ভারতে গান্ধী-যুগ – সম্পাদকীয়, মাসিক বসুমতী
প্রহারে—পীড়নে ভারতের জন—সাধারণ তখন জড় পদার্থ। অন্যায়—অসাম্য, অধর্ম্ম ও নিব্বীর্যতার সুযোগে যে বেদুইন সভ্যতা ভারতকে গ্রাস করেছিল, সে সভ্যতা ভারতের ভেদকে শাশ্বত করে তুলেছে—সে ভেদের সুযোগে মহাভারতকে গ্রাস করেছে ইউরোপ। ভারতের জনগণের শোণিত শোষণ করে প্রাণটুকুও কেড়ে নিয়েছে তারা।
এমন সময় মাথা তুলল দুনিয়ার গণশক্তি। ধ্বনি উঠাল—সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা। জাগে বিদ্রোহ, বাধে বিপ্লব—রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সমাজের বিরুদ্ধে,গলিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। যৌবনের যে জল—তরঙ্গ নব্য ভারতেও এসে পৌঁছে। ভেঙ্গে গড়বার আয়োজন এখানেও চলে। কাথিয়াবাড়ের সুদামপুরীতে মোহনদাস যখন জন্মেছিলেন (১৮৬১ খ্রঃ—২ অক্টোবর, প্রায় ৭—১৫ মিঃ) এদেশে এক দিকে যেমন পাশ্চাত্যপন্থী ইয়ং বেঙ্গলের প্রভাব, তেমনি প্রভাব রাজা রামমোহনের, কেশবচন্দ্রের ও সর্ব্বোপরি শ্রীরামকৃষ্ণের। এর ৩ বছর পরে আর এক জন যুগনেতা শ্রীঅরবিন্দের আবির্ভাব। প্রাচীনতম পরিস্থিতিতে মোহনদাসের জন্ম। পিতা কাবা গান্ধীর, চতুর্থ পক্ষের স্ত্রী পুতলিবাঈ—এর চার সন্তানের সর্ব্বকনিষ্ঠ মোহনদাস। তাঁদের ধনি—পরিবার দুই পুরুষ ধরে সামন্ত নৃপতিদের প্রধান মন্ত্রিত্ব করেন। কাবা গান্ধী রাজকোটে যখন বিচারপতির পদ নিলেন, তখন মোহন দাসের ৭ বছর। পড়েন রাজকোটের এক পাঠশালায়। এই বয়সেই ধনী—বণিক গোকুলদাস মাকনজীর শিশুকন্যা কস্তুরবার সঙ্গে তাঁর বিয়ের কথাবার্ত্তা পাকা হয়, আর ৫ম শ্রেণিতে পড়বার সময় সে বিয়ে হয় সম্পন্ন। মোহনদাসের মন এতে সায় দেয়নি, তিনি বলেছিলেন—‘‘I can see no moral argument in support of such preposterously early marriage’’ সে ইয়ং বেঙ্গলের যুগ। সর্ব্বত্র বেপরোয়া বিদ্রোহ। ইংরেজ—বিদ্বেষের অঙ্কুরিতও হচ্ছে একটু একটু। রাজকোটে মোহনদাসের কিশোর বন্ধুরাও চঞ্চল। তারা বললে—”ইংরেজরা কেমন শক্তিমান দেখেছ? হ’য় ৫ হাত লম্বা জোয়ান! তারা খায় মাংস। তাইতেই ত’ ক্ষুদে ভারতবাসীর উপর করে কর্ত্তৃত্ব। দেশ যদি মাংস খেতে সুরু করে, তা হলেই তারা ইংরেজের সঙ্গে লড়তে পারবে।” মোহন দাসেরও বিশ্বাস হল তাই। গোপনে চলল বন্ধুদের সঙ্গে মাংস খাওয়া, গোপনে চলল ইংরেজের মত পা ফাঁক করে সিগারেট খাওয়া।
বয়স তখন ১৬ (১৮৮৫)। বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের হ’ল জন্ম। রাজকোটে তাঁর বাবার হল মৃত্যু। (১৮৮৬ শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধান) এল পরিবর্ত্তন ভারতের ভাব—জগতে, গান্ধীজীরও মনে। ১৮ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাশ করে ভবনগরের শ্যামলদাস কলেজে ভর্ত্তি হয়ে দেখলেন, লেখাপড়ার অসুবিধে। বন্ধুরা বললেন, যাও বিলেত। মা বললেন, ছেড়ে কি করে থাকব? জিদ ধরলেন মোহনদাস, যেতেই হবে। বললেন—দিব্বি করছি মা, মদ, মাংস, মেয়ে তিন বর্জ্জন করব। সমাজ বললে, সমুদ্রযাত্রা—সে হতেই পারে না। মোহন বললে—কে মানে তোমাদের? সমাজ করে এক ঘরে। নির্দ্দেশ দেয়, বিলেত যাত্রায় যে ওকে সাহায্যে করবে তার জরিমানা পাঁচ সিকে।
কিন্তু পাঁচ সিকে ওঁকে ধরে রাখতে পারে না। বোম্বাই থেকে জাহাজে চড়লেন (১৮৮৮, ৪ঠা সেপ্টেম্বর)। বিলেত যখন পৌঁছলেন, তখন ‘জেন্টেলম্যান’ সাজবার জন্য ইংরেজী কেতার পোশাক হ’ল, সিল্কের হ্যাট হল। নাচনা শিখতে গিয়ে ছন্দে পা পড়ল না। বেহালায় ইংরেজী গৎ বাজাতে গিয়ে বেসুরো বোল বেরুল। বক্তৃতা শিখতে চেষ্টা করলেন, ফরাসী ভাষার পাঠ নিতেও চাইলেন, সুবিধে হ’ল না।
বিলেতেও তখন ভারতীয় স্বাদেশিকতার অনুকূল হাওয়া বইছে। ফরাসী বিপ্লবের ভাবধারায় প্রবাসী ভারতবাসীরা উদবুদ্ধ। মোহনদাস সে প্রভাব এড়াতে পারেন নি। জীবনধারা তাঁর ভিন্নমুখে চলে।
তিনি হিসেবী হলেন। খরচা আদ্ধেক কমালেন। ৮।১০ মাইল প্রত্যহ হাঁটতে লাগলেন। খুব পড়াশুনা করেও দুই বারের চেষ্টায় লণ্ডন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করলেন (১৮৯১, ২১ বৎসর)। ঠিক এই সময় কেমব্রিজে বসে অরবিন্দ এক্সয়েড ঘোষ ভারত উদ্ধার করবার জন্য সন্ত্রাসবাদী ভাবধারায় পুষ্ট হচ্ছিলেন, তখন মোহনদাস থিওসফিষ্টদের সঙ্গে গিয়ে মাথু আর্ণল্ডেব গীতা—পাঠে ব্যস্ত।
ব্যারিষ্টার খেতাব নিয়ে এরই এক বছর পরে, (১২ই জুলাই, ১৮৯১) মোহনদাস ভারতে ফিরলেন ওকালোতী ব্যবসা করার জন্য। ওতে সুবিধে হয় না। সার ফিরোজ শা মেটা বললেন—’সদ্য বিলেতে থেকে ফিরেছ। ইংরেজ রাজপুরুষদের জানতে বুঝতে দেরী আছে।’ কাথিয়াবাড়ের চক্রান্ত তাঁর খাতে সয় না। পোর বন্দরের এক মুসলমান কারবারী (আবদুল্লা কোং) চাকরী দিয়ে যখন মোহনদাসকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠান (১৮১৩, এপ্রিল) আর এই বছর ভারত স্বাধীন করবার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে অরবিন্দ এসে পৌঁছলেন, বিলেত থেকে ভারতে আর যুব—ভারতের মূর্ত্ত বিগ্রহ স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বাণী বিশ্বময় প্রচার করতে বের হলেন।
গায়ে লম্বা কোট আর মাথায় পাগড়ী, মোহনদাস নাটালে ডার্ব্বান আদালতে গেলেন ব্যারিষ্টার করতে। ম্যাজিষ্ট্রেট বললে, খুলে ফেল পাগড়ী। মোহন বললেন, সে হবে না। আদালত থেকে বেড়িয়ে এসে সংবাদ পত্রে আন্দোলন চালাতে গেলেন। সাংবাদিকরা বললে, ‘Unwelcome visitor’। ওরা ভারতবাসীদের নাম দিয়েছিল ‘কুলী’ ‘স্যামি’। মোহনদাসের নাম হ’ল কুলী ব্যারিষ্টার। ওখানে পৌঁছানর ৭।৮ দিন পরে ট্রেণে ফার্ষ্ট ক্লাসের টিকিট করে তিনি চললেন প্রিটোরিয়া। নাটালের রাজধানী মারিৎসবুর্গ ষ্টেশনে শ্বেতাঙ্গরা ‘কালা’ লোককে তাদের সঙ্গে বসে চলতে দেখে বললে ‘এখানে বসা চলবে না।’ নামতে অস্বীকার করলে এক কনষ্টেবল ধাকা দিয়ে নামিয়ে দিল ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে। শীতের রাতে সেখানে বসে মোহনদাস কাঁপতে লাগলেন—সঙ্কল্প করলেন, এই কালা বলার ভেদ ভাঙব—ভাঙব।
সেই রাতেই তিনি আবার ট্রেণে উঠে প্রাতে চার্লস টাউনে পৌঁছলেন। তার পর ঘোড়া—গাড়ি। গাড়ির কণ্ডাকটার শ্বেতাঙ্গ। কণ্ডাকটারের স্থান কোচম্যানের পাশেই থাকে। কিন্তু শ্বেতাঙ্গটির হুকুম, মোহনদাসকে কোচম্যানের পাশে বসতে হবে। নিজে গিয়ে বসল ভিতরে। কয় ঘণ্টা পর গান্ধীজীকে যেখানে ছিলেন, সেখান থেকে উঠিয়ে দিয়ে বললে, পায়ের তলায় বস। গান্ধীজী বললেন, হতে পারে না। সাদাটা তাঁর কান দিল মলে—তাঁকে টেনে নামাতে চাইল, মারতে লাগল। মোহনদাস কোচবক্সের পিতলের রেলিং চেপে ধরে অচল পড়ে রইলেন। সন্ধ্যায় গাড়ি ষ্টাণ্ডার্টনে পৌঁছলে দাদা আবদুল্লার বন্ধুরা তাঁকে নামিয়ে নিয়ে গেলেন। কোচ কোম্পানীর এজেন্টকে সব ব্যাপার জানিয়ে তিনি পত্র দিলেন, কিন্তু সাদাটার শাস্তির জন্য জিদ করলেন না।
সেই রাতেই জোহান্সবার্গ পৌঁছে মোহনদাস গ্র্যাণ্ড ন্যাশনাল হোটেলে গেলেন, হোটেলর কর্ত্তৃপক্ষ তাঁকে অস্পৃশ্য ভারতবাসী বলে ঢুকতে দিল না।
মোহনের বয়স তখন ২৫। যুগটা এশিয়ার যুব—জাগবণের। ভারতে লর্ড ডাফরিণের কীর্ত্তি ভারতীয় মহাসভা ইংরেজের আছে করজোড়ে বারোয়ারী ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে অরবিন্দের নেতৃত্বে যুব—ভারত বলছে—আবেদন —নিবেদনে দেশ স্বাধীন হবে না, চাই Purification by blood and fire (৭ই আগস্ট, ১৮১৩)।—স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে ভারতের কথা প্রচার করে ভারতীয় তরুণদের বুকে প্রদীপ্ত করলেন আশা ও উৎসাহ (১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩)—চীনে খুব—আন্দোলন মিশরে প্যাট্রিয়টিক দলের (হাবস—এল—বাতান) আন্দোলন—দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়রদের উদ্যোগ—রুশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে জাপানের তোড়জোড়। শ্রীরামকৃষ্ণের যিশুধর্ম্ম সাধনায় যুব ভারতের ভবিষ্য কর্ম্মধারার সে আভাস মিলেছিল, তার ভার যেন এসে পড়েছিল মোহনদোসের উপর। তাই দেখতে পাই, শ্রীরামকৃষ্ণের তিরোধানের ৭ বছর পরে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি অবহেলিত ভারতবাসীর সেবার জন্য সর্ব্বধর্ম্মদর্শনের, বিশেষতঃ খৃষ্ট—দর্শনের সাধনায় ব্যস্ত। তিনি পড়লেন কোরাণ, বাইবেল টলষ্টয়ের Kingdom of God is Within You’, ম্যাক্সম্যূলারের ‘What India can Teach us’ জরাথ্রুষ্টের বাণী, উপনিষদ প্রভৃতি পড়তে লাগলেন। আর এ সব দর্শনের সাধনা হতে লাগল নিয্যাতিত ভারতবাসীর সেবায়। তিনি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করলেন যে, বিদেশেও ভারতবাসীরা খৃষ্ট—উপাসক জাতিদের নিকট লাঞ্ছিত, ভারবাহী ক্রীতদাস। তাই প্রধানতঃ অহিংস খৃষ্টান সাধনা দিয়ে তিনি খৃষ্টানদের মনে সদবুদ্ধি ও সহানুভূতি জাগিয়ে তুলবার ভার নিয়েছিলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতবাসীদের সম্বন্ধে সব তথ্য তিনি সংগ্রহ করে ফেললেন। প্রিটেরিয়ায় ভারতবাসীদের এক সম্মেলন আহ্বান করে ট্রান্সভালের ভারতীয়দের দুর্দ্দশার কথা তিনি বর্ণনা করলেন। এ সভায় যোগ দিয়েছিল বেশির ভাগ মুসলমান (যেমন) বণিকরা, হিন্দুর সংখ্যা ওখানে কম। সভায় গান্ধীজী বক্তৃতা করলেন—প্রথম বক্তৃতা। বললেন, প্রথমে আত্মশুদ্ধি কর, সত্যবাদী হও, পরিচ্ছন্ন হও, সর্ব্ব সম্প্রদায়ের ভারতবাসীর মধ্যে মিল আন।
যে মামলার জন্য মোহনদাসকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার আপোষ হয়ে যেতেই (১৮১৪) তিনি ভারতে ফিরবেন ঠিক হ’ল। ডার্ব্বানে তাঁর বিদায় সম্বর্দ্ধনা—সভায় বসে ‘নাটাল মার্কারী’ পত্রের এক জায়গায় দেখলেন, নাটাল সরকার ভারতবাসীদের ভোটাধিকার লোপ করতে এক বিলের আয়োজন করছে। ভারতবাসীরা মোহনদাসকে অনুরোধ করল, এ বিপদে ফেলে না যেতে। তিনিও রাজী হলেন।
ঐ দিনই রায়েতে তিনি নাটাল ব্যবস্থা পরিষদে দাখিল করবার জন্য আবেদনের খসড়া তৈরি করলেন। সরকারের কাছে তার পাঠান হ’ল বিল স্থগিত রাখতে অনুরোধ করে। এক মাসের মধ্যে আবেদনে সই করল ১০ হাজার ভারতবাসী। ঔপনিবেশিক সচিব লর্ড রিপনের কাছে তা পাঠান হল। প্রত্যহ সভা! প্রবাসী ভারতবাসীদের মধ্যে কি জাগরণ! তারা গান্ধীজীকে বলল—আপনি নিয়মিত কিছু টাকা নিন। তিনি বললেন—কাঞ্চন বিনিময়ে জনসেবার রুচি তাঁর নেই। নাটালের সুপ্রিম কোর্টে এডবোকেটরূপে ভর্ত্তি হবার জন্য তিনি আবেদনে জানালেন নাটাল ল সোসাইটি বাধা দিল, তবু আবেদন গ্রাহ্য হল।
এ সময় ভারতীয় জাতীয় মহাসভার দাদাভাই নওরোজীর উপর শ্রদ্ধা বশতঃ গান্ধীজী নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস স্থাপন করলেন। এ কংগ্রেস বছরে একবার বারোয়য়ারীতলার উৎসব নয়। নাটাল কংগ্রেসের ২৫ বছরের তরুণ নেতা মোহনদাস বাহিরে যেমন আন্দোলন চালাতেন, ভারতবাসীর ব্যক্তিগত ও ব্যষ্টিগত সদাচার ও উন্নতি চালাতেন, ভারতবাসীর ব্যক্তিগত ও ব্যষ্টিগত সদাচার ও উন্নতি বিধানের বাস্তব আয়োজনও কম করেননি। সেখানকার কিশোর যুবকদের জন্য তিনি স্থাপন করেছিলেন কংগ্রেসের উদ্যোগে নাটাল এডুকেশনাল এসোসিয়েশন। তাঁর কর্ম্মপদ্ধতি তখনকার দিনে অভিনব। শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে সহযোগিতা কর যথাসম্ভব, ভারতবাসীদের সম্বন্ধে যা খবর পাও সংবাদপত্রে প্রচার কর, ভারতবাসীর বিরুদ্ধে অন্যায় আক্রমণের জবাব দাও। নাটালের আদর্শে ট্রান্সভাল ও কেপটাউনেও শাখা—প্রতিষ্ঠান তিনি গড়লেন।
এই আড়াই বছরে জনসেবার সঙ্গে মোহনদাসের ওকালতী ব্যবসায়ে অর্থাগম মন্দ হয়নি। স্থির করলেন, নাটালেই স্থায়িভাব বাস করবেন। তাই স্ত্রী ও দুই ছেলে (একটি ৮ বছরের, ১টি ৪ বছরের) আনবেন স্থির করে ভারতে ফিরলেন (১৮১৬,—২৮ বৎসর)।
কংগ্রেস—নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন—সার ফিরোজ শাহ মেটা, জজ বদরুদ্দীন তায়েবজী, জজ রাণাডে, বালগঙ্গাধর তিলক, গোপাল কৃষ্ণ গোখেল। কিন্তু ছ’মাস যেতে না যেতেই নাটাল থেকে তার। যেতেই হবে। সপরিবারে যাত্রা করলেন (২৮শে নভেম্বর, ১৮১৬)।
নাটালে ষ্টিমার থেকে নামতেই (১৮১৭,—১৩ই জানুয়ারি) কতকগুলো শ্বেতাঙ্গ যুবক চেঁচিয়ে উঠল—গান্ধী! গান্ধী! তথাকার প্রসিদ্ধ এডভোকেট মিঃ লাফটন রিক্সা ডাকালেন। শ্বেতাঙ্গ গুণ্ডারা আটক করল, পাথর, পচা ডিম ছুঁড়ে মারল। কেউ তাঁর পাগড়ী কেড়ে নিল, কেউ মারতে লাগল লাথি। মার খেয়ে পড়ে গেলেন। পুলিস সুপারিণ্টেগুণ্টের স্ত্রী পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তিনি গান্ধীজীকে আবৃত করে দাঁড়ালেন। পুলিশ এসে তাঁকে নিয়ে থানায় গেল। এক ডাক্তার বন্ধু সেবা করলেন। তিনি বললেন—’নিশ্চয় ওদের উত্তেজনা কমে গেছে, তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে নিশ্চয়। ওদের সদবুদ্ধির উপর বিশ্বাস করতেই ত হবে।’ পুলিশের পাহারায় রুস্তমজীর ভবনে এলেন। ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী—পুত্ররা ওখানে পৌঁছে গেছে।
কিন্তু শ্বেতাঙ্গ গুণ্ডাদের সদবুদ্ধি হয়নি। তারা রস্তমজীর বাড়ি ঘিরে ফেলল। চীৎকার করতে লাগল—গান্ধীকে চাই! পুলিশ সুরারিন্টেনডেন্ট গান্ধীজীকে পত্র লিখে জানালেন, তোমার বন্ধুর বাড়ি ও সম্পত্তি, আর তোমার স্ত্রী—পুত্রাদিকে যদি বাঁচাতে চাও, ছদ্মবেশে বাড়ি ছেড়ে পালাও। ভারতীয় এক কনষ্টেবলের পোশাক তিনি পরলেন, মাথায় দিলেন লোহার বাটি, তার উপরে মাদ্রাজী পাগড়ী। সঙ্গে চলল সাদা পোশাকে দুই গোয়েন্দা—একজন মুখ পেন্ট করে ভারতীয় ব্যবসায়ী সেজেছিল। চটের স্তূপের আড়ালে আত্মগোপন করে, কতকগুলো বেড়া লাফিয়ে পার হয়ে থানায় গিয়ে পৌঁছলেন।
বৃটিশ উপনিবেশ—সচিব জোশেফ চেম্বারলেন নাটাল সরকারকে তার করে জানালেন, গান্ধীর আক্রমণকারীদের অভিযুক্ত কর। নাটাল সরকারের পত্রের উত্তরে গান্ধীজী লিখলেন—’আমি কাউকে অভিযুক্ত করতে চাই না। যারা আমায় মেরেছিল তাদের কোন দোষ নাই। ওদের কেউ বুঝিয়েছিল যে, আমি ভারতে গিয়ে নাটালের শ্বেতাঙ্গদের সম্বন্ধে সাজান কথা প্রচার করেছি। তাদের নেতাদের অপমান করেছি। এ জন্য দোষ নাটাল সরকারের। আমি কাউকে অভিযুক্ত করতে চাই না। আমার স্থির বিশ্বাস, সত্য যখন প্রকাশ পাবে, তখন তারা তাদের আচরণের জন্য হবে অনুতপ্ত।’
শ্বেতাঙ্গরা লজ্জা পেয়েছিল। সংবাদপত্রগুলি ঘোষণা করেছিল, গান্ধী নির্দ্দোষ। তারা গুণ্ডাদের নিন্দা করেছিল। গান্ধীজী এ সম্বন্ধে পরে বলেছেন—’এই Lynching আশীর্ব্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এতে দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় সম্প্রদায়ের মর্য্যাদা বেড়ে গেছল, এতে আমার কাজ হয়ে উঠেছিল সহজ। এই অভিজ্ঞতা থেকে সত্যাগ্রহ অনুশীলনের সুযোগ আমি পেয়েছিলাম!’
এ বছরই ইংরেজ—রাণী ভিক্টোরিয়ার হীরক জুবিলী উৎসবের দিনে দামোদর চাপেকার র্যাণ্ড ও লেফটেনান্ট আয়ার্ষ্টকে হত্যা করে (প্রথম রাজনীতিক হত্যাকাণ্ড)। আবার এই বছরই স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। আফ্রিকায় বসে ২৮ বছরের যুবক গান্ধীজীও জীবনের ধারা বদলেছিলেন। নিজে কাপড়—চোপড় নিজে পরিষ্কার করেন। এ সম্বন্ধে বই পড়ে নিজে শিখলেন, স্ত্রীকে শেখালেন, প্রিটোরিয়ার শ্বেতাঙ্গ হাজাম—খানায় যখন তাঁকে ঢুকতে দিল না, তখন তিনি ক্লিপার কিনে আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে নিজে ক্ষৌরকার্য্য করতে লাগলেন। ভারতীয় শিশুদের ওদেশের স্কুলে প্রবেশ নিষেধ, তাই নিজের ছেলেদের স্কুলে পাঠালেন না, বাড়িতেই গুজরাটি ভাষায় গল্পের ছলে শিখাতে লাগলেন। একটা ছোট হাসপাতালে তিনি প্রত্যহ প্রায় ৫ ঘণ্টা সেবার কাজ করতে লাগলেন, এতে তামিল তেলেগু ও উত্তর—ভারতের লোকদের সঙ্গে তাঁহার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হতে লাগল। তারা তাঁকে আপনার জন মনে করতে লাগল।
বয়স তখন ত্রিশ (১৮১৯)। বাধল বূয়র যুদ্ধ (১০ই অক্টোবর)। বোথার বীরত্বে বাঙ্গালী যুব—সমাজে বিদ্যুৎ সঞ্চারণ করেছে। সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সমিতির প্রতিষ্ঠার আয়োজন হচ্ছে। যুবদের প্রতি গান্ধীজির ব্যক্তিগত সহানুভূতি থাকলেও তিনি মনে করলেন যে, ভারতের মুক্তি হবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতরে থেকেও ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের সহায়তায়। কাজেই বৃটিশ—শাসনের প্রতি আকর্ষণের ফলেই তিনি ইংরেজকে এ যুদ্ধে সাহায্য করেছিলেন।
ভারতে তখন দৈব দুর্যোগ। মহা ভূমিকম্পে (১২ জুন, ১৮৯৭) প্রায় প্রত্যেক ভারতবাসী বিপন্ন। বহু নদ—নদী বিশুষ্ক। চারি ধারে অনাহার ও হাহাকার—দুর্ভিক্ষ ও মহামারী। দক্ষিণ আফ্রিকায় সে সংবাদ যখন পৌঁছল, প্রত্যেক প্রবাসী ভারতবাসী সেবার জন্য অর্থ পাঠালেন ভারতে গান্ধীজীর হাত দিয়ে। (৩২ বছর বয়সে ১৯০১) গান্ধীজী দেশে ফিরলেন। সোনা, হীরে, মাণিক, কত কত অর্থ, কস্তুরবার জন্য লক্ষ টাকার কণ্ঠাহার উপঢৌকন। গান্ধীজী বললেন, এ সব রইল প্রবাসী ভারতবাসীদের জন্য—‘‘Conviction has ever grown on me that a public worker should accept the gifts.’’
কলকাতায় তখন কংগ্রেস অধিবেশন (১৯০১ ডিসেম্বর)। বিপন্ন দেশবাসীর ধারণা—‘‘People had believed that regeneration could only come from outside, that another nation would take us by the hand and lift us up and that we have nothing to do for ourselves,’’—গান্ধীজী কলকাতার কংগ্রেসের ভালণ্টয়ার হলেন অন্য স্বেচ্ছাসেবকদের কংগ্রেস অধিবেশনে ধাঙ্গড়ের কাজের বাস্তব শিক্ষা দিলেন। নিজে কংগ্রেসের এক জন সাধারণ সম্পাদকের কেরাণী ও বেয়ারার কাজ গ্রহণ করলেন।
স্বামীজি তখন ভারতময় মানুষের সন্ধান করে ফিরেছেন—আর আইরিশ বিপ্লবী নারী ভগিনী নিবেদিতা। গান্ধীজীরও ইচ্ছে হল, পরিক্রমণ ব্যতীত স্বদেশের সঠিক পরিচয় পাওয়া যাবে না। গোখলে দিলেন লোহর এক টিফিন ব্যাক্স। বার অনা দিয়ে নিজে ক্যাম্বিসের এক ব্যাগ কিনলেন। ব্যাগে একটা মন্ত উলের কোট, একখানা ধূতি, গামছা ও ১টা সার্ট। কাঁধে কম্বল ও লোটা। যাবেন কলকাতা থেকে রাজকোট। বাহন ট্রেণের থার্ড ক্লাশ। বারাণসী, আগ্রা, জয়পুর, পানপুরে ধর্ম্মশালায় ১ দিন করে বিশ্রাম। ব্যয় মবলকে ৩১৭। বারাণসীতে বিশ্বনাথ দর্শনের পর শুনলেন এনি বেশান্ত পীড়িতা, দেখা করলেন। ১৯০২ মার্চের মাঝামাঝি বোম্বাই গিয়ে যখন আফিস খুললেন, তখন তাঁর মনোভাব বরদাস্ত করবার মত অবস্থা স্বামীজির সাক্ষাৎ প্রভাবে বিচলিত ভারতের নও—জোয়ানের নেই। এ বছরই স্বামী বিবেকানন্দ বিদায় নেবার সময় ভারতের সেবার ভার দায়স্বরূপ অর্পণ করেছিলেন ভারতের নতুন জাতের কাঁধে। তারা সে দায় গ্রহণ করে অনুশীলন সমিতি খুলল পুণায়, ঠাকুর সাহেবের গুপ্ত সমিতি থেকে অরবিন্দ বাংলায় বিপ্লবের বীজ আমদানী করলেন। মাত্র আন্দোলনে তুষ্ট হল না দেশ! তাদের নেতারা বলতে লাগলেন—‘‘Agitation is not in any sense a test of true patriotism. The test is selfhelp and self sacrifice’’—দেশব্যাপী এই self-help এবং self sacrifice-এর জন্য যখন বস্তুতান্ত্রিক আয়োজন চলতে লাগল, তখন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তার এল, অবস্থা গুরুতর। আফিস ভেঙ্গে গান্ধীজী আবার আফ্রিকা যাত্রা করলেন (১৯০২ বয়স ৩৩)।
প্রিটোরিয়ায় পৌঁছে দেখেন (১লা জানুয়ারি, ১৯০৩) রাজপুরুষরা সব নতুন কাছে ঘেঁসবার উপায় নেই। ভারতবাসীদের উপর যাদের দরদ নেই, তাদেরই নিয়ে এশিয়াটিক ডিপার্টমেন্ট গড়া হয়েছে। গান্ধীজী ডিপার্টমেন্টের কর্ত্তা ডেভিডসনের সঙ্গে অনেক কষ্টে দেখা করলেন, তিনি তাঁর সহকারীর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। রাজা—পুরুষরা গান্ধীকে দেখে রীতিমত ভয় করতে শুরু করেছে। ডেভিড সনের এসিসষ্ট্যান্ট স্থানীয় ভারতবাসীদের ডেকে ধমকে দিলেন ট্রান্সভালে গান্ধীজীকে ডেকে আনবার জন্যে। আদালতের যোগে সংগ্রামের জন্যে সুপ্রিম কোর্টে এটর্ণীগিরি করবার আবেদন করলেন। তাঁর চেষ্টায় টান্সভাল বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েসন স্থাপিত হল। দৃঢ়তার সংগ্রামের জন্য গান্ধীজী আপনার অন্তরকে তপঃশুদ্ধ করবার কাজে আত্মনিয়োগ করলেন। গীতার ১৩ অধ্যায় তিনি মুখস্থ করলেন। আর পড়তে লাগলেন স্বামী বিবেকানন্দের রাজযোগ, পাতঞ্জল যোগসূত্র। ‘অপরিগ্রহ’ ও ‘সমভাব’ এই দুই তাঁকে পেয়ে বসল। ১০ হাজার টাকার এক বীমা তাঁর ছিল, তিনি তার প্রিমিয়ম আর দিলেন না, বীমা নষ্ট হয়ে গেল। ভাইকে লিখলেন, এ পর্য্যন্ত যা সঞ্চয় করেছিলাম সব রইল তোমার। কিন্তু এর পর আর কিছুরই আশা করো না, সব ভারতবাসীদের জন্য রইবে। বোম্বাই—এ এক বন্ধুকে লিখলেন—”সর্ব্বস্ব ত্যাগ না করলে তাঁর পথে চলব কি করে? দিনের আলোর মত আজ স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে, অপরিগ্রহ ও সমভাব হতে হলে অন্তরের পরিবর্ত্তন, মনোভাবের আমূল পরিবর্ত্তন চাই।”
সংবাদ এল (১লা মার্চ, ১৯০৪) প্লেগে মুমূর্ষ ও মৃত ভারতীয় কুলিদের খনিগুলো থেকে আনা হচ্ছে। তিনি তাদের ভার নিজ হাতে নিলেন। সঙ্গে নতুন কাজ ইংরেজি, তামিল, গুজরাটি ও হিন্দি ভাষায় ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ সাপ্তাহিক পত্র সম্পাদন। এই পত্রিকার জন্য আপনার সঞ্চিত ২০০০ পাউণ্ড ব্যয় করলেন। এই কাগজে খাদ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে গুজরাটি ভাষায় যে সব প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন, পরে তার ইংরেজি অনুবাদ হয়। রাস্কিনের Unto This Last বই পড়ে এ সময় তাঁর মনোভাবের এক আমূল পরিবর্তন হয়। কায়িক পরিশ্রম বেড়ে যায়, ঔষধ ব্যবহার বন্ধ হয়। ম্যাঞ্চেষ্টারের ‘No Breaking Assocication-এর কথা শুনে প্রাতরাশ বন্ধ হয়, Just-এর Return to Nature’ বই পড়ে শরীর—চর্চা সম্বন্দে নতুন নতুন অনুশীলন চলতে থাকে। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ পত্রিকার জন্য একটা আশ্রম (Phoenix settlement) তৈরি হয়। আশ্রমের সবাইকে কায়িক শ্রম করতে হত, সবারই সমান ভাতা মাসে ৩ পাউণ্ড। ভারতীয় ছুতোর প্রেসের জন্য চালা বাঁধল, চালায় বসল হস্তচালিত প্রেস, তাতে ছাপা হয় ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন।’
ভারতে তখন Babus of Bengal এর যুগ। কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশনের (১৯০৪) সভাপতি রাজনারায়ণ বসুর বন্ধু সার হেনরী কটনের কথায় ‘‘Babus of Bengal, strenous and able, who rule and control public opinion from Peshawar to Chittagong’’—ভারতে তখন ব্যঙ্গবিচ্ছেদের ফলে (২০ জুলাই ১৯০৫) বৃটিশ পণ্য বর্জন আন্দোলন—বিপ্লবী গুপ্ত প্রচেষ্টা, অর সে আন্দোলন ও প্রচেষ্টার জন্য মনে বনে ও কোণে মৃত্যুর্স্পদ্ধী তরুণের রাধনা—অরবিন্দের ভবানী মন্দিরের পরিকল্পনায় এমন সব ব্রহ্মচারীর আয়োজন ‘‘who would return to the গৃহস্থ আশ্রম when alltoted work was finished’ ভারতের বাইরে লন্ডনে, গান্ধীজীর দেশ কাথিয়াবাড় থেকেই শ্যামজী কৃষ্ণবর্ম্মা ইন্ডিয়ান হোমরুল সোসাইটি গঠন করে গান্ধীজীর ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়নে’র মত ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজিষ্ট’ প্রকাশ করলেন। ‘ইন্ডিয়ান ওপিনিয়ন’ চেয়েছিল ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতায় ভারতবাসীর অবস্থা ফেরাতে; ‘ইন্ডিয়ান সোসিওলজিষ্ট’ বললে—‘It seems that any agitation in India must be carried on secretly and that the only method which can bring the English Government to its senses are the Russian methods vigorously and incessantly applied until the English relax their tyranny and are driven out of the country.’’
১৯০৬ এপ্রিলে (৩৭ বৎসর) দকিণ আফ্রিকার জুলু বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে খাজানা বন্ধ আন্দোলন। গান্ধীজী ইন্ডিয়ান এম্বুলেন্স কোর গঠন করে ইংরেজের সাহায্য করতে লাগলেন। সাদারা আহত জুলুদের সেবা করতে চাইত না। জুলুদের সেবার বার এ বিদ্রোহের অজুহাতে শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গ নিপাতই করতে চায় তবু করেন সহযোগিতা, যদি ওদের চিত্তশুদ্ধি হয়। এ ব্যবহারের বিনিময়ে ওরা ভারতীয় নবাগতদের বিরুদ্ধে আইন করল (১২ সেপ্টেম্বর ১৯০৭)। গান্ধী মিশন বিলাতে গেলেন। ফল কিছু হল না। চলল নিরুপদ্রব প্রতিরোধ আন্দোলন। দলে দলে এশিয়াবাসী জেলে যেতে লাগল, জেলে স্থান সঙ্কুলান যখন হল না, তখন খনির খাদে তারা বন্দিজীবন যাপন করতে লাগল। মগনলাল গান্ধী এ আন্দোলনের প্রথম নামকরণ করেছিলেন ‘সদাগ্রহ’, গান্ধীজী পরে তা পালটে নাম দেন ‘সত্যাগ্রহ।’
এ সময় গান্ধীজীর পসার চমৎকার, বছরে আয় ৫।৬ হাজার পাউণ্ড। তিনি ব্যারিষ্টারী ত্যাগ করলেন, সব সঞ্চয় আন্দোলনকে দান করে স্বেচ্ছায় সন্ন্যাস—ব্রত গ্রহণ করলেন।
শ্বেতাঙ্গ সরকার যখন ভারতীয়দের জন্য রেজিষ্ট্রেসন সার্টিফিকেটের পার্ম্মিট অফিস খুলল, গান্ধীজীর নেতৃত্বে ভারতবাসীরা সেগুলো পিকেট করতে লাগল। প্রিটোরিয়ার মসজিদে বিরাট জনসভা। গোখলে তার করে(১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯০৬) উৎসাহিত করলেন।
৩০শে নভেম্বর নাম রেজিষ্টারীর শেষ দিন। ১৩ হাজার ভারতবাসীর মধ্যে মাত্র ৫১১ জন নাম লিখাল। গান্ধীজী, চীনা নেতা কুইন ও অপর ২৪ জন সত্যাগ্রহীকে ম্যাজিষ্ট্রেট ডেকে পাঠিয়ে (২৮শে ডিসেম্বর) ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ট্রান্সভাল ছেড়ে যেতে হুকুম দিল।
তখন স্মাটসের প্রতাপ। ট্রান্সভালে নতুন ভারতবাসীর প্রবেশ নিষেধ। এ অত্যাচারের আর অত্যাচারের প্রতিরোধের প্রভাব ভারতে এসে পৌঁছাল। ভারতে তখন মারাঠি বাঙালির নেতৃত্বে বিপ্লবের তাণ্ডব, বৃটিশ পণ্য বর্জ্জনের হিড়িক, জাগ্রত যুব—নারায়ণের তুর্য্য নিনাদ—
চল রে চল রে চল রে সবাই জীবন আহবে চল
বাজবে সেথায় রণভেরী আসবে প্রাণে বল!
ভারতেও সত্যাগ্রহের জন্ম ‘পুণ্যে বিশাল’ বরিশালে! প্রথম প্রচারক বিপিন পাল, তিনি বললেন—‘‘One method is resistence, which means organised determination to refuse to render any voluntary or honorary service to the Government.’’ বৃটিশ আদালতের কাজে জবাবদিহি করতে নায়ক ও কর্ম্মীরা অসম্মত। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় আদালতকে জানালেন—”বিধাতৃ নির্দ্দেশে স্বরাজ লাভের প্রচেষ্টায় আমি যে ক্ষুদ্র অংশ গ্রহণ করিতেছি, তজ্জন্য আমি কোনো বিদেশি গভর্ণমেন্টের নিকট জবাবদিহি করিতে প্রস্তুত নহি।”
কিংসর্ফোডের আদালতে অভিযুক্ত বিপিন চন্দ্র পাল বললেন—‘‘I have conscientious objection against taking part in a prosecution which I believe to be uniust and injurious to the cause of popular freedom and the interest of public peace. I refuse to answer any question in connection with this case.’’ (২৬শে আগষ্ট, ১৯০৭)।
দক্ষিণ আফ্রিকায়ও (১০ই জানুঃ, ১৯০৮) গান্ধীজী ও তাঁর সহকর্ম্মীদের যখন আদালতে অভিযুক্ত করা হল তাঁরা কেউই আত্মপক্ষ সমর্থন করলেন না। বললেন—হাঁ দোষী। গান্ধীজী ম্যাজিষ্ট্রেটকে বললেন, তোমার তূণে যত বড় শাস্তি আছে, দাও। হল দুই মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড। প্রথম কারা—অভিজ্ঞতা জোহান্সবুর্গ জেলে। ভারতীয় সমাজ উত্তেজিত।
কে বা আগে প্রাণ
করিবেক দান,
তার লাগি কাড়াকাড়ি!
বললে চল জেলে! ভারতীয় ফেরীওয়ালারাই আগে চলে। বললে, লাইসেন্স দেখাব না। সপ্তাহে প্রায় দেড়শ’ গ্রেপ্তার।
৩০শে জানুয়ারি প্রিটোরিয়ায় জেনারল স্মাটস গান্ধীজীকে ডেকে পাঠালেন। বললে—তোমরা ছাড়া পাবে। যদি স্বেচ্ছায় যথেষ্ট ভারতবাসী নাম রেজেষ্টারী কর তবে কালা কানুন উঠিয়ে নেওয়া হবে। ছাড়া পেয়ে ঐদিনই তিনি গেলেন জোহান্সবুর্গে। মধ্যরাত্রে মসজেদে হাজার লোক সমবেত। সবাই আপোষ মেনে নিল। মাত্র জনাকয় পাঠান বললে, হতেই পারে না।
১০ই ফেব্রুয়ারী প্রাতে গান্ধীজী ও আর কয় জন সহকর্মী রেজিষ্ট্রেসন সার্টিফিকেট নিতে গেলেন। মি আলম গান্ধীজীর মাথায় করলে আঘাত। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। পাঠান গ্রেপ্তার হল। গান্ধীজী বললেন, ওকে ছেড়ে দাও—‘‘Let the blood split today cement the two communities indissolubly.’’ রোগশয্যায় শুয়ে গান্ধীজী টিপসই দিলেন।
জেনারল স্মাটস কিন্তু কথা রাখেনি। কালাকানুন সে উঠিয়ে নেয়নি। স্মাটসকে পত্র দিলেন গান্ধীজী—ট্রান্সভাল সরকারকেও। লিখলেন—”আপোষের শর্ত অনুসারে এশিয়াটিক একট যদি উঠিয়ে না নেওয়া হয়, যদি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এ সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্ত জানান না হয়, তা হলে ভারতবাসীরা যে সব সার্টিফিকেট পেয়েছে তা পুড়িয়ে ফেলে ভবিষ্যৎ বরণ করে নেবে।”
কালা কানুন ব্যবস্থাপক সভায় পেশ হয়। জোহান্সবুর্গের হামিদিয়া মসজেদের ময়দানে মস্ত কটাহে জলন্ত প্যারাকিনে ২ হাজার কালা কানুন গান্ধীজী পুড়ালেন (১৬ই আগষ্ট)।
নাটাল থেকে ফিরবার পথে সার্টিফিকেট দেখাতে না পারার জন্য গান্ধীজীকে গ্রেপ্তার করা হল (১৫ই অক্টোবর)। টিপসই দিতে চাইলেন না। দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে। প্রিটোরিয়া জেলে নির্জ্জন সেলে আটক। কয়েক দিন পোশাকে প্রহরীরা তাঁকে পথে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াল। মুক্তি পেলেন ১৩ই ডিসেম্বর (১৯০৮)।
আফ্রিকার চার উপনিবেশ সংযুক্ত করবার তখন ব্যবস্থা করছিল বুয়ার আর ইংরেজরা। ভারতবাসীরা বিপদের আভাস পেয়ে গান্ধীজীকে বিলেত পাঠাল। ফল হল না। ইউনিয়ন বিল পাশ হয়ে গেল। এ সময় (১৯০৯) গান্ধীজী টলষ্টয়কে পত্র লিখলে, তিনি জবাবে লিখলেন—‘‘God help our dear brother and coworkers in the Transval.’’
কেপটাউনে ফিরে (১৯১০) গান্ধীজী তার পেলেন রতনজী টাটা সত্যাগ্রহী ফান্ডে ২৫ হাজার টাকা দান করেছেন। তখন আশ্রম গড়ার ইচ্ছা হল। জার্মান বন্ধু কালেন বাস ১১০০ একর জমি দিয়ে দিলেন। পুরুষ ও নারী কর্ম্মীদের জন্য পৃথক মহল তৈরি হল। ভারতের বিভিন্ন দেশের সর্ব্ব জাতের নর—নারী আশ্রমে স্থান পেল। রান্না থেকে মেথরের কাজ সবাইকে করতে হত। নিরামিষ আহার। প্রত্যেককে হাতের কাজ করতে হত। গান্ধীজী স্যাণ্ডাল তৈরি করতেন।
এপ্রিলে গান্ধীজী আবার টলষ্টয়কে পত্র লিখে জানালেন, তিনি তাঁর ‘‘humble follower.’’
ভারতে তখন যে জাগরণ, তার সাথে গান্ধীজীর কোনো যোগাযোগ ছিল না। বাংলার অঙ্গচ্ছেদ হল ও অঙ্গ সংযোগ হল। ফাঁসির দড়িতে সহিদরা মরল, কারা—কক্ষে কাদের শেকল বাজল। দ্বীপান্তরে উত্তর দিকচক্রবালের দিকে চেয়ে চেয়ে কাদের নিশ্বাস পড়ল। বজ কিশোরদের উত্থান ও সংগঠন, ভাবী ভারতের ভিত্তি গড়বার জন্য দধিচীদের বুকের অস্থি দান, এসব যেন তাঁর অজ্ঞাতসারেই হয়েছিল সুরাটের দক্ষযজ্ঞ, লোকমান্য ও অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র ও লাজপতের বাস্তব নেতৃত্বে প্রতি গৃহে নব কর্ম্ম—প্রেরণার কথা গান্ধীজী জানতেন বৈ কি? তবে সে কর্ম্মনীতি তিনি অসমর্থনও করেননি, সমর্থনও করেননি।
তখন তাঁর শক্তি সংগ্রহের সাধনা। সে সাধনায় সিদ্ধির পর যে নতুন কর্ম্মক্ষেত্রে তাঁকে অবতীর্ণ হতে হবে, ভারতের ভগবান সে ক্ষেত্রে প্রস্তুত করেছিলেন।
আফ্রিকায় মডারেট নেতা গোখলে, গান্ধীজীর সত্যাগ্রহী দলের সঙ্গে স্মাটস সরকারের আপোষ করিয়ে দিয়েছিলেন (১৯০২)। কিন্তু শ্বেত জাতি ভারতবাসীদের মানুষ বলে জ্ঞান করেনি। তারা যখন ভারতীয় বিবাহ বিধিকে পর্য্যন্ত আক্রমণ করল, তখন গান্ধীজী জননীদের সত্যাগ্রহ করতে আহ্বান করলেন। প্রথমে সত্যাগ্রহ করলেন কস্তুরবা। নারীদের পেছনে দাঁড়াল খনির শ্রমিকরা। দুই দিনে ৩৬ মাইল পথ হেঁটে ওরা ট্রান্সভাল সীমান্তে পৌঁছল। গান্ধীজী তার করে সরকারকে নোটিশ দিলেন। সরকার তথা মালিকরা পশুশক্তি প্রয়োগ করল। অনেকে আহত হল। অকুতোভয় সত্যাগ্রহী শ্রমিক দল। ২০৩৭ পুরুষ, ১২৭ নারী ৫৭ জন শিশু—পুরোভাগে গান্ধী—ভাই—পরনে পায়জামা ও সার্ট। (২৮শে অক্টোবর ১৯১২)।
গ্রেপ্তারী পরোয়ানা। আত্মসমর্পণ। জামিনে খালাস, আবার অভিযানে যোগদান। আবার গ্রেপ্তার, আবার জামিন, আবার অভিযানে যোগদান। ৪ দিন ৩ বার গ্রেপ্তার। সাজা, ৯ মাস সশ্রম কারাদণ্ড। পর দিন তিন খানা ট্রেন বোঝাই অভিযানকারীদের গ্রেপ্তার করে নাটাল ভর্ত্তি। জ্বলে আগুন। নাটালের ২০ হাজার শ্রমিক হাতিয়ার নামায়। চলে জুলুম—শ্রমিকের খুনে খনি লালে লাল।
আপোষ করতে চাই স্মাটস। বিনা শর্তে মুক্তি দেয় গান্ধীজীকে (১৮ ডিসেম্বর)। গান্ধীজী বলেন, আপোষ না হওয়া পর্য্যন্ত একাহারী হয়ে রইব, শ্রমিকের কাণি পরব।
ভারতে কংগ্রেসের করাচি অধিবেশনে গান্ধীজীর প্রশংসা হল। গোখেল আবার স্মাটসের সঙ্গে আপোষ করবার জন্য এণ্ডরুজ ও পিয়ারসনকে পাঠালেন। আপোষ হতে চায় না। গান্ধীজী বললেন, ১লা জানুয়ারি (১৯১৪) চলবে অভিযান ভারত ময় বিক্ষোভ। বড়লার্ট হার্ডিঞ্জ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কাজের প্রতিবাদ করল। আপোষ হল। দক্ষিণ আফ্রিকার মহাসত্যাগ্রহের অবসান হল। ১৮ই জুলাই (১৮১৪—৪৫ বৎসর) কস্তুরবা ও জার্ম্মাণ বন্ধু কালেনবাসকে সঙ্গে করে গান্ধীজী ইংলণ্ডে গোখেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হঠাৎ বাধল প্রথম মহাযুদ্ধ ৪ঠা আগস্ট। ৬ই গান্ধীজী লন্ডনে পৌছলেন। গোখেল প্যারিতে আটক পড়লেন। শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু, ডাঃ জীবরাজ মেটা তখন ইংলণ্ডে। গান্ধীজী প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে সেবাদল তৈরি করে ইংরেজকে সাহায্য করতে চাইলেন, ইংরেজ সম্মত হল।
এ সময় ভারতে ইংরেজে ‘‘Thinking a good deal lately for possible counterpoise to Congress aims.’’ মসলেম লীগের চেষ্টা, ‘‘to promote among the Mussalmans of India feeling of loyalty ot the British Govt.’’ মসলেম লীগের সভাপতি মিঃ জিন্না (১৯১৩) কংগ্রেসের সঙ্গে মিতালী করলেও তাঁর দলের নীতি হল, attainment under the aegis of the British crown of a system of self-Government suitable to India.’’
ভারতের কংগ্রেস এ সময় নির্জ্জীব, মসলেম লীগের নামে মাত্র অস্তিত্ব। ও—দিক মহাযুদ্ধের সুযোগ নিতে বিপ্লবী যুব—ভারতের পেশোওয়ার থেকে গোয়ালপাড়া পর্য্যন্ত বিদ্রোহের মহা আয়োজন—তাদের সাহায্য করবার জন্য ক্যালিফোর্ণিয়া ও ফিলিপাইনস থেকে জার্ম্মাণ সাহায্যের ব্যবস্থা, নানা স্থানে দুর্দ্দমনীয় তরুণদের স্বাধীনতার সশস্ত্র অসমসাহসিক অভিযান। দুর্ভাগ্যক্রমে প্রচেষ্টা পণ্ড—মুক্তিকামী ভারতবাসী দলে দলে ধৃত ও নির্যাতিত। প্রেস আইন ও রাজদ্রোহকর সভা বিধিতে দেশের কণ্ঠ রুদ্ধ। দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর বোমা আক্রমণের পর মারাঠি বিপ্লবীদের কাছে বাঙ্গালী বিপ্লবীদের আবেদন। এ সময় লোকমান্য তিলক ও এনি বেসান্ত কারামুক্ত হয়েছেন।
গান্ধীজী বিলাতে বসে সব খবর পাচ্ছিলেন। এ সময় গুরুতর পীড়িত হওয়ায় তাঁকে ভারতে ফিরতে হয় (৯ই জানুয়ারি, ১৯১৫)। পরনে স্বদেশী মিলের কাথিয়াবাড়ি কোর্ত্তা, পাগড়ি, ধুতি। বোম্বাই—এ নামতেই গোখেল খবর পাঠালেন, গবর্ণর লর্ড উইলিংডন ডেকেছেন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ নববর্ষের খেতাব ‘কাইজার—ই—হিন্দ’ স্বর্ণপদকে গান্ধীজীকে ভূষিত করলেন। গান্ধীজী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিলেন, এমন সময় সংবাদ পেলেন গোখেল মারা গেছেন (১৯শে ফেব্রুয়ারি)।
এর প্রায় ১ মাস বাদ (২৩শে মে) শান্তিনিকেতনের আদর্শে আমেদাবাদের কাছে কোচরাব গ্রামে ২৫ জনকে নিয়ে তিনি আশ্রম, খুললেন। আশ্রমাবাসীদের সত্য, অহিংসা, ব্রহ্মচর্য্য, অচৌর্য্য, নির্ভীকতা, অপ্রতিগ্রহ, লোভহীনতা, স্বদেশী, অস্পৃশত্য দূর, মাতৃ ভাষার যোগে শিক্ষা ও খদ্দরের সম্বন্ধে শপথ নিতে হল। কয় মাস পর যখন অস্পৃশ্য মাতৃভাষার যোগে শিক্ষা ও খদ্দরের সম্বন্ধে শপথ নিতে হল। কয়মাস পর যখন অস্পৃশ্য দাদা ভাই, তার স্ত্রী দানি বহিন ও কন্যা লক্ষ্মী, আশ্রমে স্থানে পেল, তখন বন্ধুরা অর্থ সাহায্য বন্ধ করে আশ্রম বর্জ্জন করলেন। কিন্তু অজ্ঞাত এক ব্যক্তি পাঠালেন ১৩ হাজার টাকা।
সঙ্গে সঙ্গে তিনি ভারতের পরিস্থিতি সম্বন্ধে গভীর ভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। বারাণসী হিন্দু—বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন সভায় (৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬) তিনি বললেন—”ভারতের মুক্তির জন্য ইংরেজের সরে যাওয়া দরকার বা তাদের তাড়িয়ে দেওয়া দরকার। বুঝলে স্পষ্ট ঘোষণা করতে ইতস্ততঃ করব না যে তাদের যেতেই হবে। আর এই বিশ্বাসের জন্য আমি প্রাণ বলি দিতেও প্রস্তুত।”
কংগ্রেসের লক্ষ্নৌ অধিবেশনে গান্ধীজীর সঙ্গে মিঃ জিন্নার ও যুবক জওহরলালের প্রথম দেখা। পর—বৎসর পাটনায় (১০ই এপ্রিল, ১৯১৭) বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের সঙ্গে দেখা করে চম্পারণের চাষীদের দুরবস্থার খবর নিলেন। প্লাণ্টার্স এসোসিয়েসনের সেক্রেটারী স্পষ্ট বললেন, তাদের ব্যাপারে লোকের মাথা ঘামাবার কিছু নেই। কমিশনার গান্ধীজীকে অবিলম্বে ত্রিহুত থেকে চলে যেতে বললেন। ১৬ই এপ্রিল হাতী চড়ে তিনি মতিহারী যাত্রা করতেই নোটিশ এল, পরের ট্রেনে চলে যেতে। আদেশ মানলেন না। সমন এল। পরদিন বিচার। সংবাদ রচনা হতেই বহু দূর—দূর থেকে হাজার—হাজার চাষী আদালতে ভীড় করল। লেঃ গভর্ণর মামলা উড়িয়ে নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে আলাপ করলেন। চাষীদের দুরবস্থা সম্বন্ধে তদন্তের জন্য গান্ধীজীকে নিয়ে এক কমিটি গঠন করা হল।
আগস্ট। মন্টেগু শাসন—সংস্কার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা, করা হল। কংগ্রেস ও লীগ সংস্কারের যে যুগ্ম পরিকল্পনা গড়েছিল, গান্ধীজী তার সমর্থন করলেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থার প্রতিকারের জন্য গান্ধীজী যেমন অকুতোভয়ে নেতৃত্ব করেছিলেন, ভারতে এসে সেই অভিজ্ঞতায় শ্রমিক—মালিকে আপোষ করিয়ে জনসাধারণের দুরবস্থা দূর করবার জন্য আয়োজন তাঁকে করতে হয়। চম্পারণ চাষীদের অবস্থার প্রতিকার হওয়ায় খেদা ও আমেদাবাদের শ্রমিক ও কৃষকরা তাদের দুর্দ্দশা বিদূরীকরণের জন্য গান্ধীজীর সাহায্য চাইলেন। আমেদাবাদের ধর্ম্মঘটকারী শ্রমিকদের দুর্ব্বলতা দেখে তিনি ৩ দিন উপোস করলেন। ২১ দিন ধর্ম্মঘটের পর অবশ্য আপোষ হয়েছিল। তার পরেই খেদা সত্যাগ্রহ। অজন্মার জন্য গুজরাটের খেদা জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি সরকারের কাছে নিষ্ফল তার করলেন। স্থির হল, সত্যাগ্রহ করতে হবে। এ সময় তাঁর সহকর্ম্মী ছিলেন সর্দ্দার বল্লভভাই পেটেল, শঙ্করলাল ব্যাঙ্কার, অনসূয়া বেন, ইন্দুলাল যাজ্ঞিক, মহাদেব দেশাই প্রভৃতি। নদিয়াদ অনাথাশ্রম থেকে সত্যাগ্রহীরা অগ্রসর হ’ল এই শপথ করে—”স্বেচ্ছায় খাজনা দেব না, জমি বাজেয়াপ্ত হয় হৌক।” সরকার জুলুম শুরু করল—জমির ফসল, চাষের হাল,লাঙ্গল, অস্থাবর ক্রোক করতে লাগল। এ সত্যাগ্রহ সার্থক হয়েছিল।
এপ্রিলে বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ড দিল্লিতে ওয়ার কনফারেন্সের অধিবেশনে যোগ দিতে গান্ধীজীকে আমন্ত্রিত করেন। তিলক, এনি বেশান্ত ও আলি—ভাইদের আমন্ত্রিত করা হয়নি বলে গান্ধীজী সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। আলি ভাইদের সঙ্গে জেলে সাক্ষাৎ করতে চাইলে গান্ধীজীর আবেদন নামঞ্জুর হয়। কলকাতায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে গান্ধীজী মুসলমানদের ডেকে বললেন, ”জালি—ভাইদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম কর।” আলিগড়ে মুসলিম কলেজের যুবকদের ডেকে বললেন—”মাতৃভূমির সেবার জন্য ফকির হও!”
বড়লাটের সাধ্য সাধনায় গান্ধীজী অবশ্য পরে ওয়ার কনফারেন্সে যোগ দিলেন। খৃষ্টান ন্যায়পরায়ণতার উপর আস্থাবান গান্ধীজী হিন্দুস্থানীতে মাত্র এক কথায় লড়াইয়ের সৈন্য সংগ্রহ প্রস্তাবের সমর্থন করে বললেন—”এ কাজের দায়িত্ব সম্বন্ধে পূর্ব্বে অবহিত হয়েই এ প্রস্তাব সমর্থন করছি।” কনফারেন্সের পর বড়লাটকে লিখলেন, বৈঠকে তিলক, এনি বেসান্ত ও আলি—ভাইদের না ডেকে মস্ত ভুল করেছ।
খেদায় গেলেন সৈন্য সংগ্রহ করতে ইংরেজের হয়ে। সরকারের অত্যাচারে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত। তারা তাদের প্রিয় গান্ধীজীকে একখানা গরুর গাড়ী পর্য্যন্ত দিল না। তিনি এক প্রচার—পত্রে লিখলেন—”ভারতে ইংরেজ শাসনের অনেক কুকীর্ত্তি, তার মধ্যে বড় কীর্ত্তি একটা গোটা জাতকে নিরস্ত্র করা। আমরা যদি অস্ত্র ব্যবহার করতে চাই তাহলে এই হল স্বর্ণ—সুযোগ।”
তাঁর এই প্রচার—পত্রে গত দশ বছরের ভারতের বিপ্লবী—তরুণ দলের সশস্ত্র সংগ্রামকে তিনি সমর্থনই করেছেন এবং লড়াইয়ের সুযোগও নিতে বলছেন। তাই এই বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যখন রাওলাট কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ হল (১৯১৯—৫০ বছর) তখন রোগ—শয্যাতে পড়ে রইলেও তিনি নীরব থাকতে পারেননি। সর্দ্দার বল্লভভাই পেটেলের সঙ্গে পরামর্শ করে তিনি শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু, মিঃ হর্ণিম্যান, ওমর শোভানি, শঙ্করলাল ব্যাঙ্কার প্রভৃতিকে ডেকে সত্যাগ্রহের আয়োজন করতে লাগলেন। বোম্বাইয়ের সত্যাগ্রহ সভার কেন্দ্র স্থাপিত হল।
কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভায় রাওলাট বিল পেশ হল (ফেব্রুয়ারি, ১৯১৮)। বিতর্ক অধিবেশনে গান্ধীজী ছিলেন। ১৮ই মাচ্চর্চ, বিল আইনে পরিণত হল। পরদিন শ্রীযুত রাজা গোপালচারিকে তিনি বললেন—’কাল রাতে স্বপ্নে আদেশ, ব্যাপক হরতাল করতে বল।”
গান্ধীজী ৬ই এপ্রিল হরতাল ঘোষণা করলেন। বললেন, সবিনয়ে ভগবানের নিকট প্রার্থনা কর।
দিল্লির জুম্বা মসজেদে হিন্দু—নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে বক্তৃতা করতে আহ্বান করা হয়েছে। শোভাযাত্রার উপর পুলিস চালাল গুলী। গুলী চলল লাহোরে, অমৃতসরে। বোম্বাইয়ে পূরা হরতাল। গান্ধীজী বললেন, সত্যাগ্রহ কর। বললেন, দরিয়ার পানি থেকে ঘরে ঘরে নুন তৈরি কর, রাজদ্রোহ কর, নিষিদ্ধ পুঁথি প্রচার কর, পাঠ কর। ৬ই এপ্রিল গান্ধীজীর ”হিন্দু স্বরাজ” আর রাস্কিনের Unto this Last-এর গুজরাটি অনুবাদ ”সর্ব্বেদয়’ পথে পথে বিক্রি হতে লাগল। মুসলমানেরা তাদের মসজেদে গান্ধীজী ও শ্রীমতী সরোজিনী নাইডুকে বক্তৃতা দিতে আহ্বান করল। ৭ই এপ্রিল মহাদেব দেশাইকে সঙ্গে গান্ধীজী দিল্লি হয়ে অমৃতসর যাত্রা করলেন। ট্রেন পালওয়ালে পৌঁছবার আগেই নিষেধাজ্ঞা জারি হ’ল—পাঞ্জাবে যেতে পাবে না। ট্রেন থেকে নামতে বলল। গান্ধীজী বললেন, নিশ্চয় না। ওরা গ্রেপ্তার করে এক ছ্যাকড়া গাড়িতে জোর করে উঠাল। মথুরায় এক পুলিস—ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। পরদিন প্রাতে একটা মাল গাড়িতে গান্ধীজীকে পুরে বোম্বাই চালান দিল। দুপুরে সাবাই মাধোপুর ষ্টেশনে মালগাড়ী থেকে ট্রেনের ফাষ্টক্লাসে উঠিয়ে দিয়ে পুলিস অনুরোধ করল, দয়া করে সোজা বোম্বাই চলে যান, পাঞ্জাবের সীমান্তে যেন পার না হন। গান্ধীজী বললেন ”এ হতে পারে না। ওরা জোর করে ধরে ১১ই এপ্রিল বোম্বাই নিয়ে গেল।
গান্ধীজী গ্রেপ্তার। লোক গেল ক্ষেপে। বোম্বাইয়ে পুলিস জনতার উপর চালায় আক্রমণ। জনসভায় গান্ধীজী জনতাকে বললেন—”সত্যাগ্রহী হিংসা করবে না। অহিংসা হতে না পারলে আমি ব্যাপক সত্যাগ্রহ ত’ করতে পারব না।” কে শোনে? নাদিয়াদ রেল—ষ্টেশনে জনতা রেল—লাইন ভাঙল। আমেদাবাদে মার্শাল ল’ জারি হল। পঞ্জাবে ডাঃ কিচলু, ডাঃ সত্যপালকে ওরা গুম করল। জনতার উপর গুলী চলল। অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালবাগে জেনারেল ডায়ারের ফৌজ মৃত্যু বণ্টন করল—মার্শাল আইন ঘোষণা করল। জনসাধারণকে রাজপথে চাবুক মারল, বুকে হাঁটাল। পঞ্জাবের সন্ত্রাস সার মাইকেল ও ডয়ার জেনারেল ডায়ারকে তার করে জানালেন—খুব কিয়া, আচ্ছা কিয়া। বোম্বাই—এ ‘বোম্বে ক্রনিকলের’ সম্পাদক হর্ণিম্যান নির্ব্বাসিত হ’লেন, ‘ক্রনিকল’ বন্ধ হ’ল। গান্ধীজী ‘ক্রনিকলে’র সাপ্তাহিক পত্র—’ইয়ং ইণ্ডিয়ার সম্পাদন ভার নিলেন।
পঞ্জাবে যাবার জন্য গান্ধীজী ছটফট করছিলেন, কিন্তু আইন অমান্য করতে চাননি। অনুমতি চাইলে বড়লাট বার—বার বলতে লাগলেন—‘‘not yet’’ যখন পঞ্জাবের অনাচার তদন্তের জন্য হাণ্টার কমিটি নিযুক্ত হল, তখন বড়লাট গান্ধীজীকে তার করলেন—১৭ই অক্টোবরের পর পঞ্জাব যেতে পারেন।
পঞ্জাবে গিয়ে সমবেত হয়েছেন পণ্ডিত মদনমোহন মালবীয়, পণ্ডিত মতিলাল নেহরু, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। গান্ধীজীর সঙ্গে মতিলালের প্রথম পরিচয় হল। ওঁরা স্থির করলেন, হাণ্টার কমিটি বর্জ্জন করতে হবে। কংগ্রেস চিত্তরঞ্জন দাশকে নিয়ে বে—সরকারী তদন্ত কমিটি গড়ল।
তখন পশ্চিম এশিয়ায় মুসলমান রাজ্যগুলোকে ভেঙে গড়া হচ্ছে। যুদ্ধে পরাজিত তুরস্কে মুস্তাফা কামাল স্বাধীনতার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন (১৯ মে, ১৯১৯)। আফগানিস্থান ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে (৩রা মে)। ভারতের মুসলমানরাও ইংরেজী—বিদ্বেষী—মসলেম লীগের ইংরেজ—প্রীতির বন্ধন, তারা অস্বীকার করে, ‘খিলাফতের’ জন্য দরদী হয়ে উঠে ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে সমস্বার্থে সংগ্রামের জন্য উদ্যত হয়েছে। গান্ধীজীর সভাপতিত্বে ২৪শে নভেম্বর নিখিল ভারত খিলাফৎ কনফারেন্স বসল। বৈঠক ভারতের হিন্দু ও মুসলমানকে বৃটিশ পণ্য বর্জন করতে অনুরোধ করল। হজরত মোহানী বললেন—”তোমাদের বৃটিশপণ্য বর্জন চলুক—but give us something quicker’’—গান্ধীজী বললেন—‘non-cooperation.’’
অমৃতসর কংগ্রেস। সভাপতি পণ্ডিত মতিলাল। ৩৬ হাজার প্রতিনিধি সমবেত। ইংরেজের রাজা বিক্ষুব্ধ ভারতকে শাসন—সংস্কার বকশিস দেবার কথা ঘোষণা করলেন। আলি ভাইরা মুক্তি পেয়ে (২৫শে ডিসেম্বর) কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিলেন। গান্ধীজী বললেন—”যখন সম্রাট কর প্রসারণ করেছেন, প্রত্যাখ্যান করো না।” চরমপন্থী দলের নেতা চিত্তরঞ্জন, বিপিন পাল, তিলক বললেন—চাই না রিফর্ম্ম। গান্ধীজীর সঙ্গে তবু আপোষ হয় চরমপন্থীদের। কংগ্রেসের রাজনীতিতে গান্ধীজী সর্ব্বপ্রথম যোগ দেন।
১৯২০ (৫১ বৎসর) গান্ধীজীর নেতৃত্বে বড়লাটের দরবারে ফিলাফৎ ডেপুটেশন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। বড়লাটের আশ্বাস আশাপ্রদ নয়। হাণ্টার কমিটির রিপোর্ট (মে) পড়ে গান্ধীজী পাকা সহযোগী। খিলাফত সাব কমিটিতে গান্ধীজী, সৌকৎ আলি, মহম্মদ আলি, মৌলানা আজাদ ঘোষণা করলেন অসহযোগ। গান্ধীজী বড়লাটকে লিখলেন—”মুসলমান বন্ধুদের পরামর্শ দিয়েছি—আপনার গভর্ণমেন্টকে যেন তাঁরা সমর্থন না করে। আর হিন্দুদের বলেছি, মুসলমানদের হাতে হাত মিলাতে।” বড়লাট বললেন—মস্ত বেয়াকুবী।
অসহযোগের সব আয়োজন সম্পূর্ণ। ৩১শে জুলাই রাতে লোকমান্য তিলক স্বর্গে গেলেন। গান্ধীজী বললেন—‘‘My strongest bulwark is gone.’’ ১লা আগস্ট গান্ধীজী তাঁর সরকারি পদকগুলো বড়লাটকে ফিরিয়ে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ নাইট পদত্যাগ করলেন। ১৮ হাজার মুসলমান ভারত ছেড়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।
কলকাতায় কংগ্রেস বিশেষ অধিবেশন। পণ্ডিত মতিলাল অনুরোধ করলেন গান্ধীজীকে স্বরাজের দাবী করতে। অসহযোগ প্রস্তাব পাশ হল। ২৬শে ডিসেম্বর নাগপুর কংগ্রেস সে প্রস্তাব অনুমোদন করল। এই দিন থেকে কংগ্রেস ও গান্ধীজীর নাম অভিন্ন হল। দেশের সেবায় আত্মশুদ্ধির জন্য গান্ধীজী সঙ্কল্প করলেন প্রত্যহ আধ ঘণ্টা সূতো না কেটে তিনি আহার করবেন না। চরকা—লাঞ্ছিত ত্রিবর্ণ জাতীয় পতাকার পরিকল্পনা তিনি করলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন ৩১শে ডিসেম্বর মধ্যে স্বরাজ! দেশব্যাপী সে কি মুমুক্ষু জনগণের উত্তেজনা! সরকার করলে নেতৃবৃন্দের গতিরোধ। যৌবন জলতরঙ্গে সে বাঁধ কোথায় ভেসে যায়! মে মাসে আসামের চা বাগানে ১২ হাজার শ্রমিকের ধর্ম্মঘট, পূর্ব্ববঙ্গে রেল—কুলীদের ধর্ম্মঘট। ফিলাফৎ কনফারেন্সও বললে, ডিসেম্বরের মধ্যে ইংরেজ যদি খিলাফৎ সম্পর্কে মতের পরিবর্তন না করে, তবে Indian Republic ঘোষণা করা হবে। আগস্টে গান্ধীজী বললেন, বিলাতী কাপড়ে আগুন দাও। জ্বলল—আগুন নগরে নগরে। আলি—ভাইরা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হ’লেন। গান্ধীজী কৌপীনবন্ত হ’লেন (১৬ই অক্টোবর)। কংগ্রেসের কার্য্যধারার প্রধান করণীয় হ’ল, খাদি ও চরকা। গান্ধীজী বললেন—ওতেই স্বরাজ।
১৭ই নভেম্বর প্রিন্স অব ওয়েলস ভারতে এলেন। জনগণ তাঁকে চাইল না। তারা চার দিন চালাল দাঙ্গা, আর রক্তস্রোত। গান্ধীজী ৫ দিন উপোস করলেন। চিত্তরঞ্জন, লাজপত, মতিলাল, জওহরলাল কারারুদ্ধ হ’লেন। সরকার আপোষ করতে চাইল গান্ধীজীর সঙ্গে, মধ্যস্থ জিন্না ও পণ্ডিত মদনমোহন। কিন্তু আপোষ ব্যর্থ হল। গান্ধীজীর ভাবে প্রবুদ্ধ ভারতের ৩০ সহস্রের অধিক নরনারী কারাবরণ করল। (১৯২২, ১৪ই জানুয়ারী) সর্ব্বদল সম্মেলনও আপোষের চেষ্টা করলেন, ফল হল না।
গান্ধীজী বড়লাটকে নোটিশ দিলেন (১লা ফেব্রুয়ারী)—বারদোলিতে সত্যাগ্রহ চালাবেন। সরকার চালাল জুলুম। চৌরীচৌরায় (৫ই ফেব্রুয়ারি) ক্ষুব্ধ জনতা বহু পুলিস পুড়িয়ে মারল। গান্ধীজী—ক্ষুব্ধ। আবার ৫ দিন উপোস। সত্যাগ্রহ স্থগিত রইল। বললেন, ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ যে পারে করুক। লিখলেন (৯ মার্চ)—‘Rivers of bloodshed by the Government cannot frighten me.’’—ওরা রাজদ্রোহের অভিযোগে গান্ধীজীকে অভিযুক্ত করল (১৮ই মার্চ)। আমেদাবাদের আদালতকে ডেকে গান্ধীজীকে বললেন—”মাদ্রাজ, বোম্বাই, চৌরী—চৌরার সব দায়িত্ব আমার। জানি, আগুন নিয়ে খেলেছি, তবু আগুন নিয়ে খেলব। আমার কাছে মাত্র দুই পথই খোলা মিঃ জজ, হয় পদত্যাগ কর, না হয় চরম দণ্ড আমাকে দাও।”
জজ ব্রুমফিল্ড ৬ বছর কারাদণ্ড নিয়ে সেদিন গান্ধীজীকে হেসে বলেছিল—‘‘You will not consider it unreasonable, I think, to be classed with Mr. Tilak.’’ গান্ধীজী জজকে এ জন্য ধনবাদ দিয়েছিলেন।
এই কারাবাসের সময় গান্ধীজীর আত্ম—জীবনী ‘‘The story of My Experience with Truth’’ গুজরাটি ভাষায় লেখা হয়।
১৯২২, নভেম্বরে কামাল পাশার সাফল্যে খিলাফৎ সমস্যা মাঠে মারা যখন গেল, মুসলমান নেতাদের উৎসাহ তখন কমে গেল। ফলে ‘২৩ সালে দেশে বাঁধল সাম্প্রদায়িক বিরোধ। জনগণের উৎসাহ কমে গেল। কংগ্রেসেও দুই দল হ’ল—স্বরাজ ও চরকাপন্থী। সহসা এপিণ্ডিসাইটিস রোগাক্রান্ত গান্ধীজী জেল থেকে বেরিয়ে এসে (৫ই ফেব্রুয়ারী, ১৯২৪, ৫৫) চরকাপন্থীদের জানালেন, স্বরাজীরা যা করে করুক, তোমরা গঠনমূলক কাজ করে যাও।
যুব—ভারত অসহযোগের নিশ্চিত মন্থর পদক্ষেপে অধৈর্য্য হয়ে পড়ল। গণ—উত্থান নেই—দেশ সাম্প্রদায়িক বিরোধে বিচ্ছিন্ন, মুসলমানরা হাত গুটিয়েছে—ইংরেজ শাসনদণ্ড দুলিয়ে খালি ব্যঙ্গ হাসি হাসছে। দেশবন্ধু সিরাজগঞ্জ প্যাক্ট করে মুসলমানদের সহযোগিতা ভিক্ষা করলে কোকনদ কংগ্রেস তা অগ্রাহ্য করল। মসলেম লীগের সর্ব্বাধিনায়ক জিন্না স্পষ্ট ঘোষণা করলেন—”The Leauge is not able and un willing to keep abreast with the movement and had perforce to go into the background কাজেই বিপ্লবীরা পূর্ব্ব পন্থার অনুসরণ করবে স্থির করল। চলল পীড়ন—চলল বন্ধন—নির্ব্বাসন—ফাঁসি। গান্ধীজী এদের নিন্দা করলেন। ওরা পটভূমি থেকে সরে গেল আন্দামানে, মান্দালয়ে ইনসিনে বা ইংরেজের কারা—পিঞ্জরে। ১৯২৫, ১৬ই জুন বাংলায় গান্ধীজীর উপস্থিতিতে দেশবন্ধুর মহাপ্রয়াণ। ১৯২৬ ডিসেম্বর রোগশয্যায় শাষিত স্বামী শ্রদ্ধানন্দ মুসলমান গুলীতে নিহত। গৌহাটী কংগ্রেসের অধিবেশনে যুব—ভারত স্বাধীনতা প্রস্তাব করলে গান্ধীজী বাধা দিলেন—দেশ প্রস্তুত নয়। ১৯২৭, (৫৮) ৫ই নভেম্বর বড়লাট লর্ড আরউইন গান্ধীজীকে ডেকে সাইমন কমিশনের ঘোষণার ঘুষ দিতে চাইলে, ঘৃণায় গান্ধীজী দিল্লি থেকে ফিরে গেলেন। পণ্ডিত জওহরলালের প্রস্তাবে কংগ্রেস মাদ্রাজে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রস্তাব পরোক্ষভাবে গ্রহণ করলে গান্ধীজী একটু দুঃখিত হলেন। ১৯২, ৩রা ফেব্রুয়ারি সাইমন কমিশন বোম্বাইয়ে নামল। ভারতব্যাপী হরতাল। সরকার জুলুম চালাল। জওহরলাল আহত হলেন। লাজপত রায়কে প্রাণ দিতে হ’ল (১৭ই নভেম্বর, ১৯২৮)। গান্ধীজীর আশীর্ব্বাদ নিয়ে সর্দ্দার বল্লভভাই বারদোলি সত্যাগ্রহ চালালেন। ১৯২৮, ডিসেম্বরে কলকাতা কংগ্রেসে জওহর ও সুভাষের বিচার। যতীন দাসের ৬১ দিন অনশনে মৃত্যুবরণ। বড়লাটের ট্রেনে বোমা। চাচ্চির্চলের ঘোষণা—ভারতের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রমর্য্যাদা র দাবী—অপরাধ। ২৩শে ডিসেম্বর গান্ধীজীকে লর্ড আরউইন বলে দিলেন—ঔপনিবেশিক মর্য্যাদা র নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি তিনি দিতে পারেন না।
লাহোর কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতা আদর্শ ঘোষণা করল। ইংরেজ প্রত্যাখ্যাত গান্ধীজী বড়লাটকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন—এইবার আমাদের অবস্থা কি তা আমরা বুঝলাম। ২৬শে জানুয়ারী ১৯৩০, ভারতের সর্ব্বত্র স্বাধীনতা শপথ গ্রহণ করা হ’ল। ২২শে মাচ্চ—গান্ধীজী লর্ড আরউইনকে চরম পত্র দিলেন। সত্যাগ্রহ চলবে। বললেন—”হাঁটু গেড়ে করজোড়ে চেয়েছিলাম রুটি, পেলাম পাথর!”
সবরমতী আশ্রমে ৭৫ হাজার সমবেত। গান্ধীজী বললেন—এক শর্ত হবে, সম্পূর্ণ অহিংস—তার পর চলে এস আমার সঙ্গে স্বাধীনতার মহাসমরে। ১২ই মার্চ প্রাতে সাড়ে ৬টার হল যাত্রা। গান্ধীজী ৭৯ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ডাণ্ডি অভিযান করলেন। বললেন, হয় নুন আইন উঠিয়ে ফিরব, না হয় আমার এ দেহ ভাসবে সাগর—জলে। ”জনতা আসে দেখতে—ফুল দেয়, মালা দেয়, নারকেল দিয়ে শুভযাত্রা কামনা করে—পতাকা আন্দোলিত করে দেয় সম্মতি। গান্ধীজী তাদের সস্নেহে বলেন—খদ্দর পর, মদ খেও না, সরকারের সঙ্গে সহযোগ করো না। সত্যাগ্রহে যোগ দাও। ২০০ মাইল পায়ে হেঁটে চলা। ডাণ্ডির বালুবেলায় লক্ষ নরনারী। সরোজিনী নাইডু এসেছেন। নাইডু আহ্বান করলেন গান্ধীজীকে—‘‘Law breaker.’’ দেশের প্রতি কোণে জ্বলে আগুন! লক্ষ লক্ষ এগিয়ে চলে স্বাধীনতা—স্বাধীনতা! মুক্তির অভিযান!
বড়লাটকে দ্বিতীয় চিঠি গান্ধীজীর। এবার আক্রমণ দর্শনা। চর্শাদার লবণ—গোলা। বায়ু ও বারির মত লবণ গণ—সম্পদ। ওরা গ্রেপ্তার করে। গান্ধীজী গভীর নিদ্রামন্ত্র। ওরা মুখের উপর টচ্চর্চ ফেলে। ওরা তাঁর শয্যা ঘিরে দাঁড়ায়। ধরে নিয়ে যারবেদা জেলে বন্দী করে। দক্ষিণ আফ্রিকার সহকর্ম্মী ৬৩ বৎসরের বুড়ো ইমাম সাহেব তাঁর জায়গায় আসেন। তাঁর নেতৃত্বে আড়াই হাজার লোক দর্শনা আক্রমণ করে। ওরা লাঠি চালায়, খুন করে, জখম করে। ভারতময় পীড়ন—১ লক্ষের দণ্ড। পণ্ডিত মতিলাল ধৃত।
২৫শে জানুয়ারি ১৯৩১ (৬২) গান্ধীজী ও কংগ্রেস নেতারা বিনাশর্তে মুক্ত। মতিলালের মৃত্যু (৬ই ফেব্রুয়ারী)। ৪ঠা মার্চ গান্ধী—আরউইন চুক্তি স্বাক্ষরিত। ১৯২১এ ‘এক বছরে স্বরাজ হবে, এই আশায় বিপ্লবীরা আপনাদের কর্ম্মকাণ্ড স্থগিত রেখেছিল গান্ধীজীর আন্দোলন সাফল্য কামনা করে—তারা সে আন্দোলনে যোগও দিয়েছিল সর্ব্বতোভাবে। কিন্তু ‘এক বছরে স্বরাজের সঙ্গে যে গান্ধীজী তথা কংগ্রেসের অপর কাম্য—‘‘Righting of Khilafat wrong’’ ব্যর্থ হয়ে যখন মুসলমানদের হেতুকী দেশপ্রেমে বাধা দাঁড়াল, তখন যথোপযুক্ত সংযমী কর্ম্মীর অভাবে আইন অমান্য আন্দোলন বন্ধ রাখতে গান্ধীজী বাধ্য হয়েছিলেন। অথচ, সরকারের দমন ও পীড়ন প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছিল। বিদেশী দর্শকদের ধারণা ‘‘the drastic measures employed to quell Gandhi’s capaigns deliver the spark to the perenial store of terrorist dynamite.’’ কেন্দ্রীয় পরিষদে বোমা—ধ্বনির সঙ্গে নব বিপ্লবের ”ইনকিলাব জিন্দাবাদের” নব ধ্বনিতে ভারত হ’ল মুখরিত। ভগৎ সিং, যতীন দাস, বটুকেশ্বর এ ধ্বনির মূর্ত্ত বিগ্রহ—তারা মানুষ মারতে যায়নি। তারা জানিয়ে দিয়েছিল—আজ হ’তে যে মহাবিপ্লব শুরু হ’ল, স্বাধীনতা অধিগত না হওয়া পর্য্যন্ত তা দীর্ঘজীবী হৌক! গান্ধীজীর ডাণ্ডি অভিযানেরও ধ্বনি, ”জয়—নয় মৃত্যু!” গান্ধীজীর সত্যাগ্রহে—৫৪,০৪৯ সৈনিক করল কারাবরণ, তার মধ্যে বাংলার বন্দী সব চাইতে বেশি (১১,৪৬৩)। হিংসাপন্থী বিপ্লবীরাও প্রস্তুত হচ্ছিল চরম আঘাত করবার জন্য।
মহাবিপ্লবের অগ্রদূত ভগৎসিংহ। তাঁর মহানিনাদে কম্পিতকলেবর বৃটিশ পাইলট। গান্ধীজীর সঙ্গে আরউইনের চুক্তির বড় শর্ত ছিল রাজনীতিক বন্দীদের মুক্তি। ভগৎ সিংও মুক্তি পাবে, গান্ধীজীর এই ছিল বিশ্বাস। কিন্তু কাপুরুষ আরউইন গোপনে ভগৎকে ফাঁসি দেবার বন্দোবস্ত করেছিল। সে বুঝেছিল, মহা বিস্ফোরকে আঘাত করবার ফলে দেশব্যাপী রক্তগঙ্গা বইবে। তাই হত্যা—সংবাদ গোপন রেখেছিল। শ্বেতাঙ্গ নারীদের সাবধান করে নির্দ্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ১০ দিন যেন তারা ইউরোপীয়ান কোয়ার্টার থেকে বের না হয়। এক দিন মধ্য—রাত্রে (২৩শে মার্চ) ওরা তাকে ফাঁসি দিল। যুব—ভারত গান্ধীজীর কৈফিয়ৎ চাইল। করাচী কংগ্রেসে তাঁর মর্য্যাদা প্রায় ক্ষুণ্ণ হল। যুব—বিপ্লবীরা কংগ্রেস অধিবেশনে তাঁকে কৃষ্ণ—পতাকা দেখাল, কৃষ্ণমাল্য দান করল। গান্ধীজী নব—জীবন সভার সভাপতি বিপ্লবী সুভাষচন্দ্রের সাহায্য চাইলেন, কংগ্রেস অধিবেশনে বিপ্লবী ভগতের প্রশংসা প্রস্তাব নিজে উত্থাপন করলেন। করাচী কংগ্রেসে বিপ্লবী নব—ভারতের মহা বিজয় ঘোষিত হল।
গান্ধীজীকে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরূপে বিলাতের গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে নিযুক্ত করা হল (১০ই জুন, ১৯৩১)। ১২ই সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডন পৌঁছলেন। শত শত দরিদ্র নরনারী—শিশু—কুমারী মুরিয়েল লেষ্টারের গৃহে তাঁকে দর্শন করতে গেল। বৈঠকের অবসানে তিনি বলে এলেন—”আমার পথ কোন দিকে জানি না, কিন্তু এতে কিছুই আসে যায় না। আমার পন্থা সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও অন্তরের অন্তর থেকে বৈঠককে ধন্যবাদ দিচ্ছি।”
তার পর ইউরোপ ভ্রমণ। লণ্ডন থেকে ফ্রান্সে সুইটজারল্যান্ডে রোমা রোলাঁর সঙ্গে দেখা (৬ ডিসেম্বর)। রোমে মুসোলিনীর সঙ্গে কথা (১২ই)। ফিরলেন ভারতে ২৮ ডিসেম্বর।
এর মধ্য ইংরেজের পীড়ন বেড়ে গেছে। বাংলা ও সীমান্ত প্রদেশে অর্ডিন্যান্সের প্রকোপ। সীমান্ত গান্ধী আবদুল্ল গফুর খান ও সহস্র সহস্র খুদাই খিদমৎকার গ্রেপ্তার। পণ্ডিত জওহরলাল ধৃত। বছর শেষ হবার পূর্ব্বে ১০ হাজার মুক্তিকামী ভারতবাসী পিঞ্জরাবদ্ধ। ভারতে পদার্পণ করেই গান্ধীজী বোম্বাই—এর আজাদ ময়দানের মহতী সভায় ঘোষণা করলেন—‘‘I take these as gifts from Lord Willingdon, our Chrisian Vicroy for is it not a custom during Christmas to exchange greetings and gifts ?’’ দেখা করতে চাইলেন বড়লাটের সঙ্গে, বড়লাট দেখা দিতে চাইলেন না।
৩১শে ডিসেম্বর কংগ্রেস গান্ধীজীকে আবার সত্যাগ্রহ অভিযান চালাবার ভার দিলেন, আর বিশ্বের স্বাধীন জাতের নরনারী ও তাদের সরকারকে আহ্বান করে বললেন, এই সংগ্রামের গতি—প্রগতি তোমরা দেখে নাও।
১৯৩২—আরম্ভ হল গান্ধীজীর মহা সংগ্রাম। ইংরেজ কংগ্রেসকে বে—আইনি প্রতিষ্ঠান বলে ঘোষণা করল। ৪ঠা জানুয়ারি ওরা গান্ধীজীকে গ্রেপ্তার করে জেলে চালান দিল। এক দিকে চলল নিরস্ত্র মহা সংগ্রাম, সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবী অভিযান। এ সময় ইংরেজ রাজকর্ম্মচারীদের প্রভাবে মুসলমান তরুণদের মধ্যে প্রচার করা হল—‘‘Muslims are a sepaerate Nation and as such they should be allowed to form a Federation of their own consisting of the Muslim majority Provinces.’’—মুসলিম বিপ্লবী দল গোপনে গোপনে এই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্র পোক্ত করতে মনোনিবেশ করল।
১৭ই আগস্ট ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রাদায়িক রোয়েদাদের ঘোষণা গান্ধীজী তাঁকে জানালেন, ”প্রাণ দেব।” ২০শে সেপ্টেম্বর উপোস আরম্ভ হল। ভারতময় নেতারা চঞ্চল হ’লেন। ২৩শে সেপ্টেম্বর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। মৌলানা সৌকৎ আলি তাঁর মুক্তির দাবী করলেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর যারবেদা—চুক্তিতে হরিজন, হিন্দু ও কংগ্রেস নেতারা সই করলেন। ইংরেজ তবু অত্যাচার শিথিল করেনি। নারীও হয় ক্ষিপ্ত। নারীও হয় বিপ্লবী। বাংলার গভর্ণর গুলী খেল। বিপ্লবী নারী বললেন—‘‘I invite the attention of all to the situation created by the measures of the Government which can unsex a frail woman like myself, brought up in all the best traditions of Indian womanhood.’’
দরিদ্র ও সামাজিক অবিচারাহত হরিজনদের প্রতি কর্ম্মীদের সচেতন করবার জন্য এ সময় গান্ধীজী ২১ দিন অনশন করলেন (৮ই মে—২৯শে মে)। আবার অনশন ১৬ই আগস্ট। ২৩ আগষ্ট অবস্থা শঙ্কটজনক—সুতরাং বিনা শর্ত্তে মুক্তি। এর ৭ দিন পরে পণ্ডিত জওহরলাল খালাস পেলেন।
এর পর সংগ্রামের গতি বদলে গেল। গান্ধীজী অনুভব করেছিলেন যে, কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতাই ১৯৩৫ এর শাসনতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক হতে চায়। তারা রাঁচিতে বসে স্বারাজ্য দল তৈরী করেছে (মে, ১৯৩৪)। গান্ধীজী তাঁদের দুর্ব্বলতা উপলব্ধি করলেন, বুঝলেন, কর্ম্মি—স্তর থেকে না উঠে যারা হঠাৎ নেতা হতে চায়, তাদের দিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবে না। তিনি গণসংগঠন করবেন স্থির করলেন. তিনি বললেন—‘‘I feel that masses have not received the full message of Satyagraha owing to tis adulteration in process of transmission,’’—সত্যাগ্রহ তিনি বন্ধ করলেন (৭ই এপ্রিল, ১৯৩৪)। তিনি দেখলেন, মুসলমানরা জাতীয়তা আন্দোলন বর্জ্জন করেছে। পাকিস্তানপন্থী বিপ্লবী মুসলমানদের সঙ্গে জাতীয়তাপন্থী মুসলমানরা মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে এক হয়ে ম্যাকডোনাল্ডের সাম্প্রায়িক রোয়েদাদ গ্রহণ করেছে (মার্চ, ১৯৩৪), নতুন শাসনতন্ত্রও মেনে নিয়েছে। কংগ্রেসও প্রায় নিমরাজি। গান্ধীজী গণ—সংগঠনের জন্য, হরিজন সংগঠনের জন্য ১০ মাস ভারতব্যাপী চেষ্টা করলেন। বোম্বাই কংগ্রেসের পর তিনি কংগ্রেস এক রকম ত্যাগই করলেন।
এই ভাবে কাটে কয় বছর।
১৯৪৭ (৬৮)—কংগ্রেস নির্ব্বাচনে জিতে ১১ প্রদেশের মন্ত্রিসভার ভার নিয়েছেন। গান্ধীজী বললেন, গণ—সংগঠনে মন দাও, চাষীদের অবস্থার উন্নতি কর, গণশিক্ষায় ব্যবস্থা কর, কারাগারগুলো গণ—সংশোধনাগারে পরিণত কর।
দেশে তখন চরমপন্থীদেরও সংগঠন চলছে, তারা কংগ্রেসী শাসনের সুযোগ নিচ্ছে। মসলেম গণ—সংযোগের চেষ্টা চলায় মসলেম লীগ ক্ষিপ্ত হচ্ছে। জিন্না ঘোষণা করছেন—(১৯৩৮) ‘‘All hopes of communal unity had been wrecked on the rock of Congress Facism.’’
চরমপন্থী যুব—ভারত সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে কংগ্রেসে প্রভাব বিস্তার করেছে—তাদের রাজনীতিক বন্দীদের মুক্তির দাবী নিয়ে সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসী মন্ত্রীদের গোলমাল বেধেছে। ত্রিপুরী কংগ্রেসে (১৯৩৯ মার্চ—৭০ বৎসর) সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে যুব—ভারত পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার দাবী করেছে।
তার পর বাধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (৩রা সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯)। বড়লাট গান্ধীজীকে ডেকে পরামর্শ করলেন। গান্ধীজী বললেন, ‘‘my own sympathies are with England.’’ কিন্তু দেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর দাবী সম্বন্ধে বড়লাট কোন প্রতিশ্রুতি দিতে চাহিলেন না। ১৭ই অক্টোবর তিনি মাত্র এই বললেন যে, যুদ্ধ শেষ হলে ইংরেজ সরকার এ সম্বন্ধে পরামর্শ করতে সম্মত। গান্ধীজী আবার বললেন,—‘‘Profoundly disappointing.—কংগ্রেস চেয়েছিল রুটি— পেয়েছে পাথর!”
কংগ্রেসী মন্ত্রীরা পদত্যাগ করল (৮ই নভেম্বর)। ইংরেজ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ—আলোচনা ব্যর্থ হল। গান্ধীজী বললেন, (১৯৪০—৭১) শান্তিপূর্ণ ও মানজক আপোষের কোন সম্ভাবনা দেখছি না। জার্মানি তখন ইংলন্ডে প্রবল আক্রমণ চালাচ্ছে। ২রা জুলাই গান্ধীজী বৃটেনকে পরামর্শ দিলেন অহিংসা পন্থা অবলম্বন করতে। গান্ধীজী আভাস পেয়েছেন, বিপ্লবী ভারত এ মহাযুদ্ধে সুযোগ নিতে অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে—তারা ইংরেজকে ৬ মাসের নোটিশ দিতে চায়। তাঁর নির্দেশ কংগ্রেস ইংরেজের সহযোগিতা করতে চান। তবে দাবী—‘‘an immediate declaration of full indepdendence of India and the formation of a Provisional Government at the centre’’—বড়লাট প্রস্তাব করেন প্রত্যাখ্যান। ওয়ার্দ্ধায় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ গান্ধীজীকে আসন্ন মহাসংগ্রামে নেতৃত্ব করতে অনুরোধ করে (২৩ংশ আগষ্ট, ১৯৪০)। ১১ই অক্টোবর তিনি ব্যক্তিগত সত্যাগ্রহ আন্দোলন চালালেন। ভারতের দিকে এই আন্দোলন প্রসারিত হল। কিন্তু তিনি দেখলেন, অহিংসা সম্বন্ধে তরুণ দলের সঙ্গে তাঁর মতভেদ হচ্ছে তিনি আবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে ত্যাগ করলেন (৩০শে ডিসেম্বর)। অধৈর্য্য বিপ্লবীরা প্রস্তুত হল স্বদেশে গণ—সংগ্রাম করতে ও তার সাথে ইংরেজশত্রু বিদেশীদের সাহায্যে সশস্ত্র অভিযান দ্বারা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে। ‘৪১ এর স্বাধীনতা দিবসে চরমপন্থীদের নেতা সুভাষচন্দ্র এই উদ্দেশ্যে ভারত থেকে পলায়ন করলেন।
দেশে বৈদ্যুতিক চঞ্চলতা। ১৯৪২, ১৬ই জানুয়ারী আবার গান্ধীজী কংগ্রেসের সংগ্রামের নেতৃত্ব করতে সম্মত হলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুর ইংরেজের হাত—ছাড়া। ১১ই মার্চ জাপানের আক্রমণে বিপন্ন ইংলণ্ডের সর্ব্বাধিনায়ক ভারত—বিদ্বেষী চাচ্চির্চল বাধ্য হয়ে ক্রিপস মিশন পাঠাবার সিদ্ধান্ত করলেন—‘‘to rally all forces of the invader.’’ ২৭শে মাচ্চর্চ ক্রিপসের সঙ্গে দিল্লিতে গান্ধীজী আলাপ করে বুঝলেন, ওদের প্রস্তাব হ’ল ‘‘a post dated cheque’’, ২১শে মার্চ ক্রিপসের প্রস্তাবের মোদ্দা কথায় প্রকাশ পেল যে, ‘‘The defence of India will not be in Indian hands even if all parties want it.’’
সুতরাং ভারত বিক্ষুব্ধ। কংগ্রেসের ৮ই আগষ্ট প্রস্তাব বললে, দূর হটো! ছাড় ভারত! ৯ই আগস্ট—ওরা গান্ধীজীকে করে গ্রেপ্তার—গ্রেপ্তার করে কংগ্রেসের শত—সহস্র নেতা ও কর্ম্মীকে। গান্ধীজী ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্ম্মীদের ওরা পুণার কাছে আগা খাঁর প্রাসাদে নিয়ে আটক করে। ১৪ই আগস্ট গান্ধীজী লর্ড লিনলিথগোকে এক পত্রে জানালেন—”মস্ত ভুল করেছ। আমি তোমাদের বন্ধুই আছি। ভগবান তোমাদের পথ নির্দ্দেশ করুন।” ১৫ই আগস্ট তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্ম্মী মহাদেব দেশাইকে কারাগারে হত্যা!
তার পর? মহাবিপ্লব ভারতে—করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ‘৪৩, ২রা জুন—সুভাষচন্দ্র সিঙ্গাপুরে। ৫ই জুন আজাদ হিন্দ সৈন্যদল নিয়ে নেতাজীর রণ—হুঙ্কার—চলো দিল্লী! সরকার ও সহকর্ম্মীদের জনাচারের মূক প্রতিবাদে গান্ধীজীর ৩ হপ্তা অনশন (১০ই ফেব্রুয়ারি, ৩ মার্চ)। অবস্থা মন্দ রেখে প্রতিবাদে ১৭ই ফেব্রুয়ারী বড়লাটের মন্ত্রিসভার ৩ জন মন্ত্রীর পদত্যাগ। ২২শে ফেব্রুয়ারি শিবরাত্রির সন্ধ্যায় কস্তুরবা গান্ধীজীকে ছেড়ে চিরবিদায় নিলেন। বিদেশি সাংবাদিকের ভাষায় আগা খাঁ প্রাসাদের কাছে কস্তুরবা’র চিতা ভস্মকে সামনে রেখে ‘‘The oldman sat under the tamarind tree and wept, ৬ই মে বিনা শর্তে মুক্তি পেয়ে গান্ধীজী প্রথমে কস্তুরবা ও মহাদেবের চিতাস্থানে ফুল দিয়ে এলেন।
গত অর্দ্ধ শতাব্দী ধরে যে অনির্ব্বাণ জ্যোতি মুমুক্ষু ভারতের পথ প্রদর্শন করছিল, তাকে ম্নান করবার জন্য ইংরেজ যেমন অবিরাম চেষ্টা করেছে, তেমনি চেষ্টা করেছে ইংরেজের করধৃত চরগুলো। ভেদ ও বৈষম্য দূর করবার জন্য গান্ধীজীর চেষ্টা বারম্বার বিফল হয়েছে, বারম্বার তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। লিনলিখগো আর ওয়াভেল তাঁকে এ চেষ্টায় সাহায্য করেনি, মহম্মদ আলি জিন্নাও করেনি—অনৈক্য ওরা মেনে নিয়েছে, অনৈক্যের সুযোগ নিয়েছে, ঐক্য সংস্থাপনে সাহায্য করা দূরে থাকুক ওরা বিরোধী হয়েছে। মিঃ জিন্না ও গান্ধীজী যদি মিলতেন, তবে অঘটন ঘটত। কিন্তু তা কি হবার?
তবু গান্ধীজী চেষ্টা করলেন। বন্ধন—মুক্তির পরই (১৭ জুলাই) তিনি পাঁচগনি থেকে মিঃ জিন্নাকে লিখলেন—”ভাই জিন্না, এক দিন ছিল, যখন আমি মাতৃভাষায় কথা বলতে আপনাকে প্ররোচিত করেছি। আজ সেই ভাষাতেই লিখতে সাহস করছি। জেলে থাকতে আমার সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেছিলাম। খালাস পেয়ে আর পত্র দিইনি। কিন্তু আজ মন ডেকে বলছে আপনাকে পত্র দিতে। আপনার ইচ্ছামত দিনে আসুন আলাপ করি। আমাকে ইসলামের বা এ দেশের মুসলমানদের শত্রু বলে মনে করবেন না। মাত্র আপনার নয়, সারা দুনিয়ার আমি বন্ধু ও দাস। আমায় হতাশ করবেন না।”
দেখা হল। আলাপ হল। মিঃ জিন্নার পাষাণ মন গলবার মত নয়। ৩১শে জুলাই জিন্না—গান্ধী চিঠিপত্র সংবাদপত্রে ছাপা হল। গান্ধী নিরাশ হলেন।
তার পর চেষ্টা ইংরেজের সাথে। বড়লাট চাইলেন, ‘definite and constructive policy’ গান্ধীজীর কাছে। তা—ও তিনি দিলেন। বললেন, কংগ্রেসের আগস্ট প্রস্তাবে যে সত্যাগ্রহের কথা বলা হয়েছে, পরিবর্তিত অবস্থায় তার আর প্রয়োজন নাই। কংগ্রেস এবার সমরোদ্যমে ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করবে—যদি …যদি ইংরেজ অবিলম্বে ভারতকে স্বাধীন ঘোষণা করে, আর কেন্দ্রে জাতীয় সরকার স্থাপন করে। তাহলে ভারত ইংরেজের যুদ্ধে সহযোগিতা করবে, তবে যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে পারবে না। গান্ধীজী বড়লাটকে জানালেন—আমি আপনারই হাতে। মানজনক আপোষের বিন্দুমাত্র আশা যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ আমি আপনাদের দ্বারে ঘা দিয়েই যাব।
ওয়াভেল ওঠালেন হিন্দু, মুসলমান, লঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সর্ব্বসম্মত প্রস্তাবের কথা। বললেন, আগে তোমাদের মধ্যে আপোষ করে ঠিক করে গান্ধীজী বললেন—”সরকারের এই জবাব থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ৪০ কোটির উপর যে প্রভুত্ব ইংরেজ সরকার করছে, যতক্ষণ পর্য্যন্ত এই ৪০ কোটির তা কেড়ে নেবার মত শক্তি না হচ্ছে, ততক্ষণ তারা তা ছাড়বে না। আমি নিরাশ হব না। ভারত আধ্যাত্মিক উপায়ে তা অর্জ্জন করবে।”
তিনি ভগবানের নিকট প্রার্থনা করলেন—কোয়াদি আজমের মনের পরিবর্ত্তন হৌক।
তখন পাকিস্তান ফ্রন্ট হয়েছে, এন্টি—পাকিস্থানী ফ্রন্টও গজিয়েছে। ওয়াডেল সরকার গান্ধীজীর চরকা—সঙ্ঘ পর্য্যন্ত ধ্বংস করবার মতলব করেছে। গান্ধীজী বললেন (৩ সেপ্টেম্বর)—”সঙ্ঘ ভেঙে তার সম্পত্তি ভারতের গ্রামের গ্রামে ছড়িয়ে দাও। ভারতের ৭ লক্ষ গ্রামে যদি এই সম্পদ প্রবেশ করে, কার সাধ্য তাকে ধ্বংস করে। গভর্ণমেন্ট ত’ ৪০ কোটি করেও মারতে পারবে না।
বোম্বাইয়ে আবার গান্ধী জিন্না সাক্ষাৎ (৯ই সেপ্টেম্বর)। জিন্নার গলা জড়িয়ে ধরলেন পরম স্নেহে। জিন্না হেসে বললেন, ওরা ছবি তুলবে। নিষ্ফল আলাপ চলেছিল ২৬শে সেপ্টেম্বর পর্য্যন্ত। ১৮ই সেপ্টেম্বর মুসলিম প্রার্থনা—সভায় জিন্না ঘোষণা করেছিলেন—পাকিস্তান লাভ করে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ না পাওয়া পর্য্যন্ত সব রকম স্বার্থই মুসলমানকে ত্যাগ করতে হবে—শপথ কর। পরদিন সার্ব্বজনীন প্রার্থন—সভায় গান্ধীজীও বললেন—”যদি স্বাদীন হতে চাও, যদি ভারতের মুক্তি চাও, হিন্দুমুসলমান ও সর্ব্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে মিত্রবন্ধন ঘনিষ্ঠ কর।”
পর বৎসর সিমলায় ওয়াভেল—প্ল্যান নিয়ে গান্ধীজীর সঙ্গে ওয়াভেলের পত্র—বিনিময়। সিমলা—বৈঠকে গান্ধীজী ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত হয়েছিলেন। বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল।
তার পর—বছর এল (১লা এপ্রিল) বৃটিশ ক্যাবিনেট মিশন। কংগ্রেস মিশনের প্রস্তাবিত গণ—পরিষদে যোগ দিয়ে স্বাধীন সংযুক্ত ও গণতান্ত্রিক ভারতের শাসনতন্ত্র গঠন করতে সম্মত হল (২৬শে জুন)। ২১শে জুন অছি—সরকার নিযুক্ত হ’ল। মিঃ জিন্নার দল ক্যাবিনেট কমিশন বর্জ্জনের হুমকি দেখিয়ে বললে—লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
৫০ বছর আগে বাংলাতেই মুসলমানরা হিন্দু—রক্তে মাতৃভূমি রঞ্জিত করে বাংলা দু’ভাগ করে স্বাধীনতার আন্দোলনের মৃত্যুস্পর্দ্ধী যোদ্ধাদের সৃষ্টি সম্ভবপর করেছিল, আর ঠিক ৫০ বছর পরে এই বাংলাতেই এই মুসলমানেরাই হিন্দুর রক্তে মাতৃভূমি সিঞ্চিত করে ইংরেজের সাহায্যে দেশকে ভাগ করে নিয়েছিল মৃত্যুস্পর্দ্ধী কোন ভাবী যোদ্ধাদের সৃজনের জন্য, তা ভারতের ভাগ্যবিধাতাই জানেন।
গান্ধীজী অন্ধকার দেখলেন। বললেন, আর বেঁচে কি হবে? জিন্নার ভক্তদের প্রহারে পীড়িত হতভাগ্যদের আর্ত্তনাদ গান্ধীজীকে ব্যাকুল করেছিল (৩০শে ডিসেম্বর)। তিনি আবার মিলনের আশা করলেন। নোয়াখালিতে একা ঘুরে বেড়ালেন (২রা জানুয়ারী) ধর্ষিতা হিন্দু—নারীদের সান্ত্বনা দিয়ে। লীগের প্রহারাহত ক্ষুব্ধ কলকাতার যুবকদের প্রতিহিংসা রোধ করলেন মৃত্যুপণ অনশন করে (১লা—৪ঠা সেপ্টেম্বর)। তার পর চললেন দিল্লীতে—সঙ্কল্প, সাম্প্রদায়িক হিংসা হয় লোপ করবেন, নয় প্রাণ দিবেন। মুখে সেই এক ধ্বনি ‘করেঙ্গে—ইয়ে— মরেঙ্গে।’ হিংসার উন্মত্ত ইন্ধন আসে সমুদ্র—পার থেকে।
অর্দ্ধ শতাব্দীর লক্ষ লক্ষ বীর ও ত্যাগীর সাধনা ব্যর্থ করে নবলব্ধ রাজনীতিক অধিকারকে ভিতর থেকে ক্ষুণ্ণ ও ব্যর্থ করবার জন্য চঞ্চল স্বার্থবানদের নির্ম্মম পরম প্রয়াস। গান্ধীজী ইঙ্গিত পান। বিদেশি সাংবাদিকদের বললেন—”চার দিকে ঘন তমসা, এবার বিদায় নেই। বলেন—”অব শিব, পার কর মেরা নেইয়া।” ১৯৪৮, ১৩ই জানুয়ারী মিলনের শেষ চেষ্টা। মৃত্যুপণ অনশন। সবাই বললে— রাষ্ট্রগুরু, সম্বরণ, কর, আমরা পণ করছি এ ভেদ ভাঙ্গব। ১৮ই জানুয়ারী, গান্ধীজী বললেন—তাই হৌক।
কিন্তু ভারত—গগনে রাহুর আবির্ভাব যে মহা জ্যোতিঃ স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল, তাকে আবৃত করবার জন্য পাপ—তমসার প্রভাব চলছিল। ওরা বিভ্রান্ত হয়েছিল। ওরা হত্যা করে রাষ্ট্র—সবিতাকে ভারত—গগন থেকে অপসারিত করতে চেয়েছিল।
২০শে জানুয়ারী প্রার্থনা সভায়—মিলনের মন্ত্র পাঠ করতে গান্ধীজী যাচ্ছিলেন—যেমন প্রত্যহ যান। তমসা—দূত এসে প্রদীপ্তা বহ্নিকে নমস্কার করেছিল—আর তার দেহকে হত্যা করে প্রতি ভারতবাসীর চিত্তে ও অঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছিল। গান্ধীজী মুখ ফিরে তাদের শেষ নমস্কার করেছিলেন—
‘ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম
সবকো সুমতি দে হে ভগবান!’
যাঁর জন্মদিনে ভারতের নবলব্ধ স্বাধীনতার পত্তন হয়েছে—প্রকৃত রাজনীতিক স্বাধীনতার অর্জ্জনের জন্য এক হাতে গীতা এক হাতে কৃপাণ নিয়ে যিনি অর্দ্ধ শতাব্দী পূর্ব্বে ভারতকে স্বাধীনতার সক্রিয় পন্থা প্রদর্শন করেছিলেন, যাঁর চেষ্টায় কংগ্রেসের ভিক্ষার আবেদন দুর্জ্জয় দাবীতে পরিণত হয়েছিল গান্ধীজীর এই দৈহিক অপসারণে জাতিকে আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছেন—
‘‘The power that brought us through so much struggle and suffering to Freedom, will achieve also, through whatever strife or trouble, the aim which so poignantly occupied the thoughts for the fallen leader at the time of his tragic ending, as it has brought us freedom, it will bring us unity. A free and united India will be there and the Mother will gather around her sons and welcome them into a single national strength in the life of a great and united people.’’ সিদ্ধ যোগীর বাণী সফল হৌক। গান্ধীজীর জয় হৌক! জয় হিন্দ।