ভারতে গণতন্ত্র

ভারতে গণতন্ত্র

মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ, পুনা, ৩ মে, ১৯২৮

বন্ধুগণ,

মহারাষ্ট্র প্রাদেশিক সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনের আলোচনাসভায় সভাপতিত্ব করবার অনুরোধ জানিয়ে আমার প্রতি যে-উচ্চ সম্মান প্রদর্শন করেছেন তার জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা সম্ভবত অবগত আছেন যে, আমি প্রথমে আপনাদের সানুগ্রহ আমন্ত্রণ গ্রহণের সাহস পাইনি, কিন্তু বাংলা এবং মহারাষ্ট্রের সুপ্রাচীন সম্পর্কের উল্লেখ করে আমার বন্ধুদের কেউ কেউ আমার হৃদয়ের এক অত্যন্ত কোমল তন্ত্রী স্পর্শ করেছেন। আবেদন তখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল এবং অন্য সব বিবেচনা গৌণ হয়ে দাঁড়াল।

আমাদের বর্তমান নীতি এবং কর্মসূচী সম্পর্কে আমার মতামত আপনাদের সামনে পেশ করবার পূর্বে আমি কয়েকটি মৌলিক সমস্যা উত্থাপন করে তার জবাব দেবার চেষ্টা করব। কখনও কখনও বিদেশীরা সজোরে বলেন যে, ভারতবর্ষের নবজাগরণ বিদেশী আদর্শ এবং কর্মধারায় অনুপ্রাণিত সম্পূর্ণরূপে এক বিদেশী বস্তু। কথাটা কোনও মতেই সত্য নয়। আমি এক মুহূর্তের জন্যও এই সত্যকে অস্বীকার করি না যে, পাশ্চাত্য প্রভাব আমাদের বৌদ্ধিক এবং নৈতিক জড়তা থেকে জেগে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই প্রভাব আমাদের জনচিত্তে আত্মসচেতনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এর থেকে যে-আন্দোলন জন্ম নিয়েছে এবং আজ আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তা খাঁটি স্বদেশী আন্দোলন। ভারতবর্ষ গতানুগতিক অন্ধ অনুকরণের যুগ—মনস্তত্ত্বের ভাষায় প্রতিবর্তী ক্রিয়ার যুগ—অনেক আগে পেরিয়ে এসেছে। এখন সে তার নিজের আত্মা ফিরে পেয়েছে এবং জাতীয় ধারায় এবং জাতীয় আদর্শের আলোকে সে তার জাতীয় আন্দোলন পুনর্গঠনে ব্যস্ত।

আমি স্যার ফ্লিল্ডার্স পেট্রি-র সঙ্গে একমত যে, ব্যক্তির মতো সভ্যতার বৃদ্ধি এবং মৃত্যু চক্রাকারে আবর্তিত হয় এবং প্রতিটি সভ্যতার জন্য একটি নির্দিষ্ট জীবন-কাল প্রদত্ত হয়েছে। আমি তাঁর সঙ্গে এ বিষয়েও একমত যে, নিঃশেষ হয়ে যাবার পরেও কতকগুলি বিশেষ অবস্থায় সেই বিশেষ একটি সভ্যতার পুনর্জন্ম হতে পারে। যখন এই পুনর্জন্ম হয় তখন সঞ্জীবনী প্রেরণা, সেই অপরিহার্য প্রাণপ্রাচুর্য, বাইরে থেকে আসে না, আসে ভিতর থেকে। এইভাবে প্রতিটি কালচক্রের শেষে ভারতীয় সভ্যতার পুনর্জন্ম হয়েছে এবং এই কারণেই প্রাচীনতা সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতা আজও তরুণ এবং সজীব।

আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই এই অভিযোগ করা হয়েছে যে, গণতন্ত্র যেহেতু পাশ্চাত্য বিধান, ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক অথবা অর্ধ-গণতান্ত্রিক বিধান গ্রহণ করে পাশ্চাত্যের অনুকারী হচ্ছে। কয়েকজন ইউরোপীয় লেখক—যেমন লর্ড রোনাল্ডশে—এতদূর পর্যন্ত বলেছেন যে, গণতন্ত্র প্রাচ্যের মানসিকতার সঙ্গে বেমানান এবং সেই কারণে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অগ্রগতি গণতন্ত্রমুখী হওয়া উচিত নয়। অজ্ঞতা এবং ধৃষ্টতা এর চেয়ে বেশি আর কিছু হতে পারে না। গণতন্ত্র কোনওমতেই এক পাশ্চাত্য বিধান নয়, এটি একটি মানবিক বিধান। মানুষ যখনই রাজনৈতিক বিধান উদ্ভাবনে প্রয়াসী হয়েছে তখনই সে এই আশ্চর্য গণতান্ত্রিক বিধানটি আবিষ্কার করেছে। ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাস গণতান্ত্রিক বিধানের দৃষ্টান্তে পূর্ণ। শ্রী কে. পি. জয়সওয়াল তাঁর বিস্ময়কর গ্রন্থ “Hindu Polity”-তে এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন এবং প্রাচীন ভারতে ৮১টি প্রজাতন্ত্রের তালিকা দিয়েছেন। ভারতীয় ভাষাসমূহও অগ্রসর রাজনৈতিক বিধান সম্পর্কিত পরিভাষায় সমৃদ্ধ। ভারতবর্ষের কোনও কোনও অঞ্চলে এখনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব আছে। যেমন, আসামের খাসিদের মধ্যে এখনও সমগ্র গোষ্ঠীর ভোটে গোষ্ঠীপ্রধান নির্বাচনের প্রথা প্রচলিত এবং স্মরণাতীত কাল থেকে এই প্রথা পুরুষানুক্রমে চলে আসছে। ভারতবর্ষে গ্রাম এবং নগরের শাসনব্যবস্থায়ও গণতান্ত্রিক নীতি প্রয়োগ করা হয়েছিল। সেদিন উত্তরবঙ্গের রাজশাহীতে বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির জাদুঘর দেখতে গেলে আমাকে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটি তাম্রলিপি দেখানো হয়, যাতে লেখা ছিল যে, প্রাচীন সেই সমৃদ্ধির দিনে পাঁচজনকে নিয়ে গঠিত এক সমিতির উপর শাসনভার ন্যস্ত ছিল, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল নগরশ্রেষ্ঠী (অর্থাৎ আধুনিক কালের মেয়র)। গ্রামের স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে প্রাচীন কাল থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গ্রাম-পঞ্চায়েতের কথা ভারতীয় শ্রোতাদের স্মরণ করিয়ে দেবার প্রয়োজন নেই। শুধু গণতান্ত্রিক নয়, অন্যান্য উন্নত ধরনের সমাজ-রাজনৈতিক নীতিসমূহ প্রাচীন ভারতে অপরিচিত ছিল না।

দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায় যে, সাম্যবাদ পাশ্চাত্য বিধান নয়। আসামের খাসিদের মধ্যে, যাঁদের কথা আমি উল্লেখ করেছি, এমন কি আজও প্রথা হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির তত্ত্বগত অস্তিত্ব নেই। গোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে সমস্ত জমির মালিক। আমি নিশ্চিত যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে এখনও অনুরূপ দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে, পাওয়া যাবে আমাদের দেশের অতীত ইতিহাসেও।

জাতীয়তাবাদের উপর একাধিক দিক থেকে যে-আক্রমণ হানা হচ্ছে সে-বিষয়ে বর্তমান অবস্থায় আমি আমার দেশবাসীকে এবং বিশেষ করে, আমার তরুণ বন্ধুদের সতর্ক করে দেওয়া প্রয়োজন মনে করি। সাংস্কৃতিক আন্তর্জাতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদকে কখনও কখনও সঙ্কীর্ণ, স্বার্থপর অথবা আগ্রাসী বলে আক্রমণ করা হয়। একে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আন্তজাতিকতা প্রসারের পক্ষেও অন্তরায় বলে গণ্য করা হয়। এই অভিযোগের আমার জবাব হল এই যে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সঙ্কীর্ণ, স্বার্থপর অথবা আগ্রাসী কোনওটাই নয়। এই জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা মনুষ্যজাতির সর্বোচ্চ আদর্শ—অথাৎ সত্যম (সত্য), শিবম (শুভ), সুন্দরম (সুন্দর)। ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা, সততা, পৌরুষ এবং সেবা আর ত্যাগের মনোভাব সঞ্চারিত করেছে। অধিকন্তু, আমাদের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-সৃষ্টিক্ষমতা সুপ্ত ছিল জাতীয়তাবাদ তাকে জাগ্রত করেছে, যার ফলে ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা এক নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করছি।

আন্তজাতিক শ্রমিকের অথবা আন্তজাতিক সাম্যবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদের উপর অন্য একটি আক্রমণ করা হচ্ছে। এই আক্রমণ শুধু অবিবেচনাপ্রসূতই নয়, এই আক্রমণ অজ্ঞাতসারে আমাদের বিদেশী শাসকদের স্বার্থ সিদ্ধ করছে। একটি সাধারণ লোকের কাছেও এটা স্পষ্ট যে সমাজতান্ত্রিক অথবা অন্য যে-কোনও ধাঁচেই হোক না কেন, নতুন করে সমাজ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা শুরু করবার আগে প্রথমে আমাদের নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করতে হবে। ভারতবর্ষ যতদিন ব্রিটেনের পদানত থাকবে ততদিন আমাদের সে অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হবে। অতএব শুধু জাতীয়তাবাদীদেরই নয়, জাতীয়তাবাদ-বিরোধী সাম্যবাদীদেরও প্রধান কর্তব্য যথাসম্ভব শীঘ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মুক্তি ঘটানো।

আগেই আভাস দিয়েছি যে, আমি শ্রমিক এবং জাতীয়তাবাদের মধ্যে সম্মিলনের সমর্থক (কৃষকদেরও শ্রমিকের অন্তর্ভুক্ত করবার জন্য ‘শ্রমিক’ শব্দটি এখানে আমি ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহার করছি)। একথা স্বীকার করতে হবে যে, কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে শ্রমিকদের সংগঠিত করবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমরা বারবার প্রস্তাব পাস করলেও এ বিষয়ে বিশেষ কোনও সাফল্য অর্জিত হয়নি।

বিগত কয়েক বছরের কংগ্রেসের কার্যসূচী পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব যে, আমরা কেবল খাদি কর্মসূচীর মাধ্যমে আমাদের জনগণকে এমন কিছু দিতে পেরেছি, যার সঙ্গে তাদের রুজি-রোজগারের সম্পর্ক আছে। আমার বলতে আনন্দ হচ্ছে যে, খাদি সমগ্র ভারতবর্ষে হাজার-হাজার ক্ষুধার্ত মুখে অন্ন এনে দিয়েছে। অর্থ এবং সংগঠন থাকলে খাদিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সুযোেগ অফুরন্ত। যে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র ভারতবাসী অনাহারের সীমান্তরেখায় দাঁড়িয়ে আছে, খাদি তাদের জীবনধারণের উপায় করে দিতে পারে। কিন্তু খাদির আবেদন সর্বজনীন হতে পারে না। বাংলার কয়েকটি অঞ্চলের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, জনসাধারণের আর্থিক অবস্থা একটু ভাল হলেই তাদের চরকা অলস হয়ে পড়ে থাকে এবং যে কৃষক ধান অথবা পাট চাষ থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল ফসল পায় সে তুলোর চাষ করতে অস্বীকার করে।

শুধু যখন কংগ্রেসকর্মীরা কৃষক আন্দোলন যোগ দিয়েছে—যেমন উত্তরপ্রদেশে—অথবা পাটচাষের প্রশ্নটি তুলে ধরেছে—যেমন বাংলায়—অথবা অবৈধ করারোপ অথবা উৎপীড়ন আইন প্রণয়ন করতে কর বন্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে—যেমন গুজরাটে—তখন ছাড়া কদাচিৎ আমরা জনসাধারণের অথনৈতিক স্বার্থের কাছে সরাসরি আবেদন পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছি। আর মানুষের যা স্বভাব তাতে এই কাজটি করতে না পারলে জনসাধারণ স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেবে এমন আশা আমরা কী করে করতে পারি?

আরও একটি কারণ আছে যে জন্য আমি জনসাধারণের স্বার্থ সম্পর্কে কংগ্রেসের আরও সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করি। ভারতবর্ষে গণচেতনা জাগরিত হয়েছে, এর জন্য অসহযোগ আন্দোলনের সময় ব্যাপক এবং নিবিড় প্রচারকে ধন্যবাদ ; এবং সম্ভবত এখন গণ-আন্দোলন রোধ করা যাবে না। একমাত্র প্রশ্ন হল এই, গণ-চেতনা। কোন পথে আত্মপ্রকাশ করবে? কংগ্রেস যদি জনগণকে অবহেলা করে তাহলে এটা অবশ্যম্ভাবী যে, একটি আংশিক—এবং বলা যায় জাতীয়তাবিরোধী—আন্দোলন জন্ম নেবে এবং রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের আগেই আমাদের জনগণের মধ্যে শ্রেণীসংগ্রাম দেখা দেবে। যখন আমরা সবাই একই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ তখন শ্রেণীসংগ্রাম শুরু হলে তা সব থেকে মারাত্মক হবে এবং আমাদের সাধারণ শত্রুর কাছে তা কৌতুকের খোরাক যোগাবে। আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি যে, বর্তমানে ভারতবর্ষের কিছু কিছু শ্রমিকপন্থীর মধ্যে কংগ্রেসকে হেয় করবার এবং কংগ্রেসের কর্মসূচীর নিন্দা করবার প্রবণতা রয়েছে। এই পালটা অভিযোগ বন্ধ হওয়া উচিত এবং জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মুক্তির জন্য শ্রমিক এবং কংগ্রেসের সংগঠিত শক্তির হাত মেলানো উচিত।

বন্ধুগণ, যদি এক মুহূর্তের জন্য আমি আপনাদের বর্তমানের বাস্তবতা থেকে চোখ ফিরিয়ে যে-ভবিষ্যৎ আমাদের সামনে তাকে বিশ্লেষণ করতে বলি তবে আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমরা কীসের পিছনে ছুটে চলেছি তা জানবার জন্য আমাদের অন্তরে অনুসন্ধান করা কাম্য যাতে আমরা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আদর্শের আলোয় বেড়ে উঠতে পারি এবং তদনুসারে আমাদের কর্মপন্থাকে রূপ দিতে পারি।

আমার নিজের কথা বলতে গেলে আমি এক স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রের সমর্থক। আমার সামনে সেটাই চরম লক্ষ্য। ভারতবর্ষকে তার নিজের লক্ষ্য অর্জন করতেই হবে এবং ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন (colonial self-government) অথবা ডোমিনিয়ন হোম রুল লাভ করে ভারত সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। আমাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থাকতেই হবে কেন? ভারতবর্ষ মানসিক এবং ভৌত সম্পদে সমৃদ্ধ। বিদেশীদের চাপিয়ে দেওয়া শৈশব সে পেরিয়ে এসেছে এবং সে শুধু নিজের দায়িত্ব বহন করতেই নয় এক স্বাধীন সত্তা হিসেবেও কাজ করতে সক্ষম। ভারতবর্ষ কানাডা, অস্ট্রেলিয়া অথবা দক্ষিণ আফ্রিকা নয়। ভারতীয়রা প্রাচ্য দেশের লোক, অশ্বেতকায় নরগোষ্ঠী এবং ভারতবর্ষ এবং গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যে এমন কোনও মিল নেই যার থেকে আমরা এমন কথা ভাবতে পারি যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে ডোমিনিয়ন হোম রুল ভারতবর্ষের কাম্য পরিসমাপ্তি। সাম্রাজ্যের ভিতরে থাকলেই বরং ভারতবর্ষের ক্ষতি। ততদিন ব্রিটিশের অধীনে থাকবার ফলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতবর্ষের পক্ষে হীনম্মন্যতা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে। যতদিন আমরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকব ততদিন ব্রিটিশের শোষণ প্রতিরোধ করাও কঠিন হতে পারে।

ব্রিটেনের সাহায্য ছাড়া ভারতবর্ষ আত্মরক্ষায় অক্ষম, প্রচলিত এই যুক্তি শিশুসুলভ। বর্তমানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তুলনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীই ভারতবর্ষকে অনেক বেশি রক্ষা করছে। ভারতবর্ষ যদি ইংল্যান্ডের হয়ে নিজের সীমান্তের বাইরে—তিব্বতে, চীনে, মেসোপটেমিয়ায়, পারস্যে, মিশরে এবং ফ্ল্যান্ডার্সে—যুদ্ধ করবার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে থাকে তবে অবশ্যই বিদেশী আক্রমণের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করবার মতো যথেষ্ট শক্তিও তার আছে। উপরন্তু, ভারতবর্ষ একবার নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হলে পৃথিবীতে শক্তির ভারসাম্য তাকে রক্ষা করবে, যেমন করেছে চীনকে। এবং জাতিসঙ্ঘ (League of Nations) যদি কিছু পরিমাণে অধিকারপ্রাপ্ত এক সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় তবে আক্রমণ এবং আগ্রাসন অতীতের বস্তুতে পরিণত হবে।

স্বাধীনতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার সময় স্বাধীনতা সমস্ত নিহিতার্থের কথা আমাদের মনে রাখা উচিত। নিজের আত্মার অর্ধাংশকে মুক্ত করে অপর অর্ধাংশকে আপনি দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারেন না। কোনও ঘরে আলো প্রবেশ করিয়ে একই সঙ্গে এমন আশা করতে পারেন না যে, সেই ঘরের একাংশ অন্ধকারাবৃত থাকবে। রাজনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে একই সঙ্গে সমাজের গণতন্ত্রীকরণ প্রতিরোধ করবেন তা হয় না। না, বন্ধুগণ, আমরা যেন রাজনৈতিক গণতন্ত্রী এবং সামাজিক রক্ষণশীলের কিম্ভুত মিশ্রণ না হই। জনগণের সামাজিক জীবনের ভিতর দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং তাকে রূপ দেয় জনগণের ভাবনা এবং আদর্শ। আমরা যদি ভারতবর্ষকে প্রকৃতই মহান করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদের এক গণতান্ত্রিক সমাজের বেদির উপরে একটি রাজনৈতিক গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে। জন্ম, বর্ণ অথবা ধর্মমতভিত্তিক সুবিধার অবসান ঘটাতে হবে এবং জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযোগের দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে হবে। নারীর মর্যাদাও উন্নীত করতে হবে এবং জনসাধারণের ব্যাপারে ব্যাপকতর এবং বিচক্ষণতার ভাবে আগ্রহী করে তুলতে তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

সাম্প্রদায়িক ক্ষত আরোগ্যের জন্য প্রয়োজন হলে জোড়াতালি ব্যবস্থার নিন্দা না করেও আমাদের সাম্প্রদায়িক গোলযোগের জন্য গভীরতর কোনও প্রতিকার আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের পরস্পরের রীতি, আদর্শ এবং ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হওয়া প্রয়োজন, কারণ সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা সাম্প্রদায়িক শান্তি এবং ঐক্যের পথ প্রস্তুত করবে। আমি মনে করি যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্যের মূল ভিত্তি হল সাংস্কৃতিক পুনর্মিলন। বর্তমানে যা অবস্থা তাতে ভারতবর্ষের অধিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায় অত্যন্ত গণ্ডিবদ্ধ।

সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সহজ করতে খানিকটা ধর্মনিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক অন্তরঙ্গতার পথে সর্বাপেক্ষা বড় বাধা ধর্মোন্মত্ততা এবং ধর্মোন্মত্ততার প্রতিকার হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং বৈজ্ঞানিক শিক্ষার চেয়ে উৎকৃষ্টতর আর কিছু নেই। এই ধরনের শিক্ষা অন্য একটি দিক থেকেও প্রয়োজনীয়, কারণ এই শিক্ষা আমাদের অর্থনৈতিক চেতনা জাগ্রত করে। অর্থনৈতিক চেতনার উন্মেষ ধর্মোন্মত্ততার মৃত্যু ডেকে আনে। একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে। তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ কোথায় নিহিত আছে জনসাধারণকে শুধু সেই শিক্ষা দিতে হবে, এবং একবার এই কথাটা বুঝতে পারলে তারা আর সাম্প্রদায়িক বিবাদে নিজেদের ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে রাজি হবে না। সাংস্কৃতিক, শিক্ষামূলক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে কাজ শুরু করে ধর্মোন্মত্ততাকে ক্রমশ ধ্বংস করতে পারি এবং এইভাবে দেশে সুস্থ জাতীয়তাবোধ বিকাশ সম্ভব করে তুলতে পারি।

বর্তমান সময়ের সর্বাপেক্ষা আশাব্যঞ্জক লক্ষণগুলির মধ্যে অন্যতম হল এই দেশের তরুণদের জাগরণ। আমি যতদূর জানি, দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এবং শুধু তরুণদেরই নয়, তরুণীদেরও আকর্ষণ করেছে। বর্তমান যুগের তরুণরা আত্মসচেতন হয়েছে ; তারা একটি আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং নিজেদের অন্তরের আহ্বানে সাড়া দিতে এবং নিয়তিনির্ধারিত কর্ম সম্পাদন করতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছে। এই আন্দোলন জাতীয় আত্মার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ এবং এই আন্দোলনের ধারার উপর নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। সুতরাং এই নবজাত উদ্দীপনাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা না করে তাকে সমর্থন করা এবং ঠিক পথে পরিচালনা করা আমাদের কর্তব্য।

বন্ধুগণ, তরুণদের জাগরণে এবং যুব-আন্দোলনে সাহায্যের জন্য আমি আপনাদের কাছে মিনতি করছি। আত্মসচেতন তরুণরা শুধু কাজই করবে না, স্বপ্নও দেখবে ; শুধু ধ্বংসই করবে না, সৃষ্টি করবে। এমন কি আপনারাও যেখানে ব্যর্থ হতে পারেন ওরা সেখানে সফল হবে ; অতীতের ব্যর্থতা, পরীক্ষা এবং অভিজ্ঞতার ভিতর থেকে ওরা আপনাদের জন্য এক নতুন ভারতবর্য—এক স্বাধীন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করবে। এবং, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আমরা যদি ভারতবর্ষকে চিরকালের মতো সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধতার দূষিত ক্ষত থেকে মুক্ত করতে চাই তবে তরুণদের মধ্যে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।

আমাদের আন্দোলনের আর একটি দিক আছে যা এদেশে কিছুটা অবহেলিত—এটি হল নারী আন্দোলন। এক অর্ধাংশের সক্রিয় সহানুভূতি এবং সমর্থন লাভ না করলে জাতির অপর অর্ধাংশের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। সকল দেশে—এমন কি ইংল্যান্ডের শ্রমিক দলের মধ্যেও—মহিলা-সংগঠনগুলি অমূল্য কাজ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মহিলাদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের অরাজনৈতিক সংগঠন আছে, কিন্তু আমি মনে করি এদের মধ্যে একটি দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংগঠনের অবকাশ রয়েছে। কেবল মহিলা পরিচালিত এই সংগঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালানো এবং ভারতের জাতীয় মহাসভার কাজে সাহায্য করা।

আমাদের সদাশয় শাসকগণ এবং স্বনিযুক্ত উপদেষ্টারা দিনের পর দিন এই উপদেশ দিতেই অভ্যস্ত, যে আমরা স্বরাজের উপযুক্ত নই। কেউ কেউ বলেন যে, স্বাধীনতা আশা করবার আগে আমাদের অবশ্যই আরও শিক্ষা পেতে হবে ; অপর কেউ কেউ বলেন যে, রাজনৈতিক সংস্কারের আগে আসা উচিত সামাজিক সংস্কার ; আবার কারও কারও মতে শিল্পের বিকাশ ছাড়া ভারতবর্ষ স্বরাজলাভের যোগ্য হতে পারে না। এইসব উক্তির কোনটিই সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, এই কথাই অনেক বেশি সত্য যে, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত—অর্থাৎ নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যতীত—আমরা বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা, সামাজিক সংস্কার অথবা শিল্পে অগ্রগতি লাভ করতে পারব না। আপনারা যদি নিজেদের স্বদেশবাসীদের জন্য শিক্ষার দাবি জানান, যেমন বহুকাল আগে শ্রীগোখেল করেছিলেন, সরকার অজুহাত দেখায় অর্থ নেই। আপনারা যদি স্বদেশবাসীর উন্নতির জন্য সামাজিক আইন প্রবর্তন করেন তাহলে দেখবেন আটলান্টিকের এপারে মিস মেয়োর জ্ঞাতি ভাইবোনরা আপনাদের সামাজিক রক্ষণশীলদের পক্ষ নিয়ে আপনাদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয়েছে। আপনারা যখন ভারতবর্ষের অর্থনীতি এবং শিল্পের ক্ষেত্রে পুনর্জাগরণ আনতে প্রাণপাত পরিশ্রম করছেন তখন অশেষ খেদ এবং বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন যে, আপনাদের ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক, রেলওয়ে এবং সরবরাহ বিভাগগুলি আপনাদের জাতীয় প্রচেষ্টায় সাহায্য করতে বিন্দুমাত্র উৎসুক নয়। আপনারা আপনাদের পৌরসভা এবং ব্যবস্থা পরিষদে মাদক নিবারণের সমর্থনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, দেখতে পাবেন যে, সরকার নির্লিপ্ততার অথবা বিরোধিতার দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার নিজের মনে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, স্বরাজ এবং একমাত্র স্বরাজই আমাদের যাবতীয় রোগের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিকার। এবং স্বরাজের জন্য আমাদের যোগ্যতা বিচারের একমাত্র মানদণ্ড মুক্তির অভিলাষ।

তাহলে আমাদের সামনে সমস্যা হল কীভাবে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে জাতীয় আকাঙক্ষাকে জাগ্রত করা যায় ; এই লক্ষ্য স্থির রেখেই আমাদের নীতি এবং কর্মসূচী তৈরি করতে হবে। ১৯২৯ সাল থেকে কংগ্রেস ধ্বংসের এবং প্রতিরোধের, বিরোধিতার এবং সংহতির দ্বৈত নীতি অনুসরণ করে আসছে। আমরা অনুভব করি যে, সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের জাল বিস্তার করে এবং এইসব পরিচালনার জন্য কর্মচারিবাহিনী নিয়োগ করে আমলাতন্ত্র এদেশে শিকড় গেড়ে বসেছে। এগুলি আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্র এবং এগুলির ভিতর দিয়ে আমলাতন্ত্র জনগণের হৃদয়কেই মুঠোয় ধরে রেখেছে। ক্ষমতার এই দুর্গগুলিতেই আমাদের আঘাত হানতে হবে এবং সেই জন্য আমাদের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। কংগ্রেস অফিসগুলিই হল সেইসব সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান। যখন কংগ্রেস কমিটিগুলির সংগঠনের ভিতর দিয়ে আমাদের শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, তখন আমরা আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি দখল করতে সমর্থ হব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে, যে-সব জেলায় কংগ্রেস কমিটিগুলি সুসংগঠিত সেখানে আঞ্চলিক সংস্থাগুলি অনায়াসে দখল করা সম্ভব হয়েছে। অতএব কংগ্রেস অফিসগুলি হল সেই দুর্গ যেখানে আমাদের নিজেদের সুরক্ষিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং আমলাতন্ত্রের দুর্গে আঘাত হানতে যেখান থেকে প্রতিদিন আন্দোলনে বেরিয়ে আসতে হবে। কংগ্রেস কমিটিগুলি আমাদের সেনাবাহিনী, এবং সমরাভিযানের পরিকল্পনা যত দক্ষতার সঙ্গেই রচিত হোক না কেন আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন শক্তিশালী, দক্ষ এবং সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী না থাকলে কোনও পরিকল্পনাই সফল হতে পারে না।

বন্ধুগণ, আপনাদের মনে পড়বে যে, ১৯২২ সালে গয়া কংগ্রেসের পরে যখন আমাদের দেশবাসীর এক বড় অংশের মধ্যে আর সব কিছু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণরূপে কেবল গঠনমূলক কর্মসূচীতে মনোযোগ সন্নিবিষ্ট করবার প্রবণতা দেখা দিয়েছিল, তখন দেশবন্ধু দাশ স্বরাজ্য দলের ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন যে, আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী মনোভাব জাগ্রত রাখার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বিরোধিতার পরিবেশ ছাড়া গঠনমূলক কর্মসূচী এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অথবা অন্য কোনও দিকে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু মনে হয় আমরা প্রায়ই এই মৌলিক নীতিটি ভুলে যাই। “অসহযোগ ফলপ্রসূ নয়”, “বিরোধিতা ব্যর্থ হয়েছে”, “প্রতিরোধ নিষ্ফল”—এই বাঁধা বুলিগুলি অসতর্ক জনগণকে বিভ্রান্ত করে। আমাদের চরিত্রের সর্বাপেক্ষা দুঃখজনক বৈশিষ্ট্য এই যে, আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই না; ব্যর্থতায় আমরা সহজেই ভেঙে পড়ি। আমাদের মধ্যে ইংরেজদের একগুঁয়েমির অভাব আছে, এবং সেই কারণে আমরা তাদের মতো দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম করতে অক্ষম।

আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়েছে, সমাপ্তি কীভাবে আসবে অথবা শেষপর্যন্ত আমলাতন্ত্র কীভাবে আমাদের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হবে। এই বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কারণ আমি এর মধ্যেই ভবিষ্যতের পূর্বাস্বাদ পেয়েছি। এক প্রকার সাধারণ ধর্মঘট অথবা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের সঙ্গে দেশব্যাপী হরতালের মধ্য দিয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবে। ধর্মঘট অথবা হরতাল, যা ঘটাতে শ্রমিক এবং জাতীয় কংগ্রেস আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে, শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের আইন অমান্য আন্দোলনও হবে, কারণ ধর্মঘট চলবার সময় আমলারা সম্ভবত চুপচাপ বসে থাকবে না। এমনও সম্ভব যে, কোনও না কোনও প্রকারের কর-বন্ধ হতে পারে, তবে এটা অপরিহার্য নয়। সঙ্কট উপস্থিত হলে ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে যে, ভারতবর্ষকে রাজনৈতিকভাবে উপবাসী রাখার অর্থ তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক উপবাস। এবং ভারতবর্ষের আমলাতন্ত্র দেখতে পাবে যে, দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের মুখে শাসনকার্য পরিচালনা করা অসম্ভব। কারাগারগুলি ১৯২১-এর মতো পূর্ণ হয়ে উঠবে। সাধারণভাবে আমলাদের মনোবল ভেঙে পড়বে এবং তারা আর তাদের ভৃত্য এবং কর্মচারীদের আনুগত্য এবং নিষ্ঠার উপর নির্ভর করতে পারবে না। শাসনব্যবস্থা এবং সম্ভবত, বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়বে। আমলারা অবস্থাটাকে বিশৃঙ্খল মনে করবে, তবে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেশ সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে। আমলাতন্ত্র তখন অপ্রয়োজনীয় গোলযোগ এবং দুশ্চিন্তার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে জনপ্রতিনিধিদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে।

অন্যান্য কাজের মধ্যে আমাদের আশু কর্তব্য হল সাইমন কমিশন বর্জনকে সামগ্রিক এবং কার্যকর করা। আমরা, কংগ্রেসের লোকেরা, ১৯১৯-এর ভারত শাসন আইনের ক্ষতিকর প্রস্তাবনা কখনও গ্রহণ করিনি। এই আইন আমাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু আমরা কখনও স্বেচ্ছায় এই আইনের আনুগত্য স্বীকার করিনি। এর সঙ্গে অসহযোগিতা করতে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। মানুষের পবিত্র এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতির উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের বক্তব্য হল নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব ভারতবর্ষের, ব্রিটেনের কাজ তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা। যে-সকল দেশ পুনরায় নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করেছে কেবল সেখানেই নয়, আইরিশ ফ্রি স্টেট-সহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্বায়ত্তশাসিত উপনিবেশগুলিতেও এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে।

এই বর্জনের পরিপূরক ব্যবস্থা, বস্তুত এর সদর্থক দিক, হল একটি জাতীয় সংবিধান প্রণয়ন। সর্বদলীয় সম্মেলন এই বিষয়টি হাতে নিয়েছে এবং ভারতবর্ষকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁদের সকলেরই এই সম্মেলনের পরিপূর্ণ সাফল্য কামনা করা উচিত। ভারত-সচিব ক্ষিপ্ত হয়ে সদম্ভে ঘোষণা করেছেন যে, ভারত সর্বসম্মত সংবিধান প্রণয়ন করতে পারবে না। আমাদের মধ্যে যদি সম্মান এবং আত্মসম্ভ্রমবোধের কণামাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে আমাদের উচিত একটি সংবিধান প্রণয়ন করে এই দম্ভোক্তির উপযুক্ত জবাব দেওয়া।

যে-সংবিধান প্রণীত হবে তার কোনও বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে আমি আপনাদের ক্লান্ত করব না। সে ভার আমাদের সংবিধান প্রণেতাদের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনটি প্রধান বিষয়ের উল্লেখ করেই আমি সন্তুষ্ট থাকব। বিষয় তিনটি নিম্নরূপ :

(১) সংবিধানে জাতীয় সার্বভৌমত্বের, অর্থাৎ জনগণের সার্বভৌমত্বের, নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমরা যা চাই তা হল জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য সরকার।

(২) সংবিধানের প্রস্তাবনায় থাকবে ‘অধিকারের ঘোষণা’ যা মৌলিক নাগরিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে। ‘অধিকারের ঘোষণা’ ব্যতীত কোনও সংবিধান মূল্যহীন। দমনমূলক আইন, অধ্যাদেশ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের সঙ্গে স্বাধীন ভারতবর্ষের কোনওরূপ পরিচয় থাকবে না।

(৩) নির্বাচন ব্যবস্থা হবে যৌথ। প্রয়োজনবোধে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে আমাদের অবশ্যই যৌথ নির্বাচন ব্যবস্থার দাবি জানানো উচিত। জাতীয়তাবাদ এবং পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা স্ববিরোধী। নীতির দিক থেকে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা ভ্রান্ত এবং একটি মন্দ নীতির উপর একটি জাতি গড়ে তুলবার প্রচেষ্টা অর্থহীন। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে এবং আমরা যত শীঘ্র এই ব্যবস্থার হাত থেকে রেহাই পাব ততই আমাদের এবং আমাদের দেশের পক্ষে মঙ্গল।

আমাদের জাতীয় দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের আয়ত্তে যে-শক্তি আছে তদনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, কারণ ব্রিটিশদের মর্জিমাফিক যৌক্তিকতার কাছে আবেদন জানিয়ে কোনও লাভ হবে না। আমরা দুর্বল এবং নিরস্ত্র হলেও ভাগ্য করুণাপরবশ হয়ে আমাদের হাতে এমন এক অস্ত্র দিয়েছে যা আমরা অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে প্রয়োগ করতে পারি। এই অস্ত্র হল অর্থনৈতিক বর্জন, অথাৎ ব্রিটিশ পণ্য বর্জন। আয়ার্ল্যান্ডে এবং চীনে এই অস্ত্র অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রায় ২০ বছর আগে স্বদেশী আন্দোলনের সময়েও, এবং আংশিকভাবে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে, এই অস্ত্র সুবিধাজনকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। স্বদেশীর পুনরুজ্জীবন এবং রাজনৈতিক মুক্তি কার্যকর করার জন্য ব্রিটিশ পণ্য বর্জন প্রয়োজন।

যখন রাজনৈতিক সংগ্রাম চলছে তখন আমাদের মধ্যে কিছু লোকের পল্লী পুনর্গঠনের কাজও হাতে নেওয়া উচিত। আমাদের দেশের মতো বিশাল এক দেশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিভার স্থান আছে, সুযোগ আছে বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের।

আমরা সকলে নিশ্চয় এটা লক্ষ্য করে বেদনা পেয়েছি যে, আমাদের জনগণ, এবং বিশেষ করে আমাদের শ্রমিকরা, বর্তমানে এক প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটের ভিতর দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন রেলওয়েতে, বিশেষ করে রেলের কারখানায়, প্রচণ্ড ছাঁটাই চলেছে। আমি জানি যে, আমাদের রেলওয়ের জন্য গ্রেট ব্রিটেন থেকে কয়েক কোটি টাকার সরঞ্জাম আমদানি করা হয়, অথচ কারখানাগুলির সম্প্রসারণ করলে এগুলি এখানে সহজে প্রস্তুত করা যেত। এই জিনিসগুলি ভারতে প্রস্তুত করবার চেষ্টা করলে বর্তমান শ্রমিকদের ছাঁটাই করা তো দূরের কথা, কর্তৃপক্ষ আরও অনেক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করতে পারতেন। কিন্তু আবার এক্ষেত্রেও ইংরেজ এবং তাদের শিল্পের স্বার্থে হতভাগ্য ভারতীয়দের স্বার্থ বলি দিতে হবে। শ্রমিকদের এই সঙ্কটের সময়ে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা প্রতিটি ভারতীয়ের, বিশেষ করে কংগ্রেস কর্মীর, অবশ্য কর্তব্য। আমাদের আয়ত্তে যত উপায় আছে, আসুন, তার সবগুলি নিয়ে আমরা তাঁদের সাহায্য করবার চেষ্টা করি।

বন্ধুগণ, আমরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক চরম সঙ্কটজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছি এবং আমাদের সমস্ত শক্তি ঐক্যবদ্ধ করে শাসকশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই হবে আমাদের কর্তব্য। আসুন, আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একই অন্তঃকরণে এবং একই কণ্ঠে বলি যে, আমাদের আদর্শ, টেনিসন যেমন ইউলিসিস-এর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, “সংগ্রাম করা, সন্ধান করা, আবিষ্কার করা এবং বশ্যতা অস্বীকার করা।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *