বছর দুই আগে বৃন্দাবন গিয়েছিলাম বেড়াতে। রাস্তাঘাটে, মাঠে গাছে, দালানে মন্দিরে বাঁদর দেখে আমি তো মুগ্ধ। আমি ওদের কলা কিনে খাওয়াতে ব্যস্ত। সেদিন ছিল গোবর্ধন পুজো। গোবর্ধন পুজোর আমি কিছুই জানতাম না আগে। সেদিনই দেখলাম গোবরকে পুজো করছে ওরা। প্রথমে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি, আশেপাশের কিছু লোককে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, পুজোটা কি গোবরকে করা হচ্ছে? ওরা বারবারই কনফার্ম করলো, হ্যাঁ গোবরকেই করা হচ্ছে। গোবরকে পুজো করার কারণটা জিজ্ঞেস করলাম। ওরা বললো কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বত তুলে নিয়ে পৃথিবীবাসী এবং গরুদের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। রক্ষা করেছিলেন বলে কৃষ্ণের পুজো করবে, গোবরের কেন! আমাকে ওরা ইংগিতে বুঝিয়ে দিল, গোমাতার কথা আমার ভুললে চলবে না।
এক বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল বন্ধুদের, যাদের সঙ্গে গিয়েছি বৃন্দাবনে। তারা আমাকে সঙ্গে নিলো। বিশাল বাড়ি, দেখি বাড়ির ভেতরেও গোবর্ধন পুজো হচ্ছে, মেঝেয় গোবর রেখে তার চারদিকে অনেকগুলো পুরুষ ঘুরছে আর গান গাইছে। গোবরের সামনে বাড়িতে যত খাবার রান্না করা হয়েছিল সব দেওয়া হলো, গোবর পুজো হলো, পরিক্রমা হলো, এবার খাবারগুলো ভেতরে নিয়ে গিয়ে সবাইকে খাওয়ানো হলো। খেতে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু আমরা তো জানিই, ক্ষিধে পেলে গু-গোবরও খায় লোকে।
হিন্দুদের কাছে অনেক পশুপাখির মতো গরুও পবিত্র। গোবরকে পুজো করা হয়, গরুর প্রস্রাব খাওয়া হয়। গরুর প্রস্রাব খেলে নাকি নানা অসুখ বিসুখ সেরে যায়। শিক্ষিত লোকরাও দেখেছি মূত্রপান করছে। আমি হাঁ হয়ে যাই এমন অদ্ভুত কুসংস্কারের চর্চা দেখে। কুসংস্কার আছে জানি, কিন্তু এ যখন মানুষ খুন করতে শুরু করে, তখন তো প্রতিরোধ গড়ে না তুলে কোনও উপায় থাকে না।
গরুর জন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আটজন হিন্দু গো-ভক্ত গুজরাটের একটি সরকারি ভবনের বাইরে ক’দিন আগে আন্দোলন করতে বসেছিল, ওখানে বসেই কীটনাশক পান করেছিল। অসুস্থ হয়ে পড়লে সবক’টাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, ওখানেই একজনের মৃত্যু হয়েছে। গরুকে রাষ্ট্রমাতার মর্যাদা দেওয়া এবং সারা ভারতে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ করার দাবিতে ওই ‘গো-ভক্তরা’ আন্দোলন করছেন। তাঁদের অভিযোগ, দেশের অনেক স্থানেই গরু হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা অমান্য করে গরু জবাই ও এর মাংস খাওয়া চলছে।
এ তো আত্মহত্যা। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার ঘটনাও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশের দাদ্রিতেই তো মোহাম্মদ এখলাসকে খুন করা হলো। তারপর হিমাচলে হলো, গরু বাছুর নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল লোকেরা, তাঁদের থামিয়ে মারা হলো। দু’দিন আগে ঝাড়খণ্ডে হলো। গরু নয়, মোষ নিয়ে দুটো মুসলমান লোক বাজারে যাচ্ছিল বিক্রি করতে। ওদের পিটিয়ে আধমরা করে মুখের ভেতর কাপড় ঠেসে, গলায় ফাঁস দিয়ে, গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। হিন্দু মৌলবাদীদের এহেন আচরণে তোলপাড় শুরু হয়েছে পুরো ভারতবর্ষে। অসহিষ্ণুতার বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। অনেকে প্রধানমন্ত্রী মোদিকে দোষ দিচ্ছেন, বলছেন, মোদির শিষ্যরাই এই খুনোখুনি করছে। মোদি ক্ষমতায় আছেন বলেই এরা আস্কারা পাচ্ছে। মোদি কিন্তু নিজে কখনও মৌলবাদীদের বলছেন না, গোমাংস যারা খাবে তাদের খুন করাটা খুব ভালো কর্ম। এই কর্মটি চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ তিনি কাউকে দিচ্ছেন না, বরং তিনি খুনিদের, অপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করতে বলছেন।
তাহলে কেন গো-ভক্তরা এমন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে! নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তারা খুন খারাবি করে যাচ্ছে। মানুষ বিশ্বাস করে, হিন্দুরা কখনও গোমাংস খায়নি, গরু হত্যাও করেনি। কিন্তু বেদেই আছে যে হিন্দুরা একসময় গরু হত্যা করতো এবং গো-মাংস খাওয়া হত। অধিকাংশ হিন্দু জানেই না যে ব্রাহ্মণরাও বৈদিক সমাজে গো-মাংস খেত। পণ্ডিতরা বলেন, যেহেতু গরু মানুষের কৃষিকাজে লাগতো, তাই এই প্রাণীটিকে খেয়ে নির্বংশ না করার পরামর্শ দেওয়া হতো। তার মানে কিন্তু এই নয় যে হিন্দুদের মধ্যে গরুর মাংস খাওয়ার চল ছিল না। ছিল, ধীরে ধীরে চলটি উঠে যায়।
আমি গরুর মাংস খেতে খুব পছন্দ করি। কিন্তু ভারতে বসে গরুর মাংস খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারি না। মাংসের দোকানীদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, বিফ বলে যে মাংস এখানে পাওয়া যায়, তা আসলে গরুর নয়, মোষের মাংস। শুনেই আমার মাংস খাওয়ার ইচ্ছে উবে গিয়েছে। ভারতের কোনও ম্যাকডোনাল্ডসে বিফ নেই। যত রেস্তোরাঁয় এ পর্যন্ত গিয়েছি, কোথাও বিফ পাইনি। গো-মাংস খেতে হলে আমাকে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে হয়।
আর কত মানুষকে গরু খাওয়ার, গরু নিয়ে হাটে যাওয়ার, গরু বিক্রি করার কারণে হেনস্থা হতে হবে, মার খেতে হবে, খুন হতে হবে আমার জানা নেই। চল শুরু হওয়া সহজ, চল অচল করা সহজ নয়, বিশেষ করে সেই চল-এ যদি ধর্মের গন্ধ থাকে।
দিন দিন মানুষ সভ্য হচ্ছে, ধর্মের গোঁড়ামি থেকে নিজেদের মুক্ত করছে, মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার ছুড়ে ফেলে আধুনিক হচ্ছে। কিন্তু কিছু কট্টর মুসলিম দেশের মতো ভারতবর্ষ ধর্মকে আঁকড়ে ধরছে। সামনের দিকে না হেঁটে পেছনের দিকে হাঁটছে, অতীতের দিকে হাঁটছে। মাঝে মাঝে আমার আশংকা হয়, বিশ্বের মুসলিম আতংকবাদীদের মতোই হয়তো হয়ে উঠছে হিন্দু আতংকবাদীরা। হতে না পারলেও চেষ্টা করছে। কী জানি, চেষ্টা করতে করতেই একদিন হয়তো ওদের স্বপ্ন পূরণ হবে। মুসলিম আতংকবাদীরা সারা বিশ্বে আতংক ছড়াচ্ছে। হিন্দু আতংকবাদীরা ভারতবর্ষে আতংক ছড়াচ্ছে। মুসলিম আতংকবাদীদের উদ্দেশ্য সারা বিশ্বকে ইসলামী বিশ্ব বা দারুল ইসলাম বানানো। হিন্দু আতংকবাদীদের উদ্দেশ্য সারা ভারতবর্ষকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো। দুটো হয়তো সমান ভয়ংকর নয়, তবে দুটোই ভয়ংকর।
ভারতবর্ষের বাইরে গো-মাংসের মূল্য এবং জনপ্রিয়তা আর সব মাংসের চেয়ে বেশি। আর সব দেশ ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত হলেও ভারতবর্ষ হতে পারছে না। মুসলমান শূকরের মাংস খাবে না, হিন্দু গরুর মাংস খাবে না। না খাওয়ার পেছনে কারণ ভিন্ন, কিন্তু কুসংস্কারটা একই রকম অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক, একই রকম অসার।
তারপরও বলবো, হিন্দুরা আগের চেয়ে উদার হয়েছে। একসময় হিন্দু-বাড়িতে মুরগি ঢুকতো না। মুসলমানরা মুরগি পুষতো, মুরগি খেতো। তাই দেখে হিন্দুরা অনেক ছি ছি করতো। একসময় হিন্দু-বাড়িতে পেঁয়াজ রসুন খেতো না কেউ। এখন মাংসাশি হিন্দুরা পেঁয়াজ রসুন দিয়ে মুরগি রান্না করে খায়। হয়তো আজ গরুর মাংস খেতে ভয়ানক আপত্তি, ভবিষ্যতে এই আপত্তি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। মুসলমানদের জন্য তো মদ হারাম। মুসলমানরা কি মদ খাচ্ছে না? অনেকেই খাচ্ছে। আরাম আয়েশ আর ভোগ বিলাসের জন্য মানুষ ধর্ম খোয়াতে রাজি। অনেক খুইয়েছে এ যাবৎ। হারাম জিনিস বেশিদিন হারাম থাকে না। প্রয়োজনে হারামকে হালাল করে নেওয়ার চল সমাজে চিরকালই ছিল, এখনও আছে। ইসলাম বলে কুকুর নাপাক জিনিস, কিন্তু মুসলমানের বাড়িতে কি কুকুর পোষা হচ্ছে না? ঠিকই হচ্ছে। চোর তাড়ানোর জন্যও হচ্ছে, ভালোবেসেও হচ্ছে।
যে গরুর জন্য জীবন নিতে প্রস্তুত হিন্দু সম্প্রদায়, সেই গরুকে দেখেছি শাহানশাহ-এর মতো রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। গাড়ি থেমে আছে, অথবা চলছে ধীরে। এই স্বাধীনতা আর সম্মান ক’টা গরুর ভাগ্যে জোটে। কিন্তু এই গরুই আবার নিজেদের সামান্য খাদ্য জোটাতে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়। কোথাও খাবার নেই। পার্কে কিছু সবুজ ঘাস ছিল, কিন্তু পার্কে কোনও গরুর ঢোকা বারণ।
খাবার না পেয়ে গরুরা ডাস্টবিন ঘেঁটে যা পায়, তাই খায়। তারা পলিথিনের ব্যাগ খায়, হ্যাঁ দিব্যি খেয়ে ফেলে। গরু রক্ষা সমিতিরা এসব অসহায় গরুদের কেন দেখতে পায় না, জানি না।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪ মার্চ, ২০১৬