ভারতমাতা

ভারতমাতা

শ্রীশ্রীঈশ্বর সহায়

পরম পূজনীয়া

শ্ৰীমতী মাতাঠাকুরাণী

কটক

শনিবার

শ্রীচরণকমলেষু,

মা,

আজ নবমী; সুতরাং আপনি এখন দেশে—দেবীর আরাধনায় নিমগ্ন আছেন।

এ বৎসর বোধ হয় পূজা বেশী জাঁকজমকে সম্পন্ন হইবে। কিন্তু মা, জাঁকজমকে প্রয়োজন কি? যাঁহাকে আমরা ডাকি—তাঁহাকে যদি প্রাণ খুলিয়া গদগদ কণ্ঠে ডাকিতে পারি তাহা হইলে যথেষ্ট হইল; আর অধিক কি প্রয়োজন? যে পূজায় আমরা ভক্তিচন্দন ও প্রেম-পুষ্প ব্যবহার করিতে পারি তাহাই জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পূজা। জাঁকজমকের সম্মুখে ভক্তি পলায়ন করে! এবার একটা দুঃখ রহিয়া গেল। সেটা বড় বেশী দুঃখ—সাধারণ দুঃখ নহে। এবার দেশে যাইয়া সেই ত্রৈলোক্যপূজ্যা সর্বদুঃখহরিণী, মহিষাসুরমর্দিনী জগন্মাতা দুর্গাদেবীর সর্বাভরণভূষিতা নানা সাজসজ্জিতা, দেদীপ্যমানা-জ্যোতির্ময় মূর্তি দর্শন করিয়া নয়ন সার্থক করিতে পারিলাম না; এবার পুরোহিত মহাশয়ের সেই মধুর, পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণ বা তাঁহার শঙ্খ ও ঘণ্টাধ্বনি কর্ণগোচর করিয়া শ্রবণশক্তি চরিতার্থ করিতে পারিলাম না; এবার কুসুম চন্দন ও ধূপাদির পবিত্র গন্ধের দ্বারা নাসিকাদ্বয়কে পবিত্র করিতে পারিলাম না; এবার একত্র বসিয়া দেবীর প্রসাদ ভক্ষণ করিয়া রসনেন্দ্রিয়কে পরিতৃপ্ত করিতে পারিলাম না; এবার পুরোহিত প্রদত্ত কুসুমরাশির দ্বারা স্পর্শেন্দ্রিয়কে ধন্য করিতে পারিলাম না এবং সর্বোপরি “শান্তি জলে”র অভাবে শান্তি লাভ করিতে পারিলাম না, সবই নিস্ফল হইল; পঞ্চেন্দ্রিয় নিষ্ফল হইল। কিন্তু যদি দেবীর সর্বত্র বিরাজমানা, অম্বরব্যাপিনী মূর্তি দেখিতে পাইতাম, তাহা হইলে মা, সে দুঃখ ঘুচিত—কাষ্ঠপুত্তলিকা দেখিবার ইচ্ছা হইত না; কিন্তু সে আনন্দ, সেইরূপ সৌভাগ্য কয়জনের কপালে ঘটিয়া থাকে। কাজে কাজেই আমার এই দুঃখ রহিয়া গেল।

বিজয়া দশমীর দিন এখানে পড়িয়া থাকিব কিন্তু মন আপনাদের নিকটেই থাকিবে। এরূপ পুণ্য দিবসে এত আনন্দ হইতে বঞ্চিত রহিলাম। আর উপায় নাই—কল্য রাত্রে আমরা এখান হইতে আপনাদিগকে প্রণাম করিব।…

……………….

কটক

রবিবার

ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের স্থান—এই মহাদেশে লোকশিক্ষার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে অবতার রূপে জন্মগ্রহণ করিয়া পাপক্লিষ্টা ধরণীকে পবিত্র করিয়াছেন এবং প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ধর্মের ও সত্যের বীজ রোপণ করিয়া গিয়াছেন। ভগবান মানবদেহ ধারণ করিয়া নিজের অংশাবতার রূপে অনেক দেশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু এতবার তিনি কোনও দেশে জন্মগ্রহণ করেন নাই—তাই বলি আমাদের জন্মভূমি ভারতমাতা ভগবানের বড় আদরের দেশ। দেখ, মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে—প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দারুণ শীত, ভীষণ বৃষ্টি আবার মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি—স্বচ্ছসলিলা, পুণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কূল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে—কি পবিত্র নদী! দেখিবামাত্র বা ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে—তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন—রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা, সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে, স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরী-তীরে কালহরণ করিতেছেন—সাংসারিক দুঃখের বা চিন্তার ছায়া আর তাঁহাদের প্রসন্ন বদনকমলকে মলিন করিতেছে না—প্রকৃতির উপাসনা ও ভগবানের আরাধনা করিয়া তাঁহারা তিনজনে মহা আনন্দে কাল কাটাইতেছেন—আর এদিকে আমরা সাংসারিক দুঃখানলে নিরন্তর পুড়িতেছি। কোথায় সে সুখ, কোথায় সে শান্তি! আমরা শান্তির জন্য হাহাকার করিতেছি! ভগবানের চিন্তন ও পূজন ভিন্ন আর শান্তি নাই। যদি মর্ত্যে কোনও সুখ থাকে তাহা হইলে গৃহে গৃহে গোবিন্দের নামকীর্তন ভিন্ন আর সুখের উপায় নাই। আবার যখন উর্ধ্বে দৃষ্টি তুলি, মা, তখন আরও পবিত্র দৃশ্য দেখি। দেখি—পুণ্য-সলিলা জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে—আবার রামায়ণের আর একটি দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন—দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠোদ্ভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত—দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসিয়া আছেন—তাঁহার পদতলে দুইটি শিষ্য—কুশ ও লব—মহর্ষি তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। পবিত্র বেদধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রূর সর্পও নিজের বিষ হারাইয়া, ফণা তুলিয়া নীরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে—গোকুল গঙ্গায় সলিল পান করিবার জন্য আসিয়াছে—তাহারাও একবার মুখ তুলিয়া সেই পবিত্র মন্ত্রধ্বনি শুনিতেছে—শুনিয়া কর্ণদ্বয় সার্থক করিতেছে। নিকটে হরিণ শুইয়া আছে—সমস্তক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে মহর্ষির মুখপানে চাহিয়া আছে। রামায়ণে সবই পবিত্র—সামান্য তৃণের বর্ণনা পর্যন্তও পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা আমরা ধর্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারি না। আর একটি পবিত্র দৃশ্য মনে পড়িতেছে। ত্রিভুবনতারিণী কলুষ-হারিণী ভাগীরথী চলিয়াছেন—তাঁহার তীরে যোগিকুল বসিয়া আছেন—কেহ অর্ধনিমীলিত নেত্রে প্রাতঃসন্ধ্যায় নিমগ্ন—কেহ কাননের পুষ্পরাজি তুলিয়া প্রতিমা গড়িয়া চন্দন ধূপ প্রভৃতি পবিত্র সুগন্ধি দ্রব্য দিয়া পূজা করিতেছেন—কেহ মন্ত্রোচ্চারণে দিগ্‌দিগন্ত মুখরিত করিতেছেন, কেহ গঙ্গার পবিত্র সলিলে আচমন করিয়া আপনাকে পবিত্র করিতেছেন—কেহ গুন গুন করিয়া গান করিতে করিতে পূজার জন্য বনফুল তুলিতেছেন। সকলই পবিত্ৰ—সকলই নয়ন ও মনের প্রীতিকর। কিন্তু হায়! যখন ভাবি সেই পুণ্যশ্লোক ঋষিকুল কোথায়? তাঁহাদের সেই যাগযজ্ঞ, পূজা হোম প্রভৃতি কোথায়? ভাবিলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়! আমাদের ধর্ম নাই, কিছুই নাই—জাতীয় জীবন পর্যন্তও নাই। আমরা এখন এক দুর্বল শরীর পরদাসত্ব-ব্যবসায়ী, নষ্টধর্ম, পাপিষ্ঠ জাতি! হায়! পরমেশ্বর! সেই ভারতের এখন কি শোচনীয় অবস্থা উপস্থিত! তুমি কি আমাদের উদ্ধার করিবে না? এ ত তোমারই দেশ—কিন্তু দেখ ভগবান, তোমার দেশের কি অবস্থা! তোমার অবতারগণ যে সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা কোথায়? আমাদের পূর্বপুরুষ আর্যগণ যে জাতি এবং যে ধর্ম গঠিত ও প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা এখন ছারখার হইয়াছে। দয়া কর, রক্ষা কর, ওহে দয়াময় হরি!

মা, আমি যখন চিঠি লিখিতে বসি তখন পাগলের চেয়েও পাগল। কি লিখিব ভাবিয়া লিখিতে বসি না এবং কি বা লিখিতে পারি তাহা জানি না। মনে যে ভাবটি আগে আসে তাহাই লিপিবদ্ধ করি—ভাবি না কি লিখিতেছি বা কেন লিখিতেছি।…

……………….

রাঁচি

রবিবার

মা, আমার মনে হয় এ যুগে দুঃখিনী ভারত মাতার কি একজন স্বার্থত্যাগী সন্তান নাই—মা কি প্রকৃতই এত হতভাগ্যা! হায়! কোথায় সেই প্রাচীন যুগ! কোথায় সেই আর্যবীরকুল যাঁহারা ভারতমাতার সেবার জন্য হেলায় এই অমূল্য মানব জীবনটা উৎসর্গ করিতেন।

মা, আপনি তো মা, আপনি কি শুধু আমাদের মা? না মা, আপনি ভারতবাসী মাত্রেরই মা—ভারতবাসী যদি আপনার সন্তান হয় তবে সন্তানদের কষ্ট দেখিলে মা’র প্রাণ কি কাঁদিয়া উঠে না? মা’র প্রাণ কি এতটা নিষ্ঠুর? না, কখনই হইতে পারে না—মা ত কখনও নিষ্ঠুর হইতে পারেন না। তবে সন্তানদের এই শোচনীয় দুরবস্থার সময়ে মা কি করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছেন! মা, আপনি ত ভারতের সর্বত্র ভ্রমণ করিয়াছেন—ভারতবাসীর অবস্থা দেখিলে এবং তাহাদের দুরবস্থার কথা ভাবিলে আপনার প্রাণ কি কাঁদে না? আমরা মূর্খ—আমরা স্বার্থপর হইতে পারি কিন্তু মা ত কখনও স্বার্থপর হইতে পারেন না—মা’র জীবন যে সন্তানের জন্য! যদি তাহাই হয় তবে সন্তানের কষ্টের সময়ে মা কি করিয়া স্থির হইয়া বসিয়া আছেন! তবে কি মা স্বার্থপর! না, না, কখনই হতে পারে না—মা কখনও স্বার্থপর হতে পারে না।

মা, শুধু দেশের কি এরূপ শোচনীয় অবস্থা! দেখুন ভারতের ধর্মের কি অবস্থা! কোথায় সেই পবিত্র সনাতন হিন্দুধর্ম, আর কোথায় আমাদের অধঃপতিত ধর্ম! কোথায় সেই পবিত্র আর্যকুল—যাঁহাদের পদধূলি লইয়া পৃথিবী পবিত্র হইয়াছে—আর কোথায় আমরা তাঁহাদেরই অধঃপতিত বংশধর! সে পবিত্র সনাতন ধর্ম কি লোপ হইতে চলিল! দেখুন না চারিদিকে নাস্তিকতা অবিশ্বাস এবং ভণ্ডামি—তাই ত লোকেদের এত পাপ, এত কষ্ট, দেখুন না সেই ধর্মপ্রাণ আর্যজাতির বংশধর এখন কিরূপ বিধর্মী ও নাস্তিক হইয়া পড়িয়াছে! যাঁহার নাম, গুণগান ও ধ্যানই জীবনের একমাত্র কর্তব্য ছিল তাঁহার নাম সমস্ত জীবনে ভক্তির সহিত একবার কয়জন লোক আজকাল ডাকে! মা, এসব দেখিলে এবং ভাবিলে, আপনার প্রাণ কি কাঁদে না, আপনার চক্ষে কি জল আসে না? সত্য সত্যই কি আপনার প্রাণ কাঁদে না—কখনই হইতে পারে না। মা’র প্রাণ ত কখনও নিষ্ঠুর হয় না!

মা, একবার চক্ষু খুলিয়া দেখুন, আপনার সন্তানদের কি দুরবস্থা! পাপে, তাপে, সর্বপ্রকার কষ্টে, অন্নাভাবে, ভালবাসার অভাবে—এবং হিংসা ও স্বার্থপরতার জন্য এবং সর্বোপরি ধর্মের অভাবের জন্য তারা যেন নরকের অগ্নিকুণ্ডে অহোরাত্র জ্বলিতেছে। আর দেখুন, পবিত্র সনাতন ধর্মের কী অবস্থা! দেখুন, সেই পবিত্র ধর্ম এখন লোপ পাইতে চলিল। অবিশ্বাস, নাস্তিকতা, এবং কুসংস্কারে আমাদের সেই পবিত্র ধর্ম এখন কতদূর অধঃপতিত ও অপভ্রষ্ট হইয়াছে। তার উপর, আজকাল ধর্মের নামেই যত অধর্ম হইতেছে—তীর্থস্থানেই যত পাপ! দেখুন না পুরীর পাণ্ডাদের কি ভীষণ অবস্থা! ছি! ছি!! ছি!!! প্রাচীন কালের সেই পবিত্র ব্রাহ্মণকে দেখুন, আর আধুনিক কালের পাপী ব্রাহ্মণকে দেখুন! আজকাল যেখানে ধর্মের নাম সেইখানেই যত ভণ্ডামি এবং যত অধর্ম।

হায়! হায়!! আমাদের কি অবস্থা! আমাদের ধর্মের কি অবস্থা।

মা, এ সব কথা যখন আপনার হৃদয়ে প্রবেশ করে তখন কি আপনার প্রাণকে আকুল করিয়া ফেলে না? আপনার প্রাণ কি কাঁদে না?

আমাদের দেশের অবস্থা কি দিন দিন এইরূপ অধঃপতিত হইতে থাকিবে—দুঃখিনী ভারতমাতার কোন সন্তান কি নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়া মা-এর জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করিবে না?

মা, আমরা আর কয়দিন ঘুমাইয়া থাকিব? আর কয়দিন আমরা পুতুল লইয়া খেলিতে থাকিব? দেশের ক্রন্দন কি আমাদের কর্ণে আসছে না? আমাদের লুপ্তপ্রায় সনাতন ধর্ম কাঁদিতেছে—তাহার ক্রন্দন কি প্রাণকে অস্থির করিতেছে না?

বসিয়া বসিয়া আর কয়দিন দেশের এবং ধর্মের এই অবস্থা দেখিব? আর বসা চলে না—আর ঘুমান চলে না—এখন নিদ্রা ত্যাগ করিয়া আলস্য ত্যাগ করিয়া কর্মসাগরে ঝাঁপ দিতে হইবে, কিন্তু হায়! এ স্বার্থপর যুগে নিজের স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়া কয়জন স্বার্থত্যাগী সন্তান মা-এর জন্য কর্মসাগরে ঝাঁপ দিতে প্রস্তুত? মা, আপনার এ সন্তান কি প্রস্তুত নহে?…

আপনার

চিরস্নেহাধীন

সেবক

সুভাষ

মাতৃদেবীকে লেখা (১৯১২-১৩ সাল) কয়েকটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *