৮
পরের দিন নাস্তা খেয়ে অফিসে যাওয়ার সময় তন্ময় তামান্নাকে বলল, মাকে রাজি করাবার জন্য আমি অনেক সময় সেখানে থাকব এবং খাওয়া দাওয়া করব। এমন কি দরকার মনে করলে সেখানে রাতও থাকতে পারি। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা না করে খেয়ে নেবে। আর রাতে যদি একান্ত ফিরতে না পারি, তা হলে মনে কিছু নিও না। তাতে হয়তো তোমার একটু কষ্ট হবে। আমার জন্য এই কষ্টটুকু সহ্য করতে পারবে না?
তামান্না আঁশুভরা চোখে বলল, নিশ্চয় পারব। তোমাকে সেদিন যে কথা বলেছিলাম তা আবার বলছি, তোমার সুখ শান্তির জন্য আমি আমার প্রাণের বাজি রাখতে পিছনা হব না। মাকে রাজি করানোর ব্যাপারে তুমি যা ভালো বুঝবে করবে। তাতে আমিও তোমাকে সাহায্য করব।
তন্ময় তাকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা আদর দিয়ে বলল, তোমার কাছ থেকে এই রকমই আশা করেছিলাম। আল্লাহপাক যখন আমার একটা আশা পূরণ করেছেন তখন নিশ্চয় এটাও করবেন। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে যেতে উদ্যত হল।
তামান্না তাড়াতাড়ি কদমবুসি করে বলল, আল্লাহ হাফেজ। তন্ময়ও আল্লাহ হাফেজ বলে বেরিয়ে গেল।
অফিসে যাওয়ার আগে তন্ময় প্রথমে বাসায় গেল। কাজের মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করল, মা কোথায়? গতকাল মা খাওয়া দাওয়া করেছে?
তারা বলল, আপনি চলে যাওয়ার পরও দরজা খুলেন নি। আপনাদের চলে যাওয়ার কথা বলে দুপুরে খাওয়ার জন্য অনেক ডাকাডাকি করলাম। উনি দরজা না খুলে বললেন, তোমরা আমাকে বিরক্ত করো না। আমার ইচ্ছামতো বেরিয়ে খাওয়া দাওয়া করব। রাতেও বেরোন নি। আজ সকালে একবার বেরিয়ে নাস্তা খেয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তন্ময় মায়ের রুমের দরজার কাছে এসে নক করে কয়েকবার মা মা বলে ডেকে সাড়া না পেয়ে অফিসে চলে গেল।
বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এলে একটা কাজের মেয়ে চা নাস্তা দিল।
তন্ময় তাকে জিজ্ঞেস করল, মা দুপুরে খেয়েছে?
মেয়েটা বলল, জি খেয়েছেন। ওনাকে ডাকাডাকি করতে আপনাকে নিষেধ করেছেন।
তন্ময় শুনল না। দরজার কাছে গিয়ে বলল, মা, আমি অন্যায় করেছি। সে জন্যে বারবার ক্ষমা চাইছি। ক্ষমা যদি করতে না পার, তবে যা মনে চায় তাই শাস্তি দাও, তবু এভাবে থেক না। তারপর ভিজে গলায় বলল, মা হয়ে ছেলের অপরাধ ক্ষমা না করলে আর কে করবে? তুমি না বললে তামান্নাকে এ বাড়িতে কখনো নিয়ে আসব না। দরজা খোল মা। তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমার যে কি কষ্ট হচ্ছে, তা কি জান না? এত কিছু বলার পরও যখন তিনি দরজা খুললেন না তখন তন্ময় চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।
তামান্না দরজা খুলে প্রথমে সালাম দিয়ে ব্রীফকেসটা হাত থেকে নিয়ে একপাশে রাখল। তারপর হাত ধরে সোফায় বসিয়ে জুতার ফিতে খোলার সময় বলল, মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
তন্ময় সালামের উত্তর দিয়ে তাকে দু’হাতে ধরে কোলে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে ছলছল নয়নে বলল, না। তারপর ভিজে গলায় বাসায় গিয়ে যা কিছু শুনেছে ও করেছে বলল।
তামান্না আঁচলে স্বামীর মুখ মুছে দিয়ে বলল, এত ভেঙ্গে পড়ছ কেন? কয়েকদিন গেলে মায়ের রাগ নিশ্চয় একটু কমবে। তখন ইনশাআল্লাহ মাকে তুমি দেখতে পাবে এবং মানাতেও পারবে। এখন ছাড়, তোমার জুতো খুলে দিই। তারপর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে জুতো খুলে দিয়ে লুঙ্গি-গেঞ্জি এনে বলল, জামা কাপড় পাল্টে নাও। আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
.
তন্ময় প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় এবং অফিস থেকে ফেরার সময় বাড়িতে যায়। কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা হয় না। তন্ময় যখনই যায় তখনই মায়ের বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডেকে দরজা খোলার জন্য কাকুতি মিনতি করে। কিন্তু ফিরোজা বেগম কোনো সাড়া দেন নি।
প্রতিদিন তামান্না স্বামীর কাছে শাশুড়ীর খোঁজ খবর নেয়। উত্তর একই পায়। এভাবে প্রায় বিশ পঁচিশ দিন পার হওয়ার পর একদিন তন্ময় অফিসে যাওয়ার সময় বাড়িতে গিয়ে শুনল, দু’দিন থেকে মায়ের একটু একটু জ্বর ছিল, গতরাত থেকে খুব বেড়েছে। কাজের মেয়েরা সারারাত মাথায় পানি ঢেলেছে। অন্ময় শুনে তাড়াতাড়ি মায়ের রুমে ঢুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার কিছু হলে আমিও বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হব।
ফিরোজ বেগমের তখন ভীষণ জ্বর। কথা বলার তেমন শক্তি নেই। তবু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, এরকম কথা বলা শক্ত গোনাহ। আর কখনও বলবি না। তারপর তিনি জ্ঞান হারালেন।
তন্ময় মা মা করে কয়েকবার ডেকে সাড়া না পেয়ে বুঝতে পারল, জ্ঞান হারিয়েছে। তাড়াতাড়ি ডাক্তার রহিমকে ফোন করে আসতে বলল।
উনি আগের থেকে ফিরোজা বেগমকে চিকিৎসা করছিলেন। এসে পরীক্ষা করে বললেন, ভয়ের কোনো কারণ নেই। জ্বরের ঘোরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। মাথায় পানি দিতে থাক জ্বর কমে আসবে। আর জ্ঞান ফিরলে যা ঔষুধ আছে তা খাওয়াবে। তারপর আবার বললেন, খুব সম্ভব পক্স বেরোবে। এখন ওনার ভালো নাসিং দরকার। তিনি তামান্নার ব্যাপারটা জানেন না। বললেন, বৌমা কি বাপের বাড়িতে? তাকে দেখছি না কেন? এ সময় তাকে খুব দরকার।
তন্ময় বলল, আমি তাকে আনার ব্যবস্থা করছি এবং নাসিং এর ব্যাপারে কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার কাছে আসছি, আপনি যান।
ডাঃ রহিম যাওয়ার পর তন্ময় তামান্নার কাছে গিয়ে মায়ের অসুখের কথা বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বলল। তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে ডাক্তার রহিমের কাছে এসে তামান্নার পরিচয় দিয়ে তাকে বিয়ে করার ও সেই জন্যে মায়ের সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা বলল। আরো বলল, তামান্না পতিতা ছিল বলে, মা ওকে একদম সহ্য করতে পারছে না। তামান্না শিক্ষিতা ও চালাক চতুর মেয়ে। ওকে আপনি নার্সিংয়ের সবকিছু বুঝিয়ে দিলে আশা করি মায়ের নার্সিং করতে পারবে। আর এমনভাবে ওকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন, মা জ্ঞান ফেরার পর যেন ওকে চিনতে না পারে। নার্সের ড্রেসেরও ব্যবস্থা করে দেবেন।
ডাঃ রহিম বললেন, তোমার সৎ সাহস দেখে বাহবা না দিয়ে পারছি না। তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি সেই রকম ব্যবস্থা করে বৌমাকে একেবারে নার্স তৈরি করে নিয়ে যাব। তুমি এখন যাও, আমরা পরে আসছি।
.
বিকেলের দিকে ডাঃ রহিম নার্সের পোষাকে তামান্নাকে নিয়ে তন্ময়দের বাড়িতে এল। একমাত্র তন্ময় ছাড়া তামান্নাকে কেউ চিনতে পারল না। ডাঃ রহিম তামান্নাকে মুর্শিদা নামে সবাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন
দু’দিন অজ্ঞান থাকার পর ফিরোজা বেগমের সারা শরীরে ভীষণ পক্স বেরোল। শরীরের এমন জায়গা বাকি রইল না, যেখানে পক্স বেরইনি। চোখ মুখের দিকে তাকালে ভয়ে গা শিউরে উঠে। পক্স বেরোবার পর জ্ঞানও ফিরল কিন্তু চোখে এত পক্স বেরিয়েছে যে, ভালো করে তাকাতে পারছেন না। ফলে কাউকে তিনি চিনতে পারলেন না।
ডাঃ রহিম রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললেন। কিন্তু ফিরোজা বেগম বললেন, মরে গেলেও আমি যাব না। হাসপাতালে পর্দা বলতে কিছু নেই। বাসাতেই চিকিৎসা চলতে লাগল। তামান্না দিনরাত অক্লান্ত সেবা যত্ন করে যেতে লাগল। প্রায় মাসখানেক পর ফিরোজা বেগম আরোগ্য লাভ করলেন। কিন্তু চোখে খুব বেশি পক্স হওয়ার ফলে চোখে দেখতে পান না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদেন আর বলেন, তোকে দেখতে চাইনি বলে আল্লাহপাক আমাকে অন্ধ করে দিলেন। তোর মুখ আর আমি কখনো দেখতে পাব না। আল্লাহ গো তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ে আমার চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দাও। আমি আমার তন্ময়কে দু’চোখ ভরে দেখব।
মাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে তন্ময় বলল, ইনশাআল্লাহ তুমি আবার দেখতে পাবে। আমি তোমার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করব। দরকার হলে বিদেশে নিয়ে গিয়ে চোখ অপারেশন করাব। তাতে বিফল হলে কর্নিয়া লাগিয়ে হলেও তোমার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনাব।
মা সুস্থ হওয়ার কয়েকদিন পর তন্ময় একজন আইস্পেশালিস্টকে দিয়ে চোখ পরীক্ষা করাল। উনি বললেন, অপারেশন করালে উনি দেখতে পাবেন। ওনার পরামর্শ মতো ওনার ক্লিনিকেই অপারেশনের ব্যবস্থা হল। তন্ময় এই ডাক্তারকে তামান্নার ও তার এবং মায়ের সব কথা বলে তামান্নাকে এখানেও ফিরোজা বেগমের নার্সিং করার জন্য নিয়ে এল।
ফিরোজা বেগম নার্স মুর্শিদার ব্যবহারে খুব সন্তুষ্ট। প্রথম অসুখের সময় যে নার্স ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি আন্তরিকতার সঙ্গে তার সেবাযত্ন করেছে। চোখে দেখতে না পেলেও মাঝে মাঝে কাছে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক দোয়া করেছেন আর বলেছেন, তুমি আমাকে এত সেবাযত্ন করে ভালো করলে; কিন্তু তোমার মুখ আমি দেখতে পেলাম না। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক। গায়ে মাথায় হাত বুলোবার সময় এবং তার গলার আওয়াজ শুনে প্রথম দিকে তাকে তামান্না বলে একটু সন্দেহ করেছিলেন। পরে ডাঃ রহিমের কাছে তার পরিচয় পেয়ে সেই সন্দেহ দূর হয়ে যায়।
চোখ অপারেশন করাতে ক্লিনিকে যখন ফিরোজা বেগমকে নিয়ে আসা হয় তখন উনি ডাক্তার রহিমকে এই নার্সকে রাখার জন্য বলেছিলেন। তিনিও চোখের ডাক্তারকে সেই কথা জানান। সেই জন্য তন্ময় যখন চোখের ডাক্তারকে মুর্শিদার পরিচয় দিয়ে তার মায়ের নার্সিং করার কথা বলল, তখন তিনি রাজি হয়ে যান।
ক্লিনিকেও তামান্না নার্স মুর্শিদা হয়ে ফিরোজা বেগমের সেবাযত্ন করতে লাগল। যেদিন ফিরোজা বেগমের চোখ খোলা হবে সেদিন ডাঃ রহিম ও এসেছেন। এক সময় তামান্না তন্ময়সহ ডাক্তারদের বললেন, মায়ের চোখের ব্যাণ্ডিজ খোলার সময় সেখানে আমার থাকা বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ মা দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেয়ে আমাকে দেখে যদি চিনে ফেলেন, তখন খুব উত্তেজিত হয়ে পড়বেন। তাতে ওনার চোখের ক্ষতি হতে পারে।
ডাঃ রহিম বললেন, গুড। তোমার আইডিয়াটা কারেক্ট। কিন্তু তুমি যতটা ভাবছ ততটা নাও হতে পারে। তা ছাড়া তোমাকে থাকতেই হবে। আজ তোমার অগ্নি পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তোমাকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। এ রকম সুযোগ তুমি আর পাবে না।
চোখের ডাক্তারও বললেন, ডাঃ রহিম ঠিক কথা বলেছেন। তোমার শাশুড়ীকে মানিয়ে নেয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। তুমি চিন্তা বা ভয় করো না। আমরা তো থাকব। যাতে ওনার চোখের কোনো ক্ষতি না হয় এবং তোমাকে ক্ষমা করে গ্রহণ করে, উভয় দিকে আমরা লক্ষ্য রাখব।
তামান্না বলল, আপনারা যখন বলছেন মায়ের চোখের ক্ষতি হবে না তখন থাকব। আপনারা দোয়া করুন আমি যেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি।
কিছুক্ষণের মধ্যে চোখের ডাক্তার ফিরোজা বেগমের চোখের ব্যাণ্ডিজ খুললেন। ডাঃ রহিম, তন্ময়, তামান্না ও বাসার অন্যান্য সবাই রয়েছে। ব্যাণ্ডেজ খোলার পর ডাক্তার আস্তে আস্তে তাকাতে বললেন।
ফিরোজা বেগম চোখ খুলতে প্রথমে আবছা কুয়াশার মতো দেখতে পেলেন। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সবাইয়ের সঙ্গে নার্সের পোশাকে তামান্নাকে মাথা নিচু করে থাকতে দেখে চিনতে পারলেন না। তন্ময়কে বললেন, আয় বাবা, আমার কাছে আয়। তোকে আজ দু’আড়াই মাস দেখি নি।
তন্ময় মা বলে ডেকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল।
ফিরোজা বেগম ছেলের পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, আল্লাহপাকের দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া জানাই, তিনি আবার তোকে দেখালেন।
চোখের ডাক্তার ওনার চোখে পানি দেখে বললেন, এখন কান্নাকাটি করবেন না। চোখের ক্ষতি হবে।
ফিরোজা বেগম ছেলেকে পাশে বসিয়ে বললেন, কোথায় নার্স মুর্শিদা? তাকে দেখছি না কেন? সে নার্স হলেও পেটের মেয়ের থেকে বেশি আমার সেবাযত্ন করেছে। কেউ কিছু বলছে না দেখে ফিরোজা বেগম আবার বললেন, আপনারা চুপ করে আছেন কেন?
ডাঃ রহিম তামান্নার হাত ধরে বেডের কাছে এসে বলল, এই তো মুর্শিদা। আপনি তো এতদিন একে দেখেন নি, তাই চিনতে পারছেন না।
ফিরোজা বেগম মুখ দেখে চিনতে পেরে কয়েক সেকেন্ড নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এইতো সেই মুর্শিদা। কিন্তু বলে তার মাথার নার্সের টুপি খুলে দিয়ে বললেন, এতদিন চোখে দেখতে পাইনি বলে তোমাকে চিনতে না পারলেও তোমার গলা শুনে ঠিকই বুঝেছিলাম, তুমি তামান্না। বৌ হয়ে আমার সেবা করতে পারনি বলে নার্স হয়ে করেছ।
তামান্না শাশুড়ীর দু’পা জড়িয়ে ধরে দরবিগলিত চোখে বলল, আমাকে মাফ করে দিয়ে চিরকালের জন্যে এই পবিত্র কদমের সেবা করার সুযোগ দিন মা। জানি, আমি অপবিত্র। আল্লাহপাক যখন অপবিত্রকে পবিত্র করার পন্থা রেখেছেন তখন আপনি মা হয়ে আমাকে পবিত্র করে নিন। আমি যদি আপনার পেটের মেয়ে হতাম। তা হলেও কি পবিত্র করার চেষ্টা করতেন না? আর তা যদি না পারেন, তা হলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলুন। তবু আপনার এই পবিত্র কদম ছাড়ব না। আমি যে আর অপবিত্রতার জ্বালা সহ্য করতে পারছি না মা। এই সব কথা বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
তন্ময় যেদিন তামান্নাকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে এসেছিল সেদিন চলে যাওয়ার আগে তামান্না যে সব কথা ফিরোজা বেগমকে বলেছিল, সে কথা দীর্ঘদিন অসুখের সময় শুয়ে শুয়ে অনেক চিন্তা করেছেন। তখন ভেবেছিলেন, তামান্নার কথাগুলো ঠিক। সে কথা ভেবে তার প্রতি করুণা হয়েছিল। নিজেকে নিজে বলেছিলেন, তাকে ঐভাবে তাড়িয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। ওনার প্রায় মনে হয়, তামান্নাকে ঐভাবে তাড়িয়ে দেয়ার ফলে আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে এই অসুখ দিয়েছেন। তারপর মুর্শিদা নার্সের সেবা যত্নে তুষ্ট হয়ে এবং তাকে তামান্না বলে সন্দেহ করে ভেবেছিলেন, এই মেয়ে যদি সত্যি সত্যি তামান্না হত, তা হলে সেদিনের দুর্বব্যবহারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতাম। এখন তামান্নাকে চিনতে পেরে এবং তার কথা শুনে আরো বেশি অনুশোচনা হল। ভাবলেন, তন্ময়ের কথাই ঠিক। “তামান্নার মতো মেয়েই পারবে তোমাকে ও আমাকে সুখী করতে।”
ফিরোজা বেগম আর কিছু বলছেন না দেখে ডাক্তার রহিম ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৌমাকে ক্ষমা করে দিয়ে গ্রহণ করুণ ভাবি। তন্ময় আমাকে সব কথা বলেছে। আমি তো মনে করি, তন্ময় একটা মহৎ কাজ করেছে। আমরা যদি অপরাধীকে ক্ষমা করে কোলে তুলে না নেই, তা হলে সে কোনো দিন আলোর পথ দেখতে পাবে না। আপনি ওকে কোলে তুলে নিন ভাবি।
চোখের ডাক্তার বললেন, ডাঃ রহিম অতি সত্য কথা বলেছেন। আমিও ওদের ব্যাপারটা শুনেছি। শুনে তন্ময় সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছি। আপনি বৌমাকে গ্রহণ করুন।
ফিরোজা বেগম আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তামান্নার হাত ধরে তুলে দু’গালে ও কপালে চুমো খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আমাকে মাফ করে দাও বৌমা। সেদিন আমি তোমাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়ে যে অপরাধ করেছি, তা তুমি না মাফ করলে আল্লাহ করবেন না।
তামান্না শাশুড়ীর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, এই কথা বলে আমাকে গোনাহগার করবেন না। আমাকে যে আপনার পবিত্র কদমে ঠাঁই দিলেন, তাতেই এই পাপী বান্দী ধন্য হয়ে গেলাম। তারপর প্রথমে ফিরোজা বেগমকে ও ডাক্তার দু’জনকে এবং শেষে তন্ময়কে কদমবুসি করে বলল, আপনারা সবাই আমাকে দোয়া করুন, আমি যেন আল্লাহর একজন খাঁটি বান্দী হয়ে সংসারের সকলকে সুখী করতে পারি।
ফিরোজা বেগম ও ডাক্তাররা একসঙ্গে বলে উঠলেন, আল্লাহ তোমার মনের কামনা বাসনা পূরণ করুক।
তারপর ফিরোজা বেগম ছেলে বৌকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোদের দু’জনের প্রতি দু’জনের ভালবাসা আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে। দো’য়া করি, আল্লাহ যেন তোদের সেই ভালবাসা আমরণ অক্ষয় রাখেন।
সেদিন বাড়িতে ফিরে ফিরোজা বেগম ছেলেকে বললেন, আমি দু’এক দিনের মধ্যে তোদের বিয়ের একটা ফাংসান করতে চাই। তুই সেই ব্যবস্থা কর। ঐদিন বৌমাকে আমি নিজের হাতে সাজাব।
তন্ময় তিন দিন পর ফাংসানের ব্যবস্থা করল। আজ ফাংসানের দিন! ফিরোজা বেগম খুব ধুম-ধামের সঙ্গে ফাংসানের আয়োজন করছেন। এক সময় সমস্ত লোকজন খাওয়া-দাওয়া করে চলে গেল।
এখন রাত গভীর। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। শুধু তন্ময় ও তামান্না জেগে আছে। ফিরোজা বেগম নিজের সমস্ত গহনা তামান্নাকে পরিয়ে সাজিয়েছেন। রূপসী তামান্নার রূপ আরো ঝলসে উঠেছে। তাই দেখে তন্ময় তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল, দেখ তো আয়নার মেয়েটা কত সুন্দরী। আমার তো মনে হচ্ছে, মেয়েটা বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।
তামান্না আয়নার দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে গেল। সত্যি তাকে অত্যন্ত সুন্দরী দেখাচ্ছে। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তন্ময়কে কদমবুসি করে বলল, মেয়েটি যতই সুন্দরী হোক না কেন, তার চেয়ে লক্ষগুণ বেশি আমি ভালবাসি তোমাকেই। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আয়নার ছেলেটা মেয়েটির চেয়ে আরো বেশি সুন্দর।
তন্ময় তামান্নাকে বুকের সঙ্গে আরো জোরে চেপে ধরে বলল, ছেলেটা যতই সুন্দর হোক না কেন, তার চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি আমি ভালবাসি তোমাকেই।
***
Just wow. Such a beautiful Romantic story ❤️❤️
Nice Story.