ভারতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ

ভারতীয় সংস্কৃতির স্বরূপ

চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীর কাছে আমরা এই শিক্ষাই লাভ করেছিলুম যে ভারতের সংস্কৃতি হচ্ছে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতীর মতো তিনটি স্রোতের ত্রিবেণিসংগম—প্রাচীন আর্য বা হিন্দু, মধ্যযুগীয় মুসলিম বা সারাসেন, আধুনিক ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়।

গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সময় একটি বেণি ছাঁটা হল। ইংরেজের সঙ্গে তখন আমাদের শত্রুতা চলছে। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতি যে তাদের সংস্কৃতির কাছে ঋণী, এ চিন্তা আমাদের অসহ্য লাগত। ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে ইউরোপের দান বাদ দিলে যা থাকে তা হিন্দু-মুসলমানের যৌথ সম্পদ। গঙ্গা-যমুনার যুক্ত বেণি। সরস্বতী একদম লুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের এটা ভালো মনে হয়নি। কিন্তু কে শোনে তাঁর প্রতিবাদ! আমরা তখন নিশ্চিত জেনেছি যে গোটা ইংরেজি আমলটাই আমাদের ইতিহাসে প্রক্ষিপ্ত। ওটা আমাদের ওপর গায়ের জোরে চাপানো হয়েছে। আমরা যদি ওর দ্বারা সম্মোহিত হই, তবে আমাদের সেটা দাস মানসিকতা। রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সবাইকে আমরা দাস মানসিকতায় দাগি করে আত্মপ্রসাদ বোধ করলুম। কেবল ছাড় দিলুম সিপাহি বিদ্রোহের নায়কদের এবং তাঁদের মানসিকতায় দীক্ষিত হিন্দু-মুসলমানদের। খেয়াল ছিল না যে, ইংরেজের ওপর রাগ করে আস্ত আধুনিক যুগটাকেই বর্জন করছি।

তারপর বেঁধে গেল হিন্দু-মুসলমানে দাঙ্গা। প্রথম প্রথম তার পিছনে আমরা একমাত্র ইংরেজের হাত দেখতে পেলুম। কিন্তু সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের পর আমাদের চোখ থেকে পর্দা সরে গেল। মুসলমানের ওপর রাগ যতই বাড়তে থাকল, ততই আসতে লাগল মুসলিম ধারা সম্বন্ধে বিতৃষ্ণা। একটু একটু করে আর একটি বেণি ছাঁটা গেল। সেটা মুসলমানেরও ইচ্ছায়। সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝলুম মুসলিমবর্জিত। তার মানে একাদশ শতাব্দীর পূর্বের। যখন সোমনাথের মন্দির কলুষিত হয়নি। আর ওঁরা বুঝলেন হিন্দুবর্জিত। তার স্থানে আরব-ইরান প্রভৃতি মুসলমান-অধ্যুষিত দেশের। যেখানকার রাষ্ট্র নাকি ইসলামি রাষ্ট্র।

পাকিস্তান হাসিল হবার পর অনেকে আশা করেছিলেন যে, হিন্দুস্থান প্রতিষ্ঠা হবে। সেখানকার সংস্কৃতিতে কেবলমাত্র গঙ্গাই থাকবে গঙ্গাজলের শুদ্ধতা নিয়ে। যমুনা থাকবে না। সরস্বতী থাকবে না। ইতিহাস থেকে প্রায় হাজার বছর কাটা পড়বে। কিন্তু ইংরেজির বদলে হিন্দি শিখতে হবে শুনে টনক নড়ল। তখন ইংরেজির খাতিরে ইংরেজ আমলটাকে কোনোরকমে হজম করা গেল। অন্তত ইংরেজি শিক্ষাটাকে। ইংরেজ আমলটা যত খারাপ হোক-না কেন, ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তনটা বেশ ভালো কাজ হয়েছিল। তবে তাতে রামমোহনের বাহাদুরি নেই। তিনি যে মুসলমানদের দ্বারা পরিবৃত থাকতেন সেটা নিষ্ঠাবান হিন্দুদেরই সুকৃতি। রামমোহন গেলে রবীন্দ্রনাথও যান। ব্রাহ্মসমাজ যায়। থাকেন তাহলে ‘শশধর, হাকসলি ও গুজ’। ইংরেজ আমলে ওইটুকুই আমাদের লাভ। আর সব লোকসান।

এই কয় বছরে মাথা অনেকটা সাফ হয়েছে। তবে যবনবিদ্বেষ এখনও বিদ্যমান। সরস্বতীকে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু যমুনাকে না। উত্তরপ্রদেশ, যেখানে গঙ্গা-যমুনার সংগম, সেখান থেকে যমুনাকে সর্বতোভাবে সরাতে হবে। শাসনতন্ত্রে উর্দু পড়ানোর বিধান আছে, তবু উর্দু পড়ানো চলবে না। মুসলমান যদি থাকে তো হিন্দি পড়তে বাধ্য। তাও যদি সে পড়ল, তবে তার গোরু-খাওয়া বন্ধ করতে হবে। এবার দেখা যাবে কেমন করে সে থাকে! তা সত্ত্বেও যদি থেকে যায়, তবে অন্য কোনো উপায় খুঁজতে হবে। নইলে শুদ্ধি কেমন করে সম্ভব হবে?

সংস্কৃতিকে শুদ্ধ করতে হবে, এ ভূত নামতে চায় না। যা হাজার বছর ছিল মিশ্র, আজ তাকে অমিশ্র করার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। হাজার বছর? তার আগেও কি সে মিশ্র ছিল না? শক, হূন, কুষাণ ইত্যাদি কি বাইরে থেকে এসে গঙ্গাপ্রবাহে মধ্য এশিয়ার বারিধারা মেশায়নি? আরও আগে আর্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গল, কোল ইত্যাদি? বৈদিকের সঙ্গে বৌদ্ধ, ষড়দর্শনের সঙ্গে আরও ছয়টি দর্শন, নাস্তিক্যের সঙ্গে নাস্তিক্য? সংস্কৃতির স্বভাবই এই যে, তার মধ্যে বহু স্বতোবিরোধ থাকে। যে সংস্কৃতি নানা বিবাদী সুরকে সংগতি দিতে জানে না সে তার শুদ্ধতা নিয়ে কালগর্ভে বিলীন হয়। আমাদের সংস্কৃতি যে এখনও বিলীন হয়নি তার কারণ বৈচিত্র্যকে অশুদ্ধ বলে বর্জন করা যৌবনকালে তার স্বভাব ছিল না। এ ভাব এসেছে বৃদ্ধবয়সে। জরাকে যৌবনে পরিণত না করলে সে আমাদের নবলব্ধ স্বাধীনতাকেও জরাগ্রস্ত করবে।

সংস্কৃতির মধ্যে কেবল একটি নয়, একাধিক ধারার স্বরসংগতি রয়েছে। কী ভাষা কী সাহিত্য কী সংগীত কী চিত্রকলা কী ভাস্কর্য কী স্থাপত্য কী বেশভূষা কী রন্ধনকলা কী দর্শন কী বিজ্ঞান কী সমাজতত্ত্ব—যেদিক থেকেই বিবেচনা করা হোক-না কেন, ভারতীয় সংস্কৃতি ত্রিবেণির জল; শুধু গঙ্গাজল নয়। এমনকী ধর্মেও সমন্বয়ের চেষ্টা হয়েছে। ইদানীং অবশ্য আর শোনা যায় না যে, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর খ্রিস্টীয় ও মুসলমান মতের সাধনা। অবিকল রামমোহন যা চেয়েছিলেন। গান্ধী যা চেয়েছেন। খ্রিস্টধর্ম প্রায় উনিশ শতাব্দী ধরে ভারতের মাটিতে দৃঢ়মূল হয়েছে; ইসলাম প্রায় হাজার বছর ধরে। ভারতের মাটির গুণে তাদেরও পরিবর্তন ঘটেছে, তারাও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। তার ফলে বিশুদ্ধ হিন্দু বা বিশুদ্ধ মুসলমান বলে কেউ নেই। বিশ্বাসের দিক দিয়ে সকলেই অল্পবিস্তর মিশ্র।

তিনটি বেণির মধ্যে গঙ্গা চিরদিনই বড়ো ছিল, চিরদিনই বড়ো থাকবে। তা বলে যমুনা ও সরস্বতী উড়ে যাবে না। রাজনৈতিক মনোমালিন্য থেকে যে বর্জনশীল মনোভাব আসে, তা শেষপর্যন্ত আপনাকেই বিড়ম্বিত ও বঞ্চিত করে। ইংরেজি পড়ব না, উর্দু শিখব না, দেড়শো বছরকে অবহেলা করব, হাজার বছরকে অবজ্ঞা করব—এতে আমাদেরই ক্ষতি। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় মানুষ আত্মখন্ডন করে না। ফিরিয়ে আনতে হবে সেই প্রকৃতিস্থ অবস্থা, যা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পূর্বেও ছিল। এরজন্যে ইংরেজের বা পাকিস্তানি কর্তাদের শুভবুদ্ধির অপেক্ষায় বসে থাকা যায় না। যা সত্য তা স্বয়ংক্রিয়, তা অন্যের মুখ চেয়ে নিষ্ক্রিয় নয়। ভারতের সংস্কৃতি যদি ত্রিবেণিসংগম হয়ে থাকে, তবে তা এই কয়েক বছরের দুর্ঘটনার ফলে ত্রিধাবিভক্ত হতে পারে না। আমরা যা হয়েছি তা বহু সহস্র বৎসরের বিবর্তনে হয়েছি। তার মধ্যে বিগত হাজার বছরও পড়ে। গত দেড়শো বছরও পড়ে। মুসলমান আমল ও ইংরেজ আমল অকারণে হয়নি, অকারণও হয়নি। শান্তভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, এসব অবশ্যম্ভাবী প্লাবন আমাদের জাতীয় জীবনের ঊষরতম মুহূর্তে ঘটেছে ও উর্বরতা বিধান করেছে। ভাঙন অপ্রীতিকর, পলিমাটি প্রীতিকর। ভাঙনের কথা মনে পুষে রাখব না, পলিমাটির উপর নতুন ফসল ফলাব।

ত্রিবেণির সঙ্গে আমি আর একটি বেণি যোগ করতে চাই। সেটি ভারতেরই চির-উপেক্ষিত লোকসংস্কৃতি। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী আমাদের সকলের দৃষ্টি জুড়েছে, দৃষ্টির অন্তরালে রয়েছে ফল্গু। লোকসংস্কৃতির চর্চার জন্যে কোথাও কোনো ব্যবস্থা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তার ধার ধারে না। মাঝে মাঝে গ্রামের গায়কদের শহরে এনে গান করানো হয়, সেটা তাঁদের স্বস্থান নয়, সেখানে তাঁদের উপযুক্ত আবহাওয়া নেই। মাঠের রাখালকে এনে মঞ্চে দাঁড় করালে সে মাঠের অভাবে মিঠে বাঁশি বাজাতে পারবে না। সাঁওতাল সং সাজবে। বাউল বেল্লিক হবে। এদের চরিত্রভ্রষ্ট করে কার কী লাভ! লোকসংস্কৃতির দিকে মন যাচ্ছে এই যা সুফল। কিন্তু এতে বিশ্বাস রাখতে হবে। এটা চতুর্থ একটা ধারা। অথর্ববেদের মতো সবচেয়ে পুরাতন অথচ সবচেয়ে নতুন। এর ইতিহাস কেউ জানে না, অথচ সকলের ইতিহাস এর মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে। এক-একটি রূপকথা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক। এক-একটি ছড়ার বয়সের গাছপাথর নেই। অথচ মুখে মুখে ঘুরতে ঘুরতে তা নিত্য নবীন।

ভবিষ্যতে যারা সংস্কৃতির গর্ব করবে তাদের এই চারটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বৈদিক-বৌদ্ধ সংস্কৃতির ম্যাট্রিকুলেশন, মুসলিম সংস্কৃতির ইন্টারমিডিয়েট, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিএ আর লোকসংস্কৃতির এমএ। ইচ্ছা করলে উলটো দিক থেকেও পাশ করা যায়। কিন্তু শিক্ষা অসমাপ্ত রয়ে যাবে যদি এর কোনো একটি অঙ্গ বাদ পড়ে। চারটি অঙ্গ মিলেই আমাদের সংস্কৃতি চতুরঙ্গ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *