ভারতে নিয়তিবাদের জন্ম
নিয়তিবাদ ঠিক কবে তার বর্তমান রূপে সমাজ ও সাহিত্যে দেখা দেয় তা বলা যায় না; সে যুগের কোনও দলিল এখনও পাওয়া যায়নি। অনেক পরে মানুষ যার হেতু বা কারণ খুঁজেছে তখন মানুষের কল্পনায় নিয়তি, দৈব, ভাগ্য, ইত্যাদি নানা নামে একটি শক্তির অবতারণা ঘটে। সেটি ক্রমে ক্রমে পল্লবিত হতে থাকে। ফলে যুক্তি ও কার্যকারণ সম্পর্ক যত পিছু হটে, ততই অযৌক্তিক শক্তি মানুষের জীবনে এক চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা দেয়। অসংখ্য দেবতার অস্তিত্বের কল্পনার সঙ্গে মিলিত হয়ে কখনও বা তাদের ওপর স্থান পেল ওই অলৌকিক শক্তি। পুরাকাল থেকে এ ঘটনা পৃথিবীর সর্বদেশে ঘটে আসছে। যদিও ক্রমে ক্রমে এর নানা রূপ ও ক্রিয়াকলাপ বাড়তে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সহজ বুদ্ধিতে এর কোনও রূপান্তর ঘটেনি। বরং তার আকৃতি প্রকৃতির নানা বিস্তার আজও ঘটে চলেছে।
কোনও না কোনও চেহারায় নিয়তিবাদ পৃথিবীর সর্বত্রই ছিল, যদিও এগুলির মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্যও চোখে পড়ে। প্রাচীন ভারতে এর নাম ছিল নিয়তি, দৈব, ভাগ্য, কাল, বিধি, বিধিলিপি, বিধান, দিষ্ট (বা দিষ্ট্য), ভবিতব্যতা, ভাগধেয়, কৃতান্ত, অদৃষ্ট, অচিন্ত্য। (মহাভারত ৩:২৭৩:৬:১২:১৮) (গ্রিক ভাগ্যদেবী আদ্রাস্টেইয়ার নামের সঙ্গে অদৃষ্টের কিছু যোগ থাকতে পারে)। অথর্ববেদে ‘রোহিত’ নামে এক দেবতাকে ‘কাল’-এর সঙ্গে একীভূত করে দেখানো হয়েছে। খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকে দণ্ডীর দশকুমারচরিত-এ মস্করী নামের সন্ন্যাসীকে ‘কার্তান্তিক’ বলা হয়েছে (এর আক্ষরিক মানে, যে মৃত্যুর সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে)।
প্রাচীন সুমেরীয় সাহিত্যে নিয়তি ‘মে’ বা ‘মু’, প্রাচীন আক্কাদীয় সাহিত্যে ‘শিমতু’। প্রাচীনতম মেসোপোটেমীয় গ্রন্থ এনুমা এলিশ ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি লিখিত রূপ পায়, কিন্তু রচনা আরও পূর্বের। এতে উল্লেখ পাই, ভাগ্যের ফলকগুলির’, যার নাম ‘তুপ শিমতি’ বা ‘দুপ শিমতি’। ব্যবিলনে প্রাকৃতিক নিয়ম এবং ভাগ্য উভয়েই ‘মা আত’ নামে উল্লিখিত।
মিশরে এই দেবীর নাম ‘হাথোর শাই রেন্নেৎ’ (শাই-এর ব্যুৎপত্তি শ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’)। মিশরে ‘রে’, ‘আমন’ ‘প্তাহ’ ‘থথ’ ‘খনুম’– এঁরাই ছিলেন ভাগ্যের দেবতা, হাথোর আংশিক ভবে ভাগ্যদেবী, ‘ভাগ্যের ফলকগুলি’র মালিক, অতএব ভাগ্যের নিয়ন্ত্রী দেবী; তাঁর স্থান খুব উঁচুতে। ‘আনজু’ ওই ফলকগুলি চুরি করে, ফলে বিশ্বের বিধানে শৃঙ্খলা নষ্ট হয়। ফলকগুলি যখন ফিরে পাওয়া যায়, তখন সেই শৃঙ্খলা আবার ফিরে আসে। পরবর্তী কালের প্রধান দেবতা মার্কই ফলকগুলির মালিক হন। আসীরিয়াতে জাতীয় দেবতা ‘অশুর’ প্রধান্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই ভাগ্যের নিয়ন্তা হন। প্রাচীন চিনে ‘মিং’-এর অর্থ ‘উক্ত’ (যেমন ল্যাটিনে ‘ফারি’ ধাতু বলা, এর অতীতকালে নিষ্পন্ন ক্রিয়াবিশেষ হল ‘ফাতুম’=ভাগ্য); ‘মিং’ এর অর্থ ভবিষ্যদ্বাণী করা। কিন্তু চিনে নিয়তি অমোঘ ছিল না, দেবতাদের হস্তক্ষেপে ভাগ্য এড়ানো যেত। এ ব্যাপার অর্বাচীন
পহ্লবী ভাষায় ভাগ্য হল ‘বখত’ এবং এর থেকেই নিষ্পন্ন ‘ভক্ত’ (সংস্কৃতে যার অর্থ ‘বিভাজিত’)। ‘ভক্ত’ ও ‘ভা’ এসেছে ‘ভঞ্জ’ ধাতু থেকে, যার মানেও ভাগ করে দেওয়া। পারসিক শব্দ ‘বাঘোবখত’-এর মানেও দৈব। তা হলে দাঁড়াচ্ছে, ভাগ করে দেওয়ার সঙ্গে দৈবের একটা অর্থগত সম্বন্ধ আছে। কী সেই সম্বন্ধ? লটারির মতো দান ফেলে ভাগ করা দৈবের একটা রূপ (প্রাচীন ইংরেজি হলট থেকে ‘লট’, যার মানে ভাগ্য বা ভাগ্য যা জুটিয়ে দিয়েছে)। গোষ্ঠীর নেতা শিকারে পাওয়া পশুমাংস, পরাজিত গোষ্ঠী থেকে লুঠ করে আনা ধন ইচ্ছেমতো (লটারির মতো) গোষ্ঠীমানবদের ভাগ করে দিতেন, ফলে প্রত্যেকের কাছে তার অংশটুকু দৈবদত্ত প্রাপ্তি বলে মনে হত। প্রাচীন ইংরেজিতে ‘হলট’ মানে অংশ, পছন্দ বা সিদ্ধান্ত। এ বোধ সম্ভবত যাযাবার গোষ্ঠীগুলিতে প্রচলিত ছিল, যারা শিকার ও লুঠ করে খেত। এই শিকারের জন্তুর মাংস ভাগ হত অন্ধ ভাবে ‘দান’ ফেলে। এই ভাবেই গোষ্ঠীগুলির ধারণা জন্মাল যে, দান ফেলে অন্ধ ভাবে ভাগ করা ভাগ্যেরই এক প্রতিরূপ এবং সেই রকমই অযৌক্তিক ভাবে ভাল বা মন্দ অংশ ব্যক্তির ভাগ্যে আসত। অন্ধ বিভাজনের এই বোধের সঙ্গে মিশে রইল অচিন্তিতপূর্ব যুক্তিহীনতা এবং অমোঘতার একটা ধারণা। জার্মান ‘লস’ মানেও ওই অন্ধ ভাবে দান ফেলে ভাগ করা। প্রথম যুগের শিকারি ও লুঠেরারা জানত যে মাংসের, লুঠের শ্রেষ্ঠ, ঊনশ্রেষ্ঠ, সাধারণ ও খারাপ অংশ থাকবেই এবং স্বেচ্ছায় কেউ খারাপটা বা সাধারণটা নিতে চাইবে না। সেই জন্যে ওই নিয়ে সংঘাত ঠেকানোর জন্যে লোকেরা এই লটারিতে রাজি হয়েছিল, অন্তত এই আশায় যে, আজকে যে খারাপটা পেল সে কাল শ্রেষ্ঠতা পেতে পারে এবং বাস্তবে মাঝে মাঝে তা পেতও। আর তা যদি না-ও হয়, ভাগ্য ও অযৌক্তিক ভাগকে ছাড়া দোষ কাউকেই দেওয়া চলে না, আর ভাগ্য তো অন্ধ, সদসৎ-বিবেচনাশূন্য, খামখেয়ালি। এই বোধগুলি তখনও ওতপ্রোত ভাবে ভাগ্যের সঙ্গে মিশে রইল। যখন ‘লট’ মানে গোষ্ঠীর মধ্যে অন্ধ ‘বিভাজন’ অর্থ ছেড়ে অদৃশ্য এক দুয়ে শক্তি বা ভগবানকে বোঝাচ্ছে তখনও। প্রাথমিক যুগে যেমন শিকারে বা লুটে-পাওয়া ধনে অস্তিত্বের সংজ্ঞাই বদলে যেত, তেমনই পরের যুগে ভাগ্য, যা মানুষের জীবন নির্ধারণ করত তা দিয়ে মানুষের জীবনের রং-রূপ পালটে যেত। ক্রমে গোষ্ঠীপতির খেয়ালি বন্ধনের বদলে মানুষ কল্পনা করতে শুরু করল সুখ-দুঃখের এক অদৃশ্য নিয়ন্তাকে, যিনি কোনও এক জায়গায় বসে মানুষের আনন্দ-বিষাদ নিয়ন্ত্রণ করেন। যোগ্য ও অযোগ্যের সম্বন্ধে তাঁর কোনও বাছবিচার নেই। তাই সুবিচারের প্রত্যাশা অন্তর্হিত হল, কারণ দৈব ন্যায়বিচার ও অন্যায় বিচারের ঊর্ধ্বে।
আরবীতে ভাগ্য হল ‘নসীব’, জার্মানে ‘শিকসাল’ (এই দ্বিতীয় শব্দটি ‘শিকেন’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন, যার অর্থ ‘পাঠানো’: নিয়তি তখন হয়ে দাঁড়াল ওপরের কোনও শক্তির ‘পাঠানো সুখদুঃখের অংশ।
প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে ভাগ্যের যে লক্ষণগুলি আছে তার থেকে একে তারা দৈব, ভাগ্য, অচিন্ত্য, অদৃষ্ট যা-ই বলুক না কেন, একে দেখা হত যেন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এক শক্তি হিসেবে, বিশ্বে সক্রিয় একটি মহাজাগতিক শক্তি, মানবিক অভিজ্ঞতায় যার প্রকাশ; এবং সাধারণত যা দুর্বোধ্য, অনিয়ন্ত্রিণীয়, অমোঘ, নিযুক্তিক এবং হেতুরহিত, অর্থাৎ কোনও প্রত্যক্ষ ঘটনার সঙ্গে কার্যকারণ সম্বন্ধে জড়িত নয়।
প্রথম গ্রিক লেখক যিনি নিয়তিকে নাম, বংশ ও নির্দিষ্ট ভূমিকা দিয়েছিলেন তিনি হেসিয়ড এক জায়গায় তিনি তাদের বলেছেন রাত্রির কন্যা, মৃত্যুর ভগিনী; অন্য এক জায়গায় তাকে বলছেন জেউস ও সুবিচারের কন্যা— নাম দিয়েছেন, ক্লোথো, এট্রপস ও লাখেসিস- বয়নকারিণী, নির্দেশিকা ও অনমনীয়া। শেষ জন বোনা কাপড়ের প্রান্ত ছিঁড়ে পৃথক বস্ত্ৰ খণ্ডকে টুকরো করেন। এঁরা মর্ত্যমানবের ভাল মন্দ ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন; কিন্তু তাঁদের ভগিনী ‘হোরাত্র’দের মতন তাঁরাও মহাজাগতিক ক্ষেত্রেরই বিধান। গ্রিক ‘আইলেইথিয়া’ নামের ভাগ্যদেবী রোমে হন ‘পার্কা’। ‘পার্কা’ বা ভাগ্যত্রয়ীকে আহ্বান করা হত শিশুজন্মের সময়ে যাতে তাঁরা শিশুর ভাগ্য ভবিষ্যৎ লিখে যেতে পারেন। (এনসাইক্লেপিডিয়া আমেরিকানা, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৬) সামান্য ভেদযুক্ত বহু নামে গ্রিসের ভাগ্যদেবীর তুলনা ভারতে নিয়তির দেবকল্পে। রোমে ‘ত্রিয়া ফাতা’র ভূমিকা অনেকটাই ভারতের লৌকিক ধর্মের ষষ্ঠীর সঙ্গে মেলে যিনি শিশুজন্মের ষষ্ঠ দিনে জাতকের ভাগ্য বা ললাট-লিখন দিয়ে যান; তাই এঁর অপর নাম বিধিলিপি।
মৎস্যপুরাণে এক জায়গায় কাল ও নিয়তিকে একীভূত করে দেখানো হয়েছে, ‘সব দুর্যোগ ও আপতিক বিপদকে নিয়ন্ত্রণ করেন কাল; কাল প্রতিকূল ও ক্রুদ্ধ হলে কেমন করে এ সব এড়ানো যাবে?’(বায়ুপুরাণ ২১০:৫-৭) কিংবা ‘মানুষের মৃত্যুর পরে কী ঘটে তা জানা সম্পূর্ণ অসম্ভব, ঋষিরা পর্যন্ত তা জানেন না, মর্ত্যমানুষের তো কথাই নেই।’ (বায়ুপুরাণ ৫৫:৬৩) নিয়তির দুয়েতা এখানে তার অন্ধকারতম ও গম্ভীরতম চেহারায় প্রকাশিত: মানুষের মরণোত্তর অবস্থার দুয়েত্বের; সঙ্গে মিলেছে মানুষের মরণোত্তর সত্তার বোধ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে কালের ও অদৃষ্টের অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ। তাই কাল নিয়তির প্রতিরূপ, প্রতিশব্দ। প্রথম উদ্ধৃতিতে দেখি বিজ্ঞতম মানুষেরও এই বিশেষ ক্ষেত্রে, অর্থাৎ মরণোত্তর অবস্থার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ জ্ঞানের অভাব; এর থেকেই আসে প্রতিকূল দৈবের সামনে মানুষের সম্পূর্ণ অসহায়তা।
গ্রিসের ‘আট্রপস’, ইরানের ‘জুর্বান’; এর সঙ্গে তত্ত্বগত ভাবে মিলে যায় ভারতের কাল, অন্তক, কৃতান্ত (প্রত্যেকটিরই অর্থ সময় ও মৃত্যু)। মনুষ্যজীবনের পরিমাপের জন্য কালের হাতে একটি প্রমাণসূত্র (মাপবার সুতো) আছে, তা হল মৃত্যু। মৃত্যু তাই কালের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে সংযুক্ত একটি তত্ত্ব, যা নিয়তির বোধক। অর্বাচীন একটি পুরাণে মৃত্যু ও কালকে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে নানা তালিকায় বহু নামে গেঁথে। (মৎস্যপুরাণ ১০২:২২; ১০৭:২৭; ১৩৫:৭৬; ১৩৬:৫ দ্রষ্টব্য মার্কণ্ডেয় পুরাণ ৮:৮০)
গ্রিসে এরিনিয়েস সম্বন্ধে প্রথম উল্লেখ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকের: ক্রিটের ক্লসস শহরের (লীনিয়ার বি বর্ণমালার) শিলালেখে। এই দেবীরা নিয়তির প্রতিহিংসার রূপ। তার পর আসেন প্রাক-ধ্রুপদী গ্রিসের হেসিয়ড। নিয়তিকে ইনি ‘ময়রা’ বলে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন, অন্যত্র আবার ক্লোথো, লাখেসিস ও আট্রপিস এর সঙ্গে সমীকরণ করেছেন। পশম পাকানো এবং বোনা সভ্যতার প্রাথমিক স্তরের দুটি কর্ম। সম্ভবত নারীরাই এ দুটির উদ্ভাবন ও চর্চা করেন; সেই জন্যেই নিয়তির সঙ্গে এই তিন দেবভগিনীর সমীকরণ, এঁরা বুনছেন, মাপছেন ও অবশেষে ছেঁটে ফেলছেন। যেন রূপকে বলা হচ্ছে জীবনযাত্রা, তার পরিমাপ ও শেষে অবচ্ছেদ— সবটাই নিষ্কারণ, এ তিন বোনের খেয়ালখুশির ওপরে নির্ভরশীল।
সংহিতা সাহিত্যের পরবর্তী ব্রাহ্মণ সাহিত্যে দেখি: দুটি বোন এই কাপড়টা বুনছেন, যা অসীম, ছ’টি রশ্মিতে উদ্ভাসিত। একজন সুতো ছুঁড়ে দিচ্ছেন, অন্যজন সেটা লুফে নিচ্ছেন। এঁদের কেউই বোনেন না, কেউই (বোনা) শেষ করেন না। (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ২:১:৪:৬০) গ্রিক ‘ময়রা’-তে একে শুধু পশম পাকানোর কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়, তাই হোমার একে ‘ক্লোথোস’ নাম দিয়েছেন। (ওডিসসেউস ৮:১৯৭) গ্রিসে অন্য ক’জন দেবতাও ভাগ্যের প্রতীক। ‘ডিকে’ ন্যায়ের প্রতিভু, ‘থেমিস’ সুবিচারের প্রতীক, ‘হুমারমেনে’ নেহাৎই ভাগ্য, যেমন ‘আদ্রাস্টাইয়া’ ও ‘তুখে’; যে ‘তুঙানো’ ধাতু থেকে তুখে নিষ্পন্ন, তার অর্থ ‘দৈবাৎ ঘটে যাওয়া’। এঁরা সবাই নিয়তির ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
ডেমোক্রিটাস জীবন ও সৃষ্টির ব্যাখ্যা করেছেন পরমানুবাদ দিয়ে, কিন্তু ‘এউদাএমোনিয়া’ বা ‘হেডোনে’-কে ও এই কাঠামোর মধ্যে স্বীকার করেছেন। পরবর্তী কালে ডিওগেনেস লায়ের্তেয়ুস ঈশ্বরকে ‘নুস’ বা যুক্তির সঙ্গে সমীকৃত করেছেন। নিয়তি হল হুমারমেনে ও দেবতা জেয়ুস। ক্লেয়াসে বলেন যদিও ঈশ্বর-নিরূপিত সবই ভাগ্য, তবু এ প্রতিপাদ্য উল্টোলে সতি থাকে না, অর্থাৎ যা কিছু ভাগ্য, তাই ঈশ্বর-নিরূপিত নয়।
হয়তো ভারতীয় নিয়তির যথার্থ প্রতিরূপ হল গ্রিক ‘নেমেসিস’, যার সম্বন্ধে কিছুই পূর্বাভাস পাওয়া যায় না, কিন্তু প্রতিহিংসা যার মুখ্য চরিত্র। এ সম্পর্কে দেখতে পাই, ‘যে-নেমেসিসের ওপরে জেউস রূঢ় ভাবে বলাৎকার করেন তার কাহিনি বিবৃত আছে। এই দোষীটির নামেই নিহিত আছে যে, ইনি অত্যাচারের ক্রুদ্ধ প্রতিশোধ নেন।’ (জেসি: হিস্ট্রি অব রিলিজিয়ন্স, ১৯৬৪, তৃতীয় খণ্ড, ২য় সংখ্যা, পৃ. ২৬৮) জেউসের এই বলাৎকার যেন নিয়তিকে দেবরাজের বশীভূত করার চেষ্টা। ফলটা কিন্তু বিপরীত হল, নেমেসিস জেউসের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হল।
অ্যারিস্টটলের কাছে ‘তুখে’ মনোনিষ্ঠ। তাই তিনি দুটি ভাগ করেছেন, দুস্তুখিয়া ও সুস্তুখিয়া, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য। প্লেটো তুখেকে বলেছেন, ‘দেবী তুখে’; কিন্তু ভাগ্যের অধিকাংশ প্রতিশব্দই বোধের জগতে ব্যক্তি-রূপায়িত, সাহিত্যে এঁদের ভূমিকা দেবতাদের প্রতিনিধি হিসেবে। ‘আনাঙ্কে’ যদিও পুরোপুরি দেবী নন, ‘আইসাও নন, তবুও ‘আতে’, ‘থেমিস’ এবং ‘পথস’ এর সঙ্গে এঁরা যেমন মানুষের সৌভাগ্যে পরশ্রীকাতর ও ঈর্ষান্বিত, তেমনই এঁরা মানুষের সৌভাগ্য সহ্য করতে পারেন না, তাই মানুষের জীবনে দুর্ভাগ্য নিয়ে আসেন, যতক্ষণ না মানুষকে মানুষী হ্রস্বতায় ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে। ‘আতে’ ও আলাস্তর’ হল খুন-হওয়া মানুষের প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে উত্থিত আর্তরবের প্রতীক।
লক্ষণীয়, গ্রিসের মতোই প্রাচীর সুমের, আক্কাদ, আসীরিয়া ও ব্যাবিলনিয়াতেও কোনও একটি মাত্র দেবতা নেই যিনি নিয়তির সব কটি দিকেরই সংহত প্রতীক। এ সব জায়গায় বহু দেবদেবী একত্রে নিয়তির ভূমিকায় অবতীর্ণ। কারণটা হয়তো নিহিত আছে স্থানে ও কালে। যুগে যুগে যে সব ছোট বড় রাজ্যের উদ্ভব, সমৃদ্ধি ও বিলয় ঘটত, সেগুলিতে দেবমণ্ডলীরও যুগপৎ উত্থান, সমৃদ্ধি ও হ্রাস ঘটত। গত যুগের দেবরাজকে পরবর্তী যুগের দেবরাজের আধিপত্য স্বীকার করতে হত। দেবতাদের প্রতি মানুষের আধিপত্যও যুগে যুগে পরিবর্তিত হত। বৈদিক যুগে নিয়তির সম্পূর্ণ প্রতিরূপ কোনও একটি দেবতাতে পাওয়া যায় না; রুদ্রশিব, কাল ও যম এই তিনজন মিলেই দৈবের কাছাকাছি আসে। কিন্তু পরবর্তী যুগের সাহিত্যে নিয়তির নানা বিমূর্ত কল্পনা বহু নামে দেখা দেয়। এই সব বিমূর্ত দেবকল্পনাই ভাবজগতে প্রাধান্য লাভ করে, যদিও প্রাচীন দেবতারা তখনও আছেন। কোনও একটি দেবতাতে নিয়তির সমস্ত ভূমিকা ও অনুষঙ্গ আরোপ করা যায় না। এই নিয়তিও কালে কালে নবতর অনুষঙ্গ সংগ্রহ করে চলেছিল। সংহিতা সাহিত্যে নিয়তি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, হয়তো অথর্ববেদের ‘রোহিত-কাল’-এ এর কিছু পূর্বাভাস মেলে। নিয়তির প্রথম দেখা পাই কিছু বৌদ্ধ সাহিত্যে ও মহাকাব্য দুটিতে; পুরাণে নানা নামে নিয়তির বিকাশ ঘটেছে।
লাতিন ‘ফাতুম’-এর আক্ষরিক অর্থ হল কোনও উচ্চারিত উক্তি— ভবিষ্যদ্বক্তার কিছু অনুষঙ্গ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। লাতিনে ‘ফরতুনা’ মানে দৈব, যদিও ক্রমে ক্রমে এর অর্থ ‘ফাতুম’ থেকে সরে যায়, তখন ‘ফাতুম’দুর্ভাগ্যের ও ‘ফরতুনা’ সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। প্রাচীন জার্মানিক সাহিত্যে ‘হালকীরিস’ (সংখ্যায় ন’টি) প্রধান দেবতা ‘ওডিন’-এর আজ্ঞাচারিণী। এদের সঙ্গে নর্স দেবকল্পনায় ‘উদ্র’ (উর্দু)-এরও খানিকটা ভাবগত সাদৃশ্য আছে।
ইরানে মাজদীয় ধর্মে নিয়তির ভূমিকা সর্বেচ্চ। ‘সারা পৃথিবীর ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রিত করে নিয়তি… কাল ও নিয়তির সিদ্ধান্ত (যা) নিজেই ‘জুৰ্বান’, সর্বাভিভু, দীর্ঘকালের রাজত্ব (তাঁর)।’ (উইনস্টন: হিস্ট্রি অব রিলিজ্যন্স’, ১৯৬৬, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ১৯৮) মানিকীজম— যা মাজদাবাদের অনেক কিছুই উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে— তা-ও মানুষের জীবনের সুখদুঃ খের জন্যে ভাগ্যকেই একমাত্র নিয়ন্তা বলে স্বীকার করেছে। প্রাচীনযুগের শেষ ভাগে গ্লস্টিসেজম-এর পরিত্রাণতত্ত্বের সঙ্গে ঈশ্বরের ওপারে এক নিয়তির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজ্যন: ফেট) যদিও কোনও কোনও ধর্ম ও দেবকল্পনার নিয়তি ও দেবতার মধ্যে সহযোগিতা বা সংঘাত ঘটে, তবুও সাধারণ ভাবে এ কথা স্বীকৃত যে নিয়তি দেবতানিরপেক্ষ ও দেবতার ঊর্ধ্বে এক স্বয়ম্ভর শক্তি। বোধহয় এর পিছনে এমনই কোনও ধারণা সক্রিয় ছিল যে নিয়তিকে যদি দেবতার মতো সাধ্যসাধনা করে অনুকূল করা যেত— যেমন দেবতাদের ক্ষেত্রে সম্ভব— তা হলে নিয়তি আর নিয়তি থাকত না। এই ক্ষেত্রে আমরা দেবতা ও নিয়তির মধ্যে এক আপাত বিরোধ দেখি, কারণ দেবতারা আর নিয়তি তত্ত্বগত ভবে এক সঙ্গে বিদ্যমান থাকতেই পারে না; একটি অপরটির সত্তাকে লঙ্ঘন ও খণ্ডন করে। কিন্তু জীবন সম্বন্ধে মানুষের প্রতিক্রিয়া ও বোধ সর্বত্রই এমন জটিল ও বিরোধী বস্তুর সমাহারে নির্মিত যে, পরস্পরবিরোধী তত্ত্বগুলি ভাবজগতে সহাবস্থান করে।
হেলেনিস্টিক গ্রিসে (যখন গ্রিক সাম্রাজ্য প্রাচ্যেও বিস্তৃত) যে অর্ফিক মতবাদের উদয় হয় তাতে নিয়তিই সেই অমোঘ বিধান যা মানুষের জন্ম, মৃত্যু, পুনর্জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতকে দেবী হিসাবে ‘তুখে’ ক্রমশই শক্তিমতী হয়ে উঠছিলেন। স্বয়ং প্লিনি-ও স্বীকার করেন যে, ‘আমরা বহুলাংশে নিয়তির কর্তৃত্বাধীন এবং নিয়তি ভগবানের স্থান নিয়েছে।’ (ন্যাচারাল হিস্ট্রি ২:২২) ভাগ্য মানেই সম্ভাব্যতা, নিষ্কারণতা, বিপদ, সুযোগ, বিশৃঙ্খলতা, আপতিকতা, সৌভাগ্য, দৈব এবং স্বয়ংক্রিয়তা; অর্থাৎ তুখে। ওই সব শব্দগুলির মধ্যে ভাবগত পার্থক্যের সীমারেখা অতি সূক্ষ্ম, কিন্তু এগুলির প্রত্যেকটি ধরে নেয় যে, সাধারণ ভাবে মহাবিশ্ব কোনও এক নিয়মে কাজ করে। এ নিয়ম প্রাকৃতিক, নৈতিক অথবা ধর্মীয় হতে পারে, কিন্তু দৈব মানে তেমন কোনও নিয়মের একান্ত অভাব।
নিয়তি কী? এর কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, কিন্তু সারা পৃথিবীতে যুগ যুগ ধরে একটা পরিসরে নিয়তি সম্বন্ধে মতানৈক্য রয়েছে। মানুষ যখন সুখী, জীবন যখন সহজ ও আনন্দের, অথবা সহসা যখন কোনও অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্যের উদয় হয়, তখন মানুষ নিয়তির কথা বলে না, বলে সৌভাগ্যের কথা। অতএব নিয়তির সঙ্গে এর সম্পর্ক বিপরীত অভিজ্ঞতার, অর্থাৎ দুঃখের। যে দুঃখ দীর্ঘ বিলম্বিত, অথবা/এবং তীব্র, আর মূলত, সহজ দৃষ্টিতে, উপলব্ধিকারীর কোনও কর্মের সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই। উল্টো এক ভাবে এই বোধ দৃঢ়তর হয়, যখন মানুষ দেখে দুষ্কৃতিকারীরা সুখে আছে, সমৃদ্ধি ভোগ করছে আর ধার্মিক মানুষ নিরতিশয় দুঃখে দিনপাত করছেন। যেহেতু ওই সুখ বা দুঃখের সঙ্গে কর্তার কোনও কার্যকারণ সম্বন্ধে যোগ ছিল না তাই দুর্ভাগ্য আর সৌভাগ্য দুটিকেই মানুষ নিষ্কারণ বলে মনে করে।
জার্মান দার্শনিক ফিখটে নিয়তিবাদের সমর্থনে বলেন যে, যে কোনও যুক্তিহীন কর্মফলই নিয়তি। শেলিং বলেন, নিয়তিবাদ হল সেই তত্ত্ব, যা কর্ম এবং ইতিহাসকে অন্ধ ও পূর্বনিরূপিত হিসেবে দেখে। শোপেনহাওয়ারের কাছে কিন্তু নিয়তিবাদ একটি মৌলিক সত্য। (রিটার: পৃ. ৯১৪) কাজেই এই তিন দার্শনিকের মধ্যে মতৈক্য নেই: ফিখটে যেখানে নিয়তিকে যুক্তিহীন কর্মফল’ বলছেন, শেলিং তাকে একটি ‘তত্ত্ব’ বলছেন এবং শোপেনহাওয়ার তাকে ‘মৌলিক সত্য’ বলছেন। প্রাচ্যের মতো প্রতীচ্যও শুধু যে নিয়তিবাদের সঙ্গে পরিচিত ছিল তাই নয়, একে ‘মৌলিক সত্য’ ও ‘তত্ত্ব’ বলেও ভেবেছে। সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতাগুলি নিয়তিবাদকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে; ভারতবর্ষ নিয়তিবাদের ওপর গড়ে তুলেছে বিপুল একটি সাহিত্য, যার প্রকৃতি, গুণ ও অনুষঙ্গ পৃথক, পরিবর্তনশীল ও পরিবর্ধনশীল।
বোধহয় দার্শনিক নিয়তিবাদের প্রথম প্রবক্তা হল আজীবিকবাদ: এখানে নিয়তি অমোঘ এবং শেষ কথা, অর্থাৎ মানুষের জীবনের সব ঘটনা বা ঘটনাপ্রবাহের অন্তিম প্রামাণ্যতা আছে নিয়তিবাদে। এ মতে ‘প্রয়াস, শ্রম, শক্তি, তেজ বা মানবিক বল বলে কিছু নেই, সব কিছুই অপরিবর্তনীয় ভাবে স্থির।’ (উবাসগদসাও ১:৯৭:১১৫, গোসালের মত সম্বন্ধে বিবৃতি) আবার, ‘প্রাণীর চরিত্রবিকারের কোনও কারণ নেই; বিনা কারণ বা হেতুতেই তারা বিকৃতচরিত্র হয়ে যায়। প্রাণীর চরিত্রের নিষ্কলুষতারও কোনও কারণ নেই, বিনা কারণে বা হেতুতেই তারা নিষ্কলুষ হয়… সংক্ষেপে, মানুষের প্রয়াসের ওপর নির্ভর করে না… মানুষের অবস্থান্তর যা ঘটে তা সবই… নিয়তি-নির্ভর।’ (দীঘনিকায় ১ম খণ্ড, পৃ. ৫৩, পালি টেক্সট, সোসাইটি সংস্করণ। গোসালের মতের উপর বিবৃতি) তাই গোসাল হলেন, প্রথম, একমাত্র ও সত্যিকারের খাঁটি নিয়তিবাদী: যে দুয়ে শক্তি সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে সেই নিয়তির অমোঘতায় পূর্ণ বিশ্বাসী। হয়তো এই সময়কার কাছাকাছি রচনা শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে শুনি, ‘কালঃ স্বভাবো নিয়তির্যদৃচ্ছা’ (১:২) অর্থাৎ কাল, প্রকৃতি ও নিয়তি অমোঘ এবং স্বেচ্ছাচারী পূর্বনিরূপণ। (সুশ্রুত তাঁর চিকিৎসাবিদ্যার গ্রন্থে ১:১১:৩ শরীরস্থান’ পরিচ্ছেদে এই উক্তিটি উদ্ধৃত করেছেন)
নিয়তি মানুষের কল্পনাপ্রসূত; কিন্তু এ কল্পনা জীবনের বহু অভিজ্ঞতা থেকে সরাসরি উঠে এসেছে এবং সে সব অভিজ্ঞতার দ্বারা রূপপরিগ্রহ করেছে, ‘নিয়তির শক্তিকে যদি নির্ব্যক্তিক মনে করা যায়, তা হলে তার সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক স্থাপন করাই অসম্ভব… ভাগ্যের নিয়ন্তা বলে কোনও ব্যক্তিকে বিশ্বাস করলে ধর্মীয় আচরণ এসে পড়ে… কিন্তু এই দুই বিশ্বাসই একই সঙ্গে একই ব্যক্তিতে থাকে। গ্রিক ও টিউটনিক (ইংরেজ জার্মানদের আদিজাতি) ধর্মে নিয়তি খুব তীব্র হয়ে ওঠে। …মানুষের জীবনের যা ঘটে তার প্রতিক্রিয়াই তার ধর্মবোধের মূলে; সে নিজেকে নির্ভরশীল, শক্তিহীন ও প্রতারিত বোধ করে। (জীবনের) ঘটনাগুলির পশ্চাতে সে একটি উদ্দেশ্য বা তাৎপর্য খোঁজে, হয়তো পায়ও; ফলে (আসে) ভগবান, আর তা না হলে নিয়তি বা দৈব…। প্রায়ই অমোঘতা নয় কিন্তু খামখেয়ালিপনাই নিয়তির চরিত্র নিরূপণ করে। বাস্তবে ঈশ্বর বিশ্বাস ও নিয়তিবাদ পরস্পর সংমিশ্র।’ (রিংগার্ন, ১৯৬৭, পৃ. ৮, ১০ )
শুধু একেশ্বরবাদী সেমিটিক ধর্মেই নয়, বহু দেবদেবী প্রাচীন সুমের, মিশর, মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, ইরান এবং পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে নিয়তি ও এক বা একাধিক নিয়ন্তা দেবতা সহাবস্থান করতেন। কোনও কোনও ধর্মে এই সব দেবতারা নিয়তির কর্তৃত্বাধীনে কাজ করতেন, কোথাও নিয়তি স্বনামে বা অন্য নামে দেবমণ্ডলীর মধ্যেই থাকতেন, কোথাও মানুষের জীবনের সমস্ত দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল দেবতা ও নিয়তি উভয়ের উপরে, যৌথ ভাবে। এ সবের মধ্যে সাধারণ মানদণ্ড হল নিয়তির অপরিবর্তনীয়, অবোধ্য, যথেচ্ছাচারী আচরণ— পৃথিবীর সব দেশে ও সব যুগেই। এ দুটি লক্ষণ নিয়তিকে এক ভয়াবহ শক্তিতে পরিণত করে, যে-শক্তি মানুষের ঊর্ধে এবং দেবতারও ঊর্ধে। সব দেশেই এ বিশ্বাস আছে যে, নিয়তির বিরুদ্ধতা সর্বদাই ব্যর্থ হতে বাধ্য, যদিও সর্বত্রই নিয়তির পাশাপাশি পুরুষকারের প্রকাশও দেখা যায়। এতেই প্রমাণ যে নিয়তি হল বিরুদ্ধ, অপ্রত্যাশিত। যে সব ঘটনার জন্যে মানুষের কোনও প্রস্তুতিই নেই তাদের সামনে মানুষের অসহায়তারই এক প্রকাশ। তাই মানুষ নিয়তিকে যদৃচ্ছা বলেও অভিহিত করে, আবার যখন নিয়তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে চায় না তখন তার প্রতিরোধ করারও চেষ্টা করে।
অধিকাংশ ধর্মবিশ্বাসে ইতিমধ্যেই নিয়তিবাদের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ‘মায়া’ সভ্যতার প্রাচীন গ্রন্থ পোপেল হুহ, ফ্লরেন্টাইন কোডেক্স, চিনের লৌকিক ধর্মসাহিত্য— এ সবের মধ্যেও নিয়তিবাদের চিহ্ন আছে। জাপানে আনেসাকির মতে, ‘মাপ্পো’র ধারণা, বৌদ্ধদের মধ্যে প্রচলিত এক নিয়তিবাদের ধারণা, যার ভিত্তি নৈরাশ্যবাদে। (আনেসাকি, ১৯৭৪, পৃ. ১০১-১০২) অতএব মুখ্য ধর্মতন্ত্রেই হোক আর লোকায়ত গৌণ ধর্মতন্ত্রেই হোক, নিয়তি প্রবল ও প্রধান ছিল। এ দুটি তন্ত্রকে সত্যই পৃথক ভাবে চিন্তা করা যায় কিনা তা নিয়েও বিতর্ক আছে, কারণ এ দুটির মধ্যে অবিরল পারস্পরিক আদান প্রদানের সম্পর্ক, যার ফলে একে অপরকে ক্রমাগতই প্রভাবিত করেছে। কিন্তু যদি লিখিত সরকারি ধর্মকে, মৌলিক ভাবে পরম্পরাগত, সংক্রমিত ও অশিক্ষিত-জনমানসে-সঞ্চরমান গৌণধর্মতন্ত্র থেকে পৃথক করাও যায়, তবু দেখা যাবে উভয়ের মধ্যেই নিয়তিবাদ বর্তমান
বেদের সংহিতা চতুষ্টয় নিয়তি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব, ব্রাহ্মণ সাহিত্যের অধিকাংশও তাই। সংহিতার প্রার্থনাগুলির পশ্চাতে এক মানবহিতৈষী দেবমণ্ডলীর অস্তিত্ব দেখা যায়; দেবতাদের যথোপযুক্ত স্তুতি ও নৈবেদ্য দিয়ে অনুকূল করা যায়, যাতে তাঁরা উপাসকদের আশীর্বাদ করে অভিলাষ পূরণ করেন, বিপদে সাহায্য করেন, যুদ্ধ, ব্যাধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সংকট থেকে উদ্ধার করেন। তাঁদের সম্মত করানো যেত মানুষকে বীর্য, শস্য ও পশুপালের প্রজনিকা শক্তি দান করতে, প্রভূত পরিমাণ ধন দান করতে (যার অনেকটাই প্রাগার্যদের সম্পত্তি লুঠ করে পাওয়া), দীর্ঘজীবন এবং ঋগ্বেদের শেষ মণ্ডলে, মরণোত্তর সুখের আভাস দিতে। জীবন ছিল সুখী ও কাম্য। যুক্তিনির্ভর এক বিধান, ঋত মহাবিশ্বকে নিযন্ত্রণ করছে; কাজেই সাধারণ মানুষের মনোভাব ছিল বিশ্বাস আর হার-না-মানা এক আশাবাদ। এমন একটা জীবনবোধে নিয়তির প্রাধান্যের কোনও অবকাশ ছিল না।
অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায়, বিশেষত সুমের, আক্কাদ, আসীরিয়া, ব্যাবিলন, চিন, ইরান, গ্রিক ও মেক্সিকোতে— যখন ভারতে ঋগ্বেদ সংহিতা সংকলিত হচ্ছে, তখনও— এ সব জায়গায় নিয়তিবাদের অনেক পরিচয় মেলে। ওই সব সভ্যতায় প্রাথমিক নগরায়ণের প্রমাণ মেলে, ওই সময়ে জীবনের মূল্যমান সম্বন্ধে মানুষের বোধ পাল্টে যায়, জীবন সম্বন্ধে সংবেদন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। পশুচারী, যাযাবর আর্যরা তাদের এক ভিন্নতর জীবনবোধ নিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। যে উজ্জ্বল আশাবাদ শতবর্ষের পরমায়ু কামনা করে যাতে ‘উদয়সূর্যকে প্রতিদিন, দীর্ঘকাল দেখতে পাওয়া যায়’, সে আশাবাদ থেকে পরবর্তী কালের আতঙ্কিত নৈরাশ্যবাদ অনেক দূরে। এই নৈরাশ্যবাদে সংলগ্ন হয়ে আছে সেই ভয়ংকর অনাশঙ্কিত সন্ত্রাস, যা আতঙ্ক উদ্রিক্ত করে। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ সম্ভবত নিয়তিতে বিশ্বাসী ছিল— যেমন প্রাথমিক নগরায়ণে সর্বত্রই ছিল, যদিও ভারতবর্ষে তার কোনও দলিল আমাদের কাছে নেই। ‘অনুমান করা যায় যে প্রাগার্য গঙ্গা উপত্যকাবাসীরা হয়তো আদিম ধরনের কোনও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী ছিল।’ (ম্যাকমিলান এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১২৮) এ বিশ্বাস সম্ভবত গাঙ্গেয় উপত্যকার চেয়েও অনেক ব্যাপকতর অঞ্চলে ছিল এবং পূর্বে সিন্ধু উপত্যকাতেও থেকে থাকতে পারে। যদিও যখন আর্যদের ব্রাহ্মণসাহিত্যের শেষ পর্যায়ে দেখি তখন তারা উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিবাসীই ছিল এবং এ বিশ্বাস প্রাচীনতর সিন্ধু সভ্যতা থেকেও পেয়ে থাকতে পারে এবং ধীরে ধীরে আত্মস্থ করে থাকতে পারে।
এ সম্বন্ধে একটা অস্পষ্ট প্রমাণ হয়তো আছে; আর্য আগমনের অর্ধসহস্রাব্দের মধ্যেই ব্রাহ্মণসাহিত্যের শেষাংশ ও উপনিষদে জন্মান্তরবাদের মধ্যে এর সূচনা দেখা গেল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই সময়েই আর্যাবর্তে দ্বিতীয় নগরায়ণ ঘটেছে, যার একটা অবশ্যম্ভাবী ফল হল নিয়তিবাদ, যেমন মিশর, চিন, মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস, মেক্সিকোর প্রথম নগরায়ণে ঘটেছিল। ব্রোঞ্জ যুগের নাগরিক সংস্কৃতির প্রভাব ছাড়াই স্বতন্ত্র ভাবে এর বিকাশ ঘটে এমন তর্ক করা যায়, কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে আর্যরা প্রাগার্য নাগরিক সভ্যতার দানগুলি ধীরে ধীরে গ্রহণ করছিল: বাণিজ্য, পাকা ইঁটের বাড়ি, কৃষি, প্রাথমিক ব্যবসা, ধীরে ধীরে কিন্তু অনিবার্য ভাবে গোষ্ঠীর ও গোষ্ঠীগত মূল্যবোধের বিনাশ এবং পরোপজীবী একটি শ্রেণির উদ্ভব, যারা চাষ, কুটিরশিল্প, চারুশিল্প, বাণিজ্য ও ব্যবসার কর্ণধার হয়ে উঠল। জীবনযাত্রার জন্য এদের আশপাশের প্রাথমিক উৎপাদকের ওপরে নির্ভর করতে হত। চাষের হোক বা শিল্পেরই হোক— জমি দুটি স্পষ্ট বর্গের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেল: (১) প্রাথমিক উৎপাদক এবং (২) ভোগী-ক্রেতা-বিক্রেতা ও উৎপন্ন কৃষিজাত ও শিল্পজাত বস্তুর বণিক। এইখানেই সূত্রপাত হল শ্রেণি-বিভাজনের, যা পশুচারী যাযাবর আগন্তুকদের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা ছিল। ক্রমবর্ধমান ও বিস্তীর্যমাণ নগরগুলিতে রচিত বেদের উত্তরভাগের সাহিত্যে সে বিভাজনের স্পষ্ট নিশানা দেখা যায়।
লোহার আবির্ভাব এবং মৌর্যযুগের মধ্যে লোহার-ফলাযুক্ত লাঙলের ব্যবহার, নগরকেন্দ্রিক ষোড়শ মহাজনপদ, বৌদ্ধযুগের অব্যবহিত পূর্বে যার উৎপত্তি— এ সব প্রতিষ্ঠিত তথ্য। আর্য জীবনবোধ তীব্র ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল। গোষ্ঠী ও কৌম ভেঙে ‘কুল’ (বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার) আসাতে পারিবারিক বোধ এবং নীতিও পাল্টাচ্ছিল। চাষের ও পশুচারণের জমি ‘কুল’ এবং ‘গ্রামে’র অধিকারীর জন্যে পৃথক নির্দিষ্ট অংশ ছিল। অর্থাৎ কৃষি ও পশুপালনে ‘কুল’ যখন সম্পত্তি ভোগ করতে শুরু করল তখন ব্যক্তিগত, অন্তত ‘কুল’-গত মালিকানা দেখা দিল। আর্যরা প্রাগার্য জমি দখল করে পশুপালন ও কৃষিভূমির প্রসার ঘটাল, সুতরাং ধনে উদ্বৃত্ত দেখা দিল; এবং শ্রেণিগুলির মধ্যে অন্তর্বিরোধ ক্রমে তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠতে লাগল। প্রাগার্য-আর্য সম্মিলিত এক জীবনবোধের উদয় হল, যা উভয়পক্ষই গ্রহণ করল। এর একটা লক্ষণ দেখা দিল— নিয়তিবাদ। সংহিতাসাহিত্যে জন্মান্তর, কর্মবাদ নেই, ব্রাহ্মণসাহিত্যের শেষাংশ উপনিষদে আছে, এবং এখান থেকেই শুরু হল নিয়তিবাদের সুদূরপ্রসারী বিকাশ। লুইস মামফোর্ড বলেন, ‘সভ্যতার সবচেয়ে দামি যৌথ আবিষ্কার, নগর, ভাষা আবিষ্কারের ঠিক পরেই। এ দুটিই সভ্যতা সঞ্চরণের মাধ্যম, এবং নগর প্রথম থেকেই বিষ্ফোরক এক আভ্যন্তরীণ শক্তির ধারক।’ (১৯৬১, পৃ. ৫৩); এতে তিনি বিষ্ফোরণের একটি অতিপ্রসারিত ধারণা দেন। একটি বিষ্ফোরণী লক্ষণ হল সমাজের মধ্যে শ্রেণিবিভাজন, তার দ্বারা সৃষ্ট হল একটি অবসরভোগী শ্রেণি, যার হাতে দায়িত্ব ছিল সমাজের আধ্যাত্মিক অভিভাবকতার। গ্রামেও পুরোহিতশ্রেণি ছিল কিন্তু নগরের পুরোহিত গুণগত ভাবে কিছু পৃথক ছিল, রাজা ও বিত্তমান শ্রেণির সঙ্গে এঁদের সম্বন্ধ নিকটতর; এঁরা গোষ্ঠীর হয়ে যজ্ঞ সম্পাদন করতেন, প্রচুর আড়ম্বরের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের ঐতিহ্য ও পারত্রিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করতেন, এবং এই উভয়ের জন্যেই এঁদের বিধিনির্দেশ দ্রুত বর্ধিত হতে লাগল। এই পুরোহিতদের একটি দান হল— যে নিগূঢ় শক্তি মানুষের জীবন পরিচালনা করে তাকে একটি রূপ দেওয়া। এঁরা তার নাম দিলেন, ‘নিয়তি’, এবং যে, দুর্ভেদ্য, অদৃশ্য-অগম্য-লোকে মানুষের নিয়তি নির্মিত হয় সেই গূঢ় দিব্য ও ভূগর্ভস্থ লোকের অধিকার এঁদের হাতেই রইল।