ভারতের ঐশ্বর্য্য
ভারতের ঐশ্বর্য্যের শ্রেষ্ঠ পরিচয় সম্রাট শাাহানের রাজ্যকালেই পাওয়া যায়। প্রাচ্য রাজসিক ঐশ্বর্য্য গরিমায় ভারতবর্ষ বোধ হয় সেই সময় শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করিয়াছিল। আব্দুল হমিদ্ লাহোরীর সমসাময়িক ইতিহাস থেকে ১৬৪৮ খ্রি: সম্রাট শাাহানের অর্থ-সম্ভারের একটি ঠিক ধারণা করিতে পারা যায়। তখনকার টাকার মূল্য ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ২.২৫ শিলিং অর্থাৎ আঠার আনার সমান। এই সঙ্গে এ কথাও স্মরণ রাখিতে হইবে যে এখন এক টাকায় যে জিনিস কিনিতে পাওয়া যায়, তখন ইহার সাতগুণ জিনিস পাওয়া যাইত।
সমস্ত মুঘল সাম্রাজ্যে ২০ কোটি টাকা খাজানা আদায় হইত। সম্রাটের খাস্ মহালের আয় ছিল ১.৫০ কোটি টাকা, তাহা হইতে ম্রাটের নিজের খরচ চলিত।
রাজত্বের প্রথম ৭০ বৎসরের শাহজাহান দান ও পুরস্কার কার্য্যে ৯.৫০ কোটী টাকা ব্যয় করেন, তাহাদের মধ্যে ৪/৫০ কোটী টাকা নগদ আর ৫ কোটী টাকার জিনিস পত্ৰ।
প্রাসাদসৌধ প্রভৃতি নির্মাণে তিনি কি বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়াছিলেন তাহা নিম্নের তালিকা দেখিলেই বুঝা যাইবে।
আগ্রার সৌধমালা:-
দুর্গাভ্যন্তরস্থ মোতী মজিদ, প্রাসাদ ও প্রাসাদ-সংলগ্ন
উদ্যান ৬০ লক্ষ টাকা
তাজমহল ৫০ লক্ষ টাকা
দিল্লীর সৌধমালা:-
প্রাসাদ-সমূহ ৫০ লক্ষ টাকা
জুম্মা মজীদ ১০ লক্ষ টাকা
দিল্লী নগরীর চারিদিকের প্রাচীর ৪ লক্ষ টাকা
দিল্লীর সহরতলীর ইদ্গাহ ১/২ লক্ষ টাকা
লাহোরের সৌধমালা: —
প্রাসাদ, উদ্যান ও খাল ৫০ লক্ষ টাকা
কাবুলের সৌধমালা:-
মজীদ, দুর্গ, প্রাসাদ ও নগর প্রাচীন ১২ লক্ষ টাকা
কাশ্মীরের সৌধমালা :-
প্রাসাদ ও উদ্যান ৮ লক্ষ টাকা
কান্দাহারের সৌধমালা:-
কান্দাহার বিস্ত ও জমিন্দাবারের দুর্গ ৮ লক্ষ টাকা
আজমীরের সৌধমালা:-
আজমীর ও আদাবাদ ১২ লক্ষ টাকা
মুখলিপুরের সৌধমালা:-
রাজপ্রাসাদ ৬ লক্ষ টাকা
যুবরাজ দারাশুকোর প্রাসাদ ২ লক্ষ টাকা
মোট ২,৭২,৫০০০০ টাকা
সম্রাটের ৫ কোটী হীরা-জহরত ছিল। তা বাদে ২ কোটী টাকার হীরা-জহরত শাহাজাদা ও শাহজাদী ও অন্যান্য সকলকে দান করিয়াছিলেন।
সম্রাট নিজে মাথায়, গলায় বাহুতে ও কোমরে যে সকল গহনা পরিতেন, তারই হীরা-জহরতের মূল্য, ২ কোটী টাকা। এই সম্রাটের নিজ ব্যবহাৰ্য্য ২ কোটী টাকা মূল্যের রত্নালঙ্কার হারেমে দাসীদের জিম্মায় থাকিত। বাকী ৩ কোটী টাকার রত্নালঙ্কার বাহিরে ক্রীতদাসের জিম্মায় থাকিত।
সম্রাটের জপমালায় ৫ খানা রুবি ও ৩০টি মুক্তা ছিল। জপমালাটির মূল্য ছিল ৮ লক্ষ টাকা। এই জপমালাটি ছাড়া আরও দুইটি জপমালা ছিল। তাহারও প্রত্যেকটিতে ১২৫টি করিয়া বড় বড় রুবি ছিল। প্রত্যেক দুটি জপের দানার মাঝখানে একটি করিয়া ইয়াকুতও yaqut ছিল; জপমালার সুমেরুটি (মাঝখানের বড় রুবিটার) ওজন ছিল ৩২ রতি, আর তার মূল্য ছিল ৪০,০০০ হাজার টাকা। আর দু’টো মিলিয়া দাম ছিল ২০ লক্ষ টাকা। এই জপমালার রুবি প্রভৃতির অধিকাংশই সম্রাট আকবরের সংগৃহীত।
প্রথম জপমালাটিতে দ্বিতীয় শ্রেণীর রত্নাদি ছিল। পড়ী ঘেরা সরপেচ্ (serpech)–এই সবচেয়ে দামী ও বড় রুবিগুলি ছিল। সিংহাসনাধিরোহণ (জলস) এর বাৎসরিক উৎসবের দিন শুধু এই বহুমূল্য সরপেচ্ সম্রাট পগড়ীতে ব্যবহার করিতেন। ইহাতে ৫টি বড় রুবি, ২৪টি মুক্তা ছিল। মাঝখানের বড় রুবিটির ওজন ২২৮ রতি ও মূল্য ২লক্ষ টাকা, এবং সরপেটির সর্ব্বসমেত মূল্য ১২ লক্ষ টাকা। ১৬৪৪ খ্রি: ১১ই নভেম্বরে এই সরপেচের সহিত ৪০,০০০ হাজার টাকা মূল্যের একটি মুক্তা গাঁথিয়া দিয়া ইহার মূল্য আরও বৃদ্ধি করা হয়। সম্রাটের নিজের হীরা-জহরতের মধ্যে সব চেয়ে বড় হীরার ওজন ৪৩০ রতি এবং মূল্য ২ লক্ষ টাকা। এই রুবিটি অবশ্য সরূপেচের বড় রুবিটি অপেক্ষা নিকৃষ্ট ছিল। আর একটি ৪৭ রতি ওজনের রুবি ছিল, সেটির মূল্য ৫৩ লক্ষ টাকা।
১৬৫৩ খ্রিঃ ১২ই মার্চ তারিখে সম্রাট শাহজাহান সর্ব্বপ্রথম তাঁর বড় সাধের ময়ূর সিংহাসনে উপবেশন করেন। হমিদ লাহোরী বলেন, “সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান ইঁহারা তিন পুরুষ ধরিয়া বহু হীরা, মুক্তা সংগ্রহ করিয়াছেন। লোকে যদি তাহা না দেখিল তবে তাহার মূল্য কি?” সম্রাটও এরূপ ভাবিয়া বাহির-বাড়ীতে ক্রীতদাসদের কাছে যে ২ কোটী টাকা মূল্যের হীরা জহরত থাকিত তাহা হইতে ভাল ভাল কএকটি বাছিয়া লইলেন। এই কএকটির মূল্য ছিল ১৬ লক্ষ টাকা। সরকারী স্বর্ণকারদের ডাকিয়া এই সকল হীরা মুক্তা প্রভৃতির সঙ্গে এক লক্ষ তোলা সোনাও দেওয়া হইল। তখন এই এক লক্ষ তোলা সোনার মূল্য ছিল ১৪ লক্ষ টাকা। বেবাদল খাঁ ছিলেন স্বর্ণকারদের প্রধান। তাঁহার কর্তৃত্বাধীনে এই সোনা ও হীরা প্রভৃতি দিয়া ময়ূর সিংহাসন নিৰ্ম্মিত হইল। ময়ূর সিংহাসনখানি ৩/২৫ গজ লম্বা ২/৫০ গজ চওড়া ও ৫ গজ উঁচু ছিল। সিংহাসনের ছাদের তলা এনামেল করা হইল; ছাদের ভিতরের দিকে খুব অল্প সংখ্যক হীরা মুক্তা বসান ছিল কিন্তু বাহিরের দিকে অসংখ্য পাথর বসান ছিল। বারটি পান্নার থামের উপর ছাদ। তার উপর মণিমুক্তা-খচিত দুইটি ময়ূর আর এই দুই ময়ূরের মাঝে ঐরূপ মণিমুক্তা খচিত একটি গাছ।
গদিতে উঠিবার তিনটি সিঁড়ি। সিঁড়িগুলি আবার রেলিং দিয়া ঘেরা, শুধু সম্রাটের বসিবার জায়গার সামনে কোনও রেলিং ছিল না; অন্য এগার দিকেই রেলিং ছিল। এই এগারটি বেষ্টনীর মধ্যটিই ছিল সবচেয়ে ভাল। এই মধ্যটিতেই সম্রাট হেলান দিয়া বসিতেন। এইটিই তৈয়ারী করিতে খরচ পড়িয়াছিল ১০ লক্ষ টাকা। ইহার মধ্য মণিটির দাম ১ লক্ষ টাকা, এই মধ্য-মণিটি পারস্য সম্রাট প্রথম শাহ আব্বাস ম্রাট জাহাঙ্গীরকে উপহার দেন। এই রুবিটিতে তৈমুর, মীর শাহরক, মীর্জা উলুক বেগ, শাহ আব্বাস, আকবর-পুত্র জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের নাম খোদিত ছিল। সিংহাসনের ভিতরের দিকে হাজী মহম্মদ জান কুদৃশী রচিত একটি কবিতা (৪০ লাইনে) মীণা করা অক্ষরে লিখিত হয়। কবিতাটির শেষ তিনটি শব্দ ছিল এই- আওরঙ্গ-ই-শাহানশা-ই-আদিল অর্থাৎ “ন্যায়পরায়ণ রাজাধিরাজের সিংহাসন।” তারপর সিংহাসনটির নির্মাণের তারিখ দেওয়া।
স্বর্ণকার প্রভৃতির মাহিয়ানা বাদে শুধু সিংহাসন তৈরীর মাল-মশলা ক্রয় করিতেই এক কোটি টাকা খরচ হইয়াছিল।
ভারতের এই বিপুল রাজকীয় অর্থ-সঞ্চার লুণ্ঠিত হইবার সম্ভাবনা তখনকার দিনে যথেষ্টই ছিল। অতএব ইহা লুণ্ঠনের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্য সেইরূপ বিপুল সৈন্য-সামন্ত রাখিতে হইত। তাই দেখিতে পাই ১৬৪৮ খ্রি: সম্রাট-বাহিনী ছিল-
২০০,০০০ অশ্বারোহী
৮,০০০ মনসবদার
৭,০০০ আহদী এবং অশ্বারোহী তীরন্দাজ
৪০,০০০ পদাতিক তীরন্দাজ ও গোলন্দাজ
ইহার মধ্যে ১০,০০০ হাজার সম্রাটের সঙ্গে থাকিত। বাকী ৩০,০০০ হাজার বিভিন্ন সুবায় থাকিত।
ইহা ছাড়া বিভিন্ন রাজপুত্র ও আমীর-ওমরাহের অধীনে ১৮৫,০০০ অশ্বারোহী ছিল। সৰ্ব্বসমেত ৪৪০,০০০ পল্টন ছিল। এই সংখ্যার মধ্যে বিভিন্ন পরগণার ফৌজদার ও ক্রোরী আমলাদের অধীনেও যে সকল স্থানীয় পল্টন ছিল, তাহাদের হিসাব ধরা হয় নাই।
শাহজাহান বন্দী হইবার অব্যবহিত পূর্ব্বে তিনি যে চিঠি লিখিয়াছিলেন তাহাতে নিজেকে ৯ লক্ষ সোয়ারের প্রভু বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তখনকার দিল্লীশ্বরের পল্টন সংখ্যা প্রায় দশ লক্ষ ছিল, যদিও সমগ্র ভারতবর্ষ তাঁহার অধীনে ছিল না।
[প্রভাতী, ভাদ্র, ১৩২৯]
ভারতী, ৪৬শ বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা, কার্ত্তিক, ১৩২৯-এ পুনঃমুদ্রিত।