ভালবাসা

ভালবাসা

বড় হয়ে গেলাম কিন্তু ভালবাসার মাথামুন্ডু আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাদের সেকেলে গিন্নিরা শুনেছি স্বামী ছাড়া কিছু জানেন না। এটা যে খুব প্রশংসনীয় কাজ তাতে কোনও সন্দেহ নেই, বিশেষ করে যা মেজাজ একেকটা স্বামীর আর যা চেহারা! এখনকার চেহারা বিয়ের সময়ে কল্পনা করতে পারলে দেখা যেত কে কাকে কতখানি ভালবাসে৷ হ্যাঁঃ।

তবে ওই যা বলছিলাম, বিয়ে দিয়েই যদি ভালবাসার বিচার করতে হয়, বিশেষত যেসব ক্ষেত্রে নিজেরা পছন্দ করে বিয়ে করেছে, তবে বলিহারি, বাপু! প্রথম কথা হল গোড়াতেই যে কী দেখে কে কাকে ভালবেসে ফেলে, তাই বোঝা দায়।

বছর চল্লিশ আগে আর জি কর হাসপাতালে আমার গলব্লাডার অপারেশন হয়েছিল। আমার জন্যে রসময়ী বলে একজন দাইকে রাখা হয়েছিল। কাজকর্মে অতিশয় পটু আর তার চেয়েও বড় কথা, উদয়াস্ত নানা রসের কথা বলে আমাকে খুশি রাখত।

দেখতে ভাল না। মোটা, বেঁটে, কালো, থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট। কিন্তু সবটার ওপরে এমন একটা সস্নেহ অমায়িক ভাব যে আমার তাকে বড্ড ভাল লাগত। ও সধবা কি বিধবা ঠাওর হত না। পরনে সরু পাড় ধুতি, খালি হাত, গলায় সোনার বিছে হার, কানে সোনার মাকড়ি।

সেকালের পক্ষে ভাল রোজগার ছিল। মাসে শদুই তো হবেই। বলেছিল ভাইপোর বাড়িতে পয়সা দিয়ে থাকে। বউ খুব যত্ন করে। রাতে পায়ে তেল মালিশ করে দেয়। দেবে না-ই বা কেন? পিসি মলে ওরাই সব পাবে। চটালে শেষটা কী হতে কী হয়ে যাবে কে জানে!

এক দিন রসময়ীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার স্বামী নেই?’ রসময়ী আকাশ থেকে পড়ল। ‘নেই মানে? আছেই তো! খুব বেশি করেই আছে। আমাকে পছন্দ হয়নি বলে আরেকটা বে করে, নারকেলডাঙার ওদিকে খোলার ঘর তুলে রয়েছে।

‘পাশে একটা দোতলা বাড়ি। সেখানে আমার সই গেছল। অনেক দিন থেকে সেই মেয়েমানুষটাকে দেখার বড় শখ ছিল। কত বড় সুন্দরী সে! কী বলব দিদি, দেখে আমি হাঁ হয়ে গেনু! এ কী তাজ্জব ব্যাপার! এই লম্বা হটকা শিড়িঙে চেহারা, কুচকুচে কালো, উটকপালী, উঁচু দাঁত, মাথার সামনে টাক! বলিহারি পুরুষ-মানুষের পছন্দ। ওকে নিয়ে সুখে থাক। আমার কোনও আপত্তি নেই!’

এই বলে আমার চায়ের পেয়ালা তুলে নিয়ে, দুম দুম করে রসময়ী চলে গেল।

মাঝে মাঝে মধুপুরে গিয়ে আমার ভাসুরদের বাড়িতে কিছুদিন কাটিয়ে আসতাম। পুজো থেকে দোল পর্যন্ত বড় চমৎকার সময় সেখানে। ওঁরা ছুটি কাটাতে যেতেন, অন্য সময় বাড়ি খালিই পড়ে থাকত; মালিরা দেখাশুনো করত।

আমার বড়-জা কেবলই বলতেন, ‘মালিদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিস। ছোটনা, বুধুয়া, পাঁচু— এরা লোক ভাল, কিন্তু বেজায় কুঁড়ে। তবে ওদের বউরা ভাল। বিশেষ করে পাঁচুর বউ লখিয়া।’

বাস্তবিকই তাই। সে যে না বলতেই আমার কত কাজ করে দিয়ে যেত, তার ঠিক নেই। আমারও বয়স তখন কম ছিল, গিন্নিপনায় আনাড়ি ছিলাম। লখিয়া আমার সমবয়সি বন্ধুর মতো ছিল। সারি সারি গুদোমঘরে দু’-তিন বাড়ির মালিরা পরিবার নিয়ে থাকত। বুধুয়া ছিল সবার বুড়ো। বয়স ষাটের কাছাকাছি, চুল পাকা, শরীরটাও পাকানো দড়ির মতো।

একবার আমি গিয়ে পৌঁছতেই, বড়দিদি বললেন, ‘আমরা কাল চলে যাচ্ছি, তুই খুব সাবধানে থাকিস। আর ওই বদ মেয়েমানুষ লখিয়াটাকে ঘরে ঢুকতে দিবি না।’ আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ‘কেন, বড়দি?’

বড়দিদি হাঁড়িমুখে বললেন, ‘সে তোর শুনে কাজ নেই।’ ‘বলুন না কী ব্যাপার।’

বউদিদি বললেন, ‘কী আবার ব্যাপার! পাঁচুকে ছেড়ে, বুধুয়ার সঙ্গে ঘর করছে।’

শুনে আমি আরেকটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম! বুধুয়ার অন্যান্য গুণের ওপর, সে পাঁচুর আপন জ্যাঠামশাই! আর পাঁচু দেখতে কী ভাল! সে যাই হোক, বড়দিদিরা তো চলে গেলেন। একটু পরেই দেখি লখিয়া বাড়ির বাইরে ঘুর-ঘুর করছে। আমি বেরিয়ে আসতেই বলল, ‘বাসনগুলো মেজে দিয়ে যাই, কাকিমা?’

আমি বললাম, ‘বড়মা তোকে ঘরে ঢুকতে দিতে মানা করে গেছেন। এটা কী করলি লখিয়া? বুড়োর ষাট বছর বয়স, চিমড়ে চেহারা, ওই বদ্‌রাগী! আর পাঁচু কী সুন্দর, কী ঠান্ডা মেজাজ। তা ছাড়া বুড়ো তোর জ্যাঠশ্বশুর হয় না?’

লখিয়া বুক ফুলিয়ে, ঘাড় উঁচু করে, সোজা আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘তা কী করব, উনার সঙ্গে ভালবাসা হয়ে গেল যে!’ যেন এ বিষয়ে আর কোনও কথাই হতে পারে না। তারপর দাপিয়ে চলে গেল। আর ওকে দেখিনি।

আমাদের এক পাতানো ছোটঠাকুমা ছিলেন, তাঁর বেলা ঠিক এর উলটো দেখলাম। ঠাকুমা দেখতে কী ভাল, কিন্তু ঠাকুরদা! হাজার গুণী হলেও বেঁটে মোটা, বেজায় পেটুক, নিজের বিষয়ে বড় বড় কথা বলতেন, খিটখিটে, খুঁতখুঁতে। কিন্তু সবাই বলত ওঁরা আদর্শ স্বামী-স্ত্রী। বিয়ের আগে পরস্পরকে একটিবার দেখেই সেই যে ভালবেসে ফেলেছিলেন, তারপর ৫২ বছরেও সেই ভালবাসায় এতটুকু ছেদ পড়েনি। গুণ দেখেই নাকি ঠাকুমা মুগ্ধ হয়েছিলেন, কন্দর্পকান্তি নিয়ে কি ধুয়ে খেতেন?

ওই তো ছোট শরিকদের রাঙা পিসেমশাইটি আছেন, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নাকি তাঁর রূপ দেখে তাঁকে নাটকে পার্ট দিতেন। অথচ সারাজীবন রাঙাপিসিকে কি কম জ্বালিয়েছেন! ভালবাসা আলাদা জিনিস। টাকাকড়ি রূপ— এসব তুচ্ছ জিনিসের সঙ্গে তার সম্বন্ধ নেই।

একবার ছোটঠাকুমাকে চেপে ধরা হয়েছিল। পাকা আমটির মতো মানুষটি ফিকফিক করে হেসে বললেন, ‘সে এক ব্যাপার, ভাই! চিড়িয়াখানায় দেখা হল। আমি এনট্রান্স পাশ করেছি, উনি নতুন ডেপুটি হয়েছেন। সামনাসামনি বসিয়ে “খুকু একটা কবিতা বল তো” তো আর চলে না।

‘ওই যে বড় পুকুরে কালো হাঁস ভাসে, তারই পাশে আমরা চার বোন মা-মাসিদের সঙ্গে বসে গল্প করতে লাগলাম। আর ওনারা পাঁচ বন্ধু পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন, নিজেদের মধ্যে যেন কতই অন্যমনস্কভাবে কথা বলতে বলতে।

‘ওরই মধ্যে চারি চক্ষুর মিলন হল, সঙ্গে সঙ্গে পছন্দও হয়ে গেল। কপাল ঘেমে গেল। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। আমি মা’র কাছে মত দিয়ে ফেললাম। এক মাসের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল। সেই ইস্তক পরম সুখে আছি। তবে কী জানিস—’ এই বলে ছোটঠাকুমা উঠে পড়লেন।

আমরা ছাড়ব কেন! ‘না, তোমাকে বলতেই হবে— তবে কী জানিস মানে কী?’

ছোটঠাকুমার ফরসা গাল লাল হয়ে উঠল, ‘সত্যি কথা বলতে কী জানিস, আমি আসলে ওঁকে চিনতে পারিনি। ওঁর বন্ধু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সঙ্গে ছিলেন, তাঁকেই পছন্দ করে ফেলেছিলাম। তা এই বা মন্দ কি? ৫২ বছর কেমন সুখে— খুব একটা শান্তিতে না হলেও— কাটিয়ে তো দিলাম। এর বেশি কী আশা করতে পারতাম?’

ওই যে গোড়ায় বলেছিলাম ভালবাসার কথা আর বলবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *