ভালোবাসা

ভালোবাসা

তপনের আজকাল প্রায়ই মন খারাপ থাকে। প্রায়ই সে একা একা দাঁড়িয়ে থাকে জানলায়, অথবা ছাদে উঠে ঘুরে বেড়ায়, আর মনে হয়, পৃথিবীতে আমাকে কেউ ভালোবাসে না।

তা যদিও সত্যি নয়, বাবা—মা তাকে খুব ভালোবাসে, আর ছোট মাসি তো এলেই তাকে কত আদর করেন। দাদা তাকে মাঝে মাঝে খুব বকুনি দেয় বটে, দাদার বই—পত্তরে হাত দিলে খুব চটে যায়, কিন্তু দাদাও তো তাকে চকোলেট কিনে দেয়, মুড়ি কেনার পয়সা দেয়। আর তাদের বুড়ো চাকর বেচারাম তো তপনের সব কথা শোনে। তবুও যে তপনের কেন মনে হয়, আমাকে কেউ ভালোবাসে না।

গত মাসে তপন তের থেকে চৌদ্দ বছরে পা দিয়েছে। হঠাৎ কিরকম তাড়াতাড়ি সে লম্বা হয়ে যাচ্ছে, এখন সে মায়ের চেয়েও লম্বা! গত বছর পুজোর সময় কেনা—জামা এখন তার ছোট হয়। গলার আওয়াজটাও কি রকম ভাঙা ভাঙা আর মোটা হয়ে গেছে, নিজের গলা বলে চেনাই যায় না।

এখন আর সে মা—বাবার সঙ্গে এক বিছানায় শোয় না। মা তাকে বলেছিলেন দাদার সঙ্গে শুতে, কিন্তু তপন রাজি হয়নি। দাদা ঘুমের মধ্যে যা লাথি মারে! এখন তপনের আলাদা খাট। এক—একদিন মাঝ—রাত্রিতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে তপনের কিরকম ভয় ভয় করে। না, তপন ভূতের ভয় পায় না। সায়েন্স বইতে সে পড়েছে, ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু ঘুম ভাঙার পর মনে হয়, সমস্ত পৃথিবীটা কি অসম্ভব চুপচাপ, একটা কুকুর শুধু দূরে কান্নার মতন ডাকছে আর কোথাও কেউ নেই যেন। তখন তপনের মনে হয়, আমি কি ভীষণ একা, আমাকে কেউ ভালোবাসে না।

দুপুর থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে, তপন স্কুল থেকে ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলো। আজ আর বিবেকানন্দ পার্কে খেলতে যাওয়া হবে না। ঘুড়ি ওড়ানোরও উপায় নেই। তপন এখন কি করে? গল্পের বইও কিছু নেই। সব পড়া বই—আর দাদার বইতে হাত দিলেই তো দাদা বলবে, বড়দের বই পড়তে নেই! কি হয় বড়দের বই পড়লে? তপন তো লুকিয়ে লুকিয়ে দাদার আলমারির তিন—চারখানা বই পড়েছে, কিছু তো হয়নি! তবে বইগুলো বড্ড একঘেয়ে, খালি কথা আর কথা!

মা পাশের বাড়ির শান্তি পিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন, সেখানে গিয়ে তপন দাঁড়াতেই ওরা চুপ করে গেলেন। তপন এখন বুঝতে পারে, চুপ করে যাওয়া মানে তার সামনে ওঁরা এখন কথা বলতে চান না। তপন সেখান থেকে চলে এলো। দাদার ঘরে দাদা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে আর লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছে। সেখানে যেতেই দাদা বকুনি দিয়ে উঠলো, তুই এখন যা এখান থেকে।

তপন কোথায় যাবে? পাশের বাড়ির টুলটুলের সঙ্গে সে আগে ক্যারাম খেলতো। কিন্তু টুলটুলটা শাড়ি পরতে শিখে কেমন যেন বদলে গেছে! এখন সব সময় সে মেয়েদের সঙ্গে মেশে, আর মাঝে মাঝে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কি বলেই অমনি হাসিতে গড়িয়ে পড়ে! মেয়েদের সব সময়েই হাসি! ওদের এইজন্য ভালো লাগে না তপনের। টুলটুল এখন আর তার বন্ধু নয়। তবু তপন জানলা দিয়ে ডাকলো, এই টুলটুল, আয় ক্যারাম খেলবি? টুলটুল আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত। তপনকে রীতিমতো অবজ্ঞা করে উত্তর দিল, না, আমি জামাইবাবুর সঙ্গে সিনেমার যাবো।

তপন একা একা ছাদের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো। বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টে। তার খুব মন খারাপ। তাকে কেউ ভালোবাসে না।

আর দু—দিন পর, তপন রাস্তা দিয়ে তন্ময় হয়ে হেঁটে আসছিল, চোখ আকাশের দিকে, সে ঘুড়ির প্যাঁচ খেলা দেখছে। কোন ঘুড়িটা কাটবে, এটা না দেখা পর্যন্ত সে চোখ ফেরাতে পারে না। কালো চাঁদিয়ালটা দুলতে দুলতে আসছে। কতকগুলো রাস্তার ছেলে ছুটেছে সেটাকে ধরার জন্য। ঘুঁড়িটা বকুল গাছেই আটকাতো, হঠাৎ গোঁত খেয়ে চলে গেল মাঝ—রাস্তার দিকে, আর একটা বাচ্চা ছেলে তীরের মতো ছুটে গেল সেদিকে।

তপন চেঁচিয়ে উঠলো, এই! এই! গাড়ি! একটা গাড়ি যে খুব কাছেই ছেলেটা দেখেনি। তপন আর থাকতে পারলো না, সে এক দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ছেলেটাকে। তারপরই কি হলো, তপনের আর জ্ঞান নেই!

কাছেই তপনের বাড়ি। পাড়ার লোক চিনতে পারলো। মোটর গাড়িটার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে তপনের। বিশেষ কিছু নয় অবশ্য। সেই গাড়ির ড্রাইভার এবং অন্যান্য লোকেরা ধরাধরি করে তপনকে নিয়ে এলো বাড়িতে।

এই তপু! এই তপু!

যেন খুব দূর থেকে একটা ডাক শোনা যাচ্ছে। তপন আস্তে আস্তে চোখ মেললো। চোখের সামনেই তার মায়ের মুখ। কান্নায় ভেসে যাচ্ছে। বাবার মুখে কি দারুণ উৎকণ্ঠা। দাদা কোনোদিন এই সময় বাড়িতে থাকে না। দাদাও ব্যগ্রভাবে ডাকছে, এই তপু। বেচারামেরও মুখ শুকনো। টুলটুলও এসেছে, তার মুখ দেখেও মনে হয়, এক্ষুনি সে কাঁদবে।

তপনের আর ব্যথা নেই। তার খুব আরাম লাগছে। ঘরে সবার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, সবাই কি দারুণ উৎকণ্ঠিত তার জন্য। বুঝতে পারলো এরা সবাই তাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *