ভার্যাং মনোরমাং
কিছুদিন আগে কাশীতে বড় সুন্দর একটি দৃশ্য দেখেছিলাম। এখনও মনে লেগে আছে। গোধুলিয়ার মোড়ে একটি হোটেলে উঠেছিলাম। যে ঘরে ছিলাম, সেই ঘরের পেছনের দিকের জানালাটি খুললেই নির্জন একটি রাস্তা। রাস্তার পরপারে প্রাচীন একটি বটবৃক্ষ। তার পাশেই বড় নিরিবিলি দোতলা একটি বাড়ি। বেনারসের বাড়ি সাধারণত যেমন হয়। চারপাশ দিয়ে বারান্দা ঘুরে গেছে। একটু অন্ধকার অন্ধকার, মনমরা।
একদিন সকালে সেই জানালাটির দিকে চোখ চলে যেতেই মনোরম একটি ছবি ভেসে উঠল। বারান্দাটিতে এক বৃদ্ধ এসে বসেছেন। একমাথা দুগ্ধধবল চুল। পরনে পরিষ্কার একটি ধুতি, গায়ে অনুরূপ পরিষ্কার একটি গোলগলা গেঞ্জি। চোখ দুটি উদাস। দেখলেই মনে হয়, বিষয় থেকে অ-বিষয়ে মনটি উড়ে গেছে।
বুড়ো বটের একটি ডাল বারান্দায় ঝুঁকে আছে। গুটিকয় পাতা বাতাসে চঞ্চল। নিজের রাস্তা দিয়ে চলেছে মানুষজন, কয়েকজন হিপি। বৃদ্ধকে দেখতে বড় ভালো লাগছিল। সৌম্য শান্ত। বসে আছেন বটের ছায়ায় আকাশের দিকে চোখ মেলে। হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধা। পরনে চওড়া লালপাড় শাড়ি। সদ্য স্নান করেছেন। পিঠের দিকে এলিয়ে দিয়েছেন জীবনের শেষ প্রান্তে মাথায় যে কটি চুল থাকে, সেই অবশিষ্ট কাঁচাপাকা কেশভার। গলার কাছে সকালের আলো পড়ে চিকচিক করছে ছিলেকাটা সোনার হার। মাথায় জ্বলছে সিঁদুরের রেখা।
বৃদ্ধা হাঁটুমুড়ে বৃদ্ধের পাশে বসলেন। হাতে একটি বাটি। সেই বাটি থেকে চামচ দিয়ে তুলে-তুলে বৃদ্ধকে কী যেন খাওয়াতে লাগলেন। মা যেমন শিশুটিকে খাওয়ায়। মাঝে-মাঝে আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন।
দৃশ্যটি এখনও আমার মনে আছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যদি ঠিক রাস্তায় চলে, শেষ জীবনে তার পরিণতি এই রকম স্বর্গীয়ই হয়। মন্ত্র পড়ে, অগ্নি সাক্ষী করে দুটি জীবনকে কবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, দূর অতীতে। কোনও এক শহরে। হয়তো সানাই বেজেছিল। খুব ধুমধাম, খুব ঘটা। এই পলিতকেশ বৃদ্ধ তখন ছিলেন সুপুরুষ যুবা। বৃদ্ধা ছিলেন লাবণ্যময়ী যুবতী। নতুন খাট, নতুন বিছানা, নতুন শাড়ি, নতুন সংসার। যে সংসারের ঘটনা, সেই সংসারের অভিভাবকরা তখন বিদায়ী। সংসারের যা নিয়ম। এক আসে, এক যায়। অভিষেক আর বিদায়ের খেলা। এক কত্তা যায় তো এক কত্তা আসে।
সুখে, দু:খে, আনন্দে, নিরানন্দে, মিলনে, বিচ্ছেদে, কখনও অভাবে, কখনও প্রাচুর্যের পথে হাঁটতে-হাঁটতে যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব, পৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্য। হিন্দু বিবাহের গাঁটছড়াটি বড় প্রবল। সহজে খোলার নয়। কেউই কারুর পরিচিত নয়। অথচ একটি রাতের পরিচয়ে গড়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য। একটি সম্পর্ক। পর সহসা এত আপন, অনেকটা এক দেহ, এক প্রাণ, এক হৃদয়ের মতো। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সন্তান, সবই যেন দূরের মানুষ। একটা জায়গা অবধি এসে তাঁরা আর কাছে আসতে পারেন না। নিজের অহঙ্কারের বন্ধনীতে বাধা পান। ট্রেনের দুটি কামরার মতো, বাফারের ব্যবধান থাকবেই। একমাত্র স্ত্রী, দীর্ঘকালের হিন্দু সংস্কার যাঁকে শিখিয়েছে : যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম। সমস্ত অহংকার বিলীন করে মিশে যাওয়া। তিনিই পারেন জীবনের সঙ্গে নি:শেষে মিলে যেতে।
প্রচণ্ড দু:খের দিনে, সবাই যখন দূরে-দূরে সরে পড়ে, তখন স্বামীর পাশে আর কেউ না থাকুক, স্ত্রী থাকেন। সংস্কারটাই এই রকম, তুমি আমাকে সুখে রাখলে সুখে। দু:খে রাখলে দু:খে। তোমার আর আমার একই পথ।
সেকালে আদর্শ দম্পতির অভাব ছিল না। নিষ্ঠায়, সেবায়, বিশ্বাসে, আদর্শপরায়ণতায়, দীনের কুটিরেও ঈশ্বরের আসন পাতা হত। দাম্পত্য জীবনের সুখ ঐশ্বর্যে আছে কি না জানি না, শিক্ষায় আদর্শ দম্পতি তৈরি হয় কি না সন্দেহ আছে। সংসারকে বলা হয় ধর্ম। বিবাহ ধর্ম। ধার্মিক না হলে সুখী হওয়া অসম্ভব। শিক্ষা আর প্রাচুর্যের বিশ্রী একটা অহংকার থাকে। অহংকার এক ধরনের খাদ। অহংকারকে বের করে ফেলে না দিতে পারলে, খাঁটি না হলে, যৌগধাতু হওয়া অসম্ভব। প্রাচীন শিক্ষায় মানুষ গভীর হত, খাঁটি হত। আধুনিক শিক্ষা প্রথমে মানুষের অহমিকার আগুনে বাতাস মারে, তারপর আপাত চাকচিক্য বাড়িয়ে নির্জীব একটি পদার্থ বানিয়ে ছেড়ে দেয়। মনের পরিসর কোথায়? জ্ঞানের খুপরি হয়ে আমরা সুখের চাবিকাঠি হারিয়ে ফেলেছি। অথচ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে একটি প্রশ্নই বিশাল আকার নেয়, আমি কি সুখী?
প্রবীণ একজন মানুষ বড় সুন্দর কথা বলেছিলেন, সুখ সুখ করছ, কিন্তু তোমার জীবনের ভূমিকাটি কী ছিল বাপু! সুখের জন্যে তুমি জমি তৈরি করে ছিলে? বীজ বপন করেছিলে? কেরিয়ারের পেছনে ছুটেছ, জীবিকার ঘোড়া ধরতে দৌড়েছ, অর্থের ভজনা করেছ, বিশ্বাসের চাষ কি করেছ? তফাৎ যাও তফাৎ যাও করলে ব্যবধানই বাড়ে, শেষ জীবনটা নি:সঙ্গই কাটাতে হয়।
এ দেশে এখন বিদেশি বাতাস বইছে। কীভাবে জানি না, আমাদের মগজ ধোলাই হয়ে গেছে। বিবাহকে আমরা এখন বলছি, একটা চুক্তি। আদালতে বিচ্ছেদ মামলা ঝুলছে হাজারে-হাজারে। আমাদের সংস্কারে কিন্তু বিচ্ছেদ নেই, আছে মিলন। খোরপোশ হয়তো আদালতের বিচারে মিলবে। অহং হয়তো পরিপুষ্ট হবে। জোর গলায় হয়তো বলা যাবে, হামভি মিলিটারি, তোমভি মিলিটারি। তারপর? একবার জোড় খুলে গেলে দাগ থাকবেই। তখন দ্বিতীয় বার জুড়তে গেলে সে জোড় আর তেমন মিলবে না। কারণ, আমরা ভারতীয়। বেদকে অস্বীকার করলেও নির্বেদ থেকে যাবে। আমরা বুঝি, কিন্তু জ্ঞানপাপী।
এই দেশেই ছিলেন বুনো রামনাথ। বসে সারাদিন জ্ঞানের চর্চা করতেন, আর হাসিমুখে দারাসহ তেঁতুলপাতার ঝোল খেতেন। বিদুরের খুদকুঁড়ো খেতে আসতেন স্বয়ং ভগবান, কারণ তাঁরা পুণ্যের সংসার গড়ে তুলতে জানতেন। ঐশ্বর্যের সংজ্ঞা সে যুগে সোনাদানায় সীমাবদ্ধ ছিল না।
হালফিল, বিদেশি একটা ঘটনায় আমাদের চোখ খুলে গেল। আর্থার কোয়েসলার ব্লাড ক্যানসারে ভুগছিলেন। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্ত্রী বললেন, তুমি যদি যাও, আমিও যাব। জগতের পথে দুজন পাশাপাশি হেঁটেছেন, মৃত্যুর পথেও সেই আদর্শ দম্পতি জোড়ে হেঁটে গেলেন।
কাশীর সেই বৃদ্ধ দম্পতি এখনও আমার চোখে ভাসেন। তাঁদের আর সব আত্মীয়-স্বজন, কে কোথায় আছেন জানি না। জীবনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে একজোড়া কপোত-কপোতী, একান্তে এসে বসেছেন। স্ত্রী নিয়েছেন মায়ের ভূমিকা।