ভালোমানুষ হরবাবু
বাড়িতে চোর ঢুকেছে টের পেয়ে হরবাবু বিছানায় উঠে বসে আপনমনে বললেন–এসব কী অসভ্যতা?
ভারী বিরক্ত হয়ে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় এসে চুপ করে বসে জ্যোৎস্না দেখতে লাগলেন। চুরিটুরি খুব অপছন্দ করেন হরবাবু। তাঁর চোখের সামনেই চুরি হোক–এটা তার সহ্য হবে না।
চোরটা বড়ই নির্লজ্জ। পাপ কাজ গোপন করার কোনো চেষ্টাই নেই। বারান্দায় বসেই তিনি শুনতে পেলেন, ঘরে বাক্স প্যাটরা নাড়ার, বাসনকোসন পড়ার, আলমারি ভাঙার বিকট সব শব্দ হচ্ছে।
রেগে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে হরবাবু ধমক মারলেন–আস্তে! বেহায়া কোথাকার!
চোরটা বা চোরেরা তাতে খানিকটা সাড়াশব্দ কম করতে লাগল। কিন্তু ব্যাটাদের কাজ আর শেষ হয় না। ভারী আনাড়ি চোর সব হয়েছে আজকাল। কিছু শিখবে না, জানবে না, দুদিন একটু ট্রেনিং নিয়েই কাজে নেমে পড়ে।
হরবাবু জ্যোৎস্না দেখতেই লাগলেন। ঘণ্টাখানেক বাদে ঘর থেকে একটা কর্কশ গলা যতদূর সম্ভব মোলায়েম হয়ে বলল–কাম সারা হয়ে গেছে বড়বাবু। এখন আরাম করে শুয়ে পড়ুন।
হাই তুলে হরবাবু উঠলেন এবং ঘরে গিয়ে বিছানায় শুলেন। ভারী লোভী আর অভদ্র চোর সব আজকালকার। বিছানার চাদর, বালিশের পাশে টর্চ–সব নিয়ে গেছে। কসার গ্লাসে জল ঢেকে রেখেছিলেন রাতে খাবেন বলে, সেটা শুন্ধু নেই।
চোরে সব নিয়ে গেছে। তবু তো বাজার করতে হবে, রাঁধতে হবে, খেতেও হবে। হরবাবু তাই ধার কর্জ করে বাজারে চললেন সকালবেলায়।
আলুওলা, পটলওলা, মাছওলা সবাই ভালমানুষ হরবাবুকে ভালভাবে চেনে। হরবাবুর যেদিন আলুর দরকার নেই সেদিনও আলুওলা তাকে পাকড়াও করে ব্যাগের মধ্যে জোর করে দু কেজি আলু ঢুকিয়ে দেয়। হরবাবু ঝিঙে বা করলা খান না, কিন্তু তা বলে ঝিঙে বা করলাওয়ালারা তাকে ছাড়ে না। প্রায় দিনই তাঁকে সের খানেক ঝিঙে আর করলা কিনে আনতে হয়। সেগুলো ঘরে পড়ে থেকে পচে যায়। হরবাবু আপন মনে রাগারাগি করেন-তরকারিওয়ালারা হয়েছে যত সব গুণ্ডা বদমাস।
ধার করা পয়সায় বাজার করতে বেরিয়েছেন, রাস্তায় খলিফা হালদারের সঙ্গে দেখা।
–এই যে হর, তুমি যে মাস তিনেক আগে একশো টাকা ধার নিয়েছিলে, তার কী করলে?
হরবাবু খুব ব্যথিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন। কথাটা ঠিকই যে মাস তিনেক আগে হরবাবু খলিফা হালদারের কাছ থেকে একশো টাকা ধার নিয়েছিলেন। কিন্তু হরবাবুর খুবই স্পষ্ট মনে আছে যে, একমাস বাদেই টাকাটা শোধ করেছিলেন। কিন্তু সেটি খলিফাবাবুর মনে ছিল না বলে পরের মাসেই আবার নতুন করে টাকাটা তাকে শোধ করতে হয়। সেটাও হরবাবু হাসি মুখেই মেনে নেন। ভুল তো মানুষের হয়ই। কিন্তু ফের গত মাসেও খলিফা সেই একশো টাকার তাগাদা দেওয়াতে খানিকটা বিরক্ত হয়েই হরবাবু আবার টাকাটা শোধ করেন। সে যা যাওয়ার গেছে। কিন্তু খলিফা আজ আবার চাইছে।
হরবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব সংকোচের সঙ্গে বললেন–টাকাটা কি আপনাকে দিইনি?
–দিয়েছো? কবে দিলে? কৈ, আমার তো মনে পড়ছে না। হরবাবু মাটির দিকে তাকিয়ে লজ্জার সঙ্গে বলেন–তাহলে তো দিতেই হয়। তা নেবেন। দুচার দিনের মধ্যেই দিয়ে দেবো।
মুদির দোকান থেকে ধারে জিনিস কেনেন হরবাবু। মুদি হরবাবুকে জক দিয়ে বলে–আপনার হিসেবটা দেখে নেন হরবাবু। গত মাসে আপনি একশো বাহাত্তর টাকা বিরাশি পয়সার জিনিস নিয়েছেন।
হরবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, মুদির দোকানের হিসেব তিনিও নোট বইতে লিখে রাখেন। তার হিসেব মতো মোটে বাষট্টি টাকা পনের পয়সা হয়েছে। কিন্তু কারো মুখের ওপর স্পষ্ট কথা বলতে তাঁর বড় কষ্ট হয়।
তাই বললেন–আচ্ছা, দেবোখন। কয়েক দিনের মধ্যেই দেবো। বাজার থেকে ফিরে রান্নাবান্না করে খেতে গিয়ে ভারী অসুবিধে হল আজ। বাসনপত্র নেই, বাজার থেকে মেটে হাঁড়ি আর কলাপাতা এনেছেন। মেটে হাঁড়িতে কোনোক্রমে সেদ্ধ ভাত করে কলাপাতায় খেয়ে ইস্কুলে চললেন। তিনি অঙ্কের মাস্টারমশাই।
বাজার-হাটে পথে-ঘাটে রাজ্যের ভিখিরি। আজকালকার ভিখিরিরাও ভারী তাঁদড়। বেশির ভাগ লোকই ভিক্ষে টিক্ষে দেয় না একটা, যারা যা-ও দেয় সে-ও দু-এক পয়সার বেশি নয়। কিন্তু হরবাবুর কথা আলাদা। ভিখিরিরা তাকে দেখলেই সব নেচে ওঠে। পাঁচ দশ পয়সা দিলে ভারী চটে যায় ভিখিরিরা। একবার একটা বুড়ো ভিখিরিকে মোটে দশ পয়সা দিয়েছিলেন তিনি। তাতে সে চটে উঠে পয়সাটা ফেরত দিয়ে বলেছিল–এঃ দশ পয়সা দিয়েছ! কেন, আমরা কি ভিখিরি নাকি?
তাই বাধ্য হয়েই হরবাবুকে চার আনা আট আনা দিতে হয়। তাতে খুশি না হয়ে ভিখিরিরা এক টাকা দু টাকা চাইতে থাকে। হরবাবু খুবই রেগে যান। কিন্তু কী আর বলবেন।
ইস্কুলের ছেলেরাই কি কিছু ভাল?
হরবাবু ক্লাসে যাওয়ার আগে থেকেই ক্লাস সিক্সের ছেলেরা হাল্লা চিল্লা করছিল। কিছু ছেলে গল্পের বই পড়ছে, কেউ কাটাকুটি খেলছে, চেঁচিয়ে গল্প করছে, কিছু বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হরবাবু ক্লাসে ঢুকতেই হাল্লা দ্বিগুণ বেড়ে গেল। হাতাহাতি চলছে, চেঁচামেচি হচ্ছে, এমন কি ক্লাসের পিছন দিকে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় কাগজ পাকিয়ে বল বানিয়ে কয়েকটা ছেলে ফুটবলও খেলছিল, হরবাবুকে কিছু না বলেই কয়েকজন জল খেতে বা বাথরুমে চলে গেল।
হরবাবু কোনোদিকে নজর দিলেন না। ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অঙ্ক দিয়ে মিনমিন করে বললেন-কষে ফেল, গোল কোরো না।
সে কথা কারো কানেই গেল না। হরবাবু বিরক্ত হয়ে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে খানিকক্ষণ বসে রইলেন। ছেলেগুলো যে কেন এত গণ্ডগোল করে! খানিক বাদে উঠে তিনি আপন মনে ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্কটা কষে দিয়ে বললেন-”টুকে নাও সব।
কেউ টুকল না।
হরবাবু কোনো ছাত্রকে কখনো মারেননি, বকেননি, কাউকে উপদেশ পর্যন্ত দেননি। পরীক্ষার সময়ে তিনি যে ঘরে গার্ড দেন সে ঘরের ছেলেদের পোয়াবারো। আজ পর্যন্ত কারো টোকা ধরেননি হরবাবু। চোখে পড়লেও অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নেন তাড়াতাড়ি।
অন্য মাস্টারমশাইরা হরবাবুকে নিয়ে ইয়ার্কি, ঠাট্টা-মস্করা করেন। হরবাবু চুপ করে হাসিমুখে সব শোনেন, কারো কথার ওপর কথা বলেন । আবার গোপনে অনেকেই তাঁর কাছ থেকে ধারকর্জও নেন। শোধ দিলেও হরবাবু কিছু বলতে পারেন না।
ইস্কুল থেকে ফেরার পথে কালীবাড়ির গলিতে একটা পেল্লায় ষাঁড়ের মুখোমুখি পড়ে গেলেন হরবাবু। পাশ দিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন। কিন্তু বজ্জাত ষাঁড়টা কাছে এসে যেন ইয়ার্কি করতেই একবার মাথানাড়া দিল, ডান পাঁজরে ষাঁড়ের শিংটা পট করে লাগতেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু ষাঁড়টাকে কিছুই বলেন না।
তালপুকুরের পাশ দিয়ে আসবার সময়ে একটা রাস্তার কুকুর খুবই অভদ্রভাবে হরবাবুর দিকে দৃত খিঁচিয়ে তেড়ে এল। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে এলেন। কুকুরটাকে একটা ধমকও দিলেন না।
সন্ধ্যের পর হরবাবু একটু বেড়াতে বেরোন। রোজকার অভ্যাস।
বেড়াতে বেড়াতে একেবারে নির্জন নদীর ধারে চলে এলেন। খুব জ্যোৎস্না, প্রকাণ্ড আকাশ, বিশাল শূন্যতায় তিনি বিভোর হয়ে গেলেন। কী আনন্দই যে হচ্ছে। কী আনন্দ আর শান্তিই না চারদিকে।
ঠিক এই সময়ে কোত্থেকে একটা বিশাল চোয়াড়ে চেহারার লোক সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল–যা আছে দিয়ে দিন।
লোকটার হাতে প্রকাণ্ড ছোরা। হরবাবু ভীষণ বিরক্ত হলেন। এই সন্ধ্যেবেলার আনন্দটা কেউ মাটি করলে তিনি অসম্ভব চটে যান।
দেওয়ার মতো কিছু নেইও। কাল রাতে সব চুরি হয়ে গেছে। হরবাবু মিনমিন করে লোকটাকে বললেন, ‘দিচ্ছি। তবে গোল কোরো না। এখন গোলমাল করলে আমার ভারী অসুবিধে।
বলে পকেটে টাকা পয়সা যা ছিল সব দিয়ে দিলেন লোকটাকে। লোকটাও হরবাবুর অবস্থা বুঝে বেশি ঘাঁটাল না, শুধু পকেট থেকে কলমটা টেনে নিয়ে গেল। যাক, হরবাবু আবার চারদিকের গভীর নির্জন আনন্দে ডুবে গেলেন।
বেশ কেটে যাচ্ছিল সময়টা। কিন্তু হঠাৎ একটু দূর থেকে একটা প্রবল চেঁচানি উঠল–বাঁচাও! বাঁচাও! মেরে ফেললে?
মনোযোগটা ছিন্ন হওয়ায় খুবই রেগে গেলেন হরবাবু। এসব কি? এমন সুন্দর জ্যোৎস্নারাতে একা একটু নির্জনে বসে থাকবেন তার জো। নেই?
প্রথমটায় চুপ করেই ছিলেন হরবাবু। কিন্তু আবার শুনলেন একটা মেয়ে ‘বাঁচাও! বাঁচাও’ বলে চেঁচাচ্ছে আর অন্য একটা হেঁড়ে গলা ধমকাচ্ছে–চুপ! শব্দ করলে মেরে ফেলব!
না, এর একটা বিহিত করা দরকার। একটু নির্জনে বসে থাকতে পারব না–এটা কেমন বিশ্রী ব্যাপার! এই ভেবে হরবাবু উঠে পড়লেন।
চাঁদমারীর ঢিবিটা পার হয়ে হরবাবু দেখতে পেলেন একজোড়া স্বামী স্ত্রী আর একটা বাচ্চা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় বেড়াতে বেরিয়েছিল। তাদের সামনে সেই প্রকাণ্ড চেহারার চোয়াড়ে লোকটা ছোরা হাতে খুব আস্ফালন করছে।
হরবাবু দাঁত কড়মড় করেন–ছিনতাই করছিস কর, তা বলে চেঁচামেচি করে লোকের শান্তি নষ্ট করবি? এমন দুধ জ্যোৎস্নার রাতটা মাটি করে দিবি? লোককে একটু ধ্যানস্থ হয়ে আনন্দ ভোগ করতে দিবি না?
হরবাবু রেগে হেঁটে গিয়ে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে ধমক মেরে বললেন–পেয়েছিস কি তুই? অ্যাঁ! পেয়েছিসটা কি? একবার বলেছি না, গোলমাল করিস না!’
লোকটা ছোরাটা নেড়ে রক্ত চোখে চেয়ে বলে, জান নিয়ে নেব। ভাগো হিয়াসে!
–বটে! তবু গোলমাল করবি? চেঁচাবি?’ বলতে বলতে হরবাবু চড়াং করে একটা চড় কষালেন লোকটার গালে। আর সেই চড়ে লোকটা হতভম্ব হয়ে গেল।
হরবাবুর তাতে রাগ গেল না। আর একটা চড় কষালেন। লোকটার হাত থেকে ছোরা খসে গেল। লোকটা গাল চেপে উবু হয়ে বসে ‘বাপ রে! মা রে!’ বলে চেঁচাতে লাগল।
কিন্তু হরবাবু তাতে আরো ক্ষেপে গেলেন। মার খাচ্ছিস, তবু চেঁচাচ্ছিস?
হরবাবু লোকটার ঘাড় ধরে তুলে কিল চড় রদ্দা মারতে মারতে আর বকাবকি করতে করতে একেবারে রাস্তায় তুলে দিয়ে এলেন। বললেন–‘ফের এদিকে আসবি তো খুন করে ফেলব?’
ফিরে এসে হরবাবু আবার হাসি-হাসি মুখ করে জ্যোৎস্না রাতের রহস্য উপভোগ করতে লাগলেন।