ভারতশ্রেষ্ঠ নাট্যশিল্পী
জীবনে উৎসবের দিন, লগ্ন ইত্যাদির নির্বাচন সম্ভব, কিন্তু অনিবার্য আঘাতের নয়। আজ সন্ধ্যায় আমাদের নাটকের দ্বিশত রজনীর পূর্তি উৎসব ছিল। সন্ধ্যার আগের বিকেল এক দুঃসহ বার্তায় নাট্যমঞ্চ নিষ্প্রদীপ করে দিল। উৎপল দত্তর সঙ্গে প্রকৃত অর্থে পরিচয় হয়েছিল অভিনয় জগতে প্রবেশের পর। তার আগে ওঁর থিয়েটার দেখেছি। সামান্য পরিচয় ছিল, তবে সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। আমি তখন মির্জাপুর স্ট্রিটে থাকি। সেটা সম্ভবত ১৯৬২। সাধারণ নির্বাচন হবে। সিনেমার নায়ক হিসেবে আমার সমর্থনের একটা মূল্য আছে ভেবে কমিউনিস্ট প্রার্থী ডাঃ নারায়ণ রায় আমাকে সাহায্য করতে বলেছিলেন, আমিও তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছিলাম। ভোটপর্ব শেষ হওয়ার পর পাশের একটি কেন্দ্রের একজন কংগ্রেসি প্রার্থীর বিজয়োৎসব হিসেবে আমার বাড়ির সামনে বিশেষভাবে পটকা ফাটানো হয়, সঙ্গে ছিল প্রচুর সমর্থকের উল্লাসধ্বনি, তাসা পার্টির বাজনা ইত্যাদি। ঘটনাটির খবর পেয়ে আমার অনেক শুভানুধ্যায়ী উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। সেই সময় উৎপলদা আমি বিচলিত না হওয়ায় আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন, অন্তরঙ্গ সম্পর্কের সেই শুরু। তারপর দীর্ঘকাল দুজনের জীবন এই শহরেই কেটেছে বলেই নয়, জীবিকাও আমাদের দুজনের সম্পর্ক দৃঢ়তর করেছে। বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়, কিন্তু তা কখনও বন্ধুত্বে বাধা হয়নি। অনেকদিনের হাজার টুকরো স্মৃতি একইসঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়াতে চাইছে, ছোট্ট স্টেজে একসঙ্গে হঠাৎ অনেক চরিত্র ঢুকে পড়লে যেমন হয় আর কি। পুরনো ক্যালেন্ডার কে আর তেমন যত্নে রাখে, যদি না সেখানে কোনও স্মৃতি-সূত্র লুকনো থাকে। ১৯৬৪-তে ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ময়দানে সভা হবে, বড় সভার আগে ছোট সভা করা দরকার, ঘরের মধ্যে। নিরঞ্জন সেনের বাড়িতে আমাদের বৈঠক হল, যতদূর মনে পড়ে সেই বৈঠকে ছিলেন অজিত লাহিড়ী, রবি সেনগুপ্ত, নির্মল ঘোষ, উৎপলদা এবং আমি। জ্যোতি বসুও সেই বৈঠকে এসেছিলেন। ময়দানে সভায় কী করা হবে তা ঠিক হয়ে গেল। তখন তো মনুমেন্ট, তার পাদদেশে বিশাল জনসভা। উৎপল দত্তর পরিচালনায় নাটক হল— ‘অজেয় ভিয়েতনাম’। সভার শুরুতে আমাকে প্রস্তাব পাঠের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অনেক পরে অভিনেতৃ সঙ্ঘের নাট্যোৎসবে উৎপলদাকে দিয়ে ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ নাটক পরিচালনা করিয়েছিলাম, সেই সব দিনের স্মৃতি আজও একইরকম উজ্জ্বল আছে। ৫টি শো হয়েছিল। উৎপলদার প্রত্যক্ষ অনুরোধে ‘স্ল্যুথ’-এর বঙ্গীকরণ করেছিলাম, সেই কঠিন কর্মটি একান্তে বসে করার জন্য আমাকে পালামৌ যেতে হয়েছিল। পড়ে উৎপলদা খুব খুশি হয়েছিলেন, ‘টিকটিকি’ তাঁরই দেওয়া নাম। পরম কৌতুকে দুজন দুজনকে ‘স্যার’ বলে ডাকতাম, তবে জীবনে কখনও কেউ কারও ওপর কোনও ধরনের শিক্ষকসুলভ আচরণ করিনি। অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন। বহু ছবিতে একইসঙ্গে অভিনয় করেছি, শুটিংয়ের ফাঁকে, আসা-যাওয়ার পথে কতদিন কত কাণ্ড ঘটেছে, লিখতে গেলে তা ১৪ কাহন হয়ে যাবে। তীক্ষ্ণ রসবোধের অব্যর্থ পরিচয় পাওয়া যেত সঙ্গে সঙ্গেই। কাশীতে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর শুটিং হচ্ছে, ওখানে একজন প্রবাসী বাঙালি হঠাৎ এসে হাজির, তিনি আমাদের দুজনেরই নাকি অত্যন্ত ভক্ত। ভক্তিতে আপত্তি ছিল না, কিন্তু ভদ্রলোক একজন উচ্চাভিলাষী সাহিত্যিক, তাঁর নবতম সৃষ্টি পড়ে আমাদের মতামত জানাতে হবে। উৎপলদা তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে খুব গম্ভীর হয়ে ‘আমার সময় নেই’ বলে এড়িয়ে গেলেন। আমি এড়াতে পারলাম না। পাণ্ডুলিপি নিয়ে হোটেলের ঘরে গিয়ে কয়েক পাতা পড়ার পর হাসির চোটে পেট ফাটার মতো অবস্থা। উৎপলদাকে দিলাম, সেই অমর রচনার এক জায়গায় লেখা ছিল— ‘কত কথা, কত কথা, কত কথা…’ উৎপলদা গলা ছেড়ে একেবারে রেলগাড়ির গতিতে পড়তে শুরু করে হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘স্রষ্টাকে ডাক, দেখি তাঁর নিজের কী প্রতিক্রিয়া হয়,’ সাহিত্যিক সেখানে ছিলেন না। গণনাট্যের সময় উৎপল দত্ত যে সব নাটক করেছিলেন তা আমি বিশেষ দেখিনি। অনেক আগে ‘অচলায়তন’ করেছিলেন। তার স্মৃতি ফিকে হয়ে গেছে। তবে, ‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ’ ইত্যাদি কেউ কখনও ভুলতে পারবেন? আমাদের অভিনয়-জীবনের কাল যদি আলাদা করে চিন্তা করি, তাহলে উৎপল দত্তকে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ নাট্যশিল্পী হিসেবে সম্মানিত করব। নাট্যশিল্পী অর্থে আমি সামগ্রিক নাট্য প্রযোজনার দক্ষতার কথা বলছি। স্টেজ, আলো, শব্দ, নাটক, অভিনয় ইত্যাদি সামগ্রিক দক্ষতায় উৎপল দত্ত একাই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন, এ ব্যাপারে অতিশয়োক্তির কোনও সুযোগ নেই, কারণ বাংলা নাটকের কর্মী ও দর্শকরা জানেন কথাটা সত্যের পুনরুক্তি মাত্র। শুনেছি তিনি জীবনের শুরুতে বাংলা ভাষাটা খুব ভাল জানতেন না, কিন্তু পরে তাঁর মুখের ও লেখার বাংলায় অবাক হয়েছি। জিওফ্রে কেন্ডালের অভিনয়ধারায় জীবন শুরু করার পর বাংলা থিয়েটারের দীর্ঘ পথে তিনি বারবার প্রমাণ করেছেন প্রথা ভেঙে নতুন কিছু গড়ার ক্ষমতা তাঁর আছে। বাংলা নাটকের ঐতিহ্যে শ্রদ্ধাশীল থেকেই তিনি স্টেজ নিয়ে সার্থক ভাঙাগড়া করেছেন। চলচ্চিত্রের অভিনেতা উৎপল দত্তকেও একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, সেখানেও তাঁর কাজ ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, পরিমার্জিত এবং বাস্তবিকই উঁচুদরের। নির্দেশক, অভিনেতা, নাট্যকার উৎপল দত্তর পাণ্ডিত্য নিয়ে গবেষণা হতে পারে, হওয়া উচিত। বাংলা নাটকে তাঁর অবদান কতটা গভীর ও মূল্যবান তার মূল্যায়ন হয়নি (আমাদের দেশে এর বিশেষ প্রচলন নেই)। তবে উৎপলদা সারাজীবন বিস্তর লেখালেখি করেছেন, তাঁর রচনা মূল্যায়নকর্মে সাহায্য করবে। তাঁর কয়েকটি মূল্যবান বই তিনি উপহার দিয়েছিলেন, তার মধ্যে ‘গিরিশ মানস’ আমাকে মুগ্ধ করেছে। গিরিশ ঘোষ সম্পর্কে উৎপলদাকে উৎসাহিত করেছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। বইটির উৎসর্গপত্রে উৎপলদা লিখেছিলেন— বিশ বছর আগে যিনি গিরিশ-প্রতিভার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, সেই নটশ্রেষ্ঠ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের করকমলে—
আমি রত্নাকর নই। তবে এই অভিনেতা-জীবনে এমন সব গুণগ্রাহী মানুষের সঙ্গও যে পেয়েছিলাম এটাই বড় প্রাপ্তি। ‘স্যার’ চলে গেলেন। যাওয়ার কোনও খবর না দিয়েই। নিজের অজান্তেই যেন কেউ ঘরের প্রিয় ছবিগুলো উল্টে দিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন স্থবির, বসে আছি, বাধা দেব কী করে?