৫
এই কয়েকদিন তন্ময় অফিসের কাজে মন বসাতে পারেনি। কেবলই ভাবছে, তামান্নাকে কোন কথা জিজ্ঞেস করলে কান্নাকাটি করছে কেন? রাতে ঘুমায় না কেন? আজ আসার সময় ডাক্তারকে পাঠিয়েছি। তিনি পরীক্ষা করে কি বললেন, সেইসব কথা চিন্তা করে অফিসে বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। সময়ের আগেই বাসায় ফিরল।
ফিরোজা বেগম ছেলেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, এত তাড়াতাড়ি ফিরলি যে?
তন্ময় বলল, না, এমনি ভালো লাগছিল না বলে চলে এলাম।
ফিরোজা বেগম বললেন, ভালো করেছিস। ডাক্তার ভাই এসেছিলেন। বললেন, বৌমার কিছু হয় নি। চাচা চাচির জন্য একটু টেনসন ফিল করছে। তুই এক কাজ কর, আজ বৌমাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যা। সবাইকে দেখিয়ে নিয়ে আয়। আর বৌমা যদি কয়েকদিন থাকতে চায়, রেখে আসবি। বৌমা আলাদা ঘরে থাকে কেন, সে কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরলে করবেন ভেবে রাখলেন।
তন্ময় মায়ের কথা শুনে বলল, ঠিক আছে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর উপরে এসে কাপড় পাল্টে বারান্দায় চেয়ারে বসে একটা পত্রিকার পাতা উল্টাতে লাগল।
তামান্না এক কাপ কফি ও কিছু হাল্কা নাস্তা নিয়ে এসে টেবিলের উপর রেখে খেতে বলল।
তন্ময়ের কিছু খেতে ইচ্ছা করিছল না। তবু তামান্নার দিকে এক পলক তাকিয়ে কফির কাপটা নিয়ে চুমুক দিল।
তামান্না বলল, আপনি চলে যাওয়ার পর মা হঠাৎ উপরে এসেছিলেন। আমি তখন ঐরুমে ছিলাম। আমাদের আলাদা থাকার ব্যাপারটা মা জেনে গেছেন।
তন্ময় চমকে উঠে বলল, তাই নাকি?
তামান্না বলল, জি। মা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন, আমি কোনোটারই উত্তর দেই নি। শেষে উনি বললেন, আপনাকে জিজ্ঞেস করবেন।
তন্ময় কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে বলল, তুমি এখানে থাক, আমি আম্মার কাছ থেকে আসছি।
ফিরোজা বেগম আসরের নামাযের আযানের অপেক্ষায় নামায পাটীতে বসে তসবীহ পড়ছিলেন। ছেলেকে দেখে তসবীহতে চুমো খেয়ে হাতের মধ্যে রেখে বললেন, কিরে, কিছু বলবি?
তন্ময় বলল, হ্যাঁ, দু’একটা কথা বলব।
ফিরোজা বেগম বললেন, বেশ তো বল।
তন্ময় মায়ের কাছে বসতে এলে ফিরোজা বেগম বললেন, তুইতো পেশাব করে পানি নিস না, একটু তফাতে বস।
তন্ময় বলল, তোমার সবটাতে বাড়াবাড়ি। আমি পেশাব করে পানি নিইনি তুমি জানলে কি করে?
ফিরোজা বেগম বললেন, নিলে ভালো। যারা নামায পড়ে না তারা পাক নাপাকের দিকে লক্ষ্য করে না। তোকে কতবার নামায পড়ার কথা বলি, তবু পড়িস না। নামাযের গুরুত্ব যদি বুঝতিস তা হলে পড়তিস। ঐ সোফায় বস।
তন্ময় সোফায় না বসে একটু দূরত্ব রেখে মেঝেয় কাপের্টের উপর বসে বলল, আমি তোমার কাছে একটা অন্যায় করেছি, আমাকে মাফ করে দেবে বল।
ছেলে কি বলবে বুঝতে না পেরে ফিরোজা বেগম বললেন, মানুষ মাত্রই দোষগুণ থাকে, বল কি করেছিস?
তন্ময় বলল, তোমার অসুখের সময় ডাক্তারের পরামর্শ মতো তামান্নাকে বিয়ে না করে তোমার বৌমা বলে পরিচয় দিই। অবশ্য তার বড় ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছে, তুমি সুস্থ হয়ে গেলেই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব। তাই আমরা প্রথম দিন থেকে আলাদা রুমে থাকি। তুমি তো এখন সুস্থ হয়ে গেছ, ওকে ওর চাচার বাসায় রেখে আসি। তুমি গিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে আসবে।
সুস্থ হওয়ার পর থেকে ফিরোজা বেগমের বৌমার সঙ্গে ছেলের আচরণ দেখে কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। তখন ভেবেছিলেন, নতুন বলে হয়তো এরকম করছে। আজ উপরে গিয়ে সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। এখন ছেলের কথা শুনে যেমন খুব অবাক হলেন, তেমনি রেগে গেলেন। বললেন, এ তুই কি সর্বনাশ খেলা খেলেছিস? আমার পেটের ছেলে হয়ে এতবড় অন্যায় কাজ করতে পারলি? এ যে কত বড় গোনাহ, তা তুই যদি জানতিস, তা হলে করতে পারতিস না। তুই তো নামায রোযা করিস না, আর ধর্মীয় বই পুস্তকও পড়িস না। পড়লে বুঝতিস কি জঘন্য অপরাধ করেছিস। ছেলে বলে তোকে না হয় আমি মাফ করে দিলাম; কিন্তু আল্লাহ কি তোকে তওবা ছাড়া মাফ করবে? তুই তওবা করে আল্লাহর কাছে মাফ চা। তাঁর আইন অমান্য করে যা করেছিস, তা আর কেউ কোনো দিন করে নি।
তন্ময় বলল, আমি নিজের জন্য কিছু করিনি। তোমাকে বাঁচাবার জন্য করেছি। তোমার মুখেই শুনেছি, আল্লাহ অত্যন্ত দয়ালু। এতে যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, তিনি নিশ্চয় মাফ করবেন। আমি তো এই মেয়েকে বিয়ে করব, তবু গোনাহ হবে?
ফিরোজা বেগম বললেন, হ্যাঁ হবে। জেনে রাখিস, আল্লাহপাক অত্যন্ত দয়ালু বলে মানুষ শতশত কঠিন অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। তিনি কালামপাকে বলিয়াছেন, “আমি যদি রাহমানুর রহিম না হতাম, তা হলে কোনো নাফরমান বান্দা একটা নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশ পেত না।” [সূরা কাহাফ, ১৫ পারা, আয়াত-৫৮] তিনি প্রত্যেক বান্দাকে সময় সুযোগ দেন, গোনাহ মাফ চাওয়ার জন্য। যে বদনসীব হয়, সে মাফ না চেয়ে মারা যায়। যাক, ওসব নিয়ে পরে মাথা ঘামাস, এখন ওকে ওর চাচার বাসায় দিয়ে আয়। আর ওদেরকে বলে আসবি, আমি কাল পরশু গিয়ে দিন ঠিক করে আসব।
তন্ময় বলল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি মা। তারপর উপরে এসে তামান্নাকে মায়ের কথা বলে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে বলল।
তামান্নার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে কি করবে না করবে ভাবতে লাগল। এক মন বলল, ফ্যানের সাথে শাড়ি পেঁচিয়ে গলায় দিয়ে ঝুলে পড়। আর এক মন বলল, সাহেব তোকে খুব ভালবাসে। তাকে তোর পরিচয় দিয়ে দেখ সাহেব কি করে। আর তা না হলে তোকে সেই পাপপুরীতে ফিরে যেতে হবে। এতদিন ফিরোজা বেগমের সঙ্গে নামায পড়ে এবং তার কাছে ধর্মের কথা শুনে তার মনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আত্মহত্যা করতে তার মন কিছুতেই সায় দিল না। সেই পাপপুরীতে ফিরে যেতেও সায় দিল না। ভেবে ঠিক করল, সাহেবের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যাক। যেতে যেতে বুদ্ধি করে সাহেবের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় নেমে কোথাও পালিয়ে যাবে। তারপর ভাগ্যে যা আছে তা হবে। তন্ময় তাকে মাঝে মাঝে কিছু টাকা দিত। তৈরি হয়ে সেগুলো নিল। তারপর তাড়াতাড়ি করে একটা চিঠি লিখল।
সাহেব,
আপনার ভালবাসা ও আপনার মায়ের স্নেহ মমতা ও মহানুভবতার কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। সে জন্যে আপনাদের কাছে শুধু কৃতজ্ঞতা জানান ছাড়া আমার আর কিছু নেই। এ যুগেও আপনাদের মতো যে মানুষ আছে, তা প্রত্যক্ষ না করলে বিশ্বাস করতাম না। আমি এক ভাগ্যবিড়ম্বিত মেয়ে। সবকিছু থেকেও আমার কিছু নেই। তাই ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে চলে যাচ্ছি। যদিও জানি এভাবে চলে যাওয়া খুব বড় অন্যায়, তবু ভাগ্যের ফেরে চলে যেতে বাধ্য হলাম। আপনারা যা কিছু দিতে চান, তা নেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমার অপরাধ ক্ষমাহীন। তবু আপনাদের ভালবাসা ও স্নেহমমতার কাছে ক্ষমা চাইছি। পারলে ক্ষমা করবেন। একটা ভালো মেয়ে দেখে অতি শিঘ্রী বিয়ে করবেন। নচেৎ আপনার মা আবার কঠিন অসুখে পড়ে যাবেন। আমার কথা কখনো মনে স্থান দেবেন না। আপনি একদিন আপনার ভালবাসার কসম দিয়ে আমাকে কিছু বলেছিলেন। আজ আমিও আমার ভালবাসার কসম দিয়ে বলছি, আমাকে চিরতরে ভুলে যান।
ইতি
.
লেখা শেষ করে চিঠিটা বুকের কাছে ব্লাউজের ভিতরে রাখল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলল, চলুন।
তন্ময় তৈরি হয়ে এতক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে সঙ্গে করে নিচে নেমে এল।
তামান্না ফিরোজা বেগমকে কদমবুসি করতে তিনি মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, তোমার চাচা চাচিকে বলো, আমি দু’একদিনের মধ্যে আসছি।
গাড়িতে উঠে তন্ময় বলল, বাসার ঠিকানা বল।
তামান্না ততক্ষণ বুদ্ধি এঁটে ফেলেছে। বলল, গুলিস্তান সিনেমার কাছে চলুন। সেখানে আমার একটা চাচাতো ভাই কাজ করে। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় যাব।
গাড়ি যখন গুলিস্তান সিনেমার কাছে এল তখন তামান্না বলল, পশ্চিম দিকের রাস্তায় পার্ক করুন। পার্ক করার পর বলল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি ওকে ডেকে নিয়ে আসি।
তন্ময় গাড়ির দরজা খুলে দেয়ার সময় বলল, আমিও সঙ্গে যাই না?
তামান্না বলল, না না, আপনাকে আর আসতে হবে না। তারপর গাড়ি থেকে নেমে গুলিস্তান সিনেমার গেট দিয়ে ঢুকে গেল।
তামান্না যে শাড়ি ব্লাউজ পরে হোটেলে এসে ছিল, সেগুলো নিজের সাইড ব্যাগে করে এনেছিল। ব্যাগটা তার কাঁধে ঝুলান ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সোজা সিনেমার লেডিজ বাথরুমে ঢুকে নিজের জামা কাপড় পরে গহনাগুলো খুলে কাপড়ের সাথে জড়িয়ে ব্যাগে ভরে নিল। তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে যাকে দেখল, তাকে দেখে ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সামলে নিয়ে কোনো রকমে বলল, খালাম্মা কেমন আছেন?
খালা গম্ভীর গলায় বলল, ভালো। তা নাগরকে ছেড়ে পালাচ্ছ কোথায়? ভেবেছ, নাগরের কাছ থেকে মোটা টাকা কামিয়ে আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবে। আরে বাবা, আমি কি এতই বোকা, তোমাকে এক নাগরের সঙ্গে অন্য নাগরের কাছে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে থাকব? তোমার সেই মজাহার নাগর তো কাতারে উড়াল দিছে। এখন তুমিও উড়াল দেয়ার পাঁয়তারা করেছিলে। আমি এত কাঁচা কাজ করিনে। মজাহারের খবর পাওয়ার পর থেকেই তোমার উপর আমার লোক নজর রেখেছে। তারপর তাকে রিকসায় তুলে নিয়ে চলে গেল। বাসায় এসে বলল, এবার বের কর নতুন নাগরের কাছ থেকে কত টাকা বাগিয়েছিস।
তামান্না বলল, টাকা পয়সার ব্যাপারে মজাহার তো আপনার সংগে চুক্তি মতো মিটিয়ে দিয়েছে।
খালা বলল, তাতো মিটিয়েছে। তুই নতুন নাগরের কাছ থেকে টাকা পয়সা, সোনাদানা বাগাস নি?
তামান্না উপায়ন্তর না দেখে ব্যাগটা খালার হাতে দিয়ে বলল, যা এনেছি এতে আছে।
খালা ব্যাগটা খুলে জামা কাপড়ের সঙ্গে টাকা ও সোনার গহনাগুলো দেখে বেশ আনন্দিত হল। তবু গালে ঠোনা মেরে বলল, মাগী এতদিন ধনী নাগরের ঘর করে এলি আরো বেশি বাগাতে পারলি না? তোর রূপ যৌবন কাজে লাগাতে পারলি না? নে এবার খদ্দেরের জন্য তৈরি হ?
তামান্না বলল, খালা, আমি আর এই পাপ কাজ করব না। তাতে আমার কপালে যা আছে তাই হবে।
খালা গর্জে উঠল, মাগীর কথা শোন, নতুন নাগরের কাছে বুঝি সেই রকম ওয়াদা করে এসেছিস? তা সে রোজ আসবে তো? এলে মোটা রোজগার করে আমার হাতে দিবি। মনে রাখিস তা যদি না পারিস, তা হলে তোর কি অবস্থা হবে তখন বুঝবি। তারপর গজর গজর করতে করতে চলে গেল।
.
এদিকে তন্ময় অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলল। এক সময় গাড়ি থেকে নেমে সিনেমা হলের নিচে ও উপরে অনেক খোঁজা-খুঁজি করল। কিন্তু কোথাও পেল না। শেষে গাড়ির কাছে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল। যখন বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠতে গেল তখন পিছনের সিটে একটা ভাঁজ করা কাগজ দেখতে পেল। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিয়ে পড়ে খুব অবাক হল। সেই সঙ্গে মনে খুব আঘাতও পেল। চিন্তা করল, তা হলে সে কি একটা কলগার্ল? না আরো খারাপ মেয়ে? চিঠিটা আরো কয়েকবার পড়ে তার মনে হল, মেয়েটাকে মজাহার রোজগারের টোপ হিসাবে ব্যবহার করছে। মেয়েটা ঐ দুষ্ট লোকের জালে স্বীকার হয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। চেষ্টা করেও সেই জাল থেকে বের হতে পারছে না। গাড়িতে বসে আরো কিছুক্ষণ এই সব চিন্তা করল। তারপর রাত নটার দিকে বাসায় ফিরল।
ফিরোজা বেগম ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে চিন্তায় ছিলেন। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত দেরি হল কেন? তারপর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাস্তায় কোনো বিপদ হয়নি তো?
তন্ময় কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর সামলে নিয়ে বলল, না মা কোনো বিপদ হয়নি।
তা হলে তোর মুখের অবস্থা ও রকম কেন? মেয়ের চাচা চাচির সঙ্গে কোনো গোলমাল হয়েছে?
না তাও হয়নি।
তা হলে কি হয়েছে বলবি তো?
তন্ময় চিঠির কথা না বলে শুধু তামান্নার চলে যাওয়ার কথা বলল। ফিরোজা বেগম যেমন খুব আশ্চর্য হলেন তেমনি আতঙ্কিতও হলেন। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বললেন, মনে হয় কেউ ওকে কিডন্যাপ করেছে। তুই থানার সাহায্য নিলি না কেন?
আমার সে কথা তখন খেয়াল হয় নি। তা ছাড়া এ ব্যাপারে থানায় জানান কি ঠিক হবে?
থানায় না জানালে তুই তাকে খুঁজে বের করবি কি করে?
ভেবে দেখি কাল সকালে যা করার করা যাবে। তারপর নিজের রুমে চলে গেল।
সে দিন তন্ময় সারারাত ঘুমাতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই তামান্নার ছবি ভেসে উঠে। প্রতিজ্ঞা করল, যেমন করে হোক ওকে খুঁজে বের করতেই হবে। দুষ্ট লোকের বেড়াজাল থেকে বের করে এনে বিয়ে করবে। তা যদি করতে না পারে, তা হলে সারাজীবন বিয়েই করবে না।
পরের দিন অফিসে গিয়ে এজাজকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, মজাহার আপনার ক্লাশমেট ও বন্ধু ছিল। তার চরিত্র, আই মিন সে কি ধরনের ছেলে বলতে পারেন?
এজাজ বলল, সে সময় তাকে ভালো বলে জানতাম। তার চারিত্রিক কোনো দোষ দেখিনি। তবে কয়েকদিন আগে বন্ধুদের কাছ থেকে তার চরিত্রের অবনতির কথা শুনেছি। কেন স্যার, সে কি আপনার সঙ্গে তেমন কিছু করেছে।
সে কথা থাক। আপনি এখন আসুন।
এজাজ চলে যাওয়ার পর তন্ময় থানায় যাওয়ার কথা চিন্তা করে দেখল, ও. সি. যখন তামান্নার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক এবং তার চাচা চাচির নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে তখন কি বলবে? তামান্নার ফটোও চাইতে পারে। তার চাচাতো ভাই মজাহার টাকা নিয়ে তামান্নাকে তাদের বাড়িতে বৌ সাজিয়ে পাঠিয়েছে, তাও বলা যাবে না। মজাহারের দেশের বাড়ির ঠিকানাও জানা নেই। সেও এখন বিদেশে। এইসব সাত পাঁচ ভেবে তন্ময় থানায় গেল না।
অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলে ফিরোজা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, থানায় গিয়েছিলি?
তন্ময় বলল, না। তারপর থানায় জানাতে গেলে যে সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, সেগুলো বলল। মাকে চিন্তা করতে দেখে আবার বলল, তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমি নিজেই তার খোঁজ করব।
ফিরোজা বেগম বললেন, যদি কেউ কিডন্যাপই করে থাকে, তা হলে তুই কি তাকে খুঁজে পাবি? যদিও পাস অথবা সে যদি নিজে ফিরে আসে, তখন কি আমরা তাকে গ্রহণ করতে পারব?
তন্ময় মায়ের কথা শুনে খুব চিন্তিত হল। বলল, তবু আমি তাকে খুঁজে বের করব। তারপর যা করার ভেবে চিন্তে করা যাবে।
ফিরোজা বেগম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেশ, তুই যা ভালো বুঝিস কর।
এরপর থেকে তন্ময় শহরের রাস্তায় রাস্তায় অলিতে গলিতে খুঁজে বেড়াতে লাগল। যেখানে যায় সেখানেই সন্ধানী দৃষ্টিতে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখে। এভাবে পাঁচ ছ মাস কেটে গেল।
একদিন ফিরোজা বেগম ছেলেকে বললেন, আর কতদিন তাকে খুঁজবি? আমার মনে হয় তাকে আর পাওয়া যাবে না। যারা তাকে কিডন্যাপ করেছিল, তারা তাদের মতলব হাসিল করে মেরে ফেলেছে। তুই তার কথা ভুলে যা। আমি অন্য মেয়ের সঙ্গে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করি।
তন্ময় বলল, না মা তা হয় না। তাকে আমি বিয়ে করব বলে কথা দিয়ে তোমাকে বাঁচাবার জন্য এনেছিলাম। তাকে আমি স্টাডি করে দেখেছি, তার মতো মেয়েই এতদিন খুঁজেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে তোমাকে ও আমাকে সুখী করতে পারবে।
ফিরোজা বেগম বললেন, আমারও তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু এতদিনেও যখন তার খোঁজ পাওয়া গেল না তখন……।
তন্ময় মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি এতদিনের কথা কি বলছ মা, তাকে আমি সারাজীবন ধরে খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। দেখে নিও একদিন না একদিন খুঁজে বের করে বিয়ে করে নিয়ে আসবই।
তামান্নার প্রতি ছেলের ভালবাসা দেখে আর কিছু বললেন না।