ভালো-না-লাগার-শেষ
রমলা বিরক্ত হয়ে উঠল। যেন এত বিরক্তি তার কোনোদিন আসেনি। নইলে ইকনমিক্সের পপুলেশন চ্যাপ্টারটা তো জমে ওঠবার কথা, কিন্তু আজকার ক্লাসে কিছুতেই যেন তার লেকচার গভীর হয়ে উঠল না।
এমন এক একটা দিন আসে সত্যি যখন কিছুই ভালো লাগে না। আজ যেন তাই। সে যেন আজ প্রথম টের পেল, ইস্কুলের মেয়েদের চেয়ে কলেজের মেয়েরা গোলমাল করে বেশি। অথচ এখানে কিছুই বলা যায় না, ইস্কুলের মতো যায় না কান মলে দেওয়া। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে মনে করে কি-না-কি করে ফেললাম; দুর্ভাগা সব। তার মেয়ে যদি হয়, সে কোনোদিন তাকে কলেজে পড়াবে না। পড়িয়ে বা লাভ কী? কিছু বোঝে না, কিছু জানে না, কেবল চোখ বুঝে মুখস্থ; আর পরীক্ষা খারাপ দিলে হাউহাউ করে কান্না, ফিট—আরও কতো কী! কিন্তু কাজের বেলায় দ্যাখো সব পেছনে পড়ে আছে।
নাচের যত পারফর্ম্যান্সই দিক, একাই কলেজে আসুক, বেড়াক একা, এক মিনিটে হাজারো কথা বলুক, পাঁচ হাজার বলো তো দশ হাজার বছর আগেকার আদিম মনোবৃত্তি আছে বেঁচে।
অথচ পুরুষেরা এমনি বোকা যে এসব তারা মোটেই জানে না, ধরে নেয়। অন্যরকম। কত কবিতা লিখে ফেলে, দেহের রূপ সাধনায়, হয়ে ওঠে তৎপর। রমলা যদি পুরুষ হত তবে দিত সব প্রকাশ করে।
রমলা হাসল, তাহলে কী মজা হবে। দুর্মুল্যতা, অহঙ্কার, লজ্জা সব চুরমার হয়ে যাবে।
রমলার মন আজ ভালো নেই। বলেছি তো, এত বিরক্তি আর অবসাদ তার কোনোদিন আসেনি। দেড়টার পর এত ঘণ্টা লীজার। সে কলেজ বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে নির্জন জায়গা দোতলার ছাদে যাওয়া সিঁড়ির কাছে যে এক টুকরো বারান্দা আছে সেখানে এসে দাঁড়াল। অন্যদিন হয় তো লাইব্রেরিতে গিয়ে বসত; গল্প করত প্রভাদির সঙ্গে, ভারী মজার লোক তিনি, হাসাতে হাসাতে মারেন, কিন্তু আজ তার কি হল সে রেলিংয়ে ভর দিয়ে বুকের কাছে এক হাতে মার্শালের ইকনমিক্স চেপে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। নীচে কিছুদূরে দেখা যায়, গেটের কাছে বেলগাছের ছায়ায় বসে কলেজের দরওয়ান কার সঙ্গে গল্প করছে। ঘণ্টা পড়বার পর মেয়েরা ক্লাস বদলিয়েছে, এখনও দু-একটি মেয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। দুপুরের দমকা বাতাস মাঝে মাঝে গায়ে এসে লাগছে; কপাল আর গালের কাছে দু-এক গোছা চুল উড়ছে বাতাসে। আকাশে ছেঁড়া সাদা মেঘ।
রমলা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার কি মনে করে প্রফেসরদের বিশ্রাম-কক্ষের দিকে গেল। কিন্তু সেখানে প্রভাদি নেই। তাহলে তিনি আসেননি, নাকি আবার প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে গল্প করছেন?
একপাশে বসে নতুন নিযুক্ত অরুন্ধতী বসু নিবিষ্ট মনে কী যেন পড়ছে। রমলা কোনো সাড়া না দিয়ে নিঃশব্দে প্রিন্সিপালের ঘরে গিয়ে হাজির হল।
প্রভাদি সত্যি আসেননি।
প্রিন্সিপাল নির্মলা রায় গম্ভীরভাবে কাগজপত্র দেখছেন। পাশের চেয়ারে ইংরেজির অধ্যাপক সুধীরবাবু বসে আছেন, কোনো কাজ আছে বোধহয়।
রমলা চকিতে একবার সেদিকে চেয়ে বললে, শরীরটা ভারী খারাপ বোধ হচ্ছে নির্মলাদি। নির্মলা মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী বললে ভাই? তিনি রমলাকে তুমি বলেই সম্বোধন করেন, রমলার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার একটু সূত্র নাকি আছে, আর তা ছাড়া সে কলেজের সবচেয়ে অল্পবয়সি অধ্যাপিকা।
রমলা বললে, ভারী exhausted feel করছি।
বোর্ডিং-এ চলে যেতে চাও?
If you permit—
নির্মলা তাড়াতাড়ি বললেন, যাও।
একটু হেসে রমলা চলে এল।
কলেজের লাইব্রেরি। বুড়ো লাইব্রেরিয়ান টেবিলের ওপর ভর দিয়ে বই পড়ছেন। ঘরে আর কেউ নেই।
রমলা একটা বই নেবে। বই দিয়ে সে তার ভালো-না-লাগার সময়গুলো কাটাবে। সে বললে, শর কোন বই সবচেয়ে ভালো হবে আপনি জানেন বড়োবাবু?
বড়োবাবু বললেন, আমাদের এখানে তো সব বই নেই, Man and Superman ছিল, এখন লাইব্রেরিতে নেই—কে যে নিয়েছে! Doctors Dilemma নিতে পারেন।
দিন তো।
যদুবাবু বই এনে দিলেন।
রমলা বই হাতে করে বোর্ডিং-এ চলে এল। দুটো বেজে গেছে। সে হাত থেকে ঘড়ি খুলতে খুলতে দেখল।
সমুখের জানালা দিয়ে হু হু করে আসছে বাতাস। তারই প্রতাপে একটা পাতলা ক্যালেণ্ডার দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শব্দ করছে।
দুপুরের নিস্তব্ধতা চারিদিকে।
রমলা জুতো ছেড়ে আয়নার কাছে এসে দাঁড়াল। আয়নাটা ছটো। বোর্ডিংয়ে এরকমই থাকে। কিন্তু রোজই কারণে অকারণে আয়নার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে রমলার একটা বড়ো আয়নার কথা মনে পড়ে যাতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যথাযথ দেখা যায়। কিন্তু দেয়ালে ঝোলানো ছোটো ওই জাপানি আয়নায় দেহের সবটুকু দেখা যায় না। রূপ কি শুধু মুখেই!
পোষাক-পরিচ্ছদ বদলাবার পর রমলা গামছা সাবান নিয়ে স্নানের ঘরে গেল। কিছু পরে হাতমুখ ধুয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে এল।
গত রাত্রির বিছানা এখনও পাতাই রয়ে গেছে। টেবিলের ওপর ক-টা বই ছড়ানো।
Writing pad-এর পাতা বাতাসে ফরফর করছে।
রমলা আবার আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে আংশিক প্রসাধন সেরে বইটা হাতে করে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বই খুলতেই Preface–
এক—
দুই—
তিন পৃষ্ঠা—রমলার আবার বিরক্তি এসে গেল। ক্রমাগত আরও পাতা উলটিয়ে দেখল, প্রায় অর্ধেক বই-ই কেবল Preface! তারপরে আসল নাটক।
ওরে বাপরে!
আপনারা শুনে আরও আশ্চর্য হবেন রমলা গুপ্তা এম-এ বইটা পাশে রেখে দিল। অদ্ভুত বটে! এরকম মনের অবস্থায় আপনি আমি হয়তো ক্ষমা পেতে পারি কিন্তু কলেজের অধ্যাপিকা রমলা গুপ্তা কখনো পান না।
আমি জানি এ আপনাদের চোখে ঠেকবে। কিন্তু ঘটেছিল সত্যি। কেন যে ঘটেছিল তা এখন খুলে বলি।
দু-বছর আগেকার কথা।
প্যাক্ট হল। কেউ কারোর স্বাধীনতায় বাধা দিতে পারবে না। যদি কখনো প্রয়োজন হয় পরস্পরে স্বামী-স্ত্রীর মতো ব্যবহার করবার তখন দুজনের সম্মতিতেই হবে, তার আগে নয়।
পূর্ববঙ্গের কোনো এক বেসরকারি কলেজের তরুণ অধ্যাপক অদিতি গুপ্ত চুক্তিপত্রে সায় দিলেন। রমলা তখন নতুন চাকরি পেয়েছে। তখন তার প্রাচুর্যের আনন্দ, নতুন জীবনের আনন্দ যেন খোলা মাঠের বাতাস, যেন বাধা না পাওয়া মধ্যরাত্রির জ্যোৎস্না।
অদিতি গুপ্তের মতো মানুষ দেখা যায় না। মনে হল, এই তার স্বামী হওয়ার উপযুক্ত। এতটুকু অভিযোগ নেই; জোর খাটাবার ইচ্ছে নেই।
কতকগুলো চিঠি আছে। বিয়ের পর এগুলোই সম্বল। রমলা আবার উঠে ডেস্ক থেকে চিঠিগুলো বার করল। একটি সে খুলে বসল।
চিঠির কাগজ প্যাড থেকে নেওয়া নয়, সামান্য ছেঁড়া কাগজ। অন্য কোনো বাহুল্য নেই; অদিতি গুপ্তের মনের একদিক এখান দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু লেখার বাহুল্য আছে; মানে পড়তে বেশ লাগে।
সেটিতে লেখা :–রমলা, কলেজের ছাত্রদের এক সভায় শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্র সম্বন্ধে কিছু বলতে হবে, ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই আদেশ এসেছে। কারণ আমি পড়াই বাংলা। যাই বলো, তুমি আছ বেশ, তোমার জীবনে ওটা কখনোই লাগবে না কাজে, অন্তত বক্তৃতা দিতে বলবে না কেউ।
তারপর আগের দিন রাতে প্রবন্ধ লিখে পরের দিন বলেছি কিছু। শুনেছি খুব ভালো নাকি হয়েছে। আমার প্রবন্ধে এমন একটা দিক নাকি প্রকাশিত হয়েছে যা আগে কখনো দেখা যায় নি। সম্পূর্ণ অভিনব। অভিনবই বটে।
নারী-চরিত্রে সর্বজ্ঞ আমি। হয়তো আরও কিছু লিখলে একটি অথরিটি হয়ে যেতাম!–
কী যেন এক অস্পষ্ট ইঙ্গিত, মনে এক আভাস আছে এই চিঠিতে, রমলা যেন আজ এই প্রথম বুঝতে পারল।
কিন্তু এ চিঠি আজকের নয়, অনেক দিনের। তখনকার মনের অবস্থা যা ছিল, এখনও তাই আছে কি না, কে জানে?
রমলা বাইরের দিকে চাইল! বোর্ডিংয়ের মাঠের পামগাছের কতখানি দেখা যাচ্ছে আর লম্বা ইউক্যালিপটাসের ছোটো পাতা বাতাসে কাঁপছে।
ফাল্গুনের বাতাস, একটু শীত করে যেন। রমলা তার একহারা পরা চাদর আরও খুলে গায়ে চেপে ধরল। তা ছাড়া শরীরটাও ক্লান্ত বোধ হচ্ছে।
অদিতি বিস্ময়ে বলল, কোনো খবর না দিয়েই যে!
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে রমলা বলল, ও খবর দিইনি বুঝি?
সে তো তুমিই জানো।
সে কথা আগে ভাববার সময় পাইনি।
এত কাজ! একরকম নোটে ছাত্রীরা আর খুশি নয়, তাই অন্য অথরের বই পড়তে হয় বুঝি খুব?
না, ইকনমিক্স সম্বন্ধে কেউ বড়ো আগ্রহ প্রকাশ করে না। রমলা হাসল। ঘরে ঢুকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে বলল, ঘরটি বেশ পরিষ্কার সাজানো তো! আমার ঘরের তুলনায় এ স্বর্গ। ইস, তুমি যদি দেখতে–
থাক, দেখার আর দরকার নেই। মেয়েদের বোর্ডিংয়ে পুরুষের যাবার অধিকার তো নেই।
অদিতি রমলাকে হাত ধরে বসাল। তারপর বলল, সারারাত ট্রেনের জার্নি, খুব strain হয়েছে নিশ্চয়ই, ঘুমও হয়নি। তুমি বিশ্রাম করো।
না, এখন স্নান করব। রমলা উঠে জুতো খুলল।
অদিতি বলল, তা হলে তুমি কাপড় বদলাও, আমি যাই।
যাও। রমলা মিষ্টি হেসে বলল, আবার এখনই এসো কিন্তু। বাথরুমটা দেখিয়ে দেবে এসে।
স্নানের পর শরীরটা বেশ ঝরঝরে হল, ভালো লাগল।
অদিতি বলল, বয়কে ডাকি। কী খাবার বল?
–সে সম্বন্ধে আমার কোনো প্রেজুডিস নেই; যা ভালো হয়।
-বেশ। অদিতি খাবার ব্যবস্থা করল। রমলা বলল, সাহেবের হোটেল। খরচ। দাও কত?
–তা কি তোমায় বলিনি রমলা? সে সংসারে অনেক ছেলেমেয়ে, এক স্বামী আর এক স্ত্রী, তাদের বুড়ি মা–বেশ চলে এ টাকায় যত আমি দিই এখানে খাওয়া আর থাকায়। অবিশ্যি এই আমার ভালো লাগে। কোনো ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হয় না।
রমলা বলল, মাইনেয় কুলোয় তাহলে?
–কোনো মাসে কুলোয়, কোনো মাসে কুলোয় না। জানো তো, আমার এক বিধবা বোন আছে, তাকে সাহায্য করতে হয়।
—জানি, রমলা এমনি হাত দুটো এক করে বলল, কিন্তু একটা কথা বলব
-কী?
—বলো কিছু মনে করবে না—
অদিতি হেসে বললো, না বল। রমলা বলল, আমার তো মোটেই খরচ নেই। তোমার যখন দরকার, কেন নাও না–
–চেয়ে? অদিতি আবার হাসল।
রমলার একবার ইচ্ছে হল বলে, না, চেয়ে নয়, জোর করে। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।
তাকে নীরব দেখে অদিতি বলল, কি, প্রস্তাব করে বুঝি ঠকে গেলে? এ তো জানোই মেয়েদের অর্জিত টাকা পুরুষে নেয় না।
—কিন্তু তা তো অনেকে নেয় দেখেছি।
–না, তা নয়। আমি বলছিলুম, তাহলে যে চুক্তি ভঙ্গ হবে।
—ও, বলে রমলা একটা নিশ্বাস ফেলল চেপে। অদিতি তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বলল, তুমি একটু পাতলা হয়ে গেছ।
-খুব কি খাটুনি পড়েছে?
–না। বেশি পরিশ্রম আমার ধাতে কোনোদিনই সইল না, তুমি তো জানো, রমলা হেসে বলল, তবু কেমন করে যে রোগা হলুম বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু তুমি টের পেলে।
অদিতি বলল, না, রোগা নয়। তুমি যেন আরও slim, আরও graceful হয়েছ।
রমলা নীরবে হাসল।
বয়ের হাতে খাবার এল। টেবিলের দুপাশে মুখোমুখি তারা বসল।
রমলা বললে, তুমি খাবে না?
–বেশিক্ষণ হয়নি যে খেয়েছি, অদিতি বলল, তুমি খাও, আমি গল্প করি।
রমলা হাত গুটিয়ে বসল।—এত খেতে আমি কিছুতেই পারব না। তুমি এসো সঙ্গে।
ভঙ্গিটা কতকটা ছোটো মেয়ের আবদারের মতে, এ পরিচয় যেন অদিতির চোখে নতুন ঠেকল। সে হেসে বলল, আচ্ছা এসো।
খাওয়া শেষ হলে পর, অদিতি কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে বললে, তোমাদের নির্মলাদি কেমন, এখনও বিয়ে করেননি? এখনও কুমারী নির্মলা রায়?
-হ্যাঁ, এখনও কুমারী নির্মলা রায়। রমলা মুচকি হাসল।
সিগারেটে আগুন লাগানো হয়নি। অদিতি তা মুখে দিয়ে এমনি বসেছিল। রমলা, দেশলাই-এর কাঠি জ্বালিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে দিল।
তাতে একটি টান দিয়ে কতকগুলো ধোঁয়া ছেড়ে অদিতি বলল, তুমি ঘুমোও, সারারাত জেগেছ।
রমলা সত্যি বড়ো ক্লান্তি বোধ করছিল। সে পাতা বিছানায় শুয়ে পড়ল।
অদিতি টেবিলের ওপর থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে লাগল।…
রমলা চোখ রগড়িয়ে ভাবলো, সে কোথায় এসেছে! এই তো কাল ছিল একা, আর আজ? কে আছে পাশে? এ কোন জায়গা?
সমস্ত ঘরটিতে রমলা চাপা আনন্দে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। কিন্তু অদিতি ঘরে নেই। সে হাতের কাছে ছোটো টেবিল থেকে ঘড়ি তুলে দেখলো। পাঁচটা বেজেছে।
বেশিক্ষণ ঘুমুইনি তো! তবে অদিতি গেল কোথায়? একটু ভয় হলে যেন। খাট থেকে নেমে সে বাইরে বারান্দায় গেল। সেখানে অদিতি নেই। তার ইচ্ছে হল চেঁচিয়ে ডাকে।
নীচে গিয়ে হোটেলের মেমগুলোকে জিজ্ঞেস করলে হয়। কিন্তু ওরা কি জানে? বারান্দায় রেলিং ধরে সে ভাবতে লাগল।
-রমলা।
রমলা চমকে ফিরে তাকাল, অদিতি খালি গায়ে ভিজে কাপড়ে দাঁড়িয়ে, কাঁধে টার্কিস টাওয়েল।
–এ কী?
অদিতি হেসে বলল, কাপড়-চোপড় নিতে মনে নেই।
বাথরুমে ঢুকেও মনে হল না?
হয়েছিল, কিন্তু তখন অর্ধেক স্নান করে ফেলেছি কি না!
রমলা খিলখিল করে হেসে উঠল। এই প্রথম সে এমনভাবে হাসল। তারপর ঘরে গিয়ে কাপড় এনে দিল।
একটু পর অদিতি ঠিক হয়ে বলল, বেড়িয়ে আসবে?
চলো।
ডাক-বাংলো, রেলওয়ে কর্মচারীদের কোয়ার্টার, পথের পাশে বড়ো লাল দালান, গাছের সারি, জনহীনপ্রায় পীচ-ঢালা মসৃণ রাস্তা।
শহরের বুকে নেমেছে ধূসর পাতলা অন্ধকার, সারি সারি বাড়ি আর গাছপালার মধ্যে ছায়া এসেছে ঘন হয়ে।
আঁকাবাঁকা রাস্তা সাপের মতো, কালো তার রং, বাতাসে আর দীর্ঘ সেগুন পাতার সঙ্গে শব্দ হচ্ছে মাঝে মাঝে।
পাশে লম্বা লেক। তারপরেই অনেক দূর পর্যন্ত মাঠ। জলের মাঝখানে ছোটো ঢেউ।
এখানে এই খোলা মাঠে, নরম ঘাসে, গাছের ছায়ায় আকাশের নীচে বসলে পর চোখে কেমন যেন নেশা লাগে, হাত দুটি কাকে যেন হাতড়ায়।
অদিতি সবুজ ঘাসের ওপর পা ফেলতে ফেলতে বলল, একটা কথা এখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুমি কেমন আছো?
রমলা হাত ধরে ছিল, একটু হাসল, বললে—ভালো। তুমি?
ছোটোবেলায় কোনো কিছু হলেই আগে থেকেই বলে রাখতুম, তোমরা যাই বলবে তার চেয়ে একবার বেশি আমার। এখনও তাই বলছি। তুমি যতটুকু ভালো, তা যদি ডিগ্রি দিয়ে মাপা যায়, তার চেয়ে এক ডিগ্রি সবসময়ে আমি বেশি।
হাসিমুখে রমলা বলল, জায়গাটা বেশ না?
-হুঁ, কিন্তু একা নয়। আমরা দুজনে আছি বলে।
—মানে?
–মানে, আমি আছি বলে তোমার ভালো লাগে, আর তুমি আছো। বলে আমার ভালো লাগে। অন্য সময়ে, অন্য কেউ হলে রমলা করত প্রতিবাদ, কিন্তু এখন করল না।
সে অনুভব করল, তার হাতের মধ্যে অদিতির হাতটি আরও চেপে এসেছে।
সন্ধ্যা গাঢ় হল।
জিমখানা ক্লাবের উৎসবের বাজনা শোনা যাচ্ছে; রাত নটা। রমলা আর অদিতি হোটেলে ফিরল। নীচের তলায় গ্রামাফোনে মার্লিনের গান হচ্ছে। ওপরে ওঠার সিঁড়ির পাশে জানালা দিয়ে দেখা গেল, কর্মরত দু-তিনটে মেম আর টেবিল ঘিরে সাহেব।
ওপরে গিয়ে অদিতি চেয়ারে বসে পড়ল আর রমলা দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে।
অদিতি একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বললো, কি, দাঁড়িয়ে যে!
–বিছানা করতে হবে না?
–কোথায় হবে? অদিতি ধোঁয়া ছেড়ে বলল, জায়গা নেই তো। ওটা তো একজনের খাট। তুমিই না হয় ঘুমাও, আমি এখানে বসে–।
রমলা একরকম চেঁচিয়ে উঠল—তবে আমি কী করব? এখন গাড়ি আছে?
-ভয় পাও কেন রমলা? এ পর্যন্ত আগাগোড়া আমার স্বভাবটায় কী দেখতে পেলে, একবারটি ভেবে দেখ না। আজ রাতেই তোমাকে যেতে হবে, অসম্ভব এ কথা। অনেকদিন পর স্বামী-স্ত্রীতে দেখা হলে পর তারা রাত জাগতেও তো পারে? কি বল? তারপর মেঝে আছে। সে কথা কি তুমি এত ভুলে গেলে যে, চেঁচিয়ে উঠলে ভয় পেয়ে?
অদিতি হাসতে হাসতে খুব কাছে এসে বলল, কী মজা, লক্ষ্য দুজনেরই আমাদের এক হলেও ভান করে তোমাকে একটু রাগিয়ে দিলাম, তোমাকে সুন্দর দেখাল, তুমি ধরা পড়লে—আর—এখন হাসছ? অদিতি রমলার মুখের ওপর নত হয়ে তার পাতলা ঠোঁটে একটি চুমো খেয়ে বলল,
খিদে পেয়েছে বড়ো। বয়কে খবর দিই।
-না আমার মোটেই ক্ষিদে নেই, তুমি খেলে খেতে পারো–
—তবে আমারও নেই।
—কি বল? আশ্চর্যের ভাবে রমলা তাকাল, এই যে বললে—
অদিতি হেসে বলল, মনে আছে, তোমার খাওয়ার সময়, হাত গুটিয়ে বসলে–
-তারই শোধ নেওয়া হচ্ছে বুঝি?
–হ্যাঁ।
–আচ্ছা বয়কে ডাকো। আমি হার মানছি।
খাওয়া, দাওয়ার পর।
রাত্রি গভীর হয়ে এসেছে, আর বেড়ে উঠছে তার রহস্যময়তা। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, আকাশে অজস্র তারা চোখ মেলে রাত জাগছে, আবার দিনের বেলা। ঘুমুবে। গির্জের ঘড়িতে বাজল বারোটা, বাজল একটা…
রাত্রির রহস্য গভীরতর হল। তারপর একটু একটু করে ভোরের আভাস।
বাজলো বেলা আটটা।
শহরের চোখে নেশা জমে রাতে, আর ভোর হতেই সে নেশা যায় টুটে, শুরু হয় কোলাহল, ব্যস্ততা, মোটরের হর্ণ। দিনের আলোয় মানুষগুলো মুখখাস পরে।
অদিতি চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
আর—রমলা শুয়ে আছে মেঝেতে পাতা বিছানায়।
রমলা—
কি?
বারোটায় ছাড়বে কলকাতার গাড়ি। এখন আটটা বেজে গেছে। আমার স্বভাবটা তো জানো, আপনভোলো নই কিন্তু নিজেকে ভুলতে পারি ইচ্ছে করলে। তুমি চলে যাও, এতটুকু জোর আমি করব না,—থাকো, তোমাকে ভয়ানক ভালোবাসব– ওঠো। না গেলে কলেজে যাওয়া হবে না, ছুটিও নাওনি। ওঠো। তোমার অনেক কাজ–
আমাকে ঠাট্টা কোরো না।
তুমি কি স্বপ্ন দেখছো।
হ্যাঁ, খুব ভালো একটা স্বপ্ন, আগে কখনও দেখিনি। খুব সুন্দর, আমার ভালো লাগছে। এত ভালো লাগছে যে তা তোমায় মুখে বোঝাতে পারব না। এত ভালো, গভীর…
রমলার ঠোঁট চেপে আসছে, চোখের পাতা অর্ধেক খোলা।
তুমি ঘুমোও আমি সব ব্যবস্থা করি গে।
না, রমলা এবার যেন জেগে উঠল, বললো, না, তুমি কোথায় যাচ্ছ আমায় একা ফেলে?
অদিতি হেসে বলল, কেন সম্মতির অপেক্ষা করতে হবে নাকি?
রমলাও হেসে বলল, আচ্ছা কাল বিকেল থেকে এ পর্যন্ত ভেবে দ্যাখো তো আমার সম্মতির দিকে কতদূর চাওয়া হয়েছে?
অদিতি বললে, বৃথাই এতদিন প্রফেসারি করলুম রমলা। অনেক আগেই এটা আমার জানা উচিত ছিল যে, মেয়েরা মুখে কিছু বলে না তাদের ডাকাতি করতে হয়, অর্জুনের মতো হরণ করতে হয়। ডাকাত জড়িমায় রমলা চোখ বুজল আবার, তার রাত্রি এখনও শেষ হয়নি।