ভারতীয় সংগীত ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথ একবার আমায় লিখেছিলেন:
প্রকাশ আমার ধর্ম। কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে যেমন আমার প্রকাশ একদিকে হয়েছে, তেমনি গানে আর সুরেও হয়েছে, ছবি-আঁকায় হচ্ছে, আর নাট্যাভিনয়েও হয়েছে।
বাস্তবিক, রবীন্দ্রনাথের অদ্ভুত আর বিশ্বন্ধর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ এত বিভিন্ন পথ ধরে ঘটেছিল যে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। যে কয়টি পথের কথা তিনি নিজে উল্লেখ করেছিলেন, সে ক-টি ছাড়া তাঁর ব্যক্তিত্ব বা প্রতিভা আরও কত বিভিন্ন প্রকারের কর্মে বা চেষ্টায় আপনাকে প্রকাশিত করেছিল! কবি, ঔপন্যাসিক, নৈবন্ধিক—তাঁর এই সমস্ত সাহিত্যিক পরিচয় তো বিশ্ববিখ্যাত, এবং তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয় ছিল কবি ও লেখক হিসাবেই। কিন্তু তাঁর স্বদেশবাসী এবং স্বভাষা-ভাষীদের সকলেই সংগীতকার—‘বাগগেয়কার’ আর ‘কলাবিশুদ্ধ গীতির স্বর-সংযোগের স্রষ্টা’—বলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে শ্রদ্ধা করে আর ভালোবেসে এসেছে। যাঁদের সে সৌভাগ্য জীবনে ঘটেছে, তাঁরা নাট্যাভিনয়ের প্রযোজক আর নাট্যাভিনেতা হিসাবেও রঙ্গমঞ্চে তাঁকে দেখেছেন; আর তাঁরা স্বীকার করবেন যে—সেখানেও তাঁর প্রতিভা ছিল অনন্যসাধারণ। তাঁর কলমে আঁকা অদ্ভুত রসের ছবিগুলির মধ্যে এক-একখানি মানুষের মুখ আবার অপূর্ব মানবিকতা-রসে ভরপুর ছিল—অল্পসংখ্যক সমঝদার রসিকজনের কাছে সেগুলি সম্মানলাভ করেছে; শিল্পীরাও তাঁর হাতের কাজ এইসব ছবির সমাদর করেছেন। নীরস শব্দতত্ত্বের আলোচনায় তিনি বাঙলাভাষায় পথিকৃৎদের মধ্যে প্রথম ও প্রধান ছিলেন, শাব্দিকেরাও এবিষয়ে তাঁকে তাঁদের একজন প্রধান নেতা বলে মেনে নিয়েছেন। এ সমস্ত বিদ্যা আর সুকুমার শিল্পের বাইরেও তাঁর একটা বিরাট কর্মীজীবন ছিল, তার পুরো আলোচনা এখন সম্ভবপর হবে না। তিনি রাজনীতির ক্ষেত্রে চিন্তা আর কর্ম দুই পথেই নিজের শক্তি সার্থকভাবে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি শিক্ষাব্রতী এবং আদর্শ শিক্ষক ছিলেন—শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তাঁর কৃতিত্বের পরিচায়ক। কৃষি, শিল্প আর শিল্প বিষয়ক তাঁর উদ্যোগ শ্রীনিকেতনে দেখা দিয়েছিল। নিখিল ভারতের রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে তিনি মহাত্মা গান্ধীর পাশেই অবস্থিতি করে এসেছেন। বিভিন্ন জাতির মানুষকে মিলিয়ে দেবার পথে যে-সমস্ত শক্তি বিগত শতকপাদের অধিক ধরে কাজ করে এসেছিল, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সেই সমস্ত শক্তির এক প্রধান উৎস—আর বোধহয়, সারা পৃথিবীর এত নানা জাতি আর সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে, তাঁর রচনা আর তাঁর বিশ্বমানবিকতার বাণীর জন্য, তিনি ছাড়া আর কেউ এতটা প্রিয় আর এতটা আপনার হতে পারেন নি।
সংগীতকার রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সংগীত বিষয়ে অনভিজ্ঞ আমার মতো লোকের কিছু বলতে যাওয়া ধৃষ্টতা। তবে আমি নিজেকে, রবীন্দ্রনাথ যাঁর পরিচয় বাঙালি পাঠক-সমাজে করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, সেই ‘উকিল শ্রীযুক্ত দুকড়ি দত্ত’ মহাশয়ের সঙ্গে পুরোপুরি এক পর্যায়ের মানুষ বলে মনে করি না, কারণ সত্য-সত্যই আমার ‘গান জিনিসটা শুনতে বড়ো ভালো লাগে’। কেন ভালো লাগে, তার বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা কখনও করি নি; তবে কী ভালো লাগে, ধীরে ধীরে তার একটা বিচার করতে পেরেছি। রাগ বা সুরের জ্ঞান আমার নেই, ‘কানেড়া রাগ’ কি ‘নাকেড়া রাগ’, তাও ঠাওর করতে পারি না। তবে একটা জিনিস ছেলেবেলা থেকেই আমাকে পেয়ে বসেছে—সেটা হচ্ছে ধ্রুপদের সকল স্নিগ্ধ-গম্ভীর স্বররেখার সমাবেশ।
তখন আমার আট-নয় বছর বয়স, এখন থেকে ৪৪/৪৫ বছর পূর্বেকার কথা। আমার বাড়ি হাওড়া শহরের অন্তর্গত শিবপুরে—তখন শিবপুর ছিল একখানি বর্ধিষ্ণু গ্রাম, তার নিজ বিশিষ্টতা আর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল; এই গ্রাম বহু চটকলের আর পশ্চিমা কুলিদের ধাক্কায়, শালিমার কারখানার আর রেললাইনের চাপে, এখন Cosmopolitan Greater Calcutta-র এক বিশিষ্টতাবিহীন অংশমাত্র হয়ে পড়ছে। তখন শিবপুর ছিল বাঙলাদেশের হৃদয় আর মস্তিষ্কস্বরূপ ভাগীরথী তীরবর্তী ভদ্রগ্রামগুলির মধ্যে অন্যতম; এখানে ভাগ্যবানদের ঘরে বারো মাসে তেরো পার্বণ ছিল, কথকতা আর ‘শখের যাত্রা’-র পাট ছিল (এক নগর-কীর্তন ছাড়া বৈঠকী রস-কীর্তন তখন প্রচলিত হয়নি), সংস্কৃত-বিদ্যার চর্চা ছিল—আর ছিল, উচ্চ অঙ্গের সংগীতের চর্চা। ‘কাণা নিকুন’ নামে পরিচিত অন্ধ গায়ক নিকুঞ্জবিহারী দত্ত তখন শিবপুরের বিখ্যাত গায়ক ছিলেন, কলকাতা থেকে, আর অন্য দূর দূর জায়গা থেকে তাঁর ডাক আসত; আর অন্য নামী কালোয়ত গায়ক অনেকগুলি ছিলেন, পাখোয়াজী অনেক ছিলেন—তাঁদের নাম ছেলেবেলায় শুনেছি, তাঁদের কতবার মামার বাড়িতে দেখেছি, গান-বাজনাও তাঁদের অনেক শুনেছি—কিন্তু অন্য কারও নাম মনে রাখতে পারি নি। আমার দুই মামা ছিলেন, দুজনেই কালোয়াতি গানের সাধক ছিলেন। তাঁদের আমলে, মামার-বাড়িতে প্রায়ই শনিবার-রবিবার গানের মজলিশ বসত; যে-সময়ে মায়ের সঙ্গে আমরা মামার বাড়িতে যেতুম, সে-সময়ে এসব মজলিশের একপাশে উপস্থিত থাকবার সৌভাগ্য আমাদের হত। ১৮৯৯ সাল, তখন আমার বয়স আট-নয় বছর, কলকাতায় তখন ভীষণ প্লেগের প্রকোপ—আমরা প্রায় একটি বছর শিবপুরে মামার-বাড়ির কাছেই মামাদের একটি বাড়িতে ছিলুম, আমার পিতা শিবপুর থেকে নৌকো করে কলকাতায় আপিস করতেন, তখন এইসব গানের জলসায় সপ্তাহে দু-বার করে অন্তত জমা হতে পারতুম। অন্যান্য মাসতুতো ভায়েদের সঙ্গে, বাড়ির ভাগ্নে হিসাবে আমাদের প্রতিপত্তি আর দাপট ছিল খুবই। কর্তাব্যক্তিদের অসাক্ষাতে তানপুরা খোলা পেলেই তার নিয়ে টানাটানি, আর পাখোয়াজের ময়দার তাল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আর লোফালুফি এসব তো ছিলই। কালোয়াতি গানের—ধ্রুপদ আর খেয়ালের—চর্চা যখন হত, সবসময়ে যে ভালো লাগত তা বলতে পারি না; টপ্পা অবধি চলত, বোধহয় এঁরা ঠুমরি-গজলে নামতেনই না—সেসব তখন শুনি নি। মাঝে মাঝে বাঙলা গান হত (পরে বুঝেছি যে সেসব ছিল নিধুবাবুর টপ্পা); আর কেউ হয়তো বাড়ির মেয়েদের খুশি করবার জন্য এক-আধখানা ‘শ্যামাসংগীত’ গাইতেন; ধ্রুপদ খেয়ালের গন্ডি কখনো কখনো এইভাবে দয়া করে কেউ অতিক্রম করতেন। এক-এক সন্ধ্যায় বড়ো গোছের জলসা হত, তখন নানা লোক আসতেন, মামার বাড়ির সামনের সরু গলিপথে অনেকগুলি ঘোড়ার গাড়ি জমা হত। রবিবার দিন কখনো কখনো সারাদিন ধরে গানের মজলিশ চলত—গায়ক-বাদকদের কেউ কেউ থেকে যেতেন, মামার-বাড়িতেই তাঁদের মাধ্যাহ্নিক সেবা হত। তখন চায়ের রেওয়াজ ছিল না, পান তামাক হরদম চলত।
এই রকম সংগীতের পারিপার্শ্বিকের মধ্যে বাল্যকাল অতিবাহিত হচ্ছিল। একদিন বর্ষাকালের দুপুরবেলা, আকাশে খুব মেঘ জমেছে, বৃষ্টিও ঝুপঝুপ করে পড়ছে, বাইরে গিয়ে দৌড়ধাপ করে খেলবার সময় সেটা নয়—তখন আধখানা নারকেল-মালায় দড়ি বেঁধে খড়ম করে পরে, খড়মে-বাঁধা দুই দড়ি দু-হাতে ধরে সেই খড়ম পায়ে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ করতে করতে ছোটাছুটি করা শিবপুর গ্রামের ছেলেদের একটা প্রিয় খেলা ছিল—মামার-বাড়ির বৈঠকখানায় অন্ধ নিকুঞ্জ দত্ত তানপুরা নিয়ে ধ্রুপদে একখানা মেঘ-মল্লার ধরেছেন, একজন পাখোয়াজ ধরেছেন, আর অন্য দু-তিনটি মাত্র শ্রোতা চুপ করে শুনছেন—সেই ধ্রুপদখানিই যেন তখন আমায় চিরতরে ভারতবর্ষের ধ্রুপদ সংগীতের কেনা গোলাম করে নিলে—
ঘোরে ঘোরে বরখত বদরবা।
ধ্রুপদের মোহ কখনো কাটিয়ে উঠতে পারি নি। বহুদিন পরে, আমার এক মামাতো ভগিনীপতি, শিবপুরের ছেলে বলে তিনিও উচ্চাঙ্গের সংগীতের চর্চা করতেন, তাঁর কাছে অনুরোধ করে তাঁর চমৎকার কন্ঠে গাওয়া দু-চারখানি ধ্রুপদ বার বার শুনেছি—
তীন গ্রাম সপ্ত সুর ইকইস মূরছনা। প্রভৃতি।
কলকাতায় সুকিয়া রো-তে আমাদের বাড়ির পাশেই সংগীত-নায়ক শ্রীযুক্ত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বাসা নিলেন, তখন কয়েক বছর ধরে তাঁর ওখানে ধ্রুপদ-খেয়ালের জলসায় হাজির থেকে সংগীত-রস আস্বাদের সুযোগ হয়েছিল।
ধ্রুপদ ভালো লাগবার কারণ বোধহয়, সরল এবং নিরাভরণ সৌন্দর্যের প্রতি, grand style-এর রচনার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ; যে-জন্য প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য, হিন্দুযুগের মহাবলীপুরম আর ঘারাপুরীর ভাস্কর্য, পৃথিবীর সব জাতির বড়ো-বড়ো উপাখ্যান বা মহাকাব্য; অনাবশ্যক বচন-বিস্তার বা ভাবের মারপ্যাঁচ না দেখিয়ে সহজ সোজাভাবে অনুভূত আর চীনা কবিতার মতো সরল কবিতার রূপে প্রকাশিত রসবস্তু; বাস্তুশিল্পের বিরাট বিরাট সৃষ্টিসমূহ—যেমন গ্রীক দোরীয় রীতির মন্দির, হুমায়ুনের সমাধিমন্দির, তাজ, প্রাচীনতম যুগের বিজান্তীয় ও গথিক গির্জা, বৃন্দাবনের গোবিন্দজীর মন্দির, তাঞ্জোরের বৃহদীশ্বর মন্দির;—এইসব জিনিস ভালো লাগে। বিশেষ করে তানসেনের ধ্রুপদ কেন ভালো লাগে, তার একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছিলুম কয়েক বৎসর পূর্বে, ‘কবি তানসেন’ নাম দিয়ে একটি প্রবন্ধে (প্রবাসী-র ১৩৪০ সালের বৈশাখ মাসের সংখ্যায় এটি বেরিয়েছিল)।
প্রাচীন ভারতের সংগীতের পুরাতন কোনো নমুনা এ পর্যন্ত সুরক্ষিত হয় নি। প্রাচীন ভারতীয় নাচের একটা ধারণা করতে পারা যায়, উদয়গিরি ভারহুৎ সাঁচীর আর মথুরা অমরাবতীর খোদিত চিত্র থেকে, অজন্তা বাঘ গুহার আঁকা ছবি থেকে। সামগানের যে ধারা এখনও পর্য্যন্ত চলে এসেছে, তা থেকে এক ধরনের অতি বিশিষ্ট ধর্ম-সংগীতের কতকটা আভাস পাওয়া যায়। সাওঁতাল মুণ্ডা টোডা প্রভৃতি অনুন্নত জাতির স্বকীয় গানের সুর থেকে ভারতের আদিম অধিবাসীদের গানের ধাঁচটাও অনুমান করা যায়। সংগীত সম্বন্ধে প্রাচীনতম সংস্কৃত বই কোনোটিই খ্রীষ্টীয় ১০০০-এর ওদিককার নয়। খ্রীষ্টজন্মের প্রথম দুই-তিন শতকের মধ্যে লেখা শূদ্রকরাজার মৃচ্ছকটিক নাটকে, নায়ক চারুদত্ত অনেক রাত ধরে গান শুনে বাড়ি ফিরছেন—তিনি পথে চলতে চলতে সঙ্গী বিদূষক মৈত্রেয়ের কাছে উচ্ছ্বসিতভাবে রেভিলের প্রশংসা করছেন—
রক্তং চ নাম মধুরং চ সমং স্ফুটং চ
ভাবান্বিতং চ ললিতং চ মনোহরং চ।
কিংবা প্রশস্তবচনৈর্বহুভির্মদুক্তৈর
অন্তর্হিতো যদি ভবেদ, বনিতেতি মন্যে।।
তার গান এত সুন্দর যে, যদি গায়ক চোখের বাইরে থাকেন, মনে হয় কোনো নারী গাইছে। এতে গানের পুরুষোচিত গাম্ভীর্যের চেয়ে মহিলোচিত মাধুর্যের প্রশংসাই দেখছি। এ জিনিস মৈত্রেয়ের ভালো লাগে নি—তিনি বলছেন—
মণুসসো বি কাঅলীং গাঅন্তো, সুকখ-সুমণো-দাম-বেটঠিদো বুডঢ-পুরোহিদো বিঅ মন্তং জবন্তো, দিঢং মে ণ রোঅদি।।
পুরুষ মানুষ যদি কাকলি গায়, তাহলে শুকনো ফুলের মালা মাথায় জড়িয়ে বুড়ো পুরোহিতের মন্ত্র-জপ করার মতন, আমার তা মোটেই ভালো লাগে না।
বীণা বাজিয়ে উজ্জয়িনীর বিদগ্ধজন-সভায় ভাব-রেভিল যে গান গেয়েছিলেন, তার ঠাট কী ধরনের ছিল, তা জানবার উপায় নেই। দুষ্যন্তের অন্যতমা রানী হংসপদিকা বীণা বাজিয়ে যে ‘বর্ণপরিচয়’ বা মূর্ছনা রাজাকে উদ্দেশ্য করে শোনাচ্ছিলেন, তাও কী ধরনের ছিল তা বলতে পারা যায় না। মহাকবি বাণভট্ট অরণ্যের মধ্যে শিবের মন্দিরের অলিন্দে তরুণী তাপসী মহাশ্বেতার গানের বর্ণনা করেছেন—শ্রীযুক্ত [অধুনা পরলোকগত] প্রবোধেন্দুনাথ ঠাকুরের গদ্য-কবিতাময় সুন্দর বঙ্গানুবাদে সেই বর্ণনাটুকু উদ্ধার করে দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না—
সেই মেয়েটির কোলের উপর, চন্দ্রাপীড় দেখতে পেল, পড়ে রয়েছে হাতীর-দাঁতে গড়া একখানি বীণা। দক্ষিণ করের অঙ্গুলিগুলি বীণার তারের উপর লীলাভরে চলেছে খেলে, আর কম্পিত অধরের অবকাশ দিয়ে ঝরে পড়ছে দেব বিরূপাক্ষের বন্দনাগান—সেই বীণাতন্তীঝংকারমিশ্র অমানুষিক সুরলালিত্য।
সাক্ষাৎ যেন গন্ধর্ববিদ্যা।
গীতরবে আকৃষ্ট হয়ে মন্দিরদ্বারে স্থির হয়ে বসে আছে মৃগ বরাহ সিংহ—
অনেক প্রাণী—আর বীণার ঝংকারে মাঝে মাঝে উঠছে সেই অষ্টাদশবর্ষীয় প্রবাল-অধরের গান।
চন্দ্রাপীড়ের মনে হল—
…যে গান শুনছি সে গান মর্ত্যের নয়—নিশ্চয় গন্ধর্বলোকের।…
তারপরে সমাপ্ত হল গীত।
স্তব্ধ হল বীণা, যেন শান্ত হল কুমুদিনীকে ঘিরে ভ্রমরের মধুগুঞ্জন।
মেয়েটি তখন উঠে শিবপ্রদক্ষিণ করে নত হয়ে প্রণাম করল।
এই রকম গানের সুর-লয় যদি পাওয়া যেত! কিন্তু সে-কন্ঠস্বর সে-বীণাধ্বনি চিরতরে স্তব্ধ—তার ক্ষীণ ধারা হয়তো আমাদের মধ্যযুগের সংগীতে একটু-আধটু ঝংকৃত হচ্ছে।
উত্তর-ভারতের রাজপুত ছবি থেকে, পশ্চিমবাঙলার শ্রেষ্ঠ পুঁথির পাটা থেকে, যেমন বাঘ অজন্তার ভিত্তি-চিত্রের ধারণা, ঘারাপুরী-কৈলাস-মহাবলিপুরম-বাদামীর, মথুরা-অমরাবতী আর ভারহুৎ-সাঁচীর খোদিত চিত্রের। ধারণা, সম্পূর্ণভাবে করা যায় না; তেমনি বোধহয় আকবর তানসেনের সময়ের, খ্রীষ্টীয় ১৬শ শতকের, হিন্দু সংগীত ধ্রুপদ থেকে (যে ধ্রুপদ গুরু-পরম্পরায় কতকটা তার তিন-চারশো বছরের ধাঁচটুকু এখনও পর্যন্ত অনেকটা বজায় রেখেছে এ অনুমান করা অসংগত হবে না), খ্রীষ্টিয় ৭ম বা ৩য় অথবা খ্রীষ্টপূর্ব ২য় বা ৩য় শতকের প্রাচীন ভারতীয় সংগীত সম্বন্ধে পুরা বোধ হওয়া অসম্ভব। সংগীতদর্পণ প্রভৃতি প্রাচীন সংস্কৃত সংগীত বিষয়ক বই থেকে, উত্তর-ভারতের ধ্রুপদ আর দক্ষিণ-ভারতের ‘পদম’ আর ‘কীর্তনম’-এর মতো প্রাচীন বা প্রাচীন-গন্ধী সংগীত-রীতি থেকে, তার কতকটা অনুমান মাত্র করতে পারা যায়; সংগীতদর্পণ প্রভৃতি প্রাচীন বই (আমাদের বাঙলাদেশের আর নেপালের বৌদ্ধ পুঁথিতে আঁকা ছবি অজন্তার আভাস যেমন কতকটা দেয় সে-রকমভাবে) বাণভট্ট-কালিদাস-শূদ্রকের যুগের সংগীতের একটা আভাস হয়তো দিতে পারে। কিন্তু সেসব আলোচনা হচ্ছে সংগীতের ইতিহাস আর সংগীতের গতির বিষয়ে গবেষণার কথা।
ভারতে আর্যভাষার বিকাশ হয়েছে এই পথ ধরে—‘সংস্কৃত’ বা আদি-আর্য, ‘প্রাকৃত’ বা মধ্য আর্য, আর ‘ভাষা’ বা নব্য-আর্য। মধ্য আর নব্য-আর্যের সন্ধিক্ষণে আছে অপভ্রংশ, যা হচ্ছে একাধারে প্রাকৃতের অন্তিম রূপ, ভাষার আদিম রূপ। এই ভাষায় ইতিহাস আরম্ভ হয়েছে খ্রীষ্টীয় ১০০০-এর দিক থেকে; এখনও পর্য্যন্ত এই ভাষা-যুগ অর্থাৎ নব্য-আর্য যুগই চলেছে। এই নব্য-আর্য যুগের ভাষাতে আবার তিনটি স্তর ধরা হয়—আদ্য, মধ্য, নব্য। ভাষার ক্ষেত্রে, আদি-আর্য্য, মধ্য-আর্য, নব্য-আর্য—এসব স্তরের প্রচুর উপাদান বিদ্যমান; কিন্তু সংগীতের ক্ষেত্রে অনুরূপ নব্য-আর্য বা ভাষা যুগের মধ্যস্তরের (অথবা আদ্য স্তরের) পূর্বেকার উপাদান আমাদের সামনে আর বিদ্যমান নেই। আমীর খুসরৌ আর গোপাল নায়ক—এঁরা ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের লোক; এঁদের সময় পর্য্যন্ত ধ্রুপদ-খেয়ালের সুর-লয়-যুক্ত গান রক্ষিত হয়েছে। এর পূর্বে আমরা জয়দেবের গীতগোবিন্দের পদ পাচ্ছি, খ্রীষ্টীয় বারোর শতকে; গানের কথা পাচ্ছি, সুর-তালের নাম পাচ্ছি, কিন্তু সুরটি পাচ্ছি না—অন্তত বাঙলাদেশে পাচ্ছি না; শুনেছি মহারাষ্ট্রদেশে নাকি পুরাতন সুর রক্ষিত আছে। সুর-তালের নাম দেখে, গানের ঢঙ দেখে মনে হয়, গীতগোবিন্দের সেসব গান ধ্রুপদের পর্যায়েরই ছিল। এর পূর্বে, খ্রীষ্টীয় বারোর শতকের প্রথম অর্ধে সংকলিত সংস্কৃত বিশ্বকোষ ‘মানসোল্লাস’ বা ‘অভিলষিতার্থ-চিন্তামণি’-তেও গানের কথা পাচ্ছি; কিন্তু সুর-লয় জানবার উপায় নেই। শিল্পী আর শিল্পের ঐতিহাসিক শ্রদ্ধেয় শ্রীযুক্ত অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয় রাজপুত রাগরাগিণী-চিত্রের আলোচনামূলক তাঁর বিরাট সচিত্র গ্রন্থের ভূমিকাতে আমাদের রাগরাগিণীগুলির ইতিহাস আলোচনা করেছেন। আমাদের সংগীতে বিভিন্ন রাগরাগিণীর কল্পনা কত পুরোনো, তা বলতে পারা যায় না; তবে নাম থেকে অনুমান হয়, অন্তত কতকগুলি প্রাচীন রাগ আর রাগিণী, বিভিন্ন প্রদেশে প্রচলিত বা বিভিন্ন প্রদেশে উদ্ভূত জনপ্রিয় সুরের বা গতের আধারে তৈরি হয়েছিল; যেমন গূর্জরী বা গূজরী, মালব, বঙ্গালী, গৌড়, মালব-কৌশিক, বহ্রাড়ী, গন্ধার, ঝিঞ্ঝৌটী, কানড়া। অর্থাৎ এ থেকে প্রমাণ হয়, আমাদের মধ্য যুগে অর্থাৎ ১২০০-১৬০০-র মধ্যে যা Classical Music বা উচ্চাঙ্গের সংগীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা মূলে, তার হাজার বছর আগে, বহুল পরিমাণে লোকসংগীতই ছিল। মার্জিত রুচির লোকের হাতে, শিক্ষিত কলাবন্তর হাতে, লোকসংগীত বা গ্রাম-গীত, উচ্চ অঙ্গের সংগীতে উন্নীত হয়ে থাকে—সব দেশেই এটা দেখা যায়। পরবর্তীকালে সেই ধারাই চলে এসেছিল বলে মনে হয়; আমাদের প্রাচীন সংগীত কখনো স্থিতিশীল ছিল না, গতিশীল অর্থাৎ প্রাণবন্ত ছিল—আর সেইজন্যই এ জিনিস এতকাল ধরে জীয়ন্ত হয়ে চলে এসেছে। দরকার মতো বিদেশী জিনিস এতে ঢুকেছে, লোকগীতের বা গ্রামগীতের সুরও এতে বিস্তার করেছে, এর সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে। শুদ্ধ আর মিশ্রিত, প্রাচীন আর নবীন, দু-রকমেরই স্থিরীকৃত melody অর্থাৎ রাগের রেওয়াজ বোধহয় গোড়া থেকেই আছে। আজ যা মিশ্র রাগ, classical বা প্রাচীন হয়ে কাল তা শুদ্ধ রাগের সম্মানই পেলে। তানসেনের সৃষ্টি ‘দরবারী কানড়া’ বা ‘মিয়াঁ-কী মলহার’—এই রকম রাগকে কেউ এখন আর non-classical অর্থাৎ নিকৃষ্ট, অথবা উৎকৃষ্ট বা উচ্চাঙ্গের নয়, এমন কথা বলবেন না।
খ্রীষ্টীয় বারো-তেরো শতকের পর, এদেশে তুর্কী বিজয়ের পর থেকে, ফারসী মুসলমান ইরানের সংস্কৃতি নতুন করে ভারতবর্ষের হিন্দু সংস্কৃতিকে প্রভাবান্বিত করে। ধর্মের আর আধ্যাত্মিক অনুভূতির ক্ষেত্রে ইরান থেকে একটা প্রবল সুফি প্রভাব ভারতের নব-জাগরিত ভক্তিবাদের উপরে পড়েছিল বলে মনে হয়। সুফি অনুভূতি আর দর্শন হচ্ছে মুখ্যত শেমীয় আরব ইসলামের ধর্মভাব আর অনুভূতির প্রতি আর্য ইরানের মনের প্রতিক্রিয়ার ফল, কিন্তু এর সংগঠনে ভারতের বেদান্তেরও যে একটা বড়ো স্থান ছিল, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উত্তর-ভারতের বাস্তুশিল্পেও বেশ প্রচুর পরিমাণে ইরানের প্রভাব পড়ে,—ভারতীয় বাস্তুশিল্পের প্রাথমিক উদ্ভবের যুগে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে হখামনিষীয় (Achaemenian) সাম্রাজ্যের পত্তনের সময় থেকেই, সাসানীয় (Sassanian) যুগ, আর তা ছাড়া ভারতের তুর্কী পাঠান আর মোগল রাজত্বের কালে—এই আড়াই হাজার বছর ধরে।
এই দুই বাস্তু-রীতির মিশ্রণে মধ্যযুগের উত্তর-ভারতীয় বাস্তু-রীতিতে তার এক নতুন Indo-Moslem বা ভারতীয়-মুসলমান ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষাতে আর সাহিত্যেও (উত্তর-ভারতে বিশেষ করে, যেখানে দোর্দন্ডপ্রতাপ মুসলমান রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল) ইরানী প্রভাব পড়তে থাকে—বিভিন্ন উত্তর-ভারতীয় নব্য-আর্য ভাষায় ফারসী শব্দ এসে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে থাকে,—আর সতেরো-আঠারোর শতকে দকনী অর্থাৎ দক্ষিণাপথে উত্তর-ভারতের মুসলমানদের দ্বারায় নীত আর প্রতিষ্ঠিত হিন্দী, আর উর্দু অর্থাৎ উত্তর-ভারতের মুসলমান রাজদরবারে প্রচলিত হিন্দী, এই দুটি ভারতীয় ভাষা, মুসলমান ইরানের ফারসী ভাষা আর সাহিত্যের আদর্শ গড়ে ওঠে। উত্তর-ভারতের সংগীতেও সেই রকম মুসলমান (অর্থাৎ ইরানী) প্রভাব কিছু কম পড়ে নি। কিন্তু ইরানের গজল-মর্সিয়া-কাওয়ালির সুর এসে গেলেও, আমাদের ভারতীয় সংগীতের জাত একেবারে যায় নি, আমাদের রাগরাগিণীর ঠাট ঠিকই বজায় ছিল, বাইরে থেকে যা এসেছিল তাকে একেবারে হজম করে নিজের অঙ্গীভূত করে নিয়েছিল। ভারতীয় সংগীতের বিকাশ তার পুরানো ধারা বজায় রেখেই চলল। মুসলমান গায়কেরা আর সংগীতের মুসলমান পৃষ্ঠপোষকেরা সকলেই প্রাচীন যুগ থেকে উপলব্ধ রাগরাগিণীমূলক ভারতীয় সংগীতের রীতি বা পদ্ধতিকে গ্রহণ করলেন। দেশে ধ্রুপদ ছিল, আমীর খুসরৌ ইরানী প্রভাব এতে সংযুক্ত করলেন, তিনি আর তাঁর সমসাময়িক সংগীত-রসিকেরা নতুন জিনিস আনলেন—‘খ্যাল’ বা খেয়াল। পাঞ্জাবের প্রচলিত লোকসংগীতের আধারে গড়ে উঠল ‘টপ্পা’, শোরী মিয়াঁর প্রভাবে যা উত্তর-ভারতের প্রৌঢ় বা শিক্ষিত সংগীতের সভায় একটি মর্যাদার আসন পেল। তেমনি বুন্দেলখন্ডের লোকসংগীত থেকে ‘দাদরা’ এল। প্রাচীনকালে যেভাবে প্রাদেশিক সংগীতের ক্ষেত্র থেকে প্রাণরস নিয়ে ভারতীয় বা উচ্চকোটির সংগীত-তরু সমৃদ্ধ হয়েছিল, এ সেই জিনিসেরই পুনরাবৃত্তি হল। মধ্যযুগে বাঙলাদেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের হাতে ‘কীর্তন’-এর সৃষ্টি হল, ষোলো আর সতোরোর শতকে; এর মূলে ছিল প্রাচীন রাগ তার তাল। কিন্তু বাঙলার স্থানীয় লোকসংগীতের প্রভাবে পড়ে কীর্তন একটা বিশিষ্ট রূপ ধরে নিলে। প্রাচীন ভারী আর বিলম্বিত চালের কীর্তন কখনো কখনো ধ্রুপদকেই স্মরণ করিয়ে দেয়; কিন্তু হালকা চালের কীর্তনও এল। বাঙলাদেশের এদিককার কালে এই জিনিসের চল বেশি করে হল। বাঙলাদেশ উত্তর-ভারতের রাজধানী দিল্লীর তুর্কী পাঠান আর মোগল দরবার থেকে দূরে ছিল বলে, মধ্যযুগে বাঙলার লোকসংগীত উত্তর-ভারতের উচ্চ-কোটির সংগীতকে তেমন কিছু দিতে পারে নি—নিজের প্রকৃতি আর রুচি অনুযায়ী বাঙলাদেশের লোকেরা কীর্তন আর বাউল, ভাটিয়াল, রামপ্রসাদী প্রভৃতি কতকগুলি ঢঙের সুর নিয়েই খুশি ছিল; আর পশ্চিমের সঙ্গে যোগ রাখতে পেরেছিলেন এমন শিক্ষিত সংগীতজ্ঞদের মধ্যে বাঙলাদেশেও ধ্রুপদ, খেয়াল একটা সম্মানের আসন করে নিলে। পশ্চিমবাঙলার বিষ্ণুপুর-নগর মল্ল-বংশীয় রাজাদের আমলে আঠারো শতকের গোড়া থেকে ধ্রুপদ-খেয়ালের একটি কেন্দ্র হয়ে পড়ে; পূর্ববঙ্গে ঢাকাও সেই রকম পশ্চিম থেকে আগত কালোয়াতি গানের আর একটি কেন্দ্র হয়। লখনৌয়ের শৌখীন বাদশাহদের আমলে উত্তর-ভারতের সংগীতের গতি অব্যাহত থাকে, গজল কাওয়ালির আর টপ্পা-ঠুমরির খুবই উন্নতি হয়। ধ্রুপদ-খেয়ালের পাশে পাশে বাঙলাদেশেও টপ্পা-ঠুমরির প্রচলন হয়, আর এই বিষয়ে রামনিধি গুপ্ত (নিধুবাবু) উনিশ শতকের মধ্যভাগে বাঙলা সংগীতে তাঁর গান আর সুরের সাহায্যে যুগান্তর আনয়ন করেন।
দক্ষিণ-ভারতের কর্ণাটক-পদ্ধতির সংগীতের ইতিহাস আমরা ঠিক জানি না। বিগত শতকের মধ্যভাগে তেলুগুভাষী কবি আর সংগীতকার, শ্রীরামচন্দ্রের পরম ভক্ত ত্যাগরাজ, দক্ষিণের ধ্রুপদ ‘কীর্তনম’ রচনা করেন; দক্ষিণ-ভারতের সংগীতে, উত্তর-ভারতের তানসেনের মতোই তাঁর গৌরবময় স্থান। ত্যাগরাজের তেলুগু কীর্তনমগুলি রামচন্দ্র-বিষয়ক, উত্তর-ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী সংগীতে তানসেনের ধ্রুপদের পদের মতন কর্ণাটকীয় সংগীতে এগুলির প্রসিদ্ধি—তামিল কানাড়ী আর মালয়ালী গায়কেরাও এই তেলুগু কীর্তনম গেয়ে থাকেন, যেমন মারাঠী, পাঞ্জাবী, কাশ্মীরী, গুজরাটী, বাঙালি গায়কেরাও তানসেনের ব্রজভাষা-হিন্দীতে নিবদ্ধ ধ্রুপদ গেয়ে থাকেন। দক্ষিণ-ভারতের সংগীতে বোধহয় আমাদের খেয়াল-টপ্পা-ঠুমরির মতো প্রাচীনের নবীনতর রূপভেদ দেখা দেয় নি—মুসলমান-পূর্ব যুগের, শুদ্ধ হিন্দুস্থানী সংগীতের রূপটি বোধ হয় দক্ষিণ-ভারতেই বেশি করে সংরক্ষিত হয়ে আছে।
বড়ো বড়ো গায়কদের কথা বলছি না, ভাতখান্ডে প্রমুখ প্রাচীন সংগীতের সংশোধক বা গবেষক এবং সংস্কারকদের কথা বলছি না। আধুনিক বাঙলা গানকে অবলম্বন করে রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষেরই সংগীতকে পুষ্ট করে দিয়ে গিয়েছেন। এখন বিশেষ করে বিগত দশ-পনেরো বছরের মধ্যে, রেডিও আর বেশি করে সিনেমার কল্যাণে, নিখিল ভারতের সংগীত বিভিন্ন প্রদেশনির্বিশেষে একই ছাঁচে ঢালা হয়ে যাচ্ছে। এক-ই হিন্দী গান বোম্বাই, পুনা, বাঙ্গালোর, মাদ্রাজ, হায়দরাবাদ, মথুরা, নাগপুর, কলকাতা, ঢাকা, পাটনা, কাশী, প্রয়াগ, লখনৌ, দিল্লী, লাহোর, করাচী, অজমেরের রাস্তায় পথচলতি লোকের মুখে শোনা যাচ্ছে—এইসব গান সিনেমার প্রভাবের ফল। পারসী থিয়েটারের মারফত বোম্বাইয়ের প্রচলিত সুর (প্রাচীন রাগরাগিণী ভেঙে, অথবা বিলিতি গান ভেঙে তৈরী) বাঙলাদেশে এসে যাচ্ছিল। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, আর হালে গুরুসদয় দত্ত, ইংরেজি সুরও বাঙলায়—ভারতবর্ষে—আমদানি করেছেন। বাঙলা গানের সুর ততটা ভারতের অন্যত্র স্থান পাচ্ছিল না; এক তো এইসব গানের ভাষা বাঙলা, বাঙলার বাইরের লোক বোঝে না—আর বাঙলা গানে (classical বা প্রাচীন গানের চেয়ে) কথার স্থানটি অনেক উঁচুতে; তারপর, এইসব গানের সুর, নিখিল-উত্তর-ভারত কতৃক সম্মানিত ভারিক্কে রাগরাগিণী নয়, ভাঙা রাগরাগিণীর। এই দুই কারণে, প্রচলিত বাঙলা গানের সুর বাইরে ততটা যেতে পারে নি—কীর্তন বাউল ভাটিয়াল তো দূরের কথা। এগুলি খাঁটি বাঙালি Folk-music বা লোকসংগীতের পর্যায়ের বলে, বাঙলার ভিতরে অনেকটা আর বাইরে অপাংক্তেয় ছিল; এক কীর্তন তো সেদিন-মাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, বিপিনচন্দ্র পাল, রসময় মিত্র আর সুন্দরীমোহন দাস মহাশয়ের চেষ্টায় বাঙলার শিক্ষিত সমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছে। নইলে, কীর্তন কেবল বৈষ্ণব সম্প্রদায়েই নিবদ্ধ ছিল; বাউল ভাটিয়াল যে তার প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছে, তা মুখ্যতঃ রবীন্দ্রনাথের প্রসাদে। বাঙালি ওস্তাদ বা কালোয়াতদের কাছে এগুলির মর্য্যাদা ছিল না, সেইজন্য বাঙলার বাইরেকার ওস্তাদ আর কালোয়াতদের শ্রদ্ধাও এই সমস্ত বিশিষ্ট বাঙলা সংগীত পেতে পারে নি।
রবীন্দ্রনাথ ধ্রুপদ-খেয়াল প্রভৃতি ভারতীয় শিল্পের প্রশস্ত রাজমার্গের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তিনি এগুলিকে উপেক্ষা করেন নি। প্রথম প্রথম শুদ্ধ বা প্রাচীন রাগরাগিণীর সংগীতের মোহে তিনিও পড়েছিলেন এবং তাতে ফল ভালোই হয়েছিল। প্রথম জীবনে রচিত তাঁর অনেক গানের সুরে আমরা শুদ্ধ প্রাচীন সংগীতের পূর্ণ অনুসরণ দেখতে পাই। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়,—তাঁর সুপরিচিত ব্রহ্ম-সংগীতটি—
তোমারি মধুর রূপে ভরেছে ভুবন …।
এটি ঝিঞ্ঝৌটী (বা ঝিঝিঁট) রাগের একটি বিখ্যাত ধ্রুপদচৌতালের ব্রজভাষা গানেরই সুরের পুরা অনুকরণ; এই প্রাচীন ব্রজভাষা বা হিন্দী গানটি এই; কার রচনা এটি জানিনে—
তেরৌ রী নয়ন বান, ভৌ হে ধনুখ, চৌন্দ্র-বদন-পর ঝলকতমোহত মন।।
অরুন-বরন অধর, দৌন্ত কুন্দন বহার দেত;
সোহৈ ঐসী বেনী সির-পর—নাগ কৌ ফন।।
স্রবন কুন্ডল, নাস বেসর, কৌন্ঠ মাল ভুজ ম্রিনাল, কুচু উতৌঙ্গ,
নাভি ভ্রমর; পহিরৈ নীল সাড়ী।।
কটি কিঙ্কিনী, কদলী-খৌম্ভ জৌঙ্ঘ, চরম কনক-নূপুর;
চলত চাল গতি মরাল, জোবন-ভরী।।
কিন্তু নিছক ধ্রুপদের মৃদঙ্গ-নির্ঘোষ—কালোয়াতি সংগীতের, শুদ্ধ বা উচ্চ হলেও, এ-যুগের লোক আমাদের মধ্যে বেশির ভাগের কাছে, কতকটা আড়ষ্ট আর প্রাণহীন গীত—সকলকার প্রীতিদায়ক হয় না; সংগীতেও এমন সব জিনিস চাই, যা তার আশপাশের জীবনের পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্যুত বা পৃথগভূত নয়। এইজন্যই, যেমন মধ্যযুগের হিন্দি-বাঙলা ভেঙে আধুনিক হিন্দি-বাঙলা, তেমনি মধ্যযুগের সংগীতের ধারা কালোয়াতি সংগীতের বিকাশে বা বিকারে জাত আধুনিক সংগীত রবীন্দ্রনাথকে সহজভাবেই টেনে নিলে। সংস্কৃতচর্চার বারণ নেই, কিন্তু ভাষার চর্চাও চাই; সংস্কৃতচর্চা নিজেই একটা উদ্দেশ্য হতে পারে, কারণ তা একটি বড়ো দরের মানসিক বা আধ্যাত্মিক আনন্দের সাধনস্বরূপ হয়ে থাকে; কিন্তু সংস্কৃতচর্চা বাঙলাভাষার উন্নতির জন্যও হতে পারে। উচ্চ অঙ্গের সংগীত কতকটা আধুনিক সংগীতেরই পটভূমিকাস্বরূপ বিদ্যমান, তাই তার চর্চা আবশ্যক—আধুনিক সংগীতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ কথাটি বলা যায়।
অপূর্ব রসানুভূতির অধিকারী রবীন্দ্রনাথ যখন গান বাঁধতে আর সুর দিতে নিযুক্ত হলেন, তখন তাঁর সৃষ্ট বাঙলা গানের সুর একটা স্বতন্ত্র বস্তু হয়ে দাঁড়াল। তিনি গানে কথার যথোচিত মূল্য দিলেন। গানের বাণী বা কথা, আর গানের সুর, এই দুয়ের হাত ধরাধরি করে না চললে একটিকে না দেখে কেবল অন্যটির দিকেই দৃষ্টি দিলে, গান আর গান থাকে না, হয়ে দাঁড়ায়—হয় খালি কবিতা, নয় কেবল গৎ। বাক্য আর অর্থের মতো, কথা আর সুরের হর-গৌরী মিলন হলেই সত্যকার ‘গান’ হয়। কবি নিজেই তাই গেয়েছেন—
প্রতিদিন তব গাথা গাবো আমি সুমধুর,
তুমি মোরে দাও কথা, তুমি মোরে দাও সুর।।
প্রাচীন ‘বাগগেয়-কবি’ অর্থাৎ সংগীত-রচকেরা একথা বুঝতেন; সেইজন্যই জয়দেবের পদের এত যত্নসাধ্য লালিত্য; তানসেন প্রমুখ ধ্রুপদ আর অন্য সংগীত রচকেরাও বুঝতেন—তানসেন, আমার মনে হয়, কেবল সংগীতকার ছিলেন না, বড়ো দরের কবিও ছিলেন, তা তাঁর রচিত বাণী বা কথায় কেবল উপলব্ধি করা যায়। তানসেনের কাছেও তাঁর গানের কথা বা বাণী যথোচিত মর্য্যাদা পেয়েছিল। তাঁর রচিত একটি গানের শেষে তিনি বলেছেন—
তানসেন অন্তর-বাণী ধুরুপদ পুকার।।
অর্থাৎ, তানসেনের অন্তরের বাণী এই ধ্রুপদ গানেই উচ্চ রবে ঘোষিত হচ্ছে।
কিন্তু মাঝের যুগের ওস্তাদ বা কালোয়াত অর্থাৎ গায়ক, যাঁদের হাতে বেশি করে সংগীত-শিক্ষা সমাজের তরফ থেকে দেওয়া হয়ে থাকে তাঁরা একথাটা প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন। তাঁরা হয়ে পড়েন সংগীতের নিছক বৈয়াকরণ; সংগীতের কথার মূল্য তাঁদের কাছে বড়ো একটা ছিল না—যা তা শব্দ বা অক্ষর হলেই তাঁদের চলত। বাঙলার ওস্তাদের হাতে তানসেনের শুদ্ধ ব্রজভাষার মতো অমন সুন্দর আর মার্জিত একটা সাহিত্যের ভাষার কী ‘হেনস্থা’ই না ইদানীং হয়েছিল! অজ্ঞাতার্থ হিন্দী শব্দের কথা ছেড়ে দিচ্ছি, পশ্চিমা উচ্চারণে শুদ্ধ সংস্কৃত কথাগুলিরও অদ্ভুত সব বিকৃতি ঘটেছিল; ‘সদ্যোজাত’ হয়ে গিয়েছিল ‘সাধ্বেও জাত’, ‘মোক্ষদায়িনী’ (উচ্চারণে ‘মোচ্ছ-দায়িনী’) হয়ে গিয়েছিল ‘মুচ্ছে দায়িনী’, ‘পক্ষিগণ’, ‘পাচিগণ’; ‘অধ্যয়ন’, ‘আধোয়ান’; আর ‘বীচ মেঁ’ হয়ে গিয়েছিল ‘বিছুমে’; ‘উমড়-ঘুমড়’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘উমডে গুমডে’; ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত গদ্যকাব্য কাদম্বরী-র সৌন্দর্য বিশ্লেযণ করে সুন্দর আর বাঙলা-সাহিত্যে সুপরিচিত প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তাতে এ সম্বন্ধে তিনি বলেছেন—গানের কথায় আছে ‘চলত রাজকুমারী’, কিন্তু সুরের মোহে পড়ে গিয়েছেন ওস্তাদ গাইয়ে, তিনি ঘুরে ফিরে ‘চ-ল-ত’ শব্দটিকে নিয়েই সুরের পেঁচ কষতে লেগে গিয়েছেন—এদিকে রাজকুমারীর চলা আর হয় না, কালোয়াতি সংগীতের সমঝদারদের তাতে আপত্তি নেই। গানের মধ্যে কথার মূল্যের প্রতি তিনি আবার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এ সম্পর্কে একথাও স্বীকার্য যে, বাঙলার কীর্তনে সুর আর বাজনার একটা বড়ো স্থান থাকলেও কথার উপরেই একটু বেশি জোর দেওয়া হত—কীর্তনের মধ্যে আখর দেবার রীতি এর-ই ফল; এইজন্যও বোধহয় ওস্তাদ-মহলে কীর্তন জাতে উঠতে পারে নি।
রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব সম্বন্ধে ভারতবর্ষে সুপরিচিত ওলন্দাজ-জাতীয় সংগীতবিৎ ও গবেষক শ্রীযুক্ত (অধুনা পরলোকগত) আর্নল্ড বাকে যা বলেছেন তা উদ্ধার করে দেওয়া যায়—
Knowing the old rāgas perfectly well, he too had the right to use and change them as his own inspiration told him to do. Had not the old mystics created their own rāgas, the BāÜls their own tunes, and had not Kīrtan adapted the old forms to new needs?
His perfect balance of words and melody, and his simplicity and conciseness of construction, are contributions to the whole of Indian music that cannot be under-rated easily.
It is characteristic of the genius of Rabindranath Tagore that he has, as if by instinct, found the Dhrūpad the only form in ancient Indian music that could serve as a basis for his creations. From long before the Muhammedan conquest, even upto our present days, this form of Indian music, regarded as most sacred, continued to exist, in which the words had and have their importance. Still the holy character implied the use of very difficult tune and very dignified rāgas. The poet has succeeded in keeping the essential features of construction, but nevertheless has made the form supple and clear, fit for the direct appeal even to the heart of the simple peasant.
This happy combination of the Dhrūpad and folk-music is the strongest feature of the musical aeuvre of Tagore. (‘Rabindranath Tagore’s Music’, in the Golden Book of Tagore).
কথা আর সুর পরস্পরের সঙ্গে এতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত থাকার দরুনই রবীন্দ্রনাথের গানের এতটা জনপ্রিয়তা। তা ছাড়া, কথার নিজের বিশেষ কাব্যসৌন্দর্য আর মর্যাদা বুঝে, তাকে তিনি তাঁর সংগীত-রচনায় যথোচিত স্থান দেন। বাঙলার বাউল আর ভাটিয়াল, বাঙলার কীর্তন—Folk-lore অর্থাৎ ‘লোক-যান’ (অর্থাৎ কিনা আধুনিক শিক্ষা হতে দূরে থেকে, প্রাচীন মনোভাব নিয়ে যেসব গ্রামীণ ব্যক্তি প্রাচীন সংস্কৃতির আবহাওয়ায় পরিবর্ধিত হয়ে চিরাচরিত রীতিতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন, তাঁদের চর্যা অর্থাৎ আচার এবং বিচার, সংগীতও এর অন্তর্গত) আলোচনা করেন এমন পন্ডিত, অথবা গ্রামীণ প্রাচীন পদ্ধতির জীবনের প্রতি দরদী লোকেরা, হয়তো কালেভদ্রে যার চর্চা করবেন, কিন্তু যা ক্রমে শিক্ষার আর আধুনিকতার প্রসারের সঙ্গে ‘সেকেলে’ আর ‘গ্রাম্য’ বলে লুপ্ত হয়ে যাবে—এরকম লোকসংগীতের গন্ডির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রসাদে আর নিবদ্ধ রইল না, বাঙালির জাতীয় সংগীতের পর্যায়ে উন্নীত হল; শিক্ষিত বাঙালিসমাজে স্থান পেয়ে, রবীন্দ্রনাথের গানে স্থান পেয়ে, বাঙলার এইসব লোকসংগীত এখন নিখিল ভারতের নিকট গৃহীত হচ্ছে; তাই আমরা হিন্দী আর অন্য ভাষায় সবাক চিত্রের গানে কীর্তন ভাটিয়ালি বাউলের ঝংকার মাঝে মাঝে শুনছি। শ্রীযুক্ত বাকে এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ করে লিখেছিলেন—It was the folk-music of Bengal that stirred the depth of his nature with such wonderful results. তিনি আরও মন্তব্য করেছেন:
Only the fact that the educated classes of his country who live in towns have lost contact with the real folk-life accounts for the discredit of his music in the appreciation of so many who love and admire his poems.
এ-কথাটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও, আংশিকভাবে ঠিক তো বটেই। পূর্ববঙ্গের বাউল আর ভাটিয়াল, আর পশ্চিমবঙ্গের কীর্তন—এইতে মিলে তাঁকে সারা বাঙলার লোকসংগীতের রাজা করে তুলেছে।
রবীন্দ্রসংগীতের আর একটি বড়ো জিনিস হচ্ছে, তাঁর দেওয়া সুরের মধ্যে তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্যটুকু—the Rabindra touch. আমরা ‘হিন্দুস্থানী দরদ’-এর কথা শুনি, হিন্দী গানে কোথাও কোথাও তা অনুভবও করি। দু-একটা এমন খোঁচ-খাঁচ, টান-টোন, গলায় কাঁপুনি গানের সুরের মধ্যে থাকে, তাতেই জিনিসটি একেবারে যেন কোন ঊর্ধ্বে উঠে যায়, তার সাধারণত্ব আর থাকে না। এই Rabindra touch—রবীন্দ্রের পুণ্যস্পর্শ, রবীন্দ্রের হাত, বা রবীন্দ্রশ্রী—আমরা সকলেই বুঝি, রবীন্দ্রসংগীতের ভালো গাইয়েরা এইটুকুই প্রকাশ করতে পারেন বলেই তাঁদের কদর। ‘আমারে করো তোমার বীণা’, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’, ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’, ‘অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বার বার ফিরে আসে’, ‘এসো, এসো বসন্ত ধরাতলে’, ‘আমার নিশীথ-রাতের বাদল-ধারা’, ‘কার বাঁশী বাজিল’, ‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’, ‘মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে’—ইত্যাদি ইত্যাদি কত গান মনে পড়ে, যা তরুণ অবস্থা থেকে শুনে আসছি, দরদী গায়কের মুখের ধ্বনি যেসব গানের সুরের মধ্যে নিহিত এই অবর্ণনীয় রবীন্দ্র-শ্রীটুকু ফুটিয়ে তুলে, মনের মধ্যে একটি অব্যক্ত আকুলতা এনে দিয়েছে, এখনও এনে দেয়। গুরু-পরম্পরায়, আর রেকর্ডের সাহায্যে এই জিনিসটি রক্ষিত হতে পারবে। কালের স্থূল হস্তাবলেপের ফলে এই রাবীন্দ্রিক শ্রীটুকু হয়তো বা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে; কিন্তু তাহলে রবীন্দ্র-সংগীতের অনেকটাই চলে যাবে। আশা করি, এই জিনিসটুকু আধুনিক ভারতীয় সংগীতে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশিষ্ট দান বলে, এটুকুর রক্ষার জন্য সকলেই অবহিত হবেন। এটা একটা বিশেষ ঢঙ বা ভঙ্গী নয়; এটি আরও সূক্ষ্ম, তুলির টানের মতন গলার বিশেষ রেশের ব্যাপার। আমার মতন অনভিজ্ঞ মানুষের কানে যেভাবে এই Rabindra touch-এর প্রকাশটুকু তার স্পর্শ এনে দিয়েছে, কেবল তারই বিষয়ে কিছু বলবার জন্য এই অক্ষম চেষ্টামাত্র করলুম—বিশেষজ্ঞরা আমার কথাগুলি ক্ষমা-ভাবের সঙ্গে গ্রহণ করবেন।
এইসব, নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু জড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে ভারতের সংগীতের ইতিহাসে তার একটা নিজস্ব স্থান দিয়েছে। আমাদের দেশের বড়ো সংগীতকারদের সঙ্গে তুলনা করবার দরকার নেই; মহাকাল যথাসময়ে যার যে স্থান তা ঠিক করে দেবেন; কিন্তু ভারত-সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে ভারত-সংগীতের আলোচনা করতে গেলে, আধুনিককালে ভারতের সংগীত বিষয়ক প্রচেষ্টার সম্বন্ধে কিছু বলতে হলেই, রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ না করে পারা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সংগীতে ইউরোপীয় সংগীতের Harmony অর্থাৎ বিবাদের মধ্যে সংবাদ আনবার পক্ষেও ছিলেন। পথিকৃৎ বা সংস্কারক না হলেও, সংগীতের বাণী আর সুর উভয়েরই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন অসাধারণ রসস্রষ্টা।
রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩৫০ সালে গীতবিতান বার্ষিকী-তে; পরে ১৩৭২ সালে, স্বল্প সংশোধন ও সংযোজনসহ, লেখকের প্রবন্ধ-সংকলন সাংস্কৃতিকী দ্বিতীয় খন্ডে পুনর্মুদ্রিত হয়