ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবি

ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবি

ফজলুল হকের এই ভূমিকা কেবলমাত্র জিন্নাকেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলেনি, ব্রিটিশ সরকারও তাঁর মতি-গতি দেখে উদ্বেগবোধ করেন। সম্প্রতি লন্ডনে মুদ্রিত ও প্রকাশিত The Transfer of Power 1942–7, Vols. I–II নামক বিশাল গ্রন্থে এই বিষয়ে অনেক মূল্যবান গোপনতথ্য উদঘাটিত হয়। তা থেকে জানা যায়, তখন ভারত সরকার ফজলুল হক সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর থেকে ৭ ডিসেম্বর ভারত সরকারের রিফর্মস কমিশনার (Reforms Commissioner) বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, তা লিখিতভাবে সরকারের নিকট পেশ করেন। এই রিপোর্টে জানা যায় ফজলুল হক বাদে প্রতিটি মুসলিম লিগ নেতা পাকিস্তান প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন। বড়োলাট লর্ড লিনলিথগো ভারত সচিব অ্যামেরীর কাছে একটি পত্রে এই তথ্য পরিবেশন করেন।

বোম্বের গভর্নরকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তিনি যেন জিন্নার সঙ্গে একান্তে কথা বলে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর মনোভাব জানবার চেষ্টা করেন। তাই স্যার আর. লুমলি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি জিন্নাকে তাঁর সঙ্গে দুপুরে খেতে নিমন্ত্রণ করেন। সেখানে দু-জনের মধ্যে অনেকক্ষণ আলাপ-আলোচনা হয়। প্রসঙ্গত লুমলি বাংলাদেশের রাজনীতি ও ফজলুল হক সম্পর্কে জিন্নার মনোভাব জানতে চেষ্টা করেন। লুমলি এই সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ লিনলিথগোকে পাঠিয়ে দেন। জিন্না বলেন: সৌভাগ্যবশত কংগ্রেস বাংলাদেশ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে অস্বীকার করায় ‘মুসলিম মন্ত্রীসভা’ গঠন করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই মন্ত্রীসভা অল্প ভোটের ব্যবধানে টিকে থাকায় জটিলতা মুক্ত নয়। শরৎচন্দ্র বসু ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর প্রভাবে ফজলুল হক নিজের বিশ্বাস ও বিবেচনার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করেছেন। অবশ্য লুমলির সামনে জিন্না ফজলুল হককে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেননি। লুমলি চিঠিতে জিন্নার উক্তি যেভাবে উল্লেখ করেছেন, তা এখানে উদ্ধৃত করা হল:

He (Jinnah) had reason to believe that Sarat Bose and Mukherjee had obtained documentary evidence about some shady transaction of Fazlul Huq’s, and they had blackmailed him to such an extent that the poor man had been forced to do many things, recently, against his convictions and his better judgment.

ফজলুল হক মনে করেন, অবিলম্বে স্বাধীনতা ভারতবাসীর হাতে অর্পণ করা উচিত। কারণ এই পথেই জিন্নার নীতি পরাস্ত করা সম্ভব। এই উদ্দেশ্যে ফজলুল হক ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত All India Azad Moslem Conference-এর সভায় যোগ দেন। সিন্ধু প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী খান বাহাদুর আল্লা বক্স সভাপতিত্ব করেন। এই সম্মেলনে আসফ আলি, ইফতিকারউদ্দিন নূরি (বোম্বের প্রাক্তন মন্ত্রী) ও ইব্রাহিম (যুক্ত প্রদেশের প্রাক্তন মন্ত্রী) প্রভৃতি বিখ্যাত মুসলিম নেতৃবৃন্দও অংশগ্রহণ করেন। বোর্ড অব অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স প্রস্তাবে উল্লেখ করে: ভারত যুদ্ধের বিপদ সীমায় এসে পৌঁছেছে। আক্রমণকারীর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য ভারতীয়দের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। যদি এই উদ্দেশ্য সফল করতে হয় তবে ভারতের স্বাধীনতা অবিলম্বে স্বীকার করতে হবে। অন্যান্য স্বাধীন দেশের মতো ভারতীয়দের এই সুযোগ দেওয়া উচিত। এই বিষয়ে ভারতীয়দের মধ্যে ঐকমত্য আছে। বহু সংখ্যক ভারতীয় এবং নয়টি মুসলিম সংগঠনের মুখপাত্ররূপে বোর্ড এই দাবি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে। মুসলিম লিগ মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বের অধিকারী, এইসব অজুহাত তুলে ব্রিটিশ সরকার ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। বিদেশি আক্রমণ যে বিশেষ জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে তাতে অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত। লিনলিথগো অ্যামেরির কাছে টেলিগ্রাম মারফত এই কনফারেন্সের বিস্তারিত বিবরণ পাঠান। এই টেলিগ্রামে আছে:

Specious plea of Secretary of State and British Government and Moslem League is Authoritative spokesman Moslem and that its attitude and demands constitute insuperable obstales in the way India’s freedom is indefensible subterfuge to mask disinclination of British Government to part with power.

এই সম্মেলনের প্রস্তাব নিয়ে ও উপস্থিত ব্যক্তিদের বিষয়ে ভারত সরকার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। সরকারি নোটে বলা হয়, এই সম্মেলনের প্রস্তাব ইত্যাদি সব কিছুই করেন আসফ আলি। ন-টি মুসলিম সংগঠন এর সঙ্গে যুক্ত ছিল, যথা, অহরর, জামিয়াত-উল-উলেমা, উগ্রপন্থী শিয়া, মোমিনদের একাংশ, ইত্তেহাদ-ই-মিল্লাত এবং রেডসার্ট প্রভৃতি দল। অকংগ্রেসী প্রভাবশালী মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন ফজলুল হক ও আল্লা বক্স। এই সময়ে ভারত সরকার আইনসভার ভেতরে ও বাইরে মুসলিম লিগের প্রকৃত ক্ষমতা এবং ফজলুল হক ও আল্লা বক্সের প্রভাব নিয়েও বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন। বাংলাদেশ ও আসামের আইনসভায় মুসলিম লিগের প্রভাব কম ছিল। বাংলার আইন সভায় ১১৭ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল ফজলুল হকের সমর্থক। অবশ্য নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে এইসব সমর্থকেরা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বাংলা ও পাঞ্জাবের আইনসভার বাইরে মুসলিম লিগ শক্তিশালী ছিল। পাঞ্জাব আইনসভার ৮৪ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে ১২ জন বাদ দিয়ে সবাই মুসলিম লিগের সভ্য ছিলেন। সিন্ধুর আইসভার ৩৩ জন মুসলিম সদস্যের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মুখ্যমন্ত্রী আল্লা বক্সের সমর্থক এবং ১১ জন মুসলিম লিগের সভ্য ছিলেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে লিগের কোনই প্রভাব ছিল না। যেসব প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যালঘিষ্ঠ সেখানে জিন্নার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আমরা এই চিত্র পাই।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ ফজলুল হক, ডাঃ খান সাহেব ও আল্লা বক্স একসঙ্গে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর নিকট টেলিগ্রাম পাঠিয়ে অবিলম্বে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা অর্পণের দাবি করেন। এই তিনজন ছিলেন তিনটি প্রদেশের প্রভাবশালী মুসলিম নেতা। স্বভাবতই ব্রিটিশ সরকার তাঁদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। টেলিগ্রামের ভাষা থেকেই এই তিনজন নেতার দৃঢ় ও স্পষ্ট মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়:

Most earnestly urge gravity situation occassioned by menace early invasion India imperatively demands immediate transfer India real power and recognition freedom enabling really representative Indians establish representative government with full powers assume responsibility defence country in effective collaboration other free and democratic countries resist aggressors. This represnts general view Indian Mussalmans also.

যুদ্ধের প্রয়োজনে ভালোভাবে দায়িত্ব পালন না করার জন্য ভারত সরকার সিন্ধু ও বাংলার মন্ত্রীসভার উপর অসন্তুষ্ট হন। সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী আল্লা বক্সকে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করা হয়। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে পদচ্যুত করার কথাও ভারত সরকার ভাবেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ মার্চ লিনলিথগো অ্যামেরীকে যে টেলিগ্রাম পাঠান তাতে এইসব তথ্য আছে।

১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২৯ মার্চ ফজলুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস যে নোট রচনা করেন তাতে আছে ফজলুল হক বর্তমানে ও ভবিষ্যতে জিন্নার বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জিন্নার নেতৃত্ব তিনি মেনে চলবেন, যদিও তাঁর সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য আছে। আর পাকিস্তান প্রস্তাব কার্যকারী করার জন্য ফজলুল হক চেষ্ট করবেন, যদিও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাব তিনি অপছন্দ করেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই তিনি চিন্তিত ছিলেন। পুনরায় ৩০ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ক্রিপস-হক সাক্ষাৎকার ঘটে। ফজলুল হক বলেন, ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পরিস্থিতি খারাপ নয়। অবশ্য যে-কোনো সময় তা পরিবর্তিত হতে পারে। এই সময়ে ফজলুল হকের সঙ্গে কয়েকজন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দেব যোগাযোগও হয়। ক্রিপসের এই রিপোর্ট পাঠ করে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন মনে আসবে, প্রচণ্ড জিন্না বিরোধী ফজলুল হক ক্রিপসের সঙ্গে এই ভাষায় কেন কথা বললেন? কারণ এক জটিল পরিস্থিরিত মধ্যে ফজলুল হককে কাজ করতে হয়। তাঁর পক্ষে মন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখা এক মস্তবড় সমস্যা ছিল। বিপদ কোন দিক থেকে আসবে সেবিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন। তাই তিনি ব্রিটিশ সরকার ও জিন্নাকে তাঁর কর্মপন্থা বুঝতে দিতে চাননি। এই অবস্থায় ফজলুল হক ক্রিপসকে এইসব কথা বলেন। ভারতের অচলাবস্থা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ক্রিপসকে ভারতে পাঠান। তিনি ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল মাসে এখানে থেকে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। কিন্তু কংগ্রেস, লিগ প্রভৃতি দল ক্রিপসের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। ক্রিপস এপ্রিল মাসে ভারত ত্যাগ করেন। ভারত তখন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। জাপান ভারতের দুয়ারে হানা দেওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার কোন আপোষ-মীমাংসা করতে রাজী হয়নি। এই অবস্থায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ওয়ার্ধাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করেন।১০ তাতে বলা হয়, ভারতের স্বার্থে ও পৃথিবীর স্বার্থে অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ, সামরিকবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং এক জাতি কর্তৃক অন্য জাতির উপরে আক্রমণ বিলুপ্ত করার জন্য ভারতের স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে বিপন্ন না করার নীতি অনুসরণ করেছে। কারণ কংগ্রেস আশা করেছিল যে, সরকার প্রকৃত ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট অর্পণ করে ভারতকে সমগ্র পৃথিবীতে মানবজাতির মুক্তি অর্জনে যোগ্য ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেবে। এও ভেবেছিল, সরকার এমন কিছু করবে না যাতে ভারতের উপর ব্রিটেনের আধিপত্য আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই আশা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ক্রিপস পরিকল্পনা থেকেই বোঝা যায় ভারত সম্পর্কে ব্রিটিশ মনোভাবের কোন পরিবর্তন হয়নি এবং ভারতের উপর ব্রিটিশ প্রভাব হ্রাস করারও কোন ইচ্ছা তাঁদের নেই। এই পরিস্থিতিতে দেশে হতাশা বিরাজ করছে। তারফলে জনসাধারণের মধ্যে একদিকে যেমন ক্রমান্বয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে শত্রুতার মনোভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে জাপানের সাফল্যে তাঁরা সন্তোষ প্রকাশ করে। ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে, জাপান বা অন্য কোন বৈদেশিক শক্তির আক্রমণ থেকে ভারতকে রক্ষা করতে হবে—তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলেই ভারতবাসীর পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। সুতরাং অবিলম্বে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। ভারতের জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে প্রভিশন্যাল গভর্নমেন্ট স্থাপন করবেন এবং তাঁরাই দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আর তাঁরা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। ওয়ার্কিং কমিটি এই প্রতিশ্রুতি দেয় যে, কংগ্রেস জাপান ও অন্যান্য শক্তির পরাজয়ের জন্য মিত্রশক্তিকে সর্বপ্রকারে সাহায্য করবে। এমনকী মিত্রশক্তির সৈন্যও ভারতে থাকতে দেবে। কাজেই কংগ্রেসের দ্বারা যুদ্ধ প্রচেষ্টা ব্যাহত হবার সম্ভাবনা নেই। তাই এই আবেদন যদি ব্যর্থ হয় তাহলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কংগ্রেস রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে সমস্ত অহিংস শক্তিকে ব্যবহার করতে বাধ্য হবে। অবশ্য সারা ভারত কংগ্রেস কমিটি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে এবং এই উদ্দেশ্যে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ৭ আগস্ট বোম্বেতে কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে। ১১

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক গৃহীত এই প্রস্তাব প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র দেশে এক নিদারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এবং সরকার ও জনসাধারণ উভয়েই এই প্রস্তাবকে ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) প্রস্তাররূপে অভিহিত করেন।১২ ইংরেজ শাসকেরা খুবই সতকর্তা অবলম্বন করেন। আমেরির সঙ্গে লিনলিথগো এবং লিনলিথগোর সঙ্গে প্রদেশের ইংরেজ গভর্ণরদের যেসব পত্রালাপ হয় তাতে তাঁদের মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। তাঁরা মুসলিম, মাদ্রাজের অ-ব্রাহ্মণ, শিখ ও তপশীল নেতৃবৃন্দকে ও অন্যান্য অকংগ্রেসী শক্তিকে সংঘবদ্ধ করে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের প্রভাব বিনষ্ট করতে চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্যসাধনে তাঁরা ওই সব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোপনে কর্থাবার্তা শুরু করেন। ১৩ এই বিষয়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই লিনলিথগো অ্যামেরিকে একটি টেলিগ্রামে জানান:

I have already taken this up. I am also telegraphing to Lumley, Herbert and Hope to suggest importance of getting Ambedker, Huq, Madras non-Brahmins and any other persons or parties who in fact disagree with Cogress policy and Gandhi’s views to say so publicly without delay, and will endeavour to organize best possible publicity if and when they do so. I recognise, and have so informed Governors, that this is a delicate matter in which we must walk circumspectly, but I have every confidence in their capacity to avoid embarrassing themselves or us. I have made a similar approach to Glancy as regards Sikhs and Sikander, and will consider what other opportunities of the same sort offer and follow them up.১৪

এমনভাবে ফজলুল হককে প্ররোচিত করার চেষ্টা হয় যাতে তিনি মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিবৃতি প্রকাশে উৎসাহিত হন। এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারকে নির্দেশ দেয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই লিনলিথগো বাংলাদেশের গভর্নর স্যার জন হার্বাটকে একটি টেলিগ্রামে জানান:

I think it is very important that we should so far as we tactfully and wisely can, try to mobilize opinion and encourage those parties and prominent individuals who do not in fact agree with Gandhi’s policy and the Congress resolution to say so in public and point out the inconsistencies and weaknesses in it. Jinnah has of course made his position clear on one or two occasions in the last month. It occurs to me that if Huq could at all tactfully be encouraged, on the assumption that he does not agree with Gandhi and the Congress, to say so in public, it might be of very considerable value. There is always the risk of our case being let go by default merely because prominent Indians and Indian parties,which do not accept the Congress point of view, are not prepared or fail to say so in public, thus leaving Congress undisputed domination of the field so far as the United States and even opinion at home is concerned. On the other hand I quite realise that this is a delicate business, needing the most careful handling, but I have every confidence in your skill and tact. It would of course be essential that any statement made should represent to a personal conviction and not bear any relation to a possible quid pro quo, for there could be no question of our considering a quid pro quo.১৫

স্যার হার্বাট ফজলুল হকের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু ফজলুল হক তাঁকে পরিষ্কার করেই জানিয়ে দেন যে, তাঁর পক্ষে কোন মতেই জিন্নার সঙ্গে মিলিত হয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা করা সম্ভব নয়। ২১ জুলাই (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) স্যার হার্বাট লিনলিথগোকে একটি টেলিগ্রামে সংবাদ পাঠান:

I have discussed the position with Huq and other leading Ministers. Huq’s attitude is not entirely satisfactory. Although he and other Ministers are inclined not to regard consequences of open movement as likely to be serious in Bengal, he feels diffident about making counter propaganda since he is unable at present to join forces with Jinnah in opposing Gandhi. That would not preclude declaration by him as Chief Minister and I hope to be able to persuade him.১৬

স্যার হার্বাট আশা করেন, তিনি ফজলুল হককে রাজি করাতে পারবেন। তিনি এও মনে করেন, প্রভাবশালী হিন্দুদের বিবৃতি ও ভাষণ এই কাজে সহায়ক হবে।১৭

অন্যদিকে জিন্না ও তাঁর সমর্থকেরা এবং তাঁদের অনুগামী মুসলিম প্রেস কংগ্রেসের প্রস্তাবের সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, এই প্রস্তাবে মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার কোনই ব্যবস্থা নেই। আম্বেদকর প্রকাশ্যেই একটি বিবৃতিতে বলেন, কংগ্রেসের প্রস্তাবকে প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক ভারতবাসীর বিরোধীতা করা উচিত। ২৩ জুলাই (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) আম্বেদকরের বিবৃতি উল্লেখ করে বোম্বের গভর্ণের লুমলি জানান:

Ambedker made a strong speech last night declaring civil disobedience at this time ‘treachery to India’ and ‘playing the enemy’s game’ and urging all Indians as a patriotic duty ‘to resist with all the power and resources at their command any attempt on the part of Congress to Launch civil disobedience.১৮

বিভিন্ন প্রদেশের আরও কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এই ধরনের বিবৃতি দেন।১৯

কিন্তু স্যার হার্বাট ফজলুল হকের আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করে ২৩ জুলাই (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) লিনলিথগোকে একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন:

I am sending you telegraphic reports at intervals regarding reactions to the Congress Working Committee’s resolution, but it may also be of interest to you to have a rather more detailed account of reaction of Ministers. I am not satisfied with Huq’s attitude. His ‘manifesto’ consists of a few sentences connected with the National War Front. I had a talk with him yesterday and he was inclined to dismiss the threat of an open Civil Disobedience movement as being unlikely to attain any success in Bengal. He remarked rather airily that the Muslim League and the Mahasabha ‘would be enough to deal with it.’ He also seemed reluctant to issue any statement, or to carry out any counter-propaganda against Gandhi’s movement, on the ground that his present relations with Jinnah made it difficult for him to identify himself with statements which Jinnah has already issued.২০

সুতরাং, এবারও ফজলুল হক মহাত্মা গান্ধি পরিচালিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোন বিবৃতি দিতে অস্বীকৃত হন।

১৪ জুলাই (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) প্রস্তাব গৃহীত হবার পরেই কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেসকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। গভর্নর জেনারেল ও তাঁর কাউন্সিলের সদস্যরা (মোদি, সুলতান আহমেদ, আনে, সরকার, ফিরোজখান নুন এবং বেনথাল) কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলন দমন করবার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করেন। অবশ্য সরকার কংগ্রেসের বোম্বাই অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা করে। ৭ আগস্ট (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) যথারীতি বোম্বেতে সারাভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশন বসে। ওয়ার্কিং কমিটি ‘ভারত ছাড়’ (Quit India) প্রস্তাব পেশ করে। প্রায় দু-দিন আলোচনার পর ৮ আগস্ট অপরাহ্ণে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।২১ তাতে বলা হয়, ব্রিটিশ সরকার যদি ভারতে শাসন ক্ষমতা ত্যাগের দাবি প্রত্যাখ্যান করে এবং অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে না নেয় তাহলে কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে এক ব্যাপক অহিংস সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হবে।২২ ব্রিটিশ সরকার আর কালক্ষেপ করেনি। ৯ আগস্ট সকালে মহাত্মা গান্ধীসহ অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। কংগ্রেস সংগঠনকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। সারা ভারতে কঠোর দমননীতি চালু করা হয়। তখন নেতৃত্বহীন জনসাধারণ সরকারের হিংস্র আক্রমণ সহিংস সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার মহাত্মা গান্ধীর শক্তি হ্রাসের জন্য জিন্নাকে ব্যবহার করে। সরকার ভেবেছিল, যদি ফজলুল হক জিন্নার সঙ্গে যুক্ত হয়ে মহাত্মা গান্ধীর বিরোধিতা করেন, তাহলে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেসের শক্তি সহজেই ক্ষুণ্ণ করা যায়। কিন্তু বারে বারে ফজলুল হক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ৮ আগস্ট ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব গৃহীত হবার পূর্বে লিনলিথগো অ্যামেরির নিকট টেলিগ্রাম করে জানান, ফজলুল হকের উপর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর এতটা প্রভাব রয়েছে যে বাংলা দেশের সরকার হয়তো এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করবেন। লিনলিথগো বলেন:

Herbert is not very certain of the attitude of Huq who under Shyama Prasad Mookherji’s influence shows signs of wobbling with the result that Bengal Government may be reluctant to take necessary action.২৩

উপরিউক্ত তথ্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ফজলুল হক ভারতের স্বাধীনতার দাবিতে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস পরিচালিত আন্দোলনের বিরুদ্ধে কোন কিছু করতে অসম্মত হন। তিনি জিন্নার মত ব্রিটিশ সরকারের হাতিয়ার হতে রাজি হননি। ফজলুল হকের এই মনোভাব দেখে ব্রিটিশ সরকার ও জিন্না যে খুবই উদবিগ্ন হন এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই ইংরেজ শাসকেরা তাঁকে মুসলিম জনসমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য নানাভাবে জিন্নাপন্থীদের সহায়তা করেন। অন্যদিকে জিন্নাও বাংলা দেশে তাঁর সমর্থকদের প্রাধান্য স্থাপনে আরও উদ্যোগী হন।

প্রশ্ন হল, ফজলুল হককে মুসলমান জনসমষ্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করা কেন সহজ হল? সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা ও ফজলুল হকের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সম্মত না হওয়ায় ফজলুল হককে মুসলিম লিগের ও সাহেবদের ভোটের উপর নির্ভর করে গোঁজামিল দিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করতে হয়। আর তাঁরা কখনই তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ-কর্ম করতে দেননি। প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। কোয়ালিশন দলের ইস্পাহানি-সুরাবর্দি গ্রুপ অকারণে বাঙালি হিন্দুদের উত্তেজিত করতে আরম্ভ করে। হোম মিনিস্টার নাজিমুদ্দিন বিধানসভায় যেভাবে সরকারি বক্তব্য পেশ করেন তাতে বিরোধী পক্ষের সদস্যদের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। সাহেবরা সরকারি পক্ষে ভোট দিলেও মাঝে মাঝে তাঁদের বক্তব্য ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে এবং তাঁরা বিভিন্ন পক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উস্কে দেন। মন্ত্রীসভার অভ্যন্তরে যে অংশ বাঙালিদের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল তাদের প্রভাব ততটা ছিল না। প্রথমে নৌশের আলি ও পরে নলিনীরঞ্জন সরকার মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় নেবার পর ফজলুল হক প্রায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। প্রকৃতপক্ষে জিন্নাপন্থী লিগ সদস্যরাই মন্ত্রীসভার পরিচালক হন। আর তাঁরা ফজলুল হককে নিজেদের গণ্ডীর মধ্যে টেনে নিয়ে এসে বাঙালির জাতীয় জীবনের মূল ধারা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে সচেষ্ট হন। হক-চরিত্রের দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁরা খুবই ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক ফজলুল হক’ হিন্দুদের আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হলে তাঁকে সামনে রেখেই বাংলাদেশে লিগের উদ্দেশ্য হাসিল করা সম্ভব হবে। এই সময়ে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে হক-লিগ মন্ত্রীসভার বিভিন্ন কার্যাবলীর তীব্র সমালোচনা করে। স্বভাবতই এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফজলুল হক মুসলিম-গরিষ্ঠ বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। আর ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক তাঁকেই মুসলিম লিগের রাজনৈতিক দাবি নিয়ে ওকালতি করতে হয়। নতুন শাসন ব্যবস্থার ফলে মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভের যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয় তাকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে যেমন সম্ভব ছিল না, তেমনি ভারতের অন্য কোন নেতার পক্ষেও তা অগ্রাহ্য করা অসম্ভব ছিল। বস্তুতঃ তাঁর পক্ষে লিগের দাবি অগ্রাহ্য করার কোন সঙ্গত কারণ ছিল না। তিনি ভেবেছিলেন, কৃষক-প্রজা সমিতির কর্মসূচি সামনে রেখে তিনি মুসলমানদের স্বার্থ ও সামগ্রিকভাবে বাঙালির স্বার্থ রক্ষা করতে সমর্থ হবেন। কিন্তু তাঁর এই আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।২৪

এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই অস্থিরচিত্ত-আবেগপ্রবণ ফজলুল হক নিজেও এরজন্য অনেকটা দায়ী ছিলেন। তিনি একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও সুবক্তা ছিলেন, অথচ তাঁর রসনা বড়োই আলগা ছিল।২৫ বিভিন্ন সময়ে তাঁর ভাষণে এমন সব শব্দ চয়ন করতেন অথবা মন্তব্য করতেন যারফলে অন্যেরা সহজেই তাঁকে ভুল বুঝতেন এবং অনেকেই তাঁর উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। ১৯৩৭–১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি যেসব ভাষণ দেন তা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে তিক্ততা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। এর মধ্যে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দেই তিনি প্রচণ্ডতার সঙ্গে কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা বিরোধী মনোভাব ব্যক্ত করেন। হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে এইসব ভাষণকে মনে হবে কথার ফুলঝুরি অথবা ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নীরব করে দেবার অহেতুক প্রচেষ্টা। তবুও এক জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এইসব ভাষণ তাঁর মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদারচেতা ব্যক্তি হলেও তাঁকে একজন সাম্প্রদায়িক নেতা বলেই মনে হয়। তাই হক-লিগ মন্ত্রীসভার প্রথম কয়েক বছরে বাঙালী ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক ফজলুল হকও ছিলেন। পরস্পর বিরোধী এই দুই উপকরণের এক অদ্ভুত ও জটিল সংমিশ্রণ তাঁর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। যিনি কৃষক-প্রজার দুরবস্থা লাঘবে প্রজাস্বত্ত্ব আইনের সংশোধন করছেন ও মহাজনদের সংযত করছেন, তিনিই আবার কলকাতা করপোরেশন, শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির জন্য এমন কয়েকটি ব্যবস্থা অবলম্বনে (পৃথক নির্বাচন প্রথার ব্যবস্থা করে কলকাতা করপোরেশনে মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান উপাচার্য নিয়োগ করা ও তথাকথিত হিন্দু ধর্মের প্রতীক চিহ্নসমূহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ থেকে দূর করা, মাধ্যমিক শিক্ষাকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বোর্ডের অধীনে আনার চেষ্টা করা এবং সরকারি পদে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসন বৃদ্ধি ইত্যাদি) উদ্যোগী হন তাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে তিনি ‘ভারতে মুসলমানেরা বিপন্ন’ এই জিগির তুলে সকল মুসলমানদের মুসলিম লিগের পতাকাতলে সমবেত হতে বলেন।২৬ এমন একটা সময়ে অনুন্নত মুসলমান সমাজের দায়িত্ব ফজলুল হককে গ্রহণ করতে হয় যখন জাতীয়তাবাদী স্বার্থের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক স্বার্থের সামঞ্জস্য বিধান করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তাই মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি যেসব বিধি-ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন তাতে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততাই শুধু বৃদ্ধি পায়। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, হক-চরিত্রে পরস্পর বিরোধী উপকরণের এক জটিল সংমিশ্রণ থাকায় তিনি নিজেরও অনেক ক্ষতি করেন, আর বাংলা দেশের স্বার্থও তাতে ক্ষুণ্ণ হয়।

গভীর পরিতাপের বিষয় হল এই যে, ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে যিনি রমেশচন্দ্র দত্তের মতবাদের দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতবাসীর দুঃখ-বেদনার মূল কারণ উপলব্ধি করেন ও সঠিকভাবে ব্রিটিশ শাসনের ভূমিকা বিশ্লেষণ করেন, তিনিই আবার ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম হান্টার রচিত The Indian Musalmans (প্রথম প্রকাশ ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ) নামক গ্রন্থের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হন।২৭ অবশ্য তখনও ব্রিটিশ শাসনের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি সচেতন থাকলেও স্যার উইলিয়াম হান্টারের মতবাদ তাঁর মনকে এতটা আচ্ছন্ন করে যে, তিনি মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে কোন সুস্পষ্ট জাতীয় লাইন অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন। স্যার হান্টার তাঁর গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ব্রিটিশ শাসনে বাংলাদেশের মুসলমানদের দুরবস্থার এক বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লেখেন, ইংরেজ শাসনের পূর্বে রাষ্ট্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পদেই মুসলমানেরা নিযুক্ত ছিলেন। ইংরেজ শাসনে হিন্দুরা নানা সুবিধা ভোগ করলেও মুসলমানদের দুরবস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে ও তাঁদের অনেক অভিযোগ জমে আছে। মুসলমানেরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন : তাঁদের সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ নেই, শিক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, ল অফিসারের পদ বিলোপ করায় সহস্র সহস্র পরিবারের জীবনে দুর্দশা নেমে এসেছে এবং ধর্ম-বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে তাঁদের আত্মাকে বিনাশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই মুসলমানেরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে হিন্দুদের সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পাচ্ছে।২৮ স্যার হান্টার বিশদভাবে মুসলমানদের দুরবস্থা আলোচনা করে মন্তব্য করেন:

In a word, the Indian Musalmans arraign the British Government for its want of sympathy, for its want of magnanimity, for its mean malversation of their funds, and for great public wrongs spread over a period of one hundred years.২৯

স্যার হান্টার লেখেন, সমস্ত সরকারি সুযোগসুবিধা হিন্দুদের করায়ত্ত হওয়ায় শিক্ষিত মুসলমানেরা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু চিরকাল কি হিন্দুরা মুসলমানদের তুলনায় বেশি যোগ্য ও দক্ষ ছিলেন? এই প্রশ্ন উত্থাপন করে স্যার হান্টার লেখেন, প্রকৃত ঘটনা হল এই যে যখন ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন শৌর্যে-বীর্যে ও দেশ শাসনে মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত ছিলেন। তথাপি বর্তমানে মুসলমানেরা সরকারি ও বেসরকারি পদে কোথাও উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত নেই। স্যার হান্টার লেখেন:

Is it that the Hindus have all along been better men than the Musalmans, and only required a fair field in order to outstrip them in the race? Or is it that the Musalmans have so many careers open to them in non-official life that they are indifferent to Government employment, and leave the Hindus to walk over the course? The Hindu has unquestionably a high order of intellect; but an universal and immeasureable superiority on the part of the Hindus, such as would be required to explain their monopoly of official preferment, is unknown at the present day, and is in direct contradiction to their past history. The truth is, that when the country passed under our rule, the Musalmans were the superior race, and superior not only in stoutness of heart and strength of arm, but in power of political organization, and in the science of practical government. Yet the Muhammadans are now shut out equally from Government employ and from the higher occupations of non-official life.৩০

এইসব উক্তি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, স্যার হান্টার অতিসূক্ষ্মভাবে হিন্দু-মুসলমানকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। অথচ ফজলুল হক এইসব মনোভাবের দ্বারা এতটা প্রভাবান্বিত হন যে, ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল কলকাতার মহম্মদ আলি পার্কে জিন্নার সভাপতিত্বে মুসলিম লিগের যে স্পেশাল অধিবেশন হয় তার অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি যে ভাষণ দেন তাতে স্যার হান্টারের উক্তির প্রতিধবনি করেন। স্যার হান্টারের গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি সহযোগে ফজলুল হক মুসলমানদের দুরবস্থা আলোচনা করেন।৩১ ফজলুল হক বলেন, পলাশির যুদ্ধের পর থেকেই ইংরেজ শাসন মুসলমানদের উপর নানা কম্যুনাল এওয়ার্ডেও মুসলমানদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। তা ছাড়া কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে মুসলমানেরা নির্যাতিত হচ্ছেন। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা মুসলমানদের আশা-আকাঙক্ষা পর্যুদস্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই অবস্থায় যদি পানিপথের ও থানেশ্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটে তবে মুসলমানেরা নিশ্চয়ই তাঁদের পূর্বপুরুষদের মতো গৌরবজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন।৩২ তাঁর ভাষণ থেকে কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হল:

Gentlemen, we are passing through times which are extremely critical for the Muslims of India. On one side we find the Congress with all its might, organisation and resources, determined to crush and subdue the Muslims and on the other side we find the Hindu Mahasabha with all its communal bigotry, characteristic intolerance, narrow political outlook, and unholy intentions, devoting its energies to the frustration of Muslim hopes and the suppression of the legitimate rights and liberties of the Muslim Community. …It is our incumbent duty to bear constantly in mind that in India we hold the integrity and safety of Islam as a sacred trust. We are born unto these traditions inherited from generation to generation, and the sacred duty to protect Islam and uphold its traditions devolves upon us as a heritage from our forbears… After all, the British came to India as traders and as traders they are now anxious to remain. They would sooner part with power than with trade. They believe that their commercial interests will be best served through an alliance with the Congress and therefore they are anxious for that alliance. Their guarantees to the minorities and particularly to the Muslims of India have proved to be shallow through and through. The sooner we cease to rely on them the better. We must fight the battle of Islam alone and with our own resources. Let us resolve to fight it to the bitter end, relying on the justice of our cause and undaunted by the gathering forces against us. Let us prepare to fight, if need be, on a double front and with our backs to the wall. If Panipat and Thaneswar must repeat themselves let the Muslims prepare to give as glorious and account of themselves as did their forbears… May the all-merciful God guide these deliberations on the right lines and may your decisions bring nearer the day of Islam’s deliverance in India.৩৩

একই ভাষণে ফজলুল হক বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার সঙ্গে কংগ্রেস শাসিত মন্ত্রীসভার কার্যাবলীর তুলনা করে বলেন, বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বজায় রাখতে পেরেছে, আর কংগ্রেস শাসিত প্রদেশের মুসলমানেরা অত্যাচারিত হচ্ছেন। বাংলাদেশে কৃষক-প্রজার দুরবস্থা লাঘবে কয়েকটি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে, আর বিহারের কৃষকদের বেদনার বোঝা লাঘব করবার জন্য বিশেষ কিছুই করা হয়নি। অথচ কংগ্রেস জোর গলায় বলে থাকে তারা নাকি কৃষকের বন্ধু।৩৪ প্রসঙ্গত ফজলুল হক একথাও ঘোষণা করেন যে, সম্মানজনক শর্তে কংগ্রেসের সঙ্গে তিনি একযোগে কাজ করতে প্রস্তুত আছেন। তিনি যেসব সর্তের কথা উল্লেখ করেন, তা হল:

১ কংগ্রেসকে মুসলিম লিগের সঙ্গে সম্মানজনক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন প্রদেশে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করতে হবে।

২ সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এবং মুসলমানদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে লিগের সঙ্গে সম্মানজনক চুক্তি করতে হবে।

৩ পাঞ্জাবে শাহিদগঞ্জ প্রশ্ন নিয়ে মুসলমান ও শিখদের মধ্যে যে বিরোধ চলছে তারও মীমাংসার জন্য কংগ্রেসকে মধ্যস্থতা করতে হবে।৩৫

এইসব কথা বলে ফজলুল হক মন্তব্য করেন যে, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলতে পারেন যে কংগ্রেসের কাছ থেকে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার আশা করা দুরাশা মাত্র। এক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে যদি নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হয় তাহলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি কয়েকমাস ধরে কংগ্রেস বারে বারে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করে তাঁর সঙ্গে কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা গঠন করার জন্য অনুরোধ করছে। তিনি সম্মত হলে এমন একটি মন্ত্রীসভা গঠিত হতে পারে যার ফলে তিনি দীর্ঘকাল মুখ্যমন্ত্রীর পদে বহাল থাকতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত হলে মুসলিম স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। উপরিউক্ত শর্ত গ্রহণ করার পরই তাঁর পক্ষে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করা সম্ভব। তার পূর্বে নয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৭ এপ্রিল ফজলুল হক এই মনোভাব ব্যক্ত করেন।৩৬ দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে (১৮ এপ্রিল) তাঁর ভাষণে আরও উগ্রতা প্রকাশ পায়। তিনি বলেন:

The League is not yet propertly organised, yet it is worth hundreds of National Congresses. Each and every one of the League is a lion and a tigher ready to shed the last drop of his blood for the sake of Islam.৩৭

তখন থেকেই তাঁর রসনা এতটা আলগা হয়ে পড়ে যে ‘সাতানা বত্তৃতায়’ তিনি ঘোষণা করেন, অন্য প্রদেশে মুসলমানদের উপর কোন অত্যাচার হলে বাংলাদেশে তাঁর প্রতিহিংসা নেওয়া হবে।৩৮ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর পাটনায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন্যাল কনফারেন্সে সভাপতিরূপে ফজলুল হক মুসলিম শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক সুচিন্তিত মন্তব্য করেও হিন্দির পরিবর্তে যখন উর্দু ভাষাকে লিংগোঅ্যা ফ্রাংক্যা (lingua franca) করতে বলেন তখন তাঁর সংকীর্ণ চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়।৩৯ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ অক্টোবর করাচিতে সিন্ধু প্রদেশ মুসলিম লিগ অধিবেশন উপলক্ষ্যে তিনি যে ভাষণ দেন তাতেও ইসলামের স্বার্থ রক্ষার কথাই উল্লেখ করেন।৪০ এইসব ভাষণ বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় তখন ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মসূচি থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন। আরও বলিষ্ঠতার সঙ্গে সেই কর্মসূচিকে কোন পথে একটি জাতীয় কর্মসূচিতে পরিণত করা যায় সে কথা না ভেবে তিনি এমনভাবে মুসলিম স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করেন যারফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হলেন জিন্না ও তাঁর সমর্থকেরা। পরবর্তীকালে যখন তিনি এইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি ভুলতে চেষ্টা করেন, তখন কিন্তু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল তাঁকে আর তা ভুলতে দেননি। তাঁরা বারে বারে কলকাতা স্পেশ্যাল সেশনের ও সাতানা বত্তৃতার কথা উল্লেখ করে ফজলুল হককে সাম্প্রদায়িক ফজলুল হকরূপে সমালোচনা করেন।৪১ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে সমস্ত ঘটনা এত দ্রুত পরিবর্তিত হয় যে, দ্বিতীয়বার মন্ত্রীসভা গঠন করে একটি সঠিক পথে চলার চেষ্টা করেও প্রতিকূল পরিবেশের জন্য তাঁর সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

অবশ্য পূর্ব বঙ্গের জমি জিন্নার প্রচারের পক্ষে খুবই উর্বর ছিল। ওখানকার জমিদার-মহাজনদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু, আর প্রজাদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। তা ছাড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বলতে যাঁদের বোঝাতো তাঁদের একটি বৃহৎ অংশ ছিলেন হিন্দু। তাই অনগ্রসর, আর্থিক অনটনে নিমজ্জিত মুসলমানদের ধর্মের নামে উত্তেজিত করা সহজ হয়। একই সঙ্গে জিন্না কলকাতা ও তার আশে-পাশে শিল্পাঞ্চলে অবাঙালি মুসলমান ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানদের মুসলিম লিগের পতাকাতলে সমবেত করার জন্য তৎপর হন। হিন্দু আধিপত্য থেকে মুসলমানদের মুক্তির একমাত্র পথ হল মুসলিম লিগকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা। জিন্নার এই প্রচারে জমিদার-মহাজন ও শিক্ষিত মুসলমানেরা খুবই আকৃষ্ট হন। এঁরাই বাংলার মুসলিম লিগের নেতৃত্বপদে আসীন হন এবং গ্রামবাংলার সাধারণ মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক মনোভাবে আচ্ছন্ন করে তোলেন। আর এইভাবেই মুসলিম লিগের গণভিত্তি দৃঢ়তর হয়। অন্যদিকে কংগ্রেস অনগ্রসর মুসলমানদের অবস্থা উন্নয়নে কোনো কর্মসূচী গ্রহণ করে তা কার্যকারী করতে পারেনি। আর কৃষি সংস্কারের দাবিতে কোন সার্থক গণআন্দোলন পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়। তার ফলে কংগ্রেস শিক্ষিত মুসলমান ও মুসলমান কৃষকদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তা ছাড়া কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হিন্দু, আবার এই নেতাদের একটি অংশ জমিদার-মহাজন শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। স্বভাবতই জিন্নাপন্থীদের পক্ষে এই প্রচার করাও সহজ হয় যে, কংগ্রেস হিন্দুদের প্রতিষ্ঠান। গ্রামবাংলার ও শহরাঞ্চলের মুসলমান সমাজ কংগ্রেস থেকে দূরে সরে থাকে। কংগ্রেসকে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠানরূপে গ্রহণ করতে পারেননি। অবশ্য বাংলার মুসলমানদের প্রধান অংশ থেকে কংগ্রেস বহুদিন থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা দূর করতে বাস্তবমুখী কোনো পরিকল্পনা কংগ্রেসের না থাকায় বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিষ ঢেলে দেওয়া জিন্নার পক্ষে সহজ হয়।

এইভাবে মুসলিম লিগ যখন প্রভাব বৃদ্ধি করতে থাকে তখন ফজলুল হক উদবিগ্ন হন। তিনি শুধু মন্ত্রিত্ব বজায় রাখার কথাই চিন্তা করেননি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন যে, জিন্নার নীতিকে পরাস্ত করতে না পারলে বাঙালির জাতীয় সত্তা সমূলে ধবংসপ্রাপ্ত হবে। তাই বাংলাদেশে মুসলিম লিগের প্রভাব হ্রাস করার জন্য তিনি উদ্যোগী হন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথাবার্তা চালান। তিনি বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে বারে বারে অনুরোধ করেন তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে। বাংলার বিধানসভায় কংগ্রেস দুটি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। বেঙ্গল কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু। আর কংগ্রেস অ্যাসেম্বলি পার্টির নেতা ছিলেন কিরণশঙ্কর রায়। সুভাষচন্দ্র বসু ও শরৎচন্দ্র বসুকে ফজলুল হক খুবই শ্রদ্ধা করতেন। অনেক বিষয়েই ফজলুল হক তাঁদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। আবার এই দু-জন নেতাও ফজলুল হককে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন। অন্যদিকে কিরণশঙ্কর রায়ের সঙ্গেও ফজলুল হকের সম্পর্ক ভালো ছিল।৪২ তাই মিলিত প্রচেষ্টার পথে বিশেষ কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তা ছাড়া হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে ফজলুল হকের অন্তরঙ্গতাও এই উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের চাপে বাংলার কংগ্রেস এই আবেদনে সাড়া দেননি। তাঁরা ফজলুল হকের উপর আস্থা স্থাপন করতে পারেননি। বাংলার দুর্ভাগ্য তখনকার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ফজলুল হকের মনোভাবকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। শুধু তাই নয়। বাংলার কংগ্রেস নেতারা একথাও বোঝার চেষ্টা করেননি যে, পাকিস্তান দাবির তাত্ত্বিক নেতারা সবাই ছিলেন অবাঙালি এবং জিন্না হক-বিরোধী শক্তিকে সংহত করে বাংলাদেশে এই প্রস্তাবের পক্ষে জনমত গড়ে তুলছেন। সুতরাং, এই অবস্থায় বাংলার কংগ্রেসের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নীতির ফলে তা তাঁরা পালন করতে পারেননি। স্বভাবতই কয়েকটি প্রশ্ন মনে আসবে, বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বভারতীয় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রকৃত ভূমিকা কি ছিল? তাঁরা কি বাংলার কংগ্রেসকে আসন্ন দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান দাবিকে প্রতিহত করার আর কি কোনো বাস্তব পরিকল্পনা কংগ্রেসের ছিল? আর তা কি ফজলুল হকের নেতৃত্ব অস্বীকার করে রূপায়িত করা সম্ভব ছিল? কংগ্রেসের কার্যবিবরণী থেকে এইসব প্রশ্নের কোনো স্বচ্ছ উত্তর পাওয়া বেশ কষ্টকর। সম্প্রতি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বিশদ আলোচনার মধ্যে না গিয়েও যে উক্তি করেছেন, তা এখানে উল্লেখ করা হল:

But inspite of occasional lapses, in words more than in deeds, Fazlul Huq was least influenced by a communal spirit. He made sincere attempts to make a political truce with the Congress but his offer was rejected. In the worst days of communal riots in Bengal he proposed to Jinnah that the Muslim League should take the initiative in an attempt to come to terms with the Congress… It is difficult to refute the charge that from the beginning to end the interests of Bengal were sacrificed at the altar of the All-India policy of the Congress and Muslim League.৪৩

প্রথমবার যখন ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন অর্থাৎ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে, তখন ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা দমনে ফজলুল হক জিন্নার নিকট প্রস্তাব করেন যে, এই গুরুতর সমস্যা সমাধানে মুসলিম লিগের উদ্যোগী হওয়া উচিত এবং কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ মীমাংসার জন্য উপায় উদ্ভাবন করা উচিত। জিন্না ফজলুল হককে বলেন, মুসলমানদের অসুবিধায় ফেলে নিজেদের দাবি মেনে নেওয়ানোর জন্য কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ দিচ্ছে। এই অবস্থায় কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা লিগের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। তখনও হক-জিন্না বিরোধ দেখা দেয়নি। তাই ফজলুল হক জিন্নার সঙ্গে একমত না হলেও এই বিষয় নিয়ে কোনো প্রকাশ্য সংঘর্ষে অবতীর্ণ হননি। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর তিনি দ্বিতীয়বার মন্ত্রীসভা গঠন করার পর থেকে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে এক নতুন পর্যায় শুরু হয়। ফজলুল হক পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গর্জন করে ওঠেন। যদি বাংলাদেশে কংগ্রেস ফজলুল হকের নেতৃত্বে মুসলিম লিগ বিরোধী জাতীয় মোর্চা গঠন করত এবং শাসনতন্ত্রের সীমিত ক্ষমতার মধ্যে বাংলার জনসাধারণের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য কয়েকটি বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য ধরনের হত। আর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত গোটা ভারতের সাম্প্রদায়িক ঘুর্ণি ঝড়কে পূর্বাঞ্চলে ঠেকাতে পারতো। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নির্বাচনের পরই কংগ্রেসের এই পথ নির্ধারণ করা উচিত ছিল। তাহলে প্রথম মন্ত্রীসভার আমলে মুসলিম লিগ ফজলুল হককে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতো না।৪৪ জিন্না তখন ফজলুল হকের প্রয়োজনীয়তা খুবই উপলব্ধি করেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে লিগের প্রাধান্য স্থাপন করতে হলে এই ছাড়া অন্য কোনো পথ তাঁর কাছে খোলা ছিল না। অন্যদিকে কংগ্রেস বাংলার ঘটনাবলিকে এই দিক থেকে বিশ্লেষণ করে কোনো সঠিক পথ গ্রহণ করতে পারেনি। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত হল এই, প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বার্থের কথা না ভেবে সর্বভারতীয় নীতি দ্বারা পরিচালিত হন। এইভাবে সর্বভারতীয় নীতির যূপকাষ্ঠে বাঙালির স্বার্থকে বলি দেওয়া হয়।

ফজলুল হকের বারে বারে মনে হয়েছে, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাঙালির স্বার্থকে গুরুত্ব না দিয়ে, প্রাদেশিক নেতৃত্বের মতামত অগ্রাহ্য করে, তাঁদের সিদ্ধান্তসমূহ চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন। এই ব্যবস্থাকে তিনি কখনোই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মনে করেননি। তিনি অভিযোগ করেন, জিন্না সুচতুরভাবে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করেন। তাঁর মতে, প্রদেশের সমস্যা সম্পর্কে প্রাদেশিক নেতৃত্বের মতামত অনুযায়ী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি একটি উল্লেখযোগ্য ভাষণে ফজলুল হক জিন্নার স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের নিন্দা করে মন্তব্য করেন:

It is not the Ministers functioning under the Government of India Act that are ruling Bengal, but it is the autocracy of Mr. Jinnah which guides the administration. And Mr. Jinnah is exercising all this authority without being hampered by any responsibility to anybody. All this may be a very clever imitation of Congress methods and very flattering to Congress-minded people, but it is not democracy. In the case of the Congress the mandates used to come from Wardha; in the case of the Muslim League the mandates come from Malabar Hill.৪৫

ভাবতে অবাক লাগে তখনই ফজলুল হক ‘মুক্ত বাংলার’ স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর কল্পিত বঙ্গদেশে প্রকৃত ক্ষমতা বাঙালিদের হাতে থাকবে এবং বাঙালিদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের দেশ শাসন করবেন, বিদেশিদের দ্বারা মনোনীত মন্ত্রীরা নন। তিনি বলেন, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের শাসনতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে কোনো ক্ষমতাই ভারতীয়দের দেয়নি। এই শাসনতন্ত্র অনুযায়ী একজন মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। কারণ একজন মুখমন্ত্রী ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক প্রশংসিত অনুগত পুতুল’ মাত্র। তিনি বিশ্বাস করতেন না দেশের স্বাধীনতা দান-সামগ্রী হিসেবে আসবে অথবা এর জন্য ভারতীয়দের কোনো রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। তাঁর মতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনিচ্ছুক হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হলে মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে প্রতিটি ভারতবাসীর ঐক্যবদ্ধ হওয়া কর্তব্য, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য নিজেদের নিয়োজিত করা উচিত। প্রসঙ্গত তিনি দরিদ্র ও পদানত মানুষের জন্য চিত্তরঞ্জন দাশের আত্মত্যাগের কথা বাঙালিদের স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদের উদ্দেশ্য করে ফজলুল হক বলেন:

…They had no right to take the name of Mr. C. R. Das unless they were prepared to undergo sacrifice and suffering for the cause of the downtrodden and the poor just as Mr. Das did, and fight for better days to come.

চিত্তরঞ্জনের অষ্টাদশ মৃত্যু দিবস উদযাপন সভায় ফজলুল হক তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই মন্তব্য করেন।৪৬

ফজলুল হক উপলব্ধি করেন, মুসলিম লিগের বিজয়কেতন বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে অন্যত্র মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ধীরে ধীরে উড়তে শুরু করবে। কারণ এই প্রদেশেই মুসলমানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। স্বভাবতই তার প্রভাব অন্যত্রও পড়তে বাধ্য। আবার এই বাংলাদেশেই যদি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রেখে জনমত গঠন করে ‘মুক্ত বাংলা’ গঠন করা যায় তবে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পাকিস্তান দাবি পর্যুদস্ত করা সম্ভব। কারণ উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে সীমান্ত গান্ধী ও জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের প্রভাব তখনও ছিল। তিনি এই দিক থেকে বাংলার জাতীয় সমস্যা বিশ্লেষণ করেন। ফজলুল হকের আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না তা পরবর্তীকালের ঘটনাবলি থেকেই প্রমাণিত হয়। এই বাংলাদেশেই মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভা জিন্নার পাকিস্তান দাবিকে কার্যকারী করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। আর কোনো প্রদেশে মুসলিম লিগ যেমন ক্ষমতায় ছিল না, তেমনি তার প্রভাবও এতটা ছিল না। বাংলাদেশে জিন্নার সাফল্য পাকিস্তান নামক পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সম্ভবপর করে তোলে।

তথ্যসূত্র

Mansergh (Ed.), Transfer, Vol. I, pp. 65–66.

Ibid, pp. 28–29.

Ibid, pp. 293–294.

Ibid, pp. 361–362.

Ibid, pp. 398–399.

Ibid, p. 521.

Ibid, p. 531.

Ibid, p. 553.

Interview with Wazir Ali and Yusuf Ali.

১০ Mansergh (Ed.), Transfer, Vol. II ‘Quit Inida.’, pp. 385–387. Vide Resolution of the Congress Working Committee, Wardha, 14 July, 1942.

১১ Ibid.

১২ Azad, Maulana Abul Kalam, India Wins Freedom, Calcutta, 1959, p. 80.

১৩ Mansergh (Ed.), Transfer, Vol. II, pp. 396–401.

১৪ Ibid, p. 401.

১৫ Ibid, pp. 396–397.

১৬ Ibid, p. 436.

১৭ Ibid.

১৮ Ibid.

১৯ Ibid, pp. 405-409.

২০ Ibid, pp. 439–440.

২১ Azad, India Wins, p. 83.

২২ Ibid, PP. 238–242. Vide Quit India Resolution.

২৩ Mansergh (Ed.), Transfer, Vol. II, pp. 616–617.

২৪ Biswas, Jukta Banglar, pp. 327–331.

২৫ Ibid, pp. 336–337.

২৬ Ibid, pp. 314, 332; Speech delivered by A. K. Fazlul Huq as Chairman of the Reception Committee of the special session of the Muslim League held at the Mohammed Ali Park, Calcutta, on 17 April, 1938. Vide Amrita Bazar Patrika, 18 April, 1938; Broomfield, J. H., Elite Conflict in a Plural Society: Twentieth-century Bengal, Bombay, 1968, pp. 293–297.

২৭ Hunter, W, W,. The Indian Musalmans, Calcutta [Year?]

২৮ Ibid, pp. 139 – 141, 149, 158–159, 161.

২৯ Ibid, p. 141.

৩০ Ibid, pp. 162–163.

৩১ Speech delivered by Fazlul Huq at Calcutta on 17 April 1938. Vide Amrita Bazar Patrika, 18 April 1938.

৩২ Ibid.

৩৩ Ibid.

৩৪ Ibid.

৩৫ Ibid.

৩৬ Ibid.

৩৭ Amrita Bazar Patrika, 19 April, 1938.

৩৮ Biswas, Jukta Banglar, p. 332.

৩৯ Speech delivered by A. K. Fazlul Huq as the President of the Fifty-first session of the All-India Muslim Educational Conference held at Patna on 1 October, 1938, Vide Amrita Bazar Patrika, 2 October, 1938.

৪০ Speech delivered by A. K. Fazlul Huq as the Sind League Conference held at Karachi on 8 October, 1938, Vide Amrita Bazar Patrika, 2 October, 1938.

৪১ Biswas, Jukta Banglar, p, 332.

৪২ Ibid, PP. 315–316, 356; Speech delivered by A. K. Fazlul Huq at Netaji Bhawan, Calcutta, dated 3 May, 1954. Vide Ananda Bazar Patrika, 4 May, 1954.

৪৩ Majumdar (Ed.), Struggle, P. 579.

৪৪ Lahiri, Pravas Chandra, Pak-Bharater Ruparekha, In Bengali, Nadiya, Bhadra 1375, pp. 327–328.

৪৫ Ibid, pp. 578–579; Vide also Bengal Legislative Assembly Proceedings, Eighteenth Session, 1944, Vol. LXVII–No, 2, p. 208.

৪৬ The Statesman, 29 April and 17 June, 1943.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *