দ্বিতীয় খণ্ড (অসম্পূর্ণ)

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভা : ডিসেম্বর, ১৯২৮

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সভা : ডিসেম্বর, ১৯২৮

সারা-ভারত ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সম্মেলন ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসের ২৪শে তারিখে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপরে কলকাতাতেই বসেছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সারা ভারতীয় বৈঠক। ২৭শে, ২৮শে ও ২৯শে ডিসেম্বর (১৯২৮) এই তিনদিন চলেছিল মিটিং। মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় দাখিল-করা কাগজপত্র হতেও এই তারিখগুলি সমর্থিত। ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সম্মেলন চলার সময়ে অলবার্ট হলের কমিটি রুমে কমিউনিস্ট পার্টির যে মিটিং হয়েছিল তার কথা আমি এ পুস্তকের প্রথম খণ্ডে লিখেছি।

এর আগে আমরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং মাদ্রাজে ও দিল্লেিত করেছি এবং বোম্বেতে কয়েকবার করেছি। কোনো মিটিং কিন্তু তিনদিন ধরে হয়নি। পার্টির অন্য কোনো বৈঠকে এত বেশী বিষয়ও আলোচিত হয়নি। ফিলিপ স্প্রাট ও বেঞ্জামিন ফ্রান্সিস ব্রাডলি গ্রেট ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। ভারতবর্ষে আমাদের সঙ্গেই তাঁরা পার্টির কাজ করতেন। এই তিন দিনের বৈঠকে তাঁরা আগাগোড়া উপস্থিত ছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য জ্যাক রায়ানও (Jack Ryan) ভ্রাতীয় প্রতিনিধিরূপে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত বৈঠকগুলিতে উপস্থিত ছিলেন। প্যানপ্যাসেফিক ট্রেড ইউনিয়ন সেক্রেটারিয়েট যাতে অল-ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের দ্বারা স্বীকৃতি লাভ করে তার জন্যেই জ্যাক রায়ান এদেশে এসেছিলেন। এই ব্যাপারে তিনি সাফল্য লাভ করেননি। অল-ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সম্মেলনেও তিনি উপস্থিত থেকেছেন। ১৯৪৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির জেনেরেল সেক্রেটারি কমরেড শার্কি – (L. L. Sharkey) যখন ভ্রাতীয় প্রতিনিধিরূপে কলকাতায় আমাদের পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন তখন তাঁর মুখে শুনেছিলেম যে জ্যাক রায়ান কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে চলে গেছেন।

কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির এই সভায় ডক্টর গঙ্গাধর অধিকারীও যোগ দিয়েছিলেন। এদেশে পার্টির সভায় এটা ছিল তাঁর প্রথম যোগদান। তিনি জার্মানী হতে এসেছিলেন। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি ফিজিকাল কেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করেছিলেন। জার্মানীর কমিউনিস্ট পার্টিতেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। বোম্বেতে জাহাজ হাতে নামার পরে কাস্টম অফিসাররা যখন তাঁর মালপত্র পরীক্ষা করেছিলেন তখন তাঁরা তাঁর জার্মান পার্টির পরিচয় পত্রখানি নিয়ে নিতে চাইছিলেন। একজন কাস্টম অফিসার ও ডক্টর অধিকারীর মধ্যে এই পরিচয় পত্রখানি নিয়ে টানাটানি শুরু হলে পত্রের অর্ধেক কাস্টম অফিসারের হতে চলে গেল, আর বাকী অর্ধেক থেকে গেল ডক্টর অধিকারীর হাতে। তিনি তাঁর পরিচয়পত্ররূপে কাগজের এই ছেঁড়া অংশটুকু কমিউনিস্ট পার্টির সভায় পেশ করলেন। আমরা মত দিলাম যে কাগজের ছেঁড়া টুকরোই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট। তাঁর সঙ্গে তাঁর মাসতুত ভাই ভালচন্দ্র এ্যাম্বক রণদীবেও কলকাতায় এসেছিলেন। তবে, তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তিনদিনের সভাগুলিতে যোগ দেননি। বোম্বে ফিরে গিয়েই তিনি ১৯২৯ সালের জানুয়ারী মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ১৭ই মার্চ ও ১৯শে মার্চ (১৯২৯) তারিখের সভায় তিনি যোগ দিয়েছেন। কমরেড বিটি রণদীবে এখন (১৯৭০) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদীর) পলিট ব্যুরোর সভ্য।

কলকাতায় পার্টির প্রথম দিনের বৈঠকে (২৭ শে ডিসেম্বর) শান্তারাম এস. মিরাজকরকে পাকাপাকিভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে সভ্য হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আমার প্রস্তাবানুসারে সেদিন সোহন সিং জোশকেও পার্টিতে নেওয়া হয়। পূরণচন্দ্র জোশীর নামও আমি প্রস্তাব করি। সভায় তাকে পার্টিতে নিতে কারুর কোনো আপত্তি ছিল না। তবে, সকলে বললেন তার নামটি এখন মুলতুবী রাখা হোক। তার মানে অদূর ভবিষ্যতে পার্টির যে বিপদ আসার সম্ভাবনা আছে তা থেকে তাকে বাঁচানো। তার বয়স কম ছিল। কিন্তু জোশী কোনো বাধা মানল না। চারদিকে অকারণে চিঠিপত্র লিখে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল। তখন আমি ফিলিপ স্প্রাট ও হালীমের সঙ্গে পরামর্শ করে বোম্বেতে পার্টির জেনেরেল সেক্রেটারি ঘাটেকে লিখেছিলেম যে পূরণচন্দ্র জোশীকে বিপদের হাত হতে বাঁচানো যাবে না। তার পার্টি সভ্যরূপে গণ্য করা হোক। এই পত্র হয়তো পুলিসের হাতে পড়েনি। কিন্তু পূরণচন্দ্রকে আমি যে সাবধান করে দিয়েছিলেম তা মীরাট মোকদ্দমার রেকর্ডে আছে। কমরেড ডি.বি. কুলকার্নিকেও কলকাতার সভায় পার্টির সভ্য ক’রে নেওয়া হয়েছিল।

কলকাতার সভায় শান্তারাম মিরাজকরকে যে পাকা পার্টি সভ্য করে নেওয়া হয়েছিল সেটা ছিল একটা ভুয়া ব্যাপার। মিরাজকর আসলে ১৯২৭ সালের আরম্ভেই পার্টি সভ্য হয়েছিল। ওই বছরের জানুয়ারী মাসে বোম্বেতে জর্জ এলিশনকে (তখনও তিনি আমাদের নিকটে ডোনাল্ড ক্যাম্পবেল ছিলেন) আমি জিজ্ঞাসা করেছিলেম যে মিরাজকরকে কেন কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বর করা হচ্ছে না। তিনি আমায় বলেছিলেন, মিরাজরকে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ দিয়ে বোম্বেতে যে নূতন ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি হতে যাচ্ছে তার সেক্রেটারি করা হবে। কার্যত তাই হয়েছিল। ১৯২৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মিরাজকর আগে হতে কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেতা ছিল। মাদ্রাজে সে যে দরখাস্ত করেছিল তার অন্য কারণ ছিল। আমরা সকলে ২২ নম্বর সাউথ বীচে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের বাড়ীতে উঠেছিলেম। আমাদের পার্টির মিটিংও হয়েছিল সেই বাড়ীতেই। সিঙ্গারাভেলু তাঁর নবলব্ধ বন্ধু মুকুন্দলাল সরকারকে হঠাৎ সেই মিটিং-এ এনে বসিয়ে দিলেন এবং অনুরোধ করলেন যে সরকারের সভ্যপদ তখনই মঞ্জুর ক’রে তাঁকে সভায় যোগ দিতে দেওয়া হোক। আমরা সিঙ্গারাভেলুর ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে তখনই মিরাজকরকে দিয়ে সভ্যপদের জন্যে দরখাস্ত করালাম। দু’খানি দরখাস্তের ওপরেই ওই মিটিং-এর সভাপতি (এস. এ. ডাঙ্গে) লিখে দিলেন যে পরে বিবেচিত হবে। মুকুন্দলাল সরকারকে কমিউনিস্ট পার্টি কোনো দিন বিশ্বাস করেনি। সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার বুঝেছিলেন যে মুকুন্দ লাল সরকার কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ আর পাবেন না। ঘাটের বহু পকেট বিশিষ্ট একটি কোট ছিল। সেই সকল পকেট কমিউনিস্ট পার্টির কাগজপত্রে ভর্তি থাকত। কলকাতার সভায় মিরাজকরের সেই দরখাস্তখানি সে পেশ করেছিল আমরা জানিনে মুকুন্দলাল সরকারের দরখাস্ত কোথায় চলে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির এই রকম অবস্থা কখনও ছিল না যে সভ্যপদের জন্যে দরখাস্ত করে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। মাদ্রাজের পরে পার্টি মিটিং-এ সভ্যপদ পেয়ে গেলেন। পূরণচন্দ্র জোশীও আসলে সভ্যপদ পেয়েই গিয়েছিলেন। সেটা মুলতুবী রাখা হয়েছিল একটা বিশেষ কারণে।

কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সভায় মিরাজকর উপস্থিত থাকতে পারেনি। সেই সময়ে বোম্বেতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ার বোম্বের কমরেডরা এক রকম জবরদস্তি মিরাজকরকে বোম্বে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটিতে প্রতিনিধি প্রেরণ

এই পুস্তকের প্রথম খণ্ডে আমি শওকত উসমানী সম্বন্ধে অনেক কিছু লিখেছি। লিখেছি যে উসমানীরা ক’জন জাল পরিচয়-পত্র নিয়ে এবং ব্রিটিশ স্পাই মসউদ আলী শাহের সাহায্যে ইরানী পাসপোর্ট সংগ্রহ ক’রে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ট কংগ্রেস (১৭ই জুলাই হতে ৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৮) আরম্ভ হওয়ার পূর্বক্ষণে মস্কো পৌঁছেছিল। মসউদ আলী শাহ্ তাদের নিয়ে গিয়েছিল। ভারতবর্ষ হতে খবর আনানোর সময় হাতে না থাকায় তখন উসমানীদের কংগ্রেসে যোগ দিতে দেওয়া হয়। তাদের দু’জন মসউদ আলী শাহ ও হাবীব আহম্দ, ইয়ং কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিল। উসমানী ও শফীক যথাক্রমে সিকান্দার সুর ও রেজা নামে ভারতের তরফ হতে পুরো ডেলিগেট হয়েছিল। উসমানী কংগ্রেসের প্রেসিডিয়ামের একজন সভ্যও মনোনীত হয়েছিল। লন্ডনের মারফতে আমাদের নিকটে মস্কোর জিজ্ঞাসা পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছিল। কলকাতার আমরা সঙ্গে সঙ্গেই অপরিস্ফুট (Cryptic) ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেম যে তাদের ওপরে আমাদের আস্থা নেই এবং তাদের ভিতরে সন্দিগ্ধ লোকও রয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদের খবর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে পৌঁছাবার পূর্বেই ৬ষ্ঠ কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হয়ে যায়। উসমানী ওদেশে থেকে যাওয়ার জন্যে গিয়েছিল। কংগ্রেস শেষ হওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসছিল ততই সে অনুভব করছিল যে তার থেকে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। আমাদের রিপোর্ট পৌঁছালে সে গিরেস্তারও হয়ে যেতে পারে। এই কারণে কংগ্রেস শেষ হওয়া মাত্রই সে ক্রিমিয়ায় চলে যায়। সেখানে কিঞ্চিৎ চিকিৎসিত হওয়ার পরে ইউরোপ হয়ে সে সোজা ভারতবর্ষে চলে আসে। সে জাহাজ হতে নেমেছিল বোম্বেতে। এ কথা তার জানা ছিল যে কলকাতায় তখন ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সারা-ভারত সম্মেলন হচ্ছে। তাই সে সোজা চলে এলো কলকাতায়। এসেই আমার সঙ্গে সন্ধ্যার পর দেখা করল। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে হিন্দুস্তান বিল্ডিং-এর নীচের তলায় একটি রেস্তোরাঁয় আমার সঙ্গে গিয়ে সে বলল, “আমি তোমাদের নিকটে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করলাম। তোমরা এখন আমাকে নিয়ে যা খুশী করতে পার। আমাকে বরঞ্চ কোনো গ্রামেই পাঠিয়ে দাও। কিছু কাজ নিয়ে আমি গ্রামেই পড়ে থাকব।” একথা বলেই সে তার পকেট থেকে তার ইরানী পাসপোর্টখানি বা’র ক’রে আমার হাতে দিল। ইউরোপের কোনো কোনো দেশের দু’ একটি ক’রে ধাতু মুদ্রা তার পকেটে ছিল। সেগুলিও বা’র ক’রে সে আমার হাতে দিল। অর্থাৎ সে যদি তখনই গিরেতার হয়ে যায় তবে তার নিকটে তার ইউরোপ ও মস্কো যাওয়ার কোনও চিহ্ন না থাকে এমন ব্যবস্থা সে করল।

উসমানী আমার নিকটে তার জাল পরিচয়পত্রগুলির কথা সবই বলল এবং আরও বলল যে আজমীঢ়ের অর্জুনলাল শেঠীও তার একটিতে সই করেছিলেন। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে অনেক আলোচনার কথাও সে আমায় তখন জানিয়েছিল। বলেছিল যে আলোচনার সময়ে আমার অনেক সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু মাজুত তার প্রতিবাদ করায় তা থেমে যায়। আমার সমালোচনা উসমানীই করেছিল কিনা আমি তা জানিনে। আমি তার মস্কো যাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেম। উসমানী আরও বলেছিল যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনারের হেড কোয়ার্টার্সে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিদের সোজাসুজি ভারতবর্ষ হতে গিয়ে থাকতে হবে। “তোমাদের আর এস ভি ঘাটের নাম কমিউনিস্ট ইনটারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটির অল্টারনেট মেম্বর হিসাবে প্রস্তাবিত হয়েছে, ইত্যাদি। মাজুতের পরিচয় আমি পরে দেব।

উসমানীর কথাগুলি আমি আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি কমিটির অন্যান্য মেম্বরদের নিকটে রিপোর্ট করেছিলেম। উসমানী নিজেও তাঁদের বলে থাকতে পারে। জে. ডব্লিউ জনস্টোন (J. W. Johnstone) আমেরিকার কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের ষষ্ঠ কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। অল-ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের ঝরিয়া অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্যে তিনি ভারতে এসেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসকে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লীগের অন্তর্ভুক্তকরণের প্রচেষ্টা তাঁর কাজ ছিল। আমার যতটা মনে পড়ে তিনি তাতে সফলও হয়েছিলেন অর্থাৎ অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লীগের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ট্রেড ইউনিয়ন শেষ হওয়ার আগেই জনস্টোনকে ঝরিয়াতে গিরোর ক’রে ভারত হতে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল। কলকাতাতে কয়েকদিন থাকার পরে তিনি ঝরিয়া গিয়েছিলেন। সেই ক’দিন তিনি মজুরদের নানান সভ্য-সমিতিতে, বিশেষ ক’রে ঝাউড়িয়ার ধর্মঘটকারী মজুরদের মিটিং-এ বক্তৃতা দিয়েছেন। সুবক্তা ছিলেন তিনি। ভারতবর্ষ তাঁর নিকটে অচেনা জায়গা ছিল না। আগে তিনি জাতিতে ইংরেজ ছিলেন এবং প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি ভারতে ইংরেজ সৈনিক ছিলেন। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গে তিনি বাস করে গেছেন। তাঁর এদেশে থাকার সময়ে আমি আমাদের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি কনফারেন্সের কাজে অতি ব্যস্ত ছিলেম। তাই জনস্টোনের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করার সময় পাইনি। ফিলিপ স্প্রাটের সঙ্গে তাঁর অনেক কথা হয়েছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটিতে ভারতের পার্টিতে প্রতিনিধি পাঠানো সম্বন্ধে জনস্টোন স্প্রাটকে কিছু বলেছিলেন কিনা সে-খবর নেওয়ার সময় কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং হওয়ার আগে আমি নিতে পারিনি।

উসমানীরা যেভাবে মস্কো গিয়েছিল তাতে উসমানীকে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং-এ বসতে দেওয়াটা আশ্চর্য ঠেকতে পারে। কিন্তু আত্মসমর্পণের ফলে সকলের মন ভিজে গিয়েছিল। তাই তাকে সভায় বসতে দেওয়া হয়। সে সুদীর্ঘ রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেনি। অত্যন্ত নিরীহের মতো সভায় বসেছিল। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটিতে যে সোজাসুজি ভারত হতে প্রতিনিধি গিয়ে মস্কোয় বাস করতে হবে এবং মুজফফর আদ ও সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটের নাম এই একজেকিউটিব কমিটির অল্টারনেট মেম্বররূপে প্রস্তাবিত হয়েছে, এই রিপোর্ট সে সভায় করে।

বিষয়টি সভায় আলোচিত হয়। দু’জন নয়-একজনই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটিতে যাবেন এটা আগে ধরে নিয়েই আলোচনা চলেছিল। উসমানীর রিপোর্ট সত্ত্বেও ঘাটের নাম আলোচিত হয়নি। নিজের নাম সকলের সামনে তুলে ধরবে এমন লোক ঘাটে ছিল না। মিরাজকর, মুজফফর আহমদ ও কেশব জোগলেকরের নাম সভায় আলোচিত হয়। জ্যাক রায়ান মিরাজকরের নাম সভায় প্রস্তাব করেছিলেন এবং অত্যন্ত জোরের সঙ্গে করেছিলেন। কলকাতা ছাড়ার আগে মিরাজকর তাঁকে খুব ভজিয়ে গিয়েছিল। নিজেকে সামনে তুলে ধরা ছিল মিরাজকরের সহজাত গুণ বা দোষের মতো। তবে তার প্রচেষ্টা হতে বুঝে নিতে হবে যে আগে হতে পার্টির মেম্বর না থাকলে সে কখনও জ্যাক রায়ানকে দিয়ে নিজের নাম প্রস্তাব করাত না। জোগেলকর অবশ্য নিজের নাম নিজেই প্রস্তাব করেছিল। এটা তার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। আমার নাম যতটা মনে পড়ে উসমানীর রিপোর্ট হতে উঠেছিল। হতে পারে জেনেরেল সেক্রেটারি হিসাবে ঘাটে আমার নাম প্রস্তাব করেছিল। ব্যাপারটি আমার এখন ভালো মনে নেই। প্রথমে স্থির করা হয় যে মিরাজকর ও মুজফফর আহমদকেই পাঠানো হবে। এই আলোচনাতে আমি একটি কথাও উচ্চারণ করিনি। আমি আমার মনে আনন্দ অনুভব যে করিনি তা নয়, কিন্তু পার্টির বাইরের লোকেরা ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির কনফারেন্সের সময় যে ক্ষতি করেছিলেন তার আঘাত আমি তখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

কলকাতা হতে বোম্বে ফিরে যাওয়ার সময়ে বেন ব্রাডলি আমায় বারে বারে বলে গেলেন খুব শীঘ্রই যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেল। বোম্বে ফিরে গিয়েও আবার সেই কথাই কেউ বলে গেলেন না। তাঁরা সব দায়িত্ব আমার ওপরের ন্যস্ত করে যে যার পথে চলে গেলেন।

কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতার সভায় পার্টিতে নূতন মেম্বর গ্রহণ করা হয়েছিল সে কথা বলেছি। কয়েকজন পার্টি হতে বহিষ্কৃতও হয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন (১) মাওলানা হস্ত মোহানী, (২) লাহোরের শাসুদ্দীন হাস্সান ও (৩) সি কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার। হস্ত্রত সাহেবের বহিষ্কারের কারণ এই ছিল যে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। এখন যে-সব কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছে তা থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে কানপুরের কমিউনিস্ট পার্টি হতে বার হয়ে গিয়ে সত্যভক্ত তাঁর দ্বিতীয় ন্যাশনালিস্ট কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেছিল। তাতেও হস্রত সাহেব ছিলেন। সি কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গারের বহিষ্কারের কআ এই পুস্তকে প্রথম খণ্ডে লিখেছি।

কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতার এই সভায় পার্টির সেন্ট্রাল একজেকিউটিব কমিটিও নির্বাচিত হয়েছিল। তাতে সভ্য ছিলেন:

(১) এস ভি ঘাটে

(২) এস এস মিরাজকর

বোম্বে

(৩) এস এ ডাঙ্গে

(৪) আর এস নিম্বকর

(৫) কে এন জোগলেকর

(৬) মুজফফর আহমদ

(৭) আবদুল হালীম

কলকাতা

(৮) শামসুল হুদা

(৯) মীর আবদুল মজীদ

(১০) সোহন সিং জোশ

পাঞ্জাব

এবারেও এস ভি ঘাটেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জেনেরেল সেক্রেটারি করা হয়। পার্টির এই সভার অতি সংক্ষিপ্ত কার্যবিবরণী মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমার পি ১২৯৫ নম্বর এজিবিটরূপে তার পেপার বুকে ছাপা হয়েছে।

কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটব কমিটিতে কে যাবেন তা যেদিন স্থির হলো সেদিনই আমাদের সভায় উপস্থিত একজনের সহিত ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির একজন সভ্য যিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না দেখা করলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য তাঁকে বলে দিলেন যে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একজেকিউটিব কমিটিতে যোগ দেওয়ার জন্য মুজফফর আদ মস্কো যাচ্ছেন। ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির সভ্যটি ছিলেন তাঁদেরই একজন যাঁরা পার্টির বন্ধু ও দরদী মহলে ব’লে বেড়াচ্ছিলেন যে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর ওপরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার ভার কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল দিয়েছিলেন, কিন্তু মুজফফর আহমদ সেই অধিকার আত্মসাৎ করে নিয়েছে। তিনি কোনো সময় নষ্ট না করে এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে সঙ্গে সঙ্গেই খবরটি পুলিসের ইনটেলিজেন্স বিভাগে পৌঁছে যায়। এই ইন্‌টেলিজেন্স বিভাগ বলতে আমি কলকাতা পুলিসের স্পেশাল ব্রাঞ্চকেও শামিল করে নিচ্ছি। কারণ, তাঁরাই সে যুগে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি বিশেষ নজর রাখছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পুলিসও তাদের তৎপরতা দেখাল। যিনি আমার মস্কো যাওয়ার সিদ্ধান্তের খবর সংগ্রহ করে নিয়েছিলেন তিনিই কয়েক দিন পরে টেলিফোনে আমায় খবর দিলেন। বললেন, তাঁর এবং বন্ধু ব্যক্তিগত কাজে একজন ইনটেলিজেন্স অফিসারের সঙ্গে তাঁর বাড়ীতে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অফিসারটি বাড়ীতেও অফিসের কাজ করেছিলেন। তাঁর টেবিলের ওপরে একখানি ছাপানো সার্কুলার পড়ে থাকতে তিনি দেখেন। সেই সার্কুলারে আমার ফটো মুদ্রিত হয়েছিল। তাতে নির্দেশ দেওয়া ছিল যে এই লোকটি যেন জল বা স্থল কোনো পথেই ভারতবর্ষ হতে বার হয়ে না যেতে পারে। অভিযুক্ত হয়ে মীরাটের আদালতে যাওয়ার পরে জুনিয়র পাবলিক প্রসেকিউটর মিস্টার জে.পি. মিত্রও আমাদের এই খবর দিয়েছিলেন। টেলিফোনের খবর পাওয়ার পরে আমি বুঝেছিলেম যে আমার মস্কো যাওয়ার দফা রফা হয়ে গেল।

মজুরদের লড়াই: ১৯২৭ ও ১৯২৮ সাল

১৯২৭ সালে আমরা কলকাতা-কাশীপুর অঞ্চলের জুট প্রেস মজুরদের ধর্মঘটে কিছু সাহায্য করেছিলেম। ইংরেজ মালিকের কাগজ “স্টেটস্ম্যান” আমাদের খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করতেন। তাঁরা লিখলেন এবার পেজান্ট্স এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি মজুরদের লড়াইয়ে নামল।

১৯২৭ সালের মজুরদের আরও একটি লড়াইতে আমরা সাহায্য করেছিলেম। কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট মজুরদের একটা বিশেষ অংশ (সেক্‌শন) ধর্মঘট করেছিলেন। আমরা তার পরিচালনা করেছিলেম। এই পরিচালনায় আমাদের সঙ্গে গভীরভাবে লিপ্ত ছিলেন মহারাষ্ট্রীয় যুবক গড়বোলে। তিনি পেজান্ট্স এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টির বা কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না, কলকাতার এজ্রা স্ট্রীটে কোনও সওদাগরী আফিসে চাকরী করতেন। হাইকোর্টের নিকটে একটি ছোট পার্কে প্রতিদিন ধর্মঘটী মজুরদের মিটিং হতো। এই পার্ক জুড়েই পরে বেঙ্গল লেজিসলেটিব এসেীর বাড়ী উঠেছে। এ সব মিটিঙেই গড়বোলের উদ্যোগে কাস্তে ও হাতুড়ী বাদ দিয়ে কলকাতায় প্রথম লাল ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়েছিল। তিনি আমাদের সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করতে এসেছিলেন। তাঁকে আমরা জোর করে বলিনি যে কাস্তে-হাতুড়ী খচিত লাল পতাকাই ওড়াতে হবে।

১৯২৭ সালের শেষ ভাগে নভেম্বর মাসে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ের (খনকার সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়ে) খড়গপুর কারখানায় মজুরদের ধর্মঘট হয়েছিল। মুকুন্দলাল সরকার অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স ফেডারেশনের নাম দিয়ে একটি কাগুজে সংগঠন খাড়া করেছিলেন। পরে তা সত্যকার শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়। খড়গপুর রেলওয়ে কারখানার মজুরদের ধর্মঘটে মুকুন্দলাল সরকার কি করে নেতৃত্বে বরিত হলেন তা আমার ভালো মনে নেই। খুব সম্ভবত অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স ফেডারেশনের নেতা হিসাবে তিনি খড়গপুর ধর্মঘটেরও নেতা হয়েছিলেন। কোন্ সময়ে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার সহিত তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয়েছিল তা জানিনে, কিন্তু তিনি খড়গপুরে চেট্টিয়ারকে ডেকে এনে নিজের সঙ্গে রেখেছিলেন। সেখানে তেলুগুভাষী মজুরদের বড় প্রাধান্য। তামিলভাষী চেট্টিয়ার তেলেগু বুঝতেন বটে, কিন্তু তাতে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। প্রতিদিন তিনি ইংরেজি ভাষায় দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন। অন্য কেউ তেলুগুতে তর্জমা করে তাঁর বক্তৃতা মজুরদের বুঝিয়ে দিতেন।

১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে আমরা ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টির আফিস ৩৭, হ্যারিসন রোড (মহাত্মা গান্ধী রোড) হতে তুলে এনে সবে ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে (আবদুল হালীম লেনে) ঘর গোছানোর চেষ্টা শুরু করেছি, মুকুন্দলাল সরকারের নিকট হতে আমার নামে টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম আসাতে লাগল যে “খড়গপুরে আসুন।” সব কাজ ফেলে রেখে আবদুল হালীমকে সঙ্গে নিয়ে আমি খড়গপুরে গেলাম। আমাদের সঙ্গে ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্তও গেলেন। তিনি অবশ্য ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির সভ্য ছিলেন না। ওখানে পৌঁছে দেখলাম যে বোম্বে হতে এস এ ডাঙ্গে আর শান্তারাম মিরাজকরও পৌঁছে গেছে। আসলে অল ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স ফেডারেশনের কনফারেন্স হচ্ছিল। ডাঙ্গে, মিরাজকর, হালীম ও আমি,-আমাদের কেউ কোনও রেলওয়ে ইউনিয়নের সঙ্গে সংসৃষ্ট ছিলেম না। তবুও প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি ডাঙ্গেকে বলতে দিলেন। হালীম আর আমি কলকাতা চলে এসেছিলেম। ডাঙ্গেরা একদিন বেশী ছিল। নির্বাচনে মুকুন্দলাল সরকারের হাতে কোনো ক্ষমতা আর থাকল না, তাঁর নিকট হতে কাগজপত্র ও টাইপ রাইটার ইত্যাদি কেড়ে নেওয়া হলো। ধর্মঘটও তুলে নেওয়া হলো। কিন্তু মুকুন্দলালও প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। সেকালে আমাদের দেশের পিছিয়ে পড়া মজুরেরা দীর্ঘদিন ধর্মঘট করে থাকলে বিদেশের মজুরেরা সাহায্য পাঠাতেন। খড়গপুরের মজুরদের নামেও ধর্মঘট তুলে নেওয়ার পূর্বক্ষণে অনেক হাজার টাকা সোবিয়েৎ ইউনিয়নের মজুরেরা পাঠিয়েছিলেন। ঠিক অঙ্কটা আমার মনে নেই, তবে খুব মোটা টাকা। মুকুন্দলাল সরকার কর্তৃপক্ষকে লিখে জানালেন যে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকার আর প্রয়োজন নেই। অতএব, টাকা ফেরৎ চলে গেলে। তার পরে নানা মহলে এই টাকার জন্যে যে বুক চাপড়ানো দেখেছিলেম তা সত্যই উপভোগ করার মত ছিল।

খড়গপুরেই আমি প্রথম জটাজুটওয়ালা কিরণচন্দ্র মিত্রকে দেখেছিলেম। তিনি তখন আর কিরণচন্দ্র মিত্র ছিলেন না, হয়ে গিয়েছিলেন জটাধারীবাবা। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের তিনি তখন ছিলেন সেক্রেটারী।

লিলুয়ার ধর্মঘট

লিলুয়া হাওড়া শহরের একটি বড় শহরতলী। ওখানে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের একটি স্টেশন আছে, আর কাছে ওই রেলওয়েরই একটি খুব বড় কারখানা। ১৯২৮ সালে এই কারখানায় কত লোক কাজ করতেন তা ঠিক মনে নেই, হয়তো পনের হাজার মজুর তাতে কাজ করতেন। কিরণচন্দ্র মিত্র ওর্ফে জটাধারী বাবার এক জবানবন্দীতে আমরা পাচ্ছি যে প্রতি মাসে এগারো-বারো হাজার মজুর ইউনিয়নের চাঁদা দিতেন।

এখানে কিরণচন্দ্র মিত্রের কিঞ্চিৎ পরিচয় দেব। তিনি যশোহর জিলার লোক, চাকরী করতেন অবধ (Oudh) রোহিলখণ্ড রেলওয়েতে (O.R.R) স্টেশন মাস্টার ছিলেন। তাঁর নিজের কথায় (মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মোকদ্দমায় আদালতে সাফাই সাক্ষীর জবানবন্দী) ১৯২০ সালে তিনি চাকরী হতে বরখাস্ত হন। কারণ তিনি নন্ কোঅপারেশন (অসহযোগী) আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সত্যের দিক হতে অসহযোগ আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল পরের বছর। তবে, ১৯২০ সালেও বড় বড় আন্দোলন হয়েছিল। তার কোনোটিতে কিরণ মিত্র যোগ দিয়ে থাকবেন। তাঁর চাকরী চলে যাওয়ার পরেও তিনি রেলওয়ে মজুরদের সংগঠন ছাড়েননি। ১৯২৫ সালে ও আর রেলওয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। তারপরে তাঁর রেলওয়ে মজুর সংগঠনের নাম হয়ে গেল ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স এসোসিয়েশন। ১৯২৬ সালে এই এসোসিয়েশন লখনউ হতে দানাপুরে উঠে গেল। সে বছর ট্রেড ইউনিয়ন এক্ট অনুসারে ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রী করা হলো এবং তার নাম হলো ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স ইউনিয়ন। ‘এসোসিয়েশন’ নাম আর থাকল না। ১৯২০ সাল হতে ১৯২৬ সালের ভিতরে কখন তা ঠিক বলতে পারব না, মিত্ৰ মশায় ভেক গ্রহণ করলেন, অর্থাৎ মাথার চুল লম্বা ক’রে তাকে জটাতে পরিণত করলেন। সরলমনা মজুরেরা তাঁকে ‘জটাধারী বাবা’ ডাকতে লাগলেন। কিন্তু এতে দানাপুর ও খাগাউলে (সরকারী রেকর্ডে খাগাউল ছিল রেজিস্টার্ড হেড অফিস) ইউনিয়নের তেমন কোনো বাড়-বাড়ন্ত হলো না। কিন্তু এই রেলওয়ের সব চেয়ে বড় লিলুয়া কারখানায় মজুরদের নালিশের অন্ত ছিল না। তাঁরা কিরণচন্দ্র মিত্রকে ডেকে পাঠালেন এবং তিনি এলেনও। এসেই তিনি ইউনিয়নে একটি শাখা গঠন করে ফেললেন। সাফাই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে প্রতি মাসে এগারো-বারো হাজার মজুর ইউনিয়নের চাঁদা দিতেন।

১৯২৮ সালের ৮ই মার্চ তারিখে লিলুয়া কারখানার মজুরেরা ধর্মঘট করলেন। এই ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছিল ওই বছরেরই ৯ই জুলাই তারিখে। সরকারী কাগজপত্রে তাই পাওয়া যায়। কিন্তু কিরণ মিত্র বলেছেন ১০ই জুলাই তারিখে তিনি ধর্মঘটের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন।

ভি ভি গিরির নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে ইউনিয়ন যতটা শক্তিশালী ও প্রসারিত ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে মেন্‌স ইউনিয়ন তেমন কিছু ছিল না। কিরণ মিত্রের কি রাজনীতি ছিল তা ভালো ক’রে বোঝা যেত না, যদি কিছু রাজনীতি তাঁর থেকে থাকে তা ছিল কংগ্রেসের রাজনীতি। বড় বড় কংগ্রেস নেতাদের ডেকে এনে তিনি মজুরদের দেখাতেন। তিনি ছিলেন অতি বেশী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রিয়। তাঁর মনে সর্বদা নেতৃত্ব হারানোর ভয় থাকত। তা সত্ত্বেও ধর্মঘট হওয়ার পরে তিনি অনেককে ডাকলেন এবং ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টির আমাদেরও ডাকলেন। সকলে এলেনও, কিন্তু তিনি চাইলেন যে তিনিই ধর্মঘটের সর্বময় কর্তা হবেন, অন্যরা পরিশ্রম ক’রে ধর্মঘটকে সফল করে দিবেন। কোনো স্ট্রাইক কমিটি গঠন করতে তিনি একেবারেই রাজী নন। তবুও তাঁর অনুরোধে আমরা ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির তরফ হতে গোপেন্দ্ৰকৃষ্ণ চক্রবর্তীকে স্থায়িভাবে লিলুয়ার ধর্মঘটে কাজ করতে পাঠালেম। পার্টির অন্যরাও যাতায়াত করতেন। গোপেন রাতদিন ওখানেই থাকলে লাগলেন। মিত্র মশায় যা-ই করুন আমরা একটা মজুরের লড়াইকে ছেড়ে দিই কি করে?

শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিলুয়ার ধর্মঘটে কাজ করতে গিয়েছিলেন। তা করতে গিয়ে তাঁর কিন্তু উপকার হয়েছিল। তিনি আফগানিস্তানের শিক্ষা বিভাগে চাকরী করতে গিয়েছিলেন। ইংরেজের চাপে কাবুলে অবস্থিত ভারতীয় বিপ্লবীদের যখন সে দেশ হতে বা’র হয়ে যেতে বলা হলো তখন তিনি মাওলানা ওবায়দুল্লার সঙ্গে মস্কো চলে গেলন। তাঁর ওপরে অবশ্য আফগানিস্তান হতে চলে যাওয়ার কোনো অর্ডার ছিল না। তাই মস্কো যাওয়ার প্রয়োজনও তাঁর ছিল না। তবুও তিনি শুধু যে মস্কো গেলেন তা নয় সেখানকার প্রাচ্য জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হলেন। কিন্তু কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল শুধু আগে হতে যাঁরা কমিউনিস্ট হয়েছেন তাঁদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। এক বছরের একটি কোর্স শেষ করার পরে তিনি বললেন যে কমিউনিজমে তাঁর বিশ্বাস হলো না। তার পরে জার্মানী হয়ে তিনি ইংলন্ডে গেলেন। তাঁর নিকটে আগান কর্মচারী হিসাবে ভ্রমণের দলিল ছিল। তাঁর সন্দেহ ছিল যে (হয়তো ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট তাঁকে এই কথা বলেও থাকতে পারেন) এই দলীল দেখিয়ে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন না। তাছাড়া, তাঁর কাছে রাহাখরচের টাকাও ছিল না। তিনি একজন ব্রিটিশ প্রজা, লন্ডনে এসে আটকা (Stranded) পড়ে গেছেন, এই বলে ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের নিকট হতেই ভ্রমণের দলীল ও রাহা খরচের টাকা তিনি চাইলেন। প্রথমে ব্রিটিশ গবর্নমেন্ট কিছুই দিতে চাননি। পরে রাহাখরচের ব্যবস্থা ক’রে আফগান দলীলেই তাঁকে আসতে দিলেন। কিন্তু, কলকাতায় এসে কোনো কাগজে তিনি মস্কো বা রাশিয়ার অভিজ্ঞতা লিখতে আরম্ভ করলেন। লোকেরা ভাবলেন লোকটি রাশিয়া হতে ফিরে এলেন, তাঁর অভিজ্ঞতা কাগজে লিখছেন, অথচ পুলিস তাঁকে ধরল না, এটা কেমন কথা? লোকটি নিশ্চয় সরকারের গুপ্তচর হবেন। এটা বোধ হয় ১৯২৫ সালের কথা। প্রথম সাজার পরে আমি তখনও কলকাতা ফিরে আসিনি। সর্বত্র রটে গেল যে শিবনাথ ব্যানার্জি গুপ্তচর। কাগজওয়ালারাও তাঁর লেখা ছাপানো বন্ধ করে দিলেন। সেকালে রাশিয়া সম্বন্ধে লোকেদের মনে দারুণ ভীতি ছিল। তাঁরা ভাবতেন রাশিয়া হতে ফিরে যিনি আসবেন পুলিস তাঁকে ধরবেই। আমাদের দলের লোকদের ওই রকম ধরা হতো। কিন্তু শিবনাথ ব্যানার্জি তো আর আমাদের দলের লোক ছিলেন না।

মস্কোতে প্রাচ্য জনগণের কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়ার পরে তিনি বলে দিলেন যে কমিউনিজমে তাঁর বিশ্বাস জন্মায়নি। আমাদের সাধারণ মানুষেরা সে কথা কেউ হয় তো শুনেছেন, কেউ হয় তো তা শোনেনও নি। আর, পুলিসের লোকেরা ভাবল শিবনাথ ঝুট কথা বলছেন। লিলুয়ার ধর্মঘটে কাজ করতে যাওয়ার ফলে শিবনাথের কংগ্রেসের লোকেদের মধ্যে যাতায়াত বেড়ে গেল। তাঁর আর কিরণ মিত্রের কংগ্রেসের ওপরেই বেশী বিশ্বাস ছিল। তাছাড়া, কংগ্রেসওয়ালারাই তো ছিলেন কাগজগুলির মালিক। কাজেই, গুপ্তচর হওয়ার যে বদনাম শিবনাথের রটেছিল লিলুয়ায় ধর্মঘটে কাজ করতে গিয়ে সেটা ধীরে ধীরে কেটে গেল। মজুরেরা কিছু না পেলেও ভারতের মজুরেরা দীর্ঘদিনের একটি মজুরের লড়াই দেখতে পেলেন।

ধর্মঘটের কয়েকদিন কাটার পরে ধর্মঘটকে কারখানায় আবদ্ধ না রেখে রেলওয়ে লাইনে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব আমরা করলাম, কিন্তু কিরণ মিত্র কিছুতেই তা করতে রাজী হলেন না। কারণ, দূরে দূরে বিস্তৃত হলে তাঁর নেতৃত্ব চলে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত যখন তিনি রাজী হলেন তখন লিলুয়ার মজুরেরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। শুরু হতেই মজুরদের ‘ডোল’ দেওয়া হচ্ছিল। লাইনে ধর্মঘটের বিস্তার যখন করা হলো তখন লিলুয়ার ডোল দেওয়ার সম্ভাবনা কমে এসেছিল। ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টির লোকেরাই লাইনে গেলেন। ফিলিপ স্প্রাট গেলেন, ধরনীকান্ত গোস্বামী গেলেন এবং আরও অনেকে গেলেন। নূতন কর্মীও অনেকে এলেন। অন্ডালে কারখানায় সাড়া পাওয়া গেল, আসানসোলের রেলওয়ে মজুরেরাও সাড়া দিলেন। সীতারামপুরেও মজুরদের ভিতরে মিটিং ও মুলাকাত চলছিল। কিন্তু এসব হলে কি হবে, লিলুয়া কারখানার মজুরদের ভিতরে এসে গিয়েছিল ক্লান্তি, সেখানে দেখা দিয়েছিল অভাব আর অনটন। কিরণ মিত্র কংগ্রেসের বড় লোকদের কাছে ছোটাছুটি তো করছিলেনই, বড় লোক ধরে, যেমন কুমার অরুছচন্দ্র সিংহ, গবর্নরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করলেন, ই আই রেলওয়ের এজেন্টর সঙ্গে দেখা করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। বাধ্য হয়ে কিরণ মিত্র লিলুয়ার ধর্মঘট তুলে নিলেন। আর লিলুয়ার ধর্মঘটই যখন তুলে নেওয়া হলো তখন অন্ডাল-আসানসোলের ধর্মঘটও তুলে নিতে হলো।

এখন কিরণ মিত্রের কথা কিছু বলি। লিলুয়ার ধর্মঘট যখন চলেছিল তখন তাঁর বাবা মারা গেলেন। সেই উপলক্ষে তাঁকে মাথা ও মুখ কামাতে হলো। অতএব তাঁর দাড়ি ও জটা গেল। উকুনের কামড় হতে বেঁচে গেলেন মিত্র মশায়। কিন্তু জটা ও দাড়ি কামানোর ফলে তাঁর একটা অসুবিধাও হয়েছিল। দাড়ি ও জটাহীন কিরণ মিত্রকে হঠাৎ দেখে মজুরেরা চিনতে পারছিলেন না। মজুরদের ভিতরে চলার সময়ে একজন মজুর তাই ঘোষণা করতে থাকতেন যে “ইনি জটাধারী বাবাই। তাঁর পিতার মৃত্যু হওয়ায় তাঁকে দাড়ি ও জটা কামাতে হয়েছে।”

“লিলুয়া ধর্মঘটের কথাই যখন আমি এখানে বলছি তখন তার সঙ্গে জড়িত একটি ঘটনার কথাও আমি এখানে বলব। এই পুস্তকের প্রথম খণ্ডে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর কথা” শীর্ষক উপশিরোনামের ভিতরে আমি এই ঘটনাটার কথা একবার বলেছি। এখানে লিলুয়া ধর্মঘটের কথার সঙ্গে সেই ঘটনার উল্লেখ সংক্ষেপে হলেও করা দরকার। লিলুয়ার ধর্মঘট চলার সময়ে একদিন শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার কাছে এসে বললেন “স্ট্রাইকের সাহায্যের জন্যে ফিলিপ স্প্রাট ও আপনার নামে রেড্‌ ট্রেড্‌ ইউনিয়ন ইন্টারন্যাশনালের নিকটে মস্কোতে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে চাই।” আমি বললাম, “মিত্র মশায় (কিরণচন্দ্র মিত্র ওর্কে জটাধারী বাবা) নিজে যা খুশী করেছেন, একটি স্ট্রাইক কমিটি পর্যন্ত গঠন করলেন না, আমি এর সঙ্গে আমার নাম জড়াত্ েচাইনে।” তা সত্ত্বেও আমাদের না জানিয়ে তাঁরা নিম্নলিখিত টেলিগ্রাম পাঠালেন:

SECRETARY, POFINTERNS, MOSCOW

30,000 STRIKERS ARE OUT FOR 51 DAYS, RELIFE URGENTLY NEEDED. PLEASE SEND THROUGH BANK TO MITRA, SECRETARY, E.I. RAILEAY UNION, LILLOOAH, BENGAL

MITRA, SPARATT, MUZAFFAR
(THE STATESMAN, TUESDAY, MAY 1, 1928)

সেক্রেটারি, প্রফিটার্নস, ট্রেড ইউনিয়নসমূহের আন্তর্জাতিক), মস্কো

৩০ হাজার মজুর ৫১ দিন ধ’রে ধর্মঘট করে আছেন। সাহায্য অত্যাবশ্যক। মিত্র, সেক্রেটারি, ই আই রেলওয়ে ইউনিয়ন, লিলুয়া, বেঙ্গল, ঠিকানায় দয়া ক’রে ব্যাঙ্কের মারফতে সাহায্য পাঠান।

মিত্র, স্প্রাট, মুজফফর
(দি স্টেট্সম্যান, মঙ্গলবার, ১লা মে ১৯২৮)

পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগের (ইনটেলিজেন্স বিভাগের) লোকের হাওড়া ডে পোস্ট অফিসে এসে এই টেলিগ্রাম পাঠানো বন্ধ করে দিল।

পোস্ট আফিস হতে লিলুয়ার ইউনিয়ন আফিসে খবর পাঠানো হলো যে আপত্তিজনক হওয়ায় টেলিগ্রামটি পাঠানো হলো না। শ্রী কিরণ মিত্র মীরাটের আদালতে শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিশোরীলাল ঘোষের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন টেলিগ্রামটি ইউনিয়ন আফিসে ফেরৎ পাঠানো হয়েছিল। এটা ঠিক কথা নয়। এই জাতীয় টেলিগ্রামও ফাইলে রাখাই নিয়ম। তাই রাখা হয়েছিল।

মুখে মুখে কথাটা হাওড়া ও কলকাতায় রটে গেল। স্টেট্সম্যান পত্রিকায় তরুণ ইংরেজ রিপোর্টার মিস্টার প্লুটন হাওড়া হেড্‌ পোস্ট আফিসে গিয়ে আটকানো টেলিগ্রামটির অবিকল নকল করে নিলেন। তিনি ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে (এখনকার আবদুল হালীম লেন) এসে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন (স্প্রাট বোধ হয় সেদিন ছিলেন না) যে স্প্রাট ও আমি সেই টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম কিনা। টেলিগ্রামটি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কিন্তু কোনো উপায় ছিল না, হাজার হাজার জুর ধর্মঘট করে আছেন, টাকার দরকার। আমি তৎক্ষণাৎ মিস্টার প্লটনকে নীরবে চলে গেলেন। পরের দিন ভোরের স্টেট্সম্যানে’ দেখলাম পুরো টেলিগ্রামটি ছাপা হয়ে গেছে। ইংরেজের কাগজ ছিল স্টেটসম্যানে’ দেখলাম পুরো টেলিগ্রামটি ছাপা হয়ে গেছে। ইংরেজের কাগজ ছিল স্টেট্সম্যান। মালিকেরা কারুর তোয়াক্কা করতেন না। রয়টারের নিউজ এজেন্সিই বা কাকে পরোয়া করতেন। তাঁরা এই টেলিগ্রামটিকে বিদেশে নিউজ করে দিলেন। আসল কাজটি হয়ে গেল। খবরটা মস্কোতে পৌঁছে গেল। টাকাও এসে গেল লয়ড্স ব্যাঙ্কের মারফতে। ভারত সরকারের রিপোর্ট অনুসারে বিশ হাজার টাকা। হাওড়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার গুরুসদয় দত্ত আই সি এস কিরণ মিত্রকে শনাৎ করে দিলেন। তিনি টাকাটা সহজে পেয়ে গেলেন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে কিরণ মিত্ররা আমাকে কিংবা স্প্রাটকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দিলেন না যে মস্কো হতে টাকা এসেছে।

এ খবর এখানে পড়ে কেউ যেন মনে করবেন না যে এ পুস্তকের প্রথম খাণ্ডে মুদ্রিত “গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তীর কথা” শীর্ষক উপশিরোনামের ভিতরে বর্ণিত কথাগুলি খণ্ডিত হয়ে গেল না। না, তা হলো না। এখানকার কথাগুলি অধিকন্তু। জ্ঞানী লোকেরা বলে থাকেন যে অধিকন্তুতে দোষ নেই। স্টেট্সম্যানে মুদ্রিত টেলিগ্রামটিও অতি কষ্টে সংগ্রহ করে এই সঙ্গে ছেপে দিলেম।

লিলুয়ার স্ট্রাইকের শেষ হওয়ার পরে রেলওয়ে মজুরদের ধ’রে কিরণ মিত্র আর পড়ে থাকলেন না। কেউ না কেউ লিলুয়ায় বাতি জ্বালিয়ে রাখছিলেন। দীনেশ রায় লিলুয়া ইউনিয়নে শেষ পর্যন্ত বাতি জ্বালিয়েছেন। ১৯৩৬ সালে আমার বন্দীদশা হতে মুক্তির কিছুকাল পরে একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী বন্ধু আমায় বলেছিলেন যে অবশেষে দীনেশ রায় লিলুয়ার ইউনিয়নটি টেরো- কমিউনিস্টদের নিকটে দু’শ টাকায় বিক্রয় করতে রাজী হয়েছিলেন। তার পরে বাতি বোধ হয় সব সময়ের জন্যে বুজে গিয়েছিল। যাঁরা একই সঙ্গে টেরোরিস্ট ও কমিউনিস্ট ছিলেন তাঁদের কেউ কেউ টেরো-কমিউনিস্ট বলেছেন। সিংহলের ভিক্ষু শরণঙ্কর নাকি বানারসে টেরো-কমিউনিস্ট ছিলেন। অনেক পরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। মনে পড়ে ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রাম হতে কেউ বা কারা সূর্য সেন কমিউনিস্ট পার্টির তরফ হতে ছোট্ট ইতিহার একখানি প্রচার করেছিলেন। আবদুস সত্তার তার উদ্যোক্তা ছিলেন? পরে কিরণচন্দ্র মিত্র অন্য শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা করেছেন। পোর্ট ট্রাস্ট বা ডক্ মজুরদের ভিতরেও ট্রেড ইউনিয়ন করার চেষ্টা তিনি করেছেন। তাঁর পদ্ধতি একই ছিল। প্রথমে তিনি মজুরদের নিকট হতে এক সঙ্গে অনেক টাকা তুলে নিতেন

কেশোরাম কটন মিলে

মাটিয়াবুর্জে, গার্ডেনরীচও বলা হয়, কেশোরাম কটন মিলে হঠাৎ একদিন ধর্মঘট হয়ে গেল। তখন লিলুয়ার ধর্মঘট চলেছে। জটাধারী বাবার খুব নাম। ধর্মঘটের নেতৃত্ব ছিল তাঁতিদের হাতে। তাঁদের বেশীর ভাগই ছিল আবার অযোধ্যা (অবধ) প্রদেশের মুসলমান। কমবেশী উর্দু লেখাপড়া তাঁরা জানতেন। কেশোরামে ধর্মঘট করে এই তাঁতিদেরই একজন লিলুয়ায় জটাধারী বাবাকে খুঁজতে গেলেন। ওখানে তখন আবদুল হালীম আর গোপেন চক্রবর্তীকে সেই তাঁতির সঙ্গে মাটিয়াবুর্জে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁরা ওখানে পৌছে দেখতে পেলেন যে আশলীপুর মহকুমার সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটও সেখানে পৌঁছে গেছেন। এই ধর্মঘটের কারণ ছিল অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তাঁতিদের চেষ্টায় তখনও ধর্মঘট হয়েছিল। মজুরেরা বেশীদিন লড়াই চালাতে পারলেন না। তাঁরা তাই কাজে ফিরে যেতে চাইলেন। তখন মিলের মালিকেরা বললেন, তোমরা সমস্ত মজুরকে উকিয়ে ধর্মঘট করিয়েছ। এখন তোমাদের প্রত্যেকে যদি কোম্পানীর নিকটে এক মাসের মজুরীর টাকা এই করারে জমা না রাখ যে ভবিষ্যতে আর ধর্মঘট করবে না, তবেই আমরা মিল খুলব। সুতাকলে-চটকলে তাঁতিরা কাজ বন্ধ করে দিলে সমস্ত কল বন্ধ হয়ে যায়। যাক, সেই জমা রাখা টাকাটা ফেরৎ দিতে হবে এটাই ছিল এই ধর্মঘটের আসল দাবী। তার সঙ্গে আরও দু’চারটি দাবী জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। কেশোরাম পোদ্দারের ব্যবসায় তখন ফেল পড়েছিল। কোম্পানীর ম্যানেজিং এজেন্সি চলে গিয়েছিল আরেকটি মাড়োয়ারী কোম্পানী,-বিড়লা ব্রাদার্সের হাতে। সেই দিনের মিটিং হতে চলে যাওয়ার আগে সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল হালীমকে ডেকে বলে গেলেন, যেভাবে তাঁতিদের নিকট হতে টাকা জমা নেওয়া হয়েছে তা আইনসম্মত নয়। সেদিন রাত্রে আবদুল হালীম আমাদের সব কথা জানাল। পরের দিন হতে ফিলিপ স্প্রাট আর আমি প্রতিদিন ধর্মঘটের সভায় যেতে লাগলাম। স্প্রাট ইংরেজিতে বক্তৃতা দেন, আমি হিন্দুস্তানীতে তার তর্জমা করি, তার পরে নিজেও দু’চার কথা বলি।

আমরা যেদিন গেলাম সেদিন হতে মণীন্দ্রকুমার সিংহও (মণি সিং) সভায় আসতে লাগলেন। তূলেঢুলে বক্তৃতাও দিতে লাগলেন। এটা তাঁর অভ্যাস ছিল। সে দিনই আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘আপনি যে বড় এখানে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘এখন হতে এ কাজই করব।’ ধরণীকান্ত গোস্বামীর মারফতে তাঁর সঙ্গে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল। অনুশীলন সমিতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল, তবে আমার ধারণা যে তাঁদের কর্মরত সভ্য যিনি ছিলেন না। ময়মনসিংহ জিলার শুশুঙ্গের লোক ছিলেন তিনি। উপাধি সিংহ হলেও জাতে ছিলেন বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। তাঁর সঙ্গে মেলা মেশা ক’রে তাঁর ভিতরে বামনাই কখনও দেখিনি। ক্লাইব স্ট্রীটে আফিসে ক’রে টেলিফোনে নিয়ে তাঁকে বসতে দেখেছি, আবার তাঁকে সাপের ও বাঘের ব্যবসায় করতেও আমরা দেখেছি। সব কিছুতে ফেল করে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করতে এলেন। এখানে বরঞ্চ তিনি কিছু সাফল্য লাভ করলেন। আমরা তাঁকে কেশোরাম কটন মিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সেক্রেটারি করেছিলেম। তিনি সব সময়ে কর্মী হলেন।

কেশোরামের ধর্মঘটের কথা হতে অনেক দূরে সরে এসেছি। কেশোরামের একজন মজুর কিরণ মিত্রকে ডাকার জন্যে লিলুয়া পর্যন্ত ধাওয়া করলেন, পুরনো ফিয়াৎ গাড়ীও একখানি তিনি কিনেছিলেন, তবুও নিজে না গিয়ে আবদুল হালীম আর গোপেন চক্রবর্তীকে মাটিয়াবুর্জে পাঠালেন।-এটা তিনি কেন করলেন? কারণ ছিল। সেই সময়ে বিড়লাদের সঙ্গে তাঁর একটা কথাবার্তা চলেছিল। লিলুয়ার মজুরদের ডোল দেওয়ার জন্যে তাঁদের নিকট হতে দু’হাজার টাকার চাল তিনি চাইছিলেন। তাঁরা প্রায় রাজীও হয়েছিলেন। এই জন্যেই তিনি মাটিয়াবুর্জে গেলেন না। বিড়ালরা বললেন তুমি রেলওয়ে মজুরদের জন্যে আমাদের কাছে চাল চাইছ, আবার আমাদের সুতাকলে ধর্মঘটও চালাচ্ছ, এটা কেমন করে হয়? বিড়ালারা বে-আইনীভাবে মজুরদের নিকট হতে টাকা ডিপজিট রেখেছিলেন, সে টাকা তাঁদের ফেরৎ দিতে হতে একথাও বুঝতেন, তবুও তাঁদের সম্মানে বাধছিল। কিরণ মিত্র এতদিন মাটিয়াবুর্জের কোনো সভায় আসেননি। একদিন মরীয়া হয়ে ধর্মঘট ভাঙার জন্যে ফিয়াৎ গাড়ীতে চড়ে তিনি কেশোরামের সভায় এলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন গোপেন্দ্রকৃষ্ণ চক্রবর্তী। কিরণ মিত্র খুব জোরের সঙ্গে অবধী ভাষায় বক্তৃতা দিলেন। অনেক কাল তিনি সে দেশে থেকে এসেছেন। মোদ্দা কথা তিনি যা বললেন তা হচ্ছে এই। তোমাদের টাকা তোমাদেরই থাকছে। বিড়লাদের নিকটে জমা আছে মাত্র। এর ভিতর দিয়ে বিড়লাদের সঙ্গে তোমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। টাকা যদি ফেরৎ নাও তবে তোমাদের সম্পর্কে কেটে যাবে। কেন ফেরৎ নেবে তোমরা টাকা?” সম্পর্কচ্ছেদ হওয়া মানে মজুরদের কাজ চলে যাওয়া কিনা সেটা তিনি কিছু বললেন না। তিনি ফিলিপ স্প্রাট ও আমাকে বললেন, মিটিং তো হয়ে গেল, আপনারাও চলুন আমার সঙ্গে, এসপ্লানেডে নামিয়ে দিয়ে যাব। অনেক পীড়াপীড়ি তিনি করলেন। স্প্রাট আর আমি কিছুতেই নড়লাম না। আমরা মজুরদের বললাম, দেখুন, জটাধারী বাবা কার্যত আপনাদের ধর্মঘট ভেঙে দেওয়ার কথা বলে গেলেন। আপনারা আপনাদের মজুরী বেচেন, আর বিড়লারা তা কেনেন, সম্পর্কচ্ছেদের কথা আসে কোথা হতে।” মিত্র মশায় ‘নাতা’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন। আমরা বললাম মূল দাবীতে আপনারা জিতবেনই। তারপর ইউনিয়ন তৈয়ার করুন, লড়তে থাকুন। এই হলো মজুরের জীবন। টাকা ডিপোজিট নিয়ে বিড়লারা তো বে-আইনী কাজই করেছেন। মিত্র মশায়ের কথায় ধর্মঘট যখন ভাঙল না তখন পরের দিন কোম্পানী টাকা ফেরৎ দিলেন। মজুরেরা আবার কাজে ফিরে গেলেন। মার্টিয়াবুর্জ-গার্ডেনরীচ ইলাকায় এইভাবেই ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাস পার্টিরও সঙ্গে সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিরও প্রবেশ লাভ ঘটেছিল। ৪৩ বছর আগেকার কথা। যে-সকল মজুরের সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয়েছিল, তাঁরা আর নেই। তখনকার দিনের পার্টি সংগঠকেরাও নেই। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এখন দক্ষিণপন্থী আর বামপন্থীতে দ্বিখণ্ডিত। দু’পক্ষই গার্ডেনরীচ ইলাকায় রয়েছেন। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের, অর্থাৎ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদীর) প্রভাব দ্রুত বাড়ছে, প্রভাব বাড়ছে মাটিয়াবুর্জ গার্ডেনরীচ ইলাকায়ও এবং বাড়ছে কলকাতার দক্ষিণের সমস্ত তল্লাটে।

মেথর ও ঝাড়ুদারদের আন্দোলন

১৯২৮ সালে কলকাতা ও হাওড়ায় মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘট বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যাঁরা মানুষের পায়খানা পরিষ্কার করেন মানুষের সমাজ তাঁদের বড় নাম দিয়েছেন মের। মেহ্ত্তর পারসী ভাষার শব্দ, তার অর্থ সমাজের শিরোমণি। রাজকুমার বা শাহ্জাদকেও মের বলা হয়। হিন্দুকুশ পর্বতের শেষ সীমাস্থিত চিত্রল রাজ্যের অধিপতিকেও বলা হয় মের। যাদের দ্বারা আমরা অতি ঘৃণ্য কাজ করাই তাদের নাম দিয়ে রেখেছি মের। শোষণের এই এক অপরূপ ব্যবস্থা। মের শব্দ ব্যবহারের ভিতর দিয়ে আমাদের নিকটে মেথর হয়ে গেছে। আমরা উর্দুতে এই শব্দ লিখলে মেরই লিখব।

১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্ট্স পার্টি হতে স্থির করা হয় যে আমরা মেথর ও ঝাড়ুদারদের নিয়ে আন্দোলন করব এবং তাদের ইউনিয়নও গড়ব। কাজ শুরু করার আগেই আমরা স্থির করলাম যে ইংরেজিতে এই ইউনিয়নের নাম দেওয়া হবে “দি স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ্‌ বেঙ্গল” (The Scavengers Union of Bengal) স্ক্যাভেঞ্জার্স মানে শহরের রাস্তা ও নর্দমা পরিষ্কার করা। মিউনিসিপালিটিগুলিতে ঝাড়ুদার-মেথর এই দু’রকেমর লোককেই এক ধরা হয়। আমরা আমাদের ইউনিয়নের নিয়মে এ-দুজনকে একই ধরতাম। আসল কাজ শুরু করার আগে আমরা কমিটি গঠন করলাম। তাতে ডক্টর প্রভাবতী দাসগুপ্তাকে করা হলো প্রেসিডেন্ট, আমি হলেম ভাইস- প্রেসিডেন্ট আর ধরণীকান্ত গোস্বামীকে করা হলো সেক্রেটারী। প্রথমে আমরা দেবনাগরী হরফে হিন্দি ভাষায় একখানি ইতিহার ছাপালেম। ডক্টর মিস্ দাসগুপ্তা আমাদের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজাট্স পার্টির সভ্য ছিলেন না। তিনি আমাদের সেঙ্গ ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করতে এসেছিলেন। প্রথম ইতিহারখানি ছাপানোর খরচ পঁয়তাল্লিশ টাকা তিনিই দিয়েছিলেন। ধরণীকান্ত গোস্বামীর অনুরোধে আমরা তাঁকে প্রেসিডেন্ট করেছিলেম। এই ইতিহারখানি ছাপিয়ে রেখে আমরা অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভায় যোগ দিতে কানপুরে গিয়েছিলেম। ১৯২৭ সালের নভেম্বর মাসের কথা। কানপুর হতে ফিরে এসে আমি কাজ শুরু করি। আমার কাজের পদ্ধতি ছিল এইরকম। আমি জানতাম কুষ্টিগতভাবে মেথর ও ঝাড়ুদারেরা সমাজের অতি নিম্ন স্তরের লোক। অক্ষরজ্ঞান তাঁদের ছিল না। তবে কিঞ্চিৎ শ্ৰেণীচেতনা তাঁদের ভিতরেও ছিল। মেহনত যাঁরা বিক্রয় করেন তাঁদের কিঞ্চিৎ শ্রেণীচেতনার উন্মেষ না হয়ে পারে না। আমি ছাপানো ইতিহারগুলি নিয়ে এই মজুরদের বস্তিতে, বেশীরভাগ ঝানুদারদের বস্তিতে যেতাম। আর পুরো ইতিহারখানি তাদের পড়ে শোনাতাম। কিছু কিছু কথা নিজেও বলতাম। তার পরে পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট মিটিং হলো, সবাইকে নিয়ে বড় মিটিংও হলো অক্টারলোনি মনুমেটের, এখনকার শহীদ মিনারের তলায়।

এভাবে কাজ চলছিল। ১৯২৮ সালের ৪ঠা মার্চ তারিখ সকালে আমরা ক’জন ২/১, ইউরোপীয়ান এসাইলাম লেনে আমাদের অফিসে বসে আছি এমন সময়ে ২/৩ জন ঝাড়ুদার এলো, বলল আমরা ধর্মঘট করে দিয়েছি। আমরা বললাম, কোনো দাবী পেশ করা হলো না, নোটিস দেওয়া হলো না, একেবারে ধর্ম করে খবর দিতে এলে? উপায় ছিল না। আমরা সঙ্গে সাঙ্গে চারদিকে ছুটলাম, সবাইকে খবর দিতে হবে এবং যে-সব জায়গায় ধর্মঘট তখনও হয়নি সেই সব জায়গায় ধর্মঘট করাতে হবে। বলা বাহুল্য, কলকাতা কর্পোরেশনের ইলাকায় পরিপূর্ণ ধর্মঘট হয়েছিল।

কিশোরীলাল ঘোষ ও মৃণালকান্তি বসু বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের (পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নাম হয়) কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরাই টেলিফোনে কথাবার্তা ব’লে মেয়র মিস্টার জে এমন সেনগুপ্তের বাড়ীতে ৯ই মার্চ, সকালবেলা আমাদের বৈঠক স্থির করলেন। স্ট্রাইকের দু’দিন কেটে যেতেই সমস্ত কলকাতাবাসী বুঝতে পেরেছিলেন যে কলকাতায় একটা খারাব কিছু ঘটছে। মিস্টার সেনগুপ্ত আমাদের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ছিলেন। স্ট্রাইকের ৬ষ্ঠ দিবসে আমরা বৈঠকে মিলিত হলাম। কলকাতার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। যে-সব ইলাকায় খাটা পায়খানা রয়েছে সে-সব জায়গায় দুঃসহ দুর্গন্ধে মানুষের বাস করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কংগ্রেসীরা মিস্টার সেনগুপ্তকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি গাড়ীতে বা’র হ’য়ে প্রতি ইলাকায় মজুরদের কাজে ফিরে যেতে বললেই তারা সঙ্গে সঙ্গেই কাজে ফিরে যাবে। সেনগুপ্ত সে চেষ্টা ক’রে দেখেছিলেন, কিন্তু কোনো মজুরই কাজে ফিরে গেল না। সেজন্যই তিনি আমাদের বৈঠকে আগ্রহী হয়েছিলেন। টিক হলো কলকাতা কর্পোরেশন মেথর ও ঝাড়ুদারদের প্রত্যেককে মাসে দু’টাকা হিসাবে বেতন বাড়িয়ে দিবেন। ধর্মঘট করার জন্যে কারুর চাকরী যাবে না। এই শর্তগুলি কাগজে লেখা হলো, এবং কর্পোরেশনের তরফ হতে মেয়র সই দিলেন আর আমাদের তরফ হতে মিস দাসগুপ্তা, ধরণীকান্ত গোস্বামী ও আমি এই তিনজনই সই দিয়েছিলেম, না, আমাদের একজনই শুধু সই করেছিলেন তা আমার এখন ভালো মনে নেই। তবে, একটা আইনের ফাঁকি থেকে গেল। তখনকার আইন অনুসারে মেয়র ছিলেন কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের মাথা, আর চীফ একজেকিউটিব অফিসার ছিলেন কর্পোরেশনের প্রশাসনের কর্তা। কর্পোরেশনকে চুক্তি ভঙ্গ করার জন্যে দায়ী করতে হলে চুক্তিতে চীফ্ একজেকিউটিব অফিসারের সই থাকা উচিত ছিল। আমাদের সঙ্গে কিশোরীলাল ঘোষ, মৃণালকান্তি বসু ছিলেন। তাঁরা উকীল, এম এ, এল এল বি। আইনের ব্যাপারগুলির ওপরে তাঁরাই নজর রাখবেন আমরা ভেবেছিলেম কিন্তু তাঁরা এদিকে নজর দেননি। আমরা ভেবেছিলেম মেয়র যখন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন তখন কাউন্সিলারদের সভায় এটা পাস হয়েই যাবে। কিন্তু কাউন্সিলারদের সভায় (১৩ই মার্চ, ১৯২৮) কংগ্রেসের কাউন্সিলাররাই ভোট দিলেন না, অন্য কাউন্সিলাররাও অনেকে ভোট দিলেন না। স্ট্রাইক করার জন্যে মজুরদের বেতন কাটা হলো না, কারুর চাকরীও গেল না। কিন্তু কাউন্সিলারদের সভা মাসিক দু’টাকা মজুরী বৃদ্ধি নাচক করে দিল। এ ব্যাপারে চুক্ত ভঙ্গের জন্যে কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা করার কথা ভাবাই যেত না। কিন্তু চীফ্ একজেকিউটিব অফিসারের সই থাকলে সে-কথা হয় তো ভাবা যেত। কি ভাবে কি হয়েছে আমরা ধৈর্যের সঙ্গে মজুরদের বোঝাতে লাগালাম। সুযোগ বুঝে মজুরদের আবারও ধর্মঘট করতে হবে। সেকাথাও বোঝাতে থাকলাম। ১৩ই মার্চ (১৯২৮) তারিখে কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের যে সভা হয়েছিল সেই সভায় “স্ক্যাভেঞ্জার্স কনফারেন্স” নাম দিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। কে যে তার নাম ‘কন্ফারেন্স’ হয়েছিল তা জানিনে। যতটা মনে হয় কাউন্সিলার ছাড়া অন্যদের নিয়ে কমিটি গঠন করার নিয়ম কর্পোরেশনের।

কলকাতায় মেথর-ঝাড়ুদারদের দ্বিতীয় ধর্মঘট

আমরা মজুরদের দাবী সংবলিত এক মাসের নোটিক কর্পোরেশনের নামে পাঠালাম। এটা ছিল কর্পোরেশনের আইন। এই নোটিস পাঠানো হয়েছিল ১৩.০৪.১৯২৮ তারিখে। তাতে আমরা বলে দিয়েছিলেম যে এক মাসের ভিতরে দাবী পূর্ণ না হলে মজুরেরা আবার ধর্মঘট করবেন। আমাদের প্রথম ধর্মঘটের পরে কর্পোরেশনের অ-কংগ্রেসী কাউন্সিলাররা একটি দল গঠন করেছিলেন। তার নাম দেওয়া হয়েছিল কোয়ালিশন দল। প্রতি বৎসর মেয়র নূতন নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সনে মেয়রের নির্বাচনের তারিখ ছিল ২রা এপ্রিল। এবারে কংগ্রেসের তরফ হতে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের পরিবর্তে প্রার্থী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রেস সংখ্যাল্প দলে পরিণত হওয়ায় সুভাষ বসু হেরে গেলেন এবং কংগ্রেস নেতা নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের ফার্মের, অর্থাৎ গণেশচন্দ্র চন্দ্র এন্ড কোম্পানীর মালিকদের একজন। নির্মলচন্দ্র ছিলেন গণেশচন্দ্রের পৌত্র আর বিজয়কুমার বসু ছিলেন তাঁর দৌহিত্র। কলকাতার কায়স্থ গোষ্ঠীতে মামাত-পিসতুত ভাইয়ের ব্যাপার আর কি।

১৯২৮ সালের ২৪ শে জুন তারিখে কলকাতার মেথর আর ঝাড়ুদারেরা দ্বিতীয়বার ধর্মঘট করলেন। আগেই বলেছি, কর্পোরেশন মেথর-ঝাড়ুদারদের নোটিসের প্রাপ্তিও স্বীকার করেননি। কিন্তু তাঁরা চুপ করে বসেও থাকেননি। তাঁরা স্থির করেছিলেন যে তাঁরা শুরু হতেই প্রতিরোধ করবেন ধরপাকড় চালাবেন এবং দরকার হলে আরও নানান রকম অত্যাচার করবেন।

স্ট্রাইক আরম্ভ হয়েছিল ২৪শে জুন তারিখে। ২৫ শে জুন তারিখে প্রভাবতী দাসগুপ্তা ও আমি হাজরা পার্কে মেথর-ঝাড়ুদারদের একটা মিটিং শেষ করে সবে হাজরা রোড পার হয়ে তার দক্ষিণ ফুটপাথে গিয়েছি (মিস দাসগুপ্তা তাঁর ঘণ্টা হিসাবে ভাড়া করা ট্যাক্টিটি খুঁজছিলেন আর তখন খুব জোরে বৃষ্টি আসায় ঝুল বারান্দার তলায় আমাদের দাঁড়াতেও হয়েছিল) এমন সময় কর্পোরেশনের স্থানীয় গাওখানার এংলো ইন্ডিয়ান কর্মচারীটি এসে ওখানে দাঁড়ানো হেড কনস্টেবলটিকে বলল এঁদের দু’জনকে গিরেফতার কর। তখনই হেড কনস্টেবল ও অপর একটি কনস্টেবল “গিরেফতার করলাম” বলেই আমাদের দু’জনের হাত চেপে ধরল। নিকটেই কলকাতা পুলিসের টালিগঞ্জ থানা। আমাদের সেখানেই নিয়ে যাওয়া হলো। থানায় দেখলাম একজন এসিস্টান্ট কমিশনারও বসে আছেন। তিনি হেড় কনস্টেবলকে জিজ্ঞাসা করলেন “এদের কেন গিরেফতার করেছ?” “হুজুর, একজন সাহেব গিরেফ্ফার করতে বললেন” জওয়াব দিল হেড্‌ কনস্টেবল। এসিস্টানট কমিশনার বললেন, কোথাকার কোন্ সাহেব এসে যাঁকে-তাঁকে গিরেফ্ফার করতে বললে তুমি তাই করবে নাকি?” কনস্টেবল মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

এসিস্টান্ট কমিশনার বললেন, “এ সম্বন্ধে পরে অনুসন্ধান করা যাবে। এখন আপনারা ব্যক্তিগত বন্ড (Personal recognizance bond) সই করে জামিনে চলে যান।” আমি তো মনে মনে খুব খুশী। কিন্তু নারীর সম্মানে ঘা লেগেছিল। তিনি অভিমান ভরে বললেন, কেন আমাদের অকারণে ধরা হলো? যাব না আমি জামিনে!” এসিস্টান্ট কমিশনার বললেন, দেখুন সকাল বেলা আমি ইউনিফর্ম পরেছি, এখন রাত্রি। বৃদ্ধ হয়েছি। বাসায় গিয়ে এসব আমায় ছাড়তে হবে। এই বলেই তিনি বাসায় চলে গেলেন। যাওয়ার সময়ে অফিসার ইন্‌চার্জকে বলে গেলেন, “এঁরা personal recognizance bond সই করে জামিনে যেতে চাইলে এঁদের ছেড়ে দিবেন”। এর পরে যে মুহূর্তে আমি প্রভাবতীর সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলবার সুযোগ পেলাম তখনই বললাম, “একি করলেন আপনি? স্ট্রাইক যে ভেঙে যাবে।” এবার তাঁর চৈতন্য হলো, তিনি অফিসার ইনচার্জকে বললেন, দেখুন, আমরা জামিনে যাব।” আমার মনে হয় ও সি কে অন্য নির্দেশ অন্য জায়গা থেকে দেওয়া ছিল। তিনি নিজে আমাদের জামিনে ছেড়ে না দিয়ে এসিস্টান্ট কমিশনারকে তাঁর বাসায় ফোন করলেন। এতক্ষণে তিনিও হয় তো অন্য রকম উপদেশ পেয়ে থাকবেন। পুলিস আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গেল। হরিশ মুখার্জি রোড কিংবা তারই মতো একটি রাস্তায় তাঁর বাসা ছিল। আমরা ওখানে পৌঁছাতেই তিনি আমাদের বললেন,- দেখুন, তখন তো আমার কথা শুনে আপনারা গেলেন না, এখন আপনাদের জামিনে দাঁড়াবার লোক আনতে হবে।” প্রভাবতী দাসগুপ্তা তখনই ডক্টর সুবোধ মিত্রকে খবর দিলেন। তিনি প্রায় ছুটতে ছুটতে এলেন। নিকটেই চিত্তরঞ্জন সেবা সদনে সম্ভবত তিনি ছিলেন। এসেই তিনি বললেন, “কি ব্যাপার? কি করতে হবে আমায়!” ডক্টর মিত্রের সঙ্গে জার্মানীতে ডক্টর দাসগুপ্তার ঘনিষ্ট পরিচয় ছিল। খুব সম্ভব ওঁদের দু’জনাই যশোহর জিলার লোক। ডক্টর দাসগুপ্তা ডক্টর মিত্রকে বললেন, “তুই আমাদের জামিন দাঁড়াবি।” সই করার জন্যে কাগজপত্র সবে বের করা হয়েছে এমন সময়ে টেলিফোনের ঘণ্টা বেজে উঠল। ফোন করছেন সাউথ ক্যালকাটা ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার মিস্টার এস এন ব্যানার্জি। এসিস্টান্ট কমিশনারকে তিনি জানালেন যে আমাদের জামিন তিনি দিবেন। আবার টালিগঞ্জ থানায় ফিরে গেলাম আমরা। সেখান থেকে রাত্রিবাসের জন্যে আমায় পাঠানো হলো আশলীপুরের পুলিস লআপে। মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা শুধু লালবাজারেই ছিল। গভীর রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে আমায় জানানো হলো যে আমার জামিন হয়ে গেছে। আমায় তখন নিয়ে যাওয়া হলো আবার টালিগঞ্জ থানায়। গিয়ে দেখলাম প্রভাবতীও এসে গেছেন, আর সেখানে উপস্থিত রয়েছে তাঁর অগ্রজ, বিখ্যাত কেমিস্ট ও ক্যালকাটা কেমিক্যারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীখগেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত ও তাঁদের পরিবারের বন্ধু মিস্টার আই বি সেন, ব্যরিস্টার। তাঁরাই সাউথের ডেপুটি কমিশনারের বাড়ীতে গিয়ে আমাদের জামিন করিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য এই যে কে সেখানে জামিন দাঁড়িয়েছিলেন সে খবর তখন নিইনি। টালিগঞ্জ থানায় তখন কলকাতার বটতলা থানার দারোগাকেও (সত্যই, দারোগা, অর্থাৎ ইনস্পেক্টর নন) দেখলাম। তিনি বললেন, তাঁর ইলাকায় আমাদের বিরুদ্ধে ছয়টি মোকদ্দমা রয়েছে। অতএব, তিনি আমাদের গিরেফ্ফার করছেন। চললাম আমরা তাঁর সঙ্গে বটতলা থানায়। মিস্টার সেন ও মিস্টার দাসগুপ্তও আমাদের সঙ্গে গেলেন। বটতলার দারোগা লোহার সিন্দুক খুলে একখানা পত্র বা’র করে সে খুব মনোযোগ সহকারে পড়লেন। তাতে বোধহয় নির্দেশ ছিল যে সে-রাত্রি আমাদের আটক করে রাখতেই হবে। মিস্টার সেন ও মিস্টার দাসগুপ্ত আমাদের জামিনে দাঁড়াতে চাইলেন, কিন্তু দারোগাটি তাতে রাজী হলেন না। তিনি বললেন, “আমি আপনাদের চিনি না, আপনাদের কি আছে, না আছে, আমি জানিনে। আপনাদের জামিনে আমি আসামীদের ছেড়ে দিতে পারব না।” মিস্টার সেন ও মিস্টার দাসগুপ্ত নিজেদের পরিচয় ইত্যাদি সবই দিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। কর্তৃপক্ষের আশা ছিল, সারা রাত্রি আমাদের আটকে রাখলে এবং মেথর ও ঝাড়ু দারগণকে পুলিশ ভয় দেখিয়ে সম্ভ্রস্ত করে তুললে ভোরবেলা তাঁরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হবেন।

সে রাত্রি আমায় বটতলা থানা হতে জোড়াবাগান পুলিস কোর্টের লআপে ও প্রভাবতীকে আবার লালবাজার লআপে পাঠানো হলো। সকাল বেলা হতেই আমাকে ও অন্য বন্দীদের দোতলার লআপ হতে নীচের তলায় এডিশনাল চী প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে নিয়ে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুতি শুরু হলো। আমার হাতে হাতকড়াতো পরানো হলোই, তা ছাড়া অন্য বন্দীদের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আমার কোমরেও দড়ি বাঁধা হলো। আদালতের দিকে পা বাড়াব ঠিক এমন সময়ে বটতলা থানার দারোগাটি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হলেন। আমার কোমরে দড়ি বাঁধা হয়েছে দেখে তিনি কনস্টেবলদের গালি দিতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমার দড়ি খুলে দেওয়া হলো এবং থীতকড়িও। দারোগা নিজেই আমায় সঙ্গে ক’রে কোর্টে নিয়ে গেলেন। তখন প্রভাবতীও এসে গেছেন। সকালের কাগজে অনেক কিছু ছাপা হয়ে থাকবে। দেখলাম অনেক লোক কোর্টে উপস্থিত হয়েছেন। শুনলাম স্ট্রাইক খুব জোরদার হয়ে উঠেছে। কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। ভোরের বেলা কোনো মজুরই কাজে যোগ দেননি আমাদের কমরেডরা যিনি যেখানে ছিলেন সকলেই সারা রাত্রি মজুরদের বিভিন্ন বস্তিতে ছোটাছুটি করেছেন। এমন কি ফিলিপ স্প্রাট যিনি অন্য একটি স্ট্রাইকের কাজে ব্যাপৃত ছিলেন তিনিও এসে মেথর-ঝাড়ুদারদের বস্তিগুলিতে ঘুরেছেন।

এডিশনাল চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল লতীফ (এক সময়ে হোম ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন) আমাকে ও প্রভাবতীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তিনি বললেন, এঁরা তো নিজেদের ব্যক্তিগত জামিনে চলে যাওয়ার মতো নাগরিক, কিন্তু কাগজে লিখলেন প্রত্যেককে এক হাজার টাকার জামিনে ছেড়ে দেওয়া হোক। তার মানে অন্য লোককে এসে আমাদের জামিন দাঁড়াতে হলো। ২৬ শে জুন (১৯২৮) অপরাহ্ণ দেড়টার সময় কোট হতে ছাড়া পেলাম।

মেয়রের নির্বাচনে সুভাষ বসু হেরে যাওয়ায় ও কংগ্রেস দল কর্পোরেশনে সংখ্যায় দল হয়ে পড়ায় কংগ্রেসীদের মতির কিছু পরিবর্তন দেখা দিল। কংগ্রেসী কাগজগুলি আমাদের গিরোরের বিরুদ্ধে লিখতে লাগলেন। এমন কি যে- সুভাষ বসু বর্মার জেল হতে মুক্তি পেয়ে আসা অবধি স্থান-অস্থান বিবেচনা না করেই মার্কসবাদকে গালি বর্ষণ করে যাচ্ছিলেন। যাঁর বক্তৃতা অসহ্য হয়ে ওঠায় একদিন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভায় আমি তাঁকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান পর্যন্ত করেছিলেম,-(সকলে একবার ভাবুন যে-আমি বক্তৃতা তো দিতেই পারিনে, ভালো ক’রে গুছিয়ে কথাও বলতে পারিনে, সে কিনা করল সুভাষ বসুকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান!) কিন্তু ঘৃণাভরে বা অহঙ্কারভরে কিংবা ঘৃণা ও অহঙ্কার দু’কারণেই যিনি আমার আহ্বানে সাড়া দেননি,-সেই সুভাষ বসু কিনা ময়দানে বের হয়ে আমাদের গিরেস্তারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিলেন!!

মেথর-ঝাড়ুদারদের কথা বলছি। প্রভাবতী ও আমার গিরেস্তারের পরেও তাঁদের ধর্মঘট না ভাঙায় তাঁদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হতে লাগল। তাঁরা খাপরার ঘরের খুপরিতে বাস করতেন। সেগুলি ছিল তাঁদের ঠিকানা মাত্র। রাতে তাঁরা ফুটপাতে ঘুমুতেন। দিনে তাঁদের কাজ না থাকলে তাঁরা আশে-পাশের খালি জায়গায় কিংবা রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কাটাতেন। এই অবস্থায় তাঁদের দলবদ্ধভাবে গিরেফ্ফার করে পুলিস কোর্টে হাজির করতেন। মিথ্যা মোকদ্দমা। কোর্ট ́ ছিল চার জায়গায়। আশলীপুর, শিয়ালদা, বংশাল স্ট্রীট ও জোড়াবাগান। সঙ্গে সঙ্গে কোর্টে যেতে পারলে জামিন কিংবা কিছু জরিমানা দিয়ে তাঁদের খালাস ক’রে আনা যেত। আশলীপুরের দ্বিতীয় পুলিস ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার নরম্যান বোস বলতেন “কিছু কিছু জরিমানা না করলে গবর্নমেন্ট আমাদের মাইনে কোথা থেকে দেবেন?” চার কোর্টে ছোটাছুটি করা ছিল মুশকিলের কাজ। কখন কোথা হতে কোন্ দলকে ধরে নিয়ে যেত পুলিস তার খবর পাওয়াও যেত না। মেথর ও ঝাড়ুদাররা জেলেও গেলেন বহু সংখ্যায়। তাঁদের ওপরে জুলুমের এখানেই শেষ ছিল না। রাস্তার কল হতে তাঁদের জল নেওয়ার ও পাবলিক পায়খানা তাঁদের ব্যবহার করায়ও তাঁদের বাধা দিচ্ছিলেন পুলিসের লোকেরা ও গরীব ভদ্রলোকেরা।

দিন দিন কলকাতা নগরের অবস্থা শোচনীয় হতে শোচনীয়তর হচ্ছিল। রাস্তায় জঞ্জাল স্তূপীকৃত হচ্ছিল, খোলা নর্দমাগুলি হতে দুর্গন্ধ বা’র হচ্ছিল আর কলকাতায় যে-সব ইলাকায় তখনও খাটা পায়খানা ছিল (অনেক ছিল) সে-সব ইলাকার দুবস্থার কথা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পায়খানা উপচে পড়ছিল, আর পোকাগুলি কী রকম কিলবিল করছিল। বড় লোকদের নাকেও কিছু কিছু দুর্গন্ধ যে না ঢুকছিল তা নয়, কিন্তু তাঁদের সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটল বেশ দেরীতে।

অবশেষে ঘাবড়ে গেলেন মেয়র বিজয়কুমার বসু ও চীফ একজেকিউটিব অফিসার জে সি মুখার্জি. কই, স্ট্রাইক তো ভাঙল না। তাঁরা কচু রায়ের বংশধর (শুনেছি কচু রায় প্রতাপাদিত্যের পুত্রের নাম ছিল) ও ভারতে ব্রিটিশ সরকারের পোষ্যপুত্র কে সি (কুষ্ণচন্দ্র) রায় চৌধুরীকে আমাদের নিকটে পাঠালেন। তিনি সরকার পক্ষীয় কাউন্সিলারও ছিলেন। সকালবেলা ন’টা-দশটায় সময় আমরা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ময়দানে মনুমেটের ধারে মেথর-ঝাড়ুদারদের মিটিং করছিলাম। রায়চৌধুরী অনেক অনুরোধ উপরোধ ক’রে আমাদের মেয়রের অফিসে নিয়ে গেলেন। আমরা (আমি, ধরণীকান্ত গোস্বামী ও প্রভাবতী দাসগুপ্তা ভিজা পোশাকেই ওখানে গিয়েছিলাম। বিজয় বসু আমাদের বললেন, আগের বারে কংগ্রেসীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলেন। এবার একবার আমাদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন। বললেন, তাঁদের হিসাবে যে টাকা আছে তাতে কোনো রকমে মাসে একটাকা মজুরী বাড়ানো যায়। অন্য শর্তগুলির বেলায় তেমন কোনো অসুবিধা হবে না। আমরা ভেবে দেখব বললাম। কিন্তু আমরা কাউন্সিলারদের মিটিং চলার সমেয়ই সিদ্ধান্ত নেব বললাম। যা স্থির হবে তা সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা পাস ক’রে দিবেন। তিনি বললেন তার পথে আইনগত অসুবিধা আছে। ৫ই জুলাই (১৯২৮) তারিখে ‘স্ক্যাভেঞ্জার্স কনফারেন্সে’র মিটিং ডাকবেন বললেন। কনফারেন্সের সভ্য ছাড়াও অন্য কাউন্সিলারদের নিমন্ত্রণ করবেন কথা দিলেন। আরও বললেন জে এম সেনগুপ্তকেও নিমন্ত্রণ করে আনবেন।

৫ই জুলাই (১৯২৮) তারিখে স্কাভেঞ্জার্স কনফারেন্সে অনেকে এলেন। সকলে এই কনফারেন্সের সভ্য ছিলেন না। যাঁরা উপস্থি ছিলেন :

(১) বিজয় কুমার বসু, মেয়র কলকাতা

(২) রায় রামতারণ বানার্জি বাহাদুর

(৩) সনৎকুমার রায় চৌধুরী

(৪) যতীন্দ্রনাথ বসু

(৫) ডাক্তার বি সি ঘোষ (ইউনিভার্সিটি সায়ান্স কলেজের অধ্যাপক

(৬) মদনমোহন বর্মন

(৭) রামপ্রসাদ মুখার্জি

(৮) এম এম হক

(৯) মুহম্মদ দাউদ

(১০) সন্তোষকুমার বসু

(১১) পি এন বানার্জি (এম এল সি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)

(১২) জে এম সেনগুপ্ত

(১৩) কে সি রায়চৌধুরী (এক হতে তের নম্বর পর্যন্ত সকলেই কর্পোরেশনের কাউন্সিলার)

(১৪) ডক্টর মিস্ প্রভাবতী দাসগুপ্তা

(১৫) ধরণীকান্ত গোস্বামী

(১৬) মুজফফর আহমদ (১৪ হতে ১৬ নম্বরের সভ্যগণ স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অফ বেঙ্গলের প্রতিনিধি)

(১৭) মৃণালকান্তি বসু

(১৮) কিশোরীলাল ঘোষ (১৭ ও ১৮ নম্বরের সভ্যগণ বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের প্রতিনিধি

(১৯) চীফ্ একজেকিউটিব অফিসার

এই উনিশনের উপস্থিতিতে বিশেষ আলোচনার পরে স্থিরীকৃত হয় যে :

“(১) মাসিক একটাকা হিসাবে ঐ মজুরদের মাইনে বাড়িয়ে দেওয়া হবে যে মজুরেরা কর্পোরেশনের অধীনে একটি চাকরী করে থাকে।

(২) গাওখানার লোকেরা যারা মাসে ১৮ টাকার বেশী রোজগার করতে পারে না তারাও মাসে একটাকা বেশী পাবে।

(৩) খোদ ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া আর কেউ মজুরদের কাজ থেকে বরখাস্ত করতে পারবে না। ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ারের বরখাস্ত করার পরেও বিতাড়িত মজুর চীফ্ একজেকিউটিব অফিসারের নিকটে আপিল করতে পারবে।

(৪) (ক) ধর্মঘট করেছে বলে কোন মজুরকে কাজ হতে বরখাস্ত করা হবে না।

(খ) ধর্মঘটের সময়ের পূর্ণ বেতন মজুরগণকে দেওয়া হবে।

(গ) ধর্মঘটকারিগণ ও তাদের নেতৃগণের নামে যে সকল মোকদ্দমা করা হয়েছে সে সকল মোকদ্দমা তুলে নেওয়া হবে।

ডক্টর মিস্ প্রভাবতী দাসগুপ্তা ও মুজফফর আহমদ জানান যে তাঁরা তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমা তুলে নেওয়ার জন্যে অনুরোধ করছেন না তাঁরা আদালতে মোকদ্দমা লড়তে চান।

শ্রমিক প্রতিনিধিগণের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও যে সকল মজুর ধর্মঘট করেনি তাদের দু’টাকা হিসাবে বশিশ দেওয়া স্থির হয়।”

(১৯২৮ সালের ১৯শে জুলাই তারিখের ‘গণবাণী’তে প্রকাশিত শোচনীয় “বিশ্বাসঘাতকতা” শীর্ষক প্রবন্ধ হতে উদ্ধৃত। )

আমরা ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা আগেকার অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম যে আগে এই শর্তগুলি কাউন্সিলারদের সভায় স্বীকৃত হলে তার পরে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হবে। তাতে সকলে ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ কলকাতা শহরের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। আমরা ইউনিয়নের লোকেরাও এই শহরের বাশিন্দা ছিলেম। এই ভাবনা আমাদেরও মনে ছিল। কিন্তু কর্পোরেশনের কাউন্সিলার ভদ্রলোকেরা যে প্রতিজ্ঞা পালন করেন না! জে এম সেনগুপ্ত সাহেব আমাদের বোঝালেন যে এবার তো আপনার শুধু একটি দলের (কংগ্রেসের) প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছেন না, আজ এখানে সকল দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত রয়েছে, তাঁদের কথার ওপরে আপনারা নির্ভর করতে পারেন। কোয়ালিশন দলের তরফ হতে ও মেয়ররূপে বিজয়কুমার বসু জানালেন যে মেথর ও ঝাড়ুদারদের ব্যাপার নিয়ে এবারে কোনো দলাদলি হবে না। সকল দলের সভ্য এখানে উপস্থিত আছেন, মুসলিম প্রতিনিধিরাও উপস্থিত আছেন। আপনাদের সন্দেহের কি কারণ থাকতে পারে? এমন কি মৃণালকান্তি বসু ও কিশোরীলাল ঘোষও আমাদের অনুরোধ করছিলেন যে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হোক। নাগরিকদের দুরবস্থায় ভিতরে ভিতরে আমরাও কম পীড়িত হচিছলাম না। আমরা রাজী হয়ে গেলাম। সেদিন তারিখ ছিল ১৯২৮ সালের ৫ই জুলাই। ওই সভা হতে আমরা ইউনিয়নের লোকেরা গাড়ী চড়ে মজুরদের বস্তীগুলিতে ঘুরতে লাগলাম। দাবীগুলির কথা খুব সংক্ষেপে বোঝালাম। বললাম ভাইরা, বোনেরা, ধর্মঘট তুলে নিয়ে কাজে লেগে যাও। বড় মিটিং-এ সব কথা হবে। শেষ খবর যখন পৌছিয়ে দিলাম তখন রাত হয়ে গেছে। মজুরদের সব বস্তিই আমরা চিনেছিলাম। খবর সর্বত্রই পৌঁছে গেল। রাত যে হয়ে গেছে সে দিকে মজুরেরা কোনো নজরই দিলেন না। তাঁরাও শহরের নাগরিক ছিলেন, কষ্ট তাঁদেরও হচ্ছিল। মনে হলো যেন অসুরের শক্তি নিয়ে তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই কাজ আরম্ভ ক’রে দিলেন।

৫ই জুলাই (১৯২৮) কলকাতার মেথর ও ঝাড়ুদারদের দ্বিতীয় বার ধর্মঘটের দ্বাদশ দিবস ছিল। এই বারো দিনের পুঞ্জীভূত জঞ্জাল ও ময়লা তাঁরা দু’দিনের ভিতরেই পরিষ্কার ক’রে ফেললেন। ৭ই জুলাই (১৯২৮) তারিখে ভোরের ইংরেজি দৈনিক “ফরওয়ার্ড” লিখল “কলকাতা নগরকে আর ময়লা দেখাচ্ছে না।”

কিন্তু এত করার পরেও মেথর ও ঝাড়ুদারদের পেছন থেকে ছুরি মারল কলকাতা কর্পোরেশনের কোয়ালিশন দল। ৫ই জুলাই তারিখে (১৯২৮) যে দাবীগুলিকে ভিত্তি করে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছিল সেগুলির স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে ১৬ই জুলাই (১৯২৮) তারিখে কর্পোরেশনের কাউন্সিলারদের সভা ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তার আগে ইংরেজরা একটি ব্যাপারে বিরুদ্ধে গেলেন। ইংরেজদের ইংরেজী দৈনিক “স্টেটস্ম্যান” ধর্মঘটের সময়ের বেতন দেওয়ার বিরুদ্ধে লিখল। ধর্মঘটের সময়কার বেতন দেওয়া হোক, এটা ইংরেজদের মনোমত ছিল না। তাতে ভয় পেয়ে গেলেন কোয়ালিশন দলের কাউন্সিলররা। তাঁদের মধ্যে অনেকের কাঁপুনি ধরে গেল। কিছু কিছু কংগ্রেসী কাউন্সিলারও ভয় পেয়েছিলেন। ১৬ই জুলাই তারিখের সভায় স্ট্রাইকের সময়কার বেতনের প্রশ্ন উঠতেই কোয়ালিশন দলের কাউন্সিলাররা বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কংগ্রেস দলের সকল কাউন্সিলার সেদিন উপস্থিত থাকলেন না। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যেও দু’জন-রামকুমার গোয়েঙ্কা ও ভূপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরুদ্ধে ভোট দিলেন। কংগ্রেসের উপস্থিত বাকী কাউন্সিলাররা অবশ্য স্ট্রাইকের সময়ের বেতন দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। মেয়র বিজয়কুমার বসুকে কোনো পক্ষেই ভোট দিতে হয়নি। কে.সি. রায়চৌধুরী পেছন থেকে পালিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ার দায়িত্ব এড়িয়েছিলেন। কিন্তু রাত-দিন পরিশ্রম করে এবং কত অতিরিক্ত খেটে যে মজুরেরা জঞ্জাল ও ময়লা পরিষ্কার করে দিলেন তার জন্যে কোনো অতিরিক্ত বেতন তাঁদের দেওয়া হলো না, তাঁরা তা দাবীও করেননি।

কলকাতার প্রথম ধর্মঘটের পরে এবং দ্বিতীয় ধর্মঘটের আগে হাওড়ার মেথর ও ঝাড়ুদারেরা ৯ দিনের (৮ই এপ্রিল হতে ১৬ই এপ্রিল ১৯২৮ পর্যন্ত) ধর্মঘট করেছিলেন। তাঁদের কথা আমি পরে বলছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *