ভালোবাসি তোমাকেই – ১

কেন তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না আজ তোকে বলতেই হবে।

তন্ময়ের খাওয়া ঘেঁষ হয়েছে। বেসিন থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে তোয়ালেতে মুছতে মুছতে বলল, তুমি খাওয়া শেষ কর বলছি।

ফিরোজা বেগম খাওয়া শেষ করে আয়াকে একটা বড় এলাচ দিতে বলে ছেলেকে সাথে করে ডাইনিংরুম থেকে বেডরুমে এলেন। তারপর নিজে একটা সোফায় বসে তাকেও বসতে বললেন। তন্ময় বসার পর বললেন, এবার বল।

তন্ময় বলল, দেখ মা, আমি তোমার ছেলে। আমার সবকিছু তুমি জান। কিন্তু আমার বিয়ে দিয়ে যে মেয়েকে আনবে, তার স্বভাব-চরিত্র, মন-মেজাজ তো জানবে না। সে যদি কোনো ব্যাপারে তোমার মনে কষ্ট দেয় তখন কি হবে?

ফিরোজা বেগম হেসে উঠে বললেন, পাগল ছেলের কথা শোন, তা বলে তুই বিয়ে করবি না?

কিন্তু তোমার মনে কষ্ট দিলে আমি সহ্য করতে পারব না। হয়তো রেগে গিয়ে মারধর করব। তখন কেলেঙ্কারীর শেষ থাকবে না।

অবুঝের মতো কথা বলছিস কেন? সারা দুনিয়াতে কি তা হলে ছেলেরা বিয়ে করে না। তুই যদি ঠিক থাকিস, তা হলে বৌমা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে না। যে ছেলে বৌকে বেশি লাই’ দেয়, সেই বৌ শ্বশুরবাড়ির কাউকে সহ্য করে না। তোকে যেভাবে মানুষ করেছি, তুই তোর বৌকে ভালবাসলেও বেশি যে লাই দিবি না, সে বিশ্বাস আমার আছে। তা ছাড়া সংসারে অশান্তির মূল হল অর্থাভাব। সেটা যখন আমাদের নেই তখন কোনো ব্যাপারে বৌমা আমার সাথে এমন ব্যবহার করবে না, যা আমার মনে কষ্টের কারণ হতে পারে।

তবু কিন্তু অনেক কথা থেকে যাচ্ছে।

যত কথাই থাক, আমি তোর বিয়ে দেবই এবং সেটা যথাসম্ভব শিঘ্রী। আর কত দিন একা একা থাকব? বৌমা এলে তবু তার সাথে গল্প করে সময় কাটাব। নাতি নাতনি হলে তাদেরকে নিয়ে খেলা করব। তা ছাড়া কত দিনই বা তোকে আমি দেখাশোনা করব? তোরও তো একটা সঙ্গি দরকার। তোর বাবা যে ব্যবসা রেখে গেছে, তাকে তুই আরো বড় করেছিস। এসব ভোগ করবে কে? তুই বাদে এই বংশ রক্ষা হবে কি করে? তোর কোনো কথাই শুনব না। পেপারে একটা বিজ্ঞপ্তী দেখলাম, এক ব্যবসায়ীর এম. এ. পড়ুয়া সুন্দরী মেয়ের জন্য ব্যবসায়ী পাত্র চেয়েছে। আমি ঐ ঠিকানায় চিঠি দিয়ে তাদেরকে যোগাযোগ করতে বলেছি। সেই সাথে মেয়ের একটা ফটো চেয়ে পাঠিয়েছি।

এটা তুমি ঠিক করোনি মা। আমি ভেবে ঠিক করেছি বিয়ে করব না।

ফিরোজা বেগম একটু রাগের সঙ্গে বললেন, বৌ আমার মনে কষ্ট দেবে বলে তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস না; কিন্তু বিয়ে না করলে আমার মনে যে আরো বেশি কষ্ট হবে, সে কথা ভেবেছিস?

তন্ময় মাকে খুশী করার জন্য উঠে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি নাকি তোমার বাবার মতো হয়েছি। তুমি প্রায় আমাকে বাবা বলে ডাক। তা হলে তুমি তো আমার মেয়ে। মেয়ের কতর্ব্য, বাবার হুকুম মেনে চলা।

ফিরোজা বেগম বললেন, বাবাকে মেয়ের কথাও শুনতে হয়। তারপর তাকে পাশে বসিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তুই অমত করিস নি। দেখি, ওখান থেকে কি উত্তর আসে। তারপর মেয়ে পছন্দ হলে যা করার করা যাবে।

আচ্ছা মা, আমি কি তোমাকে কোনো রকম কষ্টে রেখেছি?

না রাখিস নি।

তা হলে একটা উটকো ঝামেলা করতে চাচ্ছ কেন?

ঘরে বৌ আনা উটকো ঝামেলা, একথা তোকে কে বলল?

কেউ বলে নি। আমি জানি, ঘরে বৌ এলেই নানান রকম অশান্তির সৃষ্টি হয়। তার চেয়ে এই মা- ছেলে বেশ সুখে শান্তিতে রয়েছি। সেই সুখ শান্তি বাইরের একটা মেয়ে এসে নষ্ট করুক তা আমি চাই না।

তুই কি তা হলে সারাজীবন বিয়েই করবি না?

তন্ময়ের মুখ থেকে হঠাৎ করে বেরিয়ে গেল, যতদিন তুমি বেঁচে আছ অন্তত ততদিন করব না।

ফিরোজা বেগম চমকে উঠে অশ্রুসজল নয়নে বললেন, তা হলে তুই আমার শিঘ্রী মৃত্যু কামনা করিস?

তন্ময় হঠাৎ কথাটা বলে ফেলে নিজের ভুল বুঝতে পারল। মেঝেয় বসে মায়ের দুটো পা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ভিজে গলায় বলল, কথাটা হঠাৎ করে বলে ফেলেছি। তা ছাড়া ঐ উদ্দেশ্যেও বলি নি। তবু আমার অন্যায় হয়েছে। আমাকে মাফ করে দাও মা। তোমার মৃত্যু চিন্তা করার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়।

ফিরোজা বেগম বুঝতে পারলেন, ছেলে এমনি কথা প্রসঙ্গে হঠাৎ করে বলে ফেলেছে। তার মাথায় ও মুখে চুমো খেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার আগে তোর মৃত্যু হবে, একথা আর কখনো বলবি না। তোর কিছু হলে বাঁচব কাকে নিয়ে। তারপর বললেন, যা এবার তোর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।

তন্ময় মুখ মুছতে মুছতে চলে গেল।

.

তন্ময়ের বাবা মতিন সাহেব কিশোরগঞ্জের লোক। ওনারা দু’ভাই। বড় ভাই রাফাত দেশে থাকেন। ওনাদের বাবা যখন মারা যান তখন মতিন ঢাকা ভার্সিটিতে মাস্টার ডিগ্রীতে পড়ত। মাস্টার ডিগ্রী পাশ করে মতিন দেশে গিয়ে একদিন মাকে বলল, তুমি ভাইয়াকে বল, আমি ব্যবসা করব।

মতিনের মা আসিয়া খাতুন বললেন, ব্যবসা করিব ভালো কথা। আমি রাফাতকে বলবখন।

রাফাত বেশি লেখাপড়া করেনি। সে বাবার সঙ্গে চাষবাস করত। বাবার মৃত্যুর পর তাই-ই করে। রাতে খাবার সময় আসিয়া খাতুন রাফাতকে মতিনের ইচ্ছার কথা বললেন।

রাফাত ছোট ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কি ব্যবসা করতে চাস? দেশ গাঁয়ে ব্যবসা করে কি উন্নতি করতে পারবি? তারচেয়ে চাকরির চেষ্টা কর।

মতিন বলল, আমি গ্রামে ব্যবসা করব না, ঢাকায় করব।

ঢাকায় ব্যবসা করতে তো অনেক টাকা লাগবে। বাবা তো অত টাকা নগদ রেখে যান নি।

বাবা নগদ টানা না রেখে গেলেও জমি জায়গা অনেক রেখে গেছে। তুমি জমি বেচে হাজার পঞ্চাশেক টাকা দাও।

তোকে ঐ পরিমাণ টাকা দিতে হলে বাবার অর্দ্ধেক জমি বিক্রি করতে হবে।

তাতে কি হয়েছে? করতে হয় করবে।

বাবা মাত্র দু’বছর হল মারা গেছেন। জমি বেচলে লোকে কি বলবে। এমনি তোকে পড়াতে গিয়ে কিছু বেচতে হয়েছে। এখন আবার এত জমি একসঙ্গে বেচতে আমার সাহস হচ্ছে না। তার চেয়ে যা বললাম তাই কর। কোনো বড় অফিসে বা ব্যাংকে চাকরির চেষ্টা কর।

বললাম না, চাকরি করব না। চাকরি করে কেউ কোনো দিন উন্নতি করতে পারে না; তা সে যত বড় চাকরি হোক না কেন? আর যারা উন্নতি করে, তারা ঘুষ খায় এবং অন্যান্য অনেক রকম অসৎ উপায়ে টাকা রোজগার করে। আমার এক ফ্রেন্ডের মুখে শুনেছি, তার বাবা সরকারি অফিসে এক বিরাট পোস্টে আছেন। বেতনও অনেক। কিন্তু ফ্রেন্ডটা বলল, বাবার বেতনের টাকায় আমাদের সংসার পনের দিনও চলে না। তার বাবা ঘুষ খেয়ে এবং সরকারকে ফাঁকি দিয়ে টাকা মেরে গাড়ি বাড়ি করছে। তা ছাড়া আজকাল চাকরি পাওয়াও খুব দুষ্কর। কত যে ধরাধরি করতে হয়, কত টাকা পয়সা ঘুষ দিতে হয়, সে খবর জানলে চাকরির কথা বলতে না। জমি বেচে টাকা দিতে তুমি দ্বিধা করছ কেন?

কেন করছি তা তুই বুঝবি না। লেখাপড়া করে শিক্ষিত হয়েছিস ঠিক কথা কিন্তু বৈষয়িক ও সাংসারিক ব্যাপারে কিছুই জানিস না। ধর, তোকে জমি বেচে টাকাটা দিলাম। আল্লাহ না করুক, তুই যদি ব্যবসায় ফেল করে দেশে ফিরে আসিস তখন কি হবে?

তখনকার কথা ভেবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব নাকি?

আমি তোকে বসে থাকতে বলছি না। এত ছেলে পাশ করে চাকরি পাচ্ছে,

তুই পাবি না কেন?

দেখ ভাইয়া, বার বার চাকরির কথা বলো না। চাকরির উপর আমার ভীষণ বিতৃষ্ণা। তুমি জমি বেচে টাকা দেবে কিনা বল।

রাফাত খুব বৈষয়িক। ছোট ভাইয়ের কথা শুনে চিন্তা করতে লাগল, শেষ মেস যদি জমি বেচে টাকা দিতে হয়, তা হলে ওর অংশমতো বেচে দেবে।

বড় ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে আসিয়া খাতুন বললেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন?

রাফাত বলল, তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নেই। চিন্তা করে দেখি কি করা যায়। তারপর সে উঠে নিজের রুমে চলে গেল।

রাফাতের স্ত্রী নাবিলাহ ছোট দেওরের উপর তত সন্তুষ্ট নয়। নাবিলাহ হিংসুটে ধরনের মেয়ে। শাশুড়ীকেও সে সুনজরে দেখে না। কারণ তার স্বামী তার মাকে অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করে। মায়ের অনুমতি না নিয়ে কোনো কাজ করে না। মায়ের কথায় উঠা বসা করে।

আসিয়া খাতুন বৌয়ের সবকিছু ঝুঝতে পেরেও তাকে কিছু বলেন না। তিনি মনে করেন, ছেলে যখন তার বাধ্য আছে তখন বৌ কিছু করতে চাইলেও পারবে না।

রাফাত ভাইয়ের জন্য প্রতি মাসে ধান বা অন্য কোনো ফসল বিক্রি করে টাকা পাঠাতো বলে নাবিলাহ স্বামীকে অনেকবার কান ফুসকি দিয়ে বলেছে, ছোট ভাইকে যে মাসে মাসে এত করে টাকা পাঠাও, পাশ করার পর চাকরি করে সে বৌ ছেলেপুলে নিয়ে সুখে থাকবে। তাতে তো তোমার কোনো উপকার হবে না।

রাফাত স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র জানে। তার কথা শুনে বলেছে, আরে আমাকে কি অত কাঁচা ভেবেছ; ওর পিছনে যত টাকা খরচ করছি, সব লিখে রাখছি। চাকরি পেয়ে যখন ভিনো হতে চাইবে তখন সেই সব খরচ উসুল করে নেব। বৈষয়িক ব্যাপারে তুমি আর কোনো দিন কিছু বলবে না।

আজ যখন শাশুড়ীর ঘরে ঐসব কথা হচ্ছিল তখন নাবিলাহও সেখানে ছিল। সে সময় কিছু বলতে সাহস করে নি। ছোট ছেলেটা দুধ খাবার জন্য কাঁদছিল বলে কিছুক্ষণ আগে চলে এসেছে। স্বামীকে চিন্তিত মুখে ফিরে আসতে দেখে বলল, কি ঠিক করলে? জমি বেচেবে নাকি?

রাফাত বলল, এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।

নাবিলাহ বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। বলছি শোন, একান্ত যদি জমি বেচে মতিনকে দিতে চাও, তা হলে সম্পত্তি ভাগ করে ওর ভাগের অংশ বিক্রি করে দাও।

যদিও রাফাতের ইচ্ছা তাই, তবু রাগ দেখিয়ে বলল, তোমাকে এসব ব্যাপারে মাথা গলাতে নিষেধ করেছি না?

রাফাত স্ত্রীর স্বভাব চরিত্র জেনেও তাকে খুব ভালবাসে। কারণ সে খুব সংসারী। সংসারে খরচপত্র খুব হিসাব করে চালায়। সংসারে উন্নতি কিসে হবে সেদিকে তার খুব লক্ষ্য। কিন্তু রাফাত মায়ের কথার এতটুকু অবাধ্য কখনও হয়নি। কখনও মায়ের মনে কষ্ট যেমন দেয়নি, তেমনি স্ত্রীকেও সে বিষয়ে কঠোর হুশিয়ার করে দিয়েছে।

কয়েকদিন ভেবে চিন্তে একদিন রাফাত মাকে একাকি বলল, তোমাকে মতিনের ব্যাপারে দু’একটা কথা বলব। কথাগুলো শুনে তুমি আমার উপর মনে কষ্ট পেতে পার, তাই বলতে সাহস পাচ্ছি না।

আসিয়া খাতুন বললেন, কথাগুলো যদি মতিনের ভালর জন্য হয়, তা হলে মনে কষ্ট পাব কেন? তুই বল।

রাফাত বলল, মতিনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যবসার জন্য দিতে হলে আমাদের অর্ধেক জমি বিক্রি করতে হবে। আজকাল শহরে যেকোনো ব্যবসা করতে গেলে কয়েক লাখ টাকা লাগে। ঐ সামান্য টাকায় ব্যবসায় নেমে আরো টাকার দরকার হলে আবার জমি বেচতে বলে যখন টাকা চাইবে তখন তাও না হয় দিলাম। কিন্তু আল্লাহ না করুক, মতিন যদি তারপরও ব্যবসা দাঁড় করাতে না পারে অথবা ফেল করে তখন তো আমরা না খেয়ে মরব। তাই বলছিলাম, মতিন যাতে পরে আর টাকা চাইতে না পারে, সেজন্য জমি জায়গা অর্ধেক করে ওর অংশটা বিক্রি করে ওকে টাকাটা দিই। তা হলে ব্যবসার জন্য পরে আর জমি বিক্রি করে টাকা চাইতে পারবে না। যদি ব্যবসা নাও চলে, তবু অর্ধেক জমি থেকে যাবে। ও উচ্চ শিক্ষিত। কিছু না কিছু করে খেতে পারবে। কিন্তু আমি এতগুলো পেট চালাব কি করে?

আসিয়া খাতুন ছেলের উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। বললেন, তোর কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও একদিক দিয়ে ঠিক বলেছিস। মতিন যা জেদি ছেলে, ব্যবসা যখন করবে বলেছে তখন না করে ছাড়বে না। ওকে কথাটা বলে দেখি, কি বলে।

এক সময় আসিয়া খাতুন মতিনকে রাফাতের কথাগুলো বললেন।

মতিন শুনে ভাইয়ার মনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে খুব দুঃখ পেল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, মা, তুমি কোনো চিন্তা করো না। ভাইয়াকে বল, সে যা করতে চাচ্ছে তাতে আমি রাজি। তবে ভাগ বাটোয়ারার কাজ কাঁচা করা চলবে না। আর শুধু জমি নয়, সমস্ত জমি-জায়গা, পুকুর-ডোবা, ডাঙ্গা, বাড়ি-ঘর সব কিছু পাকাপাকিভাবে ভাগ করে দিতে হবে।

আসিয়া খাতুন বললেন, রাফাত তো সে কথা বলে নি ।

মতিন বলল, নাই বলুক, যতটুকু বলেছে, তা তুমি বুঝতে না পারলেও আমি বুঝেছি। ভাগ যখন হবে তখন কিছু হবে কিছু বাকি থাকবে কেন? যা হওয়ার একবারেই হয়ে যাক।

আসিয়া খাতুন মতিনকে অনেক বোঝালেন। কিন্তু কোনো কাজ হল না। শেষে রাফাতকে মতিনের কথা বললেন।

শুনে রাফাত মনে মনে খুশী হল। তা প্রকাশ না করে মা যাতে মনে কষ্ট না পায়, সেজন্য বলল, মতিন যেভাবে আমার কথাটা নিল, সেভাবে আমি বলি নি। তবু ও যখন চাচ্ছে সবকিছু পাকাপাকি ভাগ বাটোয়ারা করতে তখন তাই করা যাবে।

মাসখানেকের মধ্যে মতিন শুধু সব ধানি জমি বিক্রি করে প্রায় এক লাখের মত টাকা নিয়ে ঢাকায় এল। প্রথমে একটা ছোটমতো অফিসরুম ভাড়া নিয়ে টেন্ডার ধরে বড় বড় অফিসে নানা রকম জিনিস সাপ্লাইয়ের ব্যবসা শুরু করল। তার ভাগ্য ভালো। বছর দু’য়েকের মধ্যে ব্যবসায় বেশ উন্নতি করে মতিঝিলে একটা অফিস করল। তারপর সাপ্লায়ের কাজের সাথে সাথে এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা করে চার পাঁচ বছরের মধ্যে ফুলে ফেঁপে উঠল। এর মধ্যে বছরে দু’তিনবার করে দেশের বাড়িতে গেছে মাকে দেখার ও তার দোয়া নেয়ার জন্য। দেশে যাওয়ার সময় মা ও ভাইয়ার সংসারের সকলের জন্য অনেক কিছু জিনিস নিয়ে গেছে। কিন্তু ভাইয়ার হাতে কোনো টাকা পয়সা দেয়নি।

একবার বাড়িতে এলে আসিয়া খাতুন মতিনকে বললেন, আমি তোর জন্য মেয়ে দেখেছি, বিয়ে দেব।

মতিন বলল, এত শিল্পী আমি বিয়ে করব না। ব্যবসাটা আরো একটু বড় হোক। ঢাকায় বাড়ি গাড়ি করি, তারপর বিয়ের কথা চিন্তা করব।

আসিয়া খাতুন বললেন, তোর বয়স কত হয়েছে সে কথা খেয়াল করেছিস? ত্রিশে পড়েছে। ছেলেদের ত্রিশের মধ্যে বিয়ে করা উচিত। তা ছাড়া আমি তোর বৌ দেখে মরতে চাই। বুড়ী হয়ে গেছি। কবে বলতে কবে মরে যাব তার ঠিক আছে?

মতিন বলল, আমি তোমাকে মরতে দিলে তো তুমি মরবে।

আসিয়া খাতুন মৃদু হেসে বললেন, মরণের উপর কারো কি হাত আছে বাবা? না কেউ জানে কে কখন মরবে? আমি তোর মামাতো বোন ফিরোজার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে রেখেছি।

কিন্তু মা, আমাকে না জানিয়ে এসব করতে গেলে কেন?

কেন? করেছি তো কি হয়েছে? ফিরোজা এ বছর আই. এ. পাস করেছে। খুব ধার্মিক নিমোহর মেয়ে। তুই তাকে অনেক আগে দেখেছিস। তখন যা ছিল, তার চেয়ে এখন দেখতে আরো সুন্দর হয়েছে। আমি তোর মামাকে পাকা কথা বলেছি, এবারে তুই এলে কাজটা সেরে ফেলব। তুই আসার পর রাফাতকে দিয়ে তাকে খবর পাঠিয়েছিলাম। আজ আসবে। তুই অমত করিসনি বাবা।

মতিনের ইচ্ছা ছিল, ঢাকায় বাড়ি গাড়ি করার পর কোনো বড়লোকের উচ্চ শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করবে। পাড়াগাঁয়ের মেয়ে তার পছন্দ নয়। তাই মায়ের কথা শুনে চিন্তা করল, ফিরোজাকে বিয়ে না করলে মা মনে খুব কষ্ট পাবে। অবশ্য ফিরোজা দেখতে খুব সুন্দরী, সে কথা ঠিক। তবু পাড়াগাঁয়ের মেয়ে ভেবে কিছু না বলে চুপ করে রইল।

আসিয়া খাতুন বললেন, কিরে কিছু বলছিস না কেন? ফিরোজাকে তোর কি পছন্দ হয় না?

মতিন বলল, ফিরোজা অপছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে নয়। কিন্তু ………

আসিয়া খাতুন ছেলেকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে বললেন, অপছন্দ যখন নয় তখন আর আমি তোর কোনো কিন্তু টিন্তু শুনব না। একটা কথা মনে রাখিস, তুই যদি ফিরোজাকে বিয়ে না করিস, তা হলে যেমন আমার ইজ্জত থাকবে না, তেমনি তোর মামারও থাকবে না। আর ফিরোজার বিয়ে দেয়াও খুব মুশকিল হয়ে পড়বে।

মতিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, ঠিক আছে, তুমি ব্যবস্থা কর। তিন চার দিনের মধ্যে ফিরোজার সাথে মতিনের বিয়ে হয়ে গেল। ফিরোজাকে আগে যা দেখেছিল এখন সে দেখতে আরো সুন্দরী হয়েছে ঠিক; কিন্তু মতিন বুঝতে পারল, ফিরোজা পাড়াগায়ের সেকেলে ধরনের মেয়ে। তাকে নিজের মতো করে গড়তে হলে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবে। মাকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে ফিরোজাকে বিয়ে করে নিজে সন্তুষ্ট হতে পারল না। মনকে এই বলে প্রবোধ দিল, ফিরোজা অত্যন্ত সুন্দরী ও লেখাপড়া জানা মেয়ে; তাকে শহরের মেয়েদের মতো করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। এদিকে ব্যবসার দিকে তার মন পড়ে আছে। তাই বিয়ের পর মাত্র দু’দিন থেকে ফিরোজাকে বি. এ. ক্লাসে এ্যাডমিশন নেয়ার ব্যবস্থা করে ঢাকায় ফিরে এল। এরপর দু’তিন মাস অন্তর দেশে গেছে। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর যতবার সে দেশের বাড়িতে গেছে, ততবার মাকে নিয়ে আলাদা খেয়েছে। বিয়ের পর স্ত্রীকে মায়ের কাছে রেখে তাদের খরচপত্র দিয়ে এসেছে। তারপর দু’তিন বছরের মধ্যে কলাবাগানের কাছে জমি কিনে প্রথমে বাড়ি এবং পরে গাড়ি করে মা ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় চলে এল। ততদিনে ফিরোজা বি. এ. পাস করেছে।

আসিয়া খাতুন পাড়াগাঁয়ের মেয়ে। নিয়মিত ধর্মকর্ম পালন করেন। ফিরোজাও সেই রকম। মতিন ছেলেবেলায় মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে কুরআন ও নামায পড়া শিখেছিল। স্কুল কলেজে পড়ার সময় সেসব কিছু কিছু মেনে চললেও ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ছেড়ে দিয়েছে। শহরের চাকচিক্য দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিল, লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা করে শহরের লোকদের মতো জীবন যাপন করবে।

আল্লাহপাক তার বান্দাদের মনের বাসনা অপূরণ রাখেন না। প্রত্যেক বান্দাকে তিনি একবার হলেও তার বাসনা পূরণ করার সুযোগ দেন। তবে সেই সুযোগের সদব্যবহার অনেকে করতে পারে না বলে হা হুতাশ করে, নিজের ভাগ্যকে দোষ দেয়।

মতিন ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে খুব বড় ঝুঁকি নিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল। তাই আজ সে ঢাকার বুকে মস্ত ধনী হতে পেরেছে। কিন্তু যত তার আর্থিক উন্নতি হতে লাগল, তত সে আল্লাহ ও রাসুল (সঃ) কে ভুলে যেতে লাগল। সে ক্রমশঃ সাহেবী চাল চলনে অভ্যস্থ হয়ে পড়ল। বাসায় মাসে দু’তিনবার পার্টি দেয়। সেই পার্টিতে যে সমস্ত নারী পুরুষ আসে, তাদের খাওয়া-দাওয়া, নাচ-গান, সবকিছু বিদেশী স্টাইলে হয়।

আসিয়া খাতুন এই সব মোটেই পছন্দ করেন না। ছেলেকে অনেক সময় আল্লাহ ও রাসুলের (সঃ) বাণী স্মরণ করিয়ে এসব করতে নিষেধ করেন। নামায রোযা করতে বলেন। ফিরোজাও স্বামীকে যতটা বোঝাবার বোঝায়। কিন্তু মতিন তাদের কথায় কান দেয় না। উল্টে বলে, তোমরা তোমাদের মতো চল, আমি আমার মতো চলব। বিয়ের পর পাঁচ বছরের মধ্যে মতিন সন্তান কামনা করেনি। তাই সেরকম ব্যবস্থা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে মিলন করত। তিন বছরের মধ্যে ফিরোজা সন্তানের জন্য পাগল হয়ে উঠল। মিলনের আগে স্বামীকে প্রটেকশন নিতে নিষেধ করত। মতিন রেগে গিয়ে বলত, সন্তান হলে তোমার শরীর যেমন খারাপ হয়ে যাবে, তেমনি তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে।

আসিয়া খাতুনও এতদিন নাতি নাতনি হচ্ছে না দেখে বৌমার কাছ থেকে ছেলের উদ্দেশ্য জানতে পেরে ছেলেকে অনেক তিরস্কার করেছেন। শেষে মাকে খুশী করার জন্য এবং ফিরোজার কান্নাকাটিতে চার বছরের মাথায় একটা সন্তান নিল। মতিন তার নাম রাখল তন্ময়।

আসিয়া খাতুন রাখলেন আবু তাহের। ছেলেকে বললেন, তুই যে নামটা রাখলি, ওটা ডাক নাম। আর আমি যেটা রাখলাম, ওটা ওর আসল নাম। তন্ময় যখন ছয় বছরের তখন আসিয়া খাতুন মারা যান। তারপর তন্ময় যে বছর মাস্টার্স ডিগ্রী নিল সে বছর মতিন সাহেব মারা যান। সেই থেকে তন্ময় বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছে।

স্বামী যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন ফিরোজা বেগম ধর্মের আইন কানুন মেনে চললেও তাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য অনেক সময় ধর্মের সম্পূর্ণ আইন মেনে চলতে পারেন নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতেন।

সংসারের কাজের জন্য দু’জন কাজের মেয়ে আছে। তাদের একজন রান্না ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে। আর অন্যজন ঘরদোর মোছা ও কাপড় চোপড় গোছানোর কাজ করে। বাজার করার জন্য স্বামীর আমলের যে বুড়ো মতো একজন লোক ছিল, সে আছে। তা ছাড়াও দু’জন মালি ও একজন দারোয়ান আছে। মতিন সাহেব দু’বিঘে জমির একপাশে প্রতি তলায় দু’টি করে চার ফ্লাটের দু’তলা বাড়ি করেছেন। বাড়ির সামনের জায়গাতে ফুলের বাগান। গেটের পাশে মালি ও দারোয়ানদের থাকার ঘর। আর বাড়ির সঙ্গে গাড়ি রাখার গ্যারেজ।

তন্ময় বাবার ব্যবসাতে আরো উন্নতি করেছে। ধানমন্ডিতে একটা পাঁচতলা বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছে। সেই বাড়ি দেখাশোনা ও ভাড়া আদায় করার জন্য একজন লোক রেখেছে।

স্বামী মারা যাওয়ার দু’বছর পর থেকে ফিরোজা বেগম ছেলের বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে আসছেন। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেল তবু ছেলেকে রাজি করাতে পারেন নি। বিয়ের কথা শুনলেই তন্ময় নানান কথা বলে এড়িয়ে যায়। আজ ছেলের বিয়ে না করার কারণ জানতে পেরে ও তার মাতৃভক্তির কথা চিন্তা করে একদিকে যেমন তিনি খুব খুশী হলেন, অন্যদিকে তেমনি বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তন্ময়কে তার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে ভেবে ঠিক করলেন, যেমন করে হোক শিঘ্রী ওর বিয়ে দিতে হবে।

এদিকে তন্ময় নিজের রুমে এসে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, এবারে মা বিয়ে দেয়ার জন্য যেরকম উঠে পড়ে লেগেছে, মনে হয় কিছু না করে ছাড়বে না। তখন তার মন বলল, প্রত্যেক সক্ষম পুরুষের উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করা উচিত। তোমারও তাই করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে তার বন্ধু রাসেলের কথা মনে পড়ল। সেও তার মতো বাবা মার একমাত্র সন্তান। অবশ্য তার মা বাবা দু’জনে বেঁচে আছে। রাসেল বাবা মার যে খুব আদরের তা বলাই বাহুল্য। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দু’জনের বন্ধুত্ব হয়। রাসেল গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। তার বাবা জমি জায়গা বেচে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ভাগ্যগুণে যেমন একটা ব্যাংকে ভালো চাকরি পেয়ে যায়, তেমনি ম্যানেজারের সুনজরে পড়ে যায়। দু’তিন বছরের মধ্যে প্রমোশন পেয়ে ম্যানেজারের বি. এ. পাস মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার স্ত্রী মাত্র পনের দিন গ্রামে শ্বশুর বাড়িতে ছিল। তারপর আর সেখানে যেতে রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে রাসেল ঢাকাতে ভাড়া বাসায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। মা বাবাকে ঢাকায় নিজেদের কাছে এনে রেখেছিল। কিন্তু বৌয়ের ব্যবহারে দু’তিন মাস থাকার পর তারা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে গ্রামে ফিরে গেছে। তার স্ত্রী গ্রাম্য অশিক্ষিত শ্বশুর শাশুড়ীকে মোটেই মেনে নিতে পারে নি। রাসেল স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়েছে; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এই নিয়ে ছেলে বৌয়ের মধ্যে মনোমালিন্য হতে দেখে তার বাবা মা স্বেচ্ছায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। এরপর থেকে রাসেল বাবা মাকে মাসে মাসে কিছু কিছু টাকা পাঠায়। তাও সব মাসে পারে না স্ত্রীর লম্বা হাতের জন্য। সেই জন্য মাঝে মাঝে স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কথা কাটাকাটি হয়। রাসেলের বিয়ের সময় তন্ময় গিয়েছিল। তখন তার বৌকে বেশ সুন্দরী ও স্মার্ট দেখেছিল। বছর খানেক দু’বন্ধুর তেমন যোগাযোগ হয়নি। কিছুদিন আগে তন্ময় রাসেলের অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার কথা মনে পড়তে অফিসে গেল। রাসেল দাড়ি রেখেছে দেখে বেশ অবাক হল।

রাসেল তন্ময়কে দেখে সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, এতদিন পর বন্ধুর কথা মনে পড়ল তা হলে? তারপর তাকে চেয়ারে বসিয়ে বলল, কি খাবি বল।

তন্ময় বলল, যাহোক কিছু আনা। তারপর আবার বলল, আমি তবু মনে পড়তে এলাম। আর তুই?

রাসেল বসে মৃদু হেসে বলল, আমার কথা বাদ দে। তারপর টেলিকম তুলে পি. এ. কে নাস্তা ও ফান্টার অর্ডার দিয়ে তন্ময়কে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস দোস্ত?

আছি একরকম। তা তোর কি খবর? বৌ নিয়ে নিশ্চয় খুব সুখে আছিস?

এই কথায় রাসেল যেন চুপসে গেল। ম্লান মুখে বলল, একরকম কেটে যাচ্ছে।

তন্ময় বলল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বিয়ে করে তুই সুখী হতে পারিস নি আবার দাড়িও রেখেছিস। তুই তো এসব একদম পছন্দ করতিস না। তোর মনে আছে? “একদিন ভার্সিটিতে তোর খোঁচা খোঁচা দাড়ি দেখে যখন বললাম, কিরে দাড়ি রাখবি নাকি? তখন তুই বলেছিলি, আরে দূর, ওসব মোল্লা মৌলবীদের ব্যাপার। পড়ার চাপে ক’দিন কামাবার কথা মনে ছিল না। শালা মেয়েদের মতো পুরুষদেরও যদি দাড়ি না গজাত, তা হলে দাড়ি কামাবার ঝামেলা থেকে রেহাই পেতাম।” সেদিন এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছিলাম তাই না রাসেল?

রাসেল একটু গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ, করেছিলাম। এখন সেজন্যে খুব অনুতপ্ত।

কেন?

দাড়ি রাখা সুন্নত। সুন্নত নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা খুব অন্যায়। তোকে দু’একটা কথা বলব, মাইন্ড করবি না তো?

তোর কথায় মাইন্ড করব, এ কথা ভাবতে পারলি? বল কি বলবি। তার আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে, ভাবি কি তোকে সুখী করতে পারে নি?

তোর প্রশ্নের উত্তর দেব, তার আগে আমাকে কথাগুলো বলতে দে। আমাকে রাসেল বলে আর কখনও ডাকবি না। আমার ভালো নাম মুসতাকিম তাই বলে ডাকবি।

কেন?

কেনর উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। অত কথা শোনার সময় তোর হবে না। তাই দু’চারটে কথা বলছি শোন, রাসেল হল খৃষ্টানদের নাম। কোনো মুসলমানের নাম ঐ রকম রাখা উচিত না। মুসলমানদের এমন নাম রাখতে হবে, যাতে করে তার নাম যেন প্রকাশ করে সে মুসলমান। যাকগে, বাদ দে ও প্রসঙ্গ। এবার তোর প্রশ্নের উত্তর দিই। তোর ভাবি আমাকে সুখী করবে কি করে? আসলে আমার ভাগ্যে সুখ নেই। এমন সময় পিয়ন নাস্তা নিয়ে এলে বলল, থাক ওসব কথা, নে নাস্তা খা।

নাস্তা খেয়ে ফান্টার পাইপে একটা টান দিয়ে তন্ময় বলল, তুইতো আরো কিছু বলবি বলে মাইণ্ড করার কথা বললি। এখন আমি যদি বলি, ভাবি তোকে সুখী করতে পারল না কেন? তা হলে তুই কি মাইণ্ড করবি? নামের কথা না হয় বাদ দিলাম।

মোশতাকিম একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সে সব শুনলে তুই দুঃখ পাবি।

তবু তুই বল।

মোশতাকিম তাদের দাম্পত্য জীবনের সব কথা খুলে বলল।

তন্ময় বলল, ভাবিকে দেখে তো সে রকম মেয়ে বলে মনে হয় নি। তুই তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ম্যানেজ করতে পারলি না?

অনেক চেষ্টা করেছি দোস্ত। একটা কথা কি জানিস, যারা নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, তারা অন্যের ভালো কাজ বা কথাকে মানতে চায় না। এরা এক ধরণের অহংকারী। তারা নিজেরাও যেমন সুখ শান্তি পায় না তেমনি অন্যকেও দিতে পারে না। আর জেনে রাখ, “অহংকারীকে আল্লাহ ভালবাসেন না”। [সূরা লুকমান, আয়াত- ১৮, পারা-২১] এটা কালাম পাকের কথা।

ভাবি কি তোর কোনো কথাই শোনে না?

শোনে। তবে যেটা তার বিবেক শুনতে বলে।

এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

আছে, ধর্মীয় জ্ঞান। অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি। একটা কথা জেনে রাখ, যার মধ্যে অহংকার থাকবে ও আল্লাহভীতি নেই, সে দুনিয়াতে এমন কোনো অন্যায় কাজ নেই, যা করতে সে দ্বিধাবোধ করবে। জানিস, বাবা মাকে টাকা পাঠাই তোর ভাবিকে গোপন করে। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কি হতে পারে?

তোর কাছে আসার সময় মনে করেছিলাম, তোদের দাম্পত্য জীবনের সুখের কথা শুনে কিছু আনন্দ ও জ্ঞানলাভ করব; কিন্তু তার বদলে যা শুনলাম, তাতে দুঃখ পেলাম। যাক, আজ চলি। আর একদিন আসব। তুই একদিন আমার অফিসে আয় না?

আসব বলে মোশতাকিম বলল, দাঁড়া আমিও মসজিদে নামায পড়তে যাব। সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় তন্ময় বলল, তুই তা হলে নামাযও পড়তে শুরু করেছিস?

মোশতাকিম বলল, তুই তখন সুখ শান্তির কথা জিজ্ঞেস করলি না? নামাযের মধ্যে যে কি সুখ আর শান্তি, যখন নামায পড়বি তখন বুঝবি।

তন্ময় বলল, রক্ষে কর দোস্ত। নামায পড়ার কথা আর বলিস না। যারা নামায পড়ে তারাই বেশি পাপ করে।

মোশতাকিম বলল, তোর কথা সত্য না হলেও একেবারে অস্বীকার করব না। অনেকে নিজেদের পাপ কাজ ঢাকা দেয়ার জন্য এবং মানুষের কাছে সাধুগিরী দেখাবার জন্য নামায পড়ে। আবার অনেকে অল্প কিছু হাদীস কালাম পড়ে জেনেছে, মানুষ সারাদিন যা গোনাহ করে, নামায পড়লে তা মাফ হয়ে যায়। সেজন্য তারা নামায পড়ে। কিন্তু তারা জানে না, এমন অনেক অন্যায় কাজ আছে, যা করলে গোনাহ মাফ হওয়া তো দূরের কথা, নামাযই কবুল হয় না। কিন্তু যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং শুধু তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য নামায পড়ে, তারা কোনো দিন গোনাহর কাজ করতে পারে না। যদিও কেউ শয়তানের প্ররোচণায় কোনো গোনাহর কাজ করেও ফেলে, তা হলে নামায পড়ে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করে মাফ চেয়ে নেয়। তা ছাড়া হাদিসে আছে “অন্যের দোষ ত্রুটি অন্বেষণ করা নিষেধ।” কে কি করল না করল, তা তুই দেখবি কেন? তুই আল্লাহর হুকুম মোতাবেক নামায পড়বি।

তন্ময় বলল, তুই তো দেখছি পুরো হুজুর বনে গেছিস। কি ব্যাপার বলতো? আগে তো তুই নামাযীদের একদম দেখতে পারতিস না। তোর এরকম পরিবর্তন হল কি করে?

মোশতাকিম বলল, হুজুর হওয়াতো দূরের কথা, তাঁদের পায়ের ধুলোর যোগ্যতাও আমার নেই। আর পরিবর্তনের কথা জিজ্ঞেস করছিস? আল্লাহ কখন কাকে পরিবর্তন করে দেন, তা কেউ বলতে পারে না। আবার আসিস তখন আলোচনা করব। কথা বলতে বলতে তারা নিচে চলে এসেছে। বলল, এবার আসিরে, দেরি করলে জামাত ফেল করব। তারপর সালাম দিয়ে মসজিদের দিকে চলে গেল।

তন্ময় মোশতাকিমের দিকে তাকিয়ে ভাবল, আগে মোশতাকিম কি ছিল আর এখন কি হয়ে গেছে। তারপর গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *