয়া কত কষ্টই না পাইতেছে এবং অসহায়ভাবে আমার পথ চাহিয়া আছে। অনুতপ্ত মনে সেইদিনই সন্ধ্যাবেলা দাদারে গেলাম। ঘেঁচুর কপাল ভাল; দু’-একজনের সঙ্গে কথা কহিয়াই খবর পাইলাম, একটি ভদ্রলোকের বাসায় একটি ঘর শীঘ্রই খালি হইবার সম্ভাবনা আছে— যে বৈতনিক অতিথিটি ঘর দখল করিয়া আছেন তিনি নাকি শীঘ্রই বদ্লি হইয়া চলিয়া যাইবেন। দ্রুত গিয়া ভদ্রলোককে ধরিলাম। সনির্বন্ধ অনুরোধ বিফল হইল না। বৈতনিক অতিথিটির চলিয়া যাইতে এখনও হপ্তা-দুই দেরি আছে, কিন্তু তিনি বিদায় হইলেই ঘেঁচু তাঁহার স্থান অধিকার করিবে, এ ব্যবস্থা পাকা হইয়া গেল।
ভদ্রলোককে অসংখ্য ধন্যবাদ দিয়া উঠিয়া পড়িলাম। ভাবিলাম ঘেঁচুকে সুখবরটা দিয়া যাই, সে আশায় বুক বাঁধিয়া এই কয়টা দিন কাটাইয়া দিবে।
ঘেঁচুর চৌলে পৌঁছিতে রাত্রি হইয়া গেল। তাহার কোটরে প্রবেশ করিয়া দেখি সে মেঝেয় বিছানা পাতিয়া বসিয়া পরম মনোযোগের সহিত একখানা বই পড়িতেছে। আমাকে দেখিয়া সানন্দে উঠিয়া দাঁড়াইল।
‘বটুকদা, আপনি বলে গিছলেন, এই দ্দেখুন, মারাঠী প্রথম ভাগ আরম্ভ করেছি। ব্বাপ্, এর নাম কি ভাষা, স্রেফ্ পাথর আর ইটপাটকেল। হুঃ হুচ্চারণ করতে গিয়ে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে। ক্কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা; যখন ধরেছি, হয় এস্পার নয় ওস্পার।’
হাসিয়া বলিলাম— ‘বেশ বেশ। কিন্তু শিখছিস কার কাছে? শুধু বই থেকে তো শেখা যাবে না।’
ঘেঁচু বলিল— ‘সে জোগাড় হয়েছে। ৩৭ নম্বর ঘরে থাকে—বেঙ্কটরাও বলে একজন মারাঠী। বেশ ভদ্রলোক, আমার চেয়ে দু-চার বছরের বড় হবে; একটু আধটু হিঃ হিংরিজি বলতে পারে— সে-ই শেখাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের translation পড়েছে কিনা, বাঙালীর ওপর ভারি ভক্তি।’
রবীন্দ্রনাথ, আর কিছু না হোক, বাঙালীর জন্য ঐটুকু করিয়া গিয়াছেন; বিদেশে তাঁহার স্বজাতি বলিয়া পরিচয় দিলে খাতির পাওয়া যায়।
যা হোক, ঘেঁচুকে বাসার খবর দিয়া তাহার মাছের-ঝোল ভাত সম্ভোগের আসন্ন সম্ভাবনার আশ্বাস জানাইলাম। সে আহ্লাদে এতই তোৎলা হইয়া গেল যে তাহার একটা কথাও বোঝা গেল না। অতঃপর সে-রাত্রে বাড়ি ফিরিলাম।
দু’হপ্তা পরে দাদারের ভদ্রলোকটি জানাইলেন যে, বাসা খালি হইয়াছে, এখন ঘেঁচু ইচ্ছা করিলেই তাহা দখল করিতে পারে। আবার ঘেঁচুর কাছে গেলাম। তাহাকে তাহার নূতন বাসায় অধিষ্ঠিত করিয়া তবে আমি নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিব।
সন্ধ্যার পর বাতি জ্বলিয়াছিল। ঘেঁচুর দ্বারের কাছে পৌঁছিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িলাম। ঘরের মধ্যে বেশ একটি ছোটখাট মজলিশ বসিয়া গিয়াছে। মেজেয় পাতা বিছানার উপর চা এবং এক থাল চিঁড়া চীনাবাদাম ভাজা (এদেশের ভাষায় ‘ভাজিয়া’); তাহাই ঘিরিয়া বসিয়াছে ঘেঁচু এবং একটি মহারাষ্ট্র-মিথুন। পুরুষটি বেঁটে, নিরেট ধরনের চেহারা, বুদ্ধিমানের মতো মুখ; নারীটি কুঙ্কুমচিহ্নিত-ললাট, আঁট্সাঁট্ আঠারো হাত শাড়ি পরা একটি স্নিগ্ধ কমকান্তি যুবতী। চা পান, ‘ভাজিয়া’ ভক্ষণ ও হাস্য-কৌতুকের ফাঁকে ফাঁকে ভাষাশিক্ষা চলিতেছে। আর, একটি হাফ্- প্যান্ট ও হাতকাটা গেঞ্জি পরিহিত দুই বছরের বালক আপন মনে ঘরময় দাপাইয়া বেড়াইতেছে।
আমাকে দেখিতে পাইয়া ঘেঁচু একটু সলজ্জভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল, তারপর বন্ধুদের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল।
‘এই যে আসুন বটুকদা। ইনি হলেন গিয়ে বেঙ্কটরাও পাটিল, যাঁর কথা আপনাকে বলেছিলুম। আর ইনি হচ্ছেন ওঁর স্ত্রী হংসাবাই। আর ঐ যে দেখছেন ছোট্ট মানুষটি, উনি হচ্ছেন এঁদের ছেলে।’
নবপরিচিতদের সহিত নমস্কার বিনিময় করিয়া বিছানার একপাশে বসিলাম। যুবকটি একটু গম্ভীর অল্পভাষী, যুবতীটি সপ্রতিভ মৃদুহাসিনী। মারাঠী মেয়েদের মধ্যে ঘোম্টা বা পর্দা কোনওকালেই নাই; অনাত্মীয় পুরুষের সহিত সুষ্ঠু মেলামেশার কোনও বাধা নাই৷ দেখিলাম ঘেঁচু এই নবীন মারাঠী-দম্পতির বেশ অন্তরঙ্গ হইয়া উঠিয়াছে।
ঘেঁচু শিশুটির গতিবিধি স্নেহদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘কী দুষ্টু যে ঐ ছেলেটা— যাকে বলে আস্ত ডাকাত, এক্কেবারে আসল বৰ্গী। ওর নাম কি জানেন, বিঠ্ঠল! যাকে আমাদের দেশে বিট্লে বলে তাই।’ ঘেঁচু উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল।
কিছুক্ষণ একথা সেকথার পর বলিলাম— ‘ঘেঁচু, তোমার নতুন বাসা খালি হয়েছে— কালকেই গিয়ে দখল নিতে পারো।’
ঘেঁচু হঠাৎ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া তোৎলাইতে আরম্ভ করিল। তাহার তোৎলামি কতকটা শান্ত হইলে বুঝিলাম সে বলিতেছে— ‘আমি এইখানেই থাকি বটুকদা, এখানে মন বসে গেছে। এঁদের সঙ্গে ভ্ভাব হয়ে অবধি… জানেন, আজকাল, আমি এঁদের সঙ্গেই খ্খাবার ব্যবস্থা করেছি। এঁরা রুটি ভাত দুই-ই খান; ম্মাছ- মাংস অবিশ্যি হয় না, কিন্তু ও আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। হংসাবৌদি যে ক্কী সুন্দর রাঁধেন তা আর কী বলব। বড্ড ভাল লোক এঁরা। আমি আর কোথাও যাব না বটুকদা, মিছিমিছি আপনাকে কষ্ট দিলুম— ’
শিশু বর্গীটি ইতিমধ্যে ঘেঁচুর ট্রাঙ্কের উপর উঠিয়া নাচিতে আরম্ভ করিয়াছিল, ঘেঁচু তাহাকে ধমক দিয়া ডাকিল— ‘এই বিট্লে, এদিকে আয়— ইক্ড়ে ইক্ড়ে— ’
বুঝিলাম, ঘেঁচুর ভাল বাসার আর প্রয়োজন নাই, সে ঐ বস্তুই আরও ঘনিষ্ঠ আকারে লাভ করিয়াছে।
৮ চৈত্র ১৩৫১