ভালোবাসা মোরে ভিকিরি করেছে
ওই যে মোড়ের মাথায় হলুদ রঙের বাড়িটা দেখছেন, ওই বাড়িতে আমি থাকি। আমি থাকি, আমার বউ থাকে, আমার এক ছেলে আর মেয়ে থাকে। ছেলে বড়ো আর মেয়ে ছোটো আমি ইচ্ছে করলে আমার বাড়ির বাইরে একটা মার্বেল ফলক লাগাতে পারি; তাইতে লেখাতে পারি ‘প্ল্যানড ফ্যামিলি’।
আমি ইচ্ছে করলে আমার পরিবারের সভ্য সংখ্যা আরও অনেক বাড়াতে পারতুম। সে ক্ষমতা আমার ছিল। সাহসে কুললো না, ফলে হাম দো, হামারা দো। একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি, এখন যা বাজার পড়েছে, তাতে যেকোনো লোকের তিনটে ছেলে হলে ভালো হয়। একজন মাস্তান হবে, আর একজন হবে নেতা, আর একজন পুলিশ। একেবারে আদর্শ পরিবারের কাঠামো। হেসে খেলে রাজত্ব করে যাও। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অভাব হলেও জাতীয় সম্পত্তির অভাব নেই। পার্কের রেলিং খুলে বেচে দাও। ট্রেনের কামরা থেকে আলো। পাখা, গদি আপন ভেবে খুলে নিয়ে এসো। চারদিকে নানারকম কনস্ট্রাকশান হচ্ছে, প্রচুর মালপত্র পড়ে আছে রাস্তাঘাটে। একটু কষ্ট করে তুলে আনো। এনে আবার সেইখানেই ফিরিয়ে দাও। একেই বলে লেনদেন। জমি কেনো, বাড়ি করো, গাড়ি করো। ফুরফুরে নেশা কর। এদিক-সেদিক যাও। শহরে আবার বাইজি-কালচার ফিরে আসছে। ওড়াও, ওড়াও, দু-হাতে কারেনসি নোট ওড়াও তো, এই নয়া বাতাসের পাল তুলতে পারিনি আমি। আমার পালে সেই পুরোনো বাতাস। ধর্ম নিয়ে আদর্শ নিয়ে, এক বিশ্রী অবস্থা। লোভ আছে সাহস নেই।
আমি আমার বউকে ভীষণ ভয় পাই। সব আদর্শবাদী স্বামীই পায়, আমি একটু বেশি পাই; কারণ আমি ঝগড়াঝাঁটি ভীষণ অপছন্দ করি। আমি মনে করি কোনো ভদ্রলোকের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করা উচিত নয়। আর স্ত্রী আর হেডমিস্ট্রেসে খুব একটা তফাত নেই। সব স্বামীই স্ত্রীদের ছাত্র। কত কী শেখার আছে! আর সেই শিক্ষা তো স্ত্রীর পাঠশালাতেই হয়। আমার স্ত্রী এই এতদিন পরেও প্রায়ই বলে, ‘কবে যে তুমি একটু মানুষ হবে!’
‘আমি এখন তাহলে কী?’
স্কুলে শিক্ষকরা চিরকাল বলে এসেছেন, ‘এমন সিনসিয়ার গাধা খুব কম দেখা যায়।’
আমার বউ স্পষ্ট মুখের ওপর বলে, ‘তুমি একটা অমানুষ।’ অর্থাৎ জন্তুর জান্তব গুণাবলী চোলাই করে ঈশ্বর আমাকে মানুষের বোতলে পুরে পৃথিবীতে ঠেলে দিয়েছেন। আর আমার স্ত্রী দয়া করে সেই বোতলটিকে তুলে নিয়েছে। কত বড় উদারতা! এই উদারতার জন্যে চিরকাল আমাকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। ‘সিট ডাউন’ বললে বসতে হবে। ‘গেট আপ’ বললে উঠতে হবে।
আমি আমার ছেলে-মেয়েদের কোনোভাবেই জানতে দিতে চাই না, যে আমি প্রেম করে বিয়ে করেছি। প্রেম বাঙালির রক্তে হেমোগ্লোবিনের মতো মিশে আছে। নারী জাতির প্রতি প্রেম। বিয়ের সময় আমরা যে পণ চাই, বিয়ের পরে বধূ নিগ্রহ করি, কখনো পুড়িয়ে মারি, বা সিলিং-এ ঝুলিয়ে দিই, সেটা স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ নয়, শ্বশুরমশাইকে ঘৃণা। অধিকাংশ শ্বশুরই পাকা ব্যবসাদার। কৃপণ। হাত দিয়ে জল গলে না। চোখের চামড়া নেই। ধুরন্ধর প্রকৃতির ব্যক্তি। সুন্দর সুন্দর মেয়ের পিতা হয়ে বিয়ের বাজারে লাঠি ঘোরাতে চান।
আমি একটু বোকা ধরনের উদার প্রকৃতির মানুষ, তাই ঠকে মরেছি। আমার ভায়রাভাই, যে আমার বউয়ের বোনকে বিয়ে করেছে, সে পাকা ছেলে। আমার শ্বশুরমশায়ের কানটি মলে কম বাগিয়েছে। ভাবলে মনটা কেমন করে ওঠে! একই বউকে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করা যায় না। যা হয়ে গেছে, তা হয়ে গেছে। পস্তে লাভ নেই। ভালোবাসার পলস্তারা দিয়ে সব মসৃণ করতে হবে। ভালোবাসা জিনিসটা ভোরের শিশিরের মতো। সংসার সূর্যে নিমেষে উবে যায়।
আমার হলুদ রঙের একতলা বাড়ি। সবে হয়েছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। এই বাড়িই আমার বাঁশ হয়েছে। আমার জ্ঞানী বউয়ের পরামর্শে সব বেচেবুচে, ধারদেনা করে তৈরি হয়েছে ইটের খাঁচা। এখন বাজার করার পয়সা জোটে না। ভিকিরির অবস্থা। অফিস থেকে লোন নিয়েছিলুম। কাটতে শুরু করেছে। মাইনে হাফ হয়ে গেছে। অথচ সংসার খরচ কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে ঘনঘন বাজেট অধিবেশন হয়ে গেছে। কোনো দিক থেকেই কোনো সুরাহা হয়নি। আমরা তো আর স্টেট নই যে মদের ওপর, কি ডিজেলের ওপর, কী সিগারেটের ওপর, কী গমের ওপর ট্যাক্স বসিয়ে দেবো! এ হল ফ্যামিলি। একটাই রাস্তা, খরচ কমানো।
দুধের খরচ কমানো যাবে না। ছেলে-মেয়ের হেলথ খারাপ হয়ে যাবে। ওরাই তো আমাদের ভবিষ্যৎ। দেশের ভবিষ্যৎ। ঠিক মতো লালনপালন করতে পারলে কত কী হতে পারে। এদেশে এখনও কেউ আইনস্টাইন হয়নি, রাসেল হয়নি। এদেশে অ্যাব্রাহাম লিংকনেরও খুব প্রয়োজন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারে যাচ্ছেতাই। সারা ভারতে রাজনীতির চোলাই তৈরি হচ্ছে। চতুর্দিকে আড়ং ধোলাই শুরু হয়েছে। সারা বিশ্ব হিংসায় ভরে গেছে, একজন যিশু এলে মন্দ হয় না। আমার শিশুটিও যিশু হতে পারে। কে কি হবে, বলা তো যায় না! আমার বউ অবশ্য সন্দেহ করে, ‘তোমার মতো পিতার সন্তান কত দূর কী করতে পারবে সন্দেহ আছে। গাছ অনুযায়ীই তো ফল হবে।’ আমি ভয়ে বলতে পারি না যে, ‘তুমি তো জমি। বীজ ধারণ করেছিলে। সেই জমিতেও তো আমার সন্দেহ। বীজের দোষ না জমির দোষ!’ সাহস করে বলি না। বললেই দাঙ্গাহাঙ্গামা বেধে যাবে। মেয়েদের সঙ্গে ঝগড়ায় আমি পারব না; কারণ আমার মেমারি তেমন ভালো নয়। মামলা আর বউয়ের সঙ্গে ঝগড়ায় ‘পাস্ট রেফারেন্সের’ খুব প্রয়োজন হয়। দশ বছর আগে এক বর্ষার রাতে আমি কী বলেছিলুম, আমার বউয়ের মনে আছে। লিভিং রেফারেন্স ম্যানুয়েল। মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েদের স্মরণশক্তি বেশি, না বিয়ে হলেই স্মরণশক্তি খুলে যায়। আমার তো কালকের কথা আজ মনে থাকে না। টেপের মতো সব ইরেজ হয়ে যায়।
বেশ, দুধ কমানো যাবে না। বোতলের সাদা জল, পলিথিনের ব্যাগে ভরা থলথলে সাদা জলে বাঙালির ধৃতি, পুষ্টি, মেধা। সারা পরিবারে ভাগ বাঁটোয়ারায় আধকাপ মাথাপিছু পেটে না গেলে মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা দেখা দেবে। গ্যাসের খরচ কমানো যাবে না। গ্যাস দিয়ে আর গ্যাস নিয়েই তো আমাদের জীবন। চাবি ঘুরিয়ে জ্বালতে জ্বালতেই বেশ কিছুটা বাতাসে পাখা মেলে উড়ে যাবে। সারা বাড়ি খুশবুতে ভরে যাবে। হাতের কাছে সব গুছিয়ে নিয়ে রাঁধতে বসার নির্দেশ থাকলেও সম্ভব হবে না। সেইটাই আমাদের চরিত্র। বিদ্যুতের বিল উত্তরোত্তর বাড়বে বই কমবে না। লোকলৌকিকতা যা ছিল তাই থাকবে। শিক্ষার খরচ দিন দিন বাড়বে। প্রতিটি বিষয়ের জন্যে এক একজন গৃহশিক্ষক। তা না হলে পরীক্ষায় গোল্লা। অশ্রু বিসর্জন করে, নাকে কেঁদে লাভ নেই। যে খেলায় যা নিয়ম। খরচ কমাবার কোনো রাস্তা নেই। শুধু বেড়ে যাও, ছেড়ে যাও, উড়িয়ে যাও, পুড়িয়ে যাও।
ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি, ওয়েস্ট নট ওয়ান্ট নট। অপচয় বন্ধ করো, অভাব হবে না; কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়! মহিলাদের স্বভাব হল, তাঁরা অন্যকে উপদেশ দেবেন, সেই উপদেশের সিকির সিকি নিজেদের জীবনে পালন করবেন না। আমার স্ত্রী পাশের বাড়ির বউটিকে উপদেশ দেন, স্বামী অফিস থেকে ফেরামাত্রই অমন মেজাজ দেখাও কেন? আগে আসতে দাও, বসতে দাও, শান্ত হয়ে চা-টা খেতে দাও। তারপর যা বলার বলো। বলবে বই কী। স্বামীকে বলবে না তো কাকে বলবে! পৃথিবীতে ওই একটাই তো লোক! জীবনসাথী!
এই উপদেশ আমি নিজের কানে শুনেছি। কিন্তু আমার বেলায় ঠিক উলটোটাই হয়। আপনি আচরি ধর্ম, এই নীতিবাক্যটি ভদ্রমহিলা হয়তো বহুবার শুনেছেন; মগজে তেমন ছাপ ফেলেনি। ঢোকার দরজার মুখে একটা পাপোশ আছে। সেইখান থেকেই শুরু হয়। ‘কী হল! ওখানে পাপোশটা কী জন্যে রাখা হয়েছে? ছাপ্পান্ন টাকা নগদ দাম দিয়ে কেনা হয়েছে কী কারণে! তোমার হাইজাম্প প্র্যাকটিশ করার জন্যে? এই নোংরা জুতো নিয়ে ছাগলের মতো লাফিয়ে আমার এমন সুন্দর মোজাইক মেঝেতে দাগ ফেলে দিলে! জান না মোজেকের মেঝে কী সাংঘাতিক সেনসিটিভ। একবার দাগ ধরে গেলে সহজে উঠতে চায় না। অকজ্যালিক অ্যাসিড ঘষতে হয়, মোমপালিশ করতে হয়। আর রাস্তার জুতো নিয়ে ভেতরেই বা আসা কেন? ন্যাস্টি হ্যাবিট!
আমারও মেজাজ ঠিক থাকে না। জ্যাম ঠেঙিয়ে ধুলো, ঘাম, ডিজেলের ধোঁয়া গায়ে মেখে, ঘাড়ে পিঠে সহযাত্রীদের রদ্দা খেয়ে ময়ান দিয়ে ঠাসা লুচির ময়দার তালের মতো বাড়ি ফিরে দরজার মুখ থেকেই শুরু হলে কার ভালো লাগে? আমার মোজেক! তোমার মোজেক মানে! পুরো প্রোডাকশানটাই তো আমার। চিত্রনাট্য, পরিচালনা, সংগীত, গীতরচনা, সবই তো আমি করেছি। ভাদ্রমাসের রোদে পোস্টাপিসের পিয়োনের ছাতা মাথায় দিয়ে মিস্ত্রি খাটিয়েছি। নাক দিয়ে সিমেন্ট টেনেছি। পা দিয়ে মশলা দলেছি। জোগাড়ের অভাব হয়েছে যেদিন, ক্যানেস্তারা ক্যানেস্তারা জল ঢেলে ইট ভিজিয়েছি। পয়সা ছিল না; মোজেক ঘষাবার মেশিন আনতে পারিনি, নিজেই হাঁটুগেড়ে বসে পাথর দিয়ে ঘষে ঘষে দানা বের করেছি। সেই থেকে আমার হাঁটুতে কড়া, কোমরে সায়টিকা। ভাদ্রের রোদে পুড়ে জণ্ডিস। সেই থেকে চোখ দুটো ঘোলাটে হলুদ। আর এখন, সেই সাধনার পীঠস্থানে জুতোসুদ্ধ পা রেখেছি বলে ধাতানি খেয়ে মরছি!
বেশ চড়া গলাতেই বলতে হয়, ‘জুতো তাহলে রাখব কোথায়? মাথায়?’
‘মাথায় তো রাখতে বলিনি; বাইরের সিঁড়ির একপাশে রাখতে পার।’
‘তিনদিন আগে আমার নতুন কোলাপুরির একটা পাটি কুকুরে মুখে করে নিয়ে গেছে।’
‘গাছে তুলে রাখো।’
জমিটা যখন কিনি, তখন সেখানে একটা ফলসা গাছ ছিল। গাছটাকে কায়দা করে বাঁচানো হয়েছে। সেই গাছে জুতোটাকে ঝোলাবার পরামর্শ। গাছ থেকে ফল পাড়ে। ফলের বদলে রোজ সকালে জুতো পাড়ব? বলা যায় না, ডাল থেকে একটা সুদৃশ্য সিকা ঝুলিয়ে দেবে। এ তো কায়দার যুগ। রোজ জুতো সিকেয় তুলে বাড়ি ঢুকতে হবে!
আমার স্ত্রীর একটা ম্যানিয়া মতো হয়ে গেছে। ঘুরছে ফিরছে, ঘাড় কাত করে পাশ থেকে আলোর বিপরীতে দেখছে মেঝেতে দাগ পড়েছে কি না। পড়লেই স্পেশ্যাল ন্যাতা দিয়ে, জল দিয়ে, লিকুইড ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করছে। আমারও রেহাই নেই। বসতে দেখলেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠছে, ‘কী বসে বসে বাসী খবরের কাগজ পড়ছ! যাও ধাপ আর মেঝের স্কাটিংগুলো একটু পরিষ্কার করো না।’
বাড়ি করার পর একেই তো আমার চেহারাটা অষ্টাবক্র মুনির মতো হয়ে গেছে, তার ওপর চব্বিশ ঘণ্টা এই অত্যাচার। দেয়ালে পিঠ রেখে বসা যাবে না। দেওয়ালের রং চটে যাবে। মাথার পেছন লাগানা যাবে না। ছোপ ধরে যাবে তেলের। বাথরুম থেকে বেরিয়ে পাপোশে পনেরো মিনিট পা ঘষতে হবে। জল থাকলেই ঝকঝকে মেঝেতে দাগ পড়ে যাবে। কোথা থেকে একজোড়া ছেঁড়া মোজা জোগাড় করে দিয়েছে, সেই মোজা পরে রোজ সকালে সারা বাড়ির মেঝে পরিষ্কার করো। টুথব্রাশ দিয়ে গ্রিলের ভাঁজ থেকে ধুলো ঝাড়ো। ঘাড় উঁচু করে দ্যাখো সিলিং-এর কোথাও ঝুল ধরছে কিনা। এই সব করতে করতেই বেলা কাবার। না পড়া হয় সকালের কাগজ, না হয় ভালো করে খাওয়া। কোনোক্রমে নাকে মুখে গুঁজে গুঁজে অফিস। প্রায়ই দাড়ি কামানো হয় না। খোলতাই চেহারায় এক মুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। লোকে জিজ্ঞেস করে, ‘কি হয়েছে বলুন তো আপনার?’
‘ভাই, বাড়ি হয়েছে।’
‘বাড়ি হলে এইরকম হয় বুঝি?’
‘অনেকে টেঁসে যায়, আমি তো তবু বেঁচে আছি।’
একদিন সকালে বাড়ি ঢোকার মুখের মেঝেটা খারুয়া দিয়ে মুছছি আর পাশে হেলে হেলে দেখছি দাগ পড়েছে কিনা, এমন সময় আমার প্রতিবেশী আশুবাবু এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী রে, বিশুবাবু আছেন?’
আমার নামই বিশুবাবু। ভদ্রলোক চিনতে পারেননি। আমি বললুম, ‘বাজার গেছেন।’
‘এলে তোমার বাবুকে বোলো দেখা করতে। শুধু বলবে ইনকামট্যাক্স।’
আমি ন্যাতা ফেলে তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম, ‘ইনকামট্যাক্স মানে?’
আশুবাবু থতমত খেয়ে বললেন, ‘আরে আপনিই তো বিশুবাবু! কী করছিলেন অমন করে, এমন অদ্ভুত পোশাকে?’
‘হাউস মেনটিনেনস। মেঝে পালিশ।’
‘মেঝে পালিশ না করে নিজেকে পালিশ করুন। চেহারার একী দশা! পায়ে মোজা পরেছেন কেন? শরীর গোলমাল?’
‘না না, এটা আমার স্ত্রীর ব্যবস্থা। মেঝেতে দাগ পড়বে না।’
‘কত রঙ্গই জানেন! কতরকমের পাগল আছে এই দুনিয়ায়! যাক; কাজের কথাটা বলে যাই। বাড়ি তো করলেন, ডিক্লেয়ারেশন দিয়েছেন ইনকামট্যাক্সে?’
‘সে আবার কী?’
‘সে আবার কী, বুঝিয়ে ছেড়ে দেবে। বাড়ি তো করলেন, টাকাটা এল কোথা থেকে? কত টাকার সম্পত্তি? ঠিক ঠিক জবাব দিতে না পারলে হাতে হ্যারিকেন!’
‘কেন, স্ত্রীর কিছু গয়না বেচেছি। ধারদেনা করেছি। কিছু জমেছিল—সব ঢুকিয়ে দিয়েছি ইটের পাঁজায়।’
‘দেখে তো মনে হচ্ছে লাখ দুয়েক গলে গেছে! মোজাইক মেঝে। সেগুন কাঠের জানলা-দরজা, বরফি গ্রিল। কত গয়না বেচলেন মশাই! ধারই বা পেলেন কোথায়? এই বাজারে সংসার চালিয়ে জমেই বা কত?’
‘মনে হচ্ছে, আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন!’
‘সন্দেহ নয়, সাবধান করতে এলুম বন্ধু হিসেবে। ওই যে মোড়ের মাথায় ক্ষীরওলা বাড়ি করেছে, ওই যে সিলভার গ্রে রঙের বাড়িটা, কোন হিতৈষী বন্ধু একটি চিঠি ছেড়ে দিলে। ব্যাস, কেঁচো খুঁড়তে সাপ!’
‘এইরকম চিঠি ছাড়ে নাকি?’
‘ছাড়বে না? বাঙালিরা কত সমাজসচেতন জানা আছে আপনার? এই যে হালফিল কালীপুজো গেল; কত আনন্দ দিয়ে গেল বলুন তো! ছেলেরা অষ্টপ্রহর গান শোনাবার ব্যবস্থা করেছিল। সারারাত সারারাত, মুহুর্মুহু বোমা ফাটিয়ে শরীরের রক্তসঞ্চালন বাড়িয়ে দিয়ে গেল। দু-চারজন টেঁসে গেল, মানে মোক্ষলাভ হল। ছোটো কথা কানে তোলার উপায় ছিল না। আবগারি বিভাগের রোজগারও বেড়েছিল। সকলেই মা-মাহা করছে। কানখাড়া করে আবার শুনলুম, মা নয় বলছে মাল। ইয়াং জেনারেশন একেবারে টং। বিসর্জনের প্রসেসন যাচ্ছে। একজন ধাক্কা মেরে নর্দমায় ফেলে দেয় আর কী! দেখি কেউই প্রকৃতিস্থ নয়। সকলের মুখেই চুল্লুর গন্ধ। সমাজসচেতন না হলে পারত এসব?’
‘আপনিও তো বাড়ি করেছেন। ডিক্লেয়ারেশান ফাইল করেছেন?’
আমার বাড়ি তো আমি আমার বউয়ের নামে করেছি। চালাক লোকেরা তাই করে।’
আশুবাবু দুর্ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। এক কাপ পানসে চা নিয়ে ‘দেওয়ানি খাস’-এ পা ছড়িয়ে বসলুম। আগে এক-শো টাকা কেজির ফুরফুরে গন্ধঅলা চা নিয়ে বসতুম! সেই চা এখন চল্লিশ টাকায় নেমেছে। না আছে লিকার, না আছে ফ্লেভার। বাড়ি করে ‘পপার’ হয়ে গেলুম। এখন দুম করে ভারী রকমের কারোর অসুখ করলে বিনা চিকিৎসায় মরবে। সামনেই আসছে বিয়ের মাস। গোটা তিনেক নিমন্ত্রণ-পত্র আসবেই। বাড়িতে দেবার মতো যা ছিল সবই দেওয়া হয়ে গেছে। মাছের তেলে মাছ ভাজার আর উপায় নেই।
সেই হলুদ বাড়ি থেকে কিছুক্ষণ পরেই অষ্টাবক্র মুনির মতো একটি লোক বেরিয়ে এল। হাতে একটা ঢাউস ব্যাগ। পকেটে দশটি মাত্র টাকা। সেই টাকায় আলু হবে, কপি হবে, মাছ হবে, মাংস হবে। মাথাধরার ওষুধ হবে। গায়ে মাখা সাবান হবে। দাড়ি কামাবার ব্লেড হবে। আমার বউ বলে, বাড়িওলাকে একটু কষ্ট করতে হয়। ট্যানা পরে ঘুরতে হয়। ভোলামহেশ্বরের কথা ভাবো।
উলটো দিক থেকে বিকট শব্দ করে একটা মোটরবাইক আসছে। দেখেই বুকটা ধক করে উঠল। গ্রিলওলা এখনও অনেক টাকা পাবে। মোটাসোটা, গাঁট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোক। আমাকে জমিয়ে একটা ঘুষি মারলে আর তিন দিন উঠতে হবে না। আমি সঙ্গেসঙ্গে পেছন ফিরে দাঁড়ালুম। পাওনাদারের কাছে পেছনও নেই সামনেও নেই। মোটরবাইক ঠিক আমার পেছনে এসে থেমে পড়ল। ভুটভুট ভুটভুট মধুর শব্দ। সেই শব্দ ছাপিয়ে গলা, ‘আপনার কাছেই যাচ্ছি। আজ কিছু দেবেন তো?’
ঘুরে দাঁড়াতেই হল। ভেবেছিলুম সকালেই পাওনাদারের মুখ আর দেখব না। বললুম, ‘বাজারে যাচ্ছি। আপনি যান। ওসব এখন আমার স্ত্রীই দেখছেন।’
মোটরবাইক ভটভটিয়ে বাড়ির দিকে ছুটল। কী হবে তা জানি না। মোড়ের কাছাকাছি এসে দেখি একটা সাইকেল ঢুকছে। মরেছে! ইটখোলার মালিক। বেশ ভালোই পাওনা। নগদে শুরু করেছিলুম, ধারে ফিনিশ করেছি।
‘এই যে বিশুবাবু, আপনার ওখানেই যাচ্ছি। আজ কিছু দেবেন তো?’
‘চলে যান। সব আমার স্ত্রীর কাছে।’
সাইকেল চলে গেল। মনে পড়ল অল রোড লিডস টু রোম! হরেনের পান-বিড়ির দোকানের কাছাকাছি আর এক পাওনাদার। ফটিকবাবু। আমার কনট্র্যাকটর, নীলরঙের শার্টের বুকপকেটটা ডিমভরা ট্যাংরা মাছের পেটের মতো, প্রায় ফাটোফাটো অবস্থা। আমি জানি ওই পকেটে কী আছে! সেই মারাত্মক লোমওঠা কুকুরের মতো মলাটওলা মাঝারি মাপের নোটবুকটা আছে। যার পাতায় বর্গমিটার আর ঘনমিটারের হিসাব। আমাদের মতো চিৎ হয়ে শোয়া কুঁজোদের বধ করবার ব্রহ্মাস্ত্র। খাতা খুলেই বলবেন, লিনট্যাল, ছাজা, সানশেড, বিম, পিলার, ঢালাই বাবদ, একটু থামবেন,—তারপর এমন একটা অঙ্ক বলবেন, শোনামাত্রই শুয়ে পড়তে হবে!
ফটিকবাবু বললেন, ‘আপনার কাছেই যাচ্ছি। আজ কিছু দেবেন তো? কিছুটা ক্লিয়ার করুন। আর কতদিন ফেলে রাখবেন?’
একগাল হেসে বললুম, ‘যান, বাড়িতে যান না। এখন থেকে সবই আমার স্ত্রী দেখছেন।’
ফটিকবাবু নাচতে নাচতে চলে গেলেন। দু কদম এগোতে না এগোতেই প্যাটেলের ছেলে। জানলা, দরজা, ফ্রেম, এইসব সাপ্লাই করেছিল। কত দেওয়া হয়েছে, আর কত যে পাবে, আমার কোনো ধারণা নেই। তাকেও হাসিমুখে বাড়িমুখো করে দিলুম।
বাজার প্রায় এসে গেছে। শীতের মুখ, মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি টাটকা কপি, নতুন আলু, গলদা চিংড়ি। বুকপকেটে ময়লা একটা দশটাকার নোটমাত্র সম্বল। হাতে বিশাল এক ব্যাগ। প্রথমে কিছু ইটপাটকেল ভরব। তারপর এককিলো আলু, একফালি কুমড়ো, দু বাণ্ডিল নটেশাক কিনে, একজোড়া ফুল কপি হাত দিয়ে ধরব। ধরে আদর করে ছেড়ে দেব। তারপর মাছের বাজার গিয়ে একটা বড়োসড়ো মাছের খুব কাছে গিয়ে, ফিসফিস করে বল, ‘অহো কী সুন্দর!’ তারপর তার চিকন শরীরে একটু দীর্ঘশ্বাস মাখিয়ে ফিরে আসব। আসার পথে পঞ্চাশগ্রাম কাঁচালঙ্কা কিনব। কিনব টাকায় ছটা পাতিলেবু।
সব শেষ করে বাড়িমুখে হতে গিয়েও থেমে পড়লুম। বাড়িতে তো এখন যাওয়া যাবে না। সেখানে তো চলছে পাওনাদারদের দক্ষযজ্ঞ। ঘুপচি মতো একটা চায়ের দোকানে ঢুকে এক কাপ চায়ের হুকুম দিলুম। অনেকক্ষণ পরে একটা সিগারেট ধরাবার সুযোগ হল। যখন তখন ফুসফাস সিগারেট খাবার মতো সঙ্গতি আর নেই। ভালো বাসা মোরে ভিকিরি করেছে!
চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা সবে নামিয়েছি, দোকানদারকে পয়সা দিতে দিতে মোটামতো শ্যামবর্ণ এক ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিশ্বনাথবাবুর বাড়িটা কোথায়?’
‘কে বিশ্বনাথ?’ দোকানদার যেন বিরক্ত হলেন।
‘নতুন বাড়ি করেছেন। এই কাছাকাছি কোথাও।’
আমি আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলুম, ‘বিশ্বনাথবাবুর বাড়ি খুঁজছেন কেন?’
‘আপনি চেনেন?’
‘কেন খুঁজছেন বলুন?’
‘আমি ইনকামট্যাক্সের লোক।’
সঙ্গেসঙ্গে দোকানদার বললেন, ‘জানেন তো বলে দিন না!’
‘আমিই সেই অধম। আমার নাম বিশ্বনাথ বোস।’
ভদ্রলোকের মুখে দেখে মনে হল অনেকদিনের এক পলাতক আসামীকে ধরে ফেলেছেন। ‘বিশ্বনাথ বোস? চলুন বাড়ি চলুন, কথা আছে।’
বাড়ির বাইরে তখন সব সার দিয়ে বসে আছে। গ্রিলঅলা, কাঠঅলা, ইট-চুন-সুরকিঅলা, কনট্রাকটর—তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রী। মুখে মোনালিসার হাসি। ইনকামট্যাক্সের ভদ্রলোককে সামনে খাড়া করে দিয়ে বললুম, ‘এই নাও, আর একজন! ইনি আরও বড়ো পাওনাদার, পাওনাদারদের মহেশ্বর, খোদ ইনকামট্যাক্স। যথাবিহিত সম্মানপুরঃ নিবেদনমিদম!’
আমার স্ত্রী আরও মধুর হেসে বললেন, ‘ভালোই হয়েছে এসেছেন, ইনকামের জীবন্ত সব সোর্স এই সামনে লাইন দিয়ে বসে আছেন। আর আমি মা দুর্গা। কেউ আমাকে গ্রিল দিয়েছেন, কেউ দিয়েছেন কাঠ, কেউ দিয়েছেন বাঁশ, কেউ দিয়েছেন চুন-সুরকি। এই আপনার সোর্স। সবাই এখন গলায় গামছা দিয়ে পাক মারছেন। আপনিও মারুন।’
আমার সেই মুহূর্তে মনে পড়ল গানের লাইন—ওই দেখা যায় বাড়ি আমার, চৌদিকে মালঞ্চ নয়, পাওনাদারের বেড়া!