ভারতে সমাজতন্ত্র

ভারতে সমাজতন্ত্র

করাচিতে অল ইন্ডিয়া নওজওয়ান ভারত সভার অধিবেশনে প্রদত্ত অভিভাষণ, ৫ এপ্রিল ১৯৩১

প্রিয় বন্ধুগণ,

করাচিতে অল ইন্ডিয়া নওজওয়ান ভারত সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্য আমাকে আপনারা আমন্ত্রণ করেছেন। নির্বাচনের দ্বারা আমার প্রতি কেবলমাত্র যে সম্মান আপনারা দেখিয়েছেন সেজন্য নয়, আমার প্রতি যে প্রীতি নিঃসন্দেহে আপনাদের নির্বাচনে অনুপ্রাণিত করেছিল সেজন্যও আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আপনারা এই অধিবেশনের আয়োজন করেছেন। আমাদের সামনে যে সব সমস্যা দেখা দিয়েছে, এবং যে-পথ ধরে আমাদের চলতে হবে সে বিষয়ে আশা করি কিছু আলোকপাত করতে সমর্থ হব।

আদি কাল থেকে মানুষ আরও এক উন্নত সমাজ-ব্যবস্থার অনুসন্ধানে রত। প্রাচ্যে এবং প্রতীচ্যে সমভাবে এই অনুসন্ধান চলেছে; এবং কেবলমাত্র মহাজ্ঞানী এবং স্বপ্নদ্রষ্টারাই নন, রাজনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনেতারাও এরই সন্ধান করে বেড়াচ্ছেন। আদর্শ সমাজ বা রাষ্ট্রে একটা কল্পমূর্তি বিভিন্ন আকারে বিভিন্ন দেশে প্রতিভাত হয়েছে, কিন্তু এর পিছনকার আগ্রহস্পন্দন একই ধরনের। প্রাচ্য ভূখণ্ডের অধিবাসীরা এক আদর্শ প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন। কখনও কখনও মানুষ চেষ্টা করেছে একেবারে প্রকৃতির রাজ্যে ফিরে যেতে, তাদের ধারণা, যেখান থেকে তারা এসেছে। অন্য সময় তারা চেষ্টা করেছে যুগবাহিত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোকে ধূলিসাৎ করতে, যাতে অতীতের ধ্বংসস্তুপের উপর বৃহৎ এবং মহৎ কিছু গড়ে তোলা যায়।

বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের এই কর্মপ্রচেষ্টার পিছনে মনস্তাত্ত্বিক চেতনা হল বর্তমান সামাজিক ব্যবস্থা এবং পারিপার্শ্বিকের প্রতি তীব্র অসন্তোষ এবং আমূল পরিবর্তনের আকাঙক্ষা। এই চেতনার দ্বারা তাড়িত হয়েই অসীম হতাশার মধ্যে মানুষ এই পৃথিবী ছাড়িয়ে এবং মানুষের এই অস্তিত্ব ছাড়িয়ে আর এক স্বর্গরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছেন, যেখানে মানুষ আদর্শ পরিবেশের মধ্যে এক আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। অন্যরা ভিন্ন এক কর্মপন্থা অনুসরণ করেছেন এবং মানুষের মধ্যেই এই স্বর্গরাজ্য বিদ্যমান এই বিশ্বাসে তাঁরা তপস্যা পূজা, কিংবা সঙ্গীত ও উপাসনার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে যত বেশি পরিমাণে সম্ভব শান্তি ও সুখলাভের জন্য চেষ্টা করেছেন।

এই দুই চিন্তাধারার প্রবক্তাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁদের মত গ্রহণ বা বর্জন কোনটাই আমাদের দরকার নেই। আমরা সেই আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো বা রাষ্ট্রকাঠামোর কথাই বেশি চিন্তা করব যা আমাদের সর্বোচ্চ পরিমাণে সুখবিধান করবে, মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং চরিত্রের উন্নতি সাধনে সাহায্য করবে এবং সমগ্র মানবসমাজের সর্বোচ্চ আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারবে। এ ছাড়া, যে সব পন্থায় এই লক্ষ্যে অল্প সময়ে পৌঁছানো যাবে সেগুলি অনুসন্ধান করতে আমরা আগ্রহী।

আরও উন্নত সমাজ-ব্যবস্থার সন্ধানে যুগ যুগ ধরে মানুষ আলো-আঁধারের মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য সবই চেষ্টা করেছে আদর্শ নামক সেই ছলনাময়ী আলেয়ার উপর কিছু আলোকপাত করতে। প্রায় প্রত্যেক সভ্য দেশে যুগের পর যুগ ধরে এই সব প্রচেষ্টার অনুসন্ধান এবং পর্যালোচনা খুবই আকর্ষণীয় বিষয়, কিন্তু এ কাজে সময় লাগবে অনেক এবং আমাদের আশু সমস্যা থেকে তা আমাদের অন্য পথে চালিত করতে পারে। এ কথা বললে যথেষ্ট হবে যে মানুষ এখন অগ্রগতির মতবাদটি (Theory of Pogress) স্বীকার করে নিয়েছে এবং এর বিপরীত মতবাদ, যথা মানুষের পতন এবং তার পরবর্তী ক্রমাবনতি, প্রত্যাখ্যান করেছে। এই অগ্রগতি-মতবাদটি নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

যদি আমরা যে সব সামাজিক ও রাজনৈতিক আদর্শ মানুষকে সকল প্রকার প্রচেষ্টা এবং কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে তার তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি, তা হলে আমরা কয়েকটি সাধারণ আদর্শ লক্ষ্য করব। নিজেদের হৃদয় অনুসন্ধান করে এবং কোন নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করলে আমাদের জীবন বাঁচার যোগ্য হয়ে উঠবে, এ কথা নিজেদের জিজ্ঞাসা করলে অনুরূপ ফললাভ করা যেতে পারে। এ দুয়ের যে কোনও একটি পন্থা অনুসরণ করলে, আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছই যে, যে সব নীতি হবে আমাদের সমাজ-জীবনের ভিত্তি তা হল ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা, শৃঙ্খলা ও প্রেম। আমাদের সকল কাজ এবং পারস্পরিক সম্পর্ক ন্যায়বোধের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত, এ কথা যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করার তেমন প্রয়োজন বোধ করি নেই। ন্যায়পরায়ণ এবং নিরপেক্ষ হতে হলে মানুষকে পরস্পর সমতুল্যভাবে দেখা উচিত। মানুষকে পরস্পর সমতুল্য করতে হলে আমাদের তাদের অবশ্যই স্বাধীন করতে হবে। আর্থ-সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বন্ধন মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে এবং বিভিন্ন প্রকার অসাম্যের সৃষ্টি করে। সেজন্য সাম্য স্থাপন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে সব রকম—সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক—বন্ধন থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে, এবং আমাদের সর্বতোভাবে এবং পূর্ণভাবে স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু স্বাধীনতার অর্থ অনিয়মানুবর্তিতা বা উচ্ছৃঙ্খলতা নয়। স্বাধীনতা বলতে এ কথা বোঝায় না যে, কোন আইনকানুন থাকবে না। স্বাধীনতা বলতে কেবলমাত্র বাইরের শক্তির দ্বারা আরোপিত শান্তি ও শৃঙ্খলার বদলে আমাদের নিজেদের তৈরি আইন এবং আমাদের নিজস্ব নিয়মশৃঙ্খলার প্রবর্তন বোঝায়। নিজেদের উপর নিজেদেরই আরোপিত শৃঙ্খলা দরকার কেবলমাত্র যখন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি তখন নয়, তার চেয়েও বেশি দরকার যখন আমরা স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রাম করছি সে সময়। সেজন্য নিয়ম-শৃঙ্খলা, ব্যক্তিগত বা সামাজিক যে উদ্দেশ্যেই হোক না কেন, জীবনের ভিত্তি হিসাবে দরকার। সবশেষে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা এবং শৃঙ্খলা ইত্যাদি মৌলিক নীতিগুলি প্রেম নামক আর একটি উন্নত আদর্শের দ্যোতক বা পরোক্ষভাবে তা প্রকাশ করে থাকে। মানবজাতির প্রতি ভালবাসার দ্বারা যদি না অনুপ্রাণিত হই, তা হলে আমরা সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করতে পারব না, সকল মানুষকে সমতুল্য হিসাবে দেখতে পারব না, স্বাধীনতা লাভের জন্য সকলকে সমভাবে কষ্টভোগ এবং ত্যাগ স্বীকার করতে বলতে পারব না কিংবা সঠিক নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তন করতে পারব না। সেজন্য আমার মতে এই পাঁচটি নীতি আমাদের সমাজ-জীবনের ভিত্তি হওয়া উচিত। আরও একটু অগ্রসর হয়ে বলতে চাই যে, সাম্যবাদ বলতে আমি যা বুঝি এবং যে সাম্যবাদ আমি ভারতে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, এই নীতিগুলি হবে সেই সাম্যবাদের অপরিহার্য অংশ।

আমার বিশ্বাস অনাগত ভবিষ্যতে ভারতবর্ষে একটি আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক পরিকাঠামো উদ্ভাবন করতে সমর্থ হবে যা অনেকাংশে পৃথিবীর সামনে একটি আদর্শ লক্ষ্যবস্তু রূপে প্রতিভাত হবে, যেমনভাবে বর্তমানকালে বলশেভিজম মানুষকে অনেক প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়েছে। আমি বিশ্বাস করি না যে বিমূর্ত নীতিগুলি একই উপায়ে, রূপে এবং পরিমাণে বিভিন্ন জাতি বা দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে। রাশিয়ায় যখন মার্কসবাদ অনুসরণ করা হয় তখন রাশিয়ার প্রচলিত অবস্থার জন্যই বলশেভিজমের উদ্ভব হয়। অনুরূপভাবে ভারতে যখন সাম্যবাদ অনুসরণ করা হবে তখন ভারতের প্রচলিত অবস্থা এক নূতন ধরনের সাম্যবাদ গড়ে তুলবে যাকে আমরা ভারতীয় সাম্যবাদ বলে স্বাগত জানাব। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জাতিগত মনোভাব, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এ সবই কলমের এক খোঁচায় বাতিল করা যায় না। যে কোন আদর্শ যা আমরা বাস্তবে রূপায়িত করতে চাই এগুলি তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে বা তার পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য।

অন্য দেশ থেকে নির্দেশ বা প্রেরণা অনুসন্ধান করলেও এ কথা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে অন্য দেশের মানুষকে অন্ধভাবে অনুসরণ করা আমাদের উচিত নয়। আমাদের জাতীয় প্রয়োজনে এবং আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির পক্ষে যা উপযোগী হতে পারে সে দিকে লক্ষ্য রেখে অন্যত্র যা শেখার আছে তাকেই আমাদের আত্মস্থ করা উচিত। ‘একজনের কাছে যা খাদ্য অন্যের কাছে তা বিষ’—এই প্রবাদবাক্যের মধ্যে একটি বড় সত্য নিহিত আছে। বলশেভিক মতবাদ এবং কর্মপন্থাকে যারা অন্ধভাবে অনুসরণ করতে প্রলুব্ধ হয়েছে, তাদের আমি সতর্ক করে দিতে চাই। বলশেভিক মতবাদ সম্পর্কে বলতে চাই যে, এই তত্ত্ব বর্তমানে একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে চলেছে। কেবলমাত্র মার্কসের আদি তত্ত্ব থেকে নয়, ক্ষমতা দখলের পূর্বে লেনিন ও অন্য বলশেভিকা যে নীতি প্রবর্তন করেছিলেন তার থেকেও এই তত্ত্বের ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। রাশিয়ায় প্রচলিত বিশেষ এক অবস্থার জন্যেই এই ব্যতিক্রম ঘটেছে; এই ব্যবস্থা মূল মার্কসবাদ বা বলশেভিক আদর্শের রদবদল ঘটাতে বাধ্য করেছে। বলশেভিকরা রাশিয়ায় যে সব কর্মপন্থা এবং কৌশল গ্রহণ করেছে সে সম্বন্ধে বলতে পারি যে, সে সব অপরিহার্যভাবে ভারতীয় অবস্থার উপযোগী হবে না। এর প্রমাণস্বরূপ বলতে চাই বিশ্বজনীন এবং মানবিক আবেদন সত্ত্বেও কমিউনিজম ভারতে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এর মূল কারণ তাদের সাধারণভাবে অনুসৃত নীতি এবং কৌশল এমনই—যা মানুষকে সম্ভাব্য মিত্রভাবে গ্রহণ করার বদলে তাদের আরও বিরূপ করে তুলেছে।

যা বলেছি, সংক্ষেপে তা হল আমি চাই ভারতবর্ষে এক সমাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্র। এই সাম্যবাদী রাষ্ট্র ঠিক কি আকার গ্রহণ করবে তা এই মুহূর্তে বিস্তারিতভাবে বলা সম্ভব নয়। আমরা কেবল এই সাম্যবাদী রাষ্ট্রের মূল আদর্শ এবং বৈশিষ্ট্যের একটি নক্‌শা-চিত্র দিতে পারি।

এক সম্পূর্ণ, সর্বব্যাপী এবং অবিমিশ্র স্বাধীনতার কথাই আমি আপনাদের শোনাতে চাই। আমরা চাই রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতা, যার অর্থ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এক স্বাধীন ভারতরাষ্ট্র গঠন। সকলের কাছে এটি পরিষ্কার হওয়া দরকার যে স্বাধীনতার অর্থ হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা এবং এ বিষয়ে মনে কোনরূপ অস্পষ্টতা বা অন্য ভাব থাকা চলবে না। দ্বিতীয়ত, আমরা চাই সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। প্রত্যেক মানুষের কাজের এবং প্রাণধারণের উপযোগী পারিশ্রমিক লাভের অধিকার থাকবে। আমাদের সমাজে কোনও অলস নিষ্কর্মা মানুষ থাকবে না। সকলেরই থাকবে সমান অধিকার। সর্বোপরি থাকবে ন্যায়সঙ্গত এবং সমভাবে সম্পদ বিতরণের ব্যবস্থা। এজন্য দরকার হলে রাষ্ট্রকে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সম্পদ বন্টনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, আমরা চাই সমাজে পূর্ণ সাম্যের প্রতিষ্ঠা। সমাজে কোনও জাতিভেদ, কোনও অনুন্নত জাতি থাকবে না। সমাজে প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা থাকবে। অধিকন্তু সামাজিক মর্যাদা বা আইনের চোখে স্ত্রী-পুরুষে কোনও অসাম্য থাকবে না, এবং সকল বিষয়ে নারী হবে পুরুষের সমান অংশীদার।

এজন্য সমাজে প্রত্যেক গোষ্ঠী বা শ্রেণী বা ব্যক্তি যারা কোনও না কোনওভাবে শোষিত বা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের জন্যই আমরা এক নতুন বার্তা শোনাব। আমরা নতুন কথা শোনাব রাজনৈতিক কর্মী, শ্রমজীবী, ভূমিহীন ও সম্পত্তিহীন শ্রেণী, সমাজের তথাকথিত অনুন্নত শ্রেণী এবং নারীজাতিকে। এই শোষিত এবং অত্যাচারিত শ্রেণীর মানুষরাই সমাজের মূল অংশের এবং, বলতে দ্বিধা নেই, বিদ্রোহী অংশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। যদি আমরা তাদের কাছে গিয়ে এই নতুন বার্তা—সর্বব্যাপক পূর্ণ স্বাধীনতার কথা—শোনাই, তাতে যে তাদের অবিলম্বে অনুপ্রাণিত করা যাবে এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। সমাজের এই মূল এবং বিদ্রোহী অংশকে উজ্জীবিত না করা পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব না। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত এই নতুন বার্তা (যা সহজেই অন্যের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে) দ্বারা মানুষকে কেবলমাত্র অনুপ্রাণিত করতে না পারলে সমাজের বিদ্রোহী অংশকে উজ্জীবিত করা যাবে না।

কংগ্রেসের নীতি ও কর্মসূচীর মূল দুর্বলতা হল নেতৃবৃন্দের মনের ধারণা অনেকটা অস্বচ্ছ এবং তাদের মনে দ্বিধার ভাব রয়েছে। উপরন্তু কোনও মৌলিক পরিবর্তন নয়, কেবল একটা আপস করা হল এই কর্মসূচীর ভিওি। ভূস্বামী এবং প্রজার সঙ্গে আপস, পুঁজিপতি এবং শ্রমজীবীর সঙ্গে আপস, তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর সঙ্গে তথাকথিত অনুন্নত শ্রেণীর আপস, পুরুষ ও নারীর সঙ্গে আপস—এসব যাঁরা সমাজের স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চান তাঁদের পক্ষে আদর্শ অবস্থা হতে পারে। এহেন আপস করার দ্বারা সমাজের বিদ্রোহী অংশকে উদ্দীপ্ত করা যাবে কিনা—যে উদ্দীপনার ফলেই একমাত্র প্রত্যেক বিতর্কমূলক বিষয়ে বর্তমানে আপসকামী ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্য ভারতের স্বাধীনতালাভ সম্ভব—সে বিষয়ে আমার মনে সংশয় আছে। স্বাধীনতার জন্য এমন মূল্যের পরিমাণ হবে অতি স্বল্প। কিন্তু এই স্বল্পমূল্যেও স্বাধীনতা আসবে কিনা সে বিষয়ে আমার মনে গভীর সন্দেহ আছে।

যে বিশাল সমস্যা আমাদের সমাধান করতে হবে, তা নিয়ে যেমন তেমন ভাবে কিছু করা চলে না; এজন্য আমরা চাই একটি মূলগত জঙ্গী কর্মসূচী। এই প্রারম্ভিক বক্তৃতায় সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না; কর্মসূচীর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করেই তৃপ্ত হব। বক্তৃতার প্রারম্ভে যে পাঁচটি নীতির কথা উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং স্বাধীনতার বিভিন্ন দিকের প্রতি লক্ষ্য রেখে নিম্নবর্ণিত পন্থায় আমাদের কার্যক্রম স্থির করব—

(১) সাম্যবাদমূলক কর্মপন্থা হিসাবে কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন।

(২) যুবশক্তিকে কঠিন নিয়মশৃঙ্খলায় Volunteer Corps হিসাবে সংগঠন।

(৩) জাতিভেদ প্রথা বিলোপ এবং সব রকম সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার দূরীকরণ।

(৪) নতুন কর্মসূচী গ্রহণ এবং তা কাজে রূপায়ণে ব্রতী হওয়ার জন্য নানাপ্রকার নারীসমিতি সংগঠন।

(৫) ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বর্জনের জন্য তীব্র প্রচার।

(৬) নতুন কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা এবং একটি নতুন দল সংগঠনের জন্য দেশব্যাপী প্রচার।

(৭) নতুন কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচী প্রচারের জন্য নতুন ভাবে সাহিত্যসৃষ্টি।

এই নতুন কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচী যে সব শ্রমিক ও সহকর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হবে, তাদের গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের বাম-শাখা (Left-Wing) হিসাবে তারা নিজেদের সংগঠিত করবেন কিনা। এমন করার পক্ষে অনেক কিছু বলার আছে। প্রথমত, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের একটি ঐতিহ্য এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি আছে। তা ছাড়া, প্রজন্ম পরম্পরায় বিপুল ত্যাগের উপর এর প্রতিষ্ঠা। যদি Left-Wing-কে ঠিকমতো সংগঠিত করা যায়, সন্দেহ নেই শীঘ্রই সেই সময় আসবে যখন নিছক ঘটনাক্রমের যুক্তিতে কংগ্রেসের দায়িত্বগ্রহণের জন্য তাদের আহ্বান করা হবে। আপন কর্মসূচীর ভিত্তিতে একবার এই দল প্রতিষ্ঠিত হলে বর্তমানের সংগঠন এবং কর্মসূচীর এটাই হবে একমাত্র বিকল্প।

বন্ধুগণ, বক্তৃতা শেষ করার পূর্বে সরকার এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে সে বিষয়ে আপনারা নিশ্চয় আমার মতামত জানতে চাইবেন। সে কথা বলার পূর্বে আর একটি বিষয় যা সারা ভারতকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছে সে সম্পর্কে আমার মনোভাব লাঘব করতে চাই। সর্দার ভগৎ সিং ও তাঁর সহকর্মীদের সাম্প্রতিক ফাঁসির কথাই আমি বলছি। ঘটনাটি ঐতিহাসিক এবং ভবিষ্যতে এ থেকে নানা শিক্ষা গ্রহণের আছে। এ বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনার জন্য আপনাদের আনুকূল্য সনির্বন্ধভাবে প্রার্থনা করি।

ভগৎ সিং মৃত্যুবরণ করেছেন। ভগৎ সিং দীর্ঘজীবী হন। লাহোরে যে বিয়োগান্ত নাটক অভিনীত হচ্ছিল, ভারতবাসী তা মাসের পর মাস রুদ্ধ আশঙ্কার মধ্যে দেখেছে এবং তার পরিণতির অপেক্ষায় থেকেছে। অবশেষে তা শেষ হয়েছে। এমন একটা দৃশ্যে যবনিকা পতন হয়েছে যার গভীর করুণরস বর্ণনা করা যায় না, স্বার্থশূন্যতার দৃশ্য হিসাবে যা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকটি এত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং চরিত্র-চিত্ৰণ এত জীবন্ত যে আমরা বিস্ময়ে এবং শেষে কি ঘটবে তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতিতে ছিলাম। ভগৎ সিং এবং যতীন দাসের আত্ম-উৎসর্গে নাটকের পরিসমাপ্তি। সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসে সংগঠিত এই দুই বিরল আত্মবলিদান আমরা পরম আবেগে এবং গভীর শ্রদ্ধায় লক্ষ্য করেছি। যতীন দাসের শোকযাত্রা যেমন এক দীর্ঘ জয়যাত্রা, ভগৎ সিংহের ফাঁসি তেমনই এক পবিত্র জীবন-উৎসর্গ যা সারা দেশকে অনুপ্রাণিত করবে। লাহোর ষড়যন্ত্র যে একেবারে ভারতের গভীর মর্মস্থলকে আলোড়িত করেছে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু সরকার কি তা উপলব্ধি করতে পেরেছে? আবার বলি, ‘ভগৎ সিং মৃত্যুবরণ করেছেন! ভগৎ সিং দীর্ঘজীবী হন!’ ভগৎ সিং কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি ন’ন। যে বিদ্রোহ-চেতনা এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দেশকে গ্রাস করেছে তিনি তারই প্রতীকস্বরূপ। এই চেতনাকে বিনষ্ট করা যায় না, যে আগুনের শিখা এ জ্বালিয়েছে তা নিভে যাবে না। সেজন্য ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং শুকদেব আর জীবিত নেই বলে আমরা শোক করব না। স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে ভারতকে হয়তো আরও অনেক সন্তান হারাতে হবে। কিন্তু আমরা শোক প্রকাশ করছি এই কারণে যে, তাঁদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এমন এক সময়ে যখন দেশের অগ্রগণ্য জাতীয় সংগঠন—ভারতের জাতীয় কংগ্রেস—ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনার কথা ঘোষণা করেছেন। হরকিষণলাল, দীনেশ গুপ্ত এবং রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মতো ভারতের অন্য সন্তানদের ভাগ্যে কি ঘটবে তা সহজে জানবার উপায় নেই। সেজন্য সঙ্গত কারণেই এ প্রশ্ন তোলা যায়, এই চুক্তির মূল্য কী যদি এই সব বিরোধিতাসূচক কাজ চলতে থাকে এবং যদি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠ বীরদের প্রাণরক্ষা করতে না পারি?

যুক্তির খাতিরে বলা যেতে পারে, প্রাণদণ্ড কার্যকর হবে না এমন কোনও কথা চুক্তির শর্তে ছিল না। এ যুক্তি স্বীকার করছি। কিন্তু এ কথা কি জিজ্ঞাসা করতে পারি না, চুক্তির উদ্দেশ্য কী? সকলেই স্বীকার করবেন চুক্তির উদ্দেশ্য হল গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনার পূর্বে শান্তি এবং সদিচ্ছার এমন এক বাতাবরণ সৃষ্টি করা, যাতে শান্ত এবং নিরুদ্বেগ চিত্তে, মনে কোনরূপ তিক্ততা বা বিরূপভাব না রেখে আলোচনায় বসা যায়। যদি বন্দীদের প্রাণদণ্ডের আদেশ এবং সেইমতো কাজ হয় এবং যদি বহুসংখ্যক রাজবন্দী এখনও কারাগারে আবদ্ধ থাকেন, তা হলে কি সেই বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায়? সরকার যদি বর্তমানে চুক্তির শর্তাবলী আক্ষরিক অর্থে পালনের উপরেই বেশি জোর দিয়ে থাকে, নিজেদের লাভের দিকেই যদি তাদের বেশি আগ্রহ থাকে তা হলে আলাপ-আলোচনর সময় যখন আসবে তখন তারা যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলবে সে বিষয়ে কি আশা করা যায়? কোন নিষ্পত্তি বা নিষ্পত্তির জন্য আলোচনার পূর্বে মহাত্মা গান্ধী যে সব সময় হৃদয়-পরিবর্তনের উপর জোর দিয়ে থাকেন তা বৃথা নয়। যে সরকার পূর্বের মতোই আমলাতান্ত্রিক এবং বলা যেতে পারে, প্রতিহিংসাপরায়ণ রয়েছে সে সরকার স্বেচ্ছায় জনগণের প্রতিনিধির হাতে ভারতের ভার তুলে দেবে না। হয়তো জোর দিয়ে বলা হবে, ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে আমরা আলোচনায় বসব ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা ভারত সরকারের সঙ্গে নয়, ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা বা একেবারে ব্রিটিশ জনগণের সঙ্গে। কিন্তু পুলিশের অত্যাচার সম্পর্কে অনুসন্ধান বা মৃত্যুদণ্ড রদ করার বিষয়ে যদি ব্রিটিশ সরকারকে স্থানীয় মানুষের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে হয়, তা হলে এমন আশা করা যাবে না যে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো আরও বৃহৎ প্রশ্নে সেই একই সরকার ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রশাসকদের ইচ্ছার দ্বারা বহুলাংশে পরিচালিত হবে না?

আমার মতে সরকারের যে কোনও-রকম হৃদয়-পরিবর্তন ঘটেনি সাম্প্রতিক এই ফাঁসিগুলি তারই নিশ্চিত ইঙ্গিত বহন করে। সম্মানজনক কোনও নিষ্পত্তির সময় এখনও আসেনি। স্বরাজলাভকে স্বাগত জানানোর পূর্বে আমাদের দুঃখ এবং ত্যাগের মধ্য দিয়ে আরও দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। আইরিশ ইতিহাসের একটি সাম্প্রতিক ঘটনা আমার বক্তব্যকে পরিস্ফুট করবে। কারারুদ্ধ করার প্রতিবাদে অল্ডারম্যান MacSweeney Lord Mayor of Cork অনশনব্রত গ্রহণ করেন। যখন তাঁর মৃত্যু প্রায় আসন্ন, ব্রিটিশ ও আইরিশ জনগণের পক্ষ থেকে সমভাবে মহামান্য রাজার কাছে এই মর্মে সনির্বন্ধ আবেদন করা হয় যেন তিনি রাজকীয় বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে MacSweeney-র প্রাণরক্ষা করেন। রাজা গভীরভাবে অভিভূত হন কিন্তু তিনি তাঁর সেক্রেটারির মাধ্যমে জানালেন যে যেহেতু তাঁর মন্ত্রীরা প্রাণদণ্ড রদের বিরোধী, তিনি এ বিষয়ে কিছু করতে অক্ষম। রাজাকে আত্মসমর্পণ করতে হল। ফলে আয়ার্ল্যান্ডে এই হল যে ব্রিটেনের সঙ্গে তাদের সংগ্রাম ক্রমবর্ধমান তিক্ততার সঙ্গে চলতে থাকে। কিছুকাল পরে দুই পক্ষেরই মনে হল এ বিষয়ে সন্ধি এবং একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। এর পর রাজবন্দীদের ক্ষমাপ্রদর্শন প্রশ্নটি আবার উঠল এবং Sien Fein নেতৃবর্গ প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত বন্দীসহ সমস্ত বন্দীদের মুক্তির দাবি জানালেন। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত Seon Mckeon ছাড়া অন্য সকলকে মুক্তি দিতে সম্মত হলেন। Sien Fein নেতৃবৃন্দ চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে Seon Mckon-কে মুক্তি না দিলে চুক্তি ভঙ্গ করবেন বলে হুমকি দেন। এই চরমপত্রের উত্তরে সেই একই মন্ত্রিসভা যারা দেশব্যাপী আন্দোলন সত্ত্বেও Terence McSweeny-কে মুক্তি দিতে অস্বীকার করেছিলেন, তারা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে Seon Mckeon-কে মুক্তি দিলেন। McSweeny-কে প্রাণ দিতে হয়েছিল, কারণ নিষ্পত্তির সময় তখনও আসেনি, Seon Mckeon বেঁচে গেলেন, কারণ তখন স্থায়ী শান্তিপ্রতিষ্ঠা ছিল আসন্ন এবং ব্রিটিশ জনগণের হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটেছিল। এই একই নীতি কি আমরা ভারতের ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি না?

ভগৎ সিং এবং তাঁর সঙ্গীরা ছিলেন বীরপুরুষ, তাঁরা প্রাণভিক্ষা করেননি। ভারত যাতে স্বাধীন হয় এ জন্য তাঁরা সর্ব পণ করেছিলেন। কিন্তু সারা দেশ চেয়েছিল তাঁদের প্রাণদণ্ড থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া হোক। যদি ইতিমধ্যেই চুক্তি ঘোষণা করা হত এবং যদি শান্তি দৃষ্টিগোচর হত, তা হলে এইসব বীর ও নিঃস্বার্থ মানুষের জীবনধারা পরিবর্তিত হত এবং জাতীয় পুনর্গঠন কাজে তাঁদের আমরা নিয়োজিত করতে পারতাম। দল ও মত নির্বিশেষে সারা দেশের লোক দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের মনোভাব ব্যক্ত করেছিল এবং প্রাণদণ্ড রদের দাবি জানিয়েছিল।

দেশবাসীর পক্ষে সম্ভবপর সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও আরও একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত ছিল। যখন চুক্তি সম্পাদনের জন্য আলোচনা চলছিল, তখন দেশের জাতীয় সংগঠনের অন্যতম প্রতিনিধিরূপে কংগ্রেস বিপ্লবীদের এবং ভারতীয় লেবার পার্টির বিষয়টি উপস্থাপিত করতে পারতেন। এ জন্য বিপ্লবীদের বা লেবার পার্টির মতবাদ বা কর্মপন্থার সঙ্গে কংগ্রেসের একমত হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। তারা কেবল এ কথা বলতে পারতেন: যেহেতু এই দুটি দল রয়েছে এবং যেহেতু নিজেদের মতানুসারে তারাও ভারতের মুক্তির জন্য কাজ করছে, এই চুক্তির সঙ্গে তাদের কোনমতে যুক্ত না করা পর্যন্ত স্থায়ী শান্তি সম্ভবত স্থাপিত হবে না।

এই সন্ধিক্ষণে সরকারের পক্ষে একটু উদার মনোভাবের পরিচয় দিলে এই দুই দল এবং বৃহত্তর অর্থে সারা দেশের উপর তা মঙ্গলজনক প্রভাব বিস্তার করত। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধিকারী দলের এমন উদার মনোভাব ব্যক্ত করার পরেও কোনও গোষ্ঠী, দল বা ব্যক্তি সাড়া না দিলে ওই দল বা ব্যক্তি সারা পৃথিবীর কাছে নিন্দিত হত।

যদি এভাবে আপস করে তারা দেশের সকল বিপ্লবী দলকে শান্ত করতে পারত, সরকারের নিজস্ব শক্তি এবং সম্পদের এ দুয়ের কোনটিকেই হারাবার কিছু ছিল না; বরং এতে তাদের নৈতিক জয় হত। আপসের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সরকার পুনরায় নির্যাতনের পথ অবলম্বন করতে পারত এবং তখন আরও জোরালো যুক্তি দেখিয়ে তা করত।

সরকার যদি ভুল করে থাকে, কংগ্রেসও ভুল করেছে। বিপ্লবী এবং শ্রমিক দলের কর্মপন্থার সঙ্গে একমত না হয়েও Sien Fein দল যেমন সারা আয়ার্ল্যান্ডের হয়ে কথা বলেছিল, চুক্তি-আলোচনার সময় কংগ্রেসও তেমনি সারা দেশের পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপিত করতে পারত, সকলের দাবির সঙ্গেই কংগ্রেস বেশ ভালভাবে নিজেকে একাত্ম করে নিতে পারত। কিন্তু কংগ্রেস তা করতে ব্যর্থ হয়; এবং ব্যর্থ হওয়ার ফলে দেশবাসী এবং জগতের চোখে সে নিজের মর্যাদাহানি ঘটিয়েছে। ভগৎ সিং এবং অন্যান্যদের মৃত্যুদণ্ড রদের আবেদন সরকার কর্তৃক অগ্রাহ্য হওয়ার পর কংগ্রেস অনুরূপ মনোভাব গ্রহণ করতে পারত।

কংগ্রেস যদি দলের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ড রদের কথা বলত, তা হলে সে কিছুই হারাত না, বরং দেশবাসীর বিচারে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত এবং সম্ভবত ভগৎ সিংয়ের প্রাণ সে রক্ষা করতে পারত। এমন কি যদি সরকার তার দাবি অগ্রাহ্য করত, কংগ্রেস এই ভেবে সান্ত্বনা পেত যে সে তার কর্তব্য করেছে এবং ‘ভগৎ সিং এবং তার সহকর্মীদের প্রাণরক্ষার জন্য সে সাধ্যমত চেষ্টা করেনি’ এই মনে করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কারুর কোন অভিযোগ বা ক্ষোভের কিছু থাকত না।

গান্ধী-আরউইন চুক্তি নামে অভিহিত বিরোধনিষ্পত্তিমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে বলতে পারি যে, তা অত্যন্ত অসন্তোষজনক এবং গভীর হতাশাব্যঞ্জক। যে কথা ভেবে আমার বেশি বেদনা বোধ হয় তা হল এই চুক্তির বিষয়বস্তু থেকে আমাদের যে পরিমাণ শক্তি অনুমান করা যায়, চুক্তিসম্পাদনকালে আমরা তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী ছিলাম। এই চুক্তির শর্তাবলীর কয়েকটি অসন্তোষজনক বৈশিষ্ট্যের সংক্ষেপে উল্লেখ করছি:

১. Bengal Ordinance (Bengal Criminal Amendment Act), এবং Burma Ordinance ইত্যাদি অর্ডিনান্স— যার দ্বারা নিছক সন্দেহের বশে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করা যায়— তা বাতিল করা হয়নি।

২. জরিমানা বাবদ অর্থ এবং বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ফেরত-বিষয়ক শর্তগুলি সন্তোষজনক নয়।

৩. পুলিশী নির্যাতনের অনুসন্ধানের জন্য দাবি, বিশেষ করে তা যখন কংগ্রেসের তরফে করা হয়েছে, প্রত্যাহার করা উচিত হয়নি। অধিকন্তু, যে সমস্ত গাড়োয়ালি নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেছিল এবং যে সমস্ত পুলিশ রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত হয়েছিল, কংগ্রেসের উচিত ছিল তাদের পাশে দাঁড়ানো। অনেক রকম অন্যায় অত্যাচার করা সত্ত্বেও নিজেদের অনুগত মানুষকে সরকার কখনও বিপদের মুখে ফেলেনি; কংগ্রেস কিন্তু নিজের লোকের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।

৪. কংগ্রেসের পক্ষে ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বয়কট, বিশেষ করে তা যখন আইন অমান্য আন্দোলনের অঙ্গীভূত নয়, পরিত্যাগ করা উচিত হয়নি। গত বছর আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেকার সাধারণ সময়ে আমরা ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্য বয়কট আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখন তা করতে পারি না। আইন অমান্য আন্দোলনের পূর্বে যে অবস্থায় ছিলাম, তার চেয়ে এই আন্দোলনের পরবর্তীকালে এখন আমরা আরও খারাপ অবস্থায় আছি।

৫. লবণ উৎপাদনের বিধিগুলি পর্যাপ্ত নয়, বিশেষ করে লবণ যখন কেবল একটি সীমাবদ্ধ স্থানে উৎপন্ন করা যেতে পারে।

৬. পিকেটিং সম্পর্কে বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে গত বছর আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বেকার অবস্থার তুলনায় আমরা আরও বেশি অসুবিধায় পড়েছি। এইসব বিধিনিষেধ যদি ঠিকমতো মেনে চলা হয়, তা হলে আদৌ পিকেটিং করা, একেবারে অসম্ভব না হলেও, কঠিন হয়ে পড়বে।

৭. সর্বোপরি, বন্দীদের ক্ষমাপ্রদর্শন সংক্রান্ত বিধিগুলি খুবই অসন্তোষজনক। প্রথমত, আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য আটক সকল বন্দীকে এখনও মুক্তি দেওয়া হয়নি। উপরন্তু চুক্তির শর্তানুসারে আমরা বিপ্লবী দলের এবং লেবার পার্টির বন্দীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন দাবি করতে পারি না। ফাঁসির আদেশ রদ করা যাবে না— চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা এবং মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার মতো বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলা চলতে থাকবে। পাঞ্জাবে সামরিক আইনে আটক বন্দীদের মতো যে সব রাজবন্দী ১০/১২ বছর জেলে আটক রয়েছেন তাঁরা জেলেই আটক থাকবেন।

সব শেষে বলা যায়, বাংলাদেশে বিনা বিচারে যে সব ডেটিনিউ বন্দী আছেন তাদের মুক্তি দেওয়া হবে না। তা হলে বন্দীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের মূল্য কি? আরও একটি কথা বলতে চাই। বন্দীদের অহিংস এবং হিংসাপ্রবণ বলে যে পার্থক্য এখন কংগ্রেস করে থাকে, তা এক নতুন লোক-দেখানো ব্যাপার। এটা ১৯২৯ সালের Delhi Manifesto কিংবা মহাত্মা গান্ধীর অতি-বিখ্যাত এগারো দফার কোনটিরই অন্তর্ভুক্ত ছিল না।

চুক্তির শর্তাবলীর অসন্তোষজনক বৈশিষ্ট্য দেখাতে বিশদভাবে আর কিছু বলার দরকার নেই। চুক্তিটি পর্যালোচনা করলে এ কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হবে না যে, পরাজয়ের মনোভাব নিয়েই কংগ্রেস এতে সম্মত হয়েছিল এবং কয়েক জায়গায় এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে যা আমাদের আত্মমর্যাদা এবং সম্মানের অনুকূল নয়। এই চুক্তি সম্পাদনকালে যদি সত্যিই আমরা দুর্বল অবস্থায় থাকতাম, তা হলে আমি এত বেশি প্রতিবাদ করতাম না; কিন্তু সত্যিই কি আমরা সে সময় এত দুর্বল ছিলাম। এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।

কিন্তু চুক্তিটি এখন সম্পাদিত হয়ে গেছে; কাজেই কোনও আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে আমাদের খুব সতর্কভাবে ভেবে দেখতে হবে। নেতিবাচক সমালোচনায় নিজেদের শক্তি ক্ষয় না করে নির্দিষ্ট এবং লাভজনক কিছু কাজ আমাদের করা উচিত। এই চুক্তির শর্তাবলীর জন্য যারা দায়ী তাঁদের স্বদেশপ্রেম সম্পর্কে মুহুর্তের জন্যও আমার মনে কোনও প্রশ্ন জাগেনি। বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা মনে জাগে। ফলত এখন আমাদের কাছে সব চেয়ে বড় কথা হল বাস্তবে এমন কিছু কাজ করা, যাতে জাতি এবং জাতির দাবি আরও শক্তিশালী হয়। এই উদ্দেশ্যে প্রারম্ভেই আমি একটি কর্মসূচীর রূপরেখা দিয়েছি যা আমাদের মধ্যে যাঁরা আমূল সংস্কারের পক্ষপাতী তাঁরা তা গ্রহণ করতে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। ফলে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে অনাবশ্যক সংঘর্ষ এমন এক সময়ে এড়ানো যাবে যখন এরূপ সংঘর্ষ জনগণকে দুর্বল এবং সরকারকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

সর্বোপরি যদি আমাদের অন্যকে সমালোচনা করতে হয়, সে সময়ে যেন আমরা সংযত থাকতে এবং আত্মসংযম রক্ষা করতে পারি। অন্যের প্রতি ভদ্র ব্যবহার করলে বা নিজে সংযত থাকলে আমরা কিছুই হারাব না এবং আমাদের লাভ হবে অনেক বেশি। নিজেদের এই কর্মসূচীতে যদি আমাদের বিশ্বাস থাকে তাহলে আমাদের উচিত সাধ্যমত সকল উপায়ে তা কাজে রূপায়িত করা। আমাদের এই কর্মসূচী যদি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়, তা হলে কোনও না কোনও সময়ে দেশবাসী তা গ্রহণ করতে বাধ্য কারণ পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত সত্য জয় লাভ করে।

বন্ধুগণ, আপনাদের অনেক মূল্যবান সময় নিয়েছি কিন্তু আমার যা বলার তা বলেছি। আসুন, এই ব্রত পালনে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে, অটল সাহসে এবং বিনম্র চিত্তে অগ্রসর হই। সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত ভারতবর্ষের এক স্বপ্নছবি আমার চিত্ত আচ্ছন্ন করে আছে। এটাই আমার জীবনস্বপ্ন এবং আমার সকল কাজের লক্ষ্য। পৃথিবীর সংস্কৃতি এবং সভ্যতার ক্ষেত্রে ভারতের অনেক কিছু দেবার আছে। এই উপহার গ্রহণের জন্য পৃথিবী সাগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। পৃথিবীকে ভারতের শেষ উপহার হবে একটি নতুন আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় সংগঠন, যা থেকে সারা মানব-সমাজ নানা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। পৃথিবীরূপ অট্টালিকার মূল প্রস্তর-উপাদান হল ভারতবর্ষ এবং স্বাধীন ভারত পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্যবাদের বিনাশ ঘোষণা করবে। আসুন, আমরা এখন যা করা উচিত সেই কাজে আত্মনিয়োগ করি এবং যাতে সমগ্র মানবজাতি রক্ষা পায় সেজন্য ভারতবর্ষকে স্বাধীন করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *