ভালো ভূতের গল্প

ভালো ভূতের গল্প

“আম্মা, একটা গল্প বল” খেতে বসেই তিতলির এই এক বায়না।

“আচ্ছা-শোন্‌ একটা কচ্ছপ ছিল—-”

বলতে না বলতেই তিতলি বলে উঠল, “কোন্‌ কচ্ছপের গল্পটা বলবে শুনি। কচ্ছপ আর খরগোশের-না “তোরা ছাই খা”-কচ্ছপ আর সারসের সেই গল্প”।

আম্মা বললেন, “বাব্বা, তুই দু’টো গল্পই জানিস”।

“ওমা। তুমিই তো আমার ছেলেবেলায় বলেছিলে, মনে নেই বুঝি”।

তিতলি ছোট থেকেই গল্প শুনতে খুব ভালবাসে। ওর মা, বাবা দুজনেই চাকরি করে। ও আম্মার কাছেই সারাটি দিন থাকে। আম্মার কাছেই স্নান, খাওয়া, শোয়া আর যত আবদার। এই গল্প শোনার অভ্যাসটা আম্মাই করিয়েছেন। পঞ্চতন্ত্রের গল্প, নীতি শিক্ষা, রূপকথা, আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্প সবই মোটামুটি ওর শোনা। ওর স্মৃতিশক্তি এত প্রখর যে ফাঁকি দিয়ে গল্প শুরু করলেই ও বলে ওঠে, “না না, এটা নয়, অন্য কোন গল্প বল”।

দুপুরে বিছানায় শুয়ে আম্মা বললেন, “আজ তোকে এমন একটা নতুন গল্প শোনাব যা তুই কোনদিন শুনিস্‌ নি”।

“কিসের গল্প বলবে আম্মা”?

“সিন্ডারেলার গল্প”।

তিতলি বলে উঠল, “বলতো দেখি, সিন্ডারেলার আসল নাম কী”?

আম্মা অবাক হয়ে বললেন, “কী রে , জানি না তো”।

“এলা”- তিতলির ঝট্‌পট্‌ উত্তর।

“তাই”?

“হ্যাঁ, আসলে এলার তো মা ছিল না। সৎমা আর বোনেরা ওকে দিয়ে সব কাজ করাত। কাজকর্ম শেষ হয়ে গেলে সিন্ডারের পাশে বসে বসে কাঁদত বলে মা বোনেরা ওকে সিন্ডারেলা বলে ডাকত”।

“আচ্ছা, আম্মা, সিন্ডার মানে কী”?

“সিন্ডার মানে হল অঙ্গার”।

“সেটা আবার কী”?

সাড়ে চার বছরের মেয়ের পক্ষে অঙ্গার শব্দের মানে জানা সম্ভব নয়। তাই আম্মা বললেন, “আগেকার দিনে তো গ্যাস ছিল না, কাঠ, কয়লার উনুনে রান্না হত। সেই কয়লা সব পুড়ে ছাই হয়ে যেত না। একেই বলে অঙ্গার”।

“আচ্ছা, এবার তুই বল্‌তো, “সিন্ডারেলা” মানে কী”?

“জানি না। ওটা তো একটা নাম। নামের আবার মানে হয় নাকী”?

“হ্যাঁ, প্রায় সব নামেরই একটা মানে থাকে” আম্মা বলেন।

“আমার নামের মানে কী গো আম্মা”?

“প্রজাপতি”।

“সিন্ডারেলা মানেও তেমনি, খুব সুন্দরী-অথচ যে তার রূপগুণের কদর পায় না”

“কিন্তু তুই গল্পটা জানলি কী করে”?

“আমাদের স্কুলের ম্যাম বলেছেন”।

“তাই”?

এবার আম্মা ভাবতে শুরু করলেন ওকে কী গল্প শোনাবেন যা ওর এক্কেবারে অজানা।

সেদিন দুপুরে ঘুমোতে যাবার আগে গল্প শোনার বায়না করলে আম্মা বললেন, “তোকে আজ একটা ভূতের গল্প শোনাব। গল্পটা তুই কোনদিনই শুনিস্‌ নি”।

“বল না আম্মা, তাড়াতাড়ি বল”।

আম্মা বললেন, শোন্‌ তাহলে-

“আচ্ছা তুই সুন্দরবনের নাম শুনেছিস”?

“হ্যাঁ, শুনবো না কেনগো! আমাদের মধুমিতা দিদির তো ওখানেই বাড়ি”।

“ও তাই তো, আমার মনেই ছিল না”।

মধুমিতা আমাদের বাড়িতে বেশ কিছুদিন হল টুকটাক ফাইফরমাস কাজের জন্য এসেছে। তিতলির সঙ্গে ওর খুব ভাব। সন্ধ্যেবেলায় লেখাপড়া হয়ে গেলে তিতলি ওর সাথে বার্বিডলগুলো নিয়ে খেলে।সুন্দরবন নামটা ওর মুখেই শুনেছে বোধ হয় আম্মা ভাবলেন।

হঠাৎ তিতলি আম্মাকে বলল, “বলতো দেখি সুন্দরবনের এরকম নাম কেন”?

এবার আম্মার অবাক হবার পালা। না জানার ভান করে বললেন, “কেনরে”?

“ওমা! তাও জানো না। ওখানে অনেক সুন্দরী গাছ হয় বলে”। আচ্ছা, আম্মা! সুন্দরী গাছগুলো কী মেয়ে”?

“কেন”?

“আমি তো মেয়ে। আমায় সবাই সুন্দরী বলে। আমি দেখতে খুব সুন্দর তাই না আম্মা”।

আম্মা এবার একগাল হেসে বললেন, “আমার চোখে তুমি অতুলনীয়া রূপবতী”। কিন্তু এত কথা বল না ভাই, তাহলে গল্প শোনাটাই মাটি হবে। একদম চুপটি করে শুয়ে শুয়ে গল্প শোন”।

আম্মা শুরু করলেন-

সুন্দরবনের এক ছোট্ট গ্রামে গদাধর নামে এক গরীব চাষী ছিল। তার নিজস্ব কোন জমি ছিল না। অন্যদের জমিতে ধান, গম, আলু ভাগে চাষ করে যা পেত তাই দিয়ে সংসার চালাত।

তিতলি একদম কথা না বলে থাকতে পারেনা। সে বলে উঠল। “ওদের সংসারে কে কে আছে গো আম্মা”।

“কেন, গদাধর, বউ লক্ষ্মী, বুড়ি মা আর দুই ছেলে”।

আম্মা বলতে লাগলেন, ভাগে চাষ করে তো আর ভালভাবে সংসার চালানো যায় না তাই গদাধর বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝে জঙ্গলে কাঠ, মধু চুরি করতে যেত। একবার হয়েছে কী- ওরা চারপাঁচজন মিলে মধু নিয়ে ফিরছে। ঠিক হল নৌকা ঘাটে বেঁধে রান্না করে খেয়ে তারপর রওনা দেবে। নদীতে ডুব দিয়ে এসে সবে খেতে বসেছে। এমন সময় কখন যে একটা বাঘ চুপিসাড়ে ওদের নৌকার কাছে এসে হাজির হয়েছে ওরা টেরও পায়নি। গদাধর ছিল নৌকার একদম সামনে। বাঘটা আচমকা লাফিয়ে পরে ওকে টানতে টানতে নিয়ে জঙ্গলে মিলিয়ে গেল। বন্ধুরা সব ভয়ে কাঠ। তাড়াতাড়ি নৌকা চালিয়ে গ্রামে ফিরে এল। গদাধর আর ফিরলো না। লক্ষ্মী কয়েকদিন খুব কান্নাকাটি করল তারপর বুড়ি শাশুড়ী আর ছেলেদুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো।

এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিতলি বলে উঠল, “আহারে! ওদের তো আর বাবা রইল না। তাহলে কে ওদের রোজগার করে খাওয়াবে”?

“সে কথাই তো বলছি। চুপ করে শোন না ভাই”।

বুড়ি শাশুড়ী আর দুই ছেলেকে নিয়ে লক্ষ্মী অকূল-পাথারে পড়ল। ছেলেদুটো তখন খুব ছোট। বড়, গোপালের বয়স মাত্র আট আর ছোট নেপালের তিন। তাই ওদের মা কাঠ কুড়িয়ে, ঘুঁটে দিয়ে, লোকের বাড়ি মুড়ি ভেজে, ধান ভেনে দিয়ে পয়সা রোজগার করতে শুরু করল। লক্ষ্মী ছিল অসম্ভব চটপটে আর মিশুকে। তাই গাঁয়ের লোকেরা ওকে খুব ভালবাসত। কোন কাজ পড়লেই ওর ডাক পড়ত। লক্ষ্মী দু’পয়সা রোজগারের আশায় হাসিমুখে তাদের সব কাজ করে দিত।

এভাবেই দিন কাটছিল। একদিন হঠাৎ এক ভিন্‌গাঁয়ের জমিদার বাড়ি থেকে মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, চিঁড়ের নাড়ু তৈরী করে দেবার বরাত পেল লক্ষ্মী। দিনরাত পরিশ্রম করে সব তৈরী করে ফেলল। এবার সেগুলো জমিদার বাড়ি পৌঁছে দেবে কে? লক্ষ্মী তো মহা ভাবনায় পড়ে গেল। তখন গোপাল বলল, “মা, তুমি চিন্তা কোর না, আমি ঠিক পৌঁছে দেব”।

নির্দিষ্ট দিনে গোপালের মা ছেলেকে নাইয়ে, খাইয়ে দাইয়ে একবস্তা মুড়ি আর থলে ভর্তি নাড়ু, মুড়কি, মোয়া ছেলের মাথায়, হাতে দিয়ে রওনা করিয়ে দিল। ছোট্ট একটা পুঁটলিতে মুড়কি, নাড়ু আর মোয়া দিয়ে বলল, “পথে যেতে যেতে খিদে পেলে খাস্‌। সাবধানে যাস্‌। কেউ ডাকলে তার সাথে যেন খেলা করতে শুরু করিস না”।

গোপাল জমিদার বাড়ির দিকে রওনা হল। তিতলির দিক থেকে এতক্ষণ কোন সাড়া না পেয়ে আম্মা তাকিয়ে দেখলেন তিতলি ঘুমিয়ে কাদা। আম্মা এবার সুযোগ পেয়ে খবরের কাগজে মন দিলেন। পড়তে পড়তে যেই একটু তন্দ্রামত এসেছে অমনি তিতলি জোরে ধাক্কা দিয়ে বলল, “কিগো! তারপর কী হল বললে না তো”!

আম্মা আবার শুরু করলেন–

আলপথ ভেঙে, মাঠ ঘাট পার হয়ে গোপাল চলেছে তো চলেছেই। পথ যেন আর ফুরোয় না। এবার এসে পৌঁছাল এক জঙ্গলের কাছে। জঙ্গল পেরোলেই জমিদার বাড়ি। ছোট ছেলে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাই পথশ্রমে সে বেশ ক্লান্ত। তারপর এই ঘন জঙ্গল দেখে ওর তো ভয় ভয় করতে লাগল। ভয় ভাঙাতে ও আপনমনে গান গাইতে শুরু করল। সুনসান জঙ্গল। চারদিকে কেউ কোথাও নেই। এমন কী আশপাশে কোথাও কুঁড়ে ঘরও দেখা যাচ্ছে না। ভয়ে গা ছমছম করতে লাগল। গান গাইতে গাইতে বেশ খানিকটা এগিয়েছে এমন সময় হঠাৎ কানে এল কে যেন ওকে কিছু বলছে। হঠাৎ দেখে কী……

তিতলি বোধ হয় ভয় পেয়েছে। সরে এসে আম্মার গা ঘেঁসে বলে উঠল, “তাড়াতাড়ি বলনা আম্মা, গোপাল কী দেখল? বাঘ, ভালুক না সিংহকে”?

“নারে–

গোপাল দেখল সামনের এক বিশাল বটগাছের ডালে সাদা কাপড় পরা, হাড় ঝিরঝিরে একটা লোককে যার হাত-পা গুলো খুব লম্বা।

মনে মনে ভয় পেলেও সাহস সঞ্চয় করে গোপাল বলল, “তুমি কে? মগডালে ওভাবে বসেই বা আছ কেন? আমাকেই বা কেন ডাকছ”?

লোকটা ধূপ্‌ করে ওর সামনে নেমে এসে বলল, “তোর নাম কীরে”?

“গোপাল”।

নাম শুনে সে বলল, “জানিস্‌ আমি খুব গোপাল ভক্ত ছিলাম, অবশ্য তোর নয়, গোপাল অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের”।

“তাই বুঝি! তা আমাকে তোমার কী দরকার? তাড়াতাড়ি বলে ফেল। আমায় এখন অনেকটা পথ যেতে হবে”।

লোকটা জানাল, “বড্ড খিদে পেয়েছে রে! অনেকদিন কিছু খাইনি তো”।

গোপাল পুঁটলি খুলে মুড়কি, মোয়া, নাড়ু দিতে চাইলে সে বলল, “তুই খুব দয়ালু তো। নিজে না খেয়ে আমায় সব খাবার দিয়ে দিতে চাইছিস। আচ্ছা যা- ফেরার পথে জমিদার বাড়ি থেকে যা পাবি তা থেকে কিছু দিস্‌খন”। বলেই লোকটা কোথায় যেন নিমেষেই মিলিয়ে গেল। এদিক ওদিক খুঁজেও গোপাল তার দেখা পেল না। এবার ও জোরে জোরে “রাম নাম” করতে করতে ছুটতে লাগল।

ছুটতে ছুটতেই ও জমিদার বাড়ি পৌঁছে গেল। জমিদারের নাতির অন্নপ্রাশন। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। ভালো ভালো খাবারের গন্ধে চারদিক ম্‌ম্‌ করছে। একজন গোপালকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। গা ভর্তি গয়না পরা মাঝবয়সী এক নাদুস নুদুস মহিলাকে দেখে জমিদার গিন্নী বলে গোপাল আন্দাজ করল।

ভদ্রমহিলা গোপালের কাছ থেকে জিনিসগুলো নিয়ে গুছিয়ে রাখলেন। দাম মিটিয়ে দিয়ে বললেন, “খুব সাবধানে টাকাগুলো নিয়ে যেও”।

গোপালের মুখের দিকে চোখ পড়তে বললেন, “আহারে! অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে তো। খিদেতেষ্টায় মুখটা তাই শুকিয়ে গেছে”।

একজনকে ডেকে পাঠিয়ে, ভদ্রমহিলা, তাকে কিছু খাবার এনে দিতে বললেন। সামনে বসে যত্ন করে খাইয়ে বাড়িতে মা-ভাইকে দেবার জন্য আবার একটা পুঁটলি ভর্ত্তি খাবার দিলেন।

ফেরার পথে যখন গোপাল যেখানে লোকটাকে দেখেছিল সেখানে এসে উপস্থিত হল তখন লোকটাকে কোথাও দেখতে না পেয়ে চেঁচিয়ে বলল, “শুনতে পাচ্ছ, তুমি কোথায়? খিদে পেয়েছে বলেছিলে। দ্যাখো কত ভাল ভাল খাবার পেয়েছি। খাবে এস”।

চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই সে একজন লোককে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। সে বলল, “তোকে পরীক্ষা করব বলে খিদে পাবার কথা বলেছিলাম। তুই খুউব ভাল। আমার থেকে কী চাস্‌ বল্‌। যা চাইবি-তাই পাবি”।

গোপাল বলল, “সত্যি সত্যি বলছ”।

উত্তরে সে জানাল, “কী চাস্‌ বলেই দেখ্‌ না”।

“কী চাই বলতো? আমরা তো খুব গরীব আমাদের জন্য মা অসম্ভব পরিশ্রম করেন। মাটির বাড়ি ভেঙে পড়ছে, সারাবার পয়সা নেই। তুমি কী এমন ব্যবস্থা করে দিতে পারবে যাতে আমাদের খাওয়া থাকার অভাব ঘুচে যায়”? সে বলল, “যা-সব হয়ে যাবে। আর কী দরকার বল্‌”?

গোপাল বলল, “জানো তো, আমার না লেখাপড়া শিখে মানুষ হতে ইচ্ছে করে। আমি কী পারব”?

“আচ্ছা, যা, তুই মানুষ হবি। কিন্তু সত্যিকারের মানুষ হওয়া তোর উপরেই নির্ভর করছে। তোর সব আশাই পূরণ হবে। আর দেরী করিস্‌ না। তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। মা চিন্তা করছে”।

গোপাল মনে মনে লোকটাকে প্রণাম জানিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল। বাড়ির সামনে এসে ও তো একদম অবাক। মুখ দিয়ে কথা সরছে না।

তিতলিও যেন অবাক হয়ে গেছে। তাই বলে উঠল, “কেন গো আম্মা, গোপাল বাড়ি এসে কী দেখল”?

আম্মা দম নিয়ে বললেন, ও দেখল ওদের মাটির কুঁড়ে ঘরটা উধাও হয়ে গেছে। সেই জায়গায় একটা পাকা বাড়ি। সামনে অনেকটা জমি। তাতে বেগুন, লংকা, ঢেঁড়শ গাছগুলোতে অজস্র ফল। মাচায় ঝুলছে বড় বড় লাউ, কুমড়ো, করলা। উঠোনের একধারে তুলসী মঞ্চ। গোপাল তো নিজেদের বাড়ি চিনতেই পারল না। ও জোরে জোরে মা, ঠাকুমা আর নেপালকে ডাকতে লাগল। ওদের দেখেও গোপাল অবাক। প্রত্যেকের গায়ে ভালো ভালো পোশাক। ও ভালো করে দু’হাত দিয়ে চোখ কচলে, নিজেকে চিম্‌টি কেটে দেখল ও স্বপ্ন দেখছে কী না। তারপরই সমস্ত রহস্য ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। মাকে সব কথা জানালে মা জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, লোকটার গলায় কী পৈতে ছিল”? খানিকক্ষণ চিন্তা করে পৈতে থাকার কথা জানালে মা বললেন, ও ছিল এক ব্রাক্ষণ পুরোহিত। গরীব হলেও মনটা ছিল খুব উদার। সব লোকের বিপদে আপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিত। আর দিন রাত গোপালের সেবায় ব্যস্ত থাকত। একদিন হঠাৎ জানা গেল লোকটা গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। লোকে বলে আজও নাকি তার আত্মা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। মনে হচ্ছে তোর সঙ্গে ওরই দেখা হয়েছিল। তোর নাম গোপাল শুনেই ও তোকে ভালবেসে এসব করে দিয়েছে।

এরপর দু’ভাই স্কুলে ভর্ত্তি হল। গোপাল মন দিয়ে পড়াশোনা করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভাল ফল করে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করল। উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য শহরে যাবার দরকার হল তার। সে কিন্তু একদিনের জন্যও তার উপকারী বন্ধুর কথা ভুলতে পারেনি। তাই শহরে যাবার আগে সে জঙ্গলে গেল বন্ধুর সাথে দেখা করতে। কিন্তু কোথাও তার দেখা পেল না। ওর সাথে এবার দেখা হল মোটাসোটা এক মামদো ভূতের। সে বলল, “তুই যাকে খুঁজছিস তাকে আমি এখান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি”। গোপাল কাঁদো কাঁদো স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “তাহলে আমি কী আর আমার বন্ধুকে কখনও দেখতে পাবনা”? মামদো উত্তরে জানাল, “আরও একটু গভীর জঙ্গলে এগিয়ে যা, দেখতে পাবি”।

মামদোর কথামত গভীর জঙ্গলে গিয়ে সে তার বন্ধুর দেখা পেল। গোপাল বলল, “তোমার বরে আমি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছি, আরও অনেক পড়াশোনা শিখে গ্রামবাসীর উপকার করব বলে শহরে চলে যাচ্ছি। যাবার আগে তোমায় দেখতে এলাম। আমার জীবনে যা কিছু উন্নতি সবই তোমার দান। তোমাকে কোটি কোটি প্রণাম।

বন্ধু বলল, “বেশির ভাগ মানুষই উপকারীর উপকার মনে রাখেনা। আসলে মানুষ খুব অকৃতজ্ঞ, নিষ্ঠুর প্রকৃতির। আমার কথা মনে রেখেছিস দেখে খুব ভাল লাগছে। এবার আমার ছুটি। ভাল থাকিস্‌। মানুষকে ভালবাসিস”। বলতে বলতে গোপাল দেখল ধোঁয়ার মত কীযেন একটা ওপরে উঠে আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। গোপাল হাতজোড় করে একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইল। ওর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।

এতক্ষণ চোখ বড় বড় করে তিতলি গল্পটা শুনছিল। এবার বলে উঠল, “আম্মা গল্পটা ভীষণ দুঃখের তাই না”?

আম্মা বলল, “এরকম দুঃখের গল্প শুনলে কী তোর কষ্ট হয়? তাহলে এরকম গল্প আর কক্ষনও বলব না”।

তিতলি আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “না-না, আম্মা তুমি এরকম গল্পই আমায় বলবে। শুনতে ভীষণ-ভীষণ ভাল লাগল”।

আম্মা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন, “যে সঙ্গীতে যত বিষাদের সুর, সেই সঙ্গীত ততই মধুর” কবির এই কথাটা একরত্তি একটা মেয়ে উপলব্ধি করল কী ভাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *