কিছুদিন আগে পদ্মাবতী ছবির শুটিং এ বিখ্যাত পরিচালক সঞ্জয় লীলা ভান্সালিকে শারীরিক আক্রমণ করেছে ‘রাজপুত কারনি সেনা’ নামের একটি দল। ছবিতে পদ্মাবতীর সঙ্গে আলাউদ্দিন খিলজির ঘনিষ্ঠতা দেখানো হচ্ছে, এটা তাদের পছন্দ হচ্ছে না। সঞ্জয় ইতিহাস বদলে দিচ্ছেন, অভিযোগ এখানেই। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে বই লিখতে গেলে, বা ছবি আঁকতে গেলে, বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে লেখক, শিল্পী, চিত্রপরিচালকরা খানিকটা নিজের কল্পনা মেশানই। এ নতুন কিছু নয়। দোষ সঞ্জয় লীলার নয়। শিল্পীর স্বাধীনতা হরণ করে নিলে আর যাই তৈরি হোক, শিল্প তৈরি হয় না। পদ্মাবতীর কথা ইতিহাসে আছে, কিন্তু পদ্মাবতী নামে বাস্তবে আদৌ কেউ ছিল কি না এ নিয়ে অনেক ইতিহাসবিদেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কয়েক মাস আগে চিত্র পরিচালক করন জহরের ওপরও হামলা হয়েছে। কেন তাঁর ‘এ দিল হ্যায় মুশকিল’ ছবিতে ফওহাদ খান নামের এক পাকিস্তানি অভিনেতাকে নেওয়া হলো, এ নিয়ে আপত্তি ‘মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা’ নামের একটি দলের। দেশি অভিনেতা থাকতে পাকিস্তানের মতো শত্রু দেশ থেকে কেন অভিনেতা আনতে হয়, যখন পাকিস্তানের হামলায় ভারতের সেনারা মরছে? করন জহরের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ওরা। করন জহর প্রতিজ্ঞা করেছেন তাঁর ছবিতে তিনি আর পাকিস্তানি অভিনেতা নেবেন না। জানি না সঞ্জয় লীলা ভান্সালিও আতঙ্কে ডুবে আছেন কিনা, তিনিও তাঁর ছবির গল্প বদলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন কিনা।
মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফান্দাবিস তাঁর অফিসেই করন জহর আর ‘মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনা’র দল-প্রধান রাজ থেকারের সঙ্গে একটি মিটিংএর ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। ওই মিটিং-এ রাজ থেকারে করন জহরকে বলেছেন ভারতীয় সেনার তহবিলে পাঁচ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে। এসব হামলার জন্য রাজপুত কার্নি সেনার বা মহারাষ্ট্র নভনির্মাণ সেনার কেউ গ্রেফতার হয়নি। না হিন্দু কট্টরপন্থী, না মুসলিম কট্টরপন্থী— কাউকে তাদের অপকর্মের জন্য শাস্তি দেওয়া হয় না। আমার ওপরও হামলা হয়েছে, হামলা করেছে মুসলিম কট্টরপন্থী। তারাও শাহেনশাহর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কট্টরপন্থীরা মানুষের বাক স্বাধীনতায় এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। কিন্তু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে যে রাজনীতিকরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা কী করে গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র বাক স্বাধীনতা লঙ্ঘন করার স্পর্ধা করেন? ভারতের বেশ কজন মুখ্যমন্ত্রী তাই করছেন। মুখ্যমন্ত্রীরাই যদি ধর্মীয় মৌলবাদীদের বা কট্টরপন্থীদের, যতই তারা অন্যায় করুক, সমর্থন করেন, ভিন্ন মতের মানুষেরা তবে যাবেন কোথায়? শিল্পী সাহিত্যিকরা করবেন কী? আমার ব্যাপারেই দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের কিছু ধর্মান্ধ উগ্রপন্থী ‘তসলিমা গো ব্যাক’ বলে চেঁচালো, অমনি মুখ্যমন্ত্রী তসলিমাকে বের করে দিলেন রাজ্য থেকে, শুধু তাই নয়, বাক-স্বাধীনতা বিরোধী কট্টরপন্থীদের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু মালা পরানো বন্ধ হয়নি।
এর আগেও ২০১০ সালে শাহ্রুখ খানের ‘আমার নাম খান’ ছবি নিয়েও ঝামেলা করেছিল কট্টরপন্থী হিন্দু দল ‘শিব সেনা’। শাহ্রুখ তাঁর আই পি এল-এ পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের নিতে চেয়েছিলেন, সে কারণেই রাগ। এম এফ হুসেনকে হিন্দু মৌলবাদীদের অত্যাচারে পালিয়ে যেতে হয়েছে দেশ ছেড়ে। হুসেনের দোষ, সরস্বতীর ছবি আঁকার সময় তাঁর গায়ে তিনি কাপড় পরাননি। নারীর সম্ভ্রম নিয়ে যাদের এত মাথাব্যথা তারা কিন্তু এত যে ধর্ষণ আর খুন খারাবির শিকার হচ্ছে মেয়েরা, তার প্রতিবাদে মোটেও ঝাঁপিয়ে পড়ে না। দেবীর কাপড় কোনও শিল্পীর অধিকার নেই খোলার, কিন্তু পুরুষের অধিকার আছে রক্তমাংসের নারীর কাপড় ঘরে বাইরে খুলে ফেলার এবং ধর্ষণ করার!
জয়পুর লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে আমি গিয়েছি এ খবর শুনেই এই সেদিন কিছু মুসলিম মৌলবাদী জড়ো হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল ‘তসলিমা গো ব্যাক’ বলে। তাদের দাবি তসলিমা তার ‘লজ্জা’ নামের বইয়ে ইসলামকে, ইসলামের নবীকে অপমান করেছে। সুতরাং লিটারেচার ফেস্টিভ্যালে তসলিমার যোগ দেওয়া চলবে না। আমার লেখা কোনও বই-ই যে রাজস্থানী মুসলিম মৌলবাদীরা পড়েনি, এ আমি নিশ্চিত। লজ্জা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কাহিনী, তাদের নিরাপত্তাহীনতার আর দেশত্যাগের কাহিনী।
লজ্জায় ইসলাম নিয়ে কোনও বাক্য নেই, ইসলামের নবী নিয়ে তো নেইই। লজ্জা না পড়েই, লজ্জার গল্প না জেনেই লেখকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসা মুসলমানেরা ভণ্ড তো বটেই, পাঁড় মিথ্যুকও। এদের কাছেই ভারতের অসৎ রাজনীতিকদের মতো মাথা নোয়ালেন লিটারেচার ফেস্টিভ্যালের পরিচালক। বলে দিলেন, যেহেতু মুসলিমরা চান না তসলিমা ফেস্টিভ্যালে আসুক, তসলিমাকে তাঁরা আর কখনও আমন্ত্রণ জানাবেন না। ব্যস, সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু সমস্যা কি এভাবে মেটে? এভাবে বাক স্বাধীনতা আরও বেশি লঙ্ঘিত হয়, এভাবে মৌলবাদীদের বাক স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডে বিস্তর আস্কারা দেওয়া হয়। জয়পুর লিট ফেস্টে কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী দল ‘আর এস এস’-এর ডাকসাইটে দুই নেতা অংশগ্রহণ করেছিলেন, ওঁরা হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করতে চান, যে রাষ্ট্রে মুসলমানদের জায়গা নেই, জায়গা থাকলেও অধিকার খুব বেশি নেই। এই হিন্দুত্ববাদী আর এস এসের নেতাদের উপস্থিতির বিরুদ্ধে কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীরা প্রতিবাদ করেনি, করেছে আমার উপস্থিতির বিরুদ্ধে। হিন্দুরা অত্যাচারিত হলে যেমন আমি হিন্দুর পাশে দাঁড়াই, মুসলমানরা অত্যাচারিত হলেও একইভাবে মুসলমানদের পাশে দাঁড়াই। ওই মৌলবাদীদের মানবাধিকারের জন্য আমিও লড়বো। কিন্তু কেন মৌলবাদীরা মুসলিমদের শত্রুর বিরুদ্ধে স্লোগান না দিয়ে আমার বিরুদ্ধে দেয়? এর উত্তর খুব সোজা। কারণ আমার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছে তাই করলেও, আমাকে তাড়ালে, আমার মাথার দাম ঘোষণা করলে কারও কোনও শাস্তি হয় না, কেউই তাদের বর্বরতার প্রতিবাদ করে না, সবাই মেনে নেয় বর্বরদের দাবি, দাবি না মানলেও মুখ বুজে থাকে। সঞ্জয় লীলা ভান্সালির ওপর হামলার প্রতিবাদ প্রায় সব শিল্পী সাহিত্যিকই করেছেন, কিন্তু তসলিমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে কেউ দাঁড়ায় না। সম্ভবত এর একটিই কারণ, হিন্দু মৌলবাদীদের চেয়ে মুসলিম মৌলবাদীদের মানুষ ভয় পায় বেশি। রাজনীতিকদের অবশ্য মুসলিমদের ভোট আদায় করার জন্য মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে হাত পাতার অভ্যেস আছে, তাদের খুশি করার জন্য রাজনীতিকরা হেন কাজ নেই করেন না।
হিন্দু এবং মুসলমান মৌলবাদী— দুটোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ভারতবর্ষে। চিরকালই তাদের অস্তিত্ব ছিল, কখনও কখনও ভয়ঙ্করভাবেই ছিল, তবে শিল্পী সাহিত্যিকদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তারা আজকাল ত্রিশূল আর তলোয়ার হাতে বেপরোয়া দাঁড়িয়েছে। এদের যদি পরাস্ত করা না হয়, তবে সমাজ পরাস্ত হবে। ধর্মের শাসন কায়েম হবে। ক্রমশ পেছনে হাঁটবে ভবিষ্যৎ, ক্রমশ অতীতের দিকে যাবে। অন্ধকার যুগের দিকে যাবে।
মনে হচ্ছে পৃথিবীজুড়েই ধর্মান্ধ আর মৌলবাদীদের জয়জয়কার! আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স তো বলেছেন, তিনি বিবর্তনে বিশ্বাস করেন না, বিশ্বাস করেন বাইবেলের রূপকথায়। ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন এবার ছ’জন ক্রিশ্চান ধর্মগুরু ভাষণ দিয়েছেন। আমেরিকার অন্য কোনও প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনীতে এত বেশি ধর্মগুরুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এমন নারীবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, আগাগোড়া ব্যবসায়ী কোনও লোক কোনওদিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন করেননি, জেতেনওনি। ক্ষমতায় এসেই সাতটি মুসলিম দেশের মানুষের জন্য আমেরিকায় ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন ট্রাম্প। ওই মুসলিম দেশগুলোতে প্রচুর সেক্যুলার, প্রগতিশীল মানুষ আছেন, নিরীহ মুসলমান আছেন। তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা কেন নষ্ট করবেন ট্রাম্প? দুর্নাম হচ্ছে ট্রাম্পের। কিন্তু মনে হচ্ছে না এতে কিছু তাঁর যায় আসে।
ইউরোপেও জনপ্রিয় হচ্ছে কট্টর ডানপন্থী। অসহিষ্ণুতা চারদিকে। কিন্তু সভ্যতা বজায় রাখতে গেলে চরমপন্থী সব মতবাদকে অবজ্ঞা করতে হবে বা অগ্রাহ্য করতে হবে। চরমপন্থীর সঙ্গে উদারপন্থীর বন্ধুত্ব চলে না।
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭